#গোধূলি_বেলায়
#পর্ব_15
আনন্দি আরও বেশী মিষ্টতা গলায় ঢেলে প্রচন্ড শান্ত গলায় বলল, মজা করো না সমাপ্ত আমি মজা করার মুডে নেই।
– মজা করছি না আনন্দি। আমি সিরিয়াস।
– ওহ্ তা আমার দোষটা কি? কোন প্রকার চাঞ্চল্য ছাড়াই বলল কথাটা
সমাপ্ত আচমকা তাকাল আনন্দির দিকে। আনন্দির চোখের দিকে তাকিয়ে ওর মনের মধ্যে কি চলছে তা বোঝার চেষ্টা করল। কিন্তু আনন্দির চোখ দুটো স্থির এবং প্রচন্ড রকমের শান্ত। ওর চোখের দিকে তাকিয়ে কিছুই বুঝতে পারল না সমাপ্ত।
তাই দ্বিধাগ্রস্ত কন্ঠে বলল, না তোমার কোন দোষ নেই। সমস্যা আমার আমি থাকতে পারছি না তোমার সাথে।
আনন্দি একই ভঙ্গিতে বলল, এটাও তো আমার দোষ।
– কেন? কিভাবে?
– আমার মধ্যে নিশ্চয় কোন কিছুর অভাব আছে তাই তুমি আমার সাথে থাকতে পারছ না।
– না এমন কিছু না।
– তাহলে ডিভোর্স চাও কেন ?
সমাপ্তর মন এখন প্রচন্ড বিক্ষিপ্ত। ও এই কথাগুলো বলার আগে যেমন পরিস্থিতি হবে ভেবেছিল তার কোনটাই হলো না।
স্বাভাবিকভাবে এমন পরিস্থিতিতে আনন্দির চেচানো উচিত। চিৎকার করে সমাপ্তকে অভিসাপ দেওয়া উচিত। এই কাজগুলো আনন্দি করলে সমাপ্তর বাকি কথাগুলো বলতে বেশ সুবিধা হত।
কিন্তু আনন্দি এসব না করাতে সমাপ্ত প্রচন্ড দ্বিধান্বিত। আনন্দির এই ভালমানুষির সমানে সমাপ্ত পারছে না ওর এই কঠিন কথাগুলো বলতে।
– এতো সংকোচ বোধ করার কোন দরকার নেই। ডিভোর্স চাওয়ার মতো এতো বড় কথা যখন বলতে পেরেছ আর আমি চুপ করে তা হজম করতে পেরেছি তাহলে তোমার আর কোন কথাতেই আমার কোন প্রতিক্রিয়া হবে না বলে আশা করি।
ভাবলেসহীন ভাবে কথাগুলো বলল আনন্দি।
সমাপ্ত আবারও চমকালো। যতোটা মানসিক শক্তি নিয়ে ও কথাগুলো বলা শুরু করেছিল তার সিকিভাগও আর উপস্থিত থাকল না ওর মাঝে। আনন্দির কাঠ কাঠ কথাগুলো যেন সমাপ্তরে পুরো নাড়িয়ে দিয়েছে। আমতা আমতা করো বলল,
– আমি একটা মেয়েকে ভালবাসি। বেশি দিন আগে থেকে না। এই জবটা পাওয়ার পর। মেয়েটা আমার অফিসেই জব করে। আমার ডিপাটমেন্টে। খুব ভাল মেয়ে, সুন্দরী স্মার্ট, হাটাচলা কথা বলা সবই অসাধারণ। একদেখাতেই মেয়েটার প্রেমে গেছিলাম কিন্তু এতোদিন চুপ ছিলাম। পরে জানতে পারলাম মেয়েটাও আমাকে পছন্দ করে। আমাদের সবকিছু মিলে যায়, একদম পারফেক্ট মেয়ে যাকে বলে,, আমি চেয়েও ওর থেকে দুরে থাকতে পারি না।
কথাগুলো বলে সমাপ্ত আবারও আনন্দির দিকে তাকালো। আনন্দি তখন আনুসমিকে বুকের সাথে লেপ্টে রেখে সমাপ্তর দিকে তাকিয়ে আছে। ওর দুই চোখ উপচে পানি আসতে চাইছে কিন্তু বের হতে দিল না আনন্দি। কিছুটা সময় চুপ মেরে থাকল। কান্নাটাকে মনে মনে গিলে নিয়ে ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায় বলল, ওহ্ ভাল তা আনুসমির কি হবে কিছু ভেবেছ ?
– আমি টিয়াকে আমার অতীতের কথা বলেছি। টিয়া আনুসমির দ্বায়িত্ব নিতে রাজী আছে। ও আনুসমির দেখাশোনা করতে পারবে আমার ভরসা আছে ওর উপর। তুমি কি বল।
– ওহ্ মেয়েটার নাম বুঝি টিয়া?
সমাপ্ত কোন উত্তর দিল না। আনন্দি কিছু সময় চুপ থেকে আবার বলল, আমি যদি আনুসমিকে আমার সাথে নিতে চাই দেবে আমাকে?
এবার সমাপ্ত নড়ে উঠল। এটা কিছুতেই করতে পারবে না ও। আনন্দির চোখের দিকে স্থির হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল। একসময় এই চোখের দিকে তাকালে একটা মায়া খুজে পেত সমাপ্ত। তবে আজ সেটা পাচ্ছে না। কেন পাচ্ছে না না কি ভাল করে খুজে দেখছে না সমাপ্ত।
কিছুটা সময় পর গলায় বেশ জোর এনে সমাপ্ত বলল,
– নাহ্। তুমি জানো আনুসমি আমার প্রাণ, ওকে ছাড়া আমি বাঁচবো না। তুমি তো জানো আনুসমি আসার পর আমার কি পরির্বতন হয়েছে। সবটাই আনুসমির জন্য, ওকে নিয়ে যেও না প্লিজ। বাকি তুমি যতো টাকা চাও আমি দিবো। তুমি চাইলে তোমার সারাজীবনের ভরন পোষনের দ্বায়িত্ব আমি নিব।
– আমাকে এতোটাও ছোট ভাবার কারনটা কি ?
– মানে?কি বলতে চাইছ তুমি?
– কিছুই না। শুধু এটুকুই বলব আমি অনেক আগে থেকেই জানতাম এমন একটা দিনের সম্মুখীন আমাকে একদিন না একদিন হতে হবে। কোনদিনও তুমি আমাকে তোমার বউ হিসেবে মানবে না তা আমি জানতাম তাই তার পরিণতি সম্পর্কেও আমার ধারনা ছিল। তাই নিজেকে প্রথম থেকেই সেভাবে প্রস্তুত করেছি আমি। আমি নিজেই নিজের দ্বায়িত্ব নিতে পারব। অন্ততঃ এটুকু যোগ্যতা আমার আছে।
সমাপ্ত কোন কথা বলল না। আনন্দি আবারও বলল, কবে চাও ডিভোর্স? যেটা হবে সেটা তাড়াতাড়ি হয়ে যাওয়াই ভাল। দেরী করে লাভ কি।
সমাপ্ত চমকালো। ও কখনও ভাবে নি আনন্দি এতো অল্পতে সব কিছু মেনে নেবে। ভেবেছিল আনন্দি চেচাবে ঝগড়া করবে ওর সাথে। হয়তো চেচিয়ে পুরো বাড়ি মাথায় করত তারপর একটা খুব বড় ধরনের ঝগড়া হতো ওদের মধ্যে তারপর ডিভোর্স। কিন্তু পুরো বিষয়টাই এতো স্মুথলি হল যে এটা ঠিক হজম হলো না সমাপ্তর । আনন্দির এভাবে সবটা চুপচাপ মেনে নেওয়াটা বেশ ভাবাচ্ছে সমাপ্তকে।
পরে জানাবে বলে অফিসের জন্য বেড়িয়ে গেল সমাপ্ত। আনন্দি কিছু সময় সমাপ্তর যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে থাকল তারপর ধীর পায়ে গিয়ে দড়জাটা চাপিয়ে দিল।
এতোক্ষনের আটকে রাখা কান্নাটা এবারে বেড়িয়ে আসল। আনুসমিকে বিছানায় বসিয়ে রেখে বেশ অনেকটা সময় কাঁদল ও। চিৎকার করে কাদতে ইচ্ছা করছিল কিন্তু পারল না কারন চিৎকার করে কাদলে বাড়ির সবাই জেনে যাবে তাই শুধু নিরবে চোখের পানি ফেলল।
এরপরের ঘটনাগুলো বেশ দ্রুত ঘটল। আনন্দি আর সমাপ্ত দুজনে মিলে গিয়ে কোর্টে ডিভোর্সের কেস ফাইল করে আসল। কিন্তু কোর্ট থেকে এতো তাড়াতাড়ি ডিভোর্সের কার্যক্রম শেষ হলো না। কোর্ট ওদের তিন মাস সময় দিয়েছে। এই তিন মাসে যদি ওরা চায় তো কেসটা উঠিয়ে নিতে পারে। আর যদি এই তিন মাসে কেউই কেসটা না উঠায় তাহলে কোর্ট থেকে দুজনের ঠিকানায় একটা করে নোটিশ যাবে এবং ফাইনালী ডিভোর্সটা হয়ে যাবে।
ওদের ডিভোর্সের কথা বাড়িতে জানার পর সবাই বেশ অবাক হয়। পুরো বিষয়টাই আনন্দি একা হাতে সামলে নিয়েছে। সবাইকে ভাল ভাবে বুঝিয়েছে যেন ওদের ডিভোর্সে কেউ বাধা না দেয়। এমন কি সমাপ্তর সাথে যেন সেই মেয়েটার বিয়ে হয় সেই ব্যবস্থাও আনন্দি নিজে করে।
এটা সমাপ্ত প্রতি ওর কৃতজ্ঞতার বহিঃপ্রকাশ। ওর মনে হয় একদিন যখন ওর সমাপ্তর হাতটা খুব গভীর ভাবে প্রয়োজন ছিল সেদিন অনিচ্ছা সত্তেও সমাপ্ত হাতটা ধরেছিল। খুব শক্ত করে ধরেছিল আর জীবন যুদ্ধে ওকে জয়ী করেছিল। আজ ওর সময় এসেছে সেই প্রতিদান ফিরিয়ে দেওয়ার। আজ সমাপ্তর প্রয়োজনে ওকে সেই হাতটা ছাড়তেই হবে।
আর এমন ভাবে ছাড়বে ও যেন এই হাতটার দ্বায়িত্ব অন্য কেই নিয়ে নেয় খুব তাড়াতাড়ি।
আনন্দি তারপর থেকেই একটা চাকরির জন্য চেষ্টা করতে থাকে। রেজাল্ট ভাল থাকায় একটা বাচ্চাদের স্কুলে সাময়িকভাবে পড়ানোর সুযোগ পেয়ে যায় আনন্দি। না হলে এই বাজারে এটা একটা মেয়ের চাকরি পাওয়া আর চাকরি পেয়ে নিজেকে সারভাইব করা সহজ বিষয় না।
চাকরিটা পাওয়ার পর পরই বাড়ি ছাড়ে আনন্দি। একটা ছোট্ট বাসা ভাড়া নেয় নিজের আর আনুসমির জন্য। আনুসমিকে সাথে নিয়েই আসে। সমাপ্ত বাধা দিলে বলে যেদিন কোর্ট থেকে আনুসমিকে তোমার দ্বায়িত্বে দিয়ে দেওয়া হবে সেদিন এসে নিয়ে যেও আনুসমিকে তার আগে আমি ওকে কাছ ছাড়া করব না।
সমাপ্ত কোর্টে আনুসমির কার্সটেডির জন্য কেস করেছিল। আনন্দি তার বিপক্ষে কোন কেস করে নি কারন ও জানত নিয়ম অনুযায়ী বাচ্চাদের ওদের বাবার দ্বায়িত্বে দেওয়া হয়।
আর সেটা যদি নাও হয় তাহলেও সমাপ্ত আনুসমিকে যে পরিমাণ ভালবাসে তাতে প্রচুর টাকা খরচ করে আনুসমিকে ঠিক নিজের কাছে নিয়ে যেত।
আনন্দি এতো টাকা কোথায় পাবে! তাই বিনা যুদ্ধে হার মেনে নিয়েছে। কিন্তু আল্লাহর উপর থেকে বিশ্বাস হারায় নি। প্রত্যেকবার নামাজে ও আল্লাহ্কে বলত, আল্লাহ এমন কোন চমৎকার করে দিন যেন আমার এই বাচ্চা মেয়েটা আমার কাছেই থাকে। ও ছাড়া যে এই পুরো পৃথিবীটাতে আমার আর কেই নেয়।
আল্লাহ্ বোধহয় এই বিষয়টাতে আনন্দির সহায় ছিলেন। আনন্দি চলে আসার পর যেন আর তর সইছিল না সমাপ্তর। তাই ওদের পুরোপুরি ডিভোর্স হওয়ার আগেই বিয়ে করে নতুন বউ ঘরে তোলে সমাপ্ত। আনন্দির এতে কোন সমস্যা ছিল না। এটা হওয়ার ছিল দুই দিন আগে না হয় দুইদিন পরে।
বিয়ের পর বেশ সুখে দিন কাটছিল সমাপ্তর। নতুন বউ বেশ মনের মতো তাই মন যেন ঘরেই পরে থাকত সবসময়। নতুন বউ নিয়ে সমাপ্ত এতোটাই ব্যস্ত থাকত যে আনন্দির কথা ভাবার জন্য এতোটুকুও সময় পেত না সমাপ্ত।
আর যে মেয়েটা সারাদিন চোখের সামনে থাকার পরও তার কষ্টে যখন কোন দিন মনে মধ্যে কোন আলোড়ন সৃষ্টি হয় নি সমাপ্তর আজ তো সে চোখের আড়ালে।
কথায় আছে, চোখের আড়াল তো মনের আড়াল। কথাটা যেন পুক্ষানুপুক্ষ ভাবে মিলে গেল সমাপ্তর সাথে । চোখের আড়াল হতেই ওর মনে আর কোন কিছু অবশিষ্ট থাকল না আনন্দির জন্য । আজ ওর সবটা জুরে শুধু টিয়ার বসবাস।
কিন্তু বিপত্তি বাধল তখন যখন টিয়া সাফ ভাবে জানিয়ে দিল যে ও সমাপ্তর আগের মেয়ে মানে আনুসমির কোন দ্বায়িত নিতে পারবে না। এখানে ও সংসার করতে এসেছে কারও বাচ্চা পালন করতে না।
সমাপ্ত কিছুটা ভাঙ্গল। আনুসমি ওর জীবনে সব এটা টিয়া খুব ভাল করে জানে। তবুও একটা সময় খুব বড় বড় কিছু প্রতিশ্রুতি দিয়ে আজ কেন ও এমনটা করল তা সমাপ্ত জানে না। কিন্তু কিছু করার নেয়। টিয়া এখন ওর বিয়ে করা বউ। আর আনুসমিকে যদি জোর করে নিয়েও আসে তাহলে যে ওর মেয়েটা বেশ সুখে থাকবে না তা সমাপ্ত ভাল করে জানে।
অনেকটা ভাবার পর সমাপ্ত একটা সিধান্তে উপনিত হল। ও ওদের ডিভোর্সের কেস থেকে আনুসমির কার্সটেডির কেসটা উঠিয়ে নিল।
যথা সময়ে ওদের ডিভোর্সটা হয়ে গেল। সমাপ্ত আনুসমির উপর থেকে সব অধিকার ছেড়ে দেওয়ায় আনুসমির কার্সটেডি আনন্দি পেল। আনন্দি যেন হাপ ছেড়ে বাঁচল।
সমাপ্ত চলে যাওয়ার পর আনুসমি হচ্ছে ওর বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন। এই বিশাল পৃথিবীতে আনুসমি ছাড়া যে আনন্দির আর কেউ নেয়। এটা মানুষটা খুব ভাল করে জানত তবুও এভাবে একা করে দিল ওকে। একটা সময় ভরা সংসার ছিল আনন্দির আজ ভাগ্যের ফেরে সে সবই মরিচীকায় পরিণত হয়েছে।
আনন্দির নাকি খুব মায়া কাড়া দুটো চোখ আছে। আজ পর্যন্ত ওই চোখের মায়াতে ওনেকেই আটকেছে কিন্তু আসল মানুষটাকেই ও কোনদিন ওর মায়াতে আটকাতে পারল না। সারাটা জীবন মানুষটা ওর ধরা ছোয়ার বাইরেই থেকে গেল।
আজ আনন্দির নিজের নামটা নিয়েও একটা দীর্ঘশ্বাস এলো। ওর নাম আনন্দি কিন্তু সেই ছোট থেকে দুঃখ ছাড়া জীবনে আর কিছু পেয়েছে কি না সন্দেহ। পেয়েছে তবে সেটা এতোটাই ক্ষণস্থায়ী যে তা গুনে রাখা দুষ্কর।
সেই ছোট্ট বেলায় মায়ের মৃত্যু দিয়ে শুরু তারপর একের পয এক দুঃখ ওকে গ্রাস করে গেছে। যেন পৃথিবীর সকল মানুষকে সুখে রেখে তাদের সবার দুঃখ গুলো ভোগ করার পার্টটাইম জব নিয়েছে ও। নিজের নামটাই যেন ওর সাথে সারাজীবন ধরে উপহাস করে গেল।
জীবনটা আজও ওর কাছে বড়া দুর্বোধ্য। জীবনটা ওর কাছে শুধু এক সর্বনাশা নদীর মতো যে শুধু সব কিছু গ্রাস করে নিজের মধ্যে পুসে রাখতে ভালবাসে
চলবে,,,,
জাকিয়া সুলতানা
বি দ্রঃ ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। ধন্যবাদ