ঘূনপোকা পর্ব ৩

#ঘুনপোকা

৩.

– চারদিন পর বাবা আমাকে বললো, আজ বিকেলে মেয়ে দেখতে যাবো। বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম,

– মেয়ের বাড়ির লোকজন জানে আমার ডিভোর্স হয়েছে ?

বাবা বললো,

– হ্যাঁ জানে। জেনেই রাজি হয়েছে। ওদের মেয়েরও সমস্যা আছে৷
– কি সমস্যা?
– ক্লাস নাইনে পড়া অবস্থায় মেয়েটা বাসা থেকে পালিয়ে গিয়েছিলো ওর প্রেমিকের সাথে। আগেরদিন বিকেলে পালিয়ে গেলো পরদিন রাতে একাই ফিরে আসলো। পুরো এলাকা জানাজানি হয়ে গিয়েছিলো মেয়ে বাসা থেকে পালিয়েছে৷ লোকে অনেক আজেবাজে কথা বলতো ওকে নিয়ে। কয়েকদিন বাদেই ওর বাবা স্ট্রোক করলো৷ অসুস্থ ছিলো অনেক দিন। মুখটা বেঁকে গিয়েছিলো। একটা হাত প্যারালাইজড ছিলো প্রায় দেড় বছরের মত। হাত এরপর ঠিক হয়ে গেলেও মুখটা এখনো পুরোপুরি ঠিক হয়নি৷ কথায় সামান্য জড়তা আছে৷
– মেয়ের বাবা কি তোমার পরিচিত?
– হ্যাঁ। আমার অফিসের কলিগ ছিলো। সুন্দর একটা সম্পর্ক ছিলো উনার সাথে। এখনো আছে। মাঝেমধ্যে দেখা সাক্ষাৎ করি।
– আচ্ছা বাবা, মেয়েটা ফিরে এলো কেন?
– কেন ফিরে এসেছে সেটা স্পষ্ট কেউই জানে না। মেয়েটা কখনো বলেনি।
– এখন কি করে সে?
– মাস্টার্সে ভর্তি হয়েছে দু’মাস হলো।
– নাম কি ওর?
– রুপন্তি। মেয়েটা খুব ভালো। আমার খুব পছন্দের। তোর মায়েরও ভীষণ পছন্দ৷ খুব সাংসারিক আর সরল মনের। কখনো কোনো কিছু নিয়ে অভিযোগ করে না। যে যা বলে হাসিমুখে চুপচাপ শুনে চলে আসে। এমন মেয়ের সাথে যেকোনো ছেলে আজনম সংসার করতে পারবে নির্দ্বিধায়।

বাবার এই কথাগুলো আমার মাথায় গেঁথে গেলো। এমন মেয়েই আমার দরকার। নবনীকে দেখিয়ে দেয়ার জন্য এই মেয়েটাই প্রয়োজন। আমার দোষ ত্রুটি যাই থাকুক চুপচাপ সংসার করে যাবে। সেদিন বিকেলে আমি আর আমার ফ্যামিলি গেলাম ওদের বাসায়। দোতলা পুরাতন একটা বাড়ি। রুপন্তীর দাদার আমলের তৈরী করা৷ বাড়ির সামনে ছোট্ট এক টুকরো উঠান। নিচতলায় থাকতো রুপন্তির ফুফুরা আর উপরতলায় রুপন্তিরা। ঘরভরা মানুষ ছিলো সেদিন। রুপন্তির ফুফুর ফ্যামিলি, ওর মামা খালারা সবাই ছিলো। বাসায় যাওয়ার পর একে একে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলো আমাকে। এত লোকজন দেখে সেই মুহূর্তে আমার মনে হচ্ছিলো আমি মেয়ে দেখতে আসিনি, বিয়ে করতে এসেছি। আর রুপন্তির নিজের ফ্যামিলি খুব বড় না। আমাদের মতই ছোটখাটো। রুপন্তির মা নেই। ও জন্ম নেয়ার সময়ই মারা গিয়েছিলেন৷ ওর একটা বড় ভাই আছে যে বয়সে রুপন্তির চেয়ে অনেক বড়। কমপক্ষে ১৬-১৭ বছর তো হবেই। ওর সংসারে আরো দুজন মেম্বার হলো ভাইয়ের বউ আর ভাইয়ের একটা ছেলে রাহাত। রুপন্তির মা মারা যাওয়ার মাস ছয়েক পরেই ছেলেকে বিয়ে দিয়ে দেন আমার শ্বশুর। ওর বড় ভাই আর ভাবী ওকে নিজের সন্তানের মতই আগলে রাখতো। রাহাত আর রুপন্তির বয়সের পার্থক্য খুব বেশি না। চার বছরের ছোটবড়। কি যে সখ্যতা ওদের দুজনের! একদম বন্ধু……

মোবাইলে কল এসেছে সৈকতের। গল্প থামিয়ে কল রিসিভ করলো সে৷ কয়েক সেকেন্ড পর কল কেটে ইমরানকে বললো,

– নিচে ডেলিভারি ম্যান দাঁড়িয়ে আছে৷ এই টাকাটা নাও। পার্সেল নিয়ে টাকাটা দিয়ে আসো ওর হাতে।

হাত বাড়িয়ে সৈকতের কাছ থেকে টাকা নিয়ে রুম ছেড়ে ইমরান বেড়িয়ে গেলো। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো সৈকত৷ রুমের একপাশে থাকা পারটেক্স বোর্ডের মাঝারি আলমারির শেষ তাক থেকে থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট, গেঞ্জি আর ছোট্ট তয়লা বের করে ওয়াশরুমে চলে গেলো সে। গায়ের শার্টটা খুলে বেসিনের আয়নার সামনে দাঁড়ালো সৈকত৷ নিজেকে খুব মনোযোগে একবার দেখে নিচ্ছে। চেহারায় একরাশ ক্লান্তি লেপ্টে আছে। চোখের নিচের কালচে দাগগুলো আগের চেয়ে আরো একটু গাড় হয়েছে৷ ট্যাপ ছেড়ে হাত ভিজিয়ে চুলগুলোতে রাখতেই চোখে পড়লো হাতের নখগুলো বেশ বড় হয়ে গেছে। হঠাৎই থমকে গেলো সৈকত৷ রুপন্তি এসে স্মৃতির দোরগোড়ায় কড়া নাড়ছে। সে এই হালে দেখলে হয়তো নেইলকাটার এনে নখগুলো সযত্নে কেটে দিতো। চোখের নিচের কালো দাগ দূর করতে আলুর রস লাগিয়ে দিতো। ক্লান্ত চেহারা দেখা মাত্রই বড় একমগ ভর্তি ঠান্ডা লেবুর শরবত হাতে ধরিয়ে বলতো,

– তোমাকে কি ক্লান্ত দেখাচ্ছে! শরবতটা খাও। লেবু চিনির সাথে আমার এত্তগুলা ভালোবাসাও মিশিয়েছি শরবতে৷ মুহূর্তেই এসব ক্লান্তি-টান্তি ভ্যানিশ হয়ে যাবে।

বুকচিরে লম্বা এক দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো সৈকতের। অদ্ভুত এক শূন্যতা গ্রাস করে নিচ্ছে তাকে। দম বন্ধ হয়ে আসা অনুভূতি৷ সেই অনুভূতির খবর রুপন্তি জানে না৷ সেই যন্ত্রণায় তাকে কতটা ছটফট করতে হচ্ছে তাও রুপন্তির অজানা৷ রুপন্তি জানতে চায় না সেসব৷ কেন জানতে চায় না রুপন্তি? এসব ভাবতেই চোয়াল শক্ত হয়ে আসে সৈকতের। রাগ হচ্ছে তার। ভীষণ রাগ৷ চোখজোড়া ঝাপসা হয়ে আসছে নোনাজলে। ট্যাপ থেকে পানি পড়ছে। দু হাত আঁজলা করে পানি নিয়ে চোখে মুখে ছিটিয়ে দিচ্ছে সে।

পুরো অফিসজুড়ে দুজন পিয়ন ছাড়া আর কেউই নেই৷ পিয়ন দুজন এখানেই থাকে সবসময়৷খাবার টেবিলের উপর রেখে ইমরান অপেক্ষা করছে সৈকতের জন্য৷ এই প্রথম সে অফিসে রাত কাটাবে। তাও আবার বিনাকাজে। গল্প শোনার লোভে হুট করেই রাতে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো। এখন মনে হচ্ছে ভুল হয়েছে। সারাদিন এই কাপড় পড়ে কাটিয়েছে। রাতটাও এটা গায়ে দিয়েই কাটাতে হবে। রাতে একবার গোসল করার অভ্যাস। আজ আর রাতে গোসলটাও করা হবে না। এসব ভাবতেই অস্বস্তি হচ্ছে খুব।

– ভ্রু কুঁচকে কি ভাবছো ইমরান?
– আপনি এই কাপড় পেলেন কোথায়?
– এখানে আমার দুই তিন সেট কাপড় রেখে দেই৷ হুটহাট অফিসে থাকার সিদ্ধান্ত নেই। কাপড় চোপড় সাথে থাকলে একদিকে খুব সুবিধা৷ ফ্রেশ হয়ে নরমাল কাপড় পরে রাত কাটানো যায়।
– আমার বাসা কাছেই। ১০ মিনিটের পথ৷ আমি তো ভাবছি বাসা থেকে ড্রেস চেঞ্জ করে আসবো কি না৷
– তাহলে এক কাজ করো, খাবারটুকু খেয়ে বাসায় চলে যাও৷ আজ আর আসার প্রয়োজন নেই। আরেকদিন নাহয় গল্প শোনাবে৷
– না, না৷ আমি আজই শুনবো৷
– তাহলে বাসায় যেতে হবে না৷ আমার গেঞ্জি পরে নাও। ফ্রেশ হয়ে আসো। ডিনারটা করে নেই৷ এরপর নাহয় আস্তে ধীরে গল্প শোনাবো৷

~চলবে~

#মিম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here