ঘূনপোকা পর্ব ৫

#ঘুণপোকা
#পর্ব_৫

উল্টোহাতে মুখ চেপে হাসছে ইমরান। মাথা নিচু করে হাসছে সৈকতও। খানিক সময় বাদে হাসি থামিয়ে ইমরান বললো,

– এতটুকু শুনে মনে হচ্ছে উনার সাথে কাটানো সময়গুলো খুব মজার ছিলো। তাই না?
– উহুম। এত জলদি গল্প নিয়ে ভবিষ্যৎ বাণী দেয়া ঠিক না। গল্পের মাঝামাঝি তো আসতে দাও৷

চুপ করে রইলো ইমরান। পরবর্তী অংশটুকু শোনার জন্য তাকিয়ে রইলো সৈকতের দিকে। দু’হাত মাথার পিছনে রেখে হেলান দিয়ে বসলো সৈকত। এক পায়ের উপর আরেক পা তুলে আয়েশ করে বসলো। নিজের অতীতে আবারো ডুব দিলো সে৷

– আমি বসেই রইলাম। রুপুকে নিয়ে এটা ওটা ভাবতে থাকলাম। এরমাঝে রুপু ফ্রেশ হয়ে এসে ড্রেসিং টেবিলের সামনে এসে বসলো৷ আয়নায় রুপুকে দেখা যাচ্ছিলো। আমি আয়নার দিকে তাকিয়ে রুপুকে দেখছিলাম। ও খুব যত্ন করে চুলগুলো আঁচড়াচ্ছিলো আর গুনগুন করে গান গাচ্ছিলো। ও এই বাড়িতে নতুন বউ হয়ে এসেছে ওকে দেখে বুঝাই যাচ্ছিলো না। মনে হচ্ছিলো এটা ওরই ঘর। আর আমি এমন চুপচাপ বসে ছিলাম যে কেউ দেখলে হয়তো ভাবতো এটা আমার শ্বশুরবাড়ি। আমি এই বাড়ির নতুন জামাই৷ তাই লজ্জায় চুপ করে বসে আছি।
– আপনি চুপ হয়ে ছিলেন কেন? ভাবীর কথা শুনে?
– হ্যাঁ। ও অস্বাভাবিক রকমে স্বাভাবিক আচরন করছিলো৷ তার উপর তখন কি সব বলে ফেললো না? আমি আসলে একদম বোকা বনে গিয়েছিলাম ওর কথায় আর আচরণে। কি করবো বা কি বলবো বুঝে পাচ্ছিলাম না।
– সারারাত কি ওভাবেই পার করেছেন নাকি কথা বলার মত কিছু খুঁজে পেয়েছিলেন?
– রুপন্তি তোমার পাশে বসে থাকবে আর তুমি চুপচাপ থাকবে এটা অসম্ভব। কথা তোমাকে বলতে হবেই৷ আমি আয়নায় তাকিয়ে ওকে দেখছি এটা ও খেয়াল করলো। ভ্রু জোড়া নাচিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করলো,

– কি দেখছেন? হুম? আমার চুল দেখছেন?
আমি উত্তর দিবো ঠিক তখনই ও আমাকে থামিয়ে নিজেই বললো,

– দূর থেকে বসে কি দেখছেন? কাছে আসুন। আমার হাত থেকে চিরুনিটা নিয়ে চুলগুলো আঁচড়ে দিন। এক কাজে তিন কাজ হবে। এক, আমার চুলগুলো আঁচড়ানো হবে। দুই, এই বাহানায় আমার চুলগুলো একটু ছুঁয়ে দেখতে পারবেন। তিন, কাছাকাছি বসে আমাদের একটু সময়ও কাটানো হবে।
– চুল আঁচড়ে দিয়েছিলেন?
– উহুম।
– কেন? সুন্দর একটা মুহূর্ত কাটাতে পারতেন। আমি তো বলবো আপনার ওয়াইফ খুবই রোমান্টিক।
– আমার তখন মনে হচ্ছিলো আমি একটা পাগল ঘরে তুলে এনেছি৷ সদ্য বিয়ে করা বউকে যখন তুমি পাগল হিসেবে আবিষ্কার করবে তখন আর এই জগত সংসার তোমার ভালো লাগবে না৷ রসে টইটম্বুর কথাবার্তাও মনে হবে তেঁতো বিষ। তারপর শোনো কি হলো, আমাকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে রুপু আমাকে জিজ্ঞেস করলো,

– আপনি কি লজ্জা পাচ্ছেন? আমার কাছে কিসের লজ্জা বলুন তো? আমি তো আপনার বউ। বিয়ে করা আপন বউ৷ লজ্জা টজ্জা ঝেড়ে ফেলুন তো।
– ঠিকই তো বলেছে। লজ্জা পেয়ে লাভ কি?
– আমি কি লজ্জা পাচ্ছিলাম? না তো। আমি রুপুকে নিয়ে খুব দ্বিধায় পড়ে গিয়েছিলাম। আমি যেমন ভেবেছিলাম রুপু যে তেমন না সেটা বুঝতেই পারছিলাম৷ এমনটা তো আমি আশা করিনি৷ আমার প্রয়োজন ছিলো একদম চুপচাপ শান্ত নিরীহ একটা মানুষ যে কখনোই কোনোকিছুতে অভিযোগ করবে না। রুপু মনে যা আসে তাই বলে দেয়। এই ধরনের মানুষ কখনোই চুপচাপ সহ্য করার মত না। পান থেকে চুন খসলেই আমার সাথে ঝামেলা বাঁধিয়ে ফেলবে। নিজেকে বিশাল অপরাধী মনে হচ্ছিলো। বাবা মায়ের কথা চুপচাপ মেনে নিয়ে নিজের জীবন ধ্বংস করা অপরাধী৷ মনে মনে বারবার একই প্রশ্ন করতে থাকলাম, আমি তো বাবা মায়ের অবাধ্য ছেলে। তাহলে আজ কেন বাধ্য হতে গেলাম?
– তারপর?
– রুপু চুলগুলো পাঞ্চক্লিপে আটকে বিছানায় এসে শুয়ে পড়লো। খাটের মাঝে কোলবালিশ দিয়ে বললো,

– আপনি তো লজ্জা পাচ্ছেন তাই মাঝে বালিশ দিয়ে দিলাম। কাপড় পাল্টে ঘুমিয়ে পড়ুন। গুড নাইট।

মুখে উপর ওড়না দিয়ে ঢেকে রুপু শুয়ে রইলো। আর আমি ওড়নায় ঢাকা রুপুর দিকে তাকিয়ে রইলাম৷ ওকে ডেকে আমার খুব জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হচ্ছিলো,

– তুমি তো মোটেও শান্ত না। চুপচাপও না৷ তাহলে বিকেলে ওরকম ঢঙ করলে কেন? এতবড় ভাওতাবাজি কেন করলে রুপন্তি?

– দোষ কিন্তু একতরফা দিয়ে দিলেন।

ভ্রু কুঁচকে ইমরানকে সৈকত জিজ্ঞেস করলো,

– একতরফা? বুঝলাম না ঠিক।
– হুম, একতরফাই তো। উনি নাহয় ঢঙ করেছে, আপনিও তো মেয়েকে না জেনে বুঝেই বিয়ে করে ফেললেন।
– হ্যাঁ সে হিসেবে বলতে পারো দোষটা আমি একতরফাই দিয়েছিলাম।
– সে রাতে ঘুম হয়েছিলো?
– শেষরাতের দিকে ঘুম এসেছিলো৷
– ঘুমানোর আগ পর্যন্ত কি এসবই ভাবছিলেন?
– উহুম, শুধু রুপুর অদ্ভুত আচরন নিয়ে না৷ আরো কিছু ব্যাপার নিয়ে ভাবছিলাম। ও আমাকে গিফট করেছে অথচ আমি ওকে কিছুই গিফট করিনি। ওকে কিছু গিফট করতে হবে বা করা উচিত এই ব্যাপারটা আমার মাথায় একদমই আসেনি। ব্যাপারটা আমার জন্য বেশ লজ্জাজনক ছিলো৷ ক্ষণে ক্ষণে মাথায় খোঁচাচ্ছিলো। তাছাড়া হুট করে বিয়ে শাদী হয়েছে অফিসের কাউকেই জানানো হয়নি৷ পরদিন সকালেই অফিস ছিলো। ছুটিও নেয়া হয়নি৷ ভাবলাম পরদিন মিষ্টি নিয়ে যাবো অফিসে। সবাইকে খবরটা জানাবো৷ শনি আর রবিবার দুদিন অফিসে যাবো। ইম্পরট্যান্ট কিছু কাজ ছিলো সেগুলো সেড়ে বাসায় থাকবো সপ্তাহখানেক। বাসায় বসে রুপন্তি নামক এই অদ্ভুত মেয়েটাকে জানবো, বুঝবো। আর সবচেয়ে বড় ভাবনা হলো কাল সকালেই সাবিহার কাছ থেকে আমাদের বিয়ের ছবি নিয়ে প্রোফাইল পিকচার চেইঞ্জ করবো এবং সেই ছবি কোনো না কোনোভাবে নবনীর ইনবক্সে পাঠানোর ব্যবস্থা করবো।
– বিয়েটা তো তাহলে একরকম জেদের বশেই করেছিলেন।
– একরকম না৷ পুরোটাই ছিলো জেদের বশে। নবনীকে আমি দেখিয়ে ছাড়বো এটা একদম মনে গেঁথে গিয়েছিলো৷ আমার কাঁধে দোষ চাপিয়ে ও অন্য কারো সাথে হাসিখুশি জীবন পার করবে এটা আমার সহ্য হচ্ছিল না৷ আমি ওকে দেখাতে চাচ্ছিলাম তোমাকে ছাড়া আমিও ভালো থাকতে পারি৷ বিবাহিত জীবন আমিও সুন্দর করতে জানি। আমার বউ আমাকে পেয়ে খুশিতে আটখানা হয়ে সংসার করছে৷
– জেদের বশে আর যাই হোক সংসার সুখের হওয়ার কথা না সৈকত ভাইয়া।
– সুখী হতে পেরেছি কি পারিনি সে প্রসঙ্গে পরে আসবো৷ আগে গল্প শোনো, তারপর নাহয় পরিণতি নিয়ে ভেবো৷
– হুম, হুম। আপনি বলুন না!
– পরদিন সকালে আমার ঘুম কিভাবে ভেঙেছিলো জানো?
– কিভাবে?
– রুপু আমার চোখের পাতা টেনে ধরে আমাকে ঘুম থেকে জাগিয়েছিলো। ঘড়িতে তখন বাজে ছয়টা পনেরো। ঘুমিয়েছি সাড়ে তিনটার দিকে। ছয়টা বাজেই সে আমাকে এমন আজব কায়দায় ঘুম থেকে উঠালো। আমার ঘুম ভাঙতেই দেখতে পেলাম সামনের সব কয়টা দাঁত বের করে হাসছে। কি যে বিদঘুটে লাগছিলো ওর হাসিটা!
– কেন? দাঁত সুন্দর না?
– আরেহ্ না। দাঁত সুন্দর ছিলো। অসময়ে আরামের ঘুম কেউ ভেঙে দেয়ার পর তখন নিশ্চয়ই সেই ব্যক্তির হাসি তোমার অসহ্য লাগবে। তাই না?
– হ্যাঁ, তা তো লাগবেই।
– আমারও লেগেছিলো। ঘুম ভাঙিয়ে রুপু আমাকে বললো,

জরুরী দুইটা কথা বলার জন্য আপনাকে ঘুম থেকে জাগিয়েছি। এক, আমি আপনাকে আজ থেকে তুমি করে বলবো৷ আর দুই, আপনাকে আজ থেকে আমি সিকু বলে ডাকবো। সৈকতরে শর্টফর্ম হচ্ছে সিকু। সিসিমপুর শো হয় না টিভিতে? ঐ শো তে একটা ক্যারেক্টারের নাম হচ্ছে সিকু৷ ওখান থেকেই ইন্সপায়ার হয়ে আপনার এই নামটা ঠিক করেছি। সুন্দর না?

নাক কুঁচকে এলো ইমরানের। বললো,

– সিকু! ভাবী আপনাকে সিকু বলে ডাকে?
– হ্যাঁ, সিকু। মাত্র একরাতের ব্যবধানে আমি সৈকত থেকে সিকু হয়ে গেলাম। আমার ৩২ বছরের পুরোনো নামটার করুণ দশা হয়ে গেলো।

শব্দ করে হাসছে ইমরান। ইমরান সৈকতকে জিজ্ঞেস করলো,

– নিজের এমন অদ্ভুত নাম শুনে আগেরদিনের মত মনে মনে ও খোদা বলে চিৎকার করেননি?

হেসে ফেললো সৈকত৷ সিগারেটের প্যাকেট থেকে আরো একটা সিগারেট বের করে বললো,

– সিকু নামটা নিয়ে তখন এতটাও ভাবিনি। যে ব্যাপারটা মাথায় হাতুরিপেটা করছিলো সেটা হচ্ছে রুপন্তি খুবই বিশ্রিভাবে আমার ঘুম ভেঙে দিয়েছে। খুব ইচ্ছে হচ্ছিল ওকে বকা দেই৷ কিন্তু দেইনি৷ নিজেকে কন্ট্রোল করে নিলাম। ও নতুন এসেছে এই বাসায়, ধমক দেয়া ঠিক হবে না৷ আমি শুধু শান্ত কন্ঠে বললাম, আমি আটটা পর্যন্ত ঘুমাবো। আমাকে যেনো ডাকাডাকি না করা হয়।
– ঘুমাতে দিয়েছিলো আপনাকে? মনে তো হয় না!
– বাহ্! এত জলদি রুপুকে বুঝে ফেললে!
– সত্যিই ঘুমাতে দেয়নি?
– না৷ সামান্য আওয়াজে আমার ঘুম ভেঙে যাওয়ার সমস্যা আছে। ও একটু পরপরই দরজা খুলে রুমে আসছে আর যাচ্ছে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছে, শব্দ করে হাসছে। খাটে এসে কিছুক্ষন পরপরই ধুপ করে বসছে। মানে ঘরের ভিতর কিছু না কিছু আওয়াজ সে করেই যাচ্ছে। আমি চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর ভান ধরে পড়ে রইলাম। জানতাম আমাকে সজাগ দেখলেই কথা বলা শুরু করবে। বেশি মেজাজ খারাপ হলে আমি চুপ হয়ে যাই জানোই তো। কেন হই জানো?
– কেন?
– উল্টাপাল্টা কিছু যেন না বলি সেজন্য। আমি চাচ্ছিলাম না ওকে আজেবাজে কিছু শোনাতে। ও আমার সাথে তখন কথা বলতে আসলেই নির্ঘাৎ কিছু না কিছু শুনিয়ে দিতাম। বিয়ের পরদিন সকালেই আমি রুপন্তিকে নিয়ে ভাবতেই হাঁপিয়ে গেলাম। এত অস্থির একটা মেয়ে! একজায়গায় বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারে না৷ অকারণে এখান থেকে সেখানে আসা যাওয়া চলতেই থাকে। আর অদ্ভুত কথাবার্তা তো আছেই। এমন একটা মেয়ের সাথে আমি সংসার কিভাবে করবো সেসব ভাবতেই আমার দম আটকে আসছিলো৷

আঙুলের ভাঁজে থাকা সিগারেটটা ঠোঁটের ভাঁজে নিয়ে আগুন ধরালো সৈকত। প্রথম টান দিয়ে মুখ থেকে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে সৈকত বললো,

– এই লাইটারটা রুপন্তির দেয়া। যত্ন করে রেখে দিয়েছি। সবসময় ব্যবহার করি না। মাঝেমধ্যে করি। বছরে তিন চারবার।
– আর বাকি গিফটগুলো? সেগুলো কি আছে?
– সিগারেটগুলো অনেক আগেই শেষ। আর পারফিউম আর আফটার শেইভের বোতলগুলো এখনও আছে। রেখে দিয়েছি আমার আলমারিতে। এই জিনিসগুলোর মূল্য আমার কাছে কতখানি তা কাওকে বুঝানো সম্ভব না৷ এই জিনিসগুলো একদিন আমার কাছে এতটা মূল্যবান হয়ে যাবে জানলে আমি সিগারেটের প্যাকেটও ফেলতাম না৷ রেখে দিতাম ঐ বক্সটাতে৷
– তখন কি মূল্যবান ছিলো না?
– উহুম। অন্য দশটা মানুষের দেয়া গিফটের মতই সাধারণ কোনো গিফট মনে হয়েছিলো৷ এটা আমার রুপন্তির দেয়া প্রথম গিফট এই স্পেশাল ফিলিং টা তখন আসেনি৷ আসলে রুপন্তি তখন শুধু রুপন্তি ছিলো আমার কাছে। তাই ওর গিফটগুলোও সাধারণই ছিলো৷ রুপন্তিকে যখন আমার নিজের মনে হলো ঠিক তখন থেকে ওর সবকিছুই আমার কাছে স্পেশাল মনে হতে লাগলো।

চলবে…..

#মিম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here