ছন্দহীন পদ্য
.
পর্ব_২৮
.
পরেরদিন পদ্য যখন ঘুম থেকে উঠেছে৷ তখন অনিক আর বাসায় নেই। রাতে একটু দেরিতেই ঘুমিয়েছিল সে। কী এক অসহ্যকর যন্ত্রণায়, অস্থিরতায় ছটফট করে রাত কাটিয়েছে। পদ্য রান্নাঘরে যাওয়ার পর আফরা নিজেই ফিসফিস করে বললো, ‘সন্ধ্যায় কী এমন হলো পদ্য? অনিক ভোরে ঘুম থেকে উঠেই তোমার আব্বার থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল। আমি বললাম নাশতা করে যাও। সে বললো বাইরে করবে।’
পদ্য কোনো জবাব দিল না। রান্নাঘরের জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়৷ পাহাড় আর গাছাগাছালি দেখা যাচ্ছে। দূরে, বহুদূরের গহিন কোনো বন থেকে তখন ঘুঘু পাখির ডাক শোনা গেল৷ খানিক পরে কাকেরও কা-কা ডাক। বিষণ্ণ হয়ে উঠলো যেন চারপাশ। হাহাকারে ভরে উঠলো পদ্যের বুক। চাপা এক কষ্ট। তাড়াতাড়ি রুমে ফিরে এলো সে। মোবাইল হাতে নিয়ে অনিককে মেসেজ দিল, ‘তোমাকে আমি কী বলেছিলাম চলে যেতে? ব্লকও তো করিনি। আমাকে কষ্ট দিতে ইচ্ছা করে এমন করেছো তাই না?’
কোনো রিপ্লাই এলো না। পদ্য পায়চারি করতে লাগলো রুমে। দমবন্ধ লাগছে। মনিসা তাকে দেখে বললো, ‘কী হয়েছে আপু?’
– ‘তুই রুম থেকে যা।’
– ‘কেন যাব?’
– ‘যাবি কি-না বল।’
মনিসা উঠে চলে যায়। পদ্য দরজা বন্ধ করে কল দিল। দু’বার রিং হতেই রিসিভ করলো অনিক। পদ্য কান্নায় কথা বলতে পারছে না৷ বুক ফেটে যাচ্ছে। গলা ধরে আসছে। অনিক ওপাশ থেকে বললো, ‘হঠাৎ কল দিয়েছো যে, শুধু ফোঁপানোর শব্দ পাচ্ছি, কথা বলো।’
পদ্য নিজেকে সামলে নিয়ে বললো,
– ‘তোমাকে আমি কী বলেছিলাম চলে যেতে?’
– ‘থাকতেও তো বলোনি।’
– ‘তোমার বাসায় তুমি থাকবে এখানে আমার কী? ব্লকও তো করিনি আর।’
– ‘কী হয়েছে বলো তো পদ্য। কাঁদছো তুমি! কেন কাঁদছো?’
– ‘তুমি ভোরে উঠেই চলে গেলে কেন? মানুষকে কষ্ট দিতে তুমি ভালোই জানো তাই না?’
– ‘তুমি এভাবে বললে কিন্তু পাখি হতে ইচ্ছা করবে।’
– ‘পাখি হতে কেন?’
– ‘তোমার কাছে তাড়াতাড়ি ফেরার জন্য।’
– ‘তুমি এখন কোথায়?’
– ‘শহরেই আছি। একটা কাজ ছিল, তাই এটা সারতে দেরি হচ্ছে। একটু পরেই বাসে উঠে রসুল পুর চলে যাব। তারপর তুমি রসুল পুর গেলে আমি ফিরে আসবো এই শহরে।’
– ‘ও আচ্ছা।’
অনিকের হাসি শোনা গেল। হাসতে হাসতে বললো, ‘ও আচ্ছা বলে আবার নিজেকে শক্ত করছো তাই না? পদ্য নিজেকে কষ্ট দিয়ো না। তোমার আর আমার কষ্ট একই। আমাদের কষ্ট আমাদের থেকে আর কেউই ভালো বুঝবে না। পাই আর না পাই, মনখুলে দু’টো কথা তো বলতে পারি আমরা, তাই না? এই যে তোমার কান্না পাচ্ছে, আমারও তো পায়। কান্না পেলে তো জড়িয়ে ধরেও করতে পারি। তুমি সেটা থেকেও নিজেকে বিরত রাখো কেন? আসো, দেখা করি। তারপর চলে যাব।’
– ‘কোথায় আসবো? আমি এলে তো সত্যিই কাঁদবো। কান্না ছাড়া আর তো কিছু বলার নেই।’
অনিক খানিকক্ষণ ভেবে বললো, ‘ব্যস্ত শহরে হাসাহাসির অনেক জায়গা থাকে, কিন্তু মনখুলে কাঁদার জায়গা নেই। চারদিকে মানুষ আর মানুষ। তুমি বাসা থেকে বের হয়ে একটা সিএনজি বা রিকশা নিয়ে আম্বরখানা আসো।’
– ‘তারপর?’
– ‘আসো আগে, তারপর দেখা যাবে।’
পদ্য তাড়াতাড়ি দাঁত ব্রাশ করে, মুখ ধুয়ে, শাড়ি ঠিকঠাক করে পরে আফরাকে গিয়ে বললো, ‘ভাবি আমি বাইরে যাচ্ছি।’
আফরা তার জন্যই চা ঢালছিল। ফ্ল্যাক্স রেখে অবাক চোখে তাকিয়ে বললো, ‘কোথায়?’
– ‘ভাবি অনিক এখনও শহরে আছে। আমার ভালো লাগছে না৷ সন্ধ্যায় মানুষটা আমার সঙ্গে বসে গল্প করতে করতে ফুসকা, বাদাম খেতে বলেছিল। সেই সুযোগটাও আমি দেইনি৷ আমার চাপা কষ্ট হচ্ছে ভাবি। তুমি আব্বা-আম্মাকে সামলে নিয়ো আমি যাই?’
– ‘আচ্ছা চা খেয়ে যাও।’
– ‘না যাই, ও অপেক্ষায় আছে।’
– ‘আচ্ছা যাও।’
পদ্য আম্বরখানা এসে কল দিল।
– ‘কোথায় তুমি?’
– ‘মসজিদের সামনে আসো।’
পদ্য সেদিকে গেল৷ অনিক একটা গাড়ির সামনে থেকে হাত তুলে নিজের জানান দিল। কাঁধে ব্যাগ। এলোমেলো চুল। বিষণ্ণ চোখ। রাতের সেই সাদা পাঞ্জাবি। সে কাছে যেতেই অনিক বললো, ‘তুমি কী ঘুম থেকে উঠেই কল দিয়েছিলে। চোখ-মুখ ফুলে আছে যে?’
– ‘হ্যাঁ, ঘুম থেকে উঠেই দিয়েছি।’
‘বাহ, গুড। কোথাও পড়েছিলাম মানুষের ভোরবেলা জরুরি সিদ্ধান্তগুলো নেয়া উচিত। তখন না-কি মাথা অন্য সময়ের তুলনায় বেশি ভালো কাজ করে। সুতরাং তুমি আজ যাই সিদ্ধান্ত নিয়েছো, ভালোই নিয়েছো’ তারপর অনিক গাড়িতে উঠে বললো, ‘আসো, উঠে বসো।’
– ‘কিন্তু যাব কোথায়? বাসায় তো ওরা অপেক্ষা করবে।’
‘আসো, উঠে বসো আগে।’ পদ্য উঠার পর পুনরায় বললো, ‘বেশি সময় থাকতে পারবে না জানি। তাই গাড়ি নিয়েছি৷ এদিকে নিরিবিলি রাস্তা আছে। গাড়ি আস্তে-আস্তে যাবে। আমরা গল্প করবো। তুমি নিশ্চয় কিছু বলতে চাচ্ছ। না হলে কল দিতে না। এখন গাড়ি যেতে বলি?’
পদ্য ভালোভাবে বসে মাথা নেড়ে সম্মতি দিল। অনিক ড্রাইভারকে বললো, ‘আপনি যান ভাই।’
গাড়ি ধীর গতিতে এগোচ্ছে। অনিক এক পা সীটে তুলে পদ্যের দিকে ঘুরে বসে বললো, ‘এবার বলো তুমি কিছু বলবে কি-না। গাড়িতে এসেছি যাতে শান্তিমতো বলতে পারো। রেস্টুরেন্টে গেলেও মানুষ থাকে চারদিকে।’
পদ্য শাড়ির আঁচল খুঁটতে খুঁটতে বললো, ‘কী বলবো এখন আসলে বুঝতে পারছি না।’
অনিক সীট থেকে পা নামিয়ে সোজা হয়ে বসে বললো, ‘আচ্ছা ঠিক আছে এত তাড়া নেই’ তারপর ড্রাইভারকে বললো, ‘একটা গান ছাড়েন ভাই। অবশ্যই স্যাড গান।’
– ‘স্যাড গান কেন ভাই?’
– ‘পৃথিবীতে এখন স্যাড গানিই বেশি বাজা উচিত। মানুষের মন আর মন নেই, পাথর হয়ে গেছে। স্যাড গান শুনলে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে।’
পদ্য মুখে হাত দিয়ে স্মিথ হাসলো। অনিক পানির বোতল পদ্যের হাতে দিয়ে বললো, ‘খাও’ তারপর একটা ব্যাগ খুলতে খুলতে পুনরায় বললো, ‘তুমি তো মনে হয় নাশতা করেও আসোনি? সামনে কোনো রেস্টুরেন্ট থেকে আর কিছু নিই? এখানে শুধু পিৎজ্জা।’
– ‘না আর কিছু লাগবে না।’
অনিক ড্রাইভারকে দিয়ে আবার বসে বললো,
– ‘নাও নিজের হাতে খাও।’
পদ্য ইতস্তত করে বললো, ‘আচ্ছা পরে খাব। একটা কাজ করা যায় না। সামনে কোথাও গাড়ি রাস্তার একপাশে রেখে উনি একটু বাইরে গিয়ে দাঁড়াতে পারবে না?’
– ‘পারবে, আরেকটু সামনে যাক।’
গাড়ি আরও কিছুদূর যাওয়ার পর অনিক বললো, ‘ভাই একটা কাজ করুন। রাস্তার একপাশে গাড়ি থামান।’
ড্রাইভার থামানোর পর বললো, ‘আপনি ওই দোকানে গিয়ে সিগারেট, চা খান, মোবাইল টিপুন। আমরা কিছু কথা বলবো। তাই আরকি৷ রাস্তার পাশে আছে। গ্লাসও খোলা থাকবে।’
‘আচ্ছা ঠিক আছে’ বলে ড্রাইভার গাড়ি একপাশে রেখে চলে গেল। দুইপাশে চা বাগান, পাহাড়। মানুষের আনাগোনা কম। শুধু সাই-সাই করে গাড়ি যাচ্ছে-আসছে।
নির্জন, নিরিবিলি এই জায়গায় অনিকের সঙ্গে একা আছে ভাবতেই কেমন লজ্জা লাগতে শুরু করেছে পদ্যের। সে চা বাগানের দিকে তাকিয়ে রইল৷
– ‘পদ্য শোনো।’
অনিকের কথা শুনে পদ্য মাথা ঘুরিয়ে তাকায়।
– ‘কী।’
ক্ষীণ সময় নিয়ে বললো, ‘আমি যা বলার গতকাল বলেছি। আমার সবকিছুই তুমি জানো। এখন যা বলার তুমিই বলতে হবে। তুমি তো আর এমনিই নিজ থেকে কল দাওনি।’
– ‘তোমার কিছু বলার নেই?’
– ‘তা আছে, বলার, চাওয়ার কতকিছু আছে৷ কিন্তু সেই অধিকার আমার নেই।’
– ‘কী চাওয়ার আছে বলো শুনি।’
– ‘যেমন আমরা একসঙ্গে বসে আছি। আমার ইচ্ছা করছিল হাত ধরে বসতে। পিৎজা বের করে ইচ্ছা করছিল খাইয়ে দিতে। কিন্তু এগুলোর তো মানে হয় না। এগুলো বললেই তো একটা প্রশ্ন সামনে এসে দাঁড়ায়। এর ভবিষ্যৎ কী? তাই না?’
পদ্য দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, ‘অনিক, আমি গতকাল রাতে ফিরে এসে একা একা অনেক কেঁদেছি। তুমি তো জেনেই গেছো সব। আমিও তোমাকে ভালোবাসি৷ আমার অনেক কষ্ট হয় অনিক। গতকাল সন্ধ্যায় তুমি আমার কষ্ট আরও বাড়িয়ে দিয়েছো। তুমি হাত ধরতে চাও ধরো, খাইয়ে দিতে চাও, দাও। কিন্তু আমাকে বলো না কী করবো। কী করতে চাই। আসলে আমি নিজেই কিছু বুঝতে পারছি না। তুমিই বলো পারলে কী করবো।’
অনিক তন্ময় হয়ে তাকিয়ে আছে ওর চোখের দিকে। পদ্য খানিক পর বললো, ‘কী হলো?’
অনিক ব্যগ্র গলায় বললো, ‘সত্যিই তোমার হাতটা ধরবো একটু?’
পদ্য চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারলো না। মুখ গুঁজে ফেললো অনিকের বাহুতে। তারপর, ভেজা গলায় বললো, ‘তুমি প্লিজ এভাবে আর বলো না। আমার অনেক কষ্ট লাগে অনিক। তুমি এবার বলো আমি কী করবো। আমিও বুঝতে পারছি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবো না। আবার ওদিকে আব্বার অবস্থা তুমি জানোই।’
অনিকের চোখগুলো ছলছল করে উঠলো। পদ্যের চুলগুলো তার ভীষণ প্রিয়। তার বাহুতে কপাল ঠেকিয়ে থাকায় পদ্যের চুলগুলো চোখের সামনে। সে মাথায় হাত রেখে বললো, ‘আমরা চেষ্টা করবো পদ্য, পাই না পাই চেষ্টা করে দেখবো। তুমি আগে আমাকে সবকিছু খুলে বলো। তুমি এত ভালোবেসে থাকলে এতদিন এভাবে গোপন রেখেছিলে কেন? আর আগে পিৎজা খাও। খেতে খেতে বলো।’
পদ্য মাথা তুলে নাক টেনে চোখ মুছতে নিচ্ছিল। অনিক হাত ধরে ফেললো। পদ্য ভেজা গলায় বললো, ‘কী হয়েছে?’
– ‘কান্না কান্না ভাব থাকায় চোখ মুখ লাল হয়ে আছে তোমার৷ একটা মানুষ এত মায়াবী হয় কীভাবে পদ্য? আমি একটু চোখের পানি মুছে দেই তোমার?’
পদ্য মাথা নাড়লো। অনিক আরেকটু নিবিড় হয়ে বসে আঁজলা করে ওর মুখটা ধরলো। তারপর দুই হাতের বুড়ো আঙুল দিয়ে দুই চোখের জল মুছে দিয়ে মুচকি হেঁসে বললো, ‘চোখ মুছে দেওয়ার সুযোগে তোমার কোমল মুখটা আঁজলা করে ধরার লোভটা সামলাতে পারলাম না।’
পদ্য হেঁসে আবার কাঁধে মাথা রেখে বললো, ‘এই যে এত ভালোবাসছো, যদি না পাই এই ভয়টা ঠিকই ভেতরে খুঁড়ছে আমার।’
– ‘আমার সেই ভয় করছে না। উলটো তুমি যে হুট করে আমাকে এতকিছু দিচ্ছ, আমি হঠাৎ সুখে বুক ফেটে মরে যাব মনে হচ্ছে। বুকে এত সুখের জায়গা কোথায় বলো।’
পদ্য কাঁধ থেকে মাথা তুলে ছলছল চোখে অনিকের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘বিশ্বাস করো তোমাকে প্রশ্রয় দিতে চাইনি বলেই এত কঠিন করে কথা বলতাম। কিন্তু রোজই মনে হতো ইস পৃথিবীতে কতই না অলিক ঘটনা ঘটে। কত রহস্যময় এই পৃথিবী। কোনো দৈব ইশারায় যদি তোমাকে আমি পাইতাম৷’ তারপর চোখের পানি মুছে পুনরায় বললো, ‘তোমাকে কী কোনোভাবে পাওয়ার সুযোগ নেই অনিক? আমি আসলে নিজেকে অনেক সামলে রেখেছি। আমার আর সহ্য ক্ষমতা নেই। বাঁধ ভেঙে গেছে আমার।’
অনিক বিস্মিত নয়নে তাকিয়ে থেকে বললো, ‘তুমি হুট করে আমাকে এভাবে বলা শুরু করেছো কী খু*ন করতে পদ্য? আমার কাছে স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে সবকিছু।’
পদ্য নিজেকে সামলে নিয়ে স্বাভাবিক করে বললো, ‘আচ্ছা পিৎজা খাইয়ে দাও।’
অনিক এক পিস পিৎজা হাতে নিয়ে বললো, ‘খেতে খেতে আমাকে বলো সবকিছু। কেন এতদিন এভাবে চেপে রেখেছিলে।’
দু’জন খেতে খেতে কথা বলছে।
পদ্য মিরাজুল সাহেবের পুরো ঘটনা খুলে বললো তাকে। অনিক সবকিছু শুনে খানিক্ষণ চুপ থেকে বললো, ‘বুঝেছি, আব্বাও যে খুব খারাপ কিছু করেছেন তা না।’
– ‘এবার বলো কী করার। দুই পরিবারই তো রাজি না।’
– ‘পদ্য আগে আমাদের নিজেদের ভেতরের হীনমন্যতা দূর করা দরকার। কে রাজি, কে না সেটা পরে।’
– ‘বুঝিনি।’
– ‘আমরা একে অন্যকে ভালোবাসি তা ঠিক তো?’
– ‘হ্যাঁ।’
– ‘অবিবাহিত ছেলে-মেয়েদের ভালোবাসা কোনো অদ্ভুত কিছু না৷ খুবই স্বাভাবিক বিষয়। সমাজে এগুলো আছে বলেই নাটক, সিনেমা হয়। প্রেম-ভালোবাসাও যে সত্য। সেটার প্রমাণও হলো পৃথিবীতে বহু মানুষ এর জন্য জীবন দিয়েছে।’
– ‘এগুলো এখন শুনে কী হবে?’
– ‘আগে সব কথা শোনো। শুধু যে আমাদের পরিবার মানবে না তা তো না। সমাজও মানবে না৷ পরিবারকে বুঝাতে হলেও আমাদের মন পরিষ্কার থাকতে হবে। আমরা যে আশ্চর্য কোনো কাজ করে ফেলেছি তা না। হ্যাঁ, অসম প্রেম। সেটা আমাদের কাছে স্বাভাবিক। অন্যদের কাছে অস্বাভাবিক হলে আমাদের বুঝাক। আমি আমার কথা বলবো৷ ওরা ওদের কথা। আগে তো আমাদের শক্ত হতে হবে। তোমার বাবাকে এখন না বলে আমরা অন্যদের মুখোমুখি হই। তোমাকে আমার আব্বা বলেছিল আমাকে প্রশ্রয় না দিতে। এবং তাকে সবকিছু বলতে। তুমি এবার কল দিয়ে বলো, ‘চাচা আমি এখন নিজেই অনিকের প্রেমে পড়ে গেছি, আমি সত্যিই চাই ওকে বিয়ে করতে কিন্তু আমার আব্বার যে অসুখ এগুলোর জন্য মুখ বন্ধ রাখতে হচ্ছে।’ তারপর সে দেখো কী বলে।’
– ‘কী বলো! এভাবে বলবো?’
– ‘একটু আগে বলেছি না হীনমন্যতা দূর করতে। এজন্য বলেছি। নিজে, নিজের পক্ষ থাকতে হয়। আমি প্রেম করেছি, ভুল হলে আমাকে বুঝিয়ে দিন। বুঝতে পারছো না ব্যাপারটা? আমার আব্বা তো নিজেই মাঝখানে ঢুকছেন তাই না? তো এখন সে মাথা ঘামাক। তুমি যখন বলবে ওই কথা তখন উনি কী বলবে জানো?’
– ‘কী?’
– ‘বলবে কী বলো মা? মানুষ কী বলবে। মানে এই লাইনে কথা এগুবে।’
– ‘তখন কী বলবো আমি।’
– ‘এই তো লাইনে এসেছো। তোমার আব্বা সুস্থ হওয়ার আগপর্যন্ত আমরা আব্বার সাথে কথা বলবো। উনি সমাধান করুক এই সমস্যার।’
– ‘আচ্ছা উনি যখন বলবে তোমার লজ্জা নেই, বয়সে ছোট একটা ছেলের প্রেমে পড়লে কীভাবে?’
– ‘তুমি বলবে আমি তো চাচা আপনার কথায় ওকে সব সময় তাড়িয়ে দিয়েছি। তাকে কখনও বলিনি পছন্দ করি। ওর কষ্ট সহ্য হচ্ছে না। আমি চাচ্ছি জানিয়ে দিতে। আর না হয় আপনি একটা কিছু করেন। আমাদের বিয়ে দেন। অথবা অনিককে নিজে বুঝিয়ে দেখুন। তুমি এভাবে জবাব দিবে। তোমাকে দিয়ে যাতে আর কিছু করতে না পারে।’
– ‘আমার লজ্জা লাগবে এভাবে বলতে।’
– ‘তাহলে তুমি বলবে আচ্ছা চাচা আপনি আমাকে একা বুঝিয়ে তো লাভ নেই। অনিক আর আমাকে নিয়ে বসুন। দু’জনকে বুঝান। এভাবে তো আর হচ্ছে না।’
– ‘ওরা তো ওদের মতো বোঝাবে।’
– ‘ওরা যদি আসলেই বুঝাতে পারে তাহলে বুঝলাম, না হলে তো নাই। মানে আমরা তো পালিয়ে, লুকিয়ে বিয়ে করতে পারি, পারি না? তবুও তো তাদের সাথে কথা বলবো। ওরা বুঝাতে না পেরে কী করবে? বলতে তো পারবে না যা ইচ্ছা করো। কারণ জানে আমরা বিয়ে করে নিব। তাই আমরা নিজেদের দুশ্চিন্তা ওদের উপরও দেই।’
– ‘আচ্ছা ধরলাম তোমার আব্বা মেনে নিলেন, তারপর কী হবে? আমার আব্বা এসব শুনে যদি আবার স্ট্রোক করেন।’
– ‘তোমার আব্বা অসুস্থ তাই একেবারে পরে উনার চিন্তা। আগে আমার আব্বা যেহেতু নিজেই মাঝখানে ঢুকেছেন, উনার মুখোমুখি হই। তোমার আব্বা রাজি হওয়ার পর তুমি ঠিকই বলবে সমাজ কী বলবে। এজন্য বলেছি তুমি আগে নিজের মন পরিষ্কার করো।’
– ‘আমার মন পরিষ্কার কী করবো?’
– ‘বয়সে ছোট-বড় ব্যাপার যে স্বাভাবিক সেটা নিজে বিশ্বাস করো কি-না বলো। শোনো, পৃথিবীতে সমকামীও তো আছে। আছে না? আমরা অনেকে ব্যাপারটা ভাবলেই বমি আসে। কিন্তু ওরা তো এই জীবন যাপন করছে। যার যার রাষ্ট্রে তাদের স্বীকৃতির জন্য লড়াই করছে। করছে না? আর আমরা তো ছেলে-মেয়ে। পৃথিবীর কোনো মানুষই এসবের বাইরে না। আর বয়সে বড়ো যে ব্যাপারটা। ডিভোর্স হওয়ার পরও তো বয়সে ছোট ছেলেকে বিয়ে করে অনেকে। তখন কেউ কিছু বলে না। বড়ো ছেলে মা*রা গেলে অনেক পিতা নিজেই তার ছোট সন্তানকে বলে ভাবিকে বিয়ে করতে। তখন বয়স কোথায় থাকে? আর আপু ডাকতাম তো কী হয়েছে? রক্তের কোনো সম্পর্ক আমাদের নেই। আমি যদি মন থেকে তোমাকে নিজের বড়ো বোন ভাবতাম তাহলে তো আমার এই অনুভূতি আসতো না, তাই না? তাহলে আমরা কেন লজ্জা পাব? আর সমাজের মানুষ হাসাহাসি করবে তাতে আমাদের কী? আমরা উলটো হাসাহাসি করবো তাদের নিয়ে।’
– ‘এত মানুষ নিয়ে তুমি হাসাহাসি করবে?’
– ‘হ্যাঁ করবো, বিয়ে হোক তারপর দেইখো মানুষের নিজের মুখ থেকে কী বের করি।’
– ‘কী বের করবে?’
– ‘সেটা বিয়ে হলে দেখা যাবে। এখন তোমার কাজ হচ্ছে আব্বার সাথে কথা বলা। আর আমার সাথে চ্যাটে কথা বলবে রোজ।’
– ‘আচ্ছা।’
– ‘দাও আব্বাকে কল দাও এখন।’
__চলবে…
লেখা: জবরুল ইসলামছন্দহীন পদ্য
.
পর্ব_২৯
.
পদ্য কল না দিয়ে বাইরের দিকে চুপচাপ তাকিয়ে রইল।
অনিক দীর্ঘশ্বাস গোপন করলো। পদ্যকে আজ অস্বাভাবিক লাগছে। আচরণগুলো কেমন অসামঞ্জস্য। ইমোশনাল কথাবার্তাগুলো অবিশ্বাস্য লেগেছে। ওর ব্যক্তিত্বের সঙ্গে যেন এমন ভেঙে পড়া, দূর্বল হওয়া যায় না। তবুও তো মানতে হবে, মানুষ কোনো একজনের কাছে এসে নিজের ব্যক্তিত্বের, কাঠিন্যের খোলস খুলে ফেলে দিতে চায়। পদ্যেরও হয়তো সেই মানুষটি সে। আচ্ছা আসা মাত্রই জটিল বিষয় নিয়ে আলোচনা শুরু করাটা কী ঠিক হয়নি? সে নিজেও আসলে এগুলো ছাড়া কিছুই ভাবতে পারছে না। পদ্যের হয়তো একটু মানসিক প্রশান্তি দরকার৷ অথচ সে কি-না আসা মাত্রই জটিল বিষয় নিয়ে আলাপ শুরু করে দিয়েছিল।
অনিক পদ্যের হাতের দিকে তাকায়। ফরসা হাতে পাতলা লালচে লোম। নখগুলো এখনও লম্বা রাখে ও। সে ধীরে ধীরে পদ্যের কোমল হাতটা ধরে। পুরো শরীর যেন কাটা দিয়ে উঠে তার। পদ্য ফিরে তাকায়। অনিক অভয় দিয়ে বললো, ‘আচ্ছা এখন কল দিতে হবে না। এত তাড়াহুড়ার কিছু নেই। বাইরে গিয়ে কি হাঁটবে? দেখো ঝকঝকে নীল আকাশ। রাস্তায় পাহাড়ের ছায়া। চারদিকে সবুজ চা গাছ।’
– ‘না থাক, এখানেই ভালো লাগছে। আমি আসলে ভাবছি কল দিয়ে কীভাবে বলবো। কেমন লজ্জা লাগছে।’
– ‘থাক, বাসায় গিয়েও দিতে পারবে। চাপ নিতে হবে না।’
– ‘হ্যাঁ বাসায় গিয়েই দিলে ভালো হবে৷ এখন কল দিয়ে গুছিয়ে কথা বলতে পারবো না।’
– ‘আমরা ওই বিষয়গুলো মাথা থেকে এখন ঝেড়ে ফেলি৷ আচ্ছা তোমার মনে আছে আমরা হারিকেনের আলোয় একসঙ্গে পড়তে বসতাম?’
পদ্য মিষ্টি হেঁসে বললো, ‘গতকাল সন্ধ্যায় তোমার বারান্দায় মোমবাতির আলো আর মাদুর দেখে মনে পড়েছিল।’
– ‘আমার সব সময় মনে পড়ে। তুমি কী মিষ্টি করে গান গাইতে। কী সুন্দর চুল, চোখ। আর তোমার চোখের ব্যাপার কী জানো?’
– ‘কী?’
– ‘তোমার ভ্রু এবং চোখের পাপড়ি অনেক কালো, চোখের মণির চারপাশের সাদা অংশ পরিষ্কার সাদা, অন্যদের একটু লালচে হয়। তোমার তা নয়, চারদিকে সাদা, আবার চোখের মণি প্রচণ্ড কালো। ফলে তাকালে মনে হয় চোখ যেন কেমন গভীর অতল নদী৷’
পদ্য মুখে হাত দিয়ে ফিক করে হেঁসে বললো, ‘এবার তোমাকে ছোটবেলার সেই অনিক মনে হচ্ছে। না হলে অচেনা লাগে।’
– ‘অচেনা লাগে?’
– ‘অনেকটা।’
– ‘অচেনা ভালো লাগে না-কি চেনা?’
– ‘প্রেমিক হিসাবে তো এখনকার অচেনা ব্যক্তিত্ববান অনিকই পারফেক্ট। আর আগের অনিক আগের জন্য ঠিকই ছিল। কারণ আমরা তখন ছোট ছিলাম। আচ্ছা বাইরে যেতে বলেছিলে, চলো একটু হেঁটে আসি।’
– ‘হাত ধরে?’
পদ্য মুচকি হেঁসে বললো,
– ‘আজ আর না করবো না। না করার পর কিন্তু কষ্ট লাগে, জানো?’
‘তোমার লাগে জানতাম না।’
দু’জন বাইরে এলো। অনিক হাতটা ধরে বললো, ‘ওই দিকে যাই।’
পদ্য মাথা নাড়লো। ছায়াময় রাস্তা। দুইপাশে পাহাড়কে চাদরের মতো ঢেকে রেখেছে সবুজ চা গাছ। অনিক পদ্যের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘আমরা চাইলে কোথাও বেড়েতে যেতে পারি৷ ভাবি সামলে নিবে, যাবে?’
– ‘না থাক, আজ এমনিতেই বেশি হচ্ছে।’
‘আচ্ছা ঠিক আছে’ বলে পদ্যের দিকে তাকিয়ে পুনরায় বললো, ‘আমাকে কাপড় আনতে না করেছিলে কেন? অসুবিধা হচ্ছে না?’
পদ্য মুচকি হেঁসে বললো, ‘জেদ, তোমাকে দিয়ে আনাতে চাইছিলাম না। অথচ দেখো ভাবির শাড়ি-টাড়ি পরে থাকতে হচ্ছে। অসুবিধাই বটে।’
– ‘সেটাই আমাকে অবাক করছে। কেমন যেন স্বপ্ন লাগছে। মনে হচ্ছে একজন হৃদয়হীন নারী হুট করে আমার সঙ্গে এত ঘনিষ্ঠ হওয়ার কারণ কী।’
পদ্য ঠোঁট টিপে হেঁসে বললো, ‘আসলে আমি অনেক আগে থেকেই তো ভালোবেসে ফেলেছিলাম। এতদিন শুধু নিজেকে সামলে রেখেছি। গতকাল সন্ধ্যার পর থেকে আর পারিনি। ওখান থেকে চলে এসে পুরো রাত চাপা কষ্ট হচ্ছিল। এদিকে ভোরে উঠেই শুনি তুমি চলে গেছো। সবকিছু কেমন বাঁধ ভেঙে দিয়েছে আমার। তোমার কাছে অস্বাভাবিক লাগলেও, আমার কাছে না। কারণ তোমাকে আমি প্রশ্রয় না দিলেও অন্যদিকে পরিবারে তোমার কথা বলেছি। হৃদয়হীন হলে তা কেন বললাম?’
– ‘যাও বিশ্বাস করলাম হৃদয় আছে৷’
– ‘তোমার লেখালেখির খবর কী?’
– ‘সবকিছু গোল্লায়। জবও চলে গেছে। অবশ্য বই মেলায় বই ভালোই চলেছে। কিন্তু আরেকটা লেখায় এখনও হাত দিতে পারিনি।’
– ‘অল্প কয়দিনে জব চলে গেল?’
– ‘চলে যাক, আপাতত ট্রাই করবো না নতুন জবের। যদি আমাদের বিয়ে হয়, বিয়ের পর দুয়েক মাস গ্রামে থাকবো। তারপর এখানে এসে জবের ট্রাই করবো।’
পদ্য মুচকি হেঁসে বললো, ‘তুমি এত আত্মবিশ্বাস নিয়ে বিয়ের কথা বলো কীভাবে?’
– ‘বিয়ে তো আমাদের হাতে, ধরো এখন গিয়ে যদি করে ফেলি?’
– ‘এরকম করা যাবে না। আমার পরিবারে আমাকে দরকার আছে।’
– ‘চিন্তা করো না, ওরা মানবে, না মানলে পরে দেখা যাবে।’
– ‘আর হ্যাঁ, তুমি জব করলে লেখালেখিতে পুরোপুরি সময় দিতে পারবে তো? আমি যতদূর জানি তোমার সব বইই ভালো সাড়া ফেলেছে।’
– ‘তা ফেলেছে। কিন্তু পেশা হিসাবে নেয়ার মতো না৷ আরও কয়েক বছর যাক। তখন জব ছেড়ে পুরোপুরি লেখায় মনযোগ দেবো।’
পদ্য অন্যদিকে তাকিয়ে বললো,
– ‘শুধু বিয়ে বিয়ে করছো কেন। কাল রাতে তো বউও বলে ফেলেছিলে।’
অনিক চুলে আঙুল চালিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, ‘পাগলের সুখ মনে মনে।’
– ‘তুমি আসলেই পাগল। এরকম কেউ বলে? কী যে কষ্ট লাগছিল রুমে এসে।’
– ‘আমি তো কষ্ট দিতে বলিনি। আমি আমার কথা বলেছিলাম।’
– ‘আচ্ছা যাই, গাড়িতে গিয়ে বসি। তারপর চলে যাব।’
– ‘চলো।’
দু’জন আবার ফিরে এসে গাড়িতে বসলো। অনিক খানিকক্ষণ চুপ থেকে বললো, ‘আচ্ছা তুমি কী এখনও গুনগুন করে গান গাও?’
– ‘না তো, গাইতাম না-কি আগে?’
– ‘হ্যাঁ, সারাক্ষণ গুনগুন করতে।’
– ‘তোমার সবকিছু এত মনে আছে?’
– ‘হ্যাঁ, এবার গ্রামে গিয়ে সবকিছু এত মনে পড়ছিল। জানো, বাইক কিনেছি। রোজ নদীর পাড়ে গিয়ে বসি। এলাকায় এদিক-ওদিক যাই। সবকিছুতে কেমন তুমি মিশে আছো। নদীর পাড়ের কথা মনে আছে?’
– ‘তা আছে, মিথ্যে বলে নিয়ে গিয়েছিলে।’
– ‘রোজ গিয়ে বসি সেখানে।
আমাদের বিয়েটা সবাই মেনে নিলে কী ভালো হতো তাই না? পুরো জীবনটা শৈশবের মতো আনন্দময় হয়ে যেত।’
পদ্য দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বিষণ্ণ মনে বাইরের দিকে তাকায়। অনিক ইতস্তত করে পুনরায় বললো,
– ‘আচ্ছা চলেই তো যাবে এখন। একবার জড়িয়ে ধরে বসতে পারি তোমায়?’
পদ্যের আবার শরীরটা কাটা দিল। ফিরে তাকায় ওর দিকে। মানুষটার চোখের দিকে তাকানো যায় না। এত ভালোবাসে কেন? চোখের দিকে তাকালেও দেখা যায় সেটা। পদ্য মাথা কাত করে সম্মতি জানায়। অনিক মোবাইলে একটা গান ছাড়লো। অনুপম রায়ের গান। তারপর পদ্যের পিঠের দিকে হাত নিয়ে জড়িয়ে ধরে। পদ্য মাথা রাখে তার কাঁধে। অনিক ওর মাথায় ঠোঁট ছুঁয়ে দেয়। পদ্যের হাতটা এনে চেপে ধরে তার গালে, ঠোঁটে৷ সেই মাতাল করা ঘ্রাণ। পদ্যের মৌলিক ঘ্রাণ। যা সে এতদিন দূরে থেকেও পেত। সেই উষ্ণতা। যে এতদিন দূরে থেকেও অনুভব করতে পারতো। অনিকের চোখটা ভিজে আসে। ওর গালে হাত রেখে কানের কাছে ফিসফিস করে বলে, ‘পদ্য।’
– ‘হুম।’
– ‘আমার এই নির্জীব, নিরস জীবনটাকে হঠাৎ এভাবে রাঙিয়ে দেয়ার জন্য ধন্যবাদ। সত্যিই আমার কাছে স্বপ্ন মনে হচ্ছে।’
পদ্যের কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। ভালো লাগার আবেশে তার চোখবুজে আসছে। চুপচাপ এভাবে মানুষটার বুকে মাথা রেখে অনন্তকাল কাটিয়ে দিতে পারলে ভালো হতো। অনিকের উষ্ণ শ্বাস তার মাথায় পড়ছে৷ এত আদর করে গালে হাত রেখেছে। যেন সে শিমুল তুলো৷ সবকিছু এত ভালো লাগছে কেন? মৃদু সুরে অদ্ভুত মায়াময় একটা গানও বাজছে,
“কি মায়ায় বেঁধেছো আমায়,
পিয়া গো,
বুকে ধরে রাখো আরও কাছে থাকো,
ভালোবেসে ফেলেছি তোমায়,
সানাই এর সুর বাজে
মন নেই কোনো কাজে,
পান পাতা দিয়ে ঢেকে রেখেছি হৃদয়
কি মায়ায় বেঁধেছো আমায়,
পিয়া গো……।”
পদ্য ‘ওম-ওম’ গলায় বললো, ‘অনিক এরপর যে না পেলে দুজনের আরও বেশি কষ্ট হবে। ঠিক এই কারণে তোমাকে দূরে রাখতে চাইতাম সব সময়।’
পদ্যের মাথাটা তার কাঁধেই। ফিসফিস করে উষ্ণ শ্বাস ছেড়ে কথা বলায় তার রক্তে কেমন উষ্ণতা ছড়িয়ে গেল। পা থেকে এক অদ্ভুত শিহরণ উঠলো গিয়ে মাথায়। অনিক ওর মাথায় গালটা আরও চেপে ধরে, নিজের হাতের বাঁধন আরেকটু শক্ত করে বলে, ‘পদ্য এতদিন জানতাম তুমি আমাকে ভালোবাসো না। তাই নিজের কষ্ট সহ্য করেছি। এখন যে জানি আমার পদ্মফুলটারও আমার জন্য কষ্ট হয়। তোমাকে আমি এই কষ্ট পেতে দেবো না। দেখো ঠিকই তোমাকে পাব৷ তোমাকে পাওয়ার জন্য আমি এখন সবকিছু করতে পারবো। এতদিন তো জানতাম তুমি আমাকে চাও না।’
– ‘অনিক।’
– ‘হুম।’
– ‘তুমি যখন কাল আমার গালে হাত রেখে তাকিয়ে ছিলে। বলছিলে সরাতে ইচ্ছা করছে না। তখন আমারও ইচ্ছা করছিল এভাবে তাকিয়ে থাকি। তবুও ভয়ে তাড়াতাড়ি চলে এসেছিলাম। কাউকে ভালোবাসার পর সেটা গোপন রেখে ঘৃণা করার অভিনয়ের যন্ত্রণা কতটুকু তুমি জানো? জানো না, তোমার লেখায় কাজে লাগতো জানলে।’
– ‘না, তা জানি না। তবে মানুষের স্বভাব হচ্ছে ঘৃণা বুকের ভেতর লুকিয়ে রাখা আর ভালোবাসা প্রকাশ করা। মানুষ অহরহ ভালোবাসার অভিনয় করে, কিন্তু ঘৃণার অভিনয় করে না৷ ঘৃণা গোপন রাখে, ভালোবাসা পারলে আরও বেশি দেখায়। তুমি যেহেতু মানব জাতির স্বভাব বিরোধী কাজ করেছো, কষ্ট হবারই কথা।’
– ‘ঠিকই বলেছো৷ বুকে অসীম প্রেম নিয়ে মুখে ঘৃণার প্রলাপ বকেছি৷ এত কষ্ট হতো। অথচ এখন দেখো, প্রকাশ করতে গিয়ে কেমন শান্তি লাগছে। ইচ্ছা করছে শুধু বলতে থাকি। আচ্ছা আজ দিনটা এমন কেন অনিক?’
– ‘আজ দিনটা তোমার জন্য যেমনই হোক। এই ছোট্ট জীবনের মধ্যে আমার শ্রেষ্ঠ একটা দিন ছিল আজ আর গতকাল সন্ধ্যা৷’
পদ্য মাথা তুলে চুল ঠিক করতে করতে বললো, ‘আচ্ছা এবার যাই তাহলে।’
অনিক ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে আঁজলা করে মুখ ধরে বললো, ‘ইস এলোমেলো চুল আবার মুখটাও কেমন লাল হয়ে আছে তোমার। মনে আছে ছোটবেলায় বলতাম তুমি কেমন ‘মায়া-মায়া’।’
পদ্য ঠোঁট টিপে হেঁসে বললো ‘হ্যাঁ।’
অনিক গাল থেকে হাত সরিয়ে নিল। পদ্য তাকিয়ে রইল খানিক্ষণ ওর দিকে৷ লম্বা চুল। দাড়ি-গোঁফ। অসম্ভব সুদর্শন একজন পুরুষ। তার নিজেরও ইচ্ছা করছে হাত ধরতে। মুখটা একটু ছুঁয়ে দিতে৷ কিন্তু তা অনিকের মতো কখনও প্রকাশ করতে পারবে না সে। অনিক ড্রাইভারকে ডেকে আনার জন্য নামতে চাচ্ছে। পদ্যের কেমন যেন লাগে। অনিক গ্রামে চলে যাবে৷ সে বাসায়। দু’জন দিকে। আচ্ছা সে যদি এখন বলে অনিক তোমার শরীর অনেক গরম মনে হয়েছিল আগে। কপালে হাত দিয়ে দেখি ‘জ্বর-টর’ এলো কি-না। তাহলে কী বুঝে ফেলবে অনিক? হয়তো বুঝে যাবে। অনিক পুনরায় বললো, ‘ম্যাডাম পথ দাও। আমি ড্রাইভারকে নিয়ে আসি।’
– ‘বসো আরেকটু সময়।’
– ‘আচ্ছা বসলাম।’
– ‘চাচাকে কল দিয়ে দেই। বাসায় গিয়ে তো অসুবিধা৷ অন্যরা থাকে।’
– ‘আচ্ছা দাও।’
– ‘আমি আমার মতোই কথা বলবো? ঠিক আছে?’
– ‘আচ্ছা বলো, বুঝেছি বিয়ের পর শ্বশুর হবেন। তাই কথা বলতে এত লজ্জা।’
পদ্য মুচকি হেঁসে বললো, ‘কম কথা বলো, কল দিলাম’ বলে পদ্য মোবাইল কানে লাগায়।
তিনবার রিং হতেই রিসিভ করলেন মিরাজুল সাহেব৷ সে সালাম দিল। তিনি জবাব দিয়ে বললেন,
– ‘পদ্য মা, কী খবর তোমাদের। ভালো আছো?’
– ‘হ্যাঁ চাচা ভালো।’
– ‘কিছু বলবে?’
– ‘আসলে কীভাবে বলবো চাচা বুঝতে পারছি না।’
– ‘কী বলবে বলো মা, নির্দ্ধিধায় বলো।’
– ‘চাচা অনিকের ব্যাপারটা মনে হয় সিরিয়াসলি নেয়া দরকার আপনার। ওর আচরণ পুরাই অস্বাভাবিক।’
– ‘হ্যাঁ, মা তা তো আমিই দেখছি। গ্রামে এসে যেদিকে ইচ্ছা যাচ্ছে। চোখ লাল করে হাঁটছে। ঘুম-খাওয়ার কোনো ঠিক নাই। এখন সেখানে গিয়ে কি করছে মা?’
– ‘আসলে চাচা আপনি তো জানেন ওকে কিছুদিন আগে আমি অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছিলাম। তারপর ভাবির কাছে শুনলাম সিগারেট চিবিয়ে খেয়েছে। রাস্তায় গিয়ে বমি করেছে। জব ছেড়ে দিয়েছে। খাওয়া ঘুম বাদ। মানে এগুলো শুনলে কষ্ট লাগে। এবার এসে আরেক বিপদে ফেলেছে।’
– ‘কী?’
– ‘ও আমাকে একা পেয়ে অনেক পাগলামি করেছে। তারপর বললো আমার যেদিন বিয়ে হবে সেদিন বি*ষ খাবে অথবা গলায় দ*ড়ি দেবে। আমার অনেক ভয় করছে চাচা। আফরা ভাবিকেও বলেছি। উনি বলে সত্যিই খেতে পারে। আমাকেও বলেছে।’
– ‘আরে না মা। ভয় দেখাইছে এরকম হবে না।’
– ‘চাচা আমি একটা কথা বলি। আমার লজ্জা লাগছে তবুও বলতে চাই৷’
– ‘আহা লজ্জা পাচ্ছ কেন মা, বলো। আমি তো একদিন বলেছিলাম সবকিছু আমাকে বলতে।’
– ‘চাচা ওর কষ্ট দেখে আমার সহ্য হয় না৷ সত্যি কথা বলতে দুই পরিবার রাজি থাকলে অনিককে বিয়ে করতে আমার কোনো সমস্যা নেই। আমি শুধু আপনার কথায় ওর সাথে খারাপ ব্যবহার করেছি। এখন আর করার সাহস নেই। যদি সত্যিই বি*ষ খায়?’
– ‘তুমি ভয় পাচ্ছ কেন মা? ও বি*ষ খাবে না।’
– ‘আমি শুধু আপনাকে জানালাম চাচা। আমি ওর সঙ্গে খারাপ আচরণ করতে পারছি না। আমি সব কথা আপনাকে বলতে লজ্জাও পাচ্ছি। কিন্তু কি করবো বলুন। অবিভাবকদের মাঝে শুধু আপনি জানেন ব্যাপারটা। অনিককেও আমি কখনও প্রশ্রয় দেইনি। কিন্তু আমিও তো মানুষ চাচা। ও এত ভালোবাসে, বিয়ে করতে চায়। তার তো কোনো দোষ নেই। বিয়ে করতে চাওয়া তো খারাপ কিছু না৷ অথচ ওইদিন আমি গ্রাম থেকে বিদায় করে দিয়েছি আজেবাজে কথা বলে।’
– ‘তুমি এত দূর্বল হলে তো চলবে না মা।’
– ‘চাচা আমি তো অনেক চেষ্টা করেছি। এখন উলটো নিজেই দূর্বল হয়ে যাচ্ছি। ও বারবার এমন করলে এক সময় যদি বলে দেই আমার কোনো সমস্যা নেই দুই পরিবার মানলে।’
– ‘দুই পরিবার মানবে কীভাবে? তুমি তার বয়সে বড়ো৷’
– ‘এটা ওকে আমি আর বুঝাতে যেতে পারব না চাচা। আপনি ব্যাপারটা বুঝুন। আমার বয়সও তো ভুল করার। অলরেডি বলেছি সবাই রাজি থাকলে অনিককে আমার বিয়ে করতে সমস্যা নেই। তারপরও আপনি ওকে বুঝাতে বলছেন? আমার মনে হয় আপনি একদিন আমাদেরকে নিয়ে এক সঙ্গে বসে বুঝান। আমার আব্বা অসুস্থ। আম্মা তো আছেন। আপনি, নাঈম ভাই আছেন। সবাই বসে তাকে বুঝান। আমাকেও একা বুঝিয়ে লাভ কী। ব্যাপারটা এখন সিরিয়াসলি নেন।’
– ‘তা তো নিতে হবে মনে হচ্ছে। তুমি ওকে যদি বলে দাও সবাই রাজি থাকলে তোমার বিয়ে করতে আপত্তি নেই। তাহলে তো ঝামেলা হবে মা। আর তুমিই বা বয়সে ছোট ছেলেকে কীভাবে বিয়ে করতে আপত্তি নাই বলছো।’
– ‘চাচা আমার লজ্জা লাগছে এগুলো নিয়ে কথা বলতে। আসলে আমি নিজেই ওকে তাড়িয়ে দিয়েছি। চ*ড় মেরেছি। কিন্তু ও বারবার পাগলামি করায়। এত বছর পর এখন আর আমার কাছে ছোটো মনে হয় না৷ তবুও চাচা আমি ওকে বলিনি কিছু। আপনারা তাকে বুঝাতে পারলেই হবে।’
– ‘আমাকে বলেছো মা খুশি হয়েছি। এজন্যই তোমাকে এত পছন্দ করি। আমাকে সময় দাও। ভাবতে দাও বিষয়টা। ওকে তুমি বলতে যেও না আবার দুই পরিবার রাজি থাকলে বিয়েতে তোমার সমস্যা নেই।’
– ‘আচ্ছা চাচা, রাখি তাহলে।’
পদ্য ফোন রেখে অনিককে বললো, ‘পানির বোতলটা দাও, বাবা এত লজ্জা লাগছিল। আমার বুক ধড়ফড় করছে।’
– ‘একদম পাক্কা অভিনেত্রী তো তুমি। আমি তোমাকে শিখিয়ে দিচ্ছিলাম কেন বুঝলাম না। তুমি তো আমাকেও বোকা বানিয়েছিলে। এখন আমার বাপকেও।’
পদ্য পানি মুখে নেয়ার আগে হেঁসে বললো, ‘দাঁড়াও হাসলে পানি খেতে পারবো না।’
– ‘আচ্ছা খাও।’
পদ্য পানি খেয়ে বললো, ‘এখন উনি কী করবেন?’
– ‘জানি না। আব্বা কিন্তু তোমাকে দিয়ে যে কাজটা করেছিল সেটা খুবই ইউনিক। এবং কাজও হয়েছিল। এতটা বছর আমরা আলাদা ছিলাম। অন্য বাবারা ওইদিনই হাউকাউ করতো৷ কিন্তু উনি এমন কাজ করেছে কেউ জানে না, আবার আমাদের আলাদাও রেখেছে৷’
– ‘ভয় করছে আমার।’
‘ভয় পেও না তো, যাই ড্রাইভারকে ডেকে আনি’ বলে অনিক নেমে গেল গাড়ি থেকে।
.
__চলবে…
লেখা: জবরুল ইসলাম