উইন্ডোজ সিটে বসে বাইরে তাকিয়ে ছিল কল্লোল।ফ্লাইট টেইক অফ করতেই কেউ একজন তার হাতটা খামচে ধরে।পাশে তাকাতেই দেখতে পায় একটা মেয়ে শক্ত করে চোখ চেপে তার হাত ধরে বসে আছে।পনেরো ষোলো বছর বয়স হবে হয়তো, বাচ্চা মেয়ে বলা যায়।মেয়েটার অবস্থা দেখে মুচকি হেসে দেয় কল্লোল।শ্রেয়া যদি জানতে পারে ফ্লাইটে কোনো মেয়ে তার হাত ধরে বসেছিল তাহলে আর রক্ষা নেয় ভেবেই মেয়েটার দিকে আবার তাকায় কল্লোল।
মেয়েটা এখনো ভয়ে চোখ বন্ধ করেই আছে, মনে হচ্ছে একটু কাপছেও।কল্লোল কিছু একটা ভেবে বা হাতটা মেয়েটার হাতের উপর রেখে বলল,
-” ইটস অল ওকে নাউ,ইউ ক্যান ওপেন ইউর আইস।”
ভারী পুরুষ কন্ঠ শুনে পুতুল ফট করে চোখ খুলে তাকায়।একটা ছেলে দেখে মনে হচ্ছে অর্ক ভাইয়ার বয়সী, তার দিকে হেসে তাকিয়ে আছে।পুতুল কিছু না ভেবেই তার দিকে তাকিয়ে বলল,
_” ভাইয়া আমি একটু তোমার হাতটা ধরে থাকি আমার ভীষণ ভয় লাগছে,প্লিজ ভাইয়া প্লিজ।”
মেয়েটার নিঃসংকোচ কথায় আর তুমি করে বলায় কল্লোল অবাক হলেও মাথা নেড়ে হ্যা জানালো।
জীবনে প্রথম পুতুল একলা একলা কোথাও যাচ্ছে। মাম্মা, খালা মনি, অর্ক ভাইয়া ছাড়া সে তো রাস্তাটাও পাড় হতে পারে না, ভেবেই কান্না পাচ্ছে পুতুলের। প্রিয়ন্তিকা জামান, ডাক নাম পুতুল বয়স সতেরো।মায়ের ডায়েরি থেকে জানতে পেরেছে বাবাই তাকে পুতুল নামটা দিয়েছে।বাবা সেনাবাহিনীর স্পেশাল অফিসার ছিলেন একটা মিশনে গিয়ে না ফেরার দেশে চলে যান।মা বাবাকে ভীষণ ভালবাসতেন তাই তার মৃত্যুতে ভীষণ শক পান, অভিমান করে বাবার সকল স্মৃতি ত্যাগ করে পুতুলকে নিয়ে ভিনদেশে চলে আসে।এক বছর বয়স থেকে পুতুল মায়ের সাথে নিউইয়র্কে থাকে।মাম্মা, খালু, খালামনি আর অর্ক ভাইয়াকে নিয়েই তার পৃথিবী।কিন্তু স্থানীয় একটা মাফিয়ার জন্য তার পৃথিবীটা থমকে গেছে। তাই মাম্মা বাধ্য হয়ে তাকে তার জন্মভূমি বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিয়েছে তার বড় চাচুর কাছে। সে তো জানতোই না তার একটা চাচু আছে।এয়ারপোর্টে আসার সময় মা তাকে চাচু ও চাচির ফটো দেখিয়েছে।
বাংলাদেশ এয়ারপোর্টে পৌঁছে কল্লোলকে বিদায় দিয়ে এগিয়ে যায় পুতুল।ভাইয়াটাকে বেশ ভালো লেগেছে পুতুলের একদম অর্ক ভাইয়ার মতো হাসির কথা বলে।এসব ভেবে সামনে আগাতেই একটা ডাক শুনে দাড়িয়ে যায় পুতুল।
_” পুতুল মামুনি” বলে একজন আর্মি ড্রেস পড়া মধ্য বয়সী লোক কাছে এসেই তাকে জড়িয়ে ধরে টুপ করে মাথায় চুমু একে দেয়।
বাবার আদর কী এমন হয়? বাবা থাকলে কী তাকে এভাবেই আদর করতো নাকি আরো অনেক বেশি আদর করতো?ভেবেই টলটলে চোখে নিয়ে পুতুল বলল,
_” বড় চাচু ”
_”বড় চাচু নয় বড় আব্বু, চলো তোমার বড়ো আম্মু ওয়েট করে আছে, চলো।” বলেই মি. মাহবুব জামান খান পুতুলের হাত ধরে এগিয়ে যান।
গেইট দিয়ে ভেতরে আসতেই অসংখ্য ফুলগাছ ভর্তি বাগান পেরিয়ে দুই তলার একটা শুভ্র শাদা বাড়ির সামনে এসে বড় আব্বু গাড়ি থামিয়ে পুতুলের হাত ধরে ভিতরে যায়। ভেতরে আসতেই বড় আম্মু তার দিকে এগিয়ে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
_” আমার মিহিরের পুতুলটা কতো বড়ো হয়ে গেছে।”
বলেই পুতুলকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দেন। বাবার নাম শুনে পুতুলের মন খারাপ হয়ে যায়।তখনই একটা তের চৌদ্দ বছর বয়সী মেয়ে এসে বলল,
_” আম্মু সরো তো, পরে কেদো।” বলেই পুতুলকে ছাড়িয়ে নেয়। কিছুক্ষণ পুতুলের দিকে তাকিয়ে থেকে জোরে বলে উঠে,
_”ওহ মাই গড!!আব্বু, তুমি তো সত্যিই একটা বারবি ডল এনেছো।”বলেই বাবাকে জড়িয়ে ধরে।তারপর আবার পুতুলের কাছে এসে বলল,
_”পুতুল আপু আমি তোমাকে একটা চুমু খায়?” বলেই উত্তরের অপেক্ষা না করে পট করে পুতুলের গালে চুমু একে দেয়।
পুতুলের বেশ লজ্জা লাগছে,তখনই বড় আম্মু বলল,
_” ছন্দ আপুকে ছাড়ো, অনেক জার্নি করে এসেছে ফ্রেশ হয়ে খাবে এখন।” মায়ের কথা শুনে ছন্দ বলল,
_” আচ্ছা আম্মু আমি আপুকে আপুর ঘরে নিয়ে যায়।”
বলেই পুতুলের হাত ধরে নিয়ে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠতে উঠতে বলল,
_”তুমি এসে খুব ভালো হয়েছে আপু, আমার একটা সঙ্গী হলো।আম্মু তো সারাদিন বই পড়ে পড়ে মাথা নষ্ট করে,আব্বু তো বাসায়ই থাকে না আর ভাইয়ার কথা তো বলবোই না,হুহ।” বলতে বলতে একটা রুমে এসে বলল,
_”এই নাও আপু এটাই তোমার রুম, আসলে এটা ছোট বাবা আর ছোট মায়ের রুম। তোমার রুমে ভাইয়া জিম করে ওটাই অনেক হাংকি পাংকি জিনিস রেখেছে, ভাইয়া আসলে ঠিক করে দেবে।আপাতত এটাই তোমার রুম।”
ছন্দকে বেশ পছন্দ হয়েছে পুতুলের, কি সুন্দর একটু সময়ে তাকে আপন করে নিয়েছে।আপন করে নেবে কেন সে তো তার আপনই তার বোন ভেবেই তার অন্যরকম ভালো লাগছে।পুতুলকে চুপ থাকতে দেখে ছন্দ মন খারাপ করে বলল,
_” আপু তুমি কি রাগ হচ্ছো, এই যে আমি এতো কথা বলছি বলে?” ছন্দর কথা শুনে পুতুল এতক্ষণে কথা বলল,
_”না না আমি রাগ করিনি, আমি কি তোমাকে একবার জড়িয়ে ধরতে পারি?”
পুতুলের কথা শুনে ছন্দ ফট করে তাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
_” অবশ্যই ধরতে পারো একশো বার ধরতে পারো।”
খাবার টেবিলে বসে পুতুল ঠিকমতো খাচ্ছে না কিছু হয়তো বলতে চাইছে দেখে মিসেস মুধুমিতা মাহবুব (বড়ো আম্মু) পুতুলের মাথায় হাত রেখে বলল,
_” মামুনি তুমি কি কিছু বলতে চাইছো?”
_” আসলে বড়ো আম্মু মাম্মা পৌঁছে জানাতে বলেছিল আমার তো ফোন নেই মানে…”
_ ” পাগলি কোথাকার, এই কথা বলতে এতো সংকোচ করছিলে।এটা তোমার বাড়ি যখন যা লাগবে আমাকে বলবে কোনো সংকোচ ছাড়া,ঠিক আছে?”
পুতুল মাথা নেড়ে আচ্ছা বলে।
খাবার শেষে মাম্মার সাথে কথা বলে নিজের রুমে চলে আসে পুতুল।বাবা মায়ের আর নিজের ফটোগুলোতে হাত বুলিয়ে দেখছে পুতুল।বড় হয়ে কখনো মাকে এই ছবিগুলোর মতো হাসতে দেখেনি।প্রায় রাতেই ডায়েরি থেকে বাবার ছবি নিয়ে কাঁদতে দেখেছে সে। সেনাবাহিনীর প্রফেশন ভীষণ অপছন্দ করেন।মায়ের ধারণা এই প্রফেশনটার জন্য বাবা তাকে ছেড়ে গেছে।অবশ্য পুতুলেরও তাই মনে হয়। কথাগুলো ভেবে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পুতুল।
বিছানায় শুয়ে কিছুতেই ঘুম আসছে না পুতুলের, সতেরো বছরে কখনো মাকে ছাড়া ঘুমই নি।একলা ঘরে থাকারও অভ্যাস নেই তাই ভয়ে বাতি জ্বেলেই ঘুমানোর চেষ্টা করছে। সারদিনের ক্লান্তিতে একসময় ঘুমিয়ে যায় পুতুল।
——————————————————–
স্পেশাল আর্মি ফোর্সে ক্যাপ্টেন হওয়ায় সূর্যকে যখন তখন মিশনে বাইরে থাকতে হয়।প্রায় উনিশ দিন পরে বাড়িতে এসেছে সে।মেইন ডোরের সামনে দাড়িয়ে ঘড়িটা দেখে নিল সূর্য।রাত দেড়টা বাজে দেখে কাঁধের ব্যাগপ্যাকটা নিচে রেখে পকেট হাতড়ে একটা চাবি বের করে দরজা খুলে ভেতরে যায়।সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে ছোট বাবার রুম ক্রস করতে রুমে আলো দেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।বাবা নিশ্চয় আবার কাঁদছে, ভেবেই নিজের রুমে চলে আসে।
একঘন্টা ধরে গোসল করে একটা ব্লু থ্রি কোয়াটার প্যান্ট পড়ে মাথা মুছতে মুছতে বের হয় সূর্য। তোয়ালেটা কাঁধে ঝুলিয়ে রুম থেকে বের হয়ে সোজা কিচেনে গেল।ফ্রিজ থেকে ইচ্ছে মতো কারি ও ভাত নিয়ে ওভেনে গরম করে খেয়ে নেয়।রুমে আসায় সময়ও ছোট বাবার রুমে আলো দেখে মন খারাপ হয়ে যায়।শব্দহীন পায়ে এগিয়ে দরজাটা হালকা খুলে বাবাকে দেখার চেষ্টা করে সূর্য।
চলবে
আমার স্নিগ্ধ নক্ষত্র গল্পটা পরে লিখবো।ছুয়ে দেখো আমার শহর এটাই বেশি ভোট পেয়েছি তাই আগে লিখলাম☺☺।আর পারলে সবাই মেলা মেলা করে লাইক দিয়েন যাতে আমি বিখ্যাত হইতে পারি 🙈🙈। (আবারও দিলাম নতুন করে)
#ছুয়ে_দেখো_আমার_শহর
#লেখিকা_হৃদিতা_আহমেদ
পর্ব-১