#জনৈক_প্রেমিক
পর্ব- ০৭
পরদিন সকাল আটটা বাজেই শ্রাবণ চলে যাবার জন্য বায়না উঠালেন। আমি তখন সবে হাত-মুখ ধুয়ে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়েছি। শ্রাবণ এসে বললেন, ‘হৃদি রেডি হয়ে নাও। আমরা এখনি বেরোবো।’
কী ব্যাপার! কাল রাতের অপমান কি উনি ভুলে গেছেন? গত রাতের ঘটনার পর তো ওনার মতো আত্নবাদী, দাম্ভিক ব্যাক্তির কাছ থেকে এমন স্বাভাবিক ব্যবহার আশা করা যায় না!
উনি নিজে যেহেতু স্বাভাবিক আছেন তাই আমি আর ব্যাপারটাকে ঘাটালাম না। আমিও অবিকৃত ভাবেই বললাম, ‘আমি যাবো না।’
উনি সহসা আমার দিকে এগিয়ে আসতে লাগলেন। ওনার কথার অবাধ্য হয়েছি বলে কি মারবেন এখন? আমি কয়েক কদম পিছিয়ে গেলাম। উনি অকস্মাৎ দ্রুত পায়ে এগিয়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। আমি ওখানেই জমে গেলাম।
শ্রাবণ ওভাবেই জড়িয়ে ধরে আমার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন, ‘এত দিন ধরে রাগ করে থাকতে হয় না, বউ! গতকাল রাতে এত করে বললাম আমার সাথে যেতে! শুনলেনা কেন? সত্যিই অনেক জরুরী কথা ছিল!’
আমি কখনো ওনাকে এত নরম গলায় কথা বলতে শুনিনি। যারপরনাই অবাক হলাম!
কথা শেষ করে শ্রাবণ আচমকাই আমার কপালে চুমু খেলেন। এরপর হেসে বললেন, ‘থাক! বাড়িতে ফিরেই নাহয় বলব সব! এখন ফাস্ট ফাস্ট রেডি হয়ে নাও তো! মা, শ্রেয়া তোমার পথ চেয়ে বসে আছে। সকাল থেকে তিনবার ফোন করে জিজ্ঞেস করে ফেলেছে আমরা কখন ফিরছি!’
শ্রাবণ চলে গেলেন। কিন্তু আমি ঘোরগ্রস্তের মতো পাথরের মূর্তির ন্যায় ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম।
আমার সংবিৎ ফিরল রিহার ডাকে। ‘কী ভাবছিস? ফিরে যাবি ওনার কাছে?’
আমি চমকে উঠলাম। ‘ইমপসিবল! কখনোই না!’
.
টেবিলে নাস্তা খেতে বসেছি। শ্রাবণের খাবার মা রিহাকে দিয়ে আমার রুমে পাঠিয়ে দিয়েছে। সে একা রুমে বসেই খাক।
রিহা খাবার দিয়ে এসে বলল, ‘এই দেখ আপু!’
তাকিয়ে দেখলাম ওর হাতে দু’টো ক্যাডবেরি। জিজ্ঞেস করলাম, ‘কে দিয়েছে?’
রিহা বিরক্তি নিয়ে বলল, ‘তোর সো কল্ড হাজবেন্ড! অসহ্য!’
আমি হেসে বললাম, ‘এতই যখন অসহ্য তাহলে নিলি কেন?’
রিহা রেগে বলল, ‘নেব না তো কী করব?’ পরক্ষণেই রাগ মাখা মুখটাকে হাসি মুখে রূপান্তরিত করে ফেলল, ‘ ক্যাডবেরি যে আমার জীবন!’
‘শয়তান!’
রিহা আবার বলল, ‘তোর হাসবেন্ড তোকে যেতে বলেছে ও ঘরে। তোকে ছাড়া না কি খাবে না!’
আমি বিতৃষ্ণা নিয়ে বললাম, ‘বারবার তোর হাজবেন্ড তোর হাজবেন্ড করবি না তো! না খেলে না খাক! আমার তাতে কী যায় আসে।’
বাবা টেবিলে এসে বসলেন। রিহা, আমার দুজনেরই খাওয়া হয়ে গেছে। অকারণেই বসে ছিলাম। বাবা মুচকি হেসে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আমার মায়েরা খেয়েছে?’
আমরা দুজনেই মাথা নেড়ে ‘হ্যা’ বললাম।
.
শ্রাবণ সত্যি সত্যিই খাবার ছুঁয়েও দেখেননি। রিহা প্লেট আনতে ওঘরে গিয়ে দেখে খাবার ওমনিই পড়ে আছে। রিহাকে দেখে শ্রাবণ জিজ্ঞেস করেন, ‘তোমার বোনকে বলেছিলে রিহা?’
রিহা বলে, ‘হ্যা। আপু আসবে না।’
শুনে শ্রাবণ রিহাকে বলেন, খাবারগুলো নিয়ে যেতে। সে খাবে না।
রিহা এসে এসব জানালো আমাকে। এরপর জিজ্ঞেস করল, ‘লোকটা এমন করছে কেন রে আপু?’
‘জানিনা!’ বলতেই দেখলাম শ্রাবণ এদিকেই আসছেন। রিহা ওনাকে আসতে দেখে বলল, ‘দেখ আপু, তোকে খুঁজতে শেষমেশ এ ঘরেও এসে পড়ল।’
একদম ফরমাল ড্রেসআপে হাজির হয়েছেন তিনি। নিশ্চয়ই এসে এখন আমাকে আদেশ করবে, বাসায় চলো!
বলতে না বলতেই উনি বলে উঠলেন, ‘চলো হৃদি!’
তখনি দেবদূতের মতো বাবা এলেন। উচ্ছল কন্ঠে শ্রাবণকে বললেন, ‘এই গরিবের ঘরে একদিন থাকলে সেজন্যে আমি আর হৃদির মা দুজনেই খুব খুশি হয়েছি। ‘
শ্রাবণ বলতে নিলেন, ‘আমিও খুশি হয়েছি বা..!
কিন্তু বাবা তাকে মাঝপথেই থামিয়ে দিলেন। ‘এবার তুমি আসতে পারো, বাবা!’
শ্রাবণ হয়তো কিছু বুঝতে পারলেন না। বললেন, ‘ আপনার কথা আমি ঠিক বুঝলাম না, বাবা!’
বাবা নম্র অথচ শীতল গলায় বললেন, ‘হৃদি আর কখনো ও বাড়িতে যাবে না!’
শ্রাবণ একবার আমার দিকে তাকিয়ে পুনরায় বাবার দিকে তাকালেন। দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আমি কী কোনো ভুল করেছি?’
বাবা শ্রাবণের প্রশ্নের জবাব দিলেন না। হয়তো প্রয়োজন বোধ করলেন না দেওয়ার!
শ্রাবণ আবার বললেন, ‘বাবা, আমি সত্যিই বুঝতে পারছি না কী দোষ করেছি! তবুও বলছি প্লিজ আমাকে ক্ষমা করে দিন! মা আমাদের অপেক্ষায় বসে আছে আমাদের যেতে দিন!’
বাবা এবার রূঢ় হলেন, ‘হৃদি তোমার সঙ্গে যাবে না! তুমি নিজে যেতে পারো। ‘
শ্রাবণ হঠাৎ একরোখা কন্ঠে বলে উঠলেন, ‘আমি আমার স্ত্রীকে না নিয়ে এক পা ও নড়বো না এ বাড়ি থেকে!’
বাবা বিরক্তি প্রকাশ করে বললেন, ‘হৃদি নিজেই যেতে চায় না তোমার সঙ্গে। তুমি ওকেই জিজ্ঞেস করে দেখো!’
শ্রাবণ আমার দিকে দৃষ্টিপাত করে অত্যন্ত মোলায়েম গলায় বললেন, ‘আমার সঙ্গে যাবে না হৃদি?’
আমি না সূচক মাথা ঝাঁকালাম।
এটাই আমার জন্য কাল হল।
শ্রাবণ বাবার সামনেই ঘরের কোনে রাখা লোহার টুলটা তুলে নিয়ে ক্ষীপ্র গতিতে শোকেসের দিকে ছুড়ে মারলেন। টুলটা শোকেসের কাঁচ ভেঙেই ক্ষান্ত হল না। ভেতরে সাজিয়ে রাখা কাঁচের কাপ-পিরিচ, প্লেটসহ সবকিছু গুড়িয়ে দিল। অক্ষত রইল মাত্র হাতে গোনা কয়েকটা জিনিস।
আমার চোখ ফেটে জল চলে এল। আমরা নিম্ন মধ্যবিত্ত। মায়ের বহুদিনের শখ ছিল একটা শোকেসের। বাবা গতবছর বহু কষ্টে মায়ের সে শখ পূরণ করতে পেরেছেন। আজকে এক মুহূর্তেই সব শেষ হয়ে গেল। অমানুষটা সব শেষ করে দিল। একটাবার ভাবল না আমাদের পরিবার যে তাদের মতো ধনী নয়। একটাবার চিন্তা করল না তার মতো আজ একটা নষ্ট করলাম তো কাল তিনটা হাজির হবে এমনটা যে আমার বাবার সামর্থ্য না।
শ্রাবণ অগ্নি দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন। কিন্তু তাকানোর সাথে সাথেই সে দৃষ্টি পরিবর্তিত হল অনুতাপে। হয়তো আমার চোখের জল দেখেই! তবে এখানে আর দাঁড়িয়ে থাকলেন না। বরাবরের মতো গটগট করে হেঁটে চলে গেলেন অগ্নিশর্মা হয়ে।
.
আমি ভেবেছিলাম হয়তো ওখানেই সব শেষ হয়ে গেছে। প্রখর দাম্ভিকতায় ভোগা শ্রাবণ আর কখনো আমাকে ফিরিয়ে নেবার কথা দুঃস্বপ্নেও ভাববেন না। কিন্তু আমাকে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে বিকেলেই তিনি আমার শ্বাশুড়ি মা’কে নিয়ে এ বাড়িতে এলেন।
মা আর পাঁচটা সাধারণ মেহমানদের মতোই আপ্যায়ন করল আমার শ্বাশুড়ি মা’কে। এই ফাঁকে রিহা গিয়ে বাবাকে দোকান থেকে ডেকে নিয়ে এল। আমার শ্বাশুড়ি মা আমার বাবা-মায়ের সঙ্গে আলোচনায় বসলেন। কেন তারা তাদের মেয়েকে তাদের জামাইয়ের সঙ্গে শ্বশুর বাড়ি পাঠায়নি!
বাবা তবু বিচলিত হলেন না। ঠান্ডা মাথায় সব কথা বলতে লাগলেন। ‘দেখুন আপা, আপনি আর আপনার মেয়ে অত্যন্ত ভালো মানুষ। আপনাকে আমি মন থেকেই শ্রদ্ধা করি। কিন্তু আপনার ছেলে মোটেও আপনাদের মতো নয়। সে অতি জঘন্যরকমের খারাপ একজন মানুষ। আমি যদি আগে ঘুনাক্ষরেও টের পেতাম তাহলে কখনোই অমন ছেলের কাছে আমার মেয়েটাকে তুলে দিতাম না!’
নিজের ছেলের স্বমন্ধে ছেলের শ্বশুরের নেতিবাচক মনোভাব দেখেও মা রাগ করলেন না। মুখের মুচকি হাসি বজায় রেখেই বললেন, ‘ভাই, আপনি যদি আমার ছেলের অপরাধটা একটু খুলে বলতেন!’
বাবা বললেন, ‘আপনার ছেলের অপরাধ হচ্ছে সে প্রচন্ড বদমেজাজী আর রাগী প্রকৃতির মানুষ। বিয়ের দিনই সে সকলের সামনে নিজের সদ্য বিয়ে করা স্ত্রীকে চড় মেরেছে। শুধু তাই নয়, আজ সকালে হৃদি তার সঙ্গে যাবে না বলে ও ঘরের শোকেস ভেঙে গুড়িয়ে দিয়েছে।’
মুহূর্তেই আমার শ্বাশুড়ি মায়ের হাসি মুখটা গম্ভীর হয়ে গেল। তিনি হয়তো ভাবতেই পারেননি ছেলের শ্বশুরের কাছ থেকে ছেলের নামে এসব কথা শুনবেন।
শ্রাবণ চেয়ারগুলোর পেছনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিলেন। উনি উঠে দাঁড়িয়ে শ্রাবণের সামনে গেলেন। গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুই হৃদিকে চড় মেরেছিলি? ‘
শ্রাবণ শান্ত স্বরে জবাব দিল, ‘হ্যা।’
মা তৎক্ষনাৎ শরীরের সমস্ত শক্তি এক করে শ্রাবণের গালে চড় বসিয়ে দিলেন। শ্রাবণ লজ্জায়, অপমানে মাথা নিচু করে ফেললেন। মা আবার জিজ্ঞেস করলেন, ‘হৃদিদের শোকেস ভেঙেছিস?
শ্রাবণ সামান্য তাকিয়ে অতি নিম্ন স্বরে বললেন, ‘হ্যা!’
মা পুনরায় শ্রাবণকে চড় মারলেন। শ্রাবণের কী হল জানি না উনি পাগলের মতো আমার সামনে ছুটে এলেন। প্রায় থাবা দিয়ে আমার দু’হাত নিজের দু’হাতের মুঠোয় নিয়ে নিলেন। প্রলাপের মতো বললেন, ‘এবার আমার সঙ্গে যাবে তো হৃদি!’
আমার শ্বাশুড়ি মা বাবার সামনে হাতজোড় করে বললেন, ‘আমার ছেলের পক্ষ থেকে আমি ক্ষমা চাইছি ভাই! পারলে আমাদের মাফ করবেন!’
বাবা অতি ব্যস্ত হয়ে বললেন, ‘ওভাবে বলবেন না আপা! এতে তো আপনার কোনো দোষ নেই! আপনি কেন এভাবে হাত-জোড় করছেন!’
মা ঝটকা দিয়ে আমার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে শ্রাবণকে বললেন, ‘তুই কোন অধিকারে ওর হাত ধরিস?’
এরপর আমার দিকে তাকিয়ে হাতজোড় করতে নিতেই আমি খপ করে মায়ের হাত ধরে নিলাম। ‘মা প্লিজ আপনি এমন করবেন না!’
মা আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। ‘পারলে আমাদের ক্ষমা করিস মা! ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে তোকে আমরা কখনো জোর করবো না! তুই যে ডিসিশন নিবি সেটাই আমরা মেনে নেব। কিন্তু একটা কথা মনে রাখিস, তোর এ মায়ের দরজা আজীবন তোর জন্য খোলা থাকবে।’
আমার কান্না পেয়ে গেল। কারো শ্বাশুড়ি মা এতো মমতাময়ী, এতো ভালো হয়! বুঝতেই পারলাম না কখন গাল বেয়ে অশ্রু ঝরছে! মা আমার চোখের জল মুছে দিয়ে বললেন, ‘ভালো থাকিস মা!’
চলবে…
লেখা: #ত্রয়ী_আনআমতা
(