#টক_ঝাল_মিষ্টি (পর্ব ৬)
নুসরাত জাহান লিজা
শফিক আঙ্কেল আসার আগে আগে অনিকেত নিজেই লাবণ্যর সবকিছু টেনেটুনে নিজের রুমে নিয়ে এসেছে, ঘ্যানঘ্যান করতে হয়নি। তিনি যেদিন এলেন সেদিন রাতে খাবার টেবিলে হুট করে জিজ্ঞেস করে বসলেন,
“তোদের টোনাটুনির সংসার কেমন চলছে রে?”
দুজনেই একই সময়ে একই সুরে গলা মিলিয়ে বলল, “ভালোই তো..”
মাছের কাঁটা ছাড়াতে ছাড়াতে শফিক আঙ্কেল বললেন, “কিন্তু তোরা এতদিনেও এমন আপনি আপনি করে ফরমালি কথা বলছিস, আসার পর থেকেই দেখছি কেমন আড়ষ্ট হয়ে আছিস! এতদিনেও সহজ হতে পারিসনি বলেই মনে হচ্ছে!”
অনিকেত চোখ নামিয়ে বলল, “মামা, তেমন কিছু নয়। আসলে আমরা তো আগে থেকে পরিচিত নই। একটু সময় তো লাগবেই নাকি!”
“হ্যাঁ, তা তো লাগবেই। কিন্তু তোরা মনে হয় একটু বেশিই স্লো। এই যুগের ছেলেমেয়েদের জন্য এটা একটু বেশি বেমানান না?” শফিক আঙ্কেলের প্রশ্নে ঘরজুড়ে একরাশ নীরবতা নেমে এলো।
অনিকেত খাওয়ায় হুট করে মনোযোগী হয়ে গেল, লাবণ্য তাড়াহুড়ো করে উঠে বলল, “আমি একটু রান্নাঘরে যাই, দুধ চুলায় দিয়েছি। উপচে না পড়ে আবার।”
এমন বিচক্ষণ একটা মানুষকে ফাঁকি দেওয়া সম্ভব নয়, এর উত্তরে কী বলবে ভেবে না পেয়েই এই পলায়ন।
লাবণ্য চলে যেতেই তিনি অনিকেতকে বললেন, “অনি, এখন বিয়ে করেছিস, ওই প্রান্তের মানুষটার কথাও একটু ভাবিস। ইগো কিন্তু ভয়ংকর জিনিস, সম্পর্ক নষ্ট করার জন্য এর চাইতে ভয়াবহ জিনিস আর একটাও নেই। নতুন সম্পর্কে বেশিরভাগ মেয়েরা একটু আড়ষ্ট থাকে। ওরা মুখ ফুটে অনেককিছু বলে না। যে সম্পর্কে তোরা জড়িয়েছিস তাকে চিরস্থায়ী করতে তোকেই এগিয়ে যেতে হবে। আমি তো সবকিছু তোকে বুঝিয়ে বলতে পারব না, মামা হই তোর। একটু বুঝে চলবি।”
মামাকে এমন গম্ভীর গলায় কথা বলতে অনিকেত কখনো শোনেনি। তিনি হাস্যরসিক মানুষ, মজা করে কথা বলেন সবসময়। অনিকেতকে আগেও প্রচুর ধমকেছেন, কড়া কথা শুনিয়েছেন, কিন্তু সেখানেও রস মিশিয়ে বলতেন। আজ তার এমন রাশভারি গলায় সে কিছুটা বিচলিতবোধ করল।
“মামা, তুমি চিন্তা করো না তো। সব ঠিক হয়ে যাবে।”
“ঠিক হলেই হয়। আমি নিজে উদ্যোগ নিয়ে তোদের বিয়ে দিয়েছিলাম। আমাকে অপরাধী করে দিস না।”
অনিকেতের মনে কোথাও একটু হলেও ধাক্কা দিল কথাগুলো। কিছু বলার জন্য মুখ খুলবে তার আগেই লাবণ্য চলে এলে আর কিছু বলা হয় না। শফিক প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে বললেন,
“তুই তো পাকা ঘরণী হয়ে গেছিস রে লাবণ্য। তোকে আগে কখনো রান্না করতে দেখিনি।”
“আঙ্কেল, আমি টুকিটাকি রান্না করতাম, হলের রান্না খেতে প্রবলেম হতো, নিজের জন্য তখন একটু আধটু করে নিতাম। যদিও রাধুনি হিসেবে খুব একটা ভালো নই। তোমার সুন্দর গাধা তো খেতেই পারে না এই রান্না। রীতিমতো বাতিলের খাতায় ফেলে দিয়েছে।”
“সে কী রে! তো সেই গাধাটা কয়দিন রান্না করেছে?”
অনিকেত রেগে লাবণ্যর দিকে তাকাল, লাবণ্য সেই দৃষ্টিকে পুরোপুরি অগ্রাহ্য করে বলল, “তাহলেই হয়েছে, যে নিজের ঘর ঠিক করে গুছিয়ে…”
নিজের গোপন কথা ফাঁস হয়ে যাচ্ছে বুঝতে পেরে বাকিটা বলার আগেই অনিকেত দ্রুততার সাথে বলে উঠল, “আমাকে রান্না করতে বলছো মামা? রান্না করা আমার কাজ নাকি?”
“কেন হবে না? রান্নাটাও তো অন্য কাজের মতোই একটা কাজ৷ বউ হাত পুড়িয়ে তোর জন্য রান্না করবে আর তুই শুধু বসে বসে খাবি আর খুঁত ধরবি? একটু সাহায্য তো করতে পারিস। আমি কিন্তু তোর মামীকে অনেকবার রান্না করে খাইয়েছি, সাহায্যও করেছি সবসময়।”
লাবণ্য বলল, “সবাই কী আর তোমার মতো হয় আঙ্কেল? এসব কষ্ট অনেকের চোখেই পড়ে না।” অনিকেতের দিকে তাকিয়ে উত্তর দেয় লাবণ্য।
“গাধা পিটিয়ে ঘোড়া বানানোর চেষ্টা কর লাবণ্য, নইলে গাধা গাধাই থাকবে।”
“এবার থেকে তাই করতে হবে।” হেসে ফেলল লাবণ্য।
অনিকেতের বিশ্বাস করতে কষ্ট হলো এটা তার নিজের মামা কিনা! এভাবে সিংহের কাছে কেউ অসহায় খরগোশের দায়িত্ব দেয়? এই মেয়ে এমনিতেই ওকে নাজেহাল করে চলছে, এবার তো লাইসেন্স পেয়ে গেল, এবার না জানি ঘাড় থেকে মাথাটাই আলাদা করে দেয়! নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে অতিমাত্রায় শঙ্কিত হলো অনিকেত!
***
অনিকেত অফিসে চলে যাবার পরে শফিক লাবণ্যকে কাছে ডাকলেন। এটা সেটা নিয়ে কথা বলার পর হুট করে জিজ্ঞেস করলেন,
“আমার ভাগ্নেটাকে কেমন লাগছে তোর?”
লাবণ্য কী উত্তর দেবে বুঝতে না পেরে তাৎক্ষণিকভাবে বলল, “এত দ্রুত কাউকে জাজ করা যায়?”
“তোকে একটা গল্প বলি, শোন, অনি তখন নাইনে পড়ত, পাড়ার মাঠে ক্রিকেট খেলতে যেত। তখন ওর একটা বন্ধু ছিল, নাম তৌফিক। ওদের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো ছিল না। ছেলেটার বাবার শরীর খারাপ করায় সে পড়াশোনা বাদ দিয়ে ওর বাবার ছোট্ট দোকানে বসতে শুরু করল। অনি অনেক বুঝিয়েও পড়া কন্টিনিউ করাতে রাজি করাতে পারল না। অনি তখন আমার কাছে এসে সব বলে ভেউভেউ করে কেঁদে ফেলল। একটা ছেলে মেধাবী হয়েও পড়তে পারছে না, এটা অনি মানতে পারেনি। ওর এমন আকুলতা দেখে আমি অনেক চেষ্টা করে তৌফিকের জন্য শিক্ষাবৃত্তির ব্যবস্থা করে দেই। দুটো ভালো টিউশনির ব্যবস্থা করে দেই৷ তৌফিক যেদিন স্কুলে যেতে শুরু করল সেদিন অনি যে কতটা খুশি হয়েছিল!”
কিছুক্ষণ থেমে বললেন, “এই যে বন্ধুর জন্য এতবড় একটা ছেলে ভেউভেউ করে কাঁদল, নাছোড়বান্দা হয়ে তার জন্য কিছু একটা করতেই হবে এমন মানসিকতা দেখাল। এটা কয়জন করে বল? কষ্ট হতো, একসময় হয়ত মেনে নিত। ও কিন্তু এটা করেনি। এমন আরও অনেক গল্প আছে। ও যাকে ভালোবাসে তাকে মন থেকেই ভালোবাসে।”
লাবণ্যর মনে অনিকেতের এতদিনের যে ছবিটা ছিল সেটা সহসাই যেন কিঞ্চিৎ হলেও বদলে গেল। কথা খুঁজে পেল না বলার জন্য। তবে শফিক আঙ্কেল তার ভাগ্নের জন্য মনে যে অপরিসীম স্নেহ জমিয়ে রেখেছেন সেটা পুরোপুরি বুঝতে পারল।
“আবার ভাবিস না যে তোকে এসব বলে আমি ওর জন্য তোর মনে সিম্প্যাথি তৈরি করতে চাইছি। এই জিনিসটা অনি পছন্দ করে না। বাইরে থেকে অনেককিছু বোঝা যায় না। একটু বুঝতে চেষ্টা করিস এটুকুই অনুরোধ। ছাই থেকে মুক্তাও বের হতে পারে কে জানে!”
***
শফিক আঙ্কেল চলে যাবার পরে দুজনের আচরণ কিছুটা বদলে গেল। কেউ কারো পিছে লাগল না। যে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছিল তাতে কিছুটা হলেও যেন অলিখিত যুদ্ধবিরতি চলছে। লাবণ্য অনিকেতের রুমেই থাকছে পাঁচদিন ধরে। দেয়াল ঘেঁষে জায়গাটা অনিকেতের কপালেই স্থায়ী হয়ে গেছে। ছেলেটার নাক ডাকার শব্দেও লাবণ্য সমানতালেই বিরক্ত হচ্ছে, কিন্তু কোথাও একটা যেন সহনশীলতার আভাস দু-পক্ষ থেকেই আসছিল। তবে শান্তি বিষয়টা বোধহয় আড়ি নিয়ছে দুজনের সাথে। তাই আসি আসি করেও পুরোপুরি আসতে আর পারল কই! এবার তো শান্তির পথ আরও দুর্গম হলো।
গণ্ডগোলের শুরুটা হলো রাতে খাবার টেবিলে। লাবণ্য বলল, “হল থেকে জিনিসপত্র নিয়ে আসা দরকার।”
“তো আনুন।”
“না, মানে, আমি একা এতকিছু আনতে পারব না। আপনি যদি আমার সাথে একটু আসতেন খুব ভালো হতো।”
অনিকেত গ্লাসে পানি ঢালতে ঢালতে বলল, “ভালোই তো, এখন কুলির কাজ করাই বাকি আছে আমার। এইজন্যই তো বলি, রণরঙ্গিণী থেকে হঠাৎ এত ভদ্র হয়ে গেলেন কেন? এতক্ষণে উদ্দেশ্য পরিষ্কার হলো।”
লাবণ্যর গায়ে লাগলো কথাটা, “আপনি আমাকে সুযোগসন্ধানী বলতে চাইছেন?”
“বলতে চাইছি কী, আপনি তো সেটাই।”
লাবণ্য পানি ভর্তি গ্লাসটা হাতে নিয়ে আচমকা পুরো পানি অনিকেতের মাথায় ঢেলে দিল।
এতদিন ধরে যত কথা কাটাকাটি হয়েছে তাতে কখনো কষ্ট হয়নি। এই কয়দিনে সে সত্যি সত্যি অনিকেতের ভেতরটাকে খোঁজার চেষ্টা করছিল। তাই একটা এক্সপেক্টেশন তৈরি হয়েছিল বোধহয়। এই ছেলে ভালো কথার যোগ্যই নয়। কেন শুধু শুধু নিজেকে ছোট করল। সুযোগ-সন্ধানীর মতো এত অপমানজনক শব্দ হজম করা একদম সম্ভব নয়।
হতভম্ব অনিকেত চোখমুখ চেপে রাগ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে চূড়ান্ত ব্যর্থ হলো। ছোঁ মেরে লাবণ্যর হাত থেকে গ্লাসটা নিয়ে মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলে উঠে চলে গেল। ঝনঝন শব্দে টুকরো টুকরো হয়ে গেল গ্লাসটা।
লাবণ্য নিজের মাথা চেপে ধরে বসে রইল। রাগ আর অপমানে ওর কান্না পেয়ে গেল।
…….
(ক্রমশ)
(আজ কিছুটা ছোট হলো, কাল আরেকটা পর্ব দেব ইনশাআল্লাহ।)