টক্সিক_রিলেশনশীপ পর্ব ২৮

#টক্সিক_রিলেশনশীপ
||২৮তম পর্ব||
-ঈপ্সিতা শিকদার
ভোরের আলো ফুটতে কিছু মুহূর্ত বাকি। হাসনাহেনার মিষ্টি সুভাষে মেতে উঠেছে। বাসন্তী নিদ্রাহীন রাত্রি যাপন করেছে। শুধু ভেবেই গেছে সারাটি রাত। পুরো ছয়টা ঘণ্টা এই বারান্দার অন্ধকারময় পরিবেশে কাটিয়েছে সে। তাকে না স্পর্শ করেছে কোনো ভীতি, না নিদ্রা। গা ছমছমে অনুভূতিও হয়নি আজ তার। মেয়েটাও বেশ বুঝদার হয়েছে, সারাটা রাত্রি একটুও কাঁদেনি।

ভোরের আলো ফুটতেই কী যেন হলো রমণীর কে জানে? যন্ত্রচালিত মানবের ন্যায় নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে ঘরে চলে গেল সে। বহুদিন পর তার পুরাতন ডায়েরিটা বের করল। অনেক বছর ধরেই এই ডায়েরি ছোঁয়া হয় না তার, অযত্নে পড়ে থাকে একসময়কার প্রিয় বস্তুটি৷

সাধারণভাবেই ধুলো জমেছে ডায়েরিটিতে। বাসন্তী হাতে নিয়েই শাড়ির আঁচলে মুছে নেয়। কলম হাতে নিয়ে লিখতে বসে। আগে রোজ লিখত বিয়ের পর আর ধরা হয়নি, অলক্ষ্যেই এক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে।

অপ্রিয় প্রিয়তম,
নামটা অদ্ভুৎ না গায়ক সাহেব? কী করব বলো? তুমি আমার প্রিয়তম তা সত্য, তবে আজ জীবনের এ পর্যায়ে অপ্রিয় মানুষও বড়ো তুমি।

মনে আছে যেদিন প্রথম দেখেছিলাম তোমায়। লম্বাটে গম্ভীর মুখের এক পুরুষ, যার সুগভীর নীলচে আঁখিজোড়ায় চোখ রাখার সাহস আমার ছিল না।

তুমি যখন ডেকেছিলে, আমি তিরতির করে কাঁপছিলাম ভয়ে। বড্ড ভীতু, সাহসহীন, হীনমন্যতায় জর্জরিত কিশোরী ছিলাম যে আমি। ভাবলাম কী না কী ভুল করে ফেললাম আমি, যার জন্য শাস্তি দিতে ডাকছে আমায় অজানা এক যুবক। তোমার কণ্ঠটাও ছিল তেমন রাগী, রসকষহীন, গম্ভীর।

ভীতিগ্রস্ত, কম্পিত দেহ নিয়েই তোমার দিকে এগিয়ে গিয়েছিলাম। তুমি জিজ্ঞেস করলে, আমাকে তুমি চিনো? আমি হলাম কি না অভাগিনী আশ্রিতা। এসব রেডিও-টেডিও শোনার ক্ষমতা কই আমার?
এতক্ষণ তো শুধু কম্পন সৃষ্টি করেছিলে তুমি, আর তোমার নিকট যেতেই বাকশক্তিও বন্ধ হয়ে গেল। কারণ তোমার এই প্রশ্ন করার মাঝে কিছু একটা ছিল, যা আমাকে ছুঁয়ে ছিল। অতঃপর ইশারাতেই বুঝালাম চিনি না।

তুমি অদ্ভুৎ দৃষ্টি তাকালে কয়েক মুহূর্ত। তারপর পা থেকে মাথার চুল অবধি একদফা আমাকে পর্যবেক্ষণ করলে। তুমি হয়তো জানো না, সেদিন স্পর্শ ছাড়াই তুমি ছুঁয়ে ছিলে আমায়। জানো অতটা গভীর ভাবে কেউ স্পর্শ দিয়েও যে ছুঁতে পারে তা-ই আমি জানতাম না। অথচ, তুমি শুধু দৃষ্টিতেই সেভাবে ছুঁয়েছিলে আমায়। আমার দেহের প্রতিটি লোম লোম সেদিন পুলকিত হয়েছিল। নিজ হৃদয়ের ধকধকানি নিজ কানে শুনেছিলাম। সারাটা রাত নিদ্রাবিহীন কাটালাম, শুধু এপিঠ-ওপিঠ করেই রাত এগারোটা থেকে ভোর পাঁচটা অবধি পাড় করেছিলাম।

এর দুদিন পর স্কুল থেকে বাড়ি ফিরার জনমানবহীন পথে আবার তোমার দেখা। আমি লজ্জায় মাথা নুয়ে চলে যেতে নিলাম। তুমি হাত ধরে আটকালে। আমি হাত ছাড়াতে ছাড়াতে রাস্তার দিকে তাকিয়ে বললাম,
“কী করছেন? ছাড়েন প্লিজ। কেউ দেখলে খারাপ ভাববে।”

তুমি তো ছাড়লেই না, বরং বক্ষে মিশিয়ে নিলে আমায়। আবেগ-অনুভূতির সুখময় যন্ত্রণায় নিপীড়িত হলাম আমি। তুমি বাঁকা হেসে বললে,
“পুড়তে না জানলে কেন এই যুবককে পোড়ালি কেন পিরিতের আগুনে কিশোরী? এই যৌবনা হৃদয়ের দহনে যে এবার তোকেও পুড়তে হবে গভীর ভাবে।”

তোমার কথায় আমার হৃদয়ে আবেগ হতে সঞ্চার হয়েছিল প্রেমের। সেদিন প্রথম তোমার প্রেমে পড়েছিল। প্রথম উদ্যোগেই আমি আবদ্ধ হয়েছিলাম বলে খুব সস্তা লেগেছিল না তোমার এই বাসন্তীকে? বিশ্বাস করে সস্তা ছিলাম না মোটেও।

কৈশোরে ছিলাম, দিন-দুনিয়ার জ্ঞানহীন ছিলাম, নিঃসঙ্গ ছিলাম, একটু ভালোবাসার জন্য তৃষ্ণার্ত ছিলাম। জীবনে প্রথম এই সবকিছুর বাহিরে যেয়ে আমার প্রিয়জনের অভাব পূরণ হয়েছিল। কেউ আমার সাথে একটু মিষ্টি কথা বলেছিল। কিশোরী মন তখন আবেগাপ্লুত হয়েছিল এতটাই যে ঠিক-ভুল জ্ঞানটাই ভুলে গিয়েছিলাম।

তুমি সেদিন শুধু দামী মোবাইলটাই আমার হাতে গুঁজে দিয়ে যাওনি। আমার হৃদয়ে বুনে দিয়ে গিয়েছিল রঙিন প্রজাপতির ন্যায় রঙ্গিলা স্বপ্ন অজ্ঞাত ভাবেই। এরপর থেকে শুরু হয় আমি তন্দ্রাহীন রাতগুলোর গল্প, তোমার ভালোবাসায় ধীরেধীরে নিমোজ্জিত হওয়ার গল্প, প্রতিটা দিন ধরা পড়ার ভয় নিয়ে তোমার সাথে জুড়ার গল্প।

কী যে বেদনাময় কষ্টকর সুন্দর দিন ছিল তখন! কারণ তুমি অনিন্দনীয় সঙ্গীত শিল্পী হওয়ার সাথে বেশ ভালো অভিনেতাও। একটা বারও বুঝতে দাওনি তুমি আমায় ভালোবাসো না। তুমি ভালোবাসো আমায়, এ ধারণা নিছকই এক ভ্রান্তি আমার। অথচ, আমি এই ভালোবাসা প্রাপ্তির আশায়, ভরসায় নিজ বাড়ি ছেড়েছি। কত কী না সহ্য করেছি!

মনে আছে তুমি একবার এক মেয়ের সাথে বাহিরে যেয়ে ফুচকা খাওয়ায় খুব বকেছিলে আমায়। বাজে ভাষায় বাপ-মা তুলে গালাগাল করতেও পিছপা হওনি। আমি কাঁদতে কাঁদতে চোখ-মুখ ফুলিয়ে ফেলেছিলাম, অভিমানে কথাও বলিনি প্রায় তিনদিন। চতুর্থ দিনই পুনরায় এক অনাকাঙ্ক্ষিত সাক্ষাৎ তোমার, সেই প্রথমদিনের জায়গাটিতে।

আমার হাতজোড়া ধরে বিনতী গলায় বললে, “জানিস তো, প্রেম হলো দিয়া আর বাতির মতোন, বাতি জ্বললে দিয়াকে পুড়তেই হয়।”

আমি তোমার সেই কথা আট বছর পালন করেছি। তোমার সব অন্যায় মুখ বুজে সহ্য করেছি। বিনিময়ে শুধুই আশা করেছি তোমার ভালোবাসা। কতবার মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছি, নিজের মাতৃত্বকে গলা টিপে মেরেছি শুধুই ভালোবাসার জন্য। বিনিময়ে কী পেলাম? ভালোবাসা নামক অভিনয়।

ভালো! বেশ ভালো! জীবনে এবার প্রথম স্বার্থপর হওয়ার মতো শক্ত আবরণে আবৃত হচ্ছে হৃদয়। আমি স্বার্থপর হব! তুমিহীনা ভালো থাকব, সুখে থাকব! ভালোবাসার সাগর যে আজ তিক্ততার বিষে বিষাক্ত।

ইতি,
তোমার বিষক্রিয়ায় মৃত
বসন্ত।

____

এক বছর পর, বাসন্তী গাড়ি থেকে নামছে। উদ্দেশ্য পার্টির অফিসে ঢুকা। তার কোলে ছোট্ট নাহিবা। সে অফিসে ঢুকতেই সবাই সালাম দেয়। বাসন্তী অসৌজন্যমূলক হাসি দিয়ে আসন গ্রহণ করে।

হুট করেই পার্টিতে ঢোকা নতুন এক লোক টিপ্পনী দিয়ে উঠেন,
“আজকাল পার্টির অফিস বাচ্চাদের প্লেগ্রাউন্ড হয়ে উঠেছে। এমন না করে বাসায় বসে বাচ্চা পাললেই তো পারে! এসন সিট-টিট সামলানো মেয়েদের কাজ না কি…”

বাসন্তী বাঁকা হাসে। চোখে চোখ রেখে বলে,
“স্বাভাবিকভাবে একজন মানুষ ৪৫ ইউনিট ব্যথা সহ্য করার ক্ষমতা রাখে। কিন্তু মায়ের জাত নারী জাতিকে আল্লাহ এর অনেক বেশি ইউনিট ব্যথা সহ্য করার ক্ষমতা দিয়েছে। তাহলে সামান্য গদি কী জিনিস? আর আপনার যদি এতই সমস্যা হয় একজন নারীকে ক্ষমতায় দেখে, তবে আপনাকে পার্টি থেকে বের করে দিতে পারি।”

বাসন্তীর কথায় ঘাবড়ে যায় ব্যক্তিটি। শুকনো ঢোক গিলে সে। কিছু বলবে তার পূর্বেই বাসন্তী…

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here