#তবুও ভালোবাসি তোমায়
#লেখিকা-শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-১৯/শেষ পর্ব
ডাক্তার এসে মাথা নীচু করে বলল-
– সরি।
ডাক্তারের মুখে সরি কথাটা শোনে জাহিন সাহেব দাঁড়ানো থেকে মেঝেতে বসে পড়ল। চোখের জল যেন জাহিন সাহেবের উপচে পড়ছে।আয়রার মা চুপ করে বসে আছে। মনে হচ্ছে বুকের ভেতরে একটা পাথর চেপে আছে যেটা নামাতে পারছে না। কাঁদলে হয়তো উনার ভালো লাগত।কিন্তু কাঁদতেও পারছে না। চারদিকে স্বজন হারানোর কান্নার রোল পড়ে গেছে। আনিসা ডায়রিটা হাতে নিয়ে কোনো কথায় যেন বলতে পারছে না। সারা শরীর হিম হয়ে যাচ্ছে তার। সেই সাথে আয়ানের প্রতি থাকা তীব্র ক্ষোভটা যেন বেড়েই চলেছে। আনিসা কোনো কথা না বলেই আয়রার লাশের দিকে ছুটে গেল। আয়রাকে এক নজর দেখে যেন তার কলিজায় বান মারল। মেয়েটা শেষ নিঃশ্বাসের আগেও আয়ান নামক মানুষটার কথা ভেবেছে আর সে আয়ানেই আজকে মেয়েটাকে দেখতে আসেনি। আনিসার রাগটা যেন আরও বেড়ে গেল।হাসপাতাল থেকে বের হয়ে সোজা চলে গেল আয়ানের বাসায়।কলিং বেল চাপতেই এক রমণী দরজা খুলল। রমণীর চোখগুলো বেশ ফোলা।বুঝাই যাচ্ছে সে কেঁদেছে অনেকক্ষণ কেঁদেছে।রমণীকে দেখতে আনিসার চিনতে একদম ভুল হয়নি। এ রমণীই হলো আরশি। আনিসা নিজের রাগটা চেপে ধরতে না পেরে আরশিকে তীর্যক গলায় বলল
– লজ্জা লাগেনি নিজের বান্ধবীর সাজানোর স্বপ্ন ভেঙ্গে সংসার করতে? লজ্জা লগেনি আয়ানের সকল ভুল জানার পরও আয়রাকে কষ্ট দিতে। মেয়েটা আপনাদের সাথে অভিমান করে চলে গেছে জানেন? আজকে আপনাদের মহা খুশির দিন।আয়ান কোথায়? আয়ানকে নিয়ে সিলেব্রেট করুন। মেয়েটা তো আর আপনাদের পথে কাটা হয়ে দাঁড়াবে না। আয়রা অভিমান করে চলে গেছে আর ফিরে আসবে না।
আনিসা কথাগুলো বলার সাথে সাথে আরশি চেঁচিয়ে কাঁদতে লাগল আর বলতে লাগল
– আয়রা কেন একটা বারও বলেনি তার এ অবস্থা। একটাবার তো বলতে পারত সে বড় অসুস্থতায় ভুগতেছে।তাহলে তো তাকে এত কষ্ট পেতে হত না।আমাদের উপর অভিমান করে কেন চলে গেল?
– কোন মুখে আপনাদের সে এসব বলবে? যে কষ্ট আপনারা দিয়েছেন তারপরও সে তার রোগের ব্যাপারে বলে আপনাদের মজার পত্রী হোক এটাই চেয়েছিলেন তাই না?এত মায়া এখন কোথায় থেকে আসে? আগে কোথায় ছিল এত মায়া? ছিঃ লজ্জা লাগে না আপনার। আয়ান কোথায়? আয়ানকে অন্তত কিছু বলতে দিন।
আয়ানের কথা শোনতেই আরশি আরও জোরে কেঁদে উঠল।নিজেকে সামলে নিয়ে বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল।তারপর আনিসার হাতটা চেপে ধরে রুম থেকে বের করল। আনিসা বুঝতে পারছিল না আরশি কী করছে? কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? হাতটা চেপেই গাড়িতে উঠাল। গাড়ি দিয়ে খানিক পথ এগিয়ে একটা হাসপাতালের সামনে নামল।হাতপাতালের একটা বেডের সামনে নিয়ে হাত দিয়ে ইশারা করে বলল
– আয়ান কোথায় জানতে চেয়েছিলে না?
আনিসা নীরব গলায় বলল
– হ্যাঁ।
আরশি হালকা সুরে জাবাব দিল
– ঐ যে আয়ান। বিছানায় শুয়ে মৃত্যুর সাথে লড়ছে। দশ মাস আগে আয়ান জানতে পারে তার ক্যান্সার হয়েছে। বাঁচার সম্ভবনা খুব ক্ষীণ।তখন আয়রাকে সে তার জীবনে জড়াতে চায়নি। আয়ান জানত আয়রা ক্যান্সারের কথা বললে কখনো আয়ানকে ছাড়বে না। তাই আয়রার ভালোর জন্য আয়ান এমনটা করেছে।আয়রাকে সে জুতা দিয়ে আঘাত করেছিল ঠিকেই তবে তার ভেতরের কতটা কষ্ট বয়ে চলেছিল সেটা সে জানে। আয়রাকে সে বিভিন্ন ভাবে অপমান করত। কারণ আয়ান জানত আয়রা আয়ানকে বড্ড ভালোবাসে।আয়ানের উপর আয়রা অনেক দুর্বল ছিল।আয়রার যেন আয়ানকে ছাড়া থাকতে কষ্ট না হয় তাই এ কাজটা করে।
আনিসা তখন অবাক হয়ে বলল
– কিন্তু আপনার সাথে আয়ানের দেখা কীভাবে হয়েছিল? আপনারা তো আগে থেকে কেউ কাউকে চিনতেন না।
আরশি হালকা একটা নিঃশ্বাস নিয়ে বলল
– আমি এ মেডিকেলেই পড়ি। ওয়ার্ডে এসে একদিন আয়ান সাহেবকে দেখলাম। ডায়রিটা খোলা ছিল। সেখানে আয়রার ছবি ছিল। আয়রার ছবি দেখে চিনতে ভুল করলাম না।সাথে সাথে উনাকে জিজ্ঞেস করলাম। উনি সমস্ত ঘটনা খুলে বলল। সেই সাথে আয়রা মুভ অন করতে পারছে না সেটাও বলল। কারন আয়রা আয়ানকে বারবার কল দিয়েই যেত। তাই আয়রার ভালোর জন্য এ সাহায্য টুকু করা। সত্যিই জানতে পারেনি আয়রার ব্রেন টিউমার হয়েছে। আমি আর আয়ান তো ভেবেই নিয়েছিলাম আয়রা জাহিন সাহেবের সাথে ভালো আছে। গতকাল জানতে পারি আয়রার ব্রেনটিউমার ছিল। সে কথাটা জানার সাথে সাথে আয়ানের অবস্থাটাও খারাপ হয়ে যায়। লাইফ সাপোর্টে আছে আয়ান। আয়ানও আয়রাকে অনেক বেশি ভালোবাসে।
বলেই আরশি আনিসার দিকে একটা চিঠি বাড়িয়ে দিল। আনিসা কাঁপা কাঁপা হাতে চিঠিটা নিল। তারপর কাঁপা হাতেই চিঠিটা খুলে পড়তে লাগল।চিঠিতে লেখা ছিল
প্রিয়তমা
ভালোবাসি তোমায়। আমি জানি তুমি বড্ড অভিমান করে আছ। আচ্ছা আমাকে কী বলা যেত না তোমার কী হয়েছে? সেদিন যখন জাহিনের সাথে তোমাকে দেখেছিলাম ভেবেছিলাম তুমি ভালো আছো। কিছুদিন পর যখন তোমার চেহারার অবনতি লক্ষ্য করলাম তখন কেন জানি না বুকে মোচর দিয়েছিল। কিন্তু তুমি তো বলেছিলে পড়াশোনার চাপে এমন হয়েছে। কেন আমাকে মিথ্যা বললে? জানি বড্ড অভিমান চেপে এ কাজ টা করেছো। আয়রা আমি ওপারে চলে গেলেও তোমার জন্য অপেক্ষা করব কারন এত কিছুর পরও #তবুও ভালোবাসি তোমায়।
চিঠিটা পড়েই যেন আনিসার মাথাটা চক্কর দিতে লাগল। আয়ানের প্রতি থাকা সকল অভিযোগ যেন মলিন হয়ে গেল। দুটো মানুষের মধ্যে ভালোবাসা ছিল অসীম তবুও যেন বিধাতা কারও হতে দিল না। এর মধ্যেই ডাক্তার সাহেব এসে আরশিকে জানাল আয়ান নেই। আয়ানের পরিবার চিৎকার করে কাঁদতে লাগল। আনিসা নীরবে চোখের জল ফেলছিল আর ভেতরে কষ্টের গ্লানি বহন করছিল।
কেন জানি না সেখানে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার সাহস আনিসার হলো না। দৌঁড়ে আসলো বাসায়।
কিছুক্ষণ পর সবার কাছে সবটা পরিষ্কার হয়ে গেল।দুটো খাটিয়ায় দুটো লাশ মুড়ানো হচ্ছে। যার মধ্যে একজন বড্ড অভিমান চেপে ওপারে গিয়েছে আর আরেক জন্য তার অভিমান ভাঙ্গাতে ওপারে গিয়েছে। এ যেন সহমরণ। দাফন শেষ হয় বিকেলের আগেই।
জাহিন সাহেবের মনটা বেশ অস্থির। আজকেও জাহিন সাহেবে ছাদে গিয়েছে। আকাশের দিকে তাকাতেই যেন তার চোখ দিয়ে জল পড়ছে। কষ্টে যেন তার বুক ফেটে যাচ্ছে। একা নিস্তব হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে বলছে
তুমি হয়তো ঠিক বলেছিলে আয়রা প্রথম ভালোবাসা ভুলা যায় না। তুমি ছিলে আমার প্রথম ভালোবাসা। হয়তো তুমি আমার মনের মনিকোঠায় অস্পষ্ট স্মৃতি হয়ে রয়ে যাবে। আচ্ছা তুমি তো বলেছিলে সুস্থ হয়ে আমার পথ চলার সাথী হবে আমি যেন অপেক্ষা করি। আমি সত্যিই তোমার জন্য অপেক্ষা করব কারন #তবুও ভালোবাসি তোমায়।
আরশিও আজকে পাশের ছাদে এসে নীরবে চোখের জল ফেলছে আর মনে মনে বলছে
জানি না আয়ান অভিনয় করতে করতে কখন তোমাকে মনের এক কোণে জায়গা দিয়ে ফেলেছিলাম। আমি জানতাম তুমি আমার ছিলে না কখনও আমার হবে না #তবুও ভালোবাসি তোমায়।
আনিসা চুপ করে বসে আছে আর ভাবছে
“ভালোবাসা সত্যিই এক অদ্ভুত মায়া। এ মায়া কাটিয়ে উঠা যেন বড় দায়। কোনো না কোনো কারনে এ মায়া যেন সবাইকে গ্রাস করে। ভালোবাসা কখনও হাসায়,কখনও কাঁদায় আবার কখনও রঙ্গিন প্রজাপতির মতো উড়তে শেখায়। ভালোবসা কোনো শব্দ না ভালোবাসা একটা জীবনের মূল্যবান অধ্যায় যা মানুষের জীবনে আসে কিছু সময়ের জন্য। কারও জীবনে সেটা পূর্ণতা পায় আর কারও জীবনের সেটা অস্পষ্ট স্মৃতি হয়ে থেকে যায়”
( সমাপ্ত )
Khub khub khubbbb valo laglo golpo ta pora. Thank youu ato sudor akta golpo daoar jonno