তিক্ত বুকের বাঁ-পাশ পর্ব -২৬

#তিক্ত_বুকের_বাঁ-পাশ
#তিক্ত_বুকের_বাঁপাশ
#ফিজা_সিদ্দিকী
#পর্ব_২৬(বিষাদের কালো ছায়া)

গাড়িতে যন্ত্রণায় ছটফট করছে নম্রমিতা। ব্যথায় শরীর যেনো নীল হয়ে যাচ্ছে তার। দ্রুত থেকে দ্রুততর বেগে গাড়ি ড্রাইভ করছে রাফিদ। পিছনের সিটে নম্রমিতার মাথা কোলে নিয়ে বসে আছেন আনোয়ারা খাতুন। নানান রকম দুয়া দরুদ পাঠ করে ফুক দিচ্ছেন তিনি নম্রমিতার শরীরে। এদিকে ব্যাথায় কঁকিয়ে উঠছে নম্রমিতা। জল ছাড়া মাছের মতো কাতরাচ্ছে সে। অতিরিক্ত ব্যথায় পেট যেনো ছিঁড়ে যাচ্ছে তার। দুই পা দিয়ে দলাইমলাই করে চলেছে সিটের কাপড়। যন্ত্রণায় চোখ মুখ বের হয়ে আসছে যেনো। মাঝে মাঝে দমটাও আঁটকে আসছে যেনো। এই বুঝি সে নেই হয়ে গেলো। যন্ত্রণায় ছেড়ে দিল শরীর। হারিয়ে গেলো না ফেরার দেশে।

রাফিদ কোনোরূপ ট্রাফিক রুলস না মেনে বেগতিক হারে গাড়ী চালাচ্ছে। সামনে তার একটাই লক্ষ্য, যতদ্রুত সম্ভব নম্রমিতাকে হসপিটালে নিয়ে যাওয়া। তার নম্রমিতা কষ্টে আছে, পিছন থেকে ভেসে আসছে তার কঁকিয়ে ওঠার আহাজারি। নিতে পারছেনা রাফিদ। মন চাইছে নিজের প্রাণের বিনিময়ে হলেও তার প্রাণপাখিকে শান্তি দিক। তার কষ্ট কিছুটা কমে যাক। কিন্তু তা যে অসম্ভব! কিছুক্ষণ আগেই হসপিটালে অ্যাডমিট হতে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছিলো নম্রমিতা। অথচ কয়েক মুহূর্তের মাঝেই অসম্ভব রকম পেইন শুরু হয়ে যায় তার। ফলস্বরূপ সেই অবস্থাতেই বেরিয়ে পরে তারা নম্রমিতাকে নিয়ে। পিছনের গাড়িতে আরিয়ান চৌধুরী আর তোহা আসছে নম্রমিতার যাবতীয় জিনিসপত্র নিয়ে।

ডক্টরকে আগে থেকেই পরিস্থিতি সম্পর্কে সব জানিয়ে রেখেছিলো তোহা। তিনি গেটের কাছেই অপেক্ষা করছিলেন তাদের জন্য। এক মুহুর্ত দেরি হলে অনেক বড়ো ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। নম্রমিতাকে দেখে ডক্টরের হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে যায়। ক্যারিয়ার জীবনে এই প্রথম এমন একটা কেস হ্যান্ডেল করছে সে। মেয়েটাকে দেখে ভেতরের মাতৃসত্তা হু হু করে কেঁদে ওঠে যেনো। শরীর কেমন যেনো রক্তশুন্য হয়ে পড়েছে নম্রমিতার। ব্যথায় নীল হয়ে গেছে মুখটা। চোখ উল্টে বেরিয়ে আসছে যেনো! কী বীভৎস লাগছে তাকে দেখতে। নম্রমিতার আহাজারীতে আশপাশের সকলের চোখে জল। ডক্টর স্ট্রেচারে করে চটজলদি তাকে ওটিতে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করে। ওটিতে ঢোকার মুখে নম্রমিতা টেনে ধরে রাফিদের হাত। গলা থেকে স্বর বের হচ্ছেনা তার। তবুও অনেক কষ্ট থেমে থেমে বলে ওঠে,

“আমার দ্বায়িত্বটাও তোমার উপর দিয়ে গেলাম বলে রাগ কোরোনা। জীবনটা নতুন করে শুরু করবে। আমি না থাকলেও থেকে যাবো তোমার মনে। আমার শেষ চিহ্ন রেখে যাচ্ছি তো!”

ডুকরে কেঁদে ওঠে রাফিদ। পর পর বেশ কয়েকটা চুমু এঁকে দেয় নম্রমিতার সারামুখে, কপালে। অতঃপর কপালের সাথে কপাল ঠেকিয়ে বলে ওঠে,

“আমি তোমাকে যেতে দেবোনা নম্র। আমি কিছুতেই যেতে দেবো না। তুমি এখানেই থাকো। ভেতরে গেলে তুমি আর ফিরবে না। আমি কিছুতেই যেতে দেবো না। আমার চাইনা কাউকে। মেরে ফেলো বাচ্চাটাকে, তাও আমার তোমাকে চাই। দুনিয়ার সবকিছুর বদলে আমার তোমাকে চাই। জল ছাড়া মাছের মতো ছটফট করে মরে যাবো আমি তোমাকে ছাড়া নম্র। আমাকে ছেড়ে যাবেনা তুমি। কিছুতেই যাবে না।”

“মিষ্টার চৌধুরী, আমাদের ভেতরে নিয়ে যেতে দিন। নইলে পরে অনেক বড়ো ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। ওনাকে ভেতরে যেতে দিন।”

ডক্টরের কথায় ফ্যালফ্যাল করা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে রাফিদ। কথার খেই হারিয়ে ফেলেছে যেনো সে। কী বলবে সে! নম্রমিতা ভেতরে গেলে যে আর ফিরবে না! আবার ভেটিরে না গেলেও যে অনেক বড়ো ক্ষতি হয়ে যাবে! কী করা উচিত তার? নম্রকে ফিরে পেতে গেলে কী করতে হবে তবে!

আরিয়ান চৌধুরী ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে শান্তনা দেন। অপরদিকে নম্রমিতাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ওটির মধ্যে। রাফিদ চিৎকার করছে। নম্রমিতাকে যেনো ভেতরে না নিয়ে যাওয়া হয় অনুরোধ করছে ডক্টরদের কাছে। প্রাণপনে ছুটে যাওয়ার চেষ্টা করছে সে। গিয়ে খপ করে আঁটকে ফেলতে চাইছে নম্রমিতাকে। কিন্তু রনক আর আরিয়ান চৌধুরী দুইজন পুরুষ মানুষের সাথে একসাথে পারে উঠছে না সে। একেবারে জাপ্টে ধরে আছে তারা। কিছুতেই ছুটতে পারছে না রাফিদ। তার নম্রমিতাকে ভেতরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তার থেকে অনেক অনেক দূরে চলে যাচ্ছে নম্রমিতা। অথচ সে কিচ্ছু করতে পারছে না। চিৎকার করে ডাকছে রাফিদ নম্রমিতাকে। যেতে বারণ করছে। কিন্তু আজ কেউ তার কোনো কথা শুনছে না। সবাই একেবারে উঠে পড়ে লেগেছে তাকে নম্রমিতার থেকে দূরে সরানোর জন্য। ওটির দরজা বন্ধ হওয়ার সাথে সাথে হাঁটু মুড়ে বসে পড়ে রাফিদ। হাঁটুতে মাথা ঠেকিয়ে শব্দ করে কেঁদে ওঠে সে।

হসপিটালের প্রতিটা মানুষ থমকে গেছে রাফিদকে দেখে। এতো প্রগাঢ় ভালোবাসা আগে হয়তো কখনো দেখেনি তারা। যাকে বলে পাগলের মতো ভালোবাসা। স্ত্রীকে হারানোর ভয়ে কেউ যে এত আকুল হতে পারে তা তাদের জানা ছিলনা। পুরুষ মানুষ মূলত কাঁদে কম। তারা যে একেবারে কাঁদতে পারেনা এমনটা নাহ। বরং আমাদের সমাজ তাদের কাঁদতে দেয়না। জন্মের পর থেকেই ধীকে ধীকে তাকে শিখিয়ে দেওয়া হয়, পুরুষ মানুষকে কাঁদতে নেই। কান্নারত পুরুষ মানেই দুর্বল। অথচ আমরা ভুলে যাই দিনশেষে তারাও একটা মানুষ। হৃদয় নামক এক যন্ত্র তাদের মাঝেও অনবরত পাম্প করে। অনুভূতি ধারণ করে নিজের মাঝে। পুরুষ মানুষেরও সুখ হয়, দুঃখ হয়। কষ্ট হয়, বেদনা হয়। তাদের বুকেও চিনচিনে ব্যথা অনুভূত হয়। প্রিয়জনের হারানোর শোকে তারাও দিন দুনিয়া ভুলে যায়। একজন পুরুষের চোখ থেকে বেরিয়ে আসা জল অনেক বেশি মূল্যবান। তাও যদি হয় তাপ্রিয়তমা স্ত্রীর জন্য! অল্প আঘাতে পুরুষ কাঁদতে পারেনা। একেবারে দুমড়ে মুচড়ে যাওয়ার শেষ লক্ষণ হলো তাদের কান্না।

নম্রমিতার মা আর আরুষিকে খবর পাঠিয়েছিলো তোহা। ইতিমধ্যে তারাও হসপিটালে এসে উপস্থিত হয়েছে। রাফিদের কড়া নির্দেশে ওই বাড়ির আর কাওকে সাথে সাথে নিয়ে আসেনি তারা। মেয়ের এহেন অবস্হায় মায়ের মন হু হু করে কেঁদে ওঠে। প্রেগনেন্সির মাঝে একবার তারা এসেছিলো নম্রমিতার কাছে। তবে লজ্জায় বেশিক্ষণ থাকেনি সেখানে। মূলত তাদের লজ্জা রাফিদের কাছে। তিনি চোখ মেলাতে পারেন না জামাইয়ের চোখে। রাফিদও প্রয়োজন ছাড়া ওই বাড়ির কারোর সাথে সেভাবে কথা বলেনা। শুধুমাত্র নম্রমিতার খুশির কথা ভেবে মাঝে যোগাযোগ রাখে আরুশীর সাথে।

“আপা, আমার মেয়েটা! আমার মেয়েটা কোথায় আপা!”

আনোয়ারা খাতুন তাকে শান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করেন। হাত ধরে পাশে বসিয়ে আশ্বাস দেন। অতঃপর অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে বলে ওঠেন,

“সব ঠিক হয়ে যাবে। আপনি শান্ত হন। নম্রমিতা আমাদের সকলের কাছে অনেক আদরের। এতগুলো মানুষের আহাজারি তিনি ফিরিয়ে দিতে পারবেন না। আমাদের দুই মায়ের কোল থেকে মেয়েকে ছিনিয়ে নিতে পারবেন না তিনি। আমাদের নম্রর কিছু হবেনা। তার কিছু হলে যে আমার ছেলেটা জীবিত থেকেও মরে যাবে। এটিতা নিষ্ঠুর তিনি হতে পারেন না। এতোগুলো মানুষের জীবন আঁটকে যে মেয়েতে, তাকে এভাবে হারিয়ে যেতে দিতে পারেন না তিনি। কিছুতেই না।”

ডুকরে কেঁদে ওঠেন তিনিও। আরুশী একপাশে দাড়িয়ে তাকিয়ে আছে ওটির দিকে। তার একমাত্র বড়ো বোন, তার ছায়া প্রদানকারী বটগাছের মতো মানুষটা আজ মৃত্যুর সাথে লড়ছে। চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসে তার। নম্রমিতার এমন অবস্থা দেখে ভয় জেঁকে বসেছে তোহার মনেও। রনক কান্নারত তোহাকে বুকে টেনে নেয়। তার নিজেরও ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। অল্প পরিচয়েই নম্রমিতা তার কাছে বেশ অনেকটা আপন হয়ে গেছে। সবসময় হাসি খুশি থাকা মেয়েটার এমন অবস্থা পরিবারের কেউই যেনো মেনে নিতে পারছে না। ইতিমধ্যে খবর পেয়ে রনকের পরিবারের সবাইও উপস্থিত হয় হসপিটালে।

অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে, রাফিদ এখনও আগের মতোই হাঁটু গেঁড়ে বসে মাথা ঠেকিয়ে রেখেছে হাঁটুতে। এবার বেশ চিন্তা হয় আরিয়ান চৌধুরীর। রাফিদের কাঁধে হাত রাখতেই সে ঢলে পড়ে মেঝেতে। হসপিটাল জুড়ে আরও একবার শুরু হয় অরাজকতা। ডক্টর নার্স আর পরিবারের মানুষগুলোর ছোটাছুটি। পাশের কেবিনেই অ্যাডমিট করা হয় রাফিদকে। মাইল্ড স্ট্রোক করেছে রাফিদ। মাইল্ড স্ট্রোকে রোগীর মস্তিষ্কে রক্ত সরবরাহ সাময়িক বন্ধ হয়ে আবারও চালু হয়। অতিরিক্ত টেনশন আর শঙ্কায় শরীর ছেড়ে দিয়েছে তার।

#চলবে!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here