বৈবাহিক চুক্তি পর্ব ২১+২২

#রোদে_ভেজা_মেঘ
#লিখাঃ Liza Bhuiyan
#বৈবাহিক_চুক্তি (সিজন ২)
#পর্বঃ ২১

বধুবেশে বসে আছে ইনায়া!লাল বেনারসি, হাতে একগাদা চুড়ি, গা ভর্তি গহনা, মুখে ভারী ব্রাইডাল মেকাব আর নাকের নোলক সব মিলিয়ে স্বয়ং সম্পুর্ণা এক বাঙালী বধু। তবে এতে ওর কোন আফসোস নেই সম্পুর্ণ নিজের ইচ্ছায় ও বিয়ে করছে, মেকাপ আর্টিস্ট কিছুক্ষণ পুর্বেই সাজানো শেষ করেছে তাই রুমে চার দেয়াল আর ও ছাড়া আর কেউ নেই, আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখছে আর ভাবছে ছোট বেলা এই বধুবেশে নিজেকে প্রায়ই সাজিয়ে তুলতো আর মাম্মাকে বলতো

“যেদিন আমার বিয়ে হবে সেদিন তো আমি মেকাপ উঠাবোই না, এই হাল্কা সাজে আমাকে এতো সুন্দর লাগছে তাহলে ব্রাইডাল মেকাপে অনেক সুন্দর লাগবে। উফফফ এতো সুন্দর একটা বউ আমি!”

কথাগুলো ভাবতেই ঠোঁটের কোনে আলতো হাসি ফুটে কতোটা পাগল ছিলো ও, আজ সেই ভারি মেকাপ আর বধু সেজেছে ও হয়তো সুন্দরও লাগছে তবে সেই এক্সাইটমেন্ট কাজ করছে না আর না আগের মতো মাকে জড়িয়ে ধরে বলতে পারছে

“মাম্মা অনেক সুন্দর লাগছে না আমায়!”

বিয়ে খুবই আশ্চর্যময় একটি শব্দ! এই ছোট্ট শব্দটি হুট করে যে কাউকে বড় করে দিতে পারে। হয়তো ক্লাস এইটে পড়া অবুঝ মেয়েটি যেকিনা সবে মাত্র কৈশরে পা দিয়েছে সেও হঠাৎ করে মেচিউরড হয়ে যায়। কারণ কবুল নামক শব্দটি বলার সাথে সাথে সে কারো বাড়ির বউ, কারো স্ত্রী বা কারো ভাবি হয়ে যায়। কতো দায়িত্ব ওর! তার কি আর কচি খুকিটি সাজা চলে? সবার খেয়াল রাখাটা সেই মেয়েটির জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হয়ে যায় অথচ তার খেয়াল রাখার কেউ থাকে না।

ইনায়াও আজ কারো হতে চলেছে, কারো নামের মেহেদী ওর হাতে টকটকে লাল রঙ ধারণ করেছে। বলা হয় মেহেদির রঙ তত গাঢ় হয় যতোটা হবু স্বামী তাকে ভালোবাসে। ওর হাতের মেহেদী রঙিন হয়ে আছে তবেঁ যাকে ঘিরে পরা সে ভালোবাসে কিনা জানা নেই ওর। তার কাছে আসলে ও কি! ভালোলাগা, ভালোবাসা নাকি মোহ! নাকি কোন বাজি ও জানে না তবে এতোটুকু জানে ও এই মানুষটির অর্ধাঙ্গিনী হতে চায় নি। চেয়েছিলো অন্যকারো হতে যাকে মন উজাড় করে একসময় ভালোবেসেছিলো তবে এখন হৃদয় গহীনে খুজলে এখন একরাশ ঘৃণা ছাড়া আর কিছুই খুঁজে পাচ্ছে না।

আচ্ছা এই অনুভুতি গুলো এতো বেহায়া কেন?বারবার সেই মানুষটির কথাই মনে করিয়ে দেয় যাকে ও ভুলতে চায়। একসময় খুব করে চেয়েছিলো তাকে ভালোবাসবে, তার হাতে হাত রেখে সারাজীবন কাটিয়ে দিবে কিন্তু অজানা ঝড় এসে সব লণ্ডভণ্ড করে দিলো। এতোদিনের গড়ে উঠা আবেগ, অনুভুতি সব কিছু একনিমিষে মিথ্যে হয়ে গেলো। তার অর্ধাঙ্গিনী হওয়ার ইচ্ছে আজ কেবল দুঃস্বপ্ন ছাড়া আর কিছু নয়। তবে পরের জন্ম বলতে যদি কিছু থেকে থাকে তবে ও তার সাথে আবার দেখা করতে চায় আর সেইবার ও পুরো দুনিয়া এক করে হলেও তার হবে, শুধু তার!

ইনায়ার ভাবনার ব্যাঘাত ঘটলো বাইরের শোরগোলে, সবাই যেনো একসাথে চেঁচিয়ে বলছে “বর এসেছে, বর এসেছে”। ইনায়া একটু দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বারান্দা থেকে ঘরে ফিরে আসলো, ভাবনায় বিভোর হয়ে কখন বারান্দায় চলে গিয়েছে বুঝতেই পারেনি।

সুর্য তার নির্ধারিত ডিউটি শেষে নিজ গৃহে ফিরেছে প্রায় অনেক্ষন তবে পশ্চিম আকাশে লাল আভা এখনো রয়েছে। গোধুলির পরের এই মুহুর্ত খুব সুন্দর যাকে বলে সাঁঝবেলা, বাইরের আবছা আলোয় দূরের পাহাড়গুলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে যেনো কতোগুলো ত্রিকোণ আকাশ ছুঁয়ে আছে!

ময়মনসিংহের সৌন্দর্য হয়তো এই পাহাড়গুলো আরো অনেকগুন বাড়িয়ে দিয়েছে, কি সুন্দর লাগে শহরটিকে! চারপাশে বিল আর বিল যাতে বর্ষা হওয়ায় সাপলা,পদ্ম ফুটে আছে নিজেদের সাজে। এই শহরে পা রেখেছে আজ দশদিন, হুট করেই আসা তাও ওর বিয়ে উপলক্ষে, তিনদিন পুর্বেই জানতে পেরেছে ওর বিয়ে একমাস পরে নয় এখনি হবে তাও মায়ের মুখ থেকে! আজকাল ওর বাবা-মা ওর সাথে কথা বলে না হয়তো ওর অবনতি এখনো বিশ্বাস করে উঠতে পারছে। যেই মামার কাছে ওর প্রিন্সসেস ছিলো আজকাল তার চোখে ওকে নিয়ে হতাশা দেখতে পায় ও। আর এর জন্য ও দায়ী, কি করে পারলো এমন একজনকে পাওয়ার জন্য নিজের পরিবারকে কষ্ট দিতে?তবে ওর একটা স্বপ্ন পুরণ হচ্ছে, ওর বিদায় বাংলাদেশ থেকেই হচ্ছে।

দরজা খট করে খোলার আওয়াজে মুখ তুলে তাকালো ইনায়া, খুব কাছের একজন এসেছে ওর কাছে। রাফিন!! একমাসের মতো হয়েছে ও জানে রাফিন ওর মামির ছোট বোনের ছেলে মানে সৎ বোন। রাফিনের মায়ের বিয়ে হয়েছিলো খুব বড়োলোকের কাছে তবে রাফিনের জন্মের ছয়মাস পরেই তাদের ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। ভদ্রলোক নিজের সন্তানের দায়িত্ব নিতে চাননি তাই রাফিনের মা একাই ওকে মানুষ করছে। ওর মামি জানতে পারার পরে তার বোনের সাথে দেখা করেছিলো আর ওর বিয়েতে তারা এসেছে এখানে।রাফিন ধীর পায়ে ওর কাছে এসে দাঁড়াল তারপর বললো

“আরেকবার ভেবে দেখতে কি পারতে না?হয়তো যা দেখেছো বা শুনেছো তা সত্যি নাও হতে পারে!”

“আমি এখনো বিশ্বাস করি আমি যা দেখেছি তা সত্যি নয়। তবে কি জানো আমি তাকে যতোটুকু ভালোবাসি তার থেকেও অনেক গুন বেশি আমার পাপাকে ভালোবাসি। একবছরের সম্পর্কের জন্য আমি তেইশ বছরের সম্পর্ক শেষ করে দিতে পারিনা আমি”

“তুমি সত্যিটা বলছো না কেন সবাইকে? হয়তো পরিস্থিতি বদলে যেতে পারে”

“আমি বললেও কিছুই বদলাবে না রাফিন, সবকিছু আগের মতো নেই আর না হবে। এখন সত্যিটা বললে উল্টো অনেকগুলো মানুষের ক্ষতি হবে তাই না বলাই শ্রেয়। তোমার একটা রিকোয়েস্ট করবো রাফিন রাখবে?”

“যদি সাধ্যাতীত হয় তবে রাখবো ”

“আমার খবর তাকে দিওনা প্লিজ, আমি আমার বাবার মেয়ে হওয়ার ঋণ শোধ করছি আমাকে তা করতে দাও। বন্ধু হিসেবে এতোটুকু উপকার করো আমার প্লিজ!”

রাফিন কিছু না বলে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো, একটা ছোট্ট দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললো।

“যদি সাধ্যাতীত হতো তবে রাখতাম ইনায়া কিন্তু এতে অনেকের ক্ষতি হয়ে যাবে। তুমি যেই আগুন নিভাতে চাচ্ছো তাতে তুমি নিজের অজান্তেই ঘি ঢালছ। সব কিছুর সমাধান তার থেকে পালিয়ে করা যায়না বরং তার মোকাবিলা করতে হয়। সব কিছু ঠিক করার জন্য এই বিয়েটা না হওয়া খুব জরুরি!”

ওর হাতে ফোন ছিলো যার অপরপাশে কেউ একজন গভীরভাবে তাকিয়ে ছিলো বধুবেশে থাকা নারীর দিকে যেনো কোন অপশরী ভুল করে পৃথিবীতে এসেছে।তবে এই মেয়েটির খুব তাড়া অন্যকারো হয়ে যাওয়ার, চিরতরে ওকে ছেড়ে দেয়ার! ফোন কেটে মুচকি হেসে সে উঠে দাঁড়াল সে আর বললো

“শিঘ্রই দেখা হচ্ছে তোমার আমার!আমার ভাগের একচুল জিনিসও আমি ছেড়ে দিবো না ইনু। একচুল ও না”

কিছুক্ষনের মধ্যেই কয়েকজন মেয়ে ওকে স্টেজে নিয়ে যাওয়ার জন্য নিতে এলো, তবে এদের কাউকে ও চিনে না চিনবে কি করে? ময়মনসিংহের এই প্রথম আসা ওর তাও এমন এক সময়ে যাতে ওর মনেরই ঠিক নেই। কারো মিশার তাই সময় হয়নি,গুটি গুটি পায়ে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আর কিছুক্ষণ তারপর সারাজীবনের জন্য ও অন্যাকারো হয়ে যাবে। আরো কয়েককদম এগুতেই হঠাৎ এক এক করে লাইট গুলো সব অফ হয়ে গেলো। কিছু বুঝে উঠার পুর্বেই একজোড়া হাত ওকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো, পার্ফিউমের স্ট্রং ঘ্রাণ ওর নাকে বাড়ি খাচ্ছে, এই সুবাস ওর পরিচিত খুব চেনা। চিৎকার করে কিছু বলতে যাবে তার আগেই মুখে ভারী কিছু চেপে ধরলো সেই হাতের মালিক। মাথাটা ঝিমঝিম করা শুরু করলো মুহুর্তেই,ওকে কেউ কাঁধে তুলে নিলো হুট করেই তারপর…আর কিছুই মনে নেই!

#চলবে#রোদে_ভেজা_মেঘ
#লিখাঃ Liza Bhuiyan
#বৈবাহিক_চুক্তি (সিজন ২)
#পর্বঃ ২২

হঠাৎ করে লাইট চলে যাওয়াতে উপস্থিত সকল গেস্ট বিব্রত বোধ করলো, বাচ্চারা চেঁচামেচি আর শোরগোল করতে করতে বাইরে বেরিয়ে গেলো। বাচ্চাদের ধাক্কায় কেউ কেউ আবার বিরক্ত বোধ করলেও সম্মানের খাতিরে টু শব্দটিও করেনি। অন্ধকারের এই বদ্ধ পরিবেশে কয়েক মিনিটেই সবাই হাপিয়ে উঠেছে। অনেকে কট্টর সমালোচনা করতে গিয়েও দাঁত খিচে চুপ মেরে গেলো, ময়মনসিংহের বিখ্যাত খান বংশের বাড়িতে বিয়ে। প্রতিটা শব্দ গুনে গুনে বলতে হবে এমনটাই ধারণা সবার। যদিও এতোবছর তাদের হঠাৎ গায়েব যাওয়াতে খোট ধরতে কেউই ছাড় দেয়নি, সবাই তাদের বদনাম করে বেড়িয়েছে কিন্তু সামনে কিছু বলার সাহস এখনো কারোই নেই।

প্রায় সাত থেকে আটমিনিটের মাথায় এক এক করে সকল লাইট জ্বলে উঠা শুরু করলো, এতোক্ষন হাপিয়ে উঠা মানুষগুলো যেন কিছুটা স্বস্তি পেলো। ইনান একদফা ইভেন্ট মেনেজমেন্টের সবাইকে বকে আসলো, তাদের গাফিলতিতে তারা নিজেরাই যেনো হতাশ। কিছুক্ষণ হয়ে যাওয়ার পরও যখন ইনায়াকে কেউ নিয়ে আসলো না তখন ইনায়ার বাবা ওর মাকে আরেকদফা তাড়া দিলো যেকিনা গেস্টদের কথায় মগ্ন ছিলো,

“সামু! কি হলো এখনো দাঁড়িয়ে আছো কেনো? যাও তোমার মেয়েকে এবার নিয়ে এসো”

অন্যসময় হলে সামু কিছুটা চমকে উঠতো হয়তো ইনানের মুখে ‘তোমার মেয়ে’ শুনে যেকিনা প্রিন্সেস ছাড়া অন্য কিছু কখনো ডাকে নি। কিন্তু আজ মোটেও অবাক হলো না বরং চোখে মুখে ফুটে উঠেছে একরাশ হতাশা। তার মেয়ে কাজই করেছে এমন যে এটাই তার প্রাপ্য ছিলো, ইনানকে প্রায়ই দ্বিতীয় সন্তানের কথা মজার ছলে বললেও ইনায়াকে নিয়ে বেশ খুশিই ছিলো ওরা। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে আরেকটা সন্তান নিলেই হয়তো ভালো হতো হয়তো সে এমন কাজ করতো না! সামু দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে উপরে গেলো ইনায়ার খোঁজে, আজ ওর একমাত্র মেয়ে কিছুক্ষণ পর অন্যকারো হয়ে যাবে। হাজারো অভিমান থাকলেও বিদায়ের কথা ভাবলেই চোখের কার্নিশ বেয়ে কয়েক ফোঁটা জল বেরিয়ে আসে।



কিছুক্ষনের মধ্যেই ইনান,সায়ান কিছুটা হুড়মুড় করেই ঢুকলো রুমে, তাদের পেছনে রুশিও দ্রুতপায়ে রুমের ভেতরে ঢুকে গেলো। কিছুক্ষণ পুর্বে ও রুশি আর সায়ানের সাথে দাঁড়িয়ে কিছু বিষয় কথা বলছিলো তখনি সায়রা দৌড়ে এসে বললো সামু কেমন জানি করতেছে! তাই তারা তিনজনই রুমে ছুটে আসে। ইনান সামুকে নিচে বসা অবস্থায় দেখে দ্রুত ওর কাছে গিয়ে ওর সামনে হাটু গেড়ে বসলো,
ওর গালে আস্তে হাত রেখে বললো,,

“কি হয়েছে এভাবে বসে কাঁদছো কেনো?”

সামু পাশে পড়ে থাকা কাগজের টুকরোর দিকে ইশারা করলো, ওর হাত পা এখনো থরথর করে কাঁপছে। ইনান তাড়াতাড়ি সেই কাগজের টুকরো হাতে নিয়ে দেখে তাতে কিছু লিখা আছে যা পড়েই ও দাঁড়িয়ে পড়লো হাত মুঠো করে, ওর চোখ দেখে যেকেউ বলবে যে ও এখন হয়তো মানুষ খুন করতেও দ্বিধাবোধ করবে না। সায়ান ইনানের অবস্থা কিছুটা আন্দাজ করতে পেরে হাতে থাকা কাগজের টুকরো নিয়ে পড়া শুরু করলো যাতে লিখা ছিলো

“আমার আমানত আমি নিয়ে যাচ্ছি শশুড়মশাই! আমার আর আপনার মেয়ের বিয়েতে দাওয়াত রইলো আপনার। স্বপরিবারে আসবেন আশাকরি, অপেক্ষায় রইলাম আপনাদের। সি ইউ সুন ইন লন্ডন!”

ইতি
‘আপনার শিঘ্রই হতে যাওয়া মেয়ের জামাই’

চিঠিটা পড়ে সায়ান হাসতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিলো, কি ডেয়ারিং ছেলে! সিংহের খাঁচা থেকে তারই রাজকন্যাকে তুলে নিয়ে চলে গিয়েছে অথচ সিংহ টেরই পায়নি! ছেলেটিকে না চাইতেও সায়ানের ভালো লাগলো, সত্যি বলতে ইনায়াকে তুলে নিয়ে যাওয়াতে ওর এতো বেশি রাগ লাগছেনা বরং উল্টো কিছুটা ভালোই লাগছে। কারণ যার সাথে ইনায়ার বিয়ে হতে চলেছে তাকে শুরু থেকেই ওর অপছন্দ, কেনো জানি মনে সে তাদের প্রিন্সসেসের খেয়াল রাখার জন্য ভরসাযোগ্য নয়। তবে ইনানকে এই ব্যাপারে তেমন কিছু বলেনি কারণ মেয়েটা দিনশেষে ইনানের নিজের তাই বাবা হিসেবে তার সম্পুর্ণ অধিকার আছে নিজের মেয়ের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার। কিন্তু এই ছেলেটিকে বেশ মনে ধরেছে ওর, পৃথিবীতে সবারই ভালোবাসার অধিকার রয়েছে।আর ছেলেটি তার অধিকার আদায়ের জন্য লড়ে যাচ্ছে সেটা দেখেও ভালো লাগলো। ওর ঘোর আপত্তি থাকতো যদি ইনায়া ওই ছেলেকে ভালো না বাসতো কিন্তু ইনায়া ছেলেটিকে ভালোবাসে তাই…
ভালোবাসা সবাইকে বদলে দিতে পারে হয়তো তাকেও বদলে দিবে!

কিছুক্ষনের মধ্যেই নিশ্চুপ হয়ে থাকা পুরো বাড়িতে শোরগোল শুরু হয়ে গেলো। ‘কনে পালিয়েছে’ কথাটি যেনো বাতাসের পুর্বে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করলো। সবাই একে অপরকে যেন গুরুত্বপূর্ণ খবর পৌঁছাচ্ছে, এই সংবাদে দুটো মানুষের বেশ প্রশস্ত হাসি আর হবে নাই বা কেন? সংবাদ দাঁতা তো তারাই!

সায়রা রাফিনের হাত টেনে নিয়ে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে এলো তারপর দুজন দুজনের দিকে কিছুটা চিন্তিত মুখে তাকিয়ে হুট করে হেসে দিলো যেন বিশাল ফানি জোকস শুনেছে দুজনে, হাসতে হাসতে সায়রা বললো

“কি বিশাল প্ল্যান ছিলো মাইরি, ইশশশ আমার জিজুকে দেখতে খুব ইচ্ছে, কি ডেঞ্জারাস বয়! ইনু বেবির কপালে দুঃখ আছে। আচ্ছা জিজু দেখতে কেমন?”

“অনেক হ্যান্ডসাম দেখতে যাকে বলে আইডিয়াল টাইপ, লম্বা-ফর্সা, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি আর বাদামি চোখ সবমিলিয়ে ফিদা হয়ে যাবা দেখে”

সায়রা ভ্রু কুচকে তাকালো রাফিনের দিকে যেকিনা প্রশংসায় এমনভাবে মগ্ন যেন সামনে কল্পনা করছে,

“এই রাফু তোমার কি কোন সমস্যা আছে? আই মিন যে হারে একজন ছেলের প্রশংসা করছিস! মানুষ মেয়েদের প্রশংসায়ও এতোটা মগ্ন থাকেনা”

“সায়রাপ্পি কি যে বলোনা! সুন্দরকে সুন্দর বলাই তাতে আবার মেয়ে ছেলে আছে নাকি? আর প্রশংসার মাধ্যমে বুঝাতে চাচ্ছি ইনায়া কতো লাকি যে এমন হ্যান্ডসাম বর পেয়েছে। উল্টোপাল্টা কিছু ভাববে না বলে দিলাম!”

সায়রাকে কিছুটা শাশিয়ে নিলো রাফিন, এতে সায়রা মুচকি হেসে বললো

“যেভাবে বলবে সেভাবেই তো ভাববো তাইনা! যাকগে বাদ দে, ভেতরে চল আসল মজা দেখা তো বাকি আছে”

“হিহিহি চলো, এখনো বর উপস স্যরি না হওয়া বরের রিয়াকশন দেখা বাকি”

দুজনেই হাসতে হাসতে ভেতরে ঢুকলো, ইনায়াকে নিয়ে যাওয়ার পেছনে ওদেরও সাহায্য ছিলো।সায়রা প্রথমে না জানলেও পরে রাফিন থেকে জানতে পারে যে আজকে ইনায়াকে তুলে নিয়ে যাবে। রাফিনই বাড়ির সমস্ত লাইট অফ করেছিলো আর সায়রা তখন ইনায়ার পাশে ছিলো। ও আবছা আলোয় ছেলেটির ইনায়াকে তুলে নিয়ে যাওয়া দেখেছিলো যাওয়ার পুর্বে ছেলেটিই ওর হাতে কিছু একটা গুজে দিয়ে যায় আর বলে সেটা ইনানকে দিতে। কিন্তু সায়রা ভয়ে তা ইনায়ার রুমের টেবিলের উপর রেখে দেয় যেটা কিছুক্ষণ পুর্বে ওর বাবা জোরে জোরে পড়ছিলো।

ভেতরে ঢুকেই সায়রা বরসেজে থাকা ছেলেটিকে স্টেজ থেকে নেমে গিয়েছে আর সিঁড়ির দিকে অগ্রসর হচ্ছে। নিশ্চই এতোক্ষনে কনে পালানোর খবর পৌঁছে গিয়েছে, সে যতই যাই করুক যার জিনিস সে নিয়ে গিয়েছে সেখান থেকে আর যাইহোক ফিরিয়ে আনতে পারবেনা।

🌸🌸🌸

চোখমেলে নিজেকে ঘুটঘুটে অন্ধকার জায়াগায় আবিষ্কার করলো ইনায়া, ও নড়াচড়া করতে চেয়ে পারলো না যেনো কোন বদ্ধ প্লেসে ও আবদ্ধ হয়ে আছে। মুহুর্তেই পুরোনো ভয় চাড়া দিয়ে উঠলো মনে হচ্ছে শ্বাস নিতে পারছেনা তাই আওয়াজ করতে যাবে তখন বুঝতে পারলো মুখ বাঁধা। ও হাল্কা নড়াচড়া করতেই হঠাৎ আলো চোখে পড়লো তাই তাকাতে পারছিলো না কিন্তু মুহুর্তেই বুঝতে পারলো ও শুন্যে ভাসছে কিন্তু কোন রিয়াক্ট করতে পারছেনা কারণ ওর হাত-পা সব বাঁধা।কিছু বুঝে উঠার পুর্বেই কেউ একজন সজোরে বেডে ছুড়ে মারলো তারপর পাশে সুয়ে পড়লো

“তুমি যে এতো ভারি জানতাম নাতো আমি! এতোটা নিয়ে আসতেই হাপিয়ে উঠেছি আমি উফফফ”

যখন পাশের ব্যাক্তি থেকে সাড়া শব্দ কিছুই পেলো না তখন রোয়েন ভ্রু কুচকে তাকালো তার দিকে তারপর কিছু একটা বুঝতে পেরেই উঠে বসলো তারপর বাঁকা হেসে ইনায়ার মুখের বাঁধনি খুলে দিলো। ইনায়া কাঙ্ক্ষিত মানুষকে দেখতে পেয়ে কোন রিয়াক্ট করলো না বরং শান্ত চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো। আজ প্রায় তেরোদিন পর রোয়েনকে দেখতে পেয়েছে ও, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি সৌন্দর্য যেন দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। ওই বাদামি চোখ গুলোতে বিরাজ করছে একরাশ মায়া যাতে ঢুবে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে ওর কিন্তু নিজেকে সামলে শান্ত গলায় বললো

“আমাকে বাড়ি দিয়ে আসুন রোয়েন”

“আমি কবে থেকে আবার আপনি হয়ে গেলাম তোমার?”

“যেখানে কোন সম্পর্কই নেই সেখানে আপনি বা তুমি কোনটিই মেটার করে না। আমি আপনাকে ওইদিন সব ক্লিয়ারলি বলে এসেছি তাই আজকের এই পরিস্থিতি আশা করিনি”

“সম্পর্ক তোমার হাতের পুতুল নয় ইনায়া যে তুমি যেমনটি চাইবে ঠিক তেমনটিই হবে। একটা সম্পর্ক দুজনকে নিয়ে গড়ে উঠে তাই শেষও দুজনের সম্মতিতেই হতে হবে। আর এই সম্পর্কের শেষ কখনোই চাইনি তাহলে তা শেষ হলো কি করে?আমি অন্যদের মতো হাল ছেড়ে দেয়ার পাত্র নই, ভালো যখন বেসেছি তখন তোমাকে নিজের করেই ছাড়বো। সেটাতে তোমার সম্মতি থাকুক আর নাই থাকুক কারণ আমি জানি তুমি আমায় এখনো ভালোবাসো”

ইনায়া যতই অস্বীকার করুক ওর হৃদয় হয়তো জানে ও এখনো কতোটা চায় এই মানুষটিকে কিন্তু ওর হাত পা বাঁধা,ও চাইলেও কিছু করতে পারবে না তাই কথা না বাড়িয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে বললো

“সবাই আমার জন্য অপেক্ষা করছে আমাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসুন”

“তুমি কি তোমার বাড়ির পাশের ফ্লাটে আছো যে বাড়ি পৌঁছে দিবো? আর থাকলেও বা দিতাম নাকি? এতো কষ্ট করে নিয়ে এসেছি ফিরিয়ে দেয়ার জন্য নাকি?”

ইনায়ার মুখে বিস্ময় দেখে রোয়েন ওর দিকে কিছুটা ঝুকে বললো

“ওহ তোমাকে তো বলাই হয়নি, ওয়েলকাম টু লন্ডন ইনু বেবি!”

ইনায়া যেনো শক খেলো, লন্ডন মানে! আশেপাশে তাকিয়ে বুঝতে পারলো এটা রোয়েনের রুম যেখানে ও এই একবছরে অসংখ্য বার এসেছে আর রয়েছে ওদের খুনশুটিময় অনেক স্মৃতি!

#চলবে

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here