তুই হবি শুধু আমার পর্ব -১০+১১

#তুই_হবি_শুধু_আমার
#সাইরাহ্_সীরাত
#পর্ব_দশ

“সাইরাহ্ আনসারী রোজা” সাফোয়ান আনসারী এবং মিফতাহুল মেহরিন রেণু’র একমাত্র কন্যা। সাফোয়ান আনসারী ছিলেন এ্যান্টি টেরোরিজম ইউনিটের ডি. আই. জি। একটি গোপনীয় মিশন চলাকালীন পাঁচবছর আগে বো’মব্লাস্টে তিনি মা’রা যান। টেরোরিস্টদের কিছু গোপন তথ্য আনসারী সাহেবের কাছে ছিল বলে ওদের বাড়িতেও হা’মলা করা হয়েছিল। রোজ তখন কলকাতা অর্থাৎ আরশানের কাছে গিয়েছিল ঘুরতে। আরসালান, রজনী ভাবি, অভী, অয়ন, ফালাকসহ প্রায় সবাই এক সঙ্গেই গিয়েছিল। রোজের বাবা কাজের জন্য যেতে পারেননি আর রেণু আনসারী সাহেবের জন্য।সেই জঙ্গী ও টেরোরিস্ট বাড়িতে এসে ভাঙচুর করে, রেণু বাঁধা দিলে রেণুকেও মে’রে ফেলে। তাদের মৃত্যুর খবর দুদিন পর পৌঁছায় রোজের কাছে। রোজের বয়স তখন তেরো বছর। প্রচন্ড দুষ্টু ও চঞ্চল প্রকৃতির মেয়ে সে। সবাইকে জ্বালাতন করা ওর পেশা! দিনটি ছিল বৈখাশের প্রথম দিন। প্রচন্ড গরমে সে ছাদের কোনায় পা ঝুলিয়ে বসে সামনের আম গাছের থেকে আম ছিড়ে লবন দিয়ে খেতে খেতে গান গাইছিল। ফারহান শ্যুটিংয়ের কাজে দার্জিলিং গিয়েছিল। আজ কালের মধ্যেই ফিরবে। তাই তাঁর জন্যও কিছু আম গুছিয়ে রাখলো রোজ। এলে দুজনে মিলে মাখিয়ে খাবে। আরসালানের বড় ছেলে অভী রোজের পাশে বসেই গল্প করছে আর খাচ্ছে। ঠিক তখনই আরশান আসে ছাদে। রোজ খেতে খেতে পেছনে ফিরে বলে,
-দাদাই তোমার বাড়িতে সব ঘরে এসি নেই কেন? শুধু তোমার আর আঙ্কেলের ঘরে এসি। আমার গরম লাগে তো। এই অভী তোমার গরম লাগে না?

পাঁচ বছরের অভী খিলখিল করে হেসে উঠে বলে,
-লাগে তো। চাচ্চু আমার আর ফুপির ঘরে এসি দেবে। গরমে কালো হয়ে যাচ্ছি আমরা।

আরশানের গলা ধরে আসছে। রোজকে সে কিভাবে জানাবে ওর বাবা-মায়ের কথা?আমীর সাহেব অবধি সাহস পাচ্ছেন না এমন সংবাদ নিয়ে রোজের সামনে আসার। সেখানে আরশান এসেছে। না এসে উপায় নেই, রোজকে তো জানাতে হবে খবরটা।মেয়ে হিসেবে এটা জানার অধিকার আছে ওর। আমীর সাহেব নিজেকে ঘরবন্দি করে রেখেছেন। সপ্তাহখানেক আগে আনসারী সাহেব তাকে ফোন করে কেঁদে কেঁদে বলেছিলেন,

-মেয়েটাকে তোদের সঙ্গে পাঠাচ্ছি আমীর। ওকে দেখে রাখিস। আমার পেশায় কখন কি হয় জানি না। আমার কিছু হলে রেণু আর রোজকে তুই নিজের কাছে রাখবি। রোজকে নিরাপদে রাখবি।পরিচয় গোপন রাখবি। কেউ যেন না জানে ও সাফোয়ান আনসারীর মেয়ে, আনসারী রক্ত ওর শরীরে।

-কি হয়েছে? এভাবে কথা বলছিস কেন? ফারদিনকে নাকি ফোন দিস না অনেকদিন হলো। কোথায় তুই?

-মিশনে আছি। বাড়িতেও তেমন যোগাযোগ রাখতে পারছি না। সকালে রেণুর ফোন পেয়ে রোজকে দেখতে এসেছিলাম। ওদের মাত্র গাড়িতে তুলে দিলাম। এবার আবার ফিরতে হবে। ওদের খেয়াল রাখিস। ফারদিন আর তুই ছাড়া আমি কাউকে বিশ্বাস করতে পারবো না।

-চিন্তা করিস না, আমি আছি তো। আমি কথা দিচ্ছি আমি ওদের খেয়াল রাখবো।রোজকে নিয়ে কলকাতায় যাচ্ছি, রেণু ভাবিকেও যেতে বললাম কিন্তু তোর জন্য যাবে না ভাবি। তুই রোজকে নিয়ে টেনশন করিস না। রোজের সকল দায়িত্ব আমার।

-রাখছি। জিপ চলে এসেছে।

-সাবধানে থাকবি। সময় পেলেই ফোন করবি। অপেক্ষা করবো আমরা।

একসপ্তাহ আগে যারা ছিল তারা আজ নেই। ভাবতেই দম বন্ধ হয়ে আসছে আমীর সাহেবের। বাল্যকালের বন্ধু তারা। একসঙ্গে এক স্কুল, কলেজ, ভার্সিটি থেকে এই বয়স অবধি একসঙ্গে ছিলেন। কিন্তু এখন এসবের থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে রোজ। আরশান রোজকে কাছে ডাকল,
-বেবি শোন।

রোজ আম কামড়ে টকে চোখমুখ খিঁচে ফেলেছে। ডাক শুনে সে একচোখ মেলে বলে,
-টাইম নেই। এখন ফালাক ভাইয়ার জন্য আম গোছাতে হবে। ফালাক ভাইয়া কবে আসবে?

-আমার কাছে আয়। তোকে একটা কথা বলতে হবে। জরুরি কথা। ওখান থেকে উঠে এখানে আয়।

রোজকে ডাকার অর্থ হচ্ছে, রোজ যেমন দুষ্টু তেমনই জেদি, রাগি, অভিমানি। যদি খবরটা শুনে লাফ দিয়ে বসে? রোজ উঠে অভীর জামার ওপর আমগুলো দিয়ে আরশানের কাছে আসলো। আরশান রোজের চুলগুলো ঠিক করে বলল,
-অনেক খেয়েছিস। আর খেলে পেট ব্যাথা করবে।
-ওকে। এবার বলো তোমার জরুরি কথা কি? কি বলবে যার জন্য আমাকে, রোজকে তুলে আনলে।

আরশান দম ফেলে বলল,
-তোর বাবা-মা নেই বেবি।

রোজ ভ্রু কুঁচকে তাকায়। এটা নতুন কি? বাবা-মা তো এখানে আসেনি। তারা তো বাড়িতে। তাই এখানে তারা থাকবে না, এটাই স্বাভাবিক। আরশান বোকা বোকা কথা বলছে দেখে রোজ হেসে উঠলো,
-তো কি হয়েছে? তোমরা তো আছো। আর আমরাও তো দেশে ফিরবো কিছুদিন পরেই। এখন নেই তখন থাকবে।

আরশানের চোখে পানি চলে এসেছে। মেয়েটা এখনও ওর কথার অর্থ বোঝেনি। বুঝলে কেমন প্রতিক্রিয়া দেখাবে? আরশান কেঁদে উঠলো। বলল,
-তোর বাবা-মা মা’রা গেছে বেবি। আঙ্কেল বো’মব্লাস্টে আর আন্টিকে টেরোটিস্টরা খু’ন করেছে।

রোজের হাত আম ছিল। সে সেগুলো নেড়ে চেড়ে দেখে আরশানের হাতে দিতে যাচ্ছিলো। এমন বাক্য শুনে ওর হাত থেকে আমগুলো পড়ে যায়। সর্বাঙ্গ টলে ওঠে। কান কি ঠিকঠাক শুনতে পাচ্ছে নাকি ভুল কিছু শুনলে? হ্যাঁ ভুলই শুনেছে। এমন হতে পারে নাকি? ওর বাবা কত সাহসী বুদ্ধিমান,ব্লাস্টে কিভাবে তাঁর ক্ষতি হবে? আর মা তো বাড়িতে।রোজ আরশানের দিকে তাকিয়ে বলে,
-এমন বাজে কথা বলবে না দাদাই। আনসারীর মেয়ে আমি। এত সহজে ভয় পাবো না। আর তুমি কি ফালাক ভাইয়ার মত অভিনেতা হতে চাও? কাঁদছো কেন এমন করে? মেজাজ খারাপ করবে না একদম।

আরশান রোজকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে রোজের মাথা বুকের সঙ্গে মিশিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
-আমি সত্যি বলছি। বিশ্বাস কর আমাকে।

রোজের চোখের সামনে ঝাপসা হয়ে আসে। তাহলে এটাই সেই কথা যা আসার আগে রোজকে আনসারী সাহেব বুঝিয়েছিলেন। শিখিয়েছিলেন কঠিন পরিস্থিতে নিজেকে কিভাবে সামলাতে হয়। রোজকে বলেছিলেন সে যেন কখনও ভে’ঙে না পড়ে। সর্বদা মনে রাখে সে আনসারীর মেয়ে।আত্মসম্মান নষ্ট, মাথা নত করা, ছোট হওয়া, এগুলো আনসারীর মেয়ের জন্য শোভানীয় নয়। আনসারীর মেয়ে হবে, বাবার মত সাহসী, বুদ্ধিমতি, মায়ের মত কোমল, মমতাময়ী। রোজ আরশানের বুক থেকে মাথা তুলে দুহাতে চোখের পানি মুছে বলে,

-বাবাদের কবর কি দেওয়া হয়ে গেছে?

-হুম। তুই বাজে কিছু করার কথা ভাববি না বেবি। তুই একা নোস্ আমরা সবাই আছি তো। আমরা তোকে অনেক ভালোবাসি। আমি তোকে অনেক ভালোবাসি বেবি। অনেক!

– আমিও তোমাকে ভালোবাসি। আমি কষ্ট পাবো না। কারন তুমি, তোমরা আছো তো। তোমরা আমাকে কষ্ট পেতে দেবে না আমি জানি।

রোজের বুকের ভেতরটা কষ্টে ফেটে যাচ্ছে। ফালাক কোথায়? ওর যে ওর বন্ধু ফালাককে প্রয়োজন। ফালাককে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে চায় রোজ। কোথায় ফালাক? রোজের কাছে কেন আসছে না সে?

ফালাক শ্যুটিং শেষে সোজা ছাদে চলে এসেছিল। আর এসেই আরশান ও রোজের কথা শুনে সে স্তব্ধচোখে তাকাল। রোজ আরশান একে অপরকে ভালোবাসে? রোজ সেটা নিজ মুখে বলছে? ফালাক এসে রোজকে টানতে টানতে ঘরে নিয়ে গেল। আরশান ওর এমন কাজে বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাড়িয়ে রইলো। কি হলো ছেলেটার? আরশানও পিঁছু পিঁছু যেতেই দেখলো ফালাক দরজা লাগিয়ে দিয়েছে। জানালার কাছে এসে সে তাকাল ওদের দিকে। ফালাক রোজের গালে চ’র বসিয়ে বলল,

-কি বললি তুই?কি বললি? তুই দাদাইকে ভালোবাসিস।দাদাইকে? আর আমি? আমাকে? তোকে আমি ভালো ভেবেছিলাম রোজ! কিন্তু তোরও তো সব মেয়েদের মত টাকা চাই তাইনা? আগে সবসময় আমাকে চিনতিস যেই দাদাই আসলো ওমনি পছন্দ পাল্টে গেল? এমন করতে পারলি তুই? কেন করলি এমন? কেন ঠকালি?

বলেই রোজের গলা টিপে ধরল ফালাক। আরশান এটা দেখে দরজা ধাক্কাতে থাকে। সবাই চলে আসে চিৎকার শুনে। রোজ হা করে তাকিয়ে আছে। আরশান জানে এই ধরনের ভালোবাসার মানে। আরশান নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করেছে কিন্তু ফালাক ছোট, ও তা পারছে না। রোজও কি ফালাককে ভালোবাসে? নাকি ফালাকের দিক থেকেই শুধু এই অনুভূতি জন্মেছে? ফালাক বলতে থাকে,

-মাত্র তিনদিন ছিলাম না এখানে।তারমধ্যেই ভালোবাসা হয়ে গেল? আর কি হয়েছে? কি দিয়েছে তোকে? বল কি পেয়েছিস? যে আমাকে ভুলতে সময় লাগলো না।

রোজ এবার শব্দ করে কেঁদে উঠলো। প্রথমে বাবা-মা আর এখন ফালাক। ফালাক ওকে বাজেভাবে অপমান করছে। রোজ বোঝে এসব কথার ধরন। ফালাক তো রোজের নিরাপত্তার জন্য ওকে সব বুঝিয়ে বলেছিলো। বলেছিল খারাপ ভালোর তফাৎ। তাই ফালাক ওকে সে সব ইঙ্গিত দিচ্ছে তাও বুঝতে পারছে রোজ। আনসারী কখনও নিজের আত্মসম্মান নষ্ট করতে দিতে পারেনা।সবকিছুর উর্ধ্বে তাদের আত্মসম্মান। বাবা তো এসবই বলেছিলেন। রোজের চোখ বেয়ে টপটপ করে পানি পড়তে থাকে। এই ফালাককে রোজ চেনে না। রোজের সম্মান নিয়ে যে কথা বলে, রোজকে যে অবিশ্বাস করে তাকে রোজ মাফ করবে না। কিছুতেই না। রোজ গলা থেকে হাত ছাড়িয়ে বলল,

-কি বলছো এসব? কেন বলছো?

আরশান দরজা ভেঙে ফেললো। রোজকে একহাতে আগলে ধরে বলল,
-কি করছিস ফালাক? বেবিকে মারছিস কেন? এসব কি কথা? ঠান্ডা হ। আমার সঙ্গে চল আমি সবটা বলে দিচ্ছি। তুই ভুল ভাবছিস।

-ভুল? তোমাদের প্রেমের কথা ভুল দাদাই? তুমি তো সব জানতে।তুমি জানতে এই মেয়েটাকে আমি ভালোবাসি। তবুও এমন করলে? কেন করলে? দাদাই কেন? আর তুই তোর কি দরকার ছিল? বয়সের আগে পেঁকে গিয়ে এই হাল করেছিস তাইনা? এখনই ছেলে লাগবে? থাকা লাগবে? আমাকে বলিসনি কেন? আমি থাকতাম।

আরশান সপাটে থাপ্পড় বসালো ফালাকের গালে।রোজ হিচকি তুলে কাঁদছে। আরশান রাগে থরথর করে কাঁপছে। চেঁচিয়ে বলে,

-এসব কি ফালাক? কি বলছিস, তার মানে জানিস? ও আমাদের বেবি, আমাদের প্রিন্সেস! তুই ওকে এভাবে, আর তুই ওকে ভালোবাসিস, ও কি বলেছে ও তোকে ভালোবাসে? রোজ, তুই ফালাককে ভালোবাসিস?

রোজের চোয়াল শক্ত হয়ে আসে। ফর্সা গাল লাল হয়ে রয়েছে। রোজ জোরে শ্বাস নিয়ে বলে,
-না! উনি শুধু আমার বন্ধু। আমি কাউকে ভালোবাসিনি ভালোবাসিনা। আর হ্যাঁ এটা সত্য আমি দাদাইকে ভালোবাসি। তবে সেটা ভাই হিসেবে।

ফালাক তাচ্ছিল্য হাসি হেসে বলল,
-সবার সামনে পাল্টি খেয়ে আমাকে খারাপ বানাতে চাইলি চাঁদ? ওকে! তোর এই চাওয়াটাও পূর্ণ করবে ফালাক। খারাপ হবে সে, প্রচন্ড খারাপ। যে খারাপের কল্পনাও কেউ করতে পারবে না।

আমীর সাহেব ফালাকের কাঁধে হাত রেখে বললেন,
-ঠান্ডা হ, ফালাক।কি বাচ্চামি শুরু করেছিস? এধরনের কথা বলার সময় না এখন। রোজকে এভাবে বলিস না। ও সবে খবরটা পেল।

-তুমিও আমাকেই দোষারোপ করলে আঙ্কেল? তোমার ছেলে যেটা করেছে সেটা ঠিক?

-আরশান! ফালাক কি সত্য বলছে? তুই ভালোবাসিস রোজকে? এটা বলেছিস?

আরশানের জবাব,
-বলেছি। আর সেটা সজ্ঞানে বলেছি। ওর মত ছেলের হাতে বেবিকে তুলে দিতে পারবে তোমরা? যে এভাবে বেবিকে মা’রলো, বাজে কথা বললো। প্রয়োজনে বেবির দায়িত্ব আমি নেবো। কিন্তু এই বেয়াদবটাকে এখুনি আমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে বলো।

রোজ আমীর সাহেবের হাত জড়িয়ে ধরে বলল,
-যেতে বলো ওনাকে। আমি ওনাকে ঘৃণা করি আঙ্কেল। আমার সহ্য হচ্ছে না। কষ্ট হচ্ছে। যেতে বলো ওনাকে।

আমীর সাহেব কিছু বলবেন তার আগেই ফালাক বলে,
-আমিও চাঁদ! না চাঁদ না, আমার চাঁদ এমন হতেই পারে না। তুই রোজা, সাইরাহ্ আনসারী রোজা। আমার রোজ এমন ছিল না, আমার চাঁদ এমন ছিল না। সে প্রতারণা জানতো না। তোর মত প্রতারককে আমি ঘৃণা করি। তোর চেহারা আমি দেখতে চাইনা, কখনও না। আমাকে তুই কখনও ফালাক ভাইয়া বলে ডাকবি না। ফালাক নেই, ফালাক বলে কেউ থাকবে না। আমি চলে যাচ্ছি আঙ্কেল, তোমার ছেলের বাড়ি থেকে। তাঁর জীবন থেকে ভালো থাকিস রোজা! খুব ভালো থাকিস।

ফালাক চলে যেতেই আমীর সাহেব আরশানের দিকে তাকালো।এরপর আরশানকে প্রশ্ন করে সবটা জেনে বললেন,
-কেন করলে এমন? কেন বললে তুমি রোজকে ভালোবাসো? তুমি চেনো না ফালাককে? ওর রাগ জেদ জানো না? রোজ ওকে

রোজ কঠিন গলায় বলে,
-ভালোবাসিনা। বন্ধু ছিল। বন্ধুত্ব শেষ। আর ভালোবাসা কি? কাকে বলে? এসব কথা কেন আসলো? দাদাইকে তো আমি ভাইয়ের নজরের ভালোবাসার কথা বলেছি সেটাও দাদাই প্রথমে বললো সেজন্য। আমার মেজাজ ভালো নেই আঙ্কেল। ওই লোক আর এসব কথা বলা বন্ধ করো প্লিজ।

রোজ মুখে এটা বললেও আমীর সাহেব রোজের মনের কথা জানেন। কিন্তু পরিস্থির কথা ভেবে আরশানকে কিছু বললেন না। রজনী রোজকে নিয়ে চলে যেতেই আমীর সাহেব বললেন,
-ঠিক করোনি এটা। ফালাক ভুল করেছে, অন্যায় করেছে। তুমিও সমান ভুল করেছো আরশান।

-বেবি ওকে ভালোবাসে না। আর এমন ছেলে বেবিকে পাওয়ার যোগ্য নয়। আমি বেবিকে ভালোবাসি এটা শুধু ওকে শোনানোর জন্য বলেছি। ওকে বোঝানোর জন্য বলেছি।যেন ওর রাগ হয়, ওর এমন স্বভাব নিয়ে চলে যায় বেবির জীবন থেকে। তুমি ভাবতে পারছো বেবিকে মা’রতে চেয়েছে ও। ওর কাছে বেবি সেফ না। আর তুমি তো বেবির সেফটির দায়িত্ব নিয়েছো। তোমার উচিত ওর ভালো থাকার, নিরাপদ থাকার ব্যবস্থা করা। ওকে ওমন হিং’স্র, ছেলের কাছে রাখা নয়।

আরশানও রেগে বেরিয়ে গেল। আমীর সাহেব খাটের ওপর বসে পড়লেন। কি থেকে কি হয়ে গেল?ফারদিন ফোন করেছে। আমীর ফারদিনের সঙ্গে কথা বলে সব জানাতেই ফারদিন রেগে গেল। ফালাক রোজের গায়ে হাত তুলেছে? আমীর সাহেব সবটা বলে ওনাকে ঠান্ডা থাকতে বললেন। বাচ্চাদের মধ্যে সমস্যা হয়েছে, ওরা মিটিয়ে নেবে। কিন্তু মিটলো না কিছু। রোজ নিজের ব্যাগপত্র গুছিয়ে ফেললো। দেশে ফিরে সে চলে গেল নানাবাড়িতে। সবার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দিল। আরশানও থেকে গেল ওই দেশেই। আমীর সাহেব সন্তানদের এমন বিচ্ছিন্ন বিচ্ছেদে দুঃখে কষ্টে জর্জরিত। সমস্যা মিটে যেত, কিন্তু আরশান রেগে বানোয়াট কথাগুলো বলে ব্যাপারটা মিটতে দিল না। সব ঝামেলার মূল এই ছেলে। রোজকে আনার জন্য গ্রামে যায় আমীর সাহেব। কিন্তু রোজ স্পষ্ট বলেছে সে ফিরবে না। কারোর সঙ্গে আপাতত সে যোগাযোগ রাখতে চায়না।

এরপর চারবছর পর রোজ শহরে আসে। নানার মৃ’ত্যুর পর গ্রামে থাকার অবস্থা ছিল না ওর। ট্রান্সফার নিয়ে এখানকার কলেজে ভর্তি হবার পর আরশানের সঙ্গে দেখা হয়। আরশান রোজকে বাড়ি নিয়ে যেতে চাইলে রোজ সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। আমীর সাহেব নিজে ডেকে পাঠালে রোজ যায়। কিন্তু থাকার প্রস্তাবে রাজি হয়না। এখানে থাকলে পুরোনো ক্ষতে যন্ত্রনা হবে। তাই রোজ আমীর সাহেবের কাছ থেকে কিছু টাকা নিয়ে একটা ফ্লাট কেনে। আর রেডিওকে কাজ করে সেই টাকা পরিশোধ করার চেষ্টা করছিল। কারন ওর বাবা বলেছিল আনসারী বংশ কখনও কারোর করুনা, দয়ায় বাঁচেনি।রোজ বাবার সম্মান নষ্ট করতে চায়না। কারোর দয়ায় বাঁচতে চায়না। বৃত্তির টাকায় পড়াশোনা চালিয়ে গেছে। আর রেডিওর মাধ্যমে দিন। আরশানদের সঙ্গে স্বাভাবিক হতে পারলেও রোজ এখনও ভাবে ফালাককে নিয়ে। টিভিতে ফালাকের মুভিগুলো দেখে আর ভাবে মানুষটা কতটা বদলে গেল। আরশানের দোষ ছিলনা সেদিন। ফালাকের ব্যবহারে রেগে গিয়ে সে ওসব বলেছিল। রোজও রাগের মাথাতেই সেসব বলেছে, ফালাকও তাই। কিন্তু রোজের কষ্ট লেগেছে ফালাক ওকে অবিশ্বাস করেছে বলে। ভালোবাসলে বিশ্বাস থাকাটা জরুরি ছিল। যাক, অতিত ভাবতে থাকা মেয়ে নয় রোজ। সে অতিত ভাববে না। বাবার ইচ্ছে ছিল রোজ জার্নালিস্ট হবে, বাবার মত সাহসী! দেশের কাজ করবে। নরকের কীটগুলোকে টেনে বের করবে। আজ রোজের ধ্যানজ্ঞান শুধু সেটাই। বাবা-মা ও তাদের স্বপ্নগুলো। রোজ হার মানবে না, কারোর সামনে মাথা নত করে বাবার আদর্শ নষ্ট করবে না। সে বাঁচবে বাবা-মায়ের আদর্শে, সে হাটবে তাদের দেখানো পথে। ভালোবাসা! বাবা-মা ছাড়া কেউ তাকে আদৌ কি ভালোবেসেছে? আমীর আঙ্কেল, ফারদিন আঙ্কেল ও ফারিয়া আন্টি হয়তো বেসেছে। তাদের ভালোবাসাকে সম্মান করে রোজ। এজন্যই তো তাদের সঙ্গে এখনও যোগাযোগ রেখেছে। ফালাকের সঙ্গে যোগাযোগ না’ই বা থাকলো!
#তুই_হবি_শুধু_আমার
#সাইরাহ্_সীরাত
#পর্ব_এগারো

অয়ন্তি এসেছে খাঁন ম্যানশনে। আমীর সাহেবকে দেখার কারনেই এসেছে মীর্জা বাড়ির সবাই। কিন্তু আরশানকে কোথাও দেখা গেল না। আমীর সাহেব কথা বলতে না পারায় আশরাফ মীর্জা নিজেই বলতে শুরু করলেন,
-অয়ন্তি বিয়েতে রাজি হয়েছে। তাই আমরা সবাই এটা চাচ্ছিলাম যে বিয়েটা আগামী মাসেই হয়ে যাক। আপনি তো সেটাই চেয়েছিলেন।

আরসালান এগিয়ে এসে বলল,
-হ্যাঁ! বাবা গতকালও আমাকে বলছিলেন এটা। বিয়েটা যদি আগামী মাসে না হয়ে এমাসের শেষে হয় তাহলে কি সমস্যা হবে আঙ্কেল? আসলে আরশানের বিয়েটা দেওয়া অনেক জরুরি।
-কেন বাবা? কোনো সমস্যা?

আরসালান থেমে থেমে বলে,
-আসলে পারিবারিক একটা সমস্যা চলছিল। আরশানের বিয়েটা তার সমাধান। ওর বিয়েতে একত্রিত হতে পারবে বাবার বন্ধুরা।
-আমার আপত্তি নেই। বিয়ে তো দিতেই হবে, সেটা আজ হোক বা কাল। আজ তো মাসের পনেরো তারিখ। শেষে বলতে ঠিক কত তারিখ বোঝাচ্ছো?
-শেষের শুক্রবার।
-আচ্ছা। কিন্তু তোমার বাবা? তিনি তো সুস্থ নন।
-সবাই আসলে সুস্থ হয়ে যাবে।চিন্তা করবেন না আপনি। আর ভাই একটা কাজে বাইরে আছে সেজন্য দেখা করতে পারলো না। কিছু মনে করবেন না।
-না, ঠিক আছে।

আরশান তিনদিন পর বাড়িতে ফিরলো। আরসালান বসার ঘরে বসে টিভি দেখছে। রজনী রান্না করছে, অভী আরসালানের পাশে বসে পড়া করছে। আরশানকে দেখে আরসালান গম্ভির কন্ঠে বলল,
-তোর রেডিওতে প্রচার করে দিস তোর বিয়ের নিউজ। বাবা আদেশ করেছেন!
-বিয়ে?
-রোজের আর ফালাকের কানে তোর বিয়ের খবরটা পৌঁছানোর দরকার। দেখা যাক পাগল দুটো কি করে। ফালাক না আসলেও রোজ নিশ্চই তোর বিয়েতে আসবে।
-আসবে না। আমি ভুল করেছি দাদাভাই। অনেক বড় ভুল।আমি বুঝিনি বেবি ফালাককে ভালোবাসে। আমার জন্য বেবির পাঁচটা বছর নষ্ট হয়েছে। ফালাক তাঁর চাঁদ আর রোজকে হারিয়েছে। সব দোষ্ আমার।
-দোষ গুণের হিসেব পরে করিস। আপাতত যা বলেছি সেটা কর। তাছাড়া ভুল তোরও ছিল না। পরিস্থিতিটাই ভুল ছিল। তোদের রাগ করা’টা ভুল ছিল। তোদের গরম মাথায় সিদ্ধান্ত নেওয়াটা ভুল ছিল। রোজ জেদের বশে সেসব বলেছে, তুই রোজের কষ্ট দেখে ওসব বলেছিলি আর ওই সাইকো রোজকে তোর সঙ্গে দেখে জেলাসির ঠেলায় ওসব করেছে। সবটা ঠিক করার একটা সুযোগ এসেছে। সুযোগটা কাজে লাগা।
-ফালাকের কানে নিউজ পৌঁছাবে কি করে?
-রোজের শো’টায় কথা বলবি। খোঁজ পেয়েছি হিরো ফারহানের পি.এ রোজের ফ্যান! শো নিশ্চই শুনবে। ও ফালাকের কানে ঠিক কথাটা লাগাবে।
-আ’ইয়্যু শ্যর?
-হান্ড্রেড পার্সেন্ট। ফারদিন আঙ্কেলের সঙ্গে কথা হয়েছে আমার।উনি গ্যারান্টি দিয়ে বলেছেন। তাই এই শুক্রবার মানে আজ রাতের শো তুই করবি। আর নিজের বিয়ের এ্যানাউন্সটাও নিজে করবি।

____________

ফারহান আর সিয়াম সিলেট থেকে ঢাকায় ফিরছিল। ড্রাইভিং সীটে সিয়াম আর পাশে ফারহান। সিয়াম বার বার ফোন চেক করছে। বারো’টা বাজতেই সিয়াম গাড়ি থামিয়ে দিল। ফারহান ভাবলেশহীন হয়ে জানালার বাইরে চেয়ে আছে। গাড়ি থামতেই সে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়।
-কি প্রবলেম?
-রেডিও চলছে না কেন স্যার? আমার ফোনেও চার্জ নেই। আপনার ফোনটা একটু দেবেন? প্লিজ!
-হোয়াট!
-মাত্র দেড়ঘন্টার জন্য স্যার। যাস্ট রেডিও অন করবো। আপনি করে দেন। আমি আপনার ফোন টাচও করবো না।
-রেডিও?
-না মানে একটা শো আমি রেগুলার শুনি স্যার। একটা মেয়ে হোস্ট করে, ভালোবাসার রংমহল নাম। আর ওই রেডিও জকির নাম
-এয়ারফোন আছে? এসব ফালতু জিনিস আমি পছন্দ করিনা।
-না স্যার! কিন্তু আমি শিউর, ওর গলা শুনলে আপনার ভালো লাগবে?
-হোয়াট? (রেগে বলল )
-কিছু না স্যার। (রেডিও গুতাতে গুতাতে )রেডিও ঠিক হয়ে গেছে। এরপর আস্তে বলল, “হোয়াটের প্রতিষ্ঠাতা!”

সিয়াম রেডিও চালিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিতেই আরশানের গলা শোনা গেল। “হ্যালো ডিয়ার লিসেনার, আমি আর জে আরশান, আজ আছি আপনাদের সঙ্গে। দুঃখিত আজ আর জে রোজ শো করতে পারছেন না। তাঁর হয়ে আমি এসেছি ভালোবাসার রংমহলকে রাঙাতে। জানি পারবো না, তবুও চেষ্টা করবো। তাঁর আগে একটা গুরুত্বপূর্ণ খবর দিতে চাই, বেশ কিছুদিন ধরে আমার বিয়ে নিয়ে সবার মনে নানা প্রশ্ন ছিল। আজ সব প্রশ্নের উত্তর দিতে এসেছি আমি। আপনাদের দোয়ায় শীগ্রহই আমি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে চলেছি। ”

ফারহান আচমকা রেডিও বন্ধ করে দিল। এরপর রেগে বলল,
-আর অন করবে না।
সিয়াম দুঃখি মুখ করে বলে,
-কেন স্যার?
-আমি বলেছি তাই।
-প্লিজ স্যার একবার চালাই? রোজ মেয়েটার কি হয়েছে জানার দরকার। আই হ্যাভ অ্যা হিউজ ক্রাশ অন হার। মেয়েটার কি হলো কে জানে? দেখি কিছু বলে কিনা!
-নো।
-প্লিজ! স্যার। আপনার জন্য এত খাঁটি আমি। তবুও কি কখনও কিছু বলেছি? কোনো অনুরোধ করেছি? আজ একটা অনুরোধই তো করছি। দরকার পড়লে আমার এ মাসের স্যালারির টুয়েন্টি পার্সেন্ট কেটে রাখুন।
-নো।
-কি সমস্যা স্যার? চালাই না প্লিজ!
সিয়াম ফারহানের দুহাত চেপে ধরতেই ফারহান বিরক্ত হয়ে তাকালো। এরপর কঠিন গলায় ঝারি দিয়ে বলল,
-হাত ছাড়ো! ছাড়ো! এসব বাচ্চামির মানে কি? সামান্য একটা প্রোগ্রাম নিয়ে এত নাচানাচি কিসের?
-প্রোগ্রাম না তো, মেয়েটা!
-হোয়াট?
-কিছু না।
-ওকে। শোনো কিন্তু ভালিয়ম কম করে। আমার কানে যেন না পৌঁছায়।
সিয়াম বিরবির করে বলে,
-খাটাশ ব্যাটা।
-কি বললে?
-ন,না, ক,কিছু ন,না।

রেডিওতে এক কলার ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করেছে কে সেই ভাগ্যবতী যাকে আরশান বিয়ে করছে। আরশান হেসে বলল, ‘সে ভাগ্যবতী কিনা জানি না, তবে আমি ভাগ্যবান যে তাকে পাচ্ছি। তার নাম জেসমিন মীর্জা অয়ন্তি। ‘ ফারহান দ্রুত পাশ ফিরলো।
-সিয়াম ভলিয়ম বাড়াও তো। নামটা বোধ হয় ভুলভাল শুনলাম।
-কি শুনেছেন স্যার?
-জেসমিন টাইপ কিছু। নামটা তো সাইরাহ্ হবে।
-আমিও তো জেসমিন শুনলাম স্যার। সাইরাহ্ টাইপ কিছু তো বলেনি।
ফারহানের কপালে ভাঁজ পড়লো। রোজের বদলে কার নাম বলল আরশান? নাকি রেডিওর ফ্রিকোয়েন্সি তে প্রবলেম? ফারহানের হাত-পা-কপাল প্রচন্ড রকমেন ঘামছে। এটা কেমন মশকরা? সিয়াম ভলিয়ম বাড়াতেই ফারহান শুনলো আরশান বলছে,’ হ্যাঁ জেসমিন মানে জুঁই। আমি তাকে কুসুম ডাকি। জুঁই ফুলের পরিবর্তে কুসুম।’
-সিয়াম!
-জি স্যার।
-আর’জে আরশানের নাম্বার দ্রুত জোগাড় করে দাও আমাকে।
-কেন স্যার?
-তুমি এত প্রশ্ন কেন কর? আর একটা প্রশ্ন করলে এই রাতে, অন্ধকারে তোমাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে চলে যাবো।
-নাম্বার তো আছে আমার কাছে। এই নিন।

ফারহান নাম্বার নিয়ে দ্রুত কল করলো। আরশান কল রিসিভ করলো না। ফোন তো সাইলেন্ট করে রাখা। ফারহান অনবরত কল করতে থাকলো।ওর চাঁদের সঙ্গে কি ঘটেছে কি ঘটছে জানা প্রয়োজন। চাঁদ কেমন আছে? ভালো আছে তো? ফারহান, ফারদিন সাহেবকে কল করলো। আরশানদের সঙ্গে ওনার যোগাযোগ ছিল এখনও আছে সেটা ফারহান ভালো করেই জানে। তাই সময় নষ্ট করলো না ফারহান। তিনবার রিং হতেই বাবা ফোন রিসিভ করে বিরক্তকন্ঠে বললেন,
-কি সমস্যা ফালাক? এত রাতে কল করছো কেন?
-চাঁদকে রেখে দাদাই কাকে বিয়ে করছে?
-যাকে করা উচিত, যাকে সে ভালোবাসে। তোমার এটা জেনে কি লাভ?
-ভালোবাসে মানে? সে চাঁদকে ভালোবাসে।
-হ্যাঁ, তবে বোন হিসাবে। প্রেমিকা বা বউ হিসেবে না।
-বাবা চাঁদ কোথায়?
-জানি না। তোমারও জানার দরকার নেই। হঠাৎ এতো বছর পর ওর খোঁজ নেওয়ার কি প্রয়োজন পড়লো?
-প্রয়োজন আছে বাবা,এতদিন জেনেছি দাদাই ওর সঙ্গে আছে। ও ভালো আছে।
-আজও সেটাই জানো। আর ফোন করবে না। ঘুমাচ্ছি আমি।
ফারদিন সাহেব ফোন রেখে আরসালানকে ফোন দিলেন। পরিকল্পনা তাহলে ঠিক দিকেই এগোচ্ছে।

ফারহান আবারও আরশানকে ফোন করতে শুরু করে। সিয়াম হা করে চেয়ে আছে। রাগি তেজি স্যারটা হঠাৎ বদলে গেল কি করে? রাগ দেখানোর বদলে নরম গলায় অনুরোধ করছে। হুকুম করা ভুলে গেছে নাকি? সিয়াম কি শিখিয়ে দেবে? তারপর ভাবে, না। কি দরকার ঘুমন্ত বাঘকে জাগানো? নিজেকে বাঘের খাদ্য বানানো বুদ্ধিমানের কাজ নয়। সিয়াম গাড়ির স্পীড কমিয়ে দিল। রাস্তাটা ভালো না, জায়গায় জায়গায় গর্ত। সিয়াম ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করল,
-আপনিও আর’জে রোজের ফ্যান নাকি স্যার? তাহলে তখন নাক সিটকালেন কেন?
-মানে? রোজের ফ্যান অনেক নাকি?
-মেল ফ্যান অনেক। কিন্তু দূর্ভাগ্যবশতভাবে তাকে কেউ দেখতে পারেনি। উনি সামনে আসেননা। যদি আসতেন তাহলে
-তাহলে?
-তাহলে আমি টুপ করে ওনাকে বিয়ে করে ফেলতাম। তারপর সারাদিন ওনার মিষ্টি গলা শুনতাম। আহা!
-গুড!
-একটা আইডিয়া দেন তো স্যার, ওকে কিভাবে পাওয়া যায়। আপনার তো কদর অনেক, একটু ব্যবস্থা করে দেবেন?
-একটা পি’স্ত’ল হবে?
সিয়াম ব্রেক কষলো। পি’স্ত’ল কেন? এত রাতে পি’স্ত’ল দিয়ে কি হবে? সিয়াম থতমত খেয়ে বলে,
-পি’স্ত’ল কেন স্যার?
-তোমাকে খু’ন করবো আমি।
-আমি কি করলাম?
-ফারহানের জিনিস নিজের ভাবতে চাওয়ার মত ভুল আর অন্যায় ফারহান ক্ষমা করেনা।
-আপনার জিনিস? কোনটা স্যার? ফ্যান? না, না রেডিও? আপনার তো রেডিও নেই! তাহলে?
-আর একটা কথা বললে তোমাকে জানে মে’রে দেবো সিয়াম। আমার রাগ কিন্তু বাড়ছে বৈ কমছে না। আর তুমি জানো আমার খু’ন করতে হাত কাঁপে না।

সিয়াম এবার স্তব্ধ হয়ে গেল। এই কথাটা চিরন্তন সত্য। এই মানুষটা হাসতে হাসতে খু’ন করে। একপাশ থেকে খু’ন করে অন্যপাশে গিয়ে হাত ধুয়ে সাধুসন্ন্যাসী টাইপ রিয়াক্শন দিতে ওস্তাদ এই অভিনেতা। সিয়াম নিজেও তো সরাসরি দুইটা খু’ন দেখেছে। এনাকে বিশ্বাস নেই। দেখা গেলো সত্যিই সিয়ামকে মে’রেটেরে দিল। কিন্তু সিয়াম কি অন্যায় করেছে? কি ভুল বলেছে? ওনার জিনিসটাই’বা কি?

প্রায় দেড়শো কল করে ফেলেছে ফারহান। শো শেষ করে আরশান ফোন হাতে নিতেই দেখলো আননোন নাম্বার থেকে একশ সাতচল্লিশ মিস্ড কল। এতরাতে এভাবে কে ফোন করেছে? আরশান কল ব্যাক করল। একবার রিং হতেই ফোন রিসিভ হতেই ফারহান ক্লান্ত স্বরে বলে,
-ফোন কা’টবে না। চাঁদ কোথায়? কাকে বিয়ে করছো তুমি?

আরশান প্রথমবারেই গলা শুনে চিনে ফেলল ফারহানকে। ঔষধ এত দ্রুত কাজ করবে তা ধারনার বাইরে ছিল ওর। ও তো ভেবেছিল ফারহান রাগ নিয়েই থাকবে। ফারহান রোজকে ঘৃণা করে, আর সেটাই করে চলবে। কিন্তু পাগল ছেলে তো একটু শুনেই পাগলামি শুরু করে দিল। আগে পরে জানার প্রয়োজনবোধ করে নি নাকি? আরশান মুচকি হেসে গম্ভির গলায় বলে,
-কেন?
-আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নেবে না তুমি। চাঁদ কোথায় সেটা বলো।
-জানি না।
-জানো না মানে? চাঁদ তোমার কাছে ভালো থাকবে বলেই তো ওকে রেখে গিয়েছিলাম আমি। তুমি ওকে ভালবাসো, ও তোমাকে ভালোবাসে তাই রেখে গেছিলাম। ও ঘৃণা করে আমাকে,তাই চলে এসেছিলাম। যেন ও সুখে থাকে। ভালো থাকে । আর তুমি বলছো ও কোথায় তা তুমি জানো না!
-না জানলে কি করে বলবো? চলে গেছে রাগ করে।
-আর তুমি যেতে দিলে?
-আমাকে আটকে রেখে গেছে। ওকে চিনিস না?কেমন ফাজিল।
-সামলাতে পারো না, তাহলে দায়িত্ব নিতে গিয়েছিলে কেন? ওর কিছু হলে আমি তোমাকে ছাড়বো না দাদাই।
-আগে তো ধরে দেখা তারপর ছাড়াছাড়ির প্রশ্ন আসবে। গতবার একটা থা’প্পড় লাগিয়েছিলাম এবার গুনে গুনে বেশ কয়েকটা লাগাবো। আমার বেবিকে কষ্ট দেওয়ার ফল বুঝবি।
-ওকে আমি কষ্ট দিয়েছি? তোমরা কিছু করোনি?
-আরে ভাই, তুই তোর সাইকিক প্রেম আর পাগলামি যে ওভাবে প্রকাশ করবি তা কি আমরা বুঝেছি? তোরা দুজনেই যে ডুবে ডুবে জল খাচ্ছিলি তা কি জানতাম?ও অস্বীকার করলো বলেই তো আমি রেগে তোকে ওসব বললাম।
-তাহলে সত্যটা এতবছর বলোনি কেন? কি ভেবেছিলে? ওকেও ইউজ করে ছেড়ে দিয়েছ? নতুন করে কাকে,,
-ভাই, তুই এত সন্দেহ করিস ক্যান? তোর চাঁদ একদম ঠিকঠাক! কোনো ধরাধরি, ছাড়াছাড়ি নেই। সেদিন ওর বাবা-মায়ের মৃত্যুর খবর দেওয়ার পর ওকে সান্ত্বনা দিতে ভালোবাসার কথা বলেছিলাম, ও নিজেও সেজন্য বলেছে। তুই কোথ থেকে কতটুকু শুনে পাগলামি চালু করে ব্যাপারটা ঘেটে দিলি।
-আর এত ফ্যান?এত ছেলে? আমার পি.এ অবধি ওকে বিয়ে করতে চায়। ওকে এসব ফালতু রেডিও ফেডিও চালু করতে বলেছে কে?
-রোজকে দেখেছিস বড় হবার পর?
-না।
-তাইলে আর করলি কি? তোর বউ তো চাঁন্দের টুকরা। ফ্যানফলোয়ার বাড়বে, এটা স্বাভাবিক। আমার কয়েক ডজন ছোট ভাই তো স্বয়ংবরের অপেক্ষা করছে। মনে হয়ে বিয়ে’টিয়ে হয়ে যেতে পারে।
-বিয়ে করাচ্ছি আমি। নিঁখোজ হয়েছে কবে? এক্সাক্টলি কোনদিন কোন সময়?
-কেন?
-ওর কান টেনে নিয়ে আসবো। মা’র এখনও পাওনা আছে। হাত-পা ভে’ঙে ঘরে বসিয়ে রাখবো ওই বেয়াদব বদমাইশটাকে।
-সোমবার, সকাল সাড়ে এগারো’টা।
-ওকে! আমরা আসছি পরশু।
-কি?
-বললাম পরশু আসছি আমরা।
-তুই জানিস ও কোথায়? ক্যামনে ভাই?
-চাঁদের পাই টু পাই হিসেব রাখা ছিল আমার। জানিনা মিলবে কিনা, বাট ট্রাই করবো। বেয়াদবটা পাল্টে গেছে অনেক।
-ইউ ঠু! ওকে, কাম ফাস্ট। আ’ম ওয়েটিং।

ফারহান ফোন রেখে সিয়ামের দিকে তাকালো। সিয়াম হা করে চেয়ে আছে। নারীবিদ্বেষী মানুষটার প্রেমিকাও আছে? হিরোইন নাকি অন্যকিছু? চাঁদ বলে ডাকা হয় তাকে? এই ব্যাটা রোম্যান্টিক নাকি অত্যাচারী? টর্চার করার কথাই তো বললো। আবার কিছু কিছু কথায় রোম্যান্টিকতার আভাস! সিয়াম ফারহানের কথাগুলো পুনরায় মনে করেই লাফ দিয়ে উঠলো।
-স্যার! রোজ আপনার চাঁদ?
-ম্যাম ডাকবে।
-ও,ওকে স,স্যার! (সিয়াম রে আজ তোর কপাল ভালো ছিল। বড় বাঁচা বেঁচেছিস!)

চলবে?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here