#তুই_হৃদহরণী – ২২
তুরফা ত্রাস পায়ে ইয়া বড় দরজা দিয়ে রুমে ঢুকল। চারপাশ শুধু দেখছে। মনে হচ্ছে ভুলে কোনো রাজপ্রাসাদে চলে এসেছে। কি সুন্দর জিনিস দিয়ে সাজানো গোছানো সব। দেখলেই মন জুরে যায়। অনেক বড় ড্রয়িংরুম। বসার কি সুন্দর জায়গা। সিঁড়ি যেন কাঁচ দিয়ে তৈরি। চারিদিক থেকে সাদা সোনালি আলো দিচ্ছে। তুরফার মন এক মুহূর্তে প্রশান্তি তে ছেয়ে গিয়েছে। মুখে তার এক ফোঁটা বহিঃপ্রকাশ। হঠাৎ তার চোখ গেল একটা পিলারে। সেখানে আহরার এক হাত আরেক হাতের ফাঁকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে হেলান দিয়ে। একটা পা পিলারের সাথে লাগানো। তুরফার চোখ তার উপর যেতেই ভ্রু উঁচু করে ইশারা করল যার প্রশ্ন হয় “কি হলো?” তুরফা কোনো উত্তর দিতে পারল না। না মুখে আর না ইশারায়। শুধু দাঁড়িয়ে রইল। সে জানে না আজকাল এই লোকটার সামনে এলেই কেন তার অস্থিরতা বেড়ে যায়। হৃদ স্পন্দন বাড়ে, ভেতরের ধুকবুকানি শব্দ স্পষ্ট শুনতে পায়। নিশ্বাসের মাত্রা বাড়ে। তুরফা বড় করে একটা শ্বাস টেনে নিয়ে ঢোক গিলল। চোখের পাতা ফেলল দু তিন বার। কি করবে কোথায় যাবে কিছু মাথায় আসছে না। ইচ্ছে হচ্ছে দৌড়ে দরজা দিয়ে বের হয়ে যেতে। বিব্রত বোধ সৃষ্টি হচ্ছে তুরফার মাঝে। আহরার হাতের জোড়া আলগা করল। এক হাত ঠোঁটের কাছে এনে দুই আঙ্গুল দিয়ে ঠোঁটজোড়া চেঁপে দিয়ে কিঞ্চিৎ হাসল মুখ ফিরিয়ে। আবার তাকাল তুরফার দিকে। এবার হাত সরিয়ে আহরার ঠোঁট কামড়ে হাসল। তা দেখে তুরফার মরণদশা। দাঁত কিড়িমিড়ি করে উঠল তুরফা চোখ রাঙ্গিয়ে।
“চলুন হৃদহরণী আপনার থাকার রুম টা দেখিয়ে দিয়ে আসি।”
তুরফা যেন আকাশ থেকে পরল। এ লোক কি থাকার কথা বলছে?
“কি হলো? দাঁড়িয়ে থাকবে নাকি আসবে? চলো।”
“আমি এখানে থাকব না।”
আহরার চোখ রাঙ্গাল তুরফার দিকে চেয়ে। দাঁত কষে বলল,
“চলো।”
আহরারের পিছনে বাধ্য মেয়ের মতো যেতে লাগল তুরফা। পিছন থেকে তুরফার বিড়বিড়ানি কথা শুনা যাচ্ছে। আহরার সামনে যেতে যেতে আড়চোখে তুরফা কে দেখে মনে মনে হাসছে।
একটা রুমের দরজা খুলে আহরার দাঁড়াল।
“এখানেই থাকবে আজ।”
“….
“কি বললাম শুনলে হৃদহরণী?”
তুরফা কোনো উত্তর দিল না। চুপ করে ভেতরে গেল। কি বিশাল রুম যেন ফুটবল খেলার মাঠ। কি আকর্ষণীয় সব জিনিসপত্র দিয়ে রুম সুসজ্জিত করা। তুরফা মুখ ফুটে কিছু বলল না। মনে মনে খুশি হলো। ভেতরে গিয়ে দেখতে লাগল। কানের খুব কাছে পিনপিনে আওয়াজ এলো “হৃদহরণী” তুরফা থমথমে হয়ে গেল। হঠাৎ এমন আওয়াজে ভীষণ রকম ভয় পেল। দম একেবারে আতকে উঠল। তাড়াতাড়ি করে পিছন ফিরে খুব কাছে আহরার কে দেখতে পেয়ে পিছন যেতে গিয়ে পড়ে যায় বিছানার উপর। ধপ করে আওয়াজ হয়। তুরফার ভয়ের সে রেশ টা মনে এখনো আছে। বিছানা থেকে দূরে যেতে চাইলে আহরার তার দিকে একদম ঝুঁকে যায়। তুরফার পাশে বিছানায় এক হাত রাখল। ওর দিকে চেয়ে আহরার অপলক দেখছে। তুরফা তরাসে ড্যাবড্যাব করে আছে।
“ভয় পেলে তোমার চোখ গুলি দারুণ লাগে।”
“….
আহরার কিছু না বলে তুরফার নেকাব টা টান দিয়ে খুলে ফেলল।
“আরে আপনি..”
“সুহহ।”
তুরফার ঠোঁটে আঙ্গুল না লাগিয়ে বলল আহরার।
“ব্যস ২ মিনিট শুধু দেখতে দাও। একেবারে নড়বে না। তাহলে কিন্তু ঘাটে বেঁধে রেখে দেখব। ভালো করে দেখব।”
তুরফা চাইলেও কিছু বলতে পারল না। বিচলিত হচ্ছে তুরফা। একটু পর আহরার বলল,
“তুমি নূর আমার ‘তুর’।”
কথা শেষ করে চলে গেল আহরার। তুরফা ঠিক বুঝতে পারল না। কথাটা এত টা দ্রুত আর আস্তে উচ্চারণ করেছে লোকটা বুঝল না তেমন। সে চিন্তা বাদ দিল তুরফা। গিয়েছে আপদ বিপদ এখন হাফ ছেড়ে বাঁচা যায়। তুরফা সেসব ভুলে ঘর দেখাতে ব্যস্ত।
ফিরাত এসে ডেকে নিয়ে গিয়েছে তুরফা কে মোনতাহ্-র ঘরে। তুরফা গিয়ে দেখল মোনতাহ্ বিছানায় অনেক শপিং নিয়ে বসে আছে।
“কিরে এ গুলি..”
“বিয়ের শপিং।”
“কে আনল এত তাড়াতাড়ি করে ফিরা..”
“আহরার ভাইয়া।”
তুরফার মুখ চুপষে গেল। মুখ একটু বাঁকা করে বিছানায় বসল। মোনতাহ্ কিছু বলতে যাবে তার আগেই ঘরে দুজন মহিলা আসল। তুরফা আর মোনতাহ্ দুজনেই মুখোমুখি করল ভ্রু কুঁচকে। তখন ফিরাত এলো।
“উনারা পার্লার থেকে এসেছেন তোমাদের দুজন কে সাজাতে। তাড়াতাড়ি করো। আর তুরফা ওই যে লাল রং এর শপিং টা দেখছো এটা পরে নিও। তোমার জন্যে আনা হয়েছে। তাড়াতাড়ি করবেন আপনারা।”
ফিরাত হাসল। তুরফা তাকিয়ে দেখল আহরার প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে দরজায় হেলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তুরফার মুখ বিষিয়ে গেল রাগে। দাঁত কিটকিট করছে তার। তার জন্যে আনতে কে বলেছিল? আহরার মুচকি হাসল। ঠোঁট অল্প নাড়াল। তুরফা ঠিক বুঝল উনি তাকে.. রাগে শরীর তিরতির করছে। এখনি যেন লোকটা কে খেয়ে নিবে রাক্ষসীর করালগ্রাসের মতো।
“ফিরাত চল নয়তো ওদের দেরি আর তোর বিয়েরও।”
দুজনই হেসে চলে গেল। মোনতাহ্ কে তুরফা আর পার্লারের দুজন মিলে সাজাতে লাগল। লাল বেনারসির সাথে গহনার বাহার। মোনতাহ্ কে যেন এক লাল পরী মনে হচ্ছে। কি লাগছে! তুরফা কে দুজন মিলে জোর করে সাজাতে বসেছে।
তুরফা কে ডাকতে এসে তাড়াতাড়ি করে দরজা খুলল আহরার। তুরফা তখন আঁচল হাতের মাঝে ছড়িয়ে রেখে শাড়ীর কুচি ঠিক করাতে ব্যস্ত। আহরার মুহূর্তে স্তব্ধ হয়ে গেল। সময় যেন তার থমকে গিয়েছে। দম আটকে আসছে। কোমল মোহঘোর দৃষ্টি নিয়ে দেখছে তুরফা কে। কি মোহনীয় লাগছে তুর কে। মায়া রূপ যেন গলিয়ে পরছে তার থেকে। নেশাভরা চোখ নিয়ে অবলোকন করছে তুরফা কে। তুরফা আচমকা আহরার কে এভাবে আসতে দেখে বিব্রতে পড়ে যায়। ভয়ে বুক ধরাক ধরাক করছে। এদিক ওদিকে তাকিয়ে পিছনে যেতে লাগল। আহরার গভীরঘোর দৃষ্টি তে এগিয়ে যেতে লাগল ওর দিকে। তুরফার দিকে ভালো করে চোখ বুলাচ্ছে সে। পিওর স্লিক জরজেট সাদা শাড়ী পরনে। হাত ভর্তি সাদা চুরি। কানে বড় দুটি কানের দুল। বোট গলার ভরাহাতা নানান রং মিশ্রিত ব্লাউজ। তবে সবচেয়ে বেশি সেটা আকর্ষণ করছে আহরার কে তা হলো তুরফার খোলা সুস্নিগ্ধ চুল। তুরফা ভয় নিয়ে পিছনে যেতে লাগল। অপর দিকে আহরার মোহ নিয়ে এগিয়ে আসছে তুরফার দিকে। বুকের ভেতরে কি হচ্ছে তা কাউকে বুঝাতে পারবে না সে। অনুভূতি শুধু অনুভব করছে। চোখের পলক ফেলছে না। হৃদপিন্ডের কাজ যেন বন্ধ হয়ে আসছে। ভেতরে কি রকম হচ্ছে তা নিজেও বুঝতে পারছে না আহরার। আপনাআপনি শুধু সামনে এগিয়ে যাচ্ছে ভেতরের কোমল অনুভূতি নিয়ে। তুরফা যেতে যেতে দেওয়ালের খুব কাছে চলে গেল। সামনের চুল গুলি এলোমেলো হাওয়ায় দুলে বিরক্ত করতে শুরু করে দিয়েছে। যা তুরফা কে আরো বিচলিত করছে। আহরার একদম তার দিকে চলে এসেছে। তুরফার পিট লেগে গেল দেওয়ালে। পাশ ফিরে দেখল নিজের অবস্থান। সামনে তাকাতে যাবে তখনই আহরারের মুখ খুব নিকটে আবিষ্কার করল। নিশ্বাস থমকে গিয়েছে তুরফার। আহরার তুরফার এক পাশে দেওয়ালে ভর দিল এত হাত। তুরফা সামনের চুল গুলি সরাতে হাত উঠালে আহরার মুগ্ধ চোখে তা ধরল। তুরফার হাত নামিয়ে নিজের আলতো ছুঁয়ায় সরাল চুল। কেঁপে উঠল তুরফা। শরীরের বিদ্যুৎ প্রবাহিত হলো খনিকে। হৃদপিন্ড যেন টিপটিপ করছে। আহরারের শরীরে শিহরণ বয়ে গেল। মিগধ এক হাওয়া বইতে লাগল মনের আঙ্গিনায়। আহরারের কি হলো বুঝে উঠল না তুরফা। আচমকা আহরার তুরফার হাতের উপর পিটে চুমু দিল। তুরফা বড় করে একটা শ্বাস টান দিল। দম টা বন্ধই হয়ে যাচ্ছে। আহরার আবার স্নিগ্ধ দৃষ্টি দিল ওর দিকে। ইচ্ছে হচ্ছে ঘন কালো চোখ দুটিতে ঠোঁটের পরশ দিতে নয়তো ওই কাঁপা ঠোঁটে। খুব টানছে আহরার কে। আহরার অতিব কষ্টে নিজেকে সংযত করতে চাইছে। কিছুতেই পারছে না। বারবার মাথার পোকা তুরফার দিকে যেতে বলছে। ওদিকে তুরফার চোখ টলমল পানি চলেই আসবে। আহরার নিজেকে সামলাতে না পেরে সরে এলো তুরফার দিকে। নিজের সাথে নিজে যুদ্ধ করে এইটুক কাজ করতে সক্ষম সে। আর কিছু বলল না। একবার তুরফার দিকে তাকাল। তুরফা তখনো সেখানে দাঁড়িয়ে ভয়ে কাঁপছে। আহরার দ্রুত রুম থেকে বের হয়ে এলো। সে নিজেকে খুব ভালো চিনে। ওখানে আর ১ মিনিট থাকলে নিশ্চিত অপ্রত্যাশিত কিছু হয়ে যেত।
তুরফা সেজে এ ঘরে এসেছিল ফোন টা নিতে। তখন আহরার ঘর দেখিয়ে যাওয়ার পর দেখতে দেখতে ফোন রেখে ওঘরে চলে গিয়েছিল ফিরাতের সাথে। ফোন নিতে এসে কুচি টা একটু এলোমেলো হয়ে যাওয়ায় ঠিক করছিল। আর আহরার তুরফা কে ডেকে নিতে এসে এ ঘটনার সম্মুখীন হয়।
কাজী দুজনের বিয়ে সম্পূর্ণ করলেন। সবার মুখে হাসি। নিজের পাওনা বুজে মিষ্টিমুখ করে চলে গেলেন কাজী। তুরফা ও ঘরে। আহরার নতুন জুটির ফটোগ্রাফার সেজেছে। যেতে যেতে যখন দেখল তুরফা সুইমিংপুলের ধারে আনমনে বসে আছে খোলা চুলে। শিউরিয়ে উঠল আহরার। মুচকি হাসল।
“আজ এখানে থাকলে চলবে না আমার। খাডাস লোকটার চালচলন কেমন ঠেকছে। কখন কি করে বসে আল্লাহ জানে যে লোক উনি। দরকার নেই বাবা মোন কে গিয়ে বলি আমি থা..”
নিজের সাথে বিড়বিড় করে তুরফা মোনতাহ্-র ঘরের দিকে পা বাড়াল। পিছন থেকে গাম্ভীর্য কন্ঠ শুনা গেল।
“কোথায় যাচ্ছো?মোনতাহ্ আই মিন ভাবি ওখানে নেই। যেয়ে লাভ নেই।”
তুরফা আতকে উঠল গলা শুনে। পিছন ফিরে আহরার কে দেখল। সাদা পাজামা পাঞ্জাবী তে লোকটা কে মারাত্মক সুদর্শনে লাগছে। তুরফা আশ্চর্যান্বিত হয়ে রয়।
“যেখানে থাকা দরকার সেখানে আছে। নতুন বর বউ কে নিজেদের মতো একটু থাকতে দাও। নিজে রোমান্সের কিছু বুঝো না অন্যদের তো অন্তত বিরক্ত করো না।”
“দে দেখুন..”
“হুম দেখছি তো। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা হুর হৃদহরণী কে দেখছি। তুমি না বললেও দেখছি।”
তুরফা রাগি ভাবে তাকিয়ে পিছন ঘুরে গেল এ কথা শুনে। আহরার এগিয়ে এসে তুরফার হাত ধরল শক্ত মুঠিতে।
“এসব করে লাভ নেই তুর। চলো আমার সাথে।”
চলবে….
#সাদিয়া