#তুই_হৃদহরণী
#Sabriha_Sadi (সাদিয়া)
পর্ব : ৭
তুরফা ডেস্কে কাজ করছে। এমন সময় তার ডেস্কের সামনে একজন এসে হাজির।
“এই যে ম্যাম ফাইল গুলি দেখুন।”
তুরফা কন্ঠ শুনে মাথা তুলে তাকাল।
“কিসের ফাইল?”
জবাব দিল।
“ফিরাত স্যার দিয়ে পাঠিয়েছে। এগুলি দেখে বসের কাজ থেকে সাইন করিয়ে আনবেন।”
“রেখে যান।”
“আচ্ছা আপনার নাম টা কি জানতে পারে না এই অধম?”
“আমি তুরফা।”
“ও।”
মিহির একটু চুপ থেকে আবার বলল,
“তুরফা আপনি আমার থেকে ছোট হবেন আমি কি তুমি করে বলতে পারি না?”
তুরফা এমন প্রশ্ন শুনে মিহিরের দিকে মাথা তুলে তাকাল। কয়েক সেকেন্ড স্থির দৃষ্টি রেখে আবার নামিয়ে নিল চোখ। কিন্তু কোনো কিছু বলল না। মিহিরও একটু চুপ থেকে আবার বলল,
“তুমি মানে আপনি কিন্তু বেশ থমথমে মানুষ। চুপচাপ, কারো সাথেই বেশি কথা বলেন না। একা থাকতেই বেশি পছন্দ করেন।”
“তুমি করোই বলতে পারেন।”
মিহির কিছু বলল না। তবে মুচকি হাসল। মনে মনে হয়তো খুশি হলো। তুরফা কে আর কিছু বলল না। না বলেই চলে গেল। তুরফা সে দিকে এক বিন্দুও ভ্রুক্ষেপ করল না। নিজের মতো আবার কাজ শুরু করল।
আহরার অফিসে এসে আগে তুরফার ডেস্কে নজর দিল। মাথা নিচু করে কাজ করছে। আহরার গিয়ে ২ মিনিট সেখানে দাঁড়িয়ে রইল। তুরফা খেয়ালও করল না। আহরার দাঁড়িয়েই রইল। অন্য সব স্টার্ফরা হা করে তাকিয়ে আছে। সব কিছু নীরব, কোনো শব্দ নেই বিষয় টা খেয়াল করে তুরফা পাশ ফিরে তাকাল। সবাই তার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। সামনে তাকাতেই আহরার কে দেখল, বিমুগ্ধ হয়ে তাকে দেখছে। তুরফার চোখ আহরারের দিকে যেতেই আহরার এক গাল হেসে দিল। হেসে মাথা ঝাঁকিয়ে চুপ করে নিজের কেবিনে চলল। সবাই তখনো অবাক হয়ে দেখছিল। তুরফা আগা মাথা কিছুই বুঝল না। শুধু চোখ বড় করে হা করে তাকিয়ে ছিল বোকার মতো। ফিরাত এসে সবাই কে যার যার কাজ করার নির্দেশ দিল। একবার তুরফা দিকে তাকিয়ে কি মনে করে খুশি হলো। তারপর চলে গেল।
ফিরাত নিজের কেবিনে বসে আছে। অথচ তার মন টা অন্য জায়গায় পরে আছে। অস্থিরতা কাজ করছে। কাজে মন বসাতে পারছে না। এত দিনের ব্যস্ততায় একবার তার চাঁদ কে দেখা হয়নি তার। আর ঠিক থাকতে পারছে না। আজ যদি দেখা না হয় তবে মনে হচ্ছে তার দম টাই বন্ধ হয়ে যাবে।
“না আজ একবার দূর থেকে হলেও দেখতে হবে।”
নিজে নিজেই বলে, একটা নিশ্বাস ফেলল জোরে। গা হেলিয়ে দিল চেয়ারে। ‘মনের অসুস্থতা এখন শরীরে ছেড়ে যাচ্ছে বিষের মতো।’
মিহির তুরফার ডেস্কে গিয়ে দাঁড়াল।
“ম্যডাম তো দেখি আমাকে দেখছেই না। কখন এলাম।”
তুরফা মাথা তুলে মিহির কে দেখে ভাবল, “এড়িয়ে চলেও লাভ হয় না।”
“কি হলো? আপনি কি মানুষ দেখলে ভয় পান?”
“না। বলুন কি বলবেন।”
“আমি না মন পড়তে পারি। বলি তুমি এখন কি ভাবছো?”
তুরফা ভ্রু কুঁচকে তাকাল।
“তুমি নিশ্চয় এটা ভাবছো, যে আমি এত বেহায়া কেন? গায়ে পরা কেন? তুমি কথা না বললেও আমি কেন তোমার সাথে এসে এসে কথা বলি। তাই না?”
তুরফা আনমনে হেসে দিল। সাথে মিহিরও। ওদিকে পেছন থেকে একজন হুংকার দিয়ে উঠল। প্রচন্ড চিৎকারে পরিবেশ থমথমে হয়ে গেল। সবাই চুপ, নীরব, মুখে কথা নেই, ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে আছে। তুরফাও বেশ ভয় পেল। কেঁপে উঠল গর্জনে। উঠে দাঁড়াল। মিহির কৌতূহলে ভ্রুযোগল এক করে পিছন ফিরে তাকাল। এমন করে কে চিৎকার দিল তা দেখার জন্যে। আহরার কে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে সবার মতো সেও ভয় পেল। তুরফা পরখ করছে আহরার কে। কি রাগি চোখ, লাল টকটকে চোখ, দাঁত কিড়িমিড়ি করছে, মাথার পাশের রগ টা দপদপ করছে দেখাই যাচ্ছে। জোরে নিশ্বাস ফেলছে। যেন বিকৃত ভয়ংকর এক চেহারা। তার মনের ভেতরেও এক ভয়ের বাসা বেঁধেছে। এ কারণেই হয়তো গলা ভেতর থেকে শুকিয়ে আসছে।
আহরার প্রচন্ড রেগে ধেয়ে আসল এদিকে। মিহিরের দিকে আগুন এক দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। সংকুচিত হয়ে মিহির মাথা নোয়াল। তুরফা নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছে।
“হেই ইউ….”
আহরার রাগে ফেটে যাচ্ছে ঠিক ভাবে কথাও বলতে পারছে না।
“কাজ নেই? আন্সার মি কাজ নেই?”
শেষের কথা টা এত জোরে চিৎকার করে বলেছে আহরার সবার কানের পোক নড়ে গিয়েছে। বাকিদের সাথে তুরফাও ভয়ে কাঁপল। সব কিছু থমথমে। এত জোর চিৎকার করল যেন দেওয়াল বেঁধ করেছে। পীনতল নীরবতা চারিদিক ছেয়ে গেল। মিহির কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,
“আসলে স্যার…”
“জাস্ট শাট আপ স্কাউনড্রেল। আউট, আই সে আউট। সবাই সবার কাজে যাও। নাও ফাস্ট।”
ভয়ে সবাই তাড়াতাড়ি চলে গেল নিজের ডেস্কে। তখনো সবার ভেতর কাঁপছিল। মিহির অপমান বোধ করে সেও আস্তেআস্তে চলে গেল। তুরফা সবার মতো আহামরি ভয় না পেলেও খুব ভয় পেয়েছে। হয়তো সবার মতো নয়। এবার আহরার তুরফার দিকে তাকাল। দৃষ্টিতে সে কি ঝাঁঝ। ঝলসানো দৃষ্টি যাকে বলে। তুরফা আপনাআপনি শুকনো ঢোক গিলল। আহরার এক দৃষ্টি তে তাকিয়ে থাকল তার দিকে। তারপর কয়েক টা ঘন নিশ্বাস ফেলে তুরফার হাত ধরল। তুরফার আত্মা কলিজা পর্যন্ত শুকিয়ে এলো। এতক্ষণ সবাই যত টা না ভয় পেয়েছে তুরফা এখন তার চেয়ে হাজার গুন বেশি ভয় পাচ্ছে। আহরার টানতে টানতে শক্ত হাতে তুরফা কে নিয়ে নিজের কেবিনের দিকে এগিয়ে গেল।
ফিরাত চেয়েও আহরার কে কিছু বলতে পারল না। সে স্পষ্টই বুঝেছে আহরার ভয়ংকর ভাবে রেগে আছে। বলতে গিয়েও চোখ মুখ দেখে থেমে গেল। কিন্তু ভয় লাগছে তার মায়ের পেটের না হলেও আপনের মতো বোনের জন্যে। তবে এটা সে ভালো করে বুঝতে পেরেছে আহরার এবার তুরফা মেয়ে টা কে নিয়ে একটু নয় খুব বেশি সিরিয়াস। আর এটাও ভালো লেগেছে তার আহরার কয়েক দিন ধরে, ঠিক মতো অফিস তো করছেই সাথে মেয়েদের সাথে বিছানায় যাওয়া টা টুটালি অফ আছে। তা হয়তো একটা মেয়ের জন্যেই সম্ভব। তুরফা তো ইনডাইরেক আহরার কে অনেক টা ঠিক করে দিয়েছে। তবে কি আহরারের দিন ঘুরল বলে? কোথায় যেন ফিরাত একটু শান্তির বাতাস পাচ্ছে।
আহরার রেগে মেগে তুরফা কে নিয়ে কেবিনে নিয়ে ফেলল। সাথে সাথে রুমের দরজা লক করে দিল। তুরফার দিকে একটু একটু করে এগিয়ে আসতে লাগল। তুরফা পিছিয়ে যাচ্ছে তবুও তার কলিজা, ভেতরের সব কিছু একদম শুকিয়ে চৌচির হয়ে আছে। শরীর কাঁপছে আহরার কে এভাবে এগিয়ে আসতে দেখে। এমনিতেই উনি যেমন আর এখন.. ভেবেই ভেতর আত্মা তার হু হু করে উঠল।
তুরফা কিছু বলার আগেই আহরার লম্বা দুই পা এগিয়ে দিয়ে তুরফার একদম কাছে চলে আসে। নেকাবের উপরই গাল জোড়ো শক্ত করে চেঁপে ধরল আহরার। চোখ বড় করে বের করে দিয়ে দাঁতে দাঁত কাটছে আর বলছে,
“তোর সাহস কি করে হয়? অফিসে বসে আমার সামনে অন্য কোনো ছেলের সাথে কথা বলিস তুই? হাউ ডেয়ার ইউ? আমার সাথে বেড শেয়ারের কথা বলেছিলাম বলে ফুলে ফেটে উঠেছিলি আর এখন অন্য ছেলেদের সাথে হেসে কথা বলিস এই তোর নীতি? তুই ওই ছেলেটার সাথে হেসে কথা বলেছিস তুরফা?”
তুরফার খুব লাগছে। চোখ টলমল করছে পানি তে। আহরারের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করেও পারছে না। আহরার আরো শক্ত হাতে ধরল তুরফার গাল।
“ফারদার যদি দেখি এমন কিছু। তুই কোনো ছেলের সাথে কথা বলছিস, হাসছিস বা অন্য কিছু। তুরফা দেখে নিস আমি তোকে মেরে ফেলব। তুরফা শুধু আমার শুধুই আমার। তুরফা আমার হৃদর ছুরি করেছে ও আমার হৃদহরণী। শুনেছিস তুই হৃদহরণী।”
আহরার ছেড়ে দিল তুরফার গাল। তুরফা গুটিয়ে গিয়েছে ভয়ে। বরফ যেমন করে জমে যায় তেমন। কাঁপছে, শ্বাস টা নিতে পর্যন্ত পারছে না। আহরারের আড়ালে চোখের দুই ফোটা পানি ফেলে দিল। গাল গুলি প্রচন্ড ব্যথা করছে কারণ খুব শক্ত হাতে ধরেছিল। আহরার এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিল তুরফা দিকে,
“হৃদহরণী পানি টা বসে খেয়ে নিন।”
“….
“কি হলো? খেয়ে নিন।”
তুরফা অবাক হয়ে দেখছে লোক টা কে। উনি কি পাগল নাকি বদ্দ উন্মাদ? এই মাত্রই না তুইতুকারি করল এখন সোজা আপনি তে চলে গেল? তুরফা অবাক নয়নে দেখছে তার সামনের অদ্ভুত মানুষ টি কে। আহরার আর কিছু বলল না। এক হাতে তুরফা কে নিজের চেয়ারে ঠেলে নিয়ে গিয়ে বসাল। পাশে দাঁড়িয়ে বলল,
“খেয়ে নাও তুর। প্লিজ রাগ করো না। রাগ উঠলে আমার মাথা ঠিক থাকে না। কিছু মনে করো না প্লিজ তুর আমার। পানি টা খেয়ে নাও।”
এবার তুরফা আরো অবাক হলে। কিন্তু বুঝল এই লোকের সমস্যা আছে, হয়তো মাথা খারাপ, নয়তো অতিরিক্ত রাগ তাকে গ্রাস করে নেয়। তুরফার এবার আরো ভয় হতে লাগল। কিন্তু তবুও সে চুপচাপ বসে রইল। আহরার পানি টা এগিয়ে দিয়ে বলল,
“কি হলো? পানি টা খেতে বললাম না তোমায়(”
ধমকে তুরফা চমকে উঠল। আস্তে করে নেকাব টা খুলল। সাথে সাথে খেয়াল করল আহরার নিচে ফ্লোরে বসে আছে। তুরফা হতবাক হলো। আহরার মুগ্ধ হয়ে দেখছে তার মুগ্ধকারিনী কে। পলক পরছে না তার। তুরফার খারাপ লাগতে শুরু হলো। কেমন যেন লাগছে। তাড়াতাড়ি করে পানি খেয়ে নেকাব লাগাতে লাগল।
আহরার শান্ত ধারালো স্বরে বলল, “তুমি আমার নূর তুর।”
তুরফা বিস্মিত চোখে তাকাল। খুব জলদি করে নেকাব টা লাগিয়ে উঠে দাঁড়াল। সাথে আহরারও। তার দিকে একটু ঝুঁকে আহরার বলল,
“লজ্জা পেলেন বুঝি হৃদহরণী?”
তুরফার এখন ভয়ের সাথে রাগও হলো। রাগের পরিমাণ টা কম ভোতা। তবুও আগুন নিবুনিবু জ্বলছে। তুরফা পাশ কাটিয়ে যেতে চাইলে আহরার বাঁধা দেয়।
“আমার জবাব?”
“কাজ আছে।”
“পরেও করা যাবে। কথা বলা যায় না? আমাকে একটু সময় দিলে কি হয়?”
আগুন এবার ধপ করে জ্বলে উঠল। তুরফা ঠোঁটজোড়া এক করল। কিটকিট করছে।
“এভাবে হুটহাট আমার ডাকবেন না কাজ ছাড়া। আশা করি বুঝতে পেরেছেন।”
তুরফা এটা বলে চলে যেতে চাইলে আহরার সামনে হাত মেলে দাঁড়ায়। কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে তুরফার কোমর টেনে কাছে আনে। তুরফা ভয়ে আর আড়ষ্ট হয়ে থাকতে পারল না। কোনো রকম জোর করে আহরার কে ধাক্কা দিয়ে সরাল। সেদিনের মতো আবার ঠাসসস করে কর চর বসিয়ে দিল। চোখ দিয়ে গলগল করে কেন যেন পানি এলো। তাড়াতাড়ি করে রুম থেকে বের হয় তুরফা। আহরার স্তব্ধ হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল। পরে হুংকার দিয়ে উঠল। রাগে কটমট করছে। দেওয়ালে সজোরে ঘুষি দিল কয়েক টা। রাগ কমছে না তার।
কোট হাতে নিয়ে গটগট করে চলে গেল আহরার অফিস থেকে। কাউ কে কিছু বলল না। ফিরাত পেছন থেকে ডাকল কিন্তু আহরার তার দিকে না ফিরে তাকিয়েছে আর না কোনো জবাবা দিয়েছে। এমন কি তুরফার দিকে পর্যন্ত তাকায় নি। তুরফা হা করে তাকিয়ে দেখল আহরারের যাওয়া। একবার আড়চোখে আশপাশ তাকিয়ে নিজের জায়গায় বসল। মন টা অস্থির লাগছে কাজ করতে। তবুও নিজেকে নিজের জায়গায় স্থির করে বসিয়ে রাখার চেষ্টা টা করছে।
আহরার নিজের রুমে বসে একের পর এক গ্লাস মদ শেষ করছে। সাথে সাথে সিগারেটের অনর্গল ধোয়া। বুকের ভেতর কষ্ট লাগছে তার জ্বলছে খুব। অতীত বর্তমান সব কিছু তাকে পুড়াচ্ছে। তার নিঃসঙ্গ জীবন টার আকুতি ভেসে উঠছে। ভেতরে খা খা শূন্য লাগছে। গ্লাস টা ঠিল মেরে ভেঙ্গে ফেলল। কাঁচের টুকরো গুলি ঝনঝন করে এদিক ওদিক ছড়িয়ে পরল। চিৎকার করে কেঁদে কেঁদে বলল,
“আমার জীবন টাই কেন কষ্টের? কেন আল্লাহ? কেন এমন নিঃসঙ্গ ছন্নছাড়া জীবন দান করলে আমায়? কি দোষ ছিল ছোটবেলায় আমার? কেন একা থাকতে হয়েছে? কেন আমি এখনো একা? কাঁচের টুকরোর মতো কেন আমার জীবন টা ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিলে? কেন জীবনে আমার এত অস্থিরতা? আমি স্থির জীবন চাই। ছন্নছাড়া নয়। কাঁচের টুকরোর মতো জীবন চাই না আমি। আমি তো জড়সড় হওয়া দলা পাকানো একটা কাঁচের জিনিসের মতো জীবন চেয়েছি তোমার কাছে। যা দিয়ে আমার প্রয়োজন মিটবে সবসময় আমার দরকারে কাজে আসবে, আমার সঙ্গী হবে। যেটা পরিপূর্ণ, মিশ্রণ, কোমল ও অতি নরম হবে।”
চলবে….
(কপি করা থেকে বিরত থাকুন। ছোট ছোট না বলে গঠনমূলক কমেন্ট করুন।)