#তুমি এলে তাই ❤
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
#পর্ব- ২৩
.
স্পন্দন দু তিনবার গাড়ি স্টার্ট করার চেষ্টা করেও ব্যার্থ হলো। স্পন্দন গুঞ্জনের দিকে তাকিয়ে বলল,
— ”নেমে দেখতে হবে।”
স্পন্দন নেমে গেলো গাড়ি থেকে। গুঞ্জনও নামলো ওখান থেকে। স্পন্দন নেমে যেই ডিকি খুলতে যাবে তখনি গুঞ্জন বলে উঠল,
— ” ডিকি খুলে লাভ নেই।”
স্পন্দন ভ্রু কুচকে গুঞ্জনের দিকে তাকিয়ে বলল,
— ” কেনো?”
গুঞ্জন চোখের ইশারায় ওর সাইডের টায়ারটা দেখালো। স্পন্দন ভ্রু কুচকেই টায়ারটার কাছে এসে দেখলো। একটা কাঠের সাথে পেরেগ আটকানো আর সেখানেঈ টায়ারটা পরেছে। স্পন্দন গাড়িতে একটা লাথি মেরে বলল,
— ” ড্যাম ইট।”
গুঞ্জন গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বলল,
— ” গাড়িতে লাথি মেরে কী হবে? গাড়ির কী দোষ? পারলে তাকে লাথি মারো যে মাঝরাস্তায় এসব ফেলেছে।”
স্পন্দন বিরক্ত হয়ে বলল,
— ” পেলেতো মারতামি।”
গুঞ্জন ভ্রু কুচকে বলল,
— ” হ্যাঁ সেটাই। তাহলে গাড়িটাকে মারলে কেনো? ”
স্পন্দন এবার দুই হাত জোর করে বলল,
— ” ক্ষমা করে দে মেরি মা ভুল হয়ে গেছে আমার আর জীবণেও হবেনা।”
গুঞ্জন হাত ভাজ করে বিরক্তি নিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে বলল,
— ” এবার দাঁড়িয়ে না থেকে এক্সট্রা টায়ার টা বেড় করো। লাগাতে হবে তো?”
স্পন্দন পেছনে গিয়ে দেখলো কোনো এক্সট্রা টায়ার নেই। স্পন্দন এবার গুঞ্জনের কাছে এসে বলল,
— ” এক্সট্রা টায়ার নেই।”
গুঞ্জন অবাক হয়ে বলল,
— ” হোয়াট? নেই মানে কী?”
স্পন্দন একটু ভেবে বলল,
— ” ড্রায়ভার হয়তো রাখতে ভুলে গেছে। আমিও চেইক করিনি তাই..”
গুঞ্জন এবার বিরক্তিমাখা কন্ঠে বলল,
— ” একদম ঠিক হয়েছে। এইজন্যই নিজের কাজ নিজেকেই করতে হয়। কোন কাজই তো করো না!”
স্পন্দন চোখ ছোট ছোট পকেটে হাত ঢুকিয়ে বলল,
— ” ওহ তো এতো বড় বিজনেস আমি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে দাঁড় করিয়েছি রাইট?”
গুঞ্জন একটু গলা ঝেড়ে ইতস্তত করে বলল,
— ” ও্ ওটা আর এমন কী? ওসব সবাই করতে পারে।”
স্পন্দন একটা মেকী হাসি দিয়ে বলল,
— ” হ্যাঁ সেই।”
গুঞ্জন আড়চোখে স্পন্দনের দিকে তাকিয়ে বলল,
— ” আপনার ড্রাইভারদের কাউকে ফোন করে বলুন না আমাদের নিয়ে যেতে। আর চার্জ না
থাকলে বলুন আমি নিজে কল করছি।”
বলে ফোন বার করতে নিলেই স্পন্দন গুঞ্জনের হাত ধরে আটকে নিলো। গুঞ্জন ভ্রু কুচকে বলল,
— “কী হলো?”
স্পন্দন গুঞ্জন হাত হালকা টান মেরে নিজের কাছে এনে বলল,
— ” আজ রাতটা না হয় আমরা আমাদের মতো কাটালাম?”
গুঞ্জন ভ্রু কুচকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে স্পন্দনের দিকে। স্পন্দন ভ্রু নাচাতেই গুঞ্জন নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
— ” মানে?”
স্পন্দন মূচকি হেসে বলল,
— ” মানে হলো আজ রাতটা আমরা এখানেই থাকি। দেখো কী সুন্দর পরিবেশ। বন্ধু হিসেবে এটুকু আবদার তো করতেই পারি তাইনা?”
গুঞ্জন একটু ভেবে বলল,
— ” আচ্ছা চলুন।”
স্পন্দন ক্ষেতের দিকে আঙ্গুলের ইশারা দিয়ে বলল,
— ” দেখো? ক্ষেতের মাঝখানের রাস্তাটা বেশ সুন্দর তাইনা? চলো ওদিকেই যাই”
গুঞ্জন ওদিকে তাকিয়ে একটু হেসে বলল,
— ” আচ্ছা চলুন।”
এরপর দুজনেই ওদিকে হাটা দিলো। শীতল বাতাস, শো শো আওয়াজ করছে। দুজনেই রাস্তা দিয়ে হাটছে আর আশেপাশের পরিবেশ দেখছে। কিছুক্ষণ পর গুঞ্জন আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল,
—- ” বৃষ্টি হবে মনে হচ্ছে এক্ষুনি। এই জানুয়ারিতেও বৃষ্টি?”
স্পন্দন একটু হেসে বলল,
— ” বাংলাদেশ এখন এরকমি হয়ে গেছে। ঋতু মেনে কিছুই হয়না। চলো গাড়িতে…”
বলতে না বলতেই বৃষ্টি শুরু হয়ে গেলো। গুঞ্জন উল্টো দৌড় দিতে নিলেই স্পন্দন হাত ধরে নিয়ে বলল,
— ” গাড়িতে যেতে যেতে পুরো ভিজে যাবো। ঐ দেখো চাল দিয়ে একটা ছাউনি বানিয়ে রেখেছে ওখানে চলো।”
গুঞ্জনকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ওর হাত ধরে টেনে গিয়ে ওই ছাউনির নিচে গেলো। দুজনে হালকা একটু ভিজেকে। দুজনেই হাফাচ্ছে। গুঞ্জন বিরক্ত হয়ে তাকালো স্পন্দনের দিকে তারপর বলল,
— “সব তোমার জন্যে হলো। কী দরকার ছিলো থেকে যাওয়ার।”
স্পন্দন একটু হেসে বলল,
— ” ভালোই তো হলো পরিবেশটা আরো রোমান্টিক হয়ে গেলো।”
গুঞ্জন কেনো জানিনা আর বিরক্ত হয়ে থাকতে পারলোনা। নিজের অজান্তেই হেসে দিলো স্পন্দনের কথা শুনে। তারপর নিচের দিকে তাকিয়ে পা নেড়ে বলল,
— ” যাক ভালো হয়েছে এখানে এতো খর বিছিয়ে দিয়েছে। বসা যাবে।”
এরপর দুজনেই ওখানে বসল। দুজনের ফোনের টর্চ অন করে রেখেছে। স্পন্দন ওর হালকা ভেজা চুলগুলো হাত দিয়ে ঝাকিয়ে পানি ঝাড়ছে। গুঞ্জন দৃষ্টি সেদিকে পরতেই ও একটু থমকে গেলো। স্পন্দনের চুল সবসময় স্টাইলিস্টভাবে হালকা উচু করে রাখে। তবে আজ ভিজে যাওয়া চুলগুলো কপালে পরে থাকাতে বেশ ভালো লাগছে গুঞ্জনের কাছে। ও নিজের পুরোপুরি অজান্তেই একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে স্পন্দনের দিকে। হঠাৎ স্পন্দন ওর সামনে তুরি বাজাতেই হুস এলো ওর। নিজেকে সামলে নিলো। স্পন্দন একটু হেসে বলল,
— ” কী ম্যাডাম? প্রেমে পরে গেলে নাকি?”
গুঞ্জন কিছু না বলে ডোন্ট কেয়ার একটা এক্সপ্রেশ দিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিলো। বৃষ্টি এখনো থামেনি। ধীরগতিতে পরেই চলেছে। কিন্তু ওদের এখন বেশ শীত করছে। শীতটা একপ্রকার অসহনীয় হয়ে উঠছে। স্পন্দন বলল,
— ” বেশিই শীত করছে কিছু করতে হবে।”
গুঞ্জন এদিক ওদিক তাইয়ে বলল
— ” একটা লাইটার হবে?”
স্পন্দনের বুকের মধ্যে ধক করে উঠল এই কথাটাই তো স্পন্দনের গুঞ্জনের মুখ থেকে শোনা প্রথম ওয়ার্ড ছিলো। সেইদিনটার কথা মনে পরলে এখনো হাসি পায়। কি ভুলটাই না বুঝেছিলো মেয়েটাকে। গুঞ্জন ভ্রু কুচকে বলল,
— ‘ কী হলো আছে?”
স্পন্দন পকেট থেকে একটা লাইটার বের করে গুঞ্জনের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
— ” সেদিনের পর থেকে সবসময় পকেটে রাখি?”
গুঞ্জন ভ্রু নাচিয়ে বলল,
— ” কেনো?”
স্পন্দন একটু হেসে বলল,
— ” যদি মাঝরাতে কোনো এক মেয়ে এসে চেয়ে বসে?”
গুঞ্জন দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
— ” আচ্ছা। অন্য মেয়ে চাই তাইতো?”
গুঞ্জনের চেহারায় রাগটা স্পন্দন স্পষ্ট দেখতে পেলো তাই হেসে দিয়ে বলল,
— ” এই এক মিনিট এক মিনিট। তুমি কী জেলাস?
গুঞ্জন হকচকিয়ে গেলো তারপর সাথে সাথেই নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
— ” আমি কেনো জেলাস হবো আজব।”
স্পন্দন একটু হেসে বলল,
— ” হুমম। ঠিকই আছে। যাই হোক লাইটার দিয়ে কী হবে?”
গুঞ্জন কিছু না বলে উঠে গেলো। আশেপাশে বেশ অনেকগুলো টুকরো টুকরো চলাকাঠ ছড়িয়ে আছে ওগুলো সব কুড়িয়ে আনলো। তারপর মাঝখানে অল্প একটু জায়গা থেকে খড়গুলো সরিয়ে জায়গা খালি করে ওখানে চলাকাঠগুলোর কিছু আলাদ রেখে কয়েকা ঐ জায়গায় দিলো। স্পন্দন শুধু দেখছে গুঞ্জনের কান্ড। গুঞ্জন এবার চিকন একটা কাঠ নিয়ে ওটাতে লাইটার দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে ওই কাঠগুলোতেও জ্বালিয়ে ফেলল। তারপর স্পন্দনের দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাচাতেই স্পন্দন বলল,
— ” বাহ। ইন্টিলিজেন্ট।”
গুঞ্জন একটু হেসে আগুনে হালকা হালকা ফু দিচ্ছে। আগুনের হলদেটে আলোয় অসম্ভব সুন্দর লাগছে ওকে। চুলগুলোও হলকা ভেজা। সামনের ছোট কাটা চুলগুলো মুখের লেপটে আছে। স্পন্দন এক ঘোরের মধ্যে চলে যাচ্ছে গঞ্জনকে দেখে । গুঞ্জনের চোখ আগুনের দিকে স্পন্দন আস্তে করে উঠে গুঞ্জনের কাছে গিয়ে বসলো। গুঞ্জন সেটা এখনো খেয়ালই করেনি। স্পন্দন গুঞ্জনের হাত ধরে ওর দিকে ঘোরালো। গুঞ্জন হালকা চমকে উঠলো। তারপর ভ্রু নাচিয়ে ইশারায় জিজ্ঞেস করলো কী হয়েছে? কিন্তু স্পন্দন কোনো উত্তর দিলোনা আলতো হাতে গুঞ্জনের মুখে লেপটে থাকা চুলগুলো ধীরে ধীলে সরিয়ে দিলো। স্পন্দনের হাতের ঠান্ডা স্পর্শে গুঞ্জন চেষ্টা করেও চোখ খোলা রাখতে পারলোনা বন্ধ হয়ে গেলো ওর চোখ। বাইরের এই ঠান্ডা আর স্পন্দনের স্পর্শে গুঞ্জনের ঠোঁট ভীষণভাবে কাঁপছে। এটাই স্পন্দনের নেশা বাড়িয়ে দেওয়ার জন্যে যথেষ্ট ছিলো। এখন ও ওর নিজের মধ্যে আর নেই। ও কী করছে নিজেই বুঝতে পারছেনা। ও গুঞ্জনের কানের ওপর হাত রেখে গুঞ্জনের দিকে গভীরভাবে তাকালো তার ধীরে ধীরে গুঞ্জনের দিকে মুখ এগিয়ে নিতে লাগল। খুবই কাছে চলে গেলো গুঞ্জনের স্পন্দনের নিশ্বাস গুঞ্জনের মুখে এসে বারি লাগতেই গুঞ্জনের হুস এলো। ও সাথে সাথেই চোখ খুলে স্পন্দনকে একটু ঠেলে দূরে সরিয়ে দিলো। গুঞ্জন নিজের চুলগুলো হাত দিয়ে ঠিক করে নিয়ে ভ্রু কুচকে বাইরে তাকিয়ে রইলো। স্পন্দনও এবার বুঝতে পারল ও কী করছিলো। ও গুঞ্জনের দিকে তাকিয় ইতস্তত করে বলল,
— ” গুঞ্জন আমি..”
কিন্তু গুঞ্জন স্পন্দনকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
— ” কী আপনি? হ্যাঁ বলুন আপনি কী? দেখুন আমি শুধু বন্ধুত্ব করেছি আর সেটাও মন থেকে। আর সেই বন্ধুত্বের খাতিরেই আপনার সাথে ঘুরি ফিরি খাই। আপনার কাছে আবদার করি আপনার আবদার রাখি। তারমানে তো এটা নয় যে আমি আপনার গার্লফ্রেন্ড হয়ে গেছি?”
স্পন্দন একটু বিরক্ত হয়ে বলল,
— ” আরে আমার..”
কিন্তু এবারও স্পন্দনের কথা শেষ হওয়ার আগে গুঞ্জন বলল,
— ” তাই প্লিজ আমাকে নিজের গার্লফ্রেন্ড ভেবে ট্রিট করবেন না। এমন কোনো আচরণ করবেন না যাতে আমাদের বন্ধুত্বের সম্পর্কটা নষ্ট হয়ে যায়।”
স্পন্দন এবার বেশ রেগে গেলো। ও উঠে দাঁড়িয়ে গুঞ্জনের হাত ধরে দাঁড় করিয়ে কাঠ আর সিমেন্টের খামটার সাথে লাগিয়ে ধরে ওর ওপর দিয়ে খামে হাত রেখে বলল,
— ” কী মনে হয় আমাকে দেখে? ক্যারেক্টারলেস নাকি রেপিস্ট কোনটা? বলো কোনটা? তোমাকে একা পেয়ে সুযোগ নিতে চাইছি আমি? বন্ধুত্বের বাহানায় এডভান্টেজ নিচ্ছি এটাই মনে করছো? যদি সত্যিই এমন কোনো ইচ্ছে আমার থেকে থাকতো না তাহলে এখন এই মুহূর্তে আমি সেটা করতে পারতাম। তোমার ওসব ফাইটিং স্কিল, ক্যারাটে দিয়ে ওদের সাথে পারলেও আমার সাথে পারবেনা। ট্রাই করে দেখতে পারো। দেখো আশেপাশে কেউ নেই তাই আমার কাছে বেস্ট সুযোগ না? চাইলেই কাজে লাগাতে পারি।”
বলে খামটায় বারি মেরে বলল,
— ” কী হলো বলো?”
গুঞ্জন কিছু না বলে মাথা নিচু করে ফেলল। রেগে একটু একটু বেশিই যে বলে ফেলেছে সেটা বেশ বুঝতে পারছে। তাই চুপ করেই আছে। স্পন্দন একটা শ্বাস ফেলে গুঞ্জনের দুই বাহু ধরে নিজের কাছে এনে বলল,
— ” কেনো বোঝনা আমাকে? বলো? একটুও বুঝতে পারোনা আমার অনুভূতিগুলো। কোনো দাম নেই তোমার কাছে এসবের তাইনা? আমার ভালোবাসা, ফিলিং এসবের কোন দাম নেই তোমার কাছে? আমি জানি তুমি বুঝবে। সেটা যখনি হোক তুমিও ভালোবাসবে আমাকে। তবে বাসতে এতোটা দেরী করে ফেলোনা যে এমন কিছু হয়ে গেলো আমাকে সেটা আর বলতেই পারলেনা।”
গুঞ্জন শুধু তাকিয়ে আছে স্পন্দনের দিকে। আজ নিজেই নিজের মনকে প্রশ্ন করছে সত্যিই কী স্পন্দনের জন্যে ওর মনে ভালোবাসা তৈরী হয়নি? একটুও না? তাহলে স্পন্দনের কথা শুনে ওর কষ্ট কেনো হচ্ছে? এতো ভারী হয়ে উঠছে কেনো বুকের ভেতর।
#চলবে..