#তুমি_নামক_প্রশান্তি
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#পর্ব_দুই
কোমরের মধ্যে দুইটা পুড়ে যাওয়ার ক্ষত দেখতেই নীলাভ্রর চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম। সাথে সাথে মস্তিক প্রশ্ন করলো,
“বেলিপ্রিয়ার কোমরে পুড়ে যাওয়া ক্ষতটা কিসের?”
কপালের একটু উপরে বেশ খানিকটা কে’টে গেছে বেলির। সারা অঙ্গ জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। ব্যাথায় সূক্ষ্ম ভাঁজ পড়েছে বেলির কপালে। চোখ মুখ কুঁচকে রেখেছে। জ্ঞান ফিরলেও মেয়েটা শরীর বড্ড দূর্বল থাকায় চোখ মেলতে পারছিলো না। তাই ঘুমের ওষুধ দেওয়া হয়েছিলো। যন্ত্রণা কমানোর জন্য ঘুম প্রয়োজন। বেলির ফর্সা কপালে ব্যান্ডেজটা বড্ড বেমানান লাগছে। দৃশ্যটা সহ্য করা কঠিন। বড্ড কঠিন! নিলাভ্র বেলির হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে কপালে ঠেকিয়ে চোখ বুজে নিলো। ওর বুকের ভেতর তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষন নিশ্চুপ থেকে শান্ত, শীতল কন্ঠে বেলিকে শুধাতে লাগলো,
“খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যা প্লিজ। সহ্য হচ্ছে না আমার। খুব কষ্ট হচ্ছে।”
আর শব্দ করতে পারলো না। গলা ভেঙে আসচ্ছে। কন্ঠস্বর দিয়ে শব্দ বের হচ্ছে না। এর মধ্যেই বেলি নড়ে উঠলো। ঘুমের মাঝেই অন্য হাত দিয়ে মাথা চে’পে ধরলো। ওর মুখ দেখে মনে হলো মাথায় ব্যাথা হচ্ছে। প্রচন্ড ব্যাথা। এই ব্যাথা মেয়েটা সহ্য করবে কিভাবে? অবিলম্বে নীলাভ্র অস্থির কন্ঠে বলতে লাগলো,
“বেলিপ্রিয়া, ব্যাথা করছে? কষ্ট হচ্ছে বুঝি? খুব বেশি কি ব্যাথা করছে? চোখটা খোল না বাবুই। বল আমাকে কি হয়ছে?”
নীলাভ্রর কন্ঠস্বরে বেলি পিটপিট করে চোখ খুলে তাকালো। ঝাপসা চোখে চারদিকটা দেখে বুঝতে পারলো না, এই মূহুর্তেই ও কোথায় আছে? মনে পড়ে গেলো, ওর সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনা। শরীরের সব ব্যাথা ভুলে গেলো নিমিশেই। চিৎকার করে উঠে বসে পড়লো। চারদিকটায় ভালো করে নজর বুলিয়ে দেখলো ও হসপিটালের বেডে। নিজের দিকে একবার তাকিয়ে দেখলো গায়ে জড়ানো শাড়িটা ঠিকঠাকই আছে। তাহলে কি ও সর্বনাশ থেকে বেঁচে গেছে? ভাবলো কিছুক্ষন। পাশে কারোর উপস্থিতি টের পেয়ে পাশ ফিরলো। নীলাভ্রকে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকতে হকচকিয়ে উঠলো। কপালের ব্যাথাটা তখন পূর্নরায় মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো। নিজের হাতটা নীলাভ্রর হাতের মুঠোয় দেখে অনেক বেশি অবাক হলো। হাতটা ছাড়িয়ে নিতে নিতে দূর্বল কন্ঠে ভয়, আঁতঙ্ক নিয়ে বললো,
“ওই লোকটা? ওই বিশ্রী, জঘন্য লোকটা আবার এসেছে ভাইয়া?”
নীলাভ্র বেলির কথা বুঝতে পারলো না। কোন লোক? কে এসেছে? বেলি হাঁপাচ্ছে। শরীর কাঁপছে। কথা বলতে পারছে না। ওর মুখ দেখে অস্বস্তি ভাবটা বুঝতে পারলো নীলাভ্র। বেলিকে শান্ত করার জন্য নির্মল, শান্ত, বিষন্ন কন্ঠে বললো,
“ভয় পাস না। আমি আছি তো তোর পাশে। একদম ভয় পাবি না। তোর কিছু হয়নি। তুই একদম ঠিক আছিস। সব ঠিক হয়ে যাবে।”
নীলাভ্রর কন্ঠস্বর শুনে বেলি কিছুটা শান্ত হলো। মাথা ব্যাথায় বার বার চোখ-মুখ কুঁচকাচ্ছে। নীলাভ্র বেলির হাতটা ছেড়ে দিয়ে অশান্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করতে লাগলো,
“বেশি ব্যাথা করছে? ডাক্তার ডাকবো? বল না। চুপ করে আছিস কেনো? বেলিপ্রিয়া।”
নীলাভ্রর কথা শুনে বেলি অবাকের শেষ সীমানায়। এমন কেনো ছেলেটা? এত কিছুর পরেও কি করে এতটা ভালোবাসতে পারে? চোখ ছলছল করে উঠলো। শান্ত কন্ঠেই বললো,
“আমি বাড়ি যাব নীলাভ্র ভাই। প্লিজ একটু বাড়ি নিয়ে চলুন।”
নীলাভ্র কথা বাড়ালো না। গম্ভীর স্বরে তানিশাকে ডাকলো। তানিশা রুমে ঢুকেই বেলিকে বসে থাকতে দেখে ছুটে গিয়ে আলতো জড়িয়ে ধরলো ওকে। মেয়েটা কান্না করতে করতে চোখ মুখ ভরিয়ে ফেলছে। তা দেখে বেলি মনে মনে নিজেকে ভাগ্যবতী ভাবলো। এমন একটা বেস্ট ফ্রেন্ড পেয়েছে। তানিশা বেলিকে জড়িয়ে ধরেই বললো,
” ওই ধুলোবালি, ময়লা , অন্ধকার রুমে তুই গেছোস কেন? ওই রুমডা তো ভাঙা-চূরা বেঞ্চ আর হাবি জাবি দিয়ে ভরা। ওই রুমে কেউ যায়না। তুই গেলি কেন? তুই জানোস না তোর এডি সহ্য হয়না। বেশি পাকনামি করস। থা”বড়াইয়া তোর দাঁত ফালাইয়া দেওন দরকার বে”দ্দপ।”
তানিশার শাসানো শুনে বেলি মুচকি হাসলো। তানিশাকে জড়িয়ে ধরে বললো,
“আমি বুঝতে পারিনি রে। ওই রুম থেকে কারোর গোঙ্গানির শব্দ শুনতে পেরেছিলাম। কিন্তু আমি কি জানতাম যে…।”
বলে থামলো। নিশ্বাস ছাড়লো আড়ালে। তখনের কথা মনে হলেই শরীর ভয়ে শিউরে উঠে। ঢোক গিলে নিজেকে শান্ত করলো। ডাক্তারের সাথে কথা বলে বেলিকে নিয়ে নীলাভ্র আর তানিশা চলে আসলো। বেলি আর তানিশা পেছনের সিটে বসেছে। আর নীলাভ্র গাড়ি চালাচ্ছে। কিছুক্ষন যেতেই নীলাভ্র প্রশ্ন ছু”ড়ে মা’রলো,
“তোর কোমরের পোড়া দাগটা কিসের বেলিপ্রিয়া?”
প্রশ্নটা শুনেই তানিশা আর বেলি হকচকিয়ে উঠলো। নীলাভ্র এই দাগটা কি করে দেখতে পেলো? বেলির এতক্ষণ খেয়াল ছিলো না। নীলাভ্রর কথা শুনে মনে পড়লো। মূহুর্তেই ভয়েরা গ্রাস করে নিলো ওকে। আমতা আমতা করতে লাগলো। কি বলবে এখন? সত্যিটা বলে দিবে? বেলির ভাবনার ছেদ ঘটিয়ে তানিশা বললো,
“হায় আল্লাহ! কন কি ভাইয়া! পুইড়া গেলো ক্যামনে? কিরে কস না। ভাইয়া কি জিগাইলো? উওর দে?”
তানিশার কথা শেষ হতে না হতেই নীলাভ্র আবার জিজ্ঞেস করলো,
“তোর ব্যাথা তো মাথায়। মুখে না। তাহলে উওর দিতে দেরি হচ্ছে কেনো?”
নীলাভ্রর কন্ঠে তীব্র রাগ খুঁজে পেলো বেলি। তাই উওর দিতে সময় নিলো না। পরিষ্কার ভাবে ঘটে যাওয়া সম্পূর্ণ ঘটনাটা বললো। সবটা শুনে নীলাভ্র জোরে গাড়ি ব্রেক কষলো। তানিশা আর বেলি দুজনেই সামনের দিকে ঝুঁকে পড়তে পড়তে সিট আকঁড়ে ধরলো। গাড়ি থামিয়ে নীলাভ্র চোয়াল শক্ত করে স্ট্যায়ারিংটা চে’পে ধরে রাখলো। বেলি নীলাভ্রর এহেতুক কারন বুঝতে পারলেও তানিশা বুঝতে পারলো না। ভয়ে বুকে থুথু দিয়ে বলে উঠলো,
“আল্লাহ গো! অহোনেই আমার জান পাখিডা উড়াল দিছিলো। দেইখা গাড়ি চালাইবেন তো ভাইয়া। ”
নীলাভ্র ওর কথায় পাত্তা না দিয়ে পূর্নরায় বেলির উদ্দেশ্য বললো,
“লোকটা কে ছিলো? ”
বেলি উওর দিতে পারলো না। লোকটাকে বেলি প্রথমে চিনতে না পারলেও পরে ঠিকি চিনতে পেরেছে। কিন্তু এ কথা এখন নীলাভ্রকে বললে তুলকালাম হয়ে যাবে। তাই আমতা আমতা বললো,
“আমি অন্ধকারের মাঝে লোকটার মুখ দেখতে পারিনি। তাই চিনতে ও পারিনি।”
নীলাভ্র কথাটা বিশ্বাস করলো কিনা ঠিক বুঝতে পারলো না বেলি। কোনো উওর দিলো না। চুপচাপ গাড়ি স্ট্যাট দিলো। গাড়ি আপনমনে চলতে থাকলো। তিনজনেই এখন চুপচাপ। তানিশাকে ওর বাসার নিচে নামিয়ে দিয়ে বেলিকে নিয়ে বাসায় চলে আসলো।
—
কলিং বেল বাজাতেই মিনিটের মাথায় আইরিন বেগম এসে দরজা খুলে বেলির মাথার ব্যান্ডেজ দেখে অবাক হয়ে বলে উঠলো,
“এ কি ব্যাথা পেয়েছিস কি করে মা?”
আইরিন বেগমের কথা শুনে বেলি শান্ত স্বরেই বললো,
“তেমন কিছু হয়নি মেজো মামি। একটু ব্যাথা পেয়েছি আর কি।”
তখনি বেলির পাশ ঘেঁষে নীলাভ্র ভেতরে ঢুকে সোজা সোফায় গিয়ে বসে পড়লো। আইরিন বেগম বেলিকে ধরে এনে নীলাভ্রর পাশে বসিয়ে প্রশ্ন করলো,
” নীল ওর এমন অবস্থা হলো কি করে? ”
আইরিন বেগমের কথা শুনে নীলাভ্র ভাবলেশহীন ভাবে উওর দিলো,
“বাইরে গিয়ে বেশি ছোটাছুটি করলে এমনি হবে চাচিমা। এখন এইসব বাদ দাও। আমার খুব ক্ষুদা লেগেছে। মাকে বলো আমাকে খাবার দিতে।”
নীলাভ্রর উওরটা ঠিক মনে ধরলো না আইরিনের। বেলি চুপচাপ। এর মধ্যেই সেখানে উপস্থিত হলো বেলির মা রিতা বেগম। মেয়ের অবস্থা দেখে বুক কেঁপে উঠলো। দৌড়ে এসে মেয়ের পাশে বসতে বসতে অস্থির কন্ঠে বললো,
“মাথা ফা’টালি কি করে? কি হয়েছিলো? নীল বাবা তুই বল? ওর এমন অবস্থা হলো কি করে?”
মাকে দেখে বেলি একটা ভরসার আশ্রয় খুঁজে পেলো। গুটিশুটি মে’রে মুখ লুঁকালো মায়ের বুকে। মেয়েকে আগলে নিতে নিতে সে প্রশ্নবিদ্ধ চোখে নীলাভ্রর দিকে তাকিয়ে। নীলাভ্র তা দেখে নড়ে চড়ে বসলো একটু। উওর দিলো,
“তেমন কিছু না ফুপ্পি। সিড়ি দিয়ে উপরে উঠতে গিয়ে শাড়িতে পা আটকে পড়ে গেছে। সামান্য একটু কে’টেছে। ডাক্তার ওষুধ লাগিয়ে দিয়েছে। চিন্তা করো না।”
নীলাভ্রর কথা শুনে আইরিন আর রিতা বেগম দুজনেই হাফ ছেড়ে বাঁচলো। রিতা কিঞ্চিৎ ক্ষিপ্ত স্বরে মেয়েকে শুধালো,
“এইজন্যই সকালে শাড়ি পড়ে যেতে বারন করেছিলাম। দেখেছিস এখন কি অবস্থা হলো। তোকে নিয়ে আর পারিনা রে মা। জ্বালিয়ে মা’রলি আমাকে।”
বলে উঠে সে কিচেনের দিকে ছুটলো। রান্না বসিয়ে রেখেছেন চুলায়। বেলি কাঁচুমাচু হয়ে বসে আছে। আইরিন ও কিছু না বলে সেদিকে ছুটলো। উনারা চলে যেতেই নীলাভ্র বেলিকে উদ্দেশ্য করে বললো,
“ওই লোকটাকে তুই সত্যি চিনিস না?”
প্রশ্নটা শুনে বেলির ঠোঁট কাঁপলো। শক্ত করে শাড়ির আঁচলটা ধরে কাঁপা গলায় উওর দিলো,
“সত্যি চিনি না নীলাভ্র ভাই।”
উওর শুনে নীলাভ্র খানিক বাঁকা হাসলো। তারপর সোজা উপরে চলে গেলো। সিড়ি সামনে গিয়ে পেছনে ফিরে ক্রোধ মিশ্রিত কন্ঠে নিজে নিজেই বললো,
“বেলিপ্রিয়া আমার থেকে কথাটা লুঁকিয়ে ভুল করলি তুই। বড্ড ভুল করলি। এই ভুলের মাশুল তোকে একদিন ঠিক দিতে হবে।”
নীলাভ্রকে উপরে চলে যেতে দেখে বেলি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। নিজের ঘরে যাওয়ার জন্য রেডি হলো। তখনি ওর কানে ভেসে আসলো,
“আবার কি আকাম করে এসেছিস রে বেলি?”
কথাটা শুনেই বেলি বিস্ফোরিত চোখে পেছনে তাকালো। দেখলো নীলাভ্রর মা সীমা দাড়িয়ে আছে। সে যে প্রশ্নটা কোন ইঙ্গিতে করেছে তা বেশ বুঝতে পারলো বেলি। তাও কানে নিলো না। শান্ত ভাবেই বলার চেষ্টা করলো,
“পড়ে গিয়েছিলাম বড় মামি। কোনো আকা’ম করেনি। তুমি সব সময় আমাকে নিয়ে একটু বেশি ভেবে সময় নষ্ট করো।”
বেলির উওর শুনে সীমার মুখে রাগের আভাস ভেসে উঠলো। বেলিকে আর কিছু না বলে কিচেনে যেতে যেতে মিনমিনিয়ে বলতে লাগলো,
“ডির্ভোসী একটা মেয়ে। বুড়ো বয়সে তার আবার পড়ালেখা করতে মনে ধরেছে। আর কত কি রং-তামাশা দেখতে হবে? কে জানে? যত্তসব উটকো ঝামেলা”
কথাগুলো সে মিনমিনিয়ে বললেও বেলি স্পষ্ট শুনতে পারলো। চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়তে সময় নিলো না। কোনো রকম চোখের পানি মুছে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালো। মাথার মধ্যে তখনি হানা দিলো। আজকের ওই লোকটা আর কেউ ছিলো না। স্বয়ং বেলির স্বামী ছিলো…
#চলবে