তুমি নামক প্রশান্তি পর্ব -০৩

#তুমি_নামক_প্রশান্তি
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#পর্ব_তিন

“প্রাক্তন স্বামীর প্রতি হঠাৎ এতো দরদ, ভালোবাসা উতলে পড়লো যে, তার জঘন্য কাজটা ধামাচাপা দেওয়ার জন্য কত সুন্দর করে মিথ্যা কথা বলে ফেললি।”
কথাগুলো কানে আসতেই শরীরের শীতল রক্ত বইতে শুরু করলো বেলীর। ভয়ে বুকটা কেঁপে উঠলো। পেছন ফিরে দেখলো নীলাভ্র বেশ আয়েস ভঙ্গীতে দরজার সামনে দাড়িয়ে আছে। নীলাভ্রকে দেখেই বেলীর চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেলো। হৃদ যন্ত্রটা ঢিপঢিপ আওয়াজ করতে লাগলো। ভয়ে বার বার ঢোক গিলছে বেলী। তার মানে নীলাভ্র সবটা জেনে গেছে? কি করে জানলো? শব্দ মালা নেই কথা বলার জন্য। ফুরিয়ে গেছে। নয়তো কন্ঠস্বর দিয়ে বের হচ্ছে না। মিথ্যা বলে কি ভুল করেছে? বেলীকে চুপ থাকতে দেখে নীলাভ্র পুনরায় বললো,
“চুপ করে আছিস যে? প্রাক্তন স্বামীর কাছে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছে হয়েছে বুঝি?”
কি উত্তর দিবে বেলী? ওই লোকটাকে ও সহ্য করতে পারেনা। আর ওই লোকটাকে নিয়েই নীলাভ্র এমন কথা বলছে, মানতে পারলো না। চাপা স্বরে বললো,
“আপনি ভুল ভাবছেন নীলাভ্র ভাই। ওই লোকটার কাছে ফিরে যাওয়া তো দূরে থাক, নাম শুনলেই ঘৃণায় শরীর ফুলে উঠে।”
উত্তর শুনে নীলাভ্র মুচকি হাসলো। ট্রাউজারের পকেটে হাত গুঁজে শান্ত স্বরে শুধালো,
“তাহলে কেনো মিথ্যা বলেছিলি?”
থতমত খেয়ে উঠলো বেলী। আমতা আমতা করতে লাগলো। থেমে থেমে বললো,
“আপনি যদি ঝামেলা করেন তাই।”
নীলাভ্র কিছু বললো না। কয়েক সেকেন্ড চুপ থাকলো। বেলী নীলাভ্রর দিকে তাকালো। মুখটা শুকিয়ে গেছে কেনো ছেলেটার? নীলাভ্রর পড়নে সাদা রঙের পাতলা টি-শার্ট, কালো রঙের ট্রাউজার, কাঁধে জড়ানো ভারী তোয়ালে। ভেজা চুল গুলো থেকে পানি নাক, মুখ বেয়ে পড়ছে। দেখে মনে হচ্ছে এই মাত্র গোসল করে এসেছে। বেশিরভাগ সময় নীলাভ্র রাতে গোসল করে। তাই বেলী অবাক হলো না। অনেক বেশি শান্ত লাগছে নীলাভ্রকে। বেলীকে তাকিয়ে থাকতে দেখে নীলাভ্র শান্ত স্বরে প্রশ্ন করল,
“একটা সত্যি কথা বলবি বেলীপ্রিয়া?”
নীলাভ্রর কন্ঠস্বরে কি যেনো খুঁজে পেলো বেলী। বিষন্নতা, নাকি অন্য কিছু? মুখ ফুটে বললো,
“কি কথা?”
নীলাভ্র সময় নিলো না প্রশ্ন করতে। জিজ্ঞেস করলো,
“এখনো ভালোবাসিস রাফিনকে?”
প্রশ্নটা শুনে হকচকালো বেলী। তীক্ষ্ণ স্বরেই বললো,
“এইসব প্রশ্ন কেনো করছেন নীলাভ্র ভাইয়া?”
কথাটায় পাত্তা দিলো না নীলাভ্র। আগের মতোই প্রশ্ন করলো,
“ভালোবাসিস কিনা?”
বেলী থমকালো। এই প্রশ্নের উত্তর দিতে মন সায় দিচ্ছে না। তাই শান্ত কন্ঠে বললো,
“আমি এই বিষয়ে কথা বলতে চাচ্ছি না ভাইয়া। অনেক রাত হয়েছে। আপনি আপনার ঘরে যান। বড় মামি এসে দেখলে বাজে অবস্থা হবে।”
বলে এগিয়ে এসে নীলাভ্রর মুখের উপর দরজাটা বন্ধ করে দিলো। নীলাভ্র কিছুক্ষন, কিছুসময় ঠাঁই দাড়িয়ে রইলো। তারপর এলোমেলো পায়ে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালো। নিজের রুমে গিয়ে তোয়ালেটা সোফার দিকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে, ধপ করে বিছানায় সুয়ে পড়লো। বালিশে মুখ গুঁজে মিনমিনিয়ে বলতে লাগলো,
“তুই আমাকে বুঝিস না কেনো বেলীপ্রিয়া? আমাকে একটা বার বোঝার চেষ্টা করলে তোর জীবনটা আজ এমন হতো না। তোর উপর আমার এক আকাশ সমান অভিমান বেলীপ্রিয়া।”

—-

ফজরের আজানের শব্দ কানে যেতেই বেলীর ঘুম ভেঙে গেলো। এটা ওর নিত্যদিনের অভ্যাস। বেলী উঠে ওযু করে এসে নামাজ আদায় করে নিলো। বেলকনির দরজাটা খুলে দিতেই ঠান্ডা বাতাসে মনটা ফুরফুরে হয়ে গেলো। বেলকনিতে গিয়ে খোপা করা চুল গুলো ছেড়ে দিলো। দমকা হাওয়ায় এলোমেলো ভাবে চুল গুলো উড়ছে। সাদা ব্যান্ডেজের উপর কিছু চুল ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে সারা কপালে। ফজরের পরের বাতাসের মতো এত আরামদায়ক, প্রশান্তির বাতাস আর নেই। বাতাসের দাপটে দীর্ঘ লম্বা চুল দ্বারা বেলীর শরীর পুরো জড়িয়ে গেছে। বেলীর চুল হাঁটুর নিচ অব্দি লম্বা। মানুষের সৌন্দর্য তো ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। যার চোখ যেমন সে সৌন্দর্যকে তেমন ভাবে উপভোগ করে। সৌন্দর্য খুঁজে বের করতে হলে বেশি কিছুর দরকার পড়ে না। শুধু চোখের দৃষ্টি সুন্দর হলেই যথেষ্ট । যেমন, শিল্পী চোখ শুধুমাত্র নিখুঁত সৌন্দর্য খুঁজে পাওয়ার কাজে ব্যস্ত থাকে। ছোট থেকেই বেলীর মা মেয়ের চুল নিয়ে অনেক বেশি সচেতন ছিলেন। নিজেই মেয়ের চুলের যত্ন নিতেন। যত্ন ছাড়া কোনো কিছুই টিকে না। চুলগুলো অনেক বেশি বিরক্ত করছে বাতাসে। কিন্তু তাও ভালো লাগছে। শান্তি লাগছে। মনের সব ঝড়-ঝাপটা, অশান্তি নিমিশেই হাওয়ায় মিশে গেছে। অদ্ভুত প্রশান্তির ঢেউ বইছে হৃদয় গহীনে। হুট করে নীলাভ্রর কথা মনে উঠতেই বেলীর মুখটা চুপসে গেলো। অন্ধকার এসে হানা দিলো সারা মুখশ্রীতে। নিজে নিজেই বলতে লাগলো,
“আমি সমাজের চোখে একজন ডিভোর্সি নারী। কেউ আমাকে ভালো চোখে দেখে না নীলাভ্র ভাই। সেই আমি কি করে আপনার জীবন নষ্ট করে দিব বলুন? আমার জন্য আপনাকে কথা শুনতে হবে। অপমান সহ্য করতে হবে। এইসব আমি সহ্য করতে পারব না। ”
বলতে বলতে অশ্রুরা দলবেঁধে হানা দিলো চোখের পাতায়। হঠাৎ কেনো এমন এলোমেলো হয়ে গেলো সবটা? সময় গড়িয়ে গেলো এইসব ভাবতে ভাবতে। চারদিকে সূর্যের আলো ফুটেছে। এতক্ষনে সবাই হয়তো উঠে পড়েছে। বেলি চুলগুলো খোঁপা করে নিলো। ওড়নাটা ভালোভাবে মাথায় প্যাঁচিয়ে নিলো। পা বাড়ালো আয়েশা খাতুনের রুমের দিকে। এই মুহূর্তে অশান্ত মনটাকে একমাত্র তিনিই শান্ত করতে পারে।

আয়েশা খাতুন নামাজ শেষ করে বসে বসে দোয়াদরুদ পড়ছিলেন। তখন রুমে ঢুকে বেলী। বেলীকে দেখেই তিনি হাসি মুখে আঞ্চলিক ভাষায় বলে উঠলো,
“আমার বইনে সক্কাল সক্কাল আমার কাছে কি মনে কইরা আইলো?”
বেলী কোনো কথা বললো না। সোজা গিয়ে আয়েশা খাতুনের কোলে মাথা রেখে সুয়ে পড়লো। আয়েশা খাতুনের দিকে তাকিয়ে আবদারের স্বরে বললো,
“আফু, একটু মাথায় হাত বুলিয়ে দাও তো।”
ছোট থেকেই বেলী ওর নানু কে আফু বলে। এই নামে ডাকলে নাকি খুব আপন আপন লাগে। ভালো লাগে। আয়েশা খাতুন বেলীর মুখ দেখে বুঝতে পারলেন, বেলীর মনটা হয়তো খারাপ। বেলীর ব্যান্ডেজের উপর আলতো হাত বুলিয়ে বললো,
“আমার বইনের কি শরীরডা খারাপ?”
বেলী উওর দিলো না। চুপচাপ চোখ বন্ধ করে সুয়ে আছে। আয়েশা খাতুন বেলীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। কিছুক্ষন পার হলো। বেলী চোখ না খুলেই বললো,
” আফু সমাজের মানুষ কেনো ডিভোর্সি, কালো মেয়ে, ধর্ষণে স্বীকার হওয়া মেয়েকে ভালো চোখে দেখে না? চারপাশের মানুষের এত অপমান, অবহেলা আমার সহ্য হয় না। দম বন্ধ হয়ে আসে মাঝে মাঝে। বড় মামি কথার থেকে কথা উঠলেই আমাকে ডিভোর্সি, নোংরা মেয়ে যা নয় তাই বলে অপমান করে। আমি কেনো মায়ের মতো প্রতিবাদ করতে জানিনা? কেনো মুখের উপর সত্যিটা বলতে পারিনা। আমার মাঝে মাঝে ম’রে যেতে ইচ্ছে করে আফু।”
বেলীর চোখ এখনো বন্ধ। চোখের কোন বেয়ে মোটা মোটা জলরাশি গড়িয়ে পড়লো। কথাগুলো বলতে ওর বুক ফে’টে যাচ্ছে। এই মানুষটা ছাড়া আর কারোর কাছে নিজের মনের কথা বলতে পারেনা। বেলীর কথা শুনে আয়েশা খাতুনের চোখ ছলছল করে উঠলো। এইটুকু বয়সে মেয়েটা কত কিছু সহ্য করেছে। বেলীর চোখের পানি গুলো আঁচল দিয়ে মুছে দিলো। তারপর শান্ত কন্ঠে বললো,
“হোনো, বইন এক খান কতা কই তোমারে। কেউ তোমারে ভালো কইলে তুমি তো আসমানে উইঠা যাইবা না। আবার কেউ তোমারে খারাপ কইলেও তুমি মই’রা যাইবা না। তাইলে তুমি ওগো কতা কেন ধরবা। জীবনডা তোমার। ওগো না। ”
আয়েশা খাতুনের কথা শুনে বেলী উঠে বসলো। জড়িয়ে ধরলো নানু নামক আপন ছায়াটাকে। কান্না ভেজা স্বরে বললো,
“জানো আফু, আমি যখন রাস্তায় বের হই তখন কিছু মানুষ আমার দিকে নোংরা নজরে তাকিয়ে থাকে। পথে পথে আমারে মনে করিয়ে দেয় আমি ডিভোর্সি। আমার স্বামী আমাকে ছেড়ে দিছে। আমি ভালো মেয়ে না। আমার চরিত্রে সমস্যা। এইসব আমার সহ্য হয়না আর।”
বলে নিঃশব্দে কান্না করে উঠলো। আয়েশা খাতুন বেলীকে শান্ত করতে বললো,
“মাইয়া মানুষ যদি চাদের মতো স্নিগ্ধ হয় তাইলে মাইনসে তো নজর দিবোই। মাইয়া মানুষের হওয়া লাগবো সূর্যের মতো তুখোড়। যার দিকে নজর দিলেও চক্ষু ঝ’লসা’ইয়া যাইবো। ”
কথাটার মানে বেলী বুঝলো। মন কিছুটা শান্ত হলো। বেলীকে হাসানোর জন্য বিভিন্ন কথা বলতে লাগলো।

বেলী নিচে নেমে দেখে সবাই টেবিলে বসে নাস্তা করছে। নীলাভ্রর পাশের চেয়ারটা ছাড়া বাকি সব গুলো চেয়ারে সবাই বসে আছে। বেলী একবার ভাবলো পরে খাবে। কিন্তু, পরক্ষণেই কিছু না ভেবে নীলাভ্রর পাশের চেয়ারে গিয়ে বসার জন্য তৈরি হতেই, নীলাভ্রর মা পেছন থেকে কড়া গলায় বললো,
“বেছে বেছে আমার নীলের পাশেই তোর বসতে হবে রে বেলী।”
কথাটা শুনে উপস্থিত সবাই বেলীর দিকে তাকালো। শুধু মাত্র নীলাভ্র বাদে। নীলাভ্র এক ধ্যানে খেয়ে যাচ্ছে। ওকে দেখে মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে খাওয়ার থেকে বড় কিছু আর নেই। বেলী অপ্রস্তুত হয়ে বললো,
“আর তো চেয়ার ফাঁকা নেই বড় মামি।”
হাতের খাবারের বাটি টেবিলে রাখতে রাখতে সীমা বললো,
“না থাকলে পরে খাবি। এমন তো নয় যে তোর রাজ্যের কাজ ভেসে যাচ্ছে, তাই তোকে এক্ষুনি খেতে হবে।”
সীমার কথা শেষ না হতেই নীলাভ্রর বাবা আমির হোসেন স্ত্রীকে ধমকের স্বরে বললো,
“সকাল সকাল মেয়েটাকে কথা না শুনালে তোমার পেটের ভাত হজম হয়না বুঝি?”
তার কথা শুনে সীমা রেগেমেগে বলে উঠলো,
“ওকে আমি সহ্য করতে পারিনা। এই মেয়ে যেখানে যাবে, সেখানেই কিছু না কিছু খারাপ হবে। তাই ওকে আমার ছেলের থেকে দূরে রাখতে চাচ্ছি। মা হয়ে কি আমি ছেলের খারাপ চাইব।”
কথাগুলো শুনে বেলী উপরে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতে,হঠাৎ নীলাভ্র বেলীর হাতটা ধরে বললো,
“তুই কোথায় যাচ্ছিস। চুপচাপ এখানে বসে খাওয়া শুরু কর। একটা শব্দ যেনো আমি না শুনি।”
এইটুকু বলে বেলীকে টেনে চেয়ারে বসালো। তারপর মায়ের দিকে তাকিয়ে শান্ত স্বরে বললো,
“মা আমি এখনো ছোট বাচ্চা না। আমার যথেষ্ট বয়স হয়েছে। নিজের ভালো, খারাপ আমি বুঝতে শিখেছি। এখন আমাকে নিয়ে তোমার না ভাবলেও চলবে। আমার ভালো চাইতে গিয়ে অন্যকে কষ্ট দেওয়ার কোনো দরকার নেই।”

#চলবে

[ভুল গুলো ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। আসসালামু আলাইকুম ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here