#তুমি_নামক_ব্যাধি
#মুন্নী_আরা_সাফিয়া
#পর্ব_১২
তিহাম ভাইয়ার দিকে তাকালাম। বেশ হাসিখুশি লাগছে।কিন্তু চারপাশে তো হাসিখুশির তেমন কিছু ঘটেনি।আর আমি নিজেও না গোপাল ভাঁড়,না কাপিল শার্মা,আর না চার্লি চ্যাপলিন!
তাহলে এরকম ছাগলের মতো হাসার কি মানে?আচ্ছা, ছাগলের হাসি কেমন?তিহাম ভাইয়ার হাসি কে যে আমি ছাগলের হাসির সাথে তুলনা করছি,কিন্তু আমি তো কোনোদিন ছাগলকে হাসতে দেখিনি।তবে চোখ দিয়ে পানি বের হতে দেখেছি।অর্থাৎ যাকে বাংলায় বলে কান্না করতে দেখেছি।
হঠাৎ করেই খুব করে ছাগলের হাসি দেখার প্রতি মন গেছে। কিন্তু ছাগলকে হাসানোর উপায় তো জানা নেই।অনেক বেশি খাবার দিয়ে ট্রাই করতে হবে।অথবা কাতুকুতু দিয়ে ট্রাই করা যেতে পারে।পেটে সুড়সুড়ি দিলে হয়তো হাসবে।
নিজের চোখ নিজে দেখতে না পারলেও বেশ বুঝতে পারছি যে দুচোখ লাল হয়ে গেছে। কারণ চোখ জ্বালা করছে।আর নিজেকে কেমন শূন্য শূন্য লাগছে।মনে হচ্ছে আমি অভিকর্ষজ ত্বরণের আকর্ষণের বাইরে আছি।কিন্তু আমি তো না পৃথিবীর গভীরে আছি,না পৃথিবীর বাইরে অর্থাৎ মহাকাশে আছি।
মাথা নিচু করে পায়ের দিকে তাকালাম। নাহ্!পা তো পায়ের জায়গায় ফ্লোরেই আছে।আমি তো ভেসে বেড়াচ্ছি না।হয়তো পাঁচ কাপ কফি খাওয়ার ফলাফল এটা।তিহাম ভাইয়াকে উদ্দেশ্য করে বললাম,
—‘আমি উঠবো এখন।আর এরকম দাঁত ভেটকিয়ে সবাইকে দেখানোর মানে কি?দাঁত কি শুধু আপনার আছে?’
তিহাম ভাইয়া দাঁত আরো বেশি বের করে বলল,
—‘তোমার নিরবতা বেশ ইন্জয় করছি।তাই খুশিতে দাঁত অগোছালো হয়ে গেছে।আমার কথা না শুনেই বের হচ্ছে বার বার।আরো দু এক কাপ কফি অর্ডার করবো নাকি?’
—‘কনসার্ন হওয়ার জন্য ধন্যবাদ। আজকের মতো আর লাগবে না।আমি বাসায় যাবো।’
—‘বাহ!গ্রেট!!সুপারভ!!তোমার সাথে ঘুরতে এসে আমার দারুণ এক্সপেরিয়েন্স হলো।টানা পাঁচ পাঁচটা ঘন্টা তুমি পাঁচ কাপ কফি খেয়ে কাটিয়ে দিলে।আর আমি নিরব দর্শকের মতো চেয়ে চেয়ে রইলাম।বিরক্ত করিনি।কারণ শায়লা আপুর কাছে শুনেছিলাম তুমি খাওয়ার সময় কথা বলা পছন্দ করো না।তবুও আজকের দিনটা আমার লাইফের বেস্ট স্মৃতিগুলোর মধ্যে অন্যতম ও প্রধান হয়ে থাকবে।’
—‘ওয়েট,ওয়েট!আপনি শায়লা ভাবীর কাছ থেকে আমার ব্যাপারে আর কি কি শুনেছেন বলুন তো?আপনার লজ্জা করে না?ভাবীর মনে যদি উদয় হয় যে আমার প্রতি আপনার এত ইন্টারেস্ট কেন, তখন?’
—‘শোনো,খাওয়া আর বউ এই দুইটার কাছে কখনো লজ্জা করতে হয় না।বউয়ের কাছে লজ্জা করলে বাবা হবো কেমনে?এটা কিন্তু আমার কথা না।তোমার সুপ্রিয় হুমায়ুন স্যার বলেছেন।’
—‘ছি!এরকম নোংরা মানসিকতা আপনার থাকতে পারে।ওনার নেই।’
—‘হা হা।ওহ,তাই বুঝি!!শুনে হাসি পাচ্ছে।কারণ ওনার বেশ কিছু বই আমিও পড়েছি।”পেন্সিলে আঁকা পরী ” নামটা চেনা চেনা লাগে না?এখন আবার বলো না যে তুমি বইটা পড়নি।’
আমি চুপ হয়ে গেলাম।তিহাম ভাই বিল পে করতেই বাইরে বের হয়ে আসলাম।মাথা ব্যথা নেই এখন। তবুও ভালো লাগছে না তেমন একটা।কেমন যেনো সবকিছু ফাঁকা ফাঁকা লাগছে।মনে হচ্ছে শরীরের ওজন নেগেটিভ কিলো তে চলে এসেছে। খুব করে শূন্যে ভেসে বেড়াতে ইচ্ছে করছে।
ইশ!সত্যি যদি এখন সাইন্স ফিকশনের হিরোইন হতে পারতাম!মুহাম্মদ জাফর ইকবাল স্যারের সাইন্স ফিকশন “ফোবিয়ানের যাত্রী ” বইয়ের মৃত্তিকা হতে পারতাম!!কিংবা Novoland:The Castle in the sky ( S2) চাইনিজ হিস্টোরিকাল ড্রামার Wang Yuwen এর মতো যদি এখন আমার Golden Wings থাকতো!!আহা!!কত ভালো হতো।
সামনে একটা রিকশা থামতেই তাতে উঠে বসলাম।রিকশাওয়ালা বেশ মনোযোগ দিয়ে তার কাজ করছে। কোথায় যাওয়া হচ্ছে জানা নেই। বাসায় নাকি অন্য কোনো জায়গা তে কে জানে!জিজ্ঞেস করার আগ্রহ নেই।
আমি রিকশাওয়ালা মামুর দিকে নজর দিলাম।বয়স তিরিশের ঘরে হয়তো।গায়ে সাদা শার্ট যারা কিছু জায়গায় আয়রন তার ভাগ বসিয়ে লাল করে দিয়েছে।হঠাৎ করেই আমার ডান পাশে বসে থাকা প্রাণীটির কথা মনে পড়ল। আজ ভালো ভাবে তাকানো হয়নি।ড্রেস দেখার জন্য হালকা মাথা ঘুরিয়ে আর চোখে তাকালাম।
গায়ে নীল হুডি,কালো জিন্স,হাতে হাবিজাবি অনেক কিছু। এই পোলা কি হুডি ছাড়া আর কোনো পোশাক পছন্দ করে না নাকি?যাইহোক হুডিতে থাকে ড্যাশিং লাগে।অথচ আমার পোড়া কপাল।চাইনিজ,কোরিয়ানদের দেখে উৎসাহিত হয়ে একটা হুডি কিনে গায়ে দিছিলাম।
নিজেই নিজেকে আয়নায় দেখে এমন ভয় পাইছিলাম যে টানা আড়াই মাস রাতে দুঃস্বপ্ন দেখতাম।মনে হতেই ফিক করে হেসে দিলাম।পরে বুঝতে পেরে আবার গম্ভীর হয়ে গেলাম।তিহাম ভাইয়া একটু এগিয়ে কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো,
—‘ফাইনালি তুমিও কি আমার প্রেমের ফাঁদে আটকা পড়লে?’
নিচের ঠোঁট বাঁকা করে একটা ফু দিয়ে সামনে তাকালাম।কবে যে এই বজ্জাত পোলা তিথি কে বিয়ে করে আমায় মুক্তি দিবে!!ওয়েট,তিহাম ভাইয়ার তিন মাসের ছুটির এক মাস প্রায় শেষ হতে চলল।কিন্তু ওদের এক করে দেয় না কেন কেউ?নাহ্।আজ গিয়ে ভাবীর টনক নড়াতে হবে।
রিকশা থামতেই চোখের সামনে ছোট খাট একটা লেক চোখে পড়ল।আহামরি নতুন কিছু নয়।এখানে এর আগে বহুত বার ফ্রেন্ডদের সাথে এসেছি। রিকশা থেকে নামলাম।বিরক্ত লাগছে।তাও আবার একটু না।প্রচুর।
তিহাম ভাইয়াকে অনুসরণ করে লেকের পাশে ইট, পাথরে গড়া বস্তুটার উপর বসলাম।চারপাশে তাকিয়ে দেখলাম মানুষ কম।একদম নেই বললেই চলে।সরকার কি প্রেমিক প্রেমিকাদের জন্য জায়গাটা ব্যান করে দিয়েছে?নইলে এসময় টাতে তো প্রচুর কাপল থাকার কথা।
ঝিরিঝিরি বাতাস থাকা স্বত্তেও পরিবেশটা গুমোট।তিহাম ভাইয়া কোনো কথা বলছে না।নিরবতা ভঙ্গ করে আমিই বললাম,
—‘এখানে আসার কারণ জানতে পারি?’
শীতল গলায় বললো,
—‘হুম।কথা আছে।।ইউ নো,এক গবেষণায় দেখা গেছে যে,গরুকে প্রশান্তিমূলক গান শোনালে দুধ বেশি দেয়। ‘
—‘জানি।তো?’
—‘ভেরি সিম্পল। তুমি এখন আমায় একটা গান শোনাবে।ফলে আমার মনটা অনেক ভালো হয়ে যাবে।আমি অনেক সহজ হয়ে যাবো।তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা ইনফিনিটি গুণ বেড়ে যাবে।তোমাকে বলা কথাগুলো খুব ইজিলি গুছিয়ে বলতে পারবো।’
—‘হোয়াট অ্যা লজিক!গবেষণায় গরুর কথা বলেছেন,মানুষের কথা নয়।আর ভালোবাসার এসব সিলি,চিপ কথাবার্তা আপনি যত্নকরে তিথির জন্য তুলে রাখুন।আর কখনো কাউকে ইনফিনিটি পরিমাণ ভালোবাসতে যাবেন না।কারণ ইনফিনিটির কোনো অস্তিত্ব নেই।আর যে ভালোবাসার অস্তিত্ব নেই, সেটা কেমন ভালোবাসা?’
তিহাম ভাইয়া কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,
—‘আমি নিজেই তোমাকে একটা শোনাই।’
বলেই আমার মতামতের অপেক্ষা করলো না।গাওয়া শুরু করলো।
আমার ভিনদেশী তারা
একা রাতেরই আকাশে
তুমি বাজালে একতারা
আমার চিলেকোঠার পাশে।
ঠিক সন্ধ্যে নামার মুখে
তোমার নাম ধরে কেউ ডাকে
মুখ লুকিয়ে কার বুকে
তোমার গল্প বলো কাকে।
আমার ভিনদেশী তারা
তোমার অন্য পাড়ায় বাড়ী
আমার ভয় পাওয়া চেহারা
আমি আদতে আনাড়ী।
তিহাম ভাইয়া থেমে গেল।এই গানটা আমার ভীষণ রকমের প্রিয়।সেটা তিহাম ভাইয়া জানলো কিভাবে?নাকি শুধুই কাকতালীয়। কেমন একটা ঘোরের মধ্যে চলে গেছি।
সূর্য পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়েছে। তার চারপাশ জুড়ে এখন লাল আভা।তার বেশ কিছু লালচে রক্তাভা তিহাম ভাইয়ার মুখে ছড়িয়ে পড়েছে। অদ্ভুত রকম সুন্দর লাগছে তাকে।আমার নিজের মনের গোপন কোনো এক কোণে আছে কোনো এক সুরেলা কন্ঠের জাদুকরকে বিয়ে করবো।যে আমায় রোজ রাতে তার মাতাল করা কন্ঠে গান শুনিয়ে ঘুম পাড়াবে।
তিহাম ভাইয়া তিথির লাইফে যাওয়ার আগে যদি আমার আমার লাইপে আসতো তা হলে তাকে কেউ আমার থেকে আলাদা করতে পারতো না।প্রয়োজনে বেঁধে রাখতাম।হঠাৎ তিহাম ভাইয়া মায়াভরা দুটি চোখে তাকিয়ে বললো,
—‘ভালোবাসি।দিয়ামনি ভালোবাসি তোমায়।অনেক বেশি ভালোবাসি।তোমার উপর আমার অধিকারের পারমিশন দিবে?প্লিজ।তোমায় যে অনেক কিছু বলার আছে আমার। তোম……………….’
উঠে দাঁড়ালাম। ঘোর কেটে গেছে। চারপাশে বাস্তবতা এখন হিংস্র পশুর মতো মুখ করে রয়েছে। শুধু বললাম,
—‘আমি বাসায় যাবো।প্লিজ’
কেন জানি আজ রাগ করতে পারছি না।কপালের পেশিগুলোও চিরাচরিত নিয়ম না মেনে প্রশান্তিতে ঘুমিয়ে আছে।কোনো ভাজ পড়ছে না।তিহাম ভাই হয়তো আমায় বুঝতে পারলো।কিছু বলল না।দুজন নিরবে হেঁটে রিকশায় উঠলাম।
সারা পথ দুজনের কেউ কোনো কথা বলিনি।বাসায় পৌঁছে মাকে মাথা ব্যথার কথা বলে রুমে আসলাম।ফ্রেশ না হয়েই বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম।জানি ঘুম আসবে না।তবে অশান্ত মনকে স্থির করার আর কোনো বিকল্প উপায় জানা নেই।
(চলবে)
কয়েক পর্ব পর সব জানতে পারবেন।একটুপর আরেক