#তুমি_নামক_ব্যাধি
#মুন্নী_আরা_সাফিয়া
#পর্ব_০৬
.
.
সিঁড়ি দিয়ে উঠে প্রথম রুমটাতে ঢুকে বিছানায় দিলাম এক ঝাপ।অন্যের বাসা বলে দরজা লক করলাম না।
_____________
আজকে নিস্তব্ধপুরীর প্রবেশ পথেই দেখি সেই টুনটুনি দুটো।মনের সুখে তারা গান গাইছে আর উড়াউড়ি করছে।থমকে গেলাম। ভ্রু কুঁচকে ভাবলাম,এরা এখানে কি করছে? খুব একটা খারাপ লাগলো না। কারণ নিস্তব্ধপুরীতে কোনো পশুপাখি ছিল না বলে একটু বেশিই নিরব ছিল। একটু আধটু কিচিরমিচির শব্দ হলে তাতে মন্দ না!
ওদের রেখে একটু একটু করে সামনে এগোচ্ছি।কেন জানি মনে হচ্ছে, নিস্তব্ধপুরী আজ বেশি রঙিন আর প্রস্ফুট।গাছেরা যেনো মনের সুখে তাদের দিন রাত এক করে ভয়ংকর সুন্দর ফুলে ছেয়ে রেখেছে নিজেদের।আমাকে দেখে সবাই আরো বেশি করে দুলতে লাগলো।
আস্তে আস্তে পা ফেলে সামনে তাকাতেই দেখি,বকুল গাছটার নিচে হলুদ পাঞ্জাবি পরা কেউ একজন পেছন দিক করে আনমনে ফুল জড়ো করে যাচ্ছে। আমি সামনে এগোচ্ছি তার মুখটা দেখার জন্য। আর একটুু, আর মাত্র কয়েক পা, তারপরেই মানুষটাকে দেখতে পাবো। আর মাত্র, ধড়মড়িয়ে চোখ খুললাম।মনটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। যদিও এটা স্বপ্ন ছিল, তবুও কেন জানি মনে হচ্ছে আমার নিস্তব্ধপুরীর অধিকার কেউ আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিতে চাইছে।
পাশ ফিরে শুতেই দরজার উপর চোখ গেল।দরজা খোলা।দরজার পাশে সোফার উপর নজর পড়তেই সোফায় বসে থাকা মানুষটির দিকে নজর আটকে গেল। কোলের উপরে ল্যাপটপ নিয়ে কি যেনো লিখছে।
পরণে গেঞ্জি আর ট্রাউজার।গলার লকেটটা কামড়ে ধরে আছে। হয়তো সে এখন গভীর কোনো ভাবনার মাঝ সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে ।মাথার অবিন্যস্ত চুলগুলো সোজা হয়ে চোখের উপর লেপ্টে রয়েছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে শাওয়ার করার পর চুলে চিরুনি দেয়া হয়নি।
ছেলেদের চুলের উপর আমার বরাবরের মতোই দূর্বলতা।এই মুহূর্তে এই এলোমেলো চুলের উপর ক্রাশ না খেয়ে পারলাম না।ইচ্ছে হচ্ছে, চুলগুলো আলতো হাতে ছুঁয়ে দেই।হঠাৎ মানুষটি মাথা তুলে আমাকে দেখে চিন্তাযুক্ত গলায় জিজ্ঞেস করলো,
–‘ঘুম ভাঙলো?শরীর কেমন?এখন কেমন লাগছে?দূর্বল লাগছে নাকি?ক্ষুধা লেগেছে? ‘
তিহাম ভাইয়ার কন্ঠ কানে যেতেই দ্রুত উঠে বসলাম।
কপাল কুঁচকে বললাম,
–‘আপনি এখানে কেন?
ভাইয়া সোফা ছেড়ে উঠতে নিতেই কি মনে হয়ে ল্যাপটপটা বন্ধ করে কোলের উপর নিয়ে সোফায় বসল আবার।আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললেন,
–
-‘কোথায় থাকার কথা আমার?আরো ক্লোজ?’
–‘হোয়াট ডিড ইউ সে?’
–‘না মানে বলছিলাম যে,আমি তো তোমার থেকে বেশ দূরেই বসে আছি।ইজ ইট নট এনাফ? আরো দূরে থাকতে হবে?’
কপাল কুঁচকে নিচের ঠোঁট কামড়ে চুপচাপ বসে আছি।কি বুঝাতে চাইছে তা বুঝার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
ভাইয়াই আবার বললেন,
–‘তোমার কপাল কুঁচকানো দেখে একটু ভালো লাগছে।এই দুই দিনে তোমার হঠাৎ হঠাৎ রেগে যাওয়া, সেকেন্ডে সেকেন্ডে কপাল কুঁচকানো,ভ্রু কুঁচকে কথা বলা এইসবে অভ্যস্ত হয়ে গেছি।আজ সকাল বেলা গাড়িতে যখন সিক হয়ে পড়েছিলে,জানো খুব ভয় পেয়ে গেছিলাম।
তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি একদম বাচ্চাদের মতো নিষ্পাপ একটা ফেস,যে ফেসে একটা পেশিও কুঁচকে নেই, একদম ইননোসেন্ট একটা ফেস।কবি, সাহিত্যিকেরা বার বার যে ফেসের প্রেমে পড়ে। কিন্তু তোমার ওই ফেসের সাথে কোনোদিন সাক্ষাৎ হয়নি বলে সত্যিই ভয় পেয়ে গেছিলাম। থাঙ্কস গড।তুমি আগের তুমিতে ফিরে এসেছ।সেই তুমি, ফুল অফ অ্যাটিটিউড!’
কপালের খাদটা আরো গভীর করে তিহাম ভাইয়ার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি।কিছু বলার জন্য প্রস্তুতি নিতেই উনি হেসে ফেললেন।মুখের কাছে হাত নিয়ে বললেন,
–‘দিয়া,তুমি জানো,তুমি ঘুমের মধ্যেও মাঝে মাঝে কপাল কুঁচকাও।আমি আজ তিনবার তোমার কপালে হাত দিয়ে তোমার পেশিগুলো টান করে দিয়েছি।’
আমি বিস্ফারিত চোখে বললাম,
–‘হোয়াট?’
–‘না,মানে আমি না, আমি না।তিথি,তিথি করেছে। ‘
অনেকটা জোরেই বললাম,
–‘আপনি এখানে কি করেন?বেরিয়ে যান এক্ষুনি। ‘
–‘বারে,আমার বাড়ি আমার ঘর
অথচ আমিই নাকি পর।’
–‘মানে?’
তিহাম ভাইয়া কিছু বলল না। আমি বললাম,
–‘এটা আপনার রুম?’
–‘ছিল।বাট অনেক আগেই আমিসহ আমার যাবতীয় জিনিসের কর্তৃত্ব একজনকে দিয়ে দিয়েছি।তবে তাকে কখনো সেভাবে জানানো হয়নি।খুব শীঘ্রই জানাবো,আশা আছে। ‘
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাইয়া বললো। তার দীর্ঘশ্বানের অদৃশ্য শব্দ আমার কান অবধি ঠিকই পৌঁছালো।
তিথির কথা মনে পড়ল।অনিচ্ছার সাথে বললাম,
–‘হেল্প লাগবে?’
তিহাম ভাইয়ার দুচোখ খুশিতে ঝলমল করছে। বললো,
–‘তুমি সত্যিই হেল্প করবে? তাহলে তো আর কোনো বাঁধা রইলো না।বাই দা ওয়ে,তুমি আমার মালিকের রুমের কি অবস্থা করেছ,সে খেয়াল আছে? তাকে আমি কি কৈফিয়ত দিব?’
তাকিয়ে দেখলাম কোলবালিশটা অর্ধেক বেডের নিচে আর অর্ধেক বেডে,একটা বালিশ নিচে পড়ে আছে, কম্বলটাও নিচে।আর আমার গায়ে বেডশিট জড়ানো।কিছু বললাম না।আমার জন্য নতুন না এটা।একা একা ঘুমাই বলে কখন লাথি মেরে সব নিচে ফেলে দেই নিজের মাথাতেই থাকে না।আর যখন শীত লাগে তখন কিছু খুঁজে না পেয়ে বেডশিট গায়ে দেই।
তিহাম ভাইয়া আরেক দফা হেসে বলল,
–‘কি ভাবছ এত?তোমার গায়ে তিন তিন বার কম্বল দেয়া হয়েছে।কিন্তু তুমি নাছোড়বান্দা। সব ল্যাং মেরে ফেলে দিয়ে শেষমেষ বেডশিট গায়ে পেঁচিয়ে আছো।যাও এখন,ফ্রেশ হয়ে নাও।তোমার ব্যাগ ওইতো টেবিলের উপর রাখা। ‘
ওনাকে থামিয়ে দিয়ে বললাম,
–‘ওয়েট।তা গায়ে কম্বল পেঁচানোর শুভ কাজটা কে করেছে? ‘
–‘যদি বলি আমি করেছি,তাহলে কি আমার আস্ত থাকার কোনো সম্ভাবনা আছে? ‘
রেগে ফুসে উঠার আগেই তিহাম ভাইয়া দৌঁড়ে পালালো।
শাওয়ার নিয়ে রুমে ঢুকে দেখি টি টেবিলে খাবার ঢাকা দেয়া।সিক বলে হয়তো উপরে পাঠিয়েছে। দ্বিতীয় বার আর চিন্তার সুযোগ না দিয়ে খাওয়া শুরু করলাম।
খাওয়া শেষে রুমে একটু ভালো করে চোখ ভুলালাম।রুমে তিহাম ভাইয়ার একটা ছবিও নেই।শুধু মাথার ডানপাশ বরাবর দেয়ালে একটা হাতে আঁকা ছবি। এমনভাবে রাখা যেন বিছানায় শুয়ে থেকে দেখা যায়। তেমন রঙচঙ করা উজ্জ্বল নয়। ঝাপসা।বোঝা যাচ্ছে বহু বছর আগের ছবি।ছবিতে পিচ্চি একটা মেয়ে বিশাল বড় লাল রঙের শাড়ি পরে হাসছে।তার আঁচলের অধিকাংশ মাটিতে লুটোপুটি খাচ্ছে। কোনো নতুনত্ব নেই। এরকম একটা ছবি এত যত্ন সহকারে রাখার কোনো অর্থ খুঁজে পেলাম না।
দরজার উপর টুকা পড়তেই পেছন ঘুরে তাকালাম।মধ্য বয়স্ক এক মহিলা দাঁড়িয়ে আছে।বললাম,
–‘ভেতরে আসুন।’
–‘খাওয়া শেষ মা?’
–‘হুম।কে আপনি?’
–‘আমি এই বাসায় কাজ করি দীর্ঘদিন হলো। ‘
–‘ওহ্। আচ্ছা, সব নিয়ে যান।’
–‘কিছু লাগলে বলো আমাকে।’
–‘এখন লাগবে না।লাগলে বলবো।’
–‘আচ্ছা। ‘
খালা প্লেট নিয়ে চলে গেল।আমি তাকিয়ে আছি ওনার যাওয়ার দিকে।বেশ অবাক হয়েছি।কারণ এই প্রথম কোনো কাজের লোককে এত সুন্দর শুদ্ধ এবং সাবলীলভাবে কথা বলতে শুনলাম।অনেক ভালো লাগছে।আমাদের বাঙালীদের মনে বদ্ধমূল ধারণা হয়ে গেছে যে কাজের লোক মানেই গ্রামের অশিক্ষিত লোক। তাদের এই সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গিকে পাল্টানোর জন্য এরকম মানুষ প্রয়োজন।
(চলবে)
অনেকে হয়তো ভাবছেন, দিয়ানা একটু বেশি রুড!সত্যি বলতে বাস্তবে কিন্তু মেয়েরা একটু বেশি রুড হয়।বেশিরভাগ সম্পর্কে দেখা যায়, মেয়েরা কথায় কথায় রাগ করে,আবার ভালোও বাসে বেশি।
বাই দা ফুটপাত,আমি তো আমার বরকে নাকে দড়ি দিয়া ঘুরামু!🐸
#তুমি_নামক_ব্যাধি
#মুন্নী_আরা_সাফিয়া 🍁
#পর্ব_০৭
__________________
—‘আচ্ছা দিয়ানা,একটা মানুষ কি একসাথে দুইজনকে কখনো ভালোবাসতে পারে?’
তিথির প্রশ্ন শুনে কিছুটা চমকে গেলাম।আমি আর তিথি পাশাপাশি শুয়ে আছি। রাত মোটামুটি অনেক হয়েছে।হঠাৎ ওর এই অদ্ভুত প্রশ্নের কোনো যথোপযুক্ত অর্থ খুঁজে পেলাম না।এই নিছক প্রেম ভালোবাসার মতো ছেলেমানুষী বিষয় নিয়ে কথা বলা আমার ভীষণ রকমের অপছন্দ তা তিথি জানে।
শীতল গলায় বললাম,
—‘কেন পারে না,অবশ্যই পারে।আমরা নিজেরাই একসাথে বাবা মাকে কতটা ভালোবাসি!কিন্তু কখনো তাদের ভালোবাসার মধ্যে তুলনা করতে পারি না যে কাকে বেশি ভালোবাসি!!তাছাড়া আমরা ভাই বোন,বন্ধু -বান্ধব আত্মীয় স্বজনসহ কত মানুষকেই তো একসাথে ভালোবাসি।আর তুই মাত্র দুইজনের কথা বলছিস।’
তিথি একটু হাসল।তারপরেই গম্ভীর হয়ে বলল,
—‘আমি ওই ভালোবাসার কথা বলছি না রে গাধী!লাইফ লাইন, লাইফ পার্টনারের কথা বলছি।কেউ কি একসাথে তার জীবনসঙ্গীর জায়গায় দুইজনকে রেখে ভালোবাসতে পারে?’
—‘একজীবনে দুইজনকে ভালোবাসতে পারে, তবে একসাথে একই সময়ে পারে কিনা জানা নেই। ‘
তিথির দীর্ঘশ্বাসের শব্দ কান এড়াল না।মাথা ঘুরিয়ে ওর মুখটা দেখতে নেওয়ার চেষ্টা করতেই ও বলল,
—‘আমার দিকে এখন তাকাস না দিয়ানা।’
কৌতূহল নিয়ে প্রশ্ন করলাম,
—‘কেন? ‘
ও নিরবে বলল,
—‘রাত বড় অদ্ভুত একটা সময়। যে মানুষ নিজের একান্ত দুঃখ -কষ্ট, হাজারো পাওয়া না পাওয়া, ছিন্নভিন্ন সকল অনুভূতির সাথে প্রতারণা করে সারাদিন ভালো থাকার নিঁখুত অভিনয় করে, সবার সাথে লুকোচুরি খেলে,সেই মানুষটিও রাতের বেলা অন্য এক মানুষে পরিণত হয়।
তখন যে তার চারপাশে কেউ থাকে না।আর সেই সুযোগে অপ্রকাশিত অনুভূতিগুলো বন্দী পাখির মতো খাঁচা ছেড়ে বাইরে বের হয় হাঁফ ছেড়ে বাঁচার জন্য। মুক্তির আশায় ছটফট করে।কিন্তু রাত যে বড়ই রহস্যময়। আর তার রহস্যের মায়াজালে পড়ে তারা টালমাটাল হয়ে যায়। কোন দিক দিয়ে পালালে তাদের চিরমুক্তি মিলবে তার সমীকরণ কষতে থাকে। কষতে কষতে ভোরের আলো ফোটার সময় হয়ে যায়।
কিন্তু তারা উত্তর মেলাতে পারে না। বাধ্য হয়ে আবার তারা একটা দিনের জন্য খাঁচায় বন্দী হয়ে যায়।ভাবে পরের রাতে তাদের মুক্তি মিলবে। তারপর রাত আসে,আবার দিন।তাদের নিরলস প্রক্রিয়া চলতেই থাকে। কিন্তু উত্তর মিলিয়ে চিরমুক্তির চাবি খুঁজে পায় না।তাই রাতের বেলা কারো দিকে তাকালে হয়তো তার ভেতরের মানুষটাকে পড়ে ফেলা খুব সহজ হয়।’
তিথি থেমে গেল। ওর বারণ শুনলাম না।মুখ ঘুরিয়ে ওর মুখের দিকে তাকালাম।আমি ওর মুখের ভাষা পড়তে পারলাম না। ডিম লাইটের আবছা আলোয় ওকে রাতের মতোই রহস্যময় মনে হচ্ছে। ও বেশ যত্ন করে নিজেকে গুছিয়ে রেখেছে।
কেন জানি মনে হচ্ছে দিনের ওই হাসি খুশি মুখের আড়ালে অনেক না বলা কথা লুকিয়ে রেখেছে তিথি।বালিশটা একটু টেনে নিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে রইলাম। না চাইতেও এই মেয়েটাকে আমি ভীষণ রকমের ভালোবাসি।বেশ শক্ত করেই জড়িয়ে ধরলাম ওকে।যেনো ওর সমস্ত কষ্টগুলোকে নিজের করে নিতে পারি।
ও মুখ তুলে আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,
—‘অনেক রাত হয়েছে।চল ঘুমিয়ে পড়ি।’
আমি মাথা নাড়লাম শুধু। বার বার প্রার্থনা করছি রাতটা যেনো দ্রুত কেটে যায়। কেন জানি মনে হচ্ছে সব দোষ এই রহস্যময় আঁধারের। এই আঁধার কেটে গেলেই তিথির মনের সব আঁধার কেটে যাবে।আবার সেই ঠোঁটের কোনে লেগে থাকা হাসির তিথিকে দেখতে পাবো।
_______________________
দুপুরবেলা ল্যাপটপের সামনে বসে আছি।টং করে শব্দ হতেই মোবাইলের উপর চোখ পড়ল। হাতে নিয়ে লক খুললতেই বাংলায় লেখা এসএমএস ভেসে উঠলো।
“এই যে!শুনলাম তুমি নাকি পাশে কাউকে নিয়ে ঘুমাতে পারো না?একা এক বেডে না ঘুমালে ঘুম হয় না?তাহলে আমার কি হবে বলোতো? আমি যে তোমার থেকে পুরো উল্টো। যদিও কখনো কাউকে জড়িয়ে ঘুমাইনি,তবুও আমি ড্যাম সিউর তোমাকে জড়িয়ে না ঘুমালে আমার ঘুমই হবে না।আচ্ছা, এটা কি তোমার মানসিক রোগ? ইয়ে মানে আমি কি কোনো সাইক্রিয়াটিস্টের সাথে আলাপ করবো এই ব্যাপারে?”
মুখ অটোমেটিক্যালি হা হয়ে গেছে।। এই পোলা বলে কি!চোখ ধ্বক করে জ্বলে উঠলো। ছি!কি অশ্লীল ভাষায় লেখা!একদম আননোন নাম্বার। কে হতে পারে? চকিতেই তিহাম ভাইয়ার কথা মনে পড়ল। তিহাম ভাইয়া নয়তো?পরমুহূর্তেই মনে হলো তিহাম ভাইয়া এসব করতে যাবে কোন সুখে?
এই মাসেই হয়তো তার বিয়ে হয়ে যাবে।তাছাড়া আজ পাঁচদিন হলো এখানে এসেছি তেমন অসংলগ্ন ব্যবহার চোখে পড়েনি আমার। শুধু যখনি দেখেছে আমাকে চোখ দিয়ে গিলে খেয়েছে। তার চোখের হাত থেকেই রক্ষার জন্য সর্বদা লুকিয়ে থাকছি।এ বাসায় পর্যাপ্ত ফাঁকা রুম থাকতেও তিথির সাথে ঘুমাচ্ছি।কে জানে এসব ছেলেরা বিদেশে থেকে চরিত্রের কতটা ফালুদা করেছে!
দরজায় পায়ের আওয়াজ পেয়েই চোখ তুলে তাকালাম।তিথি বলল,
—‘নিচে চল।তুহিন এসেছে। সবাই নিচে এখন।তুইও চল।’
তুহিন তিহাম ভাইয়ার ছোট ভাই। ওনাদের আর কোনো ভাই বোন নেই।এই বাসায় আসার পর থেকে তুহিন তুহিন শুনতে শুনতে তার ব্যাপারে সব মুখস্ত হয়ে গেছে।কলেজে প্রথম বর্ষে পড়ে ঢাকায় মেসে থেকে।
তিথিকে বললাম,
—‘কখন এসেছে? ‘
—‘তা প্রায় আধ ঘন্টার বেশি হয়ে গেছে। ‘
—‘তুই যা না।আমি একটু পর আসছি।’
—‘একদমই না।এখনি চল’
বলেই আমার হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে গেল।ল্যাপটপটা বন্ধ করারও সময় পেলাম না।
সিঁড়ি থেকেই চোখ গেল সোফার উপর।তুহিন আর তিহাম ভাইয়া পাশাপাশি বসে আছে।দুজনের চেহারা একদম আলাদা।তুহিনকে যেমন কল্পনা করেছিলাম হুবহু তেমনই।গোলগাল মুখ। উস্কখুস্কো চুল।গোল বড় ফ্রেমের চশমা চোখে।তিথি আমাকে পাশে দাঁড় করিয়ে পরিচয় করিয়ে দিতেই সালাম দিল।
সালামের উত্তর দিয়ে কেমন আছে জিজ্ঞেস করে একটু দূরে সোফায় গিয়ে বসলাম। আড়চোখে তিহাম ভাইয়ার দিকে একবার তাকালাম।চোখে চোখ পড়তেই মাথা নিচু করলো।সবাই গল্প করছে।
অনেকক্ষণ হলো তিহাম ভাইয়ার কন্ঠ শুনছি না।চোখ তুলে চারপাশে তাকিয়ে দেখলাম নাই। হয়তো উপরে গেছে। আরো বেশ কিছুক্ষণ মোবাইল চালিয়ে ভাবীকে বলে রুমের দিকে পা বাড়ালাম।সিঁড়ি থেকে আর একবার তুহিনের দিকে তাকালাম।ক্লাস সিক্সের বাচ্চা বলে ভ্রম হয়।
রুমে ঢুকে দরজাটা হালকা লাগিয়ে সামনে তাকাতেই দুচোখ বিস্ফারিত হলো।বেশ জোরেই বললাম,
—‘আপনি এখানে কি করছেন?’
তিহাম ভাইয়ার হাতে আমার ল্যাপটপ।বলল,
—‘তেমন কিছু না।একটু চেক করছিলাম।’
—‘হোয়াট? আমার ল্যাপটপে হাত দিয়েছেন কেন?জাস্ট রিডিকিউলাস!’
বলেই হাত থেকে ল্যাপটপ টা নিয়ে নিলাম।
বললাম,
—‘ন্যূনতম ম্যানারস্ টুকু নেই নাকি? জানেন না কারো পার্সোনাল জিনিসে হাত দিতে নেই?’
—‘ল্যাপটপের উপর তো কোথাও “এটা পার্সোনাল” লেখা চোখে পড়লো না।নাকি আমার চোখের ডাক্তারের সাথে বৈঠকে বসা উচিত?’
—‘হোয়াট?’
—‘মানে তুমি চাইলেই আমার মোবাইল, ল্যাপটপ চেক করতে পারো।’
—‘আমি কোন দুঃখে চেক করতে যাবো ওসব।আজব।’
—‘আচ্ছা শোনো।তুমি কি তিথিকে লেখা ওই চিঠিটা পড়েছ?’
—‘অফকোর্স নট!জানার আগেই যখন পড়িনি,জানার পর তো পড়ার প্রশ্নই আসে না।’
—‘তুমি কি একটু চিঠিটা পড়বে প্লিজ।’
—‘আর ইউ ড্রাংক?’
—‘বাদ দাও।তোমার সাথে আমার কিছু অতি জরুরি কথা আছে।এখন না বললে হয়তো অনেক লেট হয়ে যাবে।তোমার কখন সময় হবে বলো?’
—‘এ জন্মে না!’
—‘ভেবে বলছ তো?’
—‘জি, হ্যাঁ।আপনার সাথে আমার কোন কথা নেই।আর কোনোদিন হবেও না।জাস্ট স্টে অ্যাওয়ে ফ্রম মি।’
—‘ভালো। পরে আমার দোষ দিও না।রাতে বাগানে বার্বিকিউ পার্টি হবে।শুধু ফ্যামিলি মেম্বারস থাকবে।রেডি হয়ে থেকো।’
—‘এরমধ্যে হঠাৎ পার্টি কোথা থেকে আসলো?’
—‘এখন,এইমাত্র প্রয়োজনে এসেছে। রাতে বাগানে যেতে যেনো কোনো ভুল না হয়।’
বলেই তিহাম ভাইয়া গটগট করে চলে গেল।আজিব পাব্লিক সব!যত্তসব পাগলের কারখানা।চোখের সামনে আসা চুলগুলো ফু দিয়ে উড়িয়ে দিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লাম।
________________________
রাতের বেলা সবাই বাগানে বসে আছি।ফুটফুটে জোসনা উঠেছে। বাগানে হাজার রকমের ফুলের মিশ্রিত গন্ধ নাকে আসছে।ঝিরিঝিরি বাতাসের সাথে পাল্লা দিয়ে মনমাতানো পরিবেশ বিরাজ করছে। চারপাশে তাকিয়ে দেখলাম সবাই আছে শুধু তিহাম ভাইয়া ছাড়া। সবাই কাজে ব্যস্ত।
হঠাৎ ভাবী বলল,
—‘তিহামকে তো দেখতে পাচ্ছি না।ওই তো হুট করে বলল যে রাতে বার্বিকিউ পার্টি হবে।এখন ও কই,?’
সবার মাথাতেই একি প্রশ্ন।তিথিকে জিজ্ঞেস করতে ও কিছু বলতে পারলো না।হঠাৎ তুহিন আমতাআমতা করে বললো,
—‘ভাইয়া তো বাসায় নেই।ওর সেই ছোটবেলার ফ্রেন্ডের ডাকতে যাবে বলেছিল।’
সবাই চুপ করে রইলো।আমার ভালোই লাগছে এটা ভেবে যে তিহাম ভাইয়া চারপাশে নেই।
বেশ কিছুক্ষণ পর আগুন ধরানো হয়েছে।মুরুব্বি সহ সবাই কাজে ব্যস্ত।আমি একটু দূরে বসে আছি।সবাইকে চাঁদের আলো,হলুদ লাইটের আলো আর আগুনের লাল আলোর সংমিশ্রণে বড় অদ্ভুত লাগছে।মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকার মতো দৃশ্য।
হঠাৎ তুহিন আমার পাশে এসে বেশ ভয় ভয়ে বলল,
—‘আপু,আমার রুমটা তো চিনোই।ওই তিহাম ভাইয়ার পাশের রুমটা।’
—‘চিনি।তো?’
—‘আপু আমি টেবিলের উপর একটা খাতা রেখে এসেছি।খাতার ভেতর ফোন নাম্বার লিখে রাখা। আমার এক ফ্রেন্ড আমার কাছে নাম্বারটা চাচ্ছে। অনেক জরুরি। প্লিজ একটু নিয়ে আসবে?আমি এদিকটা সামলাচ্ছি। ‘
মুচকি হেসে উঠে দাঁড়ালাম।আমি সহজে কাউকে পছন্দ করি না।কিন্তু মনে হচ্ছে এই ছেলেটাকে পছন্দ করে ফেলেছি।
তিথিকে বলতে নিতেই তুহিন বাধা দিল।বললো,
—‘আপু তুমি যাও।আর একটু তাড়াতাড়ি এসো।তোমার কথা কেউ জিজ্ঞেস করলে আমি বলে দিবো।’
অগত্যা হাঁটা ধরলাম। তিহাম ভাইয়াদের ডুপ্লেক্স বাসার একদম ডানপাশে বিশাল বাগান।বাসায় ঢুকে আগে রান্নাঘরে ঢুকলাম।কেউ নেই।পেটে একটু ক্ষুধা ক্ষুধা লাগছে।ফ্রিজ খুলে একটা মিষ্টি খেলাম।মিষ্টি আমার বরাবারের মতোই অনেক পছন্দ। একটা কোণ আইসক্রিম হাতে নিয়ে খেতে খেতে সিঁড়ি দিয়ে উঠছি।
তিহাম ভাইয়ার রুম ক্রস করে তুহিনের রুমে দরজা খুলে দেখি অন্ধকার। লাইট অন করে অনেক খুঁজেও কোনো খাতা পেলাম না।বাধ্য হয়ে আপনমননে হেঁটে চলে আসতে নিতেই তিহাম ভাইয়ার রুম থেকে একটা হাত হ্যাঁচকা টান দিয়ে রুমের ভেতর নিয়ে গিয়েই দরজা লাগিয়ে দিল।অন্ধকারের মধ্যে হাতটা ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে চিল্লিয়ে বললাম
————————————–
(চলবে)