তোমাকে চাইবো বলে পর্ব ৪

“তোমাকে চাইবো বলে”
পর্ব-৪

সন্ধ্যে থেকেই বৃষ্টি প্রচুর।থামাথামির নাম নেই।মুনা ঘুম থেকে উঠে দেখলো নাদিব নেই বাসায়।চুল বেধে কিচেনে যেয়ে দু কাপ কফি বানিয়ে শ্বাশুড়ির রুমে চলে গেলো। গিয়ে দেখলো তিনি বারান্দায়।মুনা ও গিয়ে পাশে বসলো।একমনে বাইরে তাকিয়ে আছেন রেবা বেগম। মুনা তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।

_হ্যাঁ রে মুনু, তুই কখনো বৃষ্টি তে ভিজেছিস? এমন ঝুম বর্ষায় একগুচ্ছ কদম হাতে নিয়ে?
_ভিজেছি,কিন্তু খুব কম।
_আমি যখন কলেজে পড়তাম তখন তো গ্রামের মাঠঘাটে দিব্যি বেনি ঝুলিয়ে ঘুরে ঘুরে ভিজতাম। কেউ কিচ্ছু বলতো না।এমনই এক বর্ষায় তার সাথে দেখা।
রেবা বেগম আনমনেই বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
_মুনা হুট করে জিজ্ঞেস করে ফেললো,
সে কি তোমার প্রেমিক ছিলো?
_ হাহাহা,পাগলী একটা। শ্বাশুড়িকে এভাবে জিজ্ঞেস করতে লজ্জা করেনা রে তোর?
_ওমা,লজ্জার কি।আমি জানতে চাই,তুমি আমায় বলবে ব্যাস।
_ হুম। সে ছেলেটা প্রায়ই বৃষ্টি হলেই একটা গাছের তলায় কদম হাতে দাঁড়িয়ে থাকতো।কিভাবে কিভাবে যেনো আমাদের ইশারা ইঙিতে প্রেম হয়ে গেলো। কেউই টের ই পেলাম না।
_ তারপর?
_তারপর একদিন ওই জায়গায় আর কেউই দাঁড়ায় না।আমি অপেক্ষা করে করে কষ্ট পেতাম।আপসোস হতো খুব জানিস,মনের কথা টা জানিয়ে না দেয়ার আপসোস। সে আর আসেনি কখনো। এর মাঝেই আমার বিয়ে হয়ে গেলো। পরে শুনেছি সে আমাদের গ্রামের অতিথি ছিলো। আমার বিয়ের পর সে আবার এসেছিলো, কিন্তু আমাকে পায়নি আর।
রেবা বেগম একনাগাড়ে বলে শূণ্যে তাকিয়ে রইলেন।মুনা বিরক্ত করলোনা আর।

অনেক্ষণ পর রেবা বেগম বললেন,
_ মুনা,তুই ভালো আছিস?
চমকে উঠে জবাব দিলো মুনা,হ্যাঁ কেনো মা?
_এমনিই।তোকে তো জোর করে নিজের কাছে এনেছি।তাই চিন্তা টা বেশিই হয়।আমার বাবু টা ও তো একরকম হয়েছে।বুঝিনা তোদের মাঝে কেমন সম্পর্ক চলছে।
_সব তো ঠিকই চলছে মা।এত চিন্তা কেনো করো বলোতো।
_আচ্ছা,আদিবের ঘরে যে তালা দেয়া,তার জন্য কি তোর রাগ হয়না নাদিবের উপর?
_ মুনা একটু চুপ থেকে বললো, না হয়না।বরং বেশ হয়েছে।আমি নিজেকে দুর্বল করতে চাইনা আর।একটা সময় তো আমাকে এগিয়ে যেতেই হতো।

শুনে খুশি হলেন রেবা বেগম।তার একটাই চাওয়া,নাদিবকে যেনো দ্রুত মুনা আপন করে নেয়।

নিজের রুমে এসে আয়নার সামনে বসে বসে শ্বাশুড়ির কথাগুলো ভাবছিলো মুনা।মনের কথা বলতে না পারার আপসোস মানুষ এর আজন্ম।সে নিজেই তো একটা হারিয়ে ফেলার আপসোস নিয়ে বেঁচে আছে। তারউপর পারছেনা নাদিবের মনের ভেতর কি চলছে তা জানতে।নিজের সব নাদিব কে বলতে।এই আরেক আপসোস নিয়ে সে বাঁচতে চায়না। আজ নাদিব আসলে ওকে সরাসরি জিজ্ঞেস করবে সে কাউকে পছন্দ করে কিনা।এ বিয়েটা কেনোই বা করেছিলো।
..

রাত প্রায় এগারোটা।মুনা টেবিলে খাবার দিয়েছে অনেক আগেই।শ্বাশুড়িকে খাইয়ে ওষুধ দিয়ে এসেছে। এখনো আসেনি নাদিব।এত দেরি সে করেনা কখনো। মুনা এ ঘর ও ঘর করতে করতেই চিন্তা করছে কল দিবে কিনা।পরে অস্বস্তি থেকে দিয়েই ফেললো। সুইচড অফ আসছে বারবার। মুহূর্তেই মুনার বুক কাপা শুরু হলো। এমন কেন হচ্ছে সে নিজেও জানেনা।এই মানুষ টার সাথেই তো আজ একপালা ঝগড়া হয়ে গেলো। এই মানুষ টা তো তার হবেই না কখনো। তাহলে এমন কেন হচ্ছে।মুনা খাবার টেবিলে একটা চেয়ার টেনে বসে রইলো। রাত মিনিট মিনিট পেরিয়ে বেড়েই চলেছে,এদিকে বৃষ্টির ও থামাথামি নেই।গাড়িও নেয়নি আজ।মুনার অসম্ভব চিন্তা হচ্ছে।রাগ করে কোথাও চলে যায়নি তো।নিজেকেই শাসাচ্ছে মুনা,কি দরকার ছিলো সামান্য ব্যাপারে এত রিয়েক্ট করার বিকেলে।

বিয়ের আগে তো সবার ই এক দুটা রিলেশন থাকেই,সেখানে পছন্দ করা টা স্বাভাবিক।নিজেকে যুক্তি দিয়েও শান্ত হচ্ছেনা মন।মুনা হতাশ হয়ে ভাবছে,নাদিব কি কখনো তার এই অনুভূতি বুঝবে? যে একবার পেয়ে হারিয়ে ফেলে তার যে হারানোর কি ভয় তা কি নাদিব জানে? আড়াল থেকে রেবা বেগম সব ই প্রত্যক্ষ করলেন,তিনিই বুঝলেন সব টা।

১২.

প্রায় একটার দিকে নাদিব এসে ঘরে ঢুকলো।বরাবরই তার কাছে একটা চাবি থাকে।সমস্ত শরীর কাকভেজা হয়ে আছে।এসেই টের পেলো সবাই ঘুমে।ড্রয়িংরুম পেরিয়ে আসতেই ওপাশে ডাইনিং এ চোঁখ পড়লো, মুনা টেবিলেই ঘুমিয়ে পড়েছে।নাদিব বুঝতে পারলো তার জন্যই হয়তো বসে ছিলো। ভেজা শরীর নিয়েই মুনার কাছে গিয়ে ডাক দিলো।শব্দ নেই মুনার।নাদিব আর ডাকলো না।ঘুমন্ত মুখটার দিকে তাকিয়ে রইলো।

কে বলবে এই মেয়েটাই বিকেলে রাগের মাথায় নিজের অজান্তে অধিকার এর দাবি তুলছিলো? আমি তো সব দরজা খুলেই দাঁড়িয়েছিলাম মুনা,তুমিই তো অধিকার হাতিয়ে নিলেনা।আমাকেও সরিয়ে রাখলে দূরে দূরে বন্ধুত্ব দিয়ে। এখন সেটা থেকেও বঞ্চিত করছো,কি জন্য তাও জানিনা।
ভাবতে ভাবতেই আবার ডাকতেই মুনা হকচকিয়ে উঠে দাড়ালো। ভউত দেখার মত চমকে উঠে জিজ্ঞেস করলো
_আপনি এখানে?
_হ্যাঁ,রুমে যেতেই দেখি তুমি এখানে,তাই..
_কোথায় ছিলেন আপনি? নিমেষেই মুনার মুখে রক্ত জমলো।
নাদিব হালকা স্বরে জবাব দিলো,
_একটু কাজ ছিলো। আমি রুমে যাচ্ছি বলেই কেটে পড়লো নাদিব।তার ঠান্ডা লাগছে ভীষণ।

মুনা ছলছল চোঁখে দাঁড়িয়ে রইলো। এত রাত যে বসে রইলো তার কি এই প্রতিদান? জবাবদিহি করতেই চাইলোনা নাদিব।চাইবেই কেন,আমি তার কে হই যে তার চিন্তা হবে।হনহনিয়ে মুনা রুমে গেলো, নাদিব টাওয়াল নিয়ে বাথরুমে যেতেই মুনা সামনে দাড়ালো,
_আপনার ফোন কই?
_পকেটে,কেনো?
মুনা হুট করেই ভেজা প্যান্ট এর পকেটে হাত দিয়ে মোবাইল বের করে আনলো,নাদিব হতভম্বের মত চেয়ে রইলো। মুনা দেখলো ফোন সত্যিই অফ হয়ে আছে পানিতে ভিজে।

ফোন টা ফ্লোরে আছাড় মেরে চেচিয়ে উঠলো সে,
_এমন কি কাজে আপনি ব্যস্ত ছিলেন যে ফোনের দিকেও খেয়াল ছিলো না? কি এমন কাজ যার জন্য বাসায় সবাই কি করছে তাও মাথায় আসেনা?
_ মুনা আস্তে,কি হচ্ছে এসব,মা নিশ্চয়ই ঘুমাচ্ছে।
মুনা চকিতেই নাদিবের শার্টের কলার খামছে ধরলো দু হাতে,
_মা? এতগুলো ঘন্টা মনে ছিলোনা সেটা? বাসায় দুটি মানুষ পাগলের মত হাসফাস করছে সেটা আছে আপনার মাথায়?
নাদিব বিস্ফোরিত চোখে মুনার দিকে তাকিয়ে রইলো, এই মেয়েটাকে প্রচন্ড রকম ভালো লাগছে,খুব জোরে বুকে জড়িয়ে নিতে ইচ্ছে করছে।এই বকা গুলো না হয় বুকের ভেতর ই চলবে তারপর। বকতে বকতে মেয়েটা তার বুকেই ঘুমিয়ে পড়ুক,ঘুমন্ত মুখটায় তখন চুপটি করে আদর মাখিয়ে দিবে।ভাবতেই নাদিবের সব সত্ত্বা মাথা ছাড়িয়ে উঠলো। নাদিব নিজেকে সামলে নিয়ে মুনাকে ছাড়িয়ে চলে যাচ্ছিলো বাথরুমে।মুনার রাগ এবার আরো বেড়ে গেলো। সে আবার সামনে গিয়ে নাদিব কে ধাক্কা দিতেই নাদিব দেয়ালের গা ঘেষে দাড়ালো। মুনা আরো জোরে নাদিবের শার্ট খামছে ধরলো। নাদিবের ভালোই লাগছে সব,তাকে নিয়ে যে মুনা এমন উদ্ভিঘ্ন হবে তা অজানা ছিলো তার।
_মানুষ মনে হয় আমাকে? কোনো উত্তর দিচ্ছেন না কেন?কোথায় ছিলেন আপনি এতরাত? সত্যি করে বলুন আমাকে।
_নাদিব দু হাত মুনার গালে রেখে বললো, মুনা ছাড়ো প্লিজ,শান্ত হও আগে।
_আপনি এখনো বলছেননা কিন্তু। আপনি ইরার সাথে ছিলেন তাইনা? এটাতো আমার মাথায় ই আসেনি।হ্যাঁ আসেইনি মাথায়।আরে আমি তো বোকার মতন চিন্তা করছিলাম শুধু শুধু।
_মুনা এসব কি,ইরাকে টানছো কেন হঠাৎ
_চুপ একদম,ইরার কথা বলায় খুব গায়ে লাগছে তাইনা? আরে কাপুরুষ! আমাকে তো সত্যিটা বলতেই পারতেন নিজ থেকে,ইরাকে আপনার পছন্দ,ইরার মতোই কাউকে চেয়েছিলেন,বলতেই পারতেন আমাকে।আমি তো..
_আমি তো কি? সিনেমার নায়িকাদের মতো সরে যেতে? আমাদের এক করে দিতে? তাইনা?

মুনার দুচোখের পানি এবার গড়িয়ে পড়লো। ইচ্ছের বিরুদ্ধে চলছে আজ মন।সে নরম হয়ে গেলো, সাথে সাথেই নাদিব কে ছেড়ে দিলো।
একদম চুপ হয়ে বসে পড়লো খাটে।নাদিব অপ্রস্তুত হয়ে বাথরুমে চলে গেলো। নিজেকে নিজেই গালি দিচ্ছে,কি বলতে কি বলে ফেললো সে এসব? মুনা কাপুরুষ বলায় মাথাটা খারাপ হয়ে গেলো তখন। আর ইরাকে নিয়ে এসব কি বলছে মুনা। তবে ইরাকে সন্দেহ করেই সে বন্ধুত্ব থেকে সরে গেছিলো হঠাৎ?

নাদিব জানেনা মুনার মনে তার জন্য কেমন জায়গা আছে,বা আদৌ আছে কিনা? কিন্তু তার দিকটা সে ক্লিয়ার করবেই আজ।এমন উল্টো পালটা কথার জন্য মুনা নিশ্চয়ই ওকে আর সহজ ভাবে নিবেনা।তাই সব ক্লিয়ার করতে হবে।
..

নাদিব বাথরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে এসে দেখলো মুনা রুমে নেই।খালি গায়ে টাওয়াল জড়িয়েই বারান্দায় উঁকি দিয়ে দেখলো মুনা একটা চেয়ারে পা তুলে ঘুটি মেরে বসে আছে।অন্ধকারে বুঝা যাচ্ছেনা সে জেগে নাকি ঘুমাচ্ছে।নাদিব আস্তে করেই গিয়ে পাশে বসলো। বাইরে হালকা হালকা বৃষ্টি আর হাওয়া এসে গায়ে লাগছে।শীত করছে নাদিবের একটু।একটা বারান্দা,দুজন বিচ্ছন্ন মানুষ, অন্ধকার,আর কিছু দীর্ঘশ্বাস এর শব্দে অন্যরকম পরিবেশ।
মুনা আচমকা হাত এগিয়ে সিগারেটের প্যাকেট টা নাদিব কে ফেরত দিলো।
_নিন,আমার উচিত হয়নি বিকেলে এভাবে কেড়ে নেয়া।সব কিছু ছিনিয়ে নেয়ার নিয়ম নেই।

_আসলে মুনা আমি স্যরি।ভুল আমার ই।আমার উচিত ছিলো তোমাকে শান্ত হয়ে ক্লিয়ার করা সব।

_ব্যাস,হয়ে গেলো তো সব ক্লিয়ার।চিন্তা কিসের আর।আমি চেষ্টা করবো আপনি যাতে ভালো থাকেন।
_তুমি ভুল বুঝছো আবার আমাকে,আমি বলতে চাচ্ছিলাম…

_আপনি জানেন,আমি কখনো প্রেমে পড়িনি কারো।পড়িনি মানে চেষ্টা ই করিনি।অল্প বয়সে বাবা চলে গেলেন,সব কিছু অগোছালোই রয়ে গেলো। নিজের মা,ভাই,ক্যারিয়ারের কথা চিন্তা করতে করতেই কখন জানি বড় হয়ে গেলাম খুব।বিয়ের চিন্তাও ততদিনে পালিয়েছে।আমি ভাবিইনি এভাবে আমার হুট করে বিয়ে হয়ে যাবে।
এটুক বলেই বাইরে তাকিয়ে রইলো মুনা।নাদিব একমনে মুনার কথা শুনছে।

_একদিন হুট করেই আদিব আসলো আমার জীবনে।একদম অনেক কালো রাত্রি পাড়ি দিয়ে যেমন ভোর আসে ঠিক তেমনি করে।আমার প্রথম কতক দিন এটা ভেবেই কেটেছে আসলেই কি সব সত্যি?
হুট করেই আপনার মা আমাকে দেখতে গেলেন, আমাকে তার পছন্দ হয়ে গেলো সেদিন ই।আমাকে তিনি নিজে ছেলের ছবি দেখালেন,আর বললেন ছেলেকেও আমার ছবি পাঠিয়ে দিছেন।কিন্তু আমি আপত্তি করে বসলাম।নিজের জীবনে এত উঠাপড়া দেখেছি যে,নতুন করে আর হতাশ হতে চাইনি।তাই বললাম আমার ছবির উপর ডিপেন্ড না করে সরাসরি আমাকেই দেখানো হোক। কিন্তু উনি বললেন তার ছেলে আসবে চার মাস পর।কিভাবে সম্ভব।পরে বললেন ঠিক আছে ভিডিও কলে দেখাবে।এভাবেই আমার আর আদিবের নাম্বার আদান প্রদান করলেন মা। সেদিন ই তিনি সব কথা পাকা করে গেলেন।

এর কয়েকদিন পরেই মায়ের কথাতে আদিব কল করলো আমাকে।কিন্তু সে কিছুতেই দেখবেনা আমাকে আর।ছবিতে যা দেখেছে তাই।তার এক কথা,তুমি যদি ছবির থেকেও খারাপ হও তাতেও আমার চলবে,কারণ তুমি ভেতর থেকেই খুব সুন্দর। বাইরে না হলেও চলবে।বাহিরের সৌন্দর্য তো একদিন ফুরিয়ে আসবে।
এভাবে অল্প অল্প আলাপ হতে হতেই একে অন্যের ইঞ্চি ইঞ্চি জেনে গেলাম।আমার লাইফের সেরা বন্ধু হয়ে উঠলো সে।আমার স্বভাব,অভ্যাস,অভিমান,সব কিভাবে যেনো বুঝে যেতো। ওর থেকে এত ভালো করে কেউ কখনোই বুঝেনি আমাকে।আমি নিজেকে হারিয়ে ফেললাম তার ভেতর।নিজের বলতে বাকি ছিল না কিছুই। সে এতটাই আপ্রাণ ছিলো।

নাদিব মুনার চোখের দিকে তাকিয়ে আছে,মেয়েটা খুব দৃড়তার সাথে কথা বলছে।তাকে বিরক্ত করা উচিত না এখন।

একটু দম নিয়ে মুনা শুরু করলো,
_ জানেন,চার মাসে আমাদের সম্পর্ক টা অনেক স্বপ্ন বুনে ফেললো। আমরা একসাথে একেকটা দিনের প্লানিং করেছিলাম। ওর দেশে আসার ডেট কনফার্ম হবার পর ও কত খুশি ছিলো। নিজ হাতে কেনাকাটা করতো আর আমাকে দেখাতো সব। এর মাঝেই আপনার মা আর আমি খুব ভালো বন্ধু হয়ে উঠলাম।মা আমাকে কল করে বললেন আদিব কে রিসিভ করতে আমাকেও সাথে নিবেন,যাতে আদিব চমকে যায়।এই সিদ্ধান্ত শোনার পর আমি কয়েকরাত ঘুমাতেই পারিনি উত্তেজনায়। যে মানুষ টাকে এতগুলা মাস দূর থেকেই ভালো বেসে চলেছি,একেকটা মুহূর্তের হিসেব যার সাথে কষেছি,সেই মানুষ টার সামনে দাড়াতে হবে আমাকে। আমি লজ্জায় মরে যাচ্ছিলাম আর দিন গুনছিলাম।অবশেষে সেদিন আসলো..
আদিব দেশে ফিরলো,খুব নিরিবিলি ভাবেই ফিরলো।কিন্তু আমার তার বুকে সঞ্চয় করা স্বপ্ন গুলো আর ফিরেনি। তার মায়ামায়া দুচোখের দিকে আমাকে তাকিয়ে লজ্জায় মরে যেতেও হয়নি আর। আমার সমস্ত উত্তেজনাকে শান্ত করেই ফিরেছিলো সে।
সেদিন সকালেও আমার সাথে কথা বলে বের হয়েছিলো আদিব।প্রতিদিন ই আমাদের দিনভর চ্যাটিং,কল চলেই।আমি ক্লাশ শেষ করে বের হলেই সে সাথে সাথে কল করতো।সেদিন আমি বের হওয়ার পর কল আসেনি।ভাবলাম ব্যস্ত অনেক,টেক্সট করে রাখলাম তাই।জানি সাথে সাথেই রিপ্লাই করে,সেদিন রিপ্লাই আসেনি।আমি অপেক্ষা নিয়েই ফোন রেখে ঘুমালাম।ঘুম ভাঙলো আমার মায়ের কান্নায়।কিছু বুঝতে পারছিলাম না কি ঘটছে।মা আমাকে বারবার বুকে জড়িয়ে কাঁদছেন।কিছু বুঝে ওঠার আগেই গুঞ্জন শুনলাম আদিব এক্সিডেন্ট করেছে।আমি পাত্তাই দিলাম না।নির্বিকার হয়ে ফোন হাতে নিয়ে বারবার কল আর মেসেজ করেই চলেছি।আর ভাবছি এইতো এবার বুঝি সে রিপ্লাই করে বলবে,আরে বোকা,সামান্য এক্সিডেন্ট ই তো হয়েছে।আমি ঠিক আছি।এভাবে কত সময় গেলো জানিনা।একসময় আমার আর কিছুই মনে নেই।কয়দিন গেলো মাঝে জানিনা আমি।

হুশ হবার পর টের পেলাম আমি আর মা আপনাদের বাসায়।চারপাশে সবাই আমাকে দেখছে আর আপসোস করছে।আদিবের সাথে আমার দেখা করাতে আমাকে আনতে বলেছে মা।
অথচ কি অদ্ভুত দেখুন, আমাদের প্রথম আর শেষ দেখা সেটা।

রক্তশূণ্য মুখে মুনা খুব স্বাভাবিক ভাবেই কথাগুলো বলছে।নাদিব অবাক হচ্ছে ওর লুকানোর শক্তি দেখে।একটা মানুষ কতটা আঘাত পেলে এমন নির্বিকার হয়ে যায়।

_জানেন,একটা বার ওরা কেউই আমাকে আদিবকে ছুঁতেও দেয়নি।শুধু একনজর দেখতে পেয়েছি।একটুও কাঁদিনি আমি।কফিনের সামনে বসে তাকিয়ে ছিলাম।
সারা মুখে ছিন্নভিন্ন দাগ।যে মুখের সামনে দাঁড়িয়ে আমার লজ্জায় মরে যাওয়ার কথা ছিল। যে মায়াবী চোখ দেখার আশে আমি অপেক্ষায় ছিলাম,সেই চোখ জোড়া কি নির্বিঘ্নে ঘুমিয়ে আছে। যে মুখ দিয়ে দিনে হাজারবার উচ্চারিত হতো, মুনা মুনা,সেই মুখ কেমন চুপসে আছে। আমার ওকে ভালোবাসিই বলা হলোনা জানেন? ওর গালে এই,এই দুহাত চেপে জানতে চাওয়া হলো না, আমাদের স্বপ্নগুলোর কি হবে এবার?

এই বলতে না পারার আপসোস আমাকে প্রতি মুহুর্তে খেতো।আমি পালিয়ে বেড়াতাম। নিজেকে ভুলাতে চাইতাম।এতই কি সহজ বলুন তো? ফোনের অপর প্রান্ত থেকে যার নিঃশ্বাসের শব্দ না শুনলে আমার স্বস্তি মিলতো না,তাকে ভুলতে মাত্র দুমাস সময় পেয়েছি আমি। দু মাস? তারপর আপনি এলেন আমার জীবনে,বা সঠিক করে বললে আমিই হুট করে আপনার গুছানো জীবনে ডুকে পড়লাম।
ও তো চলেই গেলো আমাকে এক ভীষণ আপসোস এর সাগরে ডুবিয়ে।পালিয়ে গেলো, স্বার্থপর লোকটা। একটা গভীর ভয় জমিয়ে দিয়ে গেলো মনে। আজকের বাড়াবাড়ির জন্য হয়তো এই ভয়টাই দায়ী।

নাদিবের ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে এই মুহুর্তে। চারপাশ চুপচাপ,এমন শুনশান মধ্যরাতে প্রেমালাপ নয় বরং একটা বিষাদী হৃদয়ের নিশ্চুপ হাহাকারে রাতটাও নত হয়ে আছে। বৃষ্টি বাড়ছে,বেশ অনেকক্ষণ পর নাদিব মুনার সামনে বসলো হাটু গেড়ে।
মুনা হাটুতে মুখ গুজেই ঘুমিয়ে পড়েছে এর মাঝে নাদিব টের পায়নি।মুনার দুহাত ধরতেই তা নেতিয়ে পড়ায় নাদিব আর কিছুই বললো না।গায়ের টাওয়াল টা সরিয়ে রেখে মুনাকে কোলে তুলে নিলো।মুনা জেগে গেলে কি ভাববে,বা সে এসব কেন করছে এসব তার মাথায় নেই এখন।নাদিবের মাথায় ঘুরছে শুধু,মেয়েটাকে সে আঘাত করেছে অজান্তেই।সে মুনার অবহেলায় যতটা আঘাত পেয়েছে তার বেশি আঘাত সে দিয়েছে মুনাকে।

১৩.
নাদিবের খালি বুকের সাথে মুনার শরীর লেপ্টে আছে।রুমে আসতেই দেখলো চোখের কোণে পানি। নাদিবের খুব ইচ্ছে হয় আজকাল মেয়েটাকে আগলে রাখতে খুব।সব দ্বিধা দ্বন্দ্ব দূর করে নিজের করে নিতে,কিন্তু অদৃশ্য কিছু বাধা তা বারবার হতে দিচ্ছেনা।

মুনাকে শুইয়ে দিয়ে মুখে লেপ্টে থাকা চুল গুলো আলতো আলতো করে সরাচ্ছে নাদিব।শ্যামবর্ণা মুখটায় অদ্ভুত মায়া খেলছে। এই মায়ায় নাদিব কবেই ডুবে আছে সে কি জানে। কেমন এক ঘোর লেগে আসছে নাদিবের।হুট করেই মুনার চুল সরিয়ে কানের গোড়ায় আলতো চুমু দিলো।অগোচরেই হোক,তবুও প্রথম চুমুর অনুভূতি নাদিবকে মাতাল করে দিচ্ছে।তারপর অনেক্ষণ মুচকি হেসে মুনার ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো।কি হলো যেনো তার,মন্ত্রমুগ্ধের মত মাথাটা নিচু করেই মুনার দু ঠোঁটের উপর ঠোঁট রেখে চোঁখ বুজে রইলো। ভয়ে বুক কাপছে হঠাৎ ই,এখনি বুঝি মুনা জেগে উঠবে।এক সেকেন্ড দু সেকেন্ড করে অপেক্ষা করে করে নিজেকে কিছুটা নরম করে মুনার ঠোঁট জোড়া এক ঝটকায় নিজের ঠোঁটের আয়ত্ত্বে নিয়ে নিলো। সাহস এর স্বল্পতা,অন্যদিকে ভালোবাসার তীব্র দহন এক অদ্ভুত উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে। বেশ কিছুক্ষণ পর নাদিব মুখ তুলে চাইলো, বেশিক্ষণ তাকাতে পারলোনা। আজ পর্যন্ত কখনো ই সে মুনার দিকে অপবিত্র নয়নে তাকায়নি,দুর্বলতা এসেছে বহুবার তবে সেটা ভালো বাসা থেকে,স্ত্রী হিসেবে মেনে নিয়েছে বলেই।মেয়েটা কেন বুঝলোনা তাকে একবার ও।স্বামী হিসেবে কি সে কম ভালোবাসতো ওকে? তার যে অধিকার চাই তা কি মুনা বুঝেনা। অধিকারবিহীন জোর খাটানোর মত মানসিকতা তো নেই নাদিবের।কিন্তু এই মুহুর্তে সে মুনার থেকে নিজেকে কিছুতেই আর সরাতে পারছেনা,অদ্ভুত দুর্বলতায়, লজ্জায়, কান্না চলে এলো নাদিবের।তার যে এই মুহুর্তে খুব বেশিই অধিকারিত্ব চাই,কবে মুনা নিজ থেকে সব বাধা পেরিয়ে আসবে।বেসামাল হয়ে আবার মুখ ডুবালো মুনার ঠোঁটে,দু হাতে মুনার গাল চেপে সমস্ত দ্বিধা দ্বন্দ্ব এক করে দিচ্ছে নাদিব।বৃষ্টি তে ভিজে সমস্ত গা কাপিয়ে জ্বর আসছে সে খেয়াল নেই তার।দু চোখ নিভে আসছে প্রায়।একসময় টের পেলো কারো দুহাত তাকে আকড়ে ধরেছে,খালি গায়ে কারো নখের স্পর্শ লাগছে।এক মুহুর্ত না ভেবেই নাদিব নিজেকে ছেড়ে দিলো মুনার বুকে। নিমেষেই ঘুমের ঘোরে তলিয়ে গেলো নাদিব।

১৪.
খুব ভোরে শরীরে খুব গরম ভাপ লাগতেই জেগে গেলো মুনা।নড়তে গিয়ে টের পেলো সে নড়তে পারছেনা।কেউ একজন তার কাধে মুখ গুজে আছে।মুনা হকচকিয়ে গেলো। হাত দিয়ে নাদিব কে আস্তে ঠেলে সোজা করে শোয়ালো।একে ত নাদিবের খালি গা দেখে মুনার অদ্ভুত লাগছে,অন্যদিকে দেখলো খুব জ্বর।হঠাৎ মনে পড়লো রাতে তো নাদিব খালি গায়েই ছিলো, হয়তো জ্বরের ঘোরেই কাছে চলে এসেছে। সমস্ত চিন্তা সরিয়ে নিজেকে হালকা করে বেরিয়ে এলো বারান্দায়।মনে পড়ে গেলো কাল রাতে সে এখানেই ঘুমিয়ে গেছিলো। লোকটা কি ওকে আবারো কোলে করেই নিয়ে গেছিলো? লজ্জা হচ্ছে নিজের অজান্তেই।কিন্তু কেনো? লোকটা তো তাকে সরিয়ে দিতে চেয়েছিলো কাল রাতেই।তবে কেন এসব মায়া দেখাতে আসে আবার।মুনা চুপ করে কিচেনে এসে চা বসালো।

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here