#তোমাকে_চাইবো_বলে
#পর্ব_৬
..
ক্লাস শেষ করেই তড়িঘড়ি করছে রিক্সার জন্য।নাদিব নতুন ও বাড়িতে,তার উপর দুর্বল, একা কি করছে টেনশন হচ্ছে। গেটের বাইরে এসে দাড়াতেই পেছন থেকে মুনা বলে ডাক শুনলো। মুনা হকচকিয়ে পেছনে তাকালো।
এক মাঝবয়েসী ভদ্রলোক, ড্রেসাপ,চেহারায় আভিজাত্যের চাপ।মুনা অবাক হলো এই লোক ওর নাম জানলো কিভাবে,কলেজের নতুন প্রফেসর না তো? তাহলেও নাম জানবে কিভাবে?
“কি ভাবছো আমি জানি,একটু কথা বলতে পারি আমরা?
“হ্যাঁ বলুন।
“এখানে না,রাস্তার ওপাশে কফিশপে যেতে পারি আমরা।
“মানে,কে আপনি,আর আমাকে এভাবে অফার করছেন কেন?
“সেটা বসলেই ক্লিয়ার করতে পারবো,প্লিজ চলো।
“সরি,আমার তাড়া আছে।যেতে হবে।
“আজ কি তোমার স্বামী আসেনি?
মুনা চমকে গেলো, এই লোক কি তবে ফলো করেছে ওকে।কিভাবে জানলো নাদিব এসেছে সেদিন।
“আপনি কি আমাকে ফলো করছেন কদিন? মতলব কি আপনার?
“হাহা, চিন্তা করোনা মেয়ে।তোমার সাথে আমার খুব জরুরী কথা ছিলো, তাই সুযোগ খুজছিলাম।
“আপনাকে তো চিনিই না।তাছাড়া আমার হাজবেন্ড অসুস্থ আজ,আমাকে যেতে হবে।
“কি হয়েছে নাদিবের? উদ্ধিগ্ন দেখালো লোকটাকে।
মুনা যেনো শক খেলো নাম শুনে।কথা না বাড়িয়ে কফিশপে বসতেই ভদ্রলোক দুটা কফির অর্ডার দিলেন।
“তারপর! আমি খুব খুশি হয়েছি তোমাকে নাদিবের সাথে দেখে। এটাই জীবন, নিজেকে মুভড অন করানো উচিত সবার ই।
“বুঝলাম না।
“কফিটা নাও,
“আপনি বলুন তো আমাকে কিভাবে চিনেন? আর নাদিব কেই বা।
“বলবো বলেই তোমাকে খুজেছি।তুমিই পারো হেল্প করতে আমাকে।
“প্লিজ আপনি এভাবে সাসপেন্স ক্রিয়েট না করে আমাকে বলুন আপনি কে? কে আপনি?
“আদিব কে তুমি খুব ভালোবাসতে,তাইনা?
মুনার হাতের কফির মগ নড়ে উঠলো। মনে হলো কেউ বর্ষপুরোনো বন্ধ দরজায় জোরসে আঘাত করেছে।ভয় হচ্ছে মুনার।কে এই লোক।কিভাবেই বা আদিবের ব্যাপারে জানে।
মুনা! আদিব আমাকে তোমাদের সম্পর্কের সব ই বলেছে,প্রচন্ড ভালোবাসার শক্তি দেখেছি আমি ওর মাঝে।আদিব ই আমাকে তোমার সব বলেছে।
মুনার সমস্ত শক্তি হারিয়ে গেছে,দু চোখ দিয়ে অবাধ্য জল বইছে।মনে হচ্ছে কেউ গলাটা বন্ধ করে দিয়েছে।
“আপনি কে বলুন প্লিজ।
খুব দৃড় স্বরে বললো মুনা।
“রেবা কেমন আছে মুনা?
মুনা আরেকটা শক খেলো। মুহুর্তেই তার মনে প্রথমেই এলো সেই লোকটার কথা,যার কথা শ্বাশুড়ি সেদিন বলেছিলেন।যাকে কিশোর বয়সে ভালো বেসেছিলো।কিন্তু তিনি এতদূর অব্দি চেনার মানে খুঁজে পায়না মুনা।
“আমি আদিবের বাবা। হাসান মাহমুদ।রেবার স্বামী।
মুনা বাকশক্তি হারিয়ে ফেললো। কিচ্ছু না বলে শক্ত হয়ে তাকিয়ে রইলো লোকটার মুখের দিকে। অনেক খেয়াল করলে নাদিবের সাথেও কিছুটা মিল পাওয়া যায়।কিন্তু সব অবিশ্বাস্য লাগছে।
মুনা মুখ খুললো ক্রোধ নিয়ে।
“আপনি নাদিবের বাবা? মজা করছেন আমার সাথে? যে মানুষ টা এতগুলো বছর নিখোঁজ আপনি এখন তার নাম ধরে এসেছেন?
“হাহা,এই ছবিগুলো দেখো।
লোকটার ফোনের স্কিনে হাস্যজ্জল আদিবের সাথে তার বেশ কিছু ছবি দেখে মুনা শঙ্কিত হয়ে গেলো। কিভাবে সম্ভব এটা।
“আদিব আপনাকে চিনতো?
“হু,ও আমাকে খুজেছিলো অনেক, ওর মুখে শুনেছি।একদিন ভাগ্য মিলিয়েই দিলো কাজের সূত্রে। সেখান থেকে ও আমার সাথে সবসময়ই যোগাযোগ রেখেছে।সবার কথাই ইঞ্চি ইঞ্চি বলেছে।তোমার এত ডিটেইলসে বলেছে যে আমার খুজে পেতে কষ্ট হয়নি। ও চেয়েছিলো আমাকে সাথে নিয়েই ফিরতে।কত প্লানিং,কত গল্প,ওর মাকে আর নাদিব কে বিরাট সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলো, অথচ…
“অথচ ও নিজেই সবার জন্য একটা সারপ্রাইজ হয়ে ফিরলো,তাইনা?
“হু। আমি এখনো ভাবতে পারিনা আদিব এভাবে কয়েকঘন্টার ব্যাবধানে নাই হয়ে গেলো। মাত্র কয়েকঘন্টা পূর্বেই ও আমার সাথে কথা বলেছে।কয়েক ঘন্টা পরেই আমি এই দুহাতে ওর নিষ্প্রাণ দেহ টা পাই। স্পট ডেড।দুনিয়ার সবচেয়ে দূর্ভাগা পিতা আমিই হয়তো,এতবছর পর ছেলেকে পেয়েও হারিয়ে ফেললাম।
“ওহ,রিয়েলি? আপনার বুঝি খুব আফসোস হচ্ছে এখন? দুর্ভাগ্য তো তাদের, যারা বুঝ হবার পর পর ই আপনার স্নেহ থেকে বঞ্চিত হয়েছে।আফসোস তো তার,যে মানুষ টা স্বামী থাকা সত্ত্বেও এতগুলা বছর বিধবার মতন কাটিয়েছে। আপনার সাহস হলো কি করে আমার সামনে মুখ তুলে এসব বলার?
”
ভদ্রলোক হতবাক হয়ে গেলেন মুনার কথায়।মুনা কান্ডজ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে, কি বলছে কাকে বলছে হুশ নেই।
“শুনো মা।আমার উপর তোমার এই ক্রোধ জায়েজ। আমার ছেলেরা ও হয়তো আরো বেশি রিয়েক্ট করবে,তাই সাহস করে ওদের সামনে যাইনি।রেবার সামনে যাওয়ার ও মুখ নেই আমার।আমি তাই তোমাকে খুজেছিলাম,তুমিই পারো আমাকে হেল্প করতে।
“আপনাকে হেল্প করতে পারি আমি? আর আপনার কেনোই বা মনে হলো আমি আপনাকে হেল্প করবো?
“কারণ আদিব আমাকে বলেছিলো,আমাকে সাথে করে এনে তোমাকে দিয়ে ওর মাকে কনভিন্স করাবে।তোমার উপর ওর খুব ভরসা ছিলো।
“আদিব, আদিব।বারবার ওই মানুষ টার নাম কেনো নিচ্ছেন আপনি।আপনার মুখে এই নামটা বিষাক্ত লাগছে।এই মুহুর্তে আমার মনে হচ্ছে আপনার হাত আছে ওর মৃত্যুর পেছনে।সত্যি করে বলুন তো কি চেয়েছেন আপনি? আদিব আপনাকে খুজে বের করায় বুঝি খুব অসুবিধায় পড়ে গেছিলেন?
“মুনা এসব কি বলছো তুমি,তুমি কি পাগল হয়ে গেছো।ও আমার সন্তান।
“সন্তান! হ্যা,সন্তান বলেই ওই মানুষ টা শুধু আপনাকে খুজবে বলে ওই দূরদেশে পাড়ি জমায়।মায়ের বাধাও মানেনি।আপনার জন্য।বাবা না থাকার কষ্ট ভুলা যায়,আমি ভুলে আছি।কিন্তু বাবা থেকেও না থাকার কষ্ট টা একমাত্র আপনার দুই ছেলেই জানে।আপনার কারণেই মা আজ এত কষ্ট পাচ্ছেন ভেতরে ভেতরে।
“আমি সব জানি মা।আমি ওদের কাছে অপরাধী ই।এই মুখ নিয়ে তাই এত বছর ফিরতে চেয়েও পারিনি ফিরতে।
“ওহ প্লিজ এসব লেইম এক্সকিউজ দিবেননা।আমার অসহ্য লাগছে।উঠি আমি।
“আরেকটু বসো মা।আমার কথা আমাকে শেষ করতে দাও।তারপর যদি ইচ্ছে হয় হেল্প করিও।তোমার মর্জি।
মুনা বসে গেলো আবার।
“নাদিবের জন্মের কয়েকবছর পর ই আমি ফ্রান্সে আসি।তোমার শ্বাশুড়ি মানা করেছিলো যদিও।আমি ছেলেদের ভালো ভবিষ্যতের কথা ভেবে ওকে বুঝিয়ে নিই।ফ্রান্সে আসার পর মহা বিপাকে পড়লাম।কিছুতেই ব্যবসা গুছিয়ে উঠতে পারছিলাম না।এমন অবস্থা হলো যে এখানে আমার ভালো মত টিকে থাকাই দায়।দেশে খোজ রাখা,দায়িত্ব নেয়া ই কষ্ট সাধ্য প্রায়। তবুও গ্যাপ রেখে রেখে খবর নিতাম।তোমার শ্বাশুড়ি ভরসা দিতো।কিন্তু টাকার কাজ গল্পে সারেনা। এর মাঝেই আমার পরিচয় হয় এক মহিলার সাথে। ওখানকার ই।মোটামুটি বিত্তশালীই।আমার সমস্যার কথা জানার পর সব জেনেও আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিলো।আমি অবাক হয়েই নাকোচ করে দিলাম।কিন্তু বারবার ও আমাকে বুঝাচ্ছিলো যে বিয়ের পর দুজনে মিলে ব্যবসা টা দাড় করাবে।সমস্ত সাহায্য ও করবে।আমার ফ্যামিলিও উপকৃত হবে এতে। আমি কিছুদিন ভেবে উপায় না পেয়ে ভাবলাম তাই হোক।একবার ব্যাবসা টা দাঁড় করার পর রেবা কে বুঝিয়ে বলে দিবো।শুরুতে বললে ও কখনোই রাজি হতোনা।বলতো চলে আসতে।কিন্তু ওই অবস্থায় আমার ফ্যামিলির জন্য আমাকে কিছু করতেই হতো।আমি একসময় রাজি হলাম, বিয়ে করলাম।ব্যবসা উন্নতি ঘটালাম।দু বছরের মাঝে সব সেটেল করলাম।ভাবলাম এবার রেবাকে সব স্বীকার করবো।কিন্তু ভয় হচ্ছিলো ও এরপর আমাকে মানবে কিনা।তাই আজ না কাল করতে করতে সময় যাচ্ছিলো। এর মাঝে ব্যবসা বাড়ার সাথে সাথে ব্যস্ততা খুব বেড়েছে।ঠিকমতো বাড়ির সাথে যোগাযোগ করতেও হিমসিম খেতাম।ঠিক তখনি ওই ঘরে আমার একটা মেয়ে জন্ম নেয়।
মেয়েকে জন্ম দিতেই মা মারা যায়।যা ছিলো আনেক্সপেক্টেড।ও আমার জন্য সবটা করেছিলো,কখনো আমাকে আমার দেশের ফ্যামিলির জন্য কিছু করতে বাধা দেয়নি,বরং সাহায্য করেছিলো।ওর হঠাৎ মৃত্যুতে আমি দিশেহারা হয়ে যাই।তারউপর বাচ্চা মেয়েটার সমস্ত দায়িত্ব আমার উপর।আমার ভয় টা আরো বেড়ে গেলো। বুঝতে পারছিলাম না কি করবো।এভাবে আরো দু বছর গোপন করলাম।রেবাকেও কম সময় দেয়া হতো চারদিকের চাপে। দেশে আসতে বললেও অজুহাত দিতাম।এভাবে কথা কম হতে হতে আমাদের ভেতর দূরত্ব ঘনিয়ে আসে।মান অভিমান বাড়ে।ছেলেরা ও আমাকে পায়না।
এভাবে আর নিতে পারছিলাম না।একদিন রেবা সাফ জানিয়ে দিলো আমার টাকা সে নিবেনা।শুধুমাত্র টাকার জন্য সে আমাকে হারাতে চায়নি।হয় আমি দেশে আসবো,নয় ও আর টাকা নিবেনা,যোগাযোগ ও রাখবেনা।
ভদ্রলোক গম্ভীর হয়ে গেলেন এতটুক বলে।মুনা অবাক হয়েই যাচ্ছে।মানুষ এর সহজ সরল সুখী জীবনের পেছনের ইতিহাস টা কি করুণ হয়।আচ্ছা যদি এমন কোন সিস্টেম থাকতো যে প্রতিটা মানুষ এর অতীত চেহারায় আয়নার মত প্রতিচ্ছবি হয়ে দেখা যেতো,তবে ভুল বুঝাবুঝির জন্মই হতো না।
“এরপর আমি অনেক ভেবে সিদ্ধান্ত নিলাম,আমার পক্ষে রেবাকে ছাড়া সম্ভব না,আবার দেশে গেলেও এই মেয়ের দায়িত্ব এড়ানো সম্ভব না।আইনের কাছে বাধা আমি।গেলে তাকেও নিতে হবে।তাই বাধ্য হয়ে রেবাকে সব বললাম খুলে।
“তারমানে মা জানতেন এসব?
“হ্যাঁ।আমি চারবছর লুকিয়েছিলাম ওর থেকে।পরে জানিয়েছি সব।
“মা কি বললেন?
“এরকম পরিস্থিতিতে মানুষ যেমন আঘাত পায়,তেমনি আঘাত পেয়েছে সেও।আমি হাজার রকম যুক্তি দিয়েও তাকে মানাতে পারিনি।তার এক কথা,আমি লোভে পড়ে তাকে ঠকিয়েছি। একসময় আমি আকুতি করে বললাম,সব ঠিক হয়ে যাবে আগের মতই,শুধু যদি সে একবার এই বাচ্চা মেয়েটাকে নিজের করে নেয়।নিজের কাছে রাখে।কিন্তু সে স্বীকার হয়নি।ভীষণ অভিমান তার।অভিমান থেকেই সে রাজি হয়নি। এবং আমাকেও আসতে মানা করে।ওই মেয়ে নিয়ে আমি যেনো তার আর ছেলেদের সামনে না আসি এটাই তার চাওয়া ছিলো। সে চায়নি ছেলেরা আমার এসব ঘটনা জেনে ফেলুক।ঘৃনা করুক আমাকে। আমি যদি যোগাযোগ এর চেষ্টা করি তবে সে ছেলেদের নিয়ে অন্য কোথাও চলে যাবে বলেছে।আমি আর সাহস পাইনি বিশ্বাস করো।নিজেকে এতটাই অপরাধি লাগছিলো যে আর দেশেই ফিরিনি।অন্যান্যদের থেকে ওদের কিছু খোজ নিতাম শুধু।সামনে আসা আর হয়নি।
“এখন কেনো আসলেন তাহলে? আপনার কি মনে হয় এতবছর পর আপনাকে মেনে নিবে মা?
“না মুনা,আমি সেই দাবি নিয়ে আসিনি।আদিব যখন আমার সন্ধান পায় ও তোমার মতই আমাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।আমি সব স্বীকার করেছি।একসময় ও চুপ মেরে যায়।আমাকে তার মায়ের সামনে আনার জন্য জোর করে।আমি রাজি হচ্ছিলাম না,পরে এক শর্তেই রাজি হলাম।বললাম আমি শুধু ক্ষমা চাইতে যেতে পারি।বয়স বেড়েছে,এতবছর ধরে যে অপরাধের বোঝা নিয়ে ঘুরছি তার থেকে মুক্তি চাই।একমাত্র রেবার কাছে ক্ষমা চাইলেই হয়তো শান্তি পাবো,এই ভেবে সিদ্ধান্ত নিলাম ফিরবো।কিন্তু সব বদলে গেলো।আমার ছেলেটাও আমার থেকে দূরে সরে গেলো। দূর থেকে সেদিন নাদিব কে দেখেও সামনে যাওয়ার সাহস হয়নি আমার।এতটাই অযোগ্য আমি।
ভদ্রলোক অঝোরে কেঁদে চললেন।মুনা শক্ত হয়ে বসে রইলো।
“আমি কি করতে পারি আপনার জন্য তাহলে? মা এখন আপনাকে দেখলে অসুস্থ হয়ে পড়বেন।ওনি ভেতরে ভেতরে খুব ই দুর্বল।
“জানি আমি।তাও ভরসা করছি তোমাকে।তুমি কি পারোনা আমার ছেলে আর রেবার সামনে আমাকে নিয়ে যেতে একবার? আমি শুধু একবার ওদের কাছে ক্ষমা চেয়ে চলে যাবো।
নাদিবের কথা ভাবতেই মুনার গা শিউরে উঠলো। যা মেজাজের নাদিব,কি না কি করে সামনে পেলে নিজেই জানেনা।
“দেখুন আমার সাহস নেই এত। আমি আপনাকে সাহায্য করতে পারবোনা।তারচেয়ে বরং এতবছরের পুরানা ঘা টা নতুন করে মেলে না ধরাই ভালো। আপনি ফিরে যান।আমি আসি।
“এই নাও আমার কার্ড।সব শুনার পরেও যদি মনে হয় তুমি সাহায্য করতে পারো,তবে একবার কল দিও।আমি অল্পকিছুদিন আছি আর।
মুনা কার্ড নিয়ে ফিরে এলো। সারাপথ ওর মাথায় লাস্ট একঘন্টার কথাগুলো ঘুরছে।পরিস্থিতির কাছে মানুষ কতটা অসহায়।কে বলবে তার শ্বাশুড়ি এতটা অভিমান নিয়ে দূরে সরে ছিলেন এত বছর।উপর দিয়ে ভদ্রমহিলা কত পারফেক্ট।
কারো দুঃখই কম না।যার জায়গা থেকে সে বুঝে শুধু।
১৭.
সকাল থেকে নাদিবের কেমন অসহ্য লাগছে বলে বুঝাতে পারবেনা সে।শ্বাশুড়ি এত আদর যত্ন করছেন তবুও শুধু মুনা নেই বলে তার ভালো লাগছেনা কিছুই।মেয়েটার গায়ের গন্ধ ছাড়াই আজকাল থাকা মুশকিল।এই যে বাইরে যেতে হবে,নিত্যান্তই জরুরী বলে,ওখানে কিভাবে থাকবে তা ভাবতেই অসহায় লাগছে। রুমে শুয়ে শুয়ে মিরানের সাথে গেমস খেলছিলো নাদিব।তখনি মুনা আসলো।নাদিব যেনো স্বস্তি পেলো এবার।
মুনা আয়নার সামনে বসে পানি খাচ্ছিলো, নাদিব একমনে তাকিয়ে রইলো।
“এত দেরি হলো যে আজ?
“হয়ে যায় মাঝেমধ্যে। আপনি কিছু খেয়েছেন সকাল থেকে?
“খেতে খেতে তো উঠাই মুশকিল।এভাবে কদিন খেলে আমি আর আমি থাকবো না।
নাদিবের কথা শুনে মিরান হেসে উঠলো।
“ওই তুই হাসছিস কেন,যা মা কে বল খাবার দিতে,ক্ষিদে পেয়েছে।
“আচ্ছা।ভাইয়া ও খায়নি তোর জন্য।আমি যাই, বলি
মুনা চোখ বড় করে নাদিবের দিকে তাকালো,
“কি ব্যাপার, আপনি খান নি কেন?
“মাত্র কয়টা বাজে? তুমি ফ্রেশ হও,একসাথে খাবো।
“দেখুন এসব অভ্যেস মোটেই ভালো না।মাকে দেখাচ্ছেন তাইনা,কত দরদ আমার জন্য?
তাড়াতাড়ি উঠুন,আমি খাবার দিচ্ছি।
“দেখাতে যাবো কেন,দরদ যে কার কতটা তা মা এমনিই বুঝেন।
“হুহ,দরদের নমুনা তো দেখছিই।
“দেখানোর সুযোগ আর দিলে কই,একবার খালি দিয়েই দেখো।
“কি মিন মিন করছেন?
“কিছুনা,বউয়ের জন্য দরদ না থাকলে কার জন্য থাকবে বলো?
মুনা গাল বাকা করে কেটে পড়লো, হাসিও পাচ্ছে।অনেকদিন পর লোকটা বউ বললো।ভালো লাগে শুনতে।
..
খাওয়ার টেবিলে নাদিব বললো একটু পর রেডি হতে,বাসায় যাবে বিকেলেই।
মুনা এক কথায় না করে দিলো।আমি আজ যাবোই না,মাকে বলা আছে আমার,তিনি বলেছে থাকতে।
নাদিব তখন বললো,
“মুনা,আমাদের আজ ই যেতে হবে।আমার কিছু কাজ আছে এখান থেকে গিয়ে।
“তো আপনাকে আসতে কে বলেছে? আপনি যান আপনার কাজে,কি কাজ ওসব কি আমি বুঝিনা? সবাইকে খুব মিস করছেন তাইনা? স্পেশালি ইরাকে? বলেই মুনা আড়চোখে তাকালো,
নাদিব নিজেকে সংযত করে উত্তর দিলো।
“মুনা,আমাকে জরুরী কাজে বাইরে যেতে হবে। তার জন্যই আমাদের যেতে হবে।
মুনার গলা দিয়ে আর কিছু নামছে না।হাত তুলে নিরবে বসে রইলো সে।মনে হচ্ছে কেউ তার গলা টিপে ধরেছে।
আড়াল থেকে মেহেরনূর শুনে এসে জিজ্ঞেস করলেন।
“হঠাৎ বাইরে কেনো বাবা।তুমি তো শুনেছি একেবারেই এসেছো।
“আসলে সেটা তখন মাকে বুঝাতেই বলা।আমার ওখানকার প্রজেক্ট এর কাজ বাকি মা।তাই যেতে হচ্ছে।
“কিন্তু.. কয়দিন থাকবে তুমি?
“তা জানিনা।এক বছর ও লাগতে পারে,আবার তার বেশি ও।কাজ তো কাজ ই।
“কখন যাবে তুমি? বিয়ে হলো মাত্র দুমাস,এখনি তুমি যাচ্ছো।
“যেতে যে হচ্ছেই মা,কি করি বলুন।পরসু হয়তো বের হবো আমি।
মুনা প্লেট সরিয়ে উঠে চলে এলো। এতক্ষণ সে চুপ ছিলো। নাদিব আর মা তাকিয়ে রইলো। ভেতরে ভেতরে নাদিব অবাক হলো। সে ভেবে পাচ্ছেনা মুনা কি রাগ করলো এজন্য নাকি খুশি হলো।
…
মুনা অনেক্ষণ ধরে তাদের পুকুর ঘাটে বসে রইলো। মাথার উপর গাছের ফাক দিয়ে উঁকি মারা রোদ প্রহার চালাচ্ছে।যেরকম প্রহার চলছে মনের উপর।এক আক্ষেপ কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই কেনো আরেকটা আক্ষেপ এসে জড়ো হয়।সময় কেনো তাকে একটু গুছিয়ে ওঠার সময় দিচ্ছেনা।সে কি কখনোই নিজেকে গুছিয়ে তোলার সময় পাবেনা।নিজের সংসার,স্বামী, ভবিষ্যত এর স্বপ্ন, কিছুই তো নতুন করে গুছানো হলোনা।এর জন্য কি সে নিজেই দায়ী তবে।তার জন্যই কি নাদিব রাগ করে সরে যাচ্ছে তবে?
ভীষণ রাগে জেদে দুচোখ ভিজে এলো। বুকের ভেতর টা ভারি হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ।লোকটার কি কোনো আক্কেল নেই,কিভাবে সে বিয়ের দু মাসের মাথায় আমাকে এভাবে ছেড়ে চলে যাচ্ছে।আমি নাহয় রাগ করে সরিয়ে দিয়েছি,কিন্তু সেও তো জোর করে রাগ ভাঙায় নি।সব কি আমার দায়? তাও কখন ফিরবে তাও জানেনা।এক বছর,দু বছর? কম সময়? এই দুমাসে একটা দিন ও তো তাকে ছাড়া থাকাই হয়নি,তাহলে কিভাবে বুঝবো আমার কত কষ্ট হবে? খুব বেশিই? আমি যদি সহ্য করতে না পারি,তবে?
কাঁদতে কাঁদতে চোখ মুখ ফুলে গেছে।বুকের ভেতর কত রকমের ভয় এসে মুছড়াচ্ছে।আজ শ্বশুরের সাথে কথাগুলো বারবার মনে পড়ছে। ওর শ্বশুর বিদেশ গিয়ে আর ফিরেনি,আদিব ও ফিরেনি,এখন যদি নাদিব..
আর কিছু ভাবতে পারছেনা মুনা।নাদিব যদি ওর ওপর রাগ করে আর না ফিরে।ওর তো আর কিছুই নেই নাদিব ছাড়া।এটুক হারালে বাঁচা যায়না আর।মুনা হাত মুখ ধুয়ে বিধ্বস্ত চেহারায় ঘরে ঢুকলো। অনেক্ষণ হয়ে গেছে, বেলা পড়ে যাচ্ছে।নাদিব মুনাকে না একাই হেলান দিয়ে শুয়ে আছে। মুনা ওর সামনে যেতে চায়না এখন।ধরা পড়ে যাবে তাহলে।লোকটার যদি ওর জন্য এতই টান তবে যতই কাজ হোক, যেতো না ওকে ফেলে।
মায়ের ঘরে গিয়ে মায়ের পাশে শুয়ে গেলো মুনা।মেয়েকে চুপচাপ দেখে মা মাথায় হাত বুলাতে লাগলেন।
“জামাই তোকে খুজছিলো,কোথায় ছিলি।
“খুঁজুক।
“আচ্ছা,আমি কি জামাইকে জিজ্ঞেস করবো তোকে সাথে নিতে পারবে কিনা?
মুনা উঠে বসে গেলো।
“মানে কি মা,কি বকতেছো এসব?
“বিয়ের পর তো কোথাও ঘুরতেও গেলিনা।এ উছিলায় ঘুরা ও হবে।দুজনের মন ও ভালো থাকবে।
“তুমি বেশিই ভাবো। আমি এমনিই ভালো থাকবো।সে সেখানে কাজে যাচ্ছে,আমি কি করবো।
“মুনা,আমি কি বুঝিনা তুই কেমন নারাজ এতে? জামাই যে খুব খুশি মনে যাচ্ছে তাও না।বয়স হয়েছে,সংসার করেছি।এসব বুঝি আমি।
“আমি কেন নারাজ হবো।যাক সে,যার ভালো নিয়ে তার ই মাথাব্যথা নেই,তুমি কেন হুশ করাবে। তাছাড়া সামনের সপ্তাহ থেকে আমার পরীক্ষা।আমরা সকালেই চলে যাবো। প্লিজ ততক্ষণে উল্টো পাল্টা কিছু বলোনা।
মেহেরনূর মেয়ের জেদ দেখে হাসলেন।মুনা একবার ভাবলো মা কে শ্বশুরের ঘটনা টা বলবে,কিন্তু পরে ভাবলো ওর শ্বাশুড়ির সম্মানে লাগবে ব্যাপার টা।শত হলেও ওটাই ওর সংসার এখন।কিছু ব্যাপার গোপন থাকাই ভালো। সন্ধ্যে হতেই মুনাকে নিয়ে মা নাস্তা বানাতে গেলো। মুনার মন বসছেনা কিছুতেই।
১৮.
নাদিব ঘরে অনেক্ষণ অব্দি বোর হচ্ছিলো, মুনাকে খুজেও পায়নি।ভেবেছিলো সব মুনাকে খুলে বলবে।কিন্তু মেয়েটা তখন এভাবে চলে গেল যে আর আসেইনি।নাদিব বসে থাকতে থাকতেই ঘুমিয়ে গেলো।
মুনা চা হাতে রুমে এসে লাইট জ্বালালো।যদিও ভয় করছিলো নাদিবের চোখাচোখি হতে।চা রেখে নাদিবের গায়ে হাত দিয়ে ডাকলো,
“এইযে,উঠুন।সন্ধ্যে হয়ে গেছে।
নাদিব জেগে উঠতেই মুনা চা পাশে রেখে বের হয়ে যাচ্ছিলো।
তখনি নাদিব হাত ধরে ফেললো,
“বসো এখানে,
“হু
“পালিয়ে বেড়াচ্ছো কেন? বাসায় যেতে চাওনা এখন?
“কাল সকালে যাবো।তাই
“তাই বলে উদাও হয়ে যাবে? আমি সারাবিকেল একা একা বোর হচ্ছি যে খেয়াল আছে আপনার?
“আপনি একা একা বোর হন? জানতাম না।
“একা একা না ঠিক।তুমি আশেপাশে না থাকলেই হয় এমন।
“মানুষ এর মন রক্ষা করা কবে শিখলেন?
“হাহা,ওসব আমাকে দিয়ে হবেনা
হয়েছেই তো,মায়ের মন রক্ষা করতে বিয়ে করেছেন,আমাকে উদ্ধার করেছেন।এখন আবার দায়িত্বের বোঝা এড়াতে পালিয়ে যাচ্ছেন দূরে।
” ওরে বাবারে,আপনি দেখি আরো এক ধাপ এগিয়েছেন বেশি বুঝায়।
“তাই? এইযে বাইরে যাচ্ছেন সেখানে তো ঠিক ই থাকবেন একা।দিব্যি চলবেন আমাকে ছাড়া।বরং এটা বলুন,নিশ্চিন্তে থাকবেন এটা ভেবে যে,আমি নেই।
“ওহ আচ্ছা,এত সব তাহলে ভাবা হয়ে গেছে আপনার? তা আর কি কি ভেবেছেন?
“কিচ্ছুনা।চা খান।
“কেঁদেছো কেনো?
“মুনা চমকে উঠলো, আমি কাঁদবো কেনো।
“তো কি করেছো? চোখ এর কি অবস্থা আয়নায় দেখো।
“যাই হোক,আপনার এত দেখা লাগবে না।নিজের কাজ করুন।আপনি কি একাই যাচ্ছেন?
“হুম,আর কেউ কি যাওয়ার কথা নাকি।
“গেলেও কি আমি জানবো নাকি।তাহলে একবছর খুব ভালোই কাটাবেন।
“এক বছর?
“কেন,আরো বেশি? মাকে যে এক বছর বললেন।
“ওহ, হ্যা হ্যা।বলেছিলাম।তবে তুমি না চাইলে এক বছর কেন,কখনো আমি আর ফিরবো না।
মুনা মুখ তুলে তাকালো,চেহারায় আগুন বের হচ্ছে।শ্যামলা মেয়েদের খেয়াল করলে দেখবেন এরা রাগলে গোলাপি বা লাল বর্ণ ধারণ করেনা খুব একটা ।অদ্ভুত এক লাল নীল আভা তৈরি হয় রঙ এর। নাদিব ভীষণ মজা নিয়ে সেটা উপভোগ করছে।
মুনা উঠে দাড়ালো, নাদিবের হাত থেকে চায়ের কাপ টা চোখের পলকে মেঝের উপর আছাড় মারলো।দরজা টা ধড়াম করে মেরে বারান্দায় চলে এলো। কানে ইয়ারফোন গুজে বসে রইলো সে।
নাদিব ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বসে রইলো। আকস্মিক যা ঘটলো তাতে নাদিবের প্রচন্ড হাসি পাচ্ছে আবার ভয় ও পাচ্ছে।কাছে যাওয়াই যাবেনা এখন মুনার।এত রাগ মুনার এর আগে দেখলেও এতটা তীব্র ভাবে দেখেনি সে।কেমন এক হিংস্র ভালোলাগা আর শান্তি পাচ্ছে নাদিব।এখন শুধু কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পালা,যতক্ষণ না স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসে।
চলবে…