#তোমাতে
লেখনীতে~আগ্নেস মার্টেল
/পর্ব ৯/
“এরকম মজা করবা কেন? আমার বুদ্ধি কম বলতে চাইছ?”
নিসা এবার মুখ কাচুমাচু করে আমার দিকে তাকায়। বলে, “ঝুম মা ডাকছে। আসি।”
মেয়েটা একপ্রকার দৌড়ে পালায়। জিসান ভাইকে আলতো হাতে মেরে সশব্দে হাসতে থাকি।
“আস্তে। মানুষ তাকাচ্ছে।”
মুখে হাত দিয়ে ঢেকে ফেলি। তবু হাসির ঝাকিতে দুলতে থাকি। তিনি বলেন, “হাসি শেষ হলে দ্রুত উঠে পর। নেহা আপু তোকে দেখতে চায়।”
ধাতস্থ হয়ে, “ভাইয়া নিয়ে যেতে বলেছে?”
“হ্যা।”
বাইকে চড়ে বসি। বাইক চলতে শুরু করে। জিসান ভাইয়ের পিঠে একহাতে খোচা মারি।
“কি হয়েছে তোর? খোচা মারিস কেন?”
আমতা আমতা করে বলি, “আপনার পার্ফিউমের ঘ্রাণ অনেক সুন্দর।”
তিনি উত্তর দেন না। আবার উসখুস করতে থাকি। আরেকবার খোচা মারি। তিনি ত্যক্ত কণ্ঠে বলেন, “আবার কি?”
“না মানে হয়েছে কি? আপনাকে দুহাতে ধরি?”
তিনি এবারও উত্তর দিলেন না। তবে কি ধরতে মানা করছেন? গাল ফুলিয়ে কিছুক্ষণ এক অবস্থায় বসে থেকে দুহাতে জড়িয়ে ধরি। বলি, “অতিরিক্ত ভাব নেন আপনি।”
“যে পূজার যে ফুল!”
আমি ঠোঁট টিপে হাসি। দ্রুত বেগে পাশ কাটানো হাওয়ারা যেন ফিসফিসিয়ে যায়। জাহির করে যায় ওদের হিংসুটে আক্ষেপ। তাতে বুকে পাক খায় সুখব্যাথা। ভাল লাগার কয়েকশ প্রজাপতি মনের মধ্যে উড়তে থাকে। তোতাপাখিটা ডানা ঝাপ্টায়। তাতে আরও একবার ভাল লাগায় মোহাবিষ্ট হই। এই মানুষটা আমার। একান্তই আমার।
নেহা আপু হাসিমাখা মুখে ভ্রু নাচায়, বলে, “তো তুমিই আমার ভাইয়ের হৃদয়হরণকারী?”
টেবিলের কাছে এসে দাঁড়িয়ে যাই। একবার আশপাশে তাকাই। ভাইয়া কাছেপিঠে নেই। আপু হয়ত ভুল বলেছে। মৃদু হাসিতে মাথা নাড়ি। বলি, “না আমি তোমার হৃদয় হরণকারীর দুইমাত্র বোন।”
আপু সশব্দে হাসে। পাশের চেয়ার থেকে নিজের ব্যাগটা সরায়। বলে, “এদিকে আসো।”
চেয়ারটায় এসে বসি। ফাইলটা টেবিলে রেখে গা এলাই। আপু এক কনুইয়ে ভর রেখে এদিক তাকায়। বলে, “ছোটবেলায় আমার একটা শাড়ি পড়ুয়া পুতুল ছিল। চিকন গড়নের। মাথায় হয়ত হাড়ি নেয়া। তুমি দেখতে ঠিক সেরকম। কি মিষ্টি!”
লজ্জারাঙা হাসি। জিসান ভাই ওপরদিকে বসে শার্টের ওপরে দুবোতাম খুলেন। হেলান দিয়ে বলেন, “সাদ ভাই কই রে?”
“অফিসের কল এসেছে। কোথাও দাঁড়িয়ে কথা বলছে হয়ত।”
“ও।” দৃষ্টি আমার ওপর পরে। বলেন, “কি? এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন?”
আপুও তাকাল। বললাম, “আপনারা এত ক্লোজ?”
“তো ক্লোজ হব না? কাজিন হই!”
বিস্মিত হয়ে গেলাম। চোখ পিটপিট করে দেখতে শুরু করলাম ওদের। ভেতরে পাক খেল রাগের হলকা। আপু না থাকলে নির্ঘাত ঝাপিয়ে পরতাম জিসান ভাইয়ের ওপর। নখের আঁচড়ে, কামড়ে রাগের ঝাঝ মিটাতাম। আপু বিস্মিত কণ্ঠে বলে, “তোরা আপনি আপনি করে সম্বোধন করিস?”
“না। শুধু ও করে।”
আপু আমার দিকে চোখ ফেরায়, বলে, “তোমাকে ও তুমি বলতে বলেনি?”
শান্ত চেহেরায় অসম্মতি দেই। আপু বলে, “বলিসনি কেন?”
“অভ্যাস হয়ে গেছে আপনি শুনতে শুনতে। তুমি বললে আদিখ্যেতা লাগবে!”
“আশ্চর্য!”
সাদ ভাইয়া এসময় টেবিলের দিকে আসে। ওদের আলোচনা থেমে যায়। জিসান ভাই কর্ণারের চেয়ারে চলে যান। ভাইয়া আমার সামনাসামনি বসে। জিজ্ঞেস করে, “মুখ এমন করে রেখেছিস কেন? পরিক্ষা ভাল হয়নি?”
মাথা নেড়ে সম্মতি দেই। ভাইয়ার চিন্তিত প্রশ্ন আসে, “পাশ মার্ক উঠবে না?”
বিরক্তচোখে ভাইয়ার দিকে তাকাই। জবাব দিতে ইচ্ছে করছে না। এদিকে ভাইয়া সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে অপেক্ষা করছে। জিসান ভাই বিরক্ত হন। বলেন, “ভাই চিন্তা করছ শুধু শুধু। ওর পরিক্ষা ভালই হয়েছে।”
“মাথা নাড়ল যে?”
“এমনি। আমি মিলিয়েছি ওর প্রশ্ন। পরিক্ষা খারাপ হয়নি!”
রেস্টুরেন্টে থাকা পুরো সময় ওরা গল্প, আড্ডায় মশগুল থাকল। আমি চুপ করে শুধু তাকিয়ে ছিলাম। জিসান ভাই কয়েকবার তাকিয়ে ছিলেন। একসময় ভ্রু’ও নাচিয়ে ছিলেন। বিরক্ত হয়ে চোখ সরিয়ে ফেলি! খাওয়া শেষে সবাই উঠে দাঁড়ায়। নেহা আপু আমার গাল টেনে বলে, “তোমার বোধ হয় আমাকে শাফির কাজিন মানতে কষ্ট হচ্ছে।”
সৌজন্যমূলক হেসে দ্রুত মাথা নাড়ি। বলি, “তা কেন হবে? আমার খুব দ্রুত মুড সুয়িং হয়।”
আপু আর ঘাটাল না। ভাইয়ার সাথে গাড়িতে করে চলে গেল। বাইকের পাশে দাঁড়িয়ে সেদিকে তাকিয়ে ছিলাম। বেণিতে টান পরে। মাথায় একহাত রেখে পেছন ফিরি।
“কি হয়েছে তোর? তখন থেকে মুখটা অমন ভুতের মতো করে রেখেছিস কেন?”
“কিছু না। রিকশা ডাকুন।”
“মানে? কিসের জন্য?”
“আমি বাসায় যাব।”
“আমার বাইক আছে কি করতে?”
“সেটা আপনি জানবেন!”
বিরক্তিতে ভ্রু কুচকান। বলেন, “সমস্যা কি তোর হুট করে এমন আজব ব্যবহার করছিস কেন? মন চাইছে তিন চারটা চড় মেরে বসিয়ে রাখি।”
জ্বলন্ত চোখে উনার দিকে তাকাই। উনার চোখে মাত্রাতিরিক্ত বিরক্তি। বলেন, “বেহুদা ঢং না করে সমস্যা বল।”
তেড়ে গিয়ে, “নেহা আপু আপনার কাজিন আগে জানাননি কেন? আপনি আমার ব্যাপারে সবই জানেন। অথচ আমি আপনার কিছুই জানি না। আপনি আপনার কলেজে যোগও দিয়ে ফেলছেন। এটাও জানতাম না। জানানোর প্রয়োজনও বোধ করেননি! সেদিনও তো বলতে পারতেন বলেননি কেন? ইফাজ ঐদিন মেসেজে বলল আপনি নাকি বলেছেন আমি নিরামিষ? অনুভূতি প্রতিবন্ধী বলা যায়! এইসব কি হ্যা?” তিনি থ হয়ে তাকিয়ে আছেন। আমার দৃষ্টি আরও সুচালো হয়, “সকালের ঐ মেন্দিও আপনার কাজিন টাজিন নয় তো? কি আপনি হ্যা? আপনাদের কাজিনেই দেখি বাংলাদেশ ভরে গেছে! তিন ভাইবোন রিলেশন করি। সব আপনার লতানো পাতানো ভাই বোন!”
তিনি হাসতে থাকেন। ধমকে উঠি, “একদম হাসবেন না!”
তিনি হাসি থামান না। বলেন, “আমার কাজিন তোর ভাই-বোনের সাথে রিলেশন করে এতে এত অভিযোগ? তাছাড়া মেহেদি আমার কাজিন না। স্কুল লাইফের বন্ধু। আচ্ছা কতদিনের এই অভিযোগগুলো?”
আমি গাল ফুলিয়ে চুপ থাকি। তিনি মুখ বাড়িয়ে একবার তাকালেন। বললেন, “রাগ কি খুব বেশি?”
“না, একটুকও না। বাড়ি যাব। রিকশা ডাকুন।”
“এগুলোতে রাগার কি হলো?”
“সমস্যা! আপনি আমাকে আপনার ব্যাপারে কোন কিছু শেয়ার করেন না। জয়েন করেছেন বললে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যেত? আর এই ছোট ছোট ব্যাপারগুলো বললে কি হয়?”
“হয়েছে আর রাগিস না। তুই তো জানিস তুই সামনে থাকলে আমার সাজানো সব এলোমেলো হয়ে যায়। আমি ভুলে যাই কি ভেবে রেখেছিলাম। চিন্তায় জট পাকাই।”
আমি তবু থমথমে মুখে দাঁড়িয়ে থাকি। তিনি বাইকে উঠে বসেন। বলেন, “রাগ কমা না। আর রাগতে হবে না।”
শক্তমুখে উনার দিকে তাকাই। তিনি বাইকের পেছনে বসতে ইশারা করেন। ফাইলটা বাইরের পেছনে আটকে দেই। জিসান ভাইয়ের কাছে গিয়ে ডান হাতটা টেনে নিলাম। কাল বিলম্ব না করে সর্বশক্তিতে কামড় বসালাম। তিনি ব্যাথাদায়ক শব্দ করেননি। আড়চোখে একবার তাকাই। চোখও রাঙালেন না। বরং শান্ত মুখভঙ্গিতে হাতটা ঝারতে থাকেন। বলেন, “এবার উঠ।”
রাত তখন। পড়া শেষ। ক্লান্ত হয়ে ফোন হাতে বিছানায় সুয়েছি। নোটিফিকেশন বারে জিসান ভাইয়ের বেশ কয়েক মিসড কল শো করছে। কিছু মেসেজও। মেসেজগুলো পড়ে মন কিছু গলল। কিছুক্ষণ পর উনার কল এল। ধরলাম। ওপাশ থেকে তিনি হ্যালো বলেন। আমি নিরুত্তর। তিনিও আর কথা বলেন না একসময় গিটারের সুর ভেসে আসতে থাকে। আমি দ্রুত উঠে বসি। চারপাশে চোখ বুলিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে থেকে ইয়ারফোনটা তুলে নেই। কানেক্ট করে চুপ করে থাকি। পুরুষালী কণ্ঠে গান আসে,
“সুন্দরী গো দোহাই দোহাই
মান করো না…”
আবেশে কান্না আসে। উনার মাদকতা মাখা ঐ সুর যতবার কানে আসছে ততবার নিজেকে খুব বিশেষ কেউ মনে হচ্ছে। অবশ্যই আমি বিশেষ কেউ। মধ্যরাতে যার প্রেমিক তার প্রেমিকার রাগ ভাঙাতে মোহময় কণ্ঠে সুর তুলে সে কি বিশেষ হবে না? উনার কণ্ঠের মোলায়েম স্বরে নিজেকে সবোর্চ্চ সুখী মনে হয়। মনে হয় প্রাপ্তির সম্পূর্ণ ঘটটাই যেন পূর্ণ। একসময় গান শেষ হয়। তিনি ক্লান্তকণ্ঠে জিজ্ঞেস করেন, “সুন্দরীর রাগ কি ভেঙেছে?” প্রতিউত্তরে খিলখিলিয়ে হাসি। নিজেরই মনে হলো হাসিটা একজন পূর্ণাঙ্গ সুখী মানুষের।
একে একে সব পরিক্ষা শেষ হয়। ভেবেছিলাম পরিক্ষা শেষে অফুরন্ত সময়। এটা করব। ওটা করব। সময় পরিকল্পনা ভেস্তে গেল। পরিক্ষার পর দেখি আরও বেশি পড়তে হয়। তবে আমাদের দেখা সাক্ষাতে পরিক্ষার সময়ের দুরবস্থা আর হয় না। কখনো ছাদে, কখনো বারান্দায় গল্প করে প্রায় সম্পূর্ণ রাত কাটিয়ে দেই। তিনি কখনো গান শোনান। কখনো সারাদিনের আক্ষেপ। আজকেও পড়ছিলাম তখনো দশটাই বাজেনি। বারান্দায় ধুপ করে শব্দ হলো। চেয়ার পিছিয়ে মুখ বারিয়ে তাকাই। জিসান ভাই হাত-পা ঝারতে ঝারতে রুমে আসেন। বলেন, “এখনো পড়ছিস?”
আমি ঘড়ি দেখাই, “আজকে এত আগে এসেছেন কেন?”
তিনি মধুর হাসেন। বলেন, “বারোটা পর্যন্ত মন টিকছিল না।”
বই বন্ধ করে সম্পূর্ণ চেয়ারটাই উনার দিকে ফেরালাম। বললাম, “আচ্ছা আপনি বেঁচে আছেন কিভাবে?”
“কেন?”
“আমি নাহয় রাত জাগার ধাক্কা সামলে নেই বেলা অবদি ঘুমিয়ে আপনি? প্রতিদিন রাত জেগে বেঁচে আছেন কিভাবে?”
দাঁতালো হাসেন, “কালকে আমার নাইট ডিউটি। তাছাড়া প্রতিদিন কই? দুই তিনদিন পরপর আসি।”
মাথা হালকা চাপড়ালাম। বলেন, “বই নিয়ে এদিকে এসে বস। আমি তোর কোলে মাথা রাখি। দরজাটা বন্ধ না?”
সম্মতি দিলাম। বললাম, “বই নিয়ে আর কি হবে? মনোযোগ আসবে না।”
“আসবে চেষ্টা কর। প্রথম প্রথম কষ্ট হবে। পরে অভ্যাস হয়ে যাবে। তখন সন্ধ্যে হলেই ছুটে আসব।”
আমি মৃদু হাসলাম। বই ছাড়াই খাটে গিয়ে বসলাম। তিনি কোলে মাথা রাখেন। ওপরে তাকিয়ে বলেন, “আমি তোকে খুব বিরক্ত করি তাই না? আমার তোকে এই সময়গুলোই বিরক্ত করা উচিত নয়। আদর্শ বয়ফ্রেন্ডের মতো তোকে আরও মেরে মেরে পড়ানো উচিত।”
উনার এই সুমতিতে নিরুত্তর উনার দিকে তাকিয়ে থাকি। আলতো হাতে ঝাকরা চুলগুলোর ভাজে ভাজে আঙুল ঢোকাই। তিনি কপালে ভাজ ফেলে কিছুক্ষণ ভাবেন। সরল মুখভঙ্গিটা ভাবনায় বদলে যায়। কপালে ভাজ পরে। মুখ বেকিয়ে বলেন, “ধুর ওদের যে আদর্শ বলা হয় ওসব কিছু না! সব বুজরুকি! নিজের প্রেমিকাকে পড়াতে পড়াতে প্রতিবন্ধী বানানোর ধান্ধা!”
আমি হাসতে থাকি, “আপনি না পারলেই সব বুজরুকি হয়ে যায়!”
“মোটেও না। তুই একবার ভাব তুই সারাদিন গাধার মতো পড়ছিস। রাতেও গাধার মতো পড়বি। তোর রেস্ট লাগবে না? আমিও যদি এসে তোকে খাটাই পরে সত্যি সত্যি প্রতিবন্ধী হবি!”
ঠোঁট টিপে চুপ থাকি। বলি, “প্রতিদিন দিনের বেলা দেখা করলে হয় না?”
তিনি ভ্রু কুচকে তাকান, “রাতে যেন না আসি এটাই চাইছিস তুই?”
উত্তর দিতে পারি না। উনি এত অবুঝ কেন বুঝি না! এই যে কোলে ঘুমিয়ে আছেন। উনার দিকে তাকালেই উনার সুদর্শন মার্কা চেহেরা আমাকে প্রলুব্ধ করছে। ইচ্ছে করে উনার
“তোদের রুমে আরেকটা বেড এনে রাখবি তো।”
“কেন?”
“আমি এসে ঘুমাব। তোকে দেখলেই ঘুমঘুম পায়। মন চায় ঝাপ্টে ধরে ঘুমিয়ে থাকি। অবশ্য আমার সবসময়ই মন চায় তোকে ঝাপ্টে ধরে নিজের কাছে রাখতে। মনে হয় আমাদের দেহ কেন জুড়ে দেয়া হলো না উপর থেকে! রেয়ার যারা জন্মগ্রহণ করে ওদের মতো হয়ে আমরা কেন পৃথিবীতে আসলাম না?”
আমি থ হয়ে তাকিয়ে থাকি, বলি, “তাহলে তো আমরা ভাই-বোন হয়ে যেতাম! একই মায়ের পেট থেকে বেরোতাম।”
জিসান ভাই কিছুক্ষণ ভ্রু কুচকে রইলেন। ব্যাপারটাকে সম্পূর্ণ উড়িয়ে চরম বিরক্তিতে বললেন, “তোর সবসময়ই উল্টাপাল্টা চিন্তা। আমরা ভাই-বোন হতে যাব কেন! শরীর জুড়ে দেয়া থাকত শুধু। উপর থেকে একবারে সেট করা। আমরা পৃথিবীতে আসতামই জামাই-বউ হয়ে। তোর মা আলাদা থাকত, আমার মা আলাদা থাকত। কিন্তু উপর থেকে তিনি আমাদের এক করে পাঠাতেন!”
আমি হতবাক হয়ে উনার দিকে তাকিয়ে থাকি। তিনি সত্যিকার অর্থে কোনটার যুক্তি দিলেন এই মাত্র?#তোমাতে
লেখনীতে~আগ্নেস মার্টেল
/পর্ব ১০/
বাসার পরিবেশটা আজ উৎসবমুখর। ভাইয়া দুপুরের পর অফিস ছুটি নিয়ে কেজি কেজি মিষ্টি এনেছে। আপু সেগুলোর গোটা কয়েক আমাকে জোর করে গিলিয়েছে। সাথে মাথায় কয়েক গাট্টা মেরে বলেছে, “মান রাখলি তাহলে! আমি তো ভাবলাম রেজাল্ট ভাল করলেও মেডিক্যালে চান্স পাবি না!”
মুখ মুছে রেগে তাকাই। আপু আরও ঠেসে কয়েক মিষ্টি খাওয়ায়। বিরক্তিতে কয়েক কিল ঘুষি বসালাম। আপু সেগুলোকে উড়িয়ে চলে গেল নিজ রুমে। উৎসবমুখর হওয়ার আরেকটা কারন মামাদের পরিবার। লস এঞ্জেলস থেকে রওনা হয়েছেন। রেনু খালার এখন একবিন্দু স্থিরতা নেই। এখানে ওখানে ছুটোছুটি করছেন, রান্না বান্নার ঝক্কিঝামেলা একাহাতে সামলাচ্ছেন। ভাইয়া মিষ্টি বিলাতে ব্যস্ত। ফোন চেক করলাম। কল আসেনি। উনার ফোনটাও বারবার ব্যস্ত বলছে। তিনি একবার শুধু শুভেচ্ছা মেসেজ করেছেন। ফোন করেননি। আজকাল ভীষণ ব্যস্ত তিনি। প্রায়ই ফোন করে শুনি তিনি অটিতে যাচ্ছেন। নয়ত মাত্র বেরলেন। মনে হল জিসান ভাইদের বাসায় গিয়ে বলে আসি। ভাইয়া হয়ত বলেছে! নিজে আবার বলতে দোষ কি?
আন্টি যত্ন করে বাসায় বসালেন। আঙ্কেল ছিলেন। মানুষটা হাসোজ্জ্বল। কুশলাদি শেষে খোজ খবর নিলেন। শুভেচ্ছা জানিয়ে হেলতে দুলতে রুমে চলে গেলেন। রুমের দিকে উঁকিঝুকি দিয়ে জিজ্ঞেস করি, “শিফা বাসায় নেই আন্টি?”
আন্টি কিছু শুষ্ক খাবার এনে হাতে দেন, “না মা। ওর এখন কোচিং হয়!”
বুঝদারের মতো মাথা নাড়ি। গল্প করতে করতে আন্টি একসময় বলেন উনারা বাসা চেঞ্জ করবেন! আমার মাথায় বাজ! হতবাক আমার ব্যাপারটা বুঝতে বেশ সময় লাগল। প্রায় হাহাকার করার মতো জিজ্ঞেস করি, “কেন?”
আন্টি স্নিগ্ধ হাসেন। গাল টিপে দেন। আন্তরিক কণ্ঠে বলেন, “জিসানের এখান থেকে যাওয়া আসায় সমস্যা হয়। ধকল পরে বেশি। তাছাড়া তোমার আঙ্কেল রিটায়ার নিয়েছে। ও চাচ্ছে গ্রামে চলে যেতে।”
বুকের ভেতর আর্তনাদের বিক্ষুব্ধ গর্জন শুরু হয়। তীব্র ভয়ে নিজেকে খাপছাড়া পাগল পাগল মনে হতে থাকে। ভয়ার্ত সে ভাব আন্টি যেন না বুঝেন তাই মাথা নিচু করি। ম্লান কণ্ঠে বলি, “শিফা? ওর সমস্যা হবে না?”
“ওকে ওর কলেজ হোস্টেলে রাখব। কষ্ট না করলে জীবনে কিছু শেখা যায়?”
গল্প আর জমে না। আমি একসময় বাহানা দেখিয়ে উঠে পরি। নিষ্প্রাণ পায়ে সিড়ি বেয়ে নেমে আসি। রুমে এসে কিছুক্ষণ পড়ার টেবিলে বসে রইলাম। মন টিকল না। গাল ফুলিয়ে রুমের জানলার পর্দা টেনে দিলাম। বিছানায় এসে বালিশ জড়িয়ে বসে পরি। অনুভূতিদের গোমট দমবন্ধ অবস্থায় একা যুদ্ধ করতে থাকি। এত খুশির খবর উনাকে বলে বাড়াতে না পেরে কান্না পাচ্ছে। আর ঐ খবরটা! আগ বাড়িয়ে না গেলেই হয়ত ভাল হত। রুমটা পুরো অন্ধকার। কানে ইয়ারফোন গুজি। দেয়ালে হেলান দেই। গান শুনতে থাকি। সবগুলোই উনার গাওয়া। ভিন্ন ভিন্ন সময়ে পাঠানো। কখনো আবদারে পাঠিয়েছেন, কখনো অভিমান ভাঙাতে। কিছু ভয়েস মেসেজ, কিছু রেকর্ডিং। দেয়ালে হেলান দিয়ে দীর্ঘ এক শ্বাস ফেলি। মুগ্ধকর কণ্ঠের আবেশে চোখের কোল ছাপিয়ে তপ্ত ফোটারা গাল গড়ায়।
সন্ধ্যে নাগাদ আমাদের কলিং বেল বেজে উঠে। আমি তখন উদাসমুখে সোফায় বসে। টিভিতে মুভি দেখছি। আশপাশে কাউকে না দেখে নিজে উঠে গেলাম। দরজা খুলে চিৎকার করে উঠি! এতদিন পর প্রিয় মুখগুলো দেখে আনন্দে আত্মহারা আমি এক মুহূর্তে ভুলে যাই সব। ঝাপিয়ে পরি মামীর ওপর। মামী কিছুটা পিছিয়ে যান। দুহাতে জড়িয়ে পিঠে হাত বুলোতে বুলোতে বলেন, “কি দারূণ রেজাল্ট করেছিস ঝুম। মেডিক্যালেও চান্স পেয়েছিস! বাহঃ আমার মা’টা লাখে একটা!”
তিয়াস ভাইয়ার কণ্ঠ আসে, “তোমার ছেলেও লাখে একটা।” মামী ভাইয়ার দিকে তাকায়, “প্রত্যেকের ব্যাগ ধরে আছি! লাখে একটা না? ভাই রে, দরজা ছেড়ে আনন্দ যাপন কর। ব্যাগ ধরতে ধরতে হাত ব্যাথা হয়ে গেল!”
আমি মৃদু হাসিতে সরে দাঁড়াই। নানাকে পা ছুয়ে সালাম করি। তিনি আমার থুতনি ধরে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলেন। কি যেন বিরবির করলেন। বুঝিনি। চোখে মুখে তৃপ্তির ছোয়া পরখ করেছি শুধু। বাসায় হট্টগোল পরে গেল। মামীর কথা, রেনু খালার বাঁশ গলা, সাদ ভাইয়া আর মামার গুরু গম্ভীর কথোপকথন, তিয়াস ভাইয়ার জোরালো কণ্ঠে মন খারাপেরা কিছু সময়ের ছুটি দেয়। বিল্ডিংয়ের একতলা আর দোতলা আমাদের দখলে। আমাদের ফ্ল্যাটের ভেতরে দোতলায় যাওয়ার আরেকটা সিড়ি আছে। আমাদের গল্প চলছিল সে সিড়িতে বসে। তিয়াস ভাইয়া সামনে বসে। আমি আপু তার মুখোমুখী। ভাইয়া কখনো বিরক্ত, কখনো কৌতুকপূর্ণ মুখভঙ্গিতে উনার বিদেশি গফদের কাহিনী বলছে। আমি আর আপু প্রায় সময়ই হেসে লুটোপুটি খাচ্ছি। বিশেষ করে ভাইয়ার বলার ধরনটা! গল্প হাস্যকর না হলেও ভঙ্গিমায় হাসি এসে যায়। হৈ চৈ চলল অনেক রাত অবদি। আমাদের আড্ডা ভাঙে মামীর ধমকে। রাত নাকি অনেক হলো। অনিচ্ছেয় ভঙ্গ হলো আড্ডা। রুমে এসে দরজা আটকে লাইট জ্বাললাম। পেছন ফিরে চমকে উঠলাম। জিসান ভাই ক্লান্ত হাসেন। চেয়ার ছেড়ে দাঁড়ান। উনাকে দেখে মনকোণে আবার মন খারাপেরা ভিড় জমায়। কান্নার দমানোর চেষ্টায় ঠোঁট কাঁপতে শুরু করে। তিনি বিস্মিতচোখে তাকান। দ্রুত দুরত্ব কমিয়ে উনাকে জড়িয়ে ধরি। হাউমাউ করে কাঁদতে থাকি। উনি আমায় বুকে চেপে ধরেন। কিছুক্ষণ পর মুখ তুলে কপালে আলতো ঠোঁট ছোয়ান। চোখ মুছিয়ে বলেন, “কাঁদছিস কেন এভাবে?”
আমি ফোঁপাতে ফোপাঁতে বলি, “জিসান ভাই আপনার চাকরি হয়ে গেছে তবু আমাকে কেন বিয়ে করছেন না?”
তিনি ধমকান, “থাপড়াব, ভাই লাগি তোর?”
চমকে আরও কাঁদতে থাকি। এবার চোখের পানির থেকে মুখ চলছে বেশি। যত না কাঁদছি তার থেকে বেশি কান্নার শব্দ তুলছি।
“মহা যন্ত্রণায় পরলাম তো। তোর পুরো পরিবার ছুটে আসবে শব্দে!”
“আসুক। এসে কেলেংকারী হয়ে গেছে ভাবুক। ভেবে গ্রামের মানুষদের মতো বিয়ে দিয়ে দিক।”
তিনি এবার হাসতে থাকেন। আমি ভেজা চোখে মুখটা দেখি। বুকটা শীতল সুখব্যাথায় জুড়িয়ে যায়। তিনি চোখ দুটো আলতো হাতে মুছে দেন। চোখের পাতায় ঠোঁট ছুয়িয়ে দুহাত কোমড়ে আবদ্ধ করেন। টেনে কাছঘেষে দাঁড় করেন। গাল টেনে বলেন, “চাকরি হয়েছে অর্থই কি বিয়ে? আমার এখনো বিসিএস বাকি। নিজে ঠিকঠাক প্রতিষ্ঠিত হই পরে তোকে বিয়ে করব। নইলে সংসার চলবে কি করে? আবেগে ভেসে ভেসে বাস্তবতার শক্ত ছোবল সামলানো যাবে? বরং তাতে নিংড়ে আরও নিঃস্ব হব। অভাবে না সম্পর্ক টিকবে না সুখ।”
আমি অসহায় চোখে তাকিয়ে থাকি। অভিমানী কণ্ঠে বলি, “আপনারা নাকি বাসা চেঞ্জ করবেন?”
তিনি কিছুক্ষণ কপালে ভাজ ফেলে কিছু ভাবেন। বলেন, “এমন কিছু ভাবা হচ্ছে।”
গাল ফোলাই, “কই আগে তো সমস্যা হয়নি! দিব্যি আসা যাওয়া করেছেন!”
“আগে কি আর নাইট ডিউটি ছিল? গতদিন ভোর বেলায় ফিরতে গিয়ে ক্লান্তিতে এক্সিডেন্ট করে ফেলছিলাম। একদিন ছিনিতাই হলো। মা তাই চাইছে না এতদূর..”
কান্না এবার থেমে গেল বিস্মিত কণ্ঠে বললাম, “এসব আমাকে বলেননি তো?”
“তোকে বাড়তি চিন্তায় ফেলতে চাইনি। পড়ার চিন্তায় এমনিতেই শুটকি হয়ে গেছিস।”
ছোট্ট এক শ্বাস ফেলে রুমের এদিক ওদিক তাকাতে শুরু করি। উনি বলেন, “কি খুজছিস?”
জবাব দেই না। কাঙ্ক্ষিত জিনিসটা চোখের সামনে না পেয়ে একসময় অসহায় মুখে বলি, “আপনার কাছে টিস্যু আছে?”
“না কেন?”
“নাক মুছব।”
উনি কিছু বলার আগেই উনার টি-শার্টটা টেনে পরপর দু-তিনবার নাক মুছে নিলাম। তিনি নাক-মুখ কুচকে তাকিয়ে থাকেন। আমি সরলমুখে হাসি। তিনি কিছু বলতে আবার মুখ খুলেন সে সময় রুমের দরজায় কেউ কড়া নাড়ে। দুজনেই চমকে তাকাই। তিয়াস ভাইয়ার কণ্ঠ আসে, “কার সাথে কথা বলছিস ঝুম?”
~চলবে❤️
~চলবে❤️
[হেহেহেহে শব্দগুলো কি খুব কঠিন? লেখার সময় সমার্থক সহজ শব্দ খোজা আরেক ভেজাল। তারমধ্যে আলসেমিও লাগে। কোন শব্দটা আপনাদের কঠিন লাগবে ঐটাও বুঝি না। মনে হয় কই কঠিন শব্দ তো ব্যবহার করিনি!🐹]