#তোর_মায়ায়_আবদ্ধ
#পর্ব_৬
#আঁধারিনী(ছদ্মনাম)
“ভাইয়া শোনো উনাকে তোমার ঘরের ওয়াশরুম টায় নিয়ে যাও।একা ছেড়ো না কিন্তু বলা তো যায় না আবার না বলে কার ঘরের ওয়াশরুমে ডুকে কার বিয়ে ভেঙ্গে দেয়।”
আমার কথা শুনে আকাশ ভাইয়া মিটমিট করে হাসছে।আর শুভ্রের মুখটা এখন দেখার মতো।বেচারা এখন না পারছে সইতে আর না পারছে কিছু বলতে।নিজেরই তো এখন অবস্থা খারাপ দুই পাশ দিয়ে দুইজন ধরে রেখেছে।আমার দিকে কড়া দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো।আমি সেইদিকে পাত্তা না দিয়ে নিজের ঘরের দিকে হাঁটা ধরলাম।মনে এখন অনেক টা শান্তি শান্তি লাগছে।ওই ঘাড়ত্যাড়া লোকটার একটা হলেও শান্তি হয়েছে।
আজ গোটা দুইদিন পর নিজের ঘরে আসলাম।এই ঘর টা থেকেই তো শেষ বার আমি বেরিয়েছিলাম অভ্রের জন্য বউ সেজে।এই ঘরটাতে অনেক অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে আমার আর অভ্রের।এই ঘরের বারান্দায় কতোরাত যে অভ্রের সাথে ফোনে কথা বলতে বলতেই ঘুমিয়ে পরতাম কোনো হিসেব নেই।অভ্রের সাথে কথা বলতে বলতে বেশিরভাগ দিনই আমি বারান্দায় ঘুমিয়ে থাকতাম।
এই ঘরে আমার আর অভ্রের অনেক ছবি টানানো ছিলো দেয়ালে।এখন আর সেগুলোর কোনো অস্তিত্বও নেই।অথচ দুইদিন আগেও এই ঘর থেকে শেষ বারের জন্য বেরিয়ে যাওয়ার আগেও দেখে গিয়েছিলাম।বাড়ির কেউই হয়তো এখন ওই ছবি গুলো সরিয়ে ফেলেছে।দেয়াল থেকে তো ছবি গুলো সরিয়ে ফেলছে কিন্তু আমার মনের ভিতর যে ছবি দৃশ্যমান সেটা কি করে সরিয়ে ফেলবে!অভ্র যেমনই হোক না কেনো এই চার টা বছরে ও আমাকে ভালোবাসুক বা না বাসুক আমি তো বাসতাম।আমার ভালোবাসা টা তো এক বিন্দু মিথ্যে ছিলো না।অভ্রকে আমি কোনোদিনও ভুলতে পারবো কিনা জানি না।এই ক’টাদিন ওই বাড়িতে সবার সাথে একসাথে থাকার কারণে তেমন একটা মনে পরেনি অভ্রের কথা। এই ঘরে আসার পর সেই পুরোনো অনুভূতি টা আবার নড়েচড়ে উঠলো।
অভ্রের সব স্মৃতি গুলো এ ঘর থেকে সরিয়ে ফেললেও একটা জিনিস এখনো রয়ে গেছে।আমার ডায়েরি টা যেটায় অভ্রের জন্য শতশত অনুভূতি লেখা।যখনই অভ্রের সাথে ঝগড়া রাগ অভিমান হতো তখনই এই ডায়েরিতে লিখতে বসতাম।ডায়েরির মধ্যে অভ্রের একটা ছবিও রাখা আছে।এখনো হয়তো আছে।কৌতূহলি হয়ে ডায়েরি টা হাতে নিলাম।খাটে বসে একের পর এক পৃষ্ঠা উল্টোতে লাগলাম।মনের মধ্যে তোলপাড় শুরু হয়ে গেছে।কান্নায় দলা পাকিয়ে আসছে গলায় বারবার। কিন্তু আমি অভ্রের জন্য এক ফোঁটাও চোখের পানি ফেলবো না বলে নিজের সাথে নিজে যুদ্ধে নামলাম।
কিন্তু চোখ কি আর কারো কথা মানে!টপটপ করে কয়েক ফোঁটা পানি ঠিকই গড়িয়ে পরলো ডায়েরির পাতার উপর। ডায়েরি টা আর খুলে রাখতে পারলাম না খুব কষ্ট হতে লাগলো।তাই তৎক্ষনাৎ ডায়েরি টা বন্ধ করে পাশে রেখে দিলাম।অধরা আসলো ঘরে আমাকে এরকম বিধস্ত অবস্থায় দেখে চিন্তিত গলায় জিজ্ঞেস করলো,
” একি আপু তোমার এমন অবস্থা কেনো?”
অধরার কন্ঠ পেয়ে তৎক্ষনাৎ চোখের পানি মুছে ফেললাম।মুখে একটা কৃত্রিম হাসি এনে জবাব দিলাম,
” কই কিছু না তো।আসলে দুইদিন পর বাড়ি আসলাম তো তাই পুরোনো কিছু স্মৃতি মনে পরছে।”
“ওওও…” যদিও আমার অবস্থা টা বুঝে ফেলছে তাও কথা প্রসঙ্গ পাল্টানোর জন্য আবার বললো,
” শুনলাম আসতে না আসতেই নাকি তোমার জামাইয়ের পা ভেঙ্গে লেঙ্গরা হয়ে গেছে।”মজার ছলে বললো।
“তোকে কে বললো? আর তুই ছিলি কই এতোক্ষণ? আসার পর থেকে তো তোকে কোথাও দেখলাম না।”
” বাব্বাহ এতো প্রশ্ন একসাথে করলে জবাব দিবো কি করে।আচ্ছা একে একে উত্তর দিচ্ছি। প্রশ্ন এক আকাশ ভাইয়া বলছে।প্রশ্ন দুই কলেজে হঠাৎ করে যেতে বলেছে কিসের যেনো কাগজ পত্র ঠিক করার জন্য।তাই এতোক্ষণ কলেজে ছিলাম।তাই তুমি আমায় দেখোনি।এইটা ছিলো তোমার লাস্ট প্রশ্নের উত্তর। পেয়ে গেছো সব উত্তর? ”
” হুম তবে কলেজে যাওয়ার ব্যপার টা বিশ্বাস হলো না।”অধরার দিকে বাকা চোখে তাকিয়ে বললাম।
” তোমার কাছ থেকে এ জীবনে আমি কিছু লুকিয়ে রাখতে পারলাম না।হুম ওর সাথেই একটু দেখা করতে গিয়েছিলাম।”হতাশ হয়ে অধরা বললো।
ওর কান মুলিয়ে দিয়ে বললাম ” বেশি পেকে গেছিস না এখন আমাকেও মিথ্যা বলা শুরু করছোছ।শোন আমি তোর থেকে বয়সে এবং অভিজ্ঞতায় অনেক বড়ো তাই আমার চোক্কে ফাঁকি দেওয়া যাবে না।”
” আহ আপু লাগছে কানে।এখন আমি অনেক বড়ো এখনো যদি কান মুলানো খাই তাহলে তো আমার ইজ্জৎ আর কিছুই বাকি থাকবে না”
“এ্যাহ কয়দিন আগেও তো বিলাই প্যান আর সেন্টু গেঞ্জি পইড়া এ বাড়ি ও বাড়ি ঘুইরা বেড়াইতি।”
অধরা আমার দিকে ছলছল চোখে তাকিয়ে বলে উঠলো ” মাপ চাই ছাইড়া দেও আফা। আমি আর জীবনে বলমু না বড় হইছি তাও এভাবে ইজ্জতের ফালুদা করো না প্লীজ!”
ওর কথা শুনে আর হাসি ধরে রাখতে পারলাম না।
” আপু কয়েকদিন থাকবে নিশ্চয়ই? ” আমার হাত নিজের হাতের মধ্যে গুঁজে নিয়ে করুন চোখে জিজ্ঞেস করলো।
সেই ছোট্ট থেকে আমার ছায়ার মতো ছিলো এই মেয়েটা।আমাকে ছাড়া ওর এক মুহূর্ত চলতো না আবার আমারও ওকে ছাড়া এক মুহূর্ত চলতো না।আমার বাবারা তিন ভাই। বড় চাচ্ছুরা এখানে থাকে না।শহরে থাকে ওরা।এই বাড়িটা আমার দাদুর আমলের। দাদুর স্মৃতি রক্ষার্থেই বাবা আর ছোটো কাকু এই বাড়ি এই গ্রাম ছেড়ে কোথাও যায়নি।বড়ো চাচ্চুর পরিবারের লোকেরা পাঁচ ছয় বছরে সময় পেলে একবার আসে একদিন কি দুইদিন থেকে চলে যায়।আসলে ওদের গ্রাম পছন্দ না।তাই বড়ো চাচ্চুর দুই মেয়ে অহি আপু আহি আপু আর অর্ণব ভাইয়াদের সাথে আমাদের তেমন একটা সম্পর্ক নেই।কিন্তু আকাশ ভাইয়া আর অধরা যে আমার কাকাতো ভাই বোন তা মনেই হয় না।ওদের সাথে নিজের আপন ভাই বোনের থেকেই বেশি আপন সম্পর্ক।ছোটো থেকেই আমরা তিনভাই বোন একসাথে বড়ো হয়েছি।আমরা একে অপরকে ছাড়া কখনো থাকিনি।আমি জানি এই দুইদিন আমার এই ছোট্ট বোনটার আমাকে ছাড়া থাকতে কতোটা কষ্ট হয়েছে।কিন্তু কি করবো মেয়েদের জীবন টাই তো এমন আপন মানুষ গুলোকে আঁকড়ে থাকতে পারে না।ফুস করে একটা শ্বাস ফেলে অধরার দিকে তাকালাম।বোন টা আমার দিকেই আমার উত্তরের অপেক্ষায় রয়েছে এখনো।ওর হাতের উপর আরেকটা হাত রেখে মুখে একটা কৃত্রিম হাসি ফুটিয়ে বললাম,
” কিচ্ছু করার নেই রে আমার এখন।ওই বাড়ির সবাই এখনো আমায় মেনে নেয়নি।তারউপর আবার মিথিলা আপু আর শ্বাশুড়ি মা উনাকে নিয়ম এই বাড়িতে আসাটাও পছন্দ ছিলো না।এখন কি করে থাকতে পারি বল!”
” তোমার ওই শাশুড়ি আর ননদ টা একদম ভালো না।ওই যে সিরিয়ালে যেরকম শাশুড়ী গুলো দেখায় ওইরকম। আর ননদটাও তো তাই!এদের কাজ হলো নিজের সংসার ছেড়ে অন্যের সংসারে এসে আগুন লাগানো।তুমি আবার সিরিয়ালের বউদের মতো পুরো সংসারে খেটেখুটে নিজেকে ভালো বাউ সাজতে যাবা না কিন্তু।”অভিমানী সুরে বললো অধরা।
ওর কথা শুনে দুষ্টুমি করে আমিও বললাম “তুইও তো এখন সিরিয়ালের বউয়ের কুটনি বাপের বাড়ির লোকেদের মতো আমাকে কুটনি গিরি শেখাচ্ছিস।”
” হুম এখন তো আমায় তাই মনে হবে।শোনো নিজের ভালো নিজে বুঝতে শিখো।”এবার শাসনের ভঙ্গিমাতে বলো।
“যথা আজ্ঞা” ওর কথার জবাবে হুকুম মানার বললাম।তারপর দুজনেই হেসে উঠলাম।এরমধ্যেই আকাশ ভাইয়ার গলা পেলাম দরজার দিক থেকে,
“এই মুন ধরা খাট থেকে সর তোরা দুইটা।”
দরজার দিকে তাকাতেই দেখি আকাশ ভাইয়া তখনকার ড্রাইভার চাচা শুভ্রকে দুইজন দুইদিক থেকে কোনোরকমে ধরে দাঁড়িয়ে আছে।শুভ্রের পায়ে আর মাথায় ব্যান্ডেজ।তখন তো শুধু পায়ে ব্যথা পেয়েছিলো কিন্তু মাথা তো কিছু হয়নি।
” ভাইয়া উনার মাথায় ব্যান্ডেজ কেনো?”ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলাম।
” তোর জামাইরে আমরা দুইজনে ধরে ধরে তখন আমার ঘরে খাটে বসিয়েছিলাম।আমরা দুইজনেই ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলাম তাই একটু বসছি।কিন্তু তোর জামাই এরমধ্যেই আমাদের না বলে একা একা ওয়াশরুমে ডুকে পরছে জামা পাল্টানোর জন্য। আর কি এই লেঙ্গরা পা নিয়ে ওয়াশরুমেই আবার ধপাস করে পরে কোমর মাথা পাঠাইয়া বইসা আছে।হইছে তোদের জানা সর এখন তোরা দুইটা এখান থেকে।”
অধরা আর আমি তৎক্ষনাৎই খাটের থেকে সরে আসলাম।আমার এখন ইচ্ছে করছে যেই বাকি একটা পা আর হাত বেঁচে আছে ওগুলোও ভেঙ্গে ফেলতে।মাথাটাই পুরো গরম করে ফেলছে।লিমিট হীন ঘাড়ত্যাড়া লোক।যদি এখন হাতের কাছে লাঠি থাকতো না সত্যি বলছি হাত পা সব ভেঙ্গে হসপিটাল ভর্তি করিয়ে দিতাম।অধরা আমার পাশে দাঁড়িয়ে মুখ টিপে টিপে সেই কখন থেকে হেসেই চলেছে।সব মিলিয়ে এখন আমার মাথা প্রচন্ড গরম এখানে আর এক মুহুর্ত থাকা সম্ভব না তাই বেরিয়ে এলাম ঘর থেকে।
চলবে,,,,,