তোলপাড়
ইসরাত জাহান তানজিলা
পর্ব-১৫
________________
অরূণীর হাতের মুঠো কেঁপে কেঁপে মুষ্টিবদ্ধ থাকা মোবাইল’টা মুঠো থেকে আগলা হয়ে যাচ্ছে।এখুনি যেন ফ্লোরে পড়ে যাবে। অরূণীর কিছু ভাবতে পারছে না। মস্তিষ্ক ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। নিম্মি হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে অরূণীর প্রতিক্রিয়া দেখে। অরূণীর হাত থেকে মোবাইল’টা নিয়ে নিলো।নিম্মি মরিয়া হয়ে ওঠে বলল, “আরে?কী হয়েছে?শরীর খারাপ লাগছে?”
অরূণী’কে টানা তিন-চার বার এই প্রশ্ন’টা করলো নিম্মি। রুদ্র হ্যালো হ্যালো করে যাচ্ছে। ফোনের এপাশ থেকে কোনো প্রত্যুত্তর পেলো না। চেঁচামেচির শব্দ শোনা গেল শুধু। ফোন’টা নিম্মি টেবিলের ওপর রেখে দিয়েছিলো অরূণীর হাত থেকে নিয়ে। রুদ্র স্পষ্ট বুঝতে পারলো না কী নিয়ে শোরগোল হচ্ছে। দুই-তিন মিনিট ধরে কোনো সাড়া না পেয়ে ফোন রেখে দিলো।
অরূণীর শরীর টলটল! হিমেল হাওয়ায় দোল খাওয়া সরোবরের পানির ন্যায় অরূণীর শরীর কাঁপছে। খাটে বসে পড়লো। নিম্মি অরূণীর পাশে বসে ক্রমাগত ভাবে জিজ্ঞেস করে যাচ্ছে, “অরূ,অরূ কী হয়েছে?”
অরূণীর গলা ধরে আসছে। প্রচণ্ড ভয়, আতঙ্ক আর শঙ্কা নিয়ে অস্ফুট স্বরে বলল, “রুদ্র কেন?”
নিম্মি অরূণীর দিকে বিস্মিত দৃষ্টি ছুঁড়ে ভ্রু কুঁচকে বলল, “হ্যাঁ রুদ্র! তো কি হয়েছে?অরূ তুই অদ্ভুত আচরণ করছিস কেন?”
অরূণীর আচরণ দেখে উদ্বিগ্ন হয়ে যায় নিম্মি।বিস্ময়বিহ্বল হয়ে তাকিয়ে বলল, “অরূ কী হলো হঠাৎ?”
নিম্মির গলার অজ্ঞাত শঙ্কা।অরূণী চোখ বুঁজে বসে আছে।চোখে-মুখের অবস্থা সঙ্গিন।অরূণীর বুকের ভিতর শুধু কেঁপে কেঁপে ওঠছে বার বার।বন্ধ চোখের কোটরে জমাট বাঁধা পানি গড়িয়ে পড়ার অপেক্ষা।বলল, “আপা কার সাথে কথা বলেছি আমি?”
নিম্মি চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে তাকিয়ে অরূণীর কাণ্ড দেখছে। কিছুই বুঝতে পারছে না। নিম্মিকে প্রশ্ন’টা করে উত্তরের অপেক্ষায় প্রহর গুনতে লাগলো অরূণী।প্রতি সেকেন্ড কে এক যুগ সম মনে হচ্ছে। ধারালো ছুরির আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হওয়ার মত যন্ত্রনা নিয়ে উত্তরের অপেক্ষায়। নিম্মি স্বাভাবিক গলায় বলল, “তোর দুলাভাইয়ের ভাই রুদ্র।”
অরূণী চোখ খুলল খুব বড় করে। এইমাত্র কানে ভেসে আসা কথা’টা কী মিছা বিভ্রম? হকচকিয়ে ওঠে চাপা গলায় জিজ্ঞেস করল, “কী?কী বললে?”
নিম্মি নিরুদ্বেগ ভাবে বলল, “তোর দুলাভাইয়ের ভাই রুদ্র। কিন্তু তোর কী হয়েছে?অরূ এক্সিডেন্টে কী তোর মানসিক সমস্যা হয়েছে?”
অরূণীর মুখ হাঁ হয়ে গেল আপনা-আপনি।চোখ-মুখ জুড়ে বিস্ময় ব্যাপ্ত হচ্ছে। উত্তেজনায় ধরে আসা গলায় আবার জিজ্ঞেস করল, “কী বললে আপা?”
এক প্রশ্ন বার বার করায় মহা বিরক্ত নিয়ে খানিক ধমকে ওঠে নিম্মি বলল, “কী বলছি শুনিস নি?তুই এরকম করছিস কেন?অরূ আমার চিন্তা হচ্ছে।পাগল-টাগল হয়ে গেলি তুই?তোকে আমার দেবরের সাথে কথা বলতে দিলাম।তুই এমন কেন করেছিস? রুদ্র কী ভেবেছে বল তো?”
নিম্মি একটু থেমে আবার বলল, “বার বার রুদ্র রুদ্র কেন করছিস?”
অরূণী এসবের প্রত্যুত্তর না করে ঘোরলাগা গলায় বলল, “তোমার হাজবেন্ডের কী নাম আপা?”
অরূণীর হাবভাব বুঝতে না পেরে কপাল ভাঁজ করে নিম্মি বলল, “তানভীর আকন।”
নামের শেষে আকন শব্দ’টা অরূণী’কে শতভাগ নিশ্চিত করে দিলো ও রুদ্রের সাথে কথা বলেছে।আর ভেবেছে রুদ্র নিম্মির হবু হাজবেন্ড।এখন সঠিক’টা বুঝতে পারলো। কী করে সম্ভব এটা?অতি আবেগ, উত্তেজনায় অরূণীর গলা চিকন হয়ে আসছে। উত্তেজনাপূর্ণ চিকন গলায় বলল, “আমি যার সাথে কথা বলেছি সে রুদ্র আকন?”
তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অরূণীর দিকে নিম্মি। নাক-মুখ ঘুচিয়ে রেখেছে।বলল, “আমি বুঝতে পারছি না অরূ,তুই কেন এমন করছিস?কী হয়েছে?আরে কী অদ্ভুত!”
অরূণীর মনে তখন বসন্তের মাতাল হাওয়া বইছে। অরূণীর মনের দিগ্বিদিক ছোটাছুটি করছে বিস্ময় আর অবিশ্বাস্য ভাব কী করে সম্ভব? স্বপ্ন এটা? পাগল পাগল হয়ে যাচ্ছে অরূণী। নেশা লাগা চোখে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। হৃদয়ে কাঁপাকাঁপি। উপরে উপরে বিস্ময়ে স্তম্তিত হয়ে রয়েছে।আকাশ-পাতাল ভুলে নিম্মির দিকে তাকিয়ে তীব্র অনুনয় করে বলল, “বলো না আপা!আমি কী রুদ্র আকনের সাথে কথা বলেছি?বাসা রাজশাহীতে। তোমারও তো বিয়ে হচ্ছে রাজশাহীতে।”
নিম্মি এ পর্যায়ে অরূণীর পিঠে জোরে একটা ধাক্কা দিয়ে বলল, “অরূ তুই রুদ্র কে আগে থেকে চিনিস? কাউকে চেনা তো অস্বাভাবিক কিছু না। কিন্তু এমন কেন করছিস?”
অরূণী নিম্মির দিকে তাকিয়ে বলল, “আমায় এখন কিছু জিজ্ঞেস করো না আপা। আমি এখন কিছু বলতে পারবো না।”
অরূণী একটু থেমে আত্মহারা হয়ে বলল, “আপা আমি না এসব বিশ্বাস করতে পারছি না।”
নিম্মি পূর্বের ন্যায় কিছু বুঝতে না পেরে আগ্রহী গলায় বলল, “অরূ কী বিশ্বাস করতে পারছিস না?আরে বল তো।”
অরূণীর যেন এসব কথা কর্ণপাত হচ্ছে না। গভীর বিস্ময়ে মগ্ন হয়ে ধ্যানপরায়ণ হয়ে আছে।নিম্মির হাত ধরে উতলা হয়ে বলল, “আপা আমার গায়ে জোরে একটা চিমটি কাটো তো।দেখো তো আমি ঘুমাচ্ছি কি-না?”
নিম্মি এবার খানিক ঘাবড়ে যায়।অরূণীর কী সত্যি সত্যি মাথায় সমস্যা হয়ে গেছে?নিম্মি সাহেদ আহমেদ আর সেলিনা আহমেদ’কে ডাকতে উদ্যত হলে অরূণী চেঁচিয়ে ওঠে বলল, “কাউকে ডেকো না।আমি ঠিক আছি, আমি ঠিক নেই।আমি পৃথিবীতে নেই। আমি বসন্তে বাতাসে ভাসছি।”
একটু থেমে আবার বলল, “আপা আমি তোমায় সব বলবো কিন্তু একটু পরে। এখন কিছু বলতে পারবো না।”
অরূণী রুম থেকে দৌড়ে ছাদে চলে গেল।রাত তখন একটা। এলোমেলো পায়ে ছাদে হাঁটাহাঁটি করতে থাকলো কোনো কারণ ছাড়াই।অস্থির ভঙ্গিতে হাঁটছে। একটু হেঁটে রেলিং ঘেঁষে দাঁড়ায়,আবার হাঁটে। উন্মাদের মত পায়তারা করে। না..কিছু ভাবতে পারছে না। পাগল পাগল ভাব এসে যায় অরূণীর মাঝে। আবার দ্রুত পায়ে রুমে যায়। নিম্মি এবার জেঁকে ধরলো অরূণী’কে।জোর গলায় বলল, “বল কী হয়েছে? পাগলের মত করছিস কেন?”
অরূণী কিছু বলে না।আত্মহারা হয়ে কি করবে বুঝতে না পেরে আবার পুরো বাসা পায়তারা করে। মাথায় এলোমেলো ভাবনা আর আনন্দ।
নিম্মি পড়লো মহা বিপাকে।অরূণী আবার রুমে এসে বলল, “আপা আমার জায়গায় যদি তুমি থাকতে পাগল হয়ে যেতে। আমার থেকে বেশি পাগল।”
নিম্মির কথার কোনো উত্তর না দিয়ে নিজের মত বিড়বিড় করে যাচ্ছে অরূণী।নিম্মি হতাশ ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে।অরূণী শুয়ে কাঁথা মুড়ি দিয়ে বলল, “আপা আমি সকালে তোমায় সব বলবো। সারা রাত বসে আমি এতসব আনন্দ, উত্তেজনা হজম করবো।”
নিম্মি আর কিছু জিজ্ঞেস করলো না। দমে গেল বোধ হয়। শুধু বলল, “গরমের ভিতর তুই কাঁথা কেন গায়ে দিয়েছিস?”
অরূণীর কাঁথার ভিতর থেকে মুখ বের করে বলল, “আমার বোধ হয় জ্বর আসছে।শীত করছে। কথা বলো না আপা।”
নিম্মি লাইট অফ করে শুয়ে পড়লো।আর অরূণীর শরীর-মনে ছটফটানি। কখনো কাঁথা মুড়ি দিয়ে থাকে।কখনো বা কাঁথার ভিতর থেকে মুখ বের করে শ্বাস ফেলে।ঘুম নেই চোখে ছিটেফোঁটাও। রুদ্রের সাথে ট্রেনে দেখা হওয়ার আনন্দে গত রাতে ঘুম হলো না।আর এখন রুদ্র নিম্মির দেবর এটা জেনে বোধ হয় মাস খানেক ঘুম হবে না অরূণীর। খাওয়া-দাওয়াও বন্ধ হয়ে যেতে পারে।অরূণী গায়ের কাঁথা ফেলে ধুপ করে ওঠে বসে আবার। বিড়বিড় করে বলে, “কী ছিলো এটা মিরাকল?”
মাঝরাতে অরূণীর এই বিড়বিড়ানিতে নিম্মির ঘুমও ভেঙে যায়। সবে মাত্র চোখে ঘুম এসেছিলো নিম্মির। কঠিন দৃষ্টিতে তাকায় অরূণীর দিকে। অরূণী নিম্মির কঠিন দৃষ্টি উপেক্ষা করে গেল। সারা রাত নিজেও ঘুমায় নি।নিম্মিকেও ঘুমাতে দেয় নি।
(চলবে)
~ আজ গল্প দেওয়ার ইচ্ছা বা সময় কোনটাই ছিলো না। কিন্তু আজকের পর্ব টার জন্য অনেকে অপেক্ষা করে আছেন। তাঁদের অপেক্ষার মূল্য দিয়ে ছোট একটা পার্ট লিখেছি।