দহন পর্ব ২

#দহন
#পর্ব_২
#লেখা_মিম

-” তোমার মতো মেয়েকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পাওয়াটা ভাগ্যের ব্যাপার। এতবড় ভাগ্য আমার নেই। আর তোমার চেয়ে ভালো বউ পাবো অতবড় স্বপ্ন আমি দেখিনা। আসলে দেখার দুঃসাহসটাই কখনো হয়নি। তোমার মত মেয়ে যদি পেয়েও যাই তবে ধরে নিবো পৃথিবীর সেরা ভাগ্যবানদের মধ্যে আমি একজন।”
-” মুহিব ভাই আপনি কিন্তু একটু বেশিই বলছেন।”
-” একদম না। আমার কথা বিশ্বাস না হলে এখানে উপস্থিত অনিমের বাকি সব বন্ধুদের জিজ্ঞেস করে দেখো। ওরা সবাই ঠিক এই কথাগুলোই বলবে।”
হাতে গহনার বাক্স নিয়ে শিমুলের কাছে এসেছেন মুহিবের মা। অনিমের মা অথবা বোন কেউই নেই। তাই আজ শিমুলকে গহনা পড়ানোর দায়িত্বটা মুহিবের মা এর উপর পড়েছে।
-” এই সর তো দেখি। জায়গা দে আমাকে। খালি তো পারিস বকবক করতে। শিমুলের মতো একটা মেয়েকে আজও খুঁজে বের করতে পারলিনা। কবে থেকে বলছি লক্ষী একটা মেয়ে খুঁজে আন তোকে বিয়ে দেই। তা তো করছিস না।”
-” কি করবো আম্মা বলো? শিমুলের মতো তো কাউকে খুঁজে পাইনা। পেলে এক সেকেন্ডও দেরী করবো না। কাজী ডেকে এনে তাকে ধরে বেঁধে সেখানেই বিয়ে করবো যাতে অন্য কেউ এসে তাকে না নিয়ে যেতে পারে যেমনটা অনিম শিমুলকে নিয়ে গেছে।”
-” মুহিব ভাই আপনি সবসময়ই খুব বাড়িয়ে কথা বলেন।”
-” হা হাহা, আমার কথাগুলো সিরিয়াসলি নিও না বোন। তুমি আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধুর বউ। সেই হিসেবে তুমি আমার ভাবী হও। তোমার সাথে একটু মজা করবো না তো আর কার সাথে করবো?”
চারদিকে গুন্জন শোনা যাচ্ছে “কাজী এসেছে”। কাজী এসেছে শুনে মুহিব দৌঁড়ে অনিমের কাছে গেলো। কিছুক্ষন পর শিমুলের বড় বোন নদী আর ছোট ভাবী বর্ষা শিমুলের সামনে বড় একটা নকশী কাজের চাদর ধরলো। পর্দার ওপারে অনিমকে এনে বসানো হয়েছে। কাজ এসেছেন, তাদের দুজনের মুখ থেকে কবুল কথাটা আদায় করেছেন। বিয়ে সম্পন্ন হওয়ার পর তাদের দুজনের মাঝখান থেকে চাদরটা সরিয়ে নিয়েছে নদী আর বর্ষা। শিমুলের দিকে অনিম অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। শিমুল তার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসছে। শিমুল আজ অনিমর চোখে পূর্নতার খুশি, অপেক্ষার অবসানের স্বস্তি খুঁজে পাচ্ছে। দীর্ঘ চার বছরের অপেক্ষার অবসান আজ ঘটেছে অনিমের। এই চারটা বছর কতভাবেই না চেষ্টা করেছে শিমুলকে বিয়েতে রাজি করানোর জন্য। শিমুল কোনোভাবেই রাজি হচ্ছিলো না। তার এক কথা অনার্স কমপ্লিট না করে বিয়ে করবে না। কিন্তু অনার্সটা আর কমপ্লিট করা হয়নি। অনিম গো ধরে বসেছিলো বিয়ে তাকে করতেই হবে। এমনকি এক মাসের মধ্যেই করতে হবে। আর নয়তো সে গলায় দড়ি দিবে। আর যতদিন না শিমুল বিয়েতে রাজি হচ্ছে ততদিন সে না খেয়ে থাকবে। এক ফোঁটা পানিও সে গলা দিয়ে ঢুকাবে না। অবশেষে শিমুল আর কোনো গতি না দেখে বিয়েতে রাজি হয়ে গেলো। এক মাস পর তার সেকেন্ড ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা। তবুও সে রাজি হয়েছে এই মুহূর্তে বিয়ে করতে।
শিমুল আর অনিমকে বসানো হয়েছে খাওয়ার জন্য। অনিম সেই কখন থেকে চেষ্টা করছে শিমুলকে কিছু একটা বলার জন্য। কোনোভাবেই বেচারা শিমুলকে কথাটা বলতে পারছেনা। মুরুব্বিদের আনাগোনায় অনিম বিশেষ সুবিধা করতে পারছে না। তার ভাবগতি দেখে শিমুল জিজ্ঞেস করলো,
-” কিছু বলতে চাচ্ছো?”
-” হ্যা।”
-” বলো।”
-” কিভাবে বলবো? দেখতে পাচ্ছো না মুরুব্বিগুলা কি শুরু করেছে? এদের কোনো কান্ডজ্ঞান নেই। এই মাত্র আমাদের বিয়ে হয়েছে। উনাদের কি উচিত হচ্ছে আমাদের চারপাশে এভাবে ঘুরঘুর করা?”
-” ও মা, তুমি এখন এই বাড়ির জামাই। আজ তোমার বিয়ের দিন। তোমার খাওয়া দাওয়ায় যেনো কোনো সমস্যা না হয় এজন্যই তো এমন ঘুরঘুর করছে তোমার আশেপাশে।”
-” কিন্তু কথাটা যে খুব বলতে ইচ্ছে হচ্ছে।”
-” হ্যা তো বলো।”
-” উনারা যদি কিছু মনে করে?”
-” আচ্ছা আস্তে করে বলো তাহলে উনারা শুনবে না।”
-” শিমুল আমি তোমাকে অনেক বেশি ভালোবাসি, ভালোবাসতাম, আজীবন ভালোবেসে যাবো। কেনো জানি না আজ মনে হচ্ছে তোমার প্রেমে নতুন করে আবার পড়েছি।”
অনিমের দিকে প্রচন্ড মায়া ভরা চোখে শিমুল তাকিয়ে আছে। অনিমের মুখে যতবারই ও এ ধরনের কথাগুলো শুনে ততবারই ওর ভেতরটায় অদ্ভুদ এক শান্তি কাজ করে। ওর বারবার কথাগুলো শুনতে ইচ্ছে হয়। অনিমকে ওর বলতে ইচ্ছে হয়,” অনিম আরও একটাবার প্লিজ বলো তুমি আমাকে ভালোবাসতে, ভালোবাসো আর আজীবন ভালোবেসেই যাবে। গত চারবছরে এই কথাটা শিমুল বহুবার শুনেছে। অনিম নিজে থেকে তাকে এই কথাটা বলতো। কিন্তু শিমুলের মনে এই কথাটা আবার অনিমের মুখ থেকে শোনার তীব্র ইচ্ছা জাগলেও কখনোই সে কথাটা অনিমকে বলতে পারেনি। কেন এই আবদারটা ধরতে পারেনি সেটা শিমুলের জানা নেই। কিছুক্ষন পর শিমুল মুচকি হেসে অনিমকে বললো,
-” আমিও তোমাকে ভালোবাসি অনিম। অনেক বেশিই ভালোবাসি।”
মনের অজান্তেই কথাটা একটু জোরেই বলে ফেললো শিমুল। সবাই ওর কথা শুনে হাসাহাসি করছে। শিমুলের ছোট ভাবী বললো,
-” বাসর রাতের জন্য কিছু কথা তুলে রাখ। সব কথা যদি এখনই বলে ফেলিস বাসর রাতে কি বলবি??”
-” আরে ভাবী, চার বছর তো কথা বলেই শেষ করেছে। আজ রাতে আর কোনো কথা হবে না। হবে তো অন্যকিছু।”(মুহিব)
চারদিকে অট্টহাসির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। শিমুল লজ্জায় নিচের দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হাসছে।

খাওয়া শেষে শিমুল আর অনিমকে স্টেজে বসানো হয়েছে। এখন তাদের আয়না দেখা পর্ব চলছে। শিমুলের মাথার ওড়নাটা দিয়ে অনিমের মাথাটাও ঢেকে দেয়া হয়েছে। আয়নায় দুজন দুজনকে দেখছে। বৃষ্টি জিজ্ঞেস করলো,
-” আয়নাতে কাকে দেখা যায় শিমুল?”
-” আমার ভালোবাসা।”
এবার অনিমের পালা। মুহিব অনিমকে জিজ্ঞেস করলো,
-” আয়নায় কাকে দেখো বন্ধু?”
-” আমার পৃথিবীকে।”
চারদিকে প্রচুর হৈ হুল্লোড় হচ্ছে। আশেপাশে উপস্থিত সবাই ওদের দুজনের উত্তর শুনে মন থেকে প্রার্থনা করছে আজীবন যেনো ভালোবাসাটা এমনই থাকে।
বাপের বাড়ির লোকজনকে বিদায় দিয়ে শিমুল তার স্বামীর ঘরে পা রেখেছে এই মাত্র। মুহিবের মা শিমুলকে বরণ করেছেন। এখন বসে উনি শিমুলকে এটা সেটা বুঝাচ্ছেন।
-” আম্মা, মেয়েটার বোধহয় ক্লান্ত লাগছে অনেক। এই মুহূর্তে এতসব জ্ঞান দেয়াটা তোমার ঠিক হচ্ছে না। চলো আমরা বাসায় যাই। ও রেস্ট নিক।”
-” ওমা ওকে তো এসব একটু আধটু বোঝাতে হবেই। নতুন সংসার ওর। বাচ্চা মেয়েটা সব বিষয় নাও বুঝতে পারে।”
-” শিমুল যথেষ্ট সংসারী মেয়ে। ওকে তোমার জ্ঞান দিতে হবে না। চলো বাসায় যাই।”
-” আমি জানি ও খুব সংসারী মেয়ে। তবুও তো..”
-” আর কোনো কথা হবে না। তুমি চলো।”
-” আরে তুই এমন করছিস কেনো? আন্টি মুরুব্বি মানুষ। এসব সংসারদারী আন্টি ভালো বুঝেন। উনি একটু আধটু শিমুলকে বলতেই পারেন। আমার আম্মা বেঁচে থাকলে তাই ই করতেন।”
-” বেচারীকে কেমন ক্লান্ত দেখাচ্ছে তুই চেয়ে দেখ। এই মূহূর্তে ওকে রেস্ট নিতে দেয়া উচিত।”
-” মুহিব ভাই, আমি মোটেও ক্লান্ত না। আন্টির কথাগুলো শুনতে তো ভালোই লাগছে।”
-” ঠিকাছে তুমি শুনো। আমি গেলাম।”
-” আরে এই মুহিব দাঁড়া… আমাকে সাথে নিয়ে যা।”
ছেলের জোরাজোরিতে অবশেষে মুহিবের মা শিমুলকে পরামর্শ দেয়া বন্ধ করে তাদের কাছ থেকে বিদায় নিলেন। পুরো ঘর খালি। শিমুল ড্রইং রুমের সোফায় অনেকটা জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে। অন্যদিকের সোফায় অনিম বসে আছে। কেউ কোনো কথা বলছে না। ঘরে প্রচন্ড নিস্তব্ধতা কাজ করছে। ফ্যানের আওয়াজ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই ঘরে। বলার অনেক কিছুই আছে দুজনের। কিন্তু মুখ দিয়ে একটা কথাও বের হচ্ছে না। কিসের এত সংকোচ কাজ করছে দুজনের মধ্যে? কি অদ্ভুদ ব্যাপার? কত কথাই না দুজনে এই চারবছরে বলেছে। অথচ আজ ওদের সম্পর্কটা পূর্নতা পাওয়ার দিন। আর আজকের দিনেই কিনা দুজনের মুখে তালা লেগে গেলো? এই প্রথম অনিম আর শিমুল খালি ঘরে একসাথে বসে আছে। একসাথে বললে ভুল হবে। কারন দুজন তো দুইপ্রান্তে বসে আছে। এর আগে কখনও দুজন দুজনকে নির্জনে কাছে পায়নি। পায়নি বলতে অনিম কখনোই শিমুলকে নির্জনে কাছে পেতে চায়নি। সে চায়নি তাদের সম্পর্কটা অপবিত্র হয়ে যাক। এমনকি এই চারবছরে শিমুলকে শুধু দুদিন চুমু খেয়েছিলো। তাও সেই চুমুটা খেয়েছিলো শিমুলের কপালে। শিমুলের তরফ থেকেও তেমন কিছু অনিম কখনো পায়নি। অনিম কখনো সে অধিকার শিমুলের উপর খাটায়ওনি। সে তার সমস্ত আকাঙ্খা আজকের এই পবিত্রদিনটার জন্য তুলে রেখেছিলো। অবশেষে নীরবতা ভেঙে অনিম মুখ খুললো।
-” পনেরো বিশ মিনিট পর মাগরিবের আযান দিবে। তুমি কি নামাজ পড়বে?”
-” হুম।”
-” আচ্ছা তাহলে এসব শাড়ি গহনা খুলে ফ্রেশ হয়ে নাও। অযু করে এসে নামাজ পড়ো।”
-” তুমি পড়বে না।”
-” হ্যাঁ পড়বো। কিন্তু কথা হচ্ছে ঘর তো খালি। আমি মসজিদে গেলে তুমি খালি ঘরে কিভাবে থাকবে?”
-” ১০-১৫ মিনিটেরই তো ব্যাপার। তুমি যাও। আমার অসুবিধা হবে না।”
-” সিউর?”
-” হুম।”
অনিম বিয়ের শেরওয়ানিটা ছেড়ে নরমাল কাপড় পরে নিলো। বাহিরে আযান শোনা যাচ্ছে। শিমুল এখনও বের হয়নি বাথরুম থেকে।
-” শিমুল হয়েছে তোমার?”
-” এই তো দুই মিনিট।”
শিমুল বেরিয়ে এলো।
-” শোনো, গেইটটা ভালোমতো লক করো। কেউ আসলে দেখে গেইট খুলবা না। মসজিদ বাসার পাশেই আছে। আমি যাবো, নামাজটা পড়েই আবার সাথেসাথে ব্যাক করবো। বেশিক্ষন লাগবে না। তুমি ভয় পেওনা কিন্তু।”
-” ভয় আমি পাচ্ছিনা। ভয় তুমি পাচ্ছো।”
-” সেটাও ঠিক বলেছো। তোমাকে বেশি ভালোবাসি তো তাই তোমাকে নিয়ে চিন্তা হয়।”
-” হয়েছে যাও এখন।”
নামাজ শেষ করে অনিম বাসায় এসেছে। ততক্ষনে শিমুলেরও নামাজ শেষ।
-” শিমুল রাতে আমরা বাহিরে খাবো। আজকে তোমার বিয়ে হয়ছে। নতুন বউ তুমি। আজকেই তোমাকে রান্নাঘরে ঢুকিয়ে দেয়াটা খুবই বাজে দেখাবে।”
-” বাহিরে যেতে হবে না। আপা আর দুলাভাই খাবার নিয়ে আসবে।”
-” ওহ্।”
অনিম রুমের ভেতর চলে গেলো। কিছুক্ষন পর হাতে করে কিসের যেনো একটা প্যাকেট নিয়ে আসলো।
-” ইয়ে…… শিমুল……”
-” হুম বলো।”
-” এটা ধরো।”
-” কি এটাতে?”
-” শাড়ি আর বেলী ফুল আছে এটাতে। আজকে রাতে পরবে।”
-“হুম পরবো।”
শিমুল অনিমের সামনে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছেনা লজ্জায়। সে মিথ্যা কাজের বাহানা দেখিয়ে বেডরুমে চলে গেলো। বেডরুমে সে তার লাগেজ থেকে কাপড় বের করে গোছাছে। তার কাপড়গুলো ভাঁজ করাই ছিলো। তবুও সে রুমে এসে কাপড়গুলো ইচ্ছে করে এলোমেলো করেছে। আসলে সে কি করবে খুঁজে পাচ্ছিলো না। লজ্জায় অনিমের সামনে দাঁড়িয়ে থাকাটাও সম্ভব হচ্ছিলো না। তাই সে নিজেই কাপড়গুলো এলোমেলো করে আবার নিজেই গোছাচ্ছে। অন্যদিকে অনিম টিভির রিমোট হাতে নিয়ে ড্রইং রুমে বসে আছে। লাগাতার চ্যানেলগুলো পাল্টাচ্ছে। টিভিতে দেখার মতো অনেক কিছু থাকলেও সে কিছুই দেখছেনা। তার মনে অস্থিরতা কাজ করছে খুব। অনিমের এই টিভি দেখাটা হচ্ছে অস্থিরতা ঢেকে রাখার একটা বাহানা মাত্র। তার এই মুহূর্তে ইচ্ছে হচ্ছে শিমুলকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেতে। কিন্তু সে কাজটা করতে পারছেনা। কিছু একটা তাকে বেঁধে রাখছে। শিমুলও খুব করে চাইছে অনিম তাকে একটাবার এসে বুকে টেনে নিক। চাইলে সে মুখ ফুটে অনিমকে কথাটা বলতে পারতো। কিন্তু সেও কথাটা বলতে পারছে না। শিমুল তো এমন আবদার আজ পর্যন্ত অনিমের কাছে ধরেনি। তাহলে আজ সে কিভাবে কথাটা অনিমকে বলবে?

~চলবে~

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here