#দহন
#পর্ব_২০
#লেখা_মিম
-” শিমুল আমি কি তোমার কাছে আজ পর্যন্ত নিজের ভালোবাসা দাবী করেছি?”
-” না, তা করেন নি। ভবিষৎ এ যদি করেন তাই আপনাকে আগেই বলে দিলাম।”
-” আজ পর্যন্ত করিনি। কোনোদিন করবোও না। আমি তোমাকে ভালোবাসি। সেটা আমি পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকবে।কোনোদিনই তোমার পর্যন্ত আমি যেতে দিবো না।”
-” তাহলে আমার একটা কথা রাখবেন?”
-” বলো।”
-” আপনি আর আমার সাথে যোগাযোগ রাখবেন না। শুধু শুধু আপনার কষ্ট বাড়বে মুহিব ভাই। আমি চাইনা কেউ আমাকে ভালোবেসে কষ্ট পাক।”
-” কষ্ট আমার সয়ে গেছে শিমুল। ভালোবাসার মানুষকে অন্যের হাতে তুলে দেয়ার চেয়ে কষ্টের আর কি হতে পারে। তোমাদের বিয়ের পরদিন যখন দেখলাম অনিমের কানের পাশে তোমার নখের দাগ তখন আমার ভেতরে কেমন লেগেছিলো জানো? জানো না। তুমি চিন্তা করতে পারবে না কি পরিমান কষ্ট আমি হজম করেছি। এক কথায় বলতে পারো বিষ খেয়ে বিষ হজম করেছি আমি। সে জায়গায় তোমাকে দেখলে, কথা বললে আমার কষ্ট লাগবে এটা তোমার ভুল ধারনা। আমার এসব সয়ে গেছে।”
-” কেনো মুহিব ভাই? আমি কি বলেছি আপনি বিষ খেয়ে হজম করেন?”
-” নাহ্, তুমি বলতে যাবে কেনো? এটা সম্পূর্নই আমার ব্যাক্তিগত মতামত।”
-” এভাবে আর কতদিন মুহিব ভাই?”
-” জানি নাহ্।”
-” অহেতুক কষ্ট পাচ্ছেন আপনি। হাজার গুনে ভালো মেয়ে আপনি পাবেন। শুধু শুধু আমার পিছনে কেনো…..”
-” ওয়েট শিমুল। আমি কিন্তু তোমাকে বলিনি আমাকে তোমার ভালোবাসতে হবে। তোমার উপর আমি কোনো অধিকারও খাটাতে আসিনি। আমার মনে যা চলছে সেটা শুধুই আমার ভিতর পর্যন্তই থাকবে। আমি যেহেতু তোমাকে কোনো জোর করছি না তেমনি তুমিও আমার মনের উপর জোর খাটাতে পারবে না। আমি কাকে ভালোবাসবো, কাকে ভালোবেসে কষ্ট পাবো সেটা একান্তই আমার মনের ব্যাপার। সেখানে অন্য কারো হস্তক্ষেপ আমি মানবো না।”
-” মুহিব তোমার কথা আমার একদমই পছন্দ হচ্ছে না। শিমুলকে তোমার কথা বলার পিছনে উদ্দেশ্য ছিলো যাতে তোমার ব্যাপারটার একটা সুরাহা হোক। এখন তো দেখছি তোমার কোনো সুরাহা করার ইচ্ছাই নেই। শিমুলকে তুমি ভালোবাসো। ওর উপর কি তোমার কোনো দাবীই নেই।?”
-” না নেই। দাবী খাটানোর জন্য ওকে আমি ভালোবাসিনি।”
-” মুহিব, শিমল বিদেশ চলে যাচ্ছে। ফের কবে আসবে জানি না। কোনোদিন নাও আসতেপারে। তুমি কি এভাবে ওকে চলে যেতে দিবে?”
-” বিদেশ কেনো যাবে?”
-” গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করতে। সেখানে যেয়ে ও নিজের মতো করে বাঁচতে চায়। ভালো থাকতে চায়।”
-” হুম, খুবই ভালো সিদ্ধান্ত। ও যদি নিজের মতো বাঁচতে চায় তবে এতে খারাপ কি আছে? ওর সিদ্ধান্তটা তো কোনো দিক দিয়েই খারাপ দেখছি না।”
নদী একরাশ বিস্ময় নিয়ে মুহিবের দিকে তাকিয়ে আছে। কি বলছে এসব? শিমুলকে আবার ফিরে পাওয়ার একটা সুযোগ ও এভাবে যেতে দিচ্ছে?
-” তোমার কোনো আপত্তি নেই?”
-” না নেই।”
-” মুহিব, শিমুল অনেক দূরে চলে যাচ্ছে। ও আর কখনো তোমার নাও হতে পারে।”
-” শিমুল কখনোই আমার ছিলো না। ওকে কখনো আমি নিজের বলে দাবী করিনি। কখনো করবোও না। আপা, আমার একটা ভুল সিদ্ধান্তের জন্য শিমুলকে এতটা ভুগতে হয়েছে। সেই যন্ত্রনায় জ্বলে পুড়ে মরছি। ও যদি এখন দূরে যেয়ে নিজের মতো করে বাঁচতে শিখতে চায় তো শিখুক না। আমি ওকে ভালোবাসি তাই চাচ্ছি ও সুখে থাকুক। যেভাবে ও সুখে থাকতে চায় সেভাবেই থাকুক।”
-” অযৌক্তিক কথা বলছো তুমি।”
-” মোটেই না। শোনো শিমুল, কেউ তোমাকে সাপোর্ট করুক আর না করুক আমি করবো। কোন দেশে যেতে চাও, কোথায় ভর্তি হতে চাও আমাকে বলো। আমি সব ব্যবস্থা করে দিবো। টাকা পয়সা লাগলে আমিই দিবো। তবু তুমি তোমার জীবনটাকে সুন্দর ভাবে গড়ে তুলো। আর শোনো, আমাকে নিয়ে ভাবার দরকার নেই। এতদিন তোমার আমার সম্পর্কটা যেভাবে চলছিলো সেভাবেই চলবে। ধরে নাও তুমি এই সম্পর্কে কিছুই জানো না। নদী আপা তোমাকে কিছুই বলেনি। ভার্সিটিতে ভর্তির সেশন কবে জানো?”
-” সেপ্টেম্বরে।”
-” এখন তো ফেব্রুয়ারী চলছে। পাসপোর্ট ভিসা সবকিছু প্রসেস হতে হতে সেপ্টেম্বর চলে আসবে। পাসপোর্টের এপ্লিকেশন কবে নাগাদ সাবমিট করতে চাচ্ছো?”
-” কালই একবার পাসপোর্ট অফিসে যেতে চাচ্ছি।”
-” আমি কি যাবো তোমার সাথে?”
-” গেলে ভালো হয়।”
-” ঠিকাছে কাল সকালে রেডি হয়ে আমাকে ফোন দিও। আমি চলে আসবো তোমাকে পিক করতে। এরপর একসাথে যাবো।”
মুহিবের এমন কথা বার্তায় ভয়ানক ক্ষেপে গেছে নদী। মুহিবের এবারের সিদ্ধান্তও তার পছন্দ হচ্ছে না। মুহিবের দিকে ভ্রু কুঁচকে বললো,
-” তুমি কি জানো তুমি কি সিদ্ধান্ত নিচ্ছো? তুমি আবারও ভুল সিদ্ধান্ত নিচ্ছো মুহিব। চারবছর আগের নেয়া সিদ্ধান্তটা যেমন আজ এসে তোমাকে ভোগাচ্ছে তেমনি এখনকার এই সিদ্ধান্তটাও তোমাকে ভোগাবে। কথাটা তুমি মনে রেখো।”
কথাটা বলেই হনহন করে চলে গেলো নদী।
রাত সাড়ে বারোটা…….
অনিমের ঘরে ভালোবাসার জোয়ার বইছে। সেই জুয়ারে ডুব দিচ্ছে দুজন মানুষ। খুনসুটি ভালোবাসা সবই চলছে অবলীলায়। আষ্ঠেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে একে অন্যকে। কন্ঠে একরাশ আহ্লাদ ঢেলে দিয়ে নীলা আবদার ধরলো,
-” আমি মা হতে চাই। তোমার সন্তানের মা।।”
অনিম নীলার কানে মুখ গুঁজে বললো,
-” আমিও চাই তুমি মা হও। আমার সন্তানের মা।”
-” এখনই চাই……”
ফের ভালোবাসার সাগরে ডুব দিয়েছে দুজন। এতটাই ডুবে গেছে যে অনিমের খেয়ালই নেই ঠিক সাড়ে তিনমাস আগে এই রুমটাতেই অন্য কাউকে এভাবে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছিল কাউকে।
আজ রাত সাড়ে এগারোটায় শিমুলের ফ্লাইট। বিদেশ যাওয়ার ব্যাপারে পুরোপুরি সহায়তা করেছে মুহিব। শিমুলের ঘরের লোকদেরকেও মুহিবই মানিয়েছে। শিমুলের খালা সেখানে বাসা ঠিক করে রেখেছে। খালা তার নিজের বাসার কাছেই ভাড়া নিয়েছে শিমুলের জন্য। একটা বাঙালি ফ্যামিলির সাথে সাবলেটে থাকবে ও। শিমুল যে ভার্সিটিতে ভর্তি হতে চাচ্ছে সেখানকার ভর্তি কার্যক্রম শুরু হয়ে গেছে আরও পাঁচদিন আগেই। শিমুলের হাতে একদমই সময় নেই। ইংল্যান্ডের মাটিতে পা দিয়েই শুরু হবে দৌড়াদৌড়ি। ভার্সিটিতে এডমিশন নিতে হবে। একটা পার্ট টাইম জব খুঁজতে হবে। সেখানকার পথঘাট সব চিনে নিতে হবে। তবে বিশেষ সমস্যা হবে না। খালা তো আছেই সেখানে। খালাতো ভাই বোনরা ওকে এসব ব্যাপারে সাহায্য করবে। বাসার সবকয়টা মানুষের মন খারাপ। বৃষ্টি আর আফসানার কান্নাকাটি শুরু হয়েছে আরও এক সপ্তাহ আগে থেকেই। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তাদের একটাই অনুরোধ শিমুলের কাছে, বিদেশ যেয়ে প্রতিদিন ফোন করবি আর গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করে সোজা দেশে চলে আসবি। সেখানে সেটেল হওয়ার চিন্তা একদমই করবি না।
বাসার সবাই এয়ারপোর্টে শিমুলের সাথে এসেছে। সঙ্গে এসেছে মুহিবও। তার চোখে মুখে কোনো কষ্টের ছাপ দেখা যাচ্ছে না। একদম স্বাভাবিক দেখাচ্ছে ওকে। নদী ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বারবার মুহিবের দিকে তাকাচ্ছে ওর মতিগতি বুঝার জন্য। মনে মনে সে খুবই অবাক হচ্ছে একটা মানুষ এমন পরিস্থিতিতে এতটা স্বাভাবিক কিভাবে থাকতে পারে। খুব সুন্দর করে শিমুলকে মুহিব এটা সেটা বুঝাচ্ছে। শুধু আজই না, বিগত কয়েক মাসে মুহিবই শিমুলকে আগলে রেখেছিলো। অনেকটা শক্ত করে তুলেছে শিমুলকে সে। আর অনিম? অনিমকে শিমুল ভুলতে পারেনি। তবে হ্যা আগের মতো আর মনের শীর্ষস্থানে অনিমের জায়গাটা নেই। সেখান থেকে সরিয়ে দিয়েছে অনেক আগেই। হুটহাট কখনো মাঝরাতে অথবা শেষ বিকেলের দিকে অনিমের কথা ভেবে নীরবে চোখের জল ফেলে শিমুল। এতদিনের সম্পর্কটা কি আর এত সহজে ভুলা যায়? হ্যা কিছু মানুষ আছে ভুলে যায়। অনিমের মতো মানুষেরা।
ঘড়িতে এখন সাড়ে এগারোটা বাজে। প্লেন টেক অফ করছে। বাংলাদেশের মাটি ছেড়ে রওয়ানা হচ্ছে বিমানটি। একরাশ কষ্টগুলোকে মাটি চাপা দিয়ে নতুন জীবনের দিকে এগোচ্ছে শিমুল। সাথে করে নিয়ে যাচ্ছে প্রিয় মানুষদের অভিমান আর নিজের একঝাঁক স্বপ্ন। সবগুলো স্বপ্ন বাস্তবায়ন হবে কিনা তা জানা নেই শিমুলের। তবে স্বপ্নপূরনের চেষ্টায় কোনো ত্রুটি রাখবে না সে। শিমুল এখন মুহিবের কথা ভাবছে। মানুষটা ওকে অনেক সাহায্য করেছে। কোনো স্বার্থ ছাড়াই। মানুষটার কাছে ঋনী হয়ে আছে শিমুল। এই ঋন মেটাবার মতো সাধ্য তার নেই। মুহিবকে মন ভরে দোয়া করার বেশি আর কিছুই করতে পারবে না সে। মনের দুয়ার তো অনিমের জন্য খোলা ছিলো। সে দুয়ারে আজ খিল পড়েছে। ফের এই দুয়ার খোলা সম্ভব না শিমুলের। তবে মুহিবও আজ পর্যন্ত মুখ ফুটে কোনো দাবী করেনি। এমন কি আজ চলে আসার সময় অন্য সবার মতো বলেনি ফোন করো, যোগাযোগ রেখো। শুধু চোখে চোখ রেখে বলেছে, আল্লাহ হাফেজ শিমুল। খুব ভালো থেকো। তোমার জীবনের কানায় কানায় সুখ ভরে উঠুক।
মুহিব তাকে ফোন দিতে বলেনি তাতে কি? সে দিবে। মাঝেমাঝে ফোন করবে মুহিবকে সে। খোঁজ খবর নিবে মানুষটার। যে মানুষটা তার জন্য এতকিছু করেছে তাকে এভাবে বেমালুম ভুলে যাওয়াটা ঠিক হবে না। এতটা বেঈমান সে না। আচ্ছা অনিম কি জানে শিমুল চলে যাচ্ছে? তবে অবশ্য জানলেই কি আর না জানলেই কি? সে তো আর শিমুলকে মনে গেঁথে বসে নেই যে শিমুল চলে গেলে তার কিছু আসবে যাবে। অনিম যেভাবে শিমুলকে ভুলে গেছে সেভাবে শিমুলও যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওকে ভুলে গেলেই ভালো হবে।
দুমাস হলো শিমুল ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে। ম্যাকডোনাল্ডে পার্ট টাইম জব করছে একমাস হলো। প্রতিমাসে যদিও বাংলাদেশ থেকে ওর জন্য টাকা পাঠানো হয়। তবুও সে পার্ট টাইম জব নিয়েছে। ইতিমধ্যে বন্ধুবান্ধবও জুটিয়ে ফেলেছে ভার্সিটিতে। ভালোই চলছে দিনকাল। নতুন জায়গা, নতুন পরিবেশ, নতুন ভার্সিটি জব বন্ধুবান্ধব সব মিলিয়ে ভীষন ব্যস্ত সময় কাটছে শিমুলের। একাকিত্বটা এখন আর তেমন একটা জেঁকে ধরে না ওকে। প্রতিদিন নিয়ম করে পরিবারের লোকদের সাথে কথা হয় শিমুলের। তবুও তাদের অভিযোগ রয়েই যায় শিমুলকে নিয়ে। শিমুল তাদেরকে ভুলে গেছে। আর সবাই অভিযোগ করলেও একটা মানুষ অভিযোগ করে না। সেটা হচ্ছে মুহিব। শিমুল কখনোই তার গলার স্বরে কোনো অভিযোগ পায় না। ১৫-২০ দিন পরপর বিশ মিনিট কিংবা আধাঘন্টা কথা হয় তাদের মাঝে। আর চার পাঁচদিনে একবার মেসেন্জারে টুকটাক চ্যাট হয়। কখনো মুহিব শিমুল ফোন করে কখনোবা শিমুল মুহিবকে। তবে শিমুলই ফোন বেশি করে মুহিবের তুলনায়। প্রতিবারই ফোন রাখার আগে শিমুলকে মুহিব বলে,
-” কোনো প্রয়োজন হলে আমাকে জানিও।”
শিমুল প্রত্যুত্তরে বলে,
-” আপনাকে আর কত জ্বালাবো মুহিব ভাই? অনেক তো করলেন আমার জন্য। আর কত করবেন?”
মুহিব প্রত্যুত্তরে কিছুই বলে না। খুব করে ইচ্ছে হয় বলতে, তোমার জন্য সব করতে পারি, আজীবন ধরে করতে পারি। কিন্তু মনের কথাটা আর মুখ পর্যন্ত ফুটে আসে না।
অনিমের সংসারে আজ দু সপ্তাহ হলো আগের মতো আর ভালোবাসার জোয়ার নেই। জোয়ার অনেকটাই স্তিমিত হয়ে এসেছে। সেদিন রাতে সন্তানের মা হওয়ার আবদার রাখার পর পুরো আটমাস চেষ্টা করার পরও যখন কোনো খুশির সংবাদ নীলা শুনতে পায়নি তখনই সে সিদ্ধান্ত নেয় ডাক্তার দেখানোর। যাবতীয় পরীক্ষা নীরিক্ষা করানোর পর জানা গেলো নীলা পুরোপুরি সুস্থ। যাবতীয় সমস্যা যা আছে সব অনিমের মধ্যে। বাবা হওয়ার ক্ষমতা তার মধ্যে নেই। পুরোপুরি নেই বললে ভুল হবে। আছে, তবে সেই ক্ষমতাটুকু খুবই স্বল্প। ডাক্তার এই স্বল্প ক্ষমতার উপরই আশা করে বেশ কয়েকটাঔষধ প্রেসক্রাইব করেছেন। তার ধারনা ঔষধগুলো নিয়মমতো চালিয়ে যেতে পারলে সে সন্তানের বাবা হতে পারবে। তবে ডাক্তার নিশ্চিত হয়ে কথাটা বলতে পারেনি।কাজ হতেও পারে নাও হতে পারে। ফিফটি-ফিফটি চান্স। সেদিন রাত থেকেই তাদের সংসারে সুখের ভাটা পড়েছে। নীলা হসপিটাল থেকে ফিরেই রুমের দরজা লাগিয়ে বিছানায় উপুর হয়ে শুয়ে হাউমাউ করে কেঁদেছে। কিছুক্ষন বিরতি দিয়ে দিয়ে সারারাত ধরেই কেঁদেছে সে। আর অনিম দরজার বাইরে সারারাত বসে নীরবে চোখের পানি ফেলেছে। কয়েকবার নীলাকে ডেকেছে ভেতর থেকে কোনো কান্নার আওয়াজ ছাড়া কোনো সাড়াশব্দ আসেনি। হুট করেই সে রাতে অনিমের মনে পড়ে গেলো শিমুলের সেই চিঠির কথা। চিঠিটা হাতে দিয়ে মুহিব বলেছিলো শেষের কথাগুলো নাকি শিমুলের তরফ থেকে দোয়া না, সেগুলো একেকটা অভিশাপ। কি লিখা ছিলো চিঠিটাতে? অনিম সেদিন চিঠিটা পড়েনি। বাসায় এসে সোফার উপর রেখে বেডরুমে চলে গিয়েছিলো নীলার কাছে। এরপর চিঠিটা যে কোথায় গেছে এ ব্যাপারে কিছুই জানা নেই অনিমের। খুব ইচ্ছে হচ্ছিলো চিঠিটা পড়তে সেদিন। কিন্তু সে এই চিঠি পাবে কোথায়?
রাত আড়াইটা বাজে। ভালোবাসার পর্ব চুকিয়ে ঘন্টাখানেক আগেই ঘুমিয়েছে নীলা। কিন্তু চোখে ঘুম নেই অনিমের। সেদিনের পর থেকে তারা দুজন কাছাকাছি আসছে ঠিকই তবে সেটা শুধুমাত্র প্রয়োজনের তাগিদে। এখানে ভালোবাসা বা আন্তরিকতার কোনো স্পর্শ পাওয়া যাচ্ছে না আজকাল। অনিমের চোখের ঘুমটাও উড়ে গেছে দু সপ্তাহ আগে হসপিটালে ডাক্তারের মুখে সেসব কথা শোনার পর থেকে। মাথায় একটা প্রশ্ন বারবার জাগছে। কি অভিশাপ দিয়েছিলো শিমুল? আচ্ছা অভিশাপ টা কি তবে লেগেই গেলো? না না তেমন কিছু না। ডাক্তার তো বলেছেই ঔষধগুলো খেলে ঠিক হয়ে যাবে। তাহলে কেনো সে এসব বাজে কথা চিন্তা করছে? সময় তো আর শেষ হয়ে যায়নি। সবে তো দু সপ্তাহ হলো ঔষধগুলো সে খাচ্ছে। আরও দুই তিনমাস যাক এরপর না হয় দেখা যাবে।
ভোরের দিকে চোখটা লেগে এসেছিলো অনিমের। সকাল সাড়ে আটটার দিকে চিল্লাচিল্লির আওয়াজে ঘুম ভেঙে গিয়েছে তার। শোয়া থেকে উঠে বসেছে সে। আওয়াজটা ড্রইংরুম থেকে আসছে। বিছানা ছেড়ে অনিম এগিয়ে গেলো সেখানে।
-” তুই আমার কথা শোন নীলা। আমি তোর মা। অহেতুক তর্ক না করে ব্যাগ প্যাক কর। এক্ষুনি তুই আমার সাথে বাসায় ফিরে যাবি।”
-” ……………….”
-” কি আশ্চর্য! তোকে কি বলছি কানে যাচ্ছে না? ”
-” মা আপনি নীলাকে নিয়ে যেতে চাচ্ছেন কেনো? আর এত সকালে চিল্লাচিল্লিই বা কেনো করছেন?
-” আমার মেয়েকে আর তোমার সংসার করতে দিবো না।”
-” কেনো?”
-” কেনো আবার কি? তুমি এই জীবনেও বাচ্চার বাপ হতে পারবে না। আমার মেয়ের ভবিষৎ অন্ধকার তোমার কাছে।”
-” এগুলো কি ধরনের কথা? ডাক্তার তো ঔষধ দিয়েছেই। আপনি এখনই এত অস্থির হচ্ছেন কেনো?”
-” এসব ঔষধে কোনো কাজ হবে না। আমার মেয়ের সামনে পুরো জীবনটাই পড়ে আছে। এভাবে ওর জীবন ধ্বংস হতে দিতে পারিনা আমি।”
-” এখানে জীবন ধ্বংসের কি দেখলেন আপনি? এই নীলা, তুমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে কি এসব শুনতেই থাকবে? কিছু বলছো না কেনো তুমি তোমার মা কে?”
-” কি বলবো মা কে? খারাপ তো কিছু বলেনি।”
-” তারমানে তুমিও উনার সাথে একমত? তুমি এই সংসার আর করতে চাচ্ছো না?”
-” আমি কখন বললাম সংসার করবো না? সংসার করবো। দেখো আম্মু, ডক্টর তো আরও টাইম দিয়েছে। সবে দু সপ্তাহ গেলো। আমি এখনই কোনো সিদ্ধান্তে যাবো না। আমি আরও দেখতে চাই। অনিমকে ভালোবাসি আমি। এভাবে তো আর ওকে ছেড়ে যেতে পারি না। যাক না আরও কয়েক মাস। এরপর না হয় সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে।
(চলবে)