#দুপাতার_পদ্ম
#পর্ব_২৬
#Writer_Fatema_Khan
আয়াত মেহেরের হাত ধরে তার দিকে ফেরালে মেহের ভয় পেয়ে যায়। হঠাৎ করে টান দেওয়ায় মেহের আয়াতের হাতের দুই পাশে থাকা টি-শার্ট টা আকড়ে ধরে।
“কি হচ্ছে কি আয়াত?”
“কার এতবড় সাহস মেহের আর তুমিই বা আমাকে কিছু বলনি কেনো?”
“কার সাহস আর আপনাকে কি বলব! হাত ছাড়ুন আমার লাগছে।”
“তুমি কেনো লুকাচ্ছো বলো আমাকে, তুমি একদম ভয় পেয়ো না আমি আছি তো।”
“জ্বরের ঘোরে উলটা পালটা বকছেন আপনি। একটু ঘুমান শরীর ঠিক লাগবে।”
এবার আয়াত রেগে মেহেরকে নিজের কাছে টেনে দুই বাহুতে ধরে বলে,
“তোমাকে কে ছুয়েছে মেহের? এতটা গভীর ভাবে তোমাকে ছোয়ার অধিকার আমি কাউকে দেই নি। আর না তোমার অনুমতি আছে কাউকে দেওয়ার। আমার চুপ করে থাকা বা তোমার থেমে দূরে থাকার সুবিধা অন্তত কেউ নিতে পারে না।”
“ছাড়ুন আমাকে আর এসব আবোল তাবোল বলা বন্ধ করুন।”
আয়াত মেহেরকে ছেড়ে দুই হাতে নিজের চুলে মুঠ করে ধরে রাগ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টায় আছে।
“ঠিক আছে আমিই আবোল তাবোল বলছি, কিন্তু তোমার গলায় কামড়ের দাগ কেনো সেটা জানতে পারি? আর কেই ই বা তোমার এত কাছে ছিলো যে এত গভীর ভাবে ছুয়েছে?”
আয়াতের কথা শুনেই মেহের নিজের গলায় হাত রাখে। তাড়াতাড়ি ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে ওড়না আরেকটু সরিয়ে দেখে সত্যি সত্যি গলায় একটা কামড়ের দাগ৷ মেহের আয়াতের দিকে করুন চোখে তাকায়। মেহের নিজের মনেই ভাবতে থাকে,
“মানে কাল রাতে আয়াতের বলা কথা আয়াতের কিছুই মনে নেই আর না মনে আছে হঠাৎ কিছু মুহূর্তের জন্য কাছে আসার সময়টা।”
আয়াত আয়নায় মেহেরকে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলে,
“কি হলো বলো কে করেছে এটা?”
“যদি বলি কাল রাতে আপনি করেছেন, তাহলে মানবেন?”
“আমি! আমার চিন্তা ভাবনাতেও কখনো এটা আসেনি যে কোনো অধিকার ছাড়া তোমায় ছুতে আর এখানে তো খুব গভীর ভাবে ছোয়া হয়েছে।”
“কাল রাতে আপনি বিকেলের পর আর নিচে নামেন নি সাথে খাবারও খান নি। তাই আমি নিজেই আপনার জন্য রাতের খাবার নিয়ে এসেছিলাম। এসে দেখি আপনার গায়ে অনেক জ্বর। তাই আপনাকে জোর করে খাইয়ে ওষুধ খাইয়ে দেই। তারপর হঠাৎ আপনি আমাকে জড়িয়ে করে গলায় মুখ ডুবান৷ এর ফলেই এই অবস্থা আমার গলার। আর কিছু শুনতে চান?”
দাঁড়ানো থেমে খাটের উপর বসে পরে আয়াত৷ হাত দিয়ে মুখ ঢেকে বলে,
“কি করে এমন অন্যায় আমি করে ফেললাম, তাও তোমার সাথে! যেখানে তুমি আগে থেকেই আমাকে ভুল বুঝে বসে আছো আর আমি কিনা আরও ভুল করে বসে আছি।”
“আমি আপনাকে ভুল বুঝি নি, আমি জানি আপনার সাথে আরশির কোনো সম্পর্ক নেই। তবে খারাপ লাগে নি এটা বলব না।”
আয়াতের চোখ যেনো চকচক করে উঠলো। মেহেরের দিকে তাকিয়ে বললো,
“কেনো খারাপ লেগেছে? আমাকে তো তুমি দূরেই ঠেলে দিতে চাও। আমি বেহায়ার মতো পেছনে পরে থাকি। তাহলে তোমার খারাপ লাগছে কেনো?”
“জানি না। তবে আমার এভাবে রিয়েক্ট করা উচিত হয় নি। আর রাতে আপনাকে এই অবস্থায় দেখেও আমার ভালো লাগে নি। হয়তো আমার জন্যই আপনার কাল রাতে এতটা জ্বর এসেছিল। আর আপনি জ্বরের ঘোরেও আমাকে বুঝানোর চেষ্টায় ছিলেন আপনি কিছুই করেন নি।”
“আমি জানি কেনো খারাপ লেগেছে তোমার আর এটাও জানি তুমি নিজেও জানো ঠিক কি কারণে তোমার খারাপ লেগেছে।”
“সবাই ঘুম থেকে উঠে পরবে আমার যাওয়া দরকার।”
মেহের টেবিল থেকে স্যুপের বাটিটা নিয়ে বের হতে গেলে আয়াত তার হাত ধরে ফেলে। তারপর হাত থেকে স্যুপের বাটিটা নিয়ে আবার টেবিলে রেখে দেয়৷
“আয়াত আমার নিচে যাওয়া উচিত এবার। এতক্ষণ সবাই নিজেদের ঘরে থাকলেও এখন সবাই উঠে গেছে হবে।”
আয়াত মেহেরের কানের কাছে এসে বলে,
“আমি তোমাকে এত ভোরে এখানে আসতে বলেছি, বলেছি আমার জ্বর আমাকে স্যুপ বানিয়ে খাওয়াও আমি সুস্থ হয়ে যাব। আমার মনে হয় না আমি এসবের একটাও বলেছি। তবে আসলে কেনো, আর এসেই যখন গেছো আমার সব কাজ শেষ হলেই যাবে।”
‘কি কাজ?”
আয়াত হেসে মেহেরের হাত ছেড়ে সামনে থাকা ওষুধের বাক্স থেমে একটা মলম বের করে মেহেরের সামনে বসে। মেহেরের গলার কাছের ওড়না কিছুটা নিচে নামিয়ে মলম লাগিয়ে দিলো লাল হয়ে যাওয়া কামড়ের যায়গায়৷ মেহের আয়াতের ছোয়ায় কেপে কেপে উঠছে যা আয়াত খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে। এমন অস্বস্তিকর পরিবেশ থেকে বের হওয়ার জন্য আয়াত তাড়াতাড়ি মলম লাগিয়ে দেয়। সরে যেতে নিলে আয়াত মেহেরের কম্পমান ঠোঁটের দিকে তাকায়৷ চোখ আটকে যায় সেখানে৷ আয়াত যেনো তলিয়ে যাবে এই কম্পমান ঠোঁটের সাথে। আয়াত নিজেকে সংযত করে উঠে দাঁড়ায়।
“হয়ে গেছে।”
আয়াতের গলার শব্দ শুনে মেহের তাকায় আয়াতের দিকে। তবে কোনো শব্দ ব্যয় করে না৷ মেহেরের কোনো শব্দের সন্ধান না পেয়ে আয়াত পেছনে তাকায়৷ মেহের তার দিকেই তাকিয়ে আছে। কেশে গলা পরিষ্কার করে বললো,
“এতক্ষণ তো যাওয়ার জন্য। মরিয়া হয়ে উঠছিলে এখন যাচ্ছ না কেনো? আমার ঘুম পাচ্ছে আমি ঘুমাব। আর তুমিও তো অফিস যাবে তাই না। তাহলে নিচে যাও।”
মেহের এমন কিছুর আশা করে নি। সে উঠে স্যুপের বাটি নিয়ে দরজা খুলে বাইরে বেরুতে নিলে আবার আয়াত বলে উঠলো,
“গলার দিকটা ওড়না দিয়ে ভালো করে ঢেকে রাখো, বাড়ির বড়রা দেখলে খারাপ লাগবে তাদের আর কাসফির চোখেও যেনো না পরে। ও পিচ্চি মানুষ কি বলতে কি বলে ফেলবে বাবা আর চাচার সামনে।”
মাথা নেড়ে হ্যাঁ বোধক বুঝিয়ে সে নিচে চলে গেলো। রান্নাঘরের দিকে যেতে নিলে ওইখানে তার মা আর চাচীকে দেখে বাটি সমেত নিজের ঘরে চলে গেলো মেহের। সে চায় না বাসার কেউ জানুক মেহের এত ভোরে আয়াতের ঘরে ছিলো৷ তারা সবটা বুঝলেও জিনিসটা দেখতে দৃষ্টিকটু লাগে। তাই মেহের নিজের ঘরে এসে গোসলে চলে গেলো। প্রায় আধা ঘণ্টা পর গোসল সেড়ে বের হয়ে মেহের অফিসের জন্য তৈরি হয়ে নিলো। তারপর মাহিকে ঘুম থেকে তুলে ফ্রেশ করিয়ে নিলো। রান্নাঘর থেমে মাহির খাবার এনে খাইয়ে দিয়ে অফিসের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে গেলো। আরেকবার আয়াতের খোঁজ নেওয়ার ইচ্ছা থাকলেও তা আর হয়ে উঠলো না মস্তিষ্কের জোরে।
আজ অফিসে অনেক কাজ থাকায় মেহেরের আসতে রাত হয়ে গেলো। রাত তখন ৮টা ছুই ছুই৷ মেহেরের বাবা আর চাচা এসে গেছেন নির্দিষ্ট সময়েই। মেহেরের বাবা অসুস্থ বলেই মেহের জোর করে তার বাবাকে বাসায় পাঠিয়ে দেয় সাথে চাচাকেও বলে সে নিজে এদিকটা সামলে নিবে তার চাচা যেনো তার বাবার সাথেই থাকে৷ তাই তারা দুইজনেই বাধ্য হয়ে চলে এলো৷ মেহের কোনোমতে ফ্রেশ হয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। আজ তার বড্ড ক্লান্ত লাগছে৷ রাতেও ঘুম হয় নি আর সেই ভোরে উঠেছিলো। ভেবেছে অফিস থেকে তাড়াতাড়ি চলে আসবে তা আর হলো কই। চোখে যেনো রাজ্যের ঘুম এসে ভর করেছে। এতটাই ক্লান্ত ছিলো মেহের যে ওই সময় টাতেই ঘুমিয়ে পরে।
রাত তখন ১১টা বাজে। মেহেরের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে কেউ আর মেহেরকে জাগায়ে ব্যস্ত। মেহেরের উদ্দেশ্যে বললো,
“মেহের, মেহের। রাত ১১টা বাজে মা সেই কখন অফিস থেকে আসলি কিছুই তো মুখে দিলি না। উঠে কিছু খেয়ে নে তারপর না হয় আবার ঘুমিয়ে যাবি।”
কারো এমন ডাকে মেহের পিটপিট করে চোখ খুলে তাকায়। সামনে নিজের বাবাকে দেখে ঘুমঘুম চোখেই হালকা হাসে মেহের। আড়মোড়া দিয়ে উঠে বসে।
“বাবা তুমি এখনো ঘুমাও নি কেনো? তোমার যে শরীর খারাপ তা কি করে ভুলে যাও বলো।”
“এইতো এখন ঘুমাতেই যাব। তার আগে ভাবলাম আমার রাজকন্যাকে কিছু খাইয়ে আসি।”
সেন্টার টেবিলের উপর খাবারের প্লেট এনে মেহেরের সামনে রাখেন মেহেরের বাবা। তারপর বলেন,
“যা হাত মুখ ধুয়ে খেতে আয়।”
মেহেরও আর কথা না বাড়িয়ে ওয়াশরুমের দিকে চলে গেলো। মিনিট দশেক পর মেহের বাবার সামনে এসে বসে। প্লেট হাতে নিয়ে খাওয়া শুরু করে। খাওয়া শেষ করে নেয় ঝটপট। তারপর হাত ধুয়ে বাবাকে বলে,
‘প্রচন্ড খিদে পেয়েছিলো বাবা, কিন্তু সাথে এতটা টায়ার্ড ছিলাম কি বলব। তাই আর নিচে গিয়ে খাওয়ার ইচ্ছেই ছিলো না। তাই তো ঘুনিয়ে পরেছিলাম। কিন্তু এখন অনেকক্ষণ ঘুমানোর ফলে ফ্রেশ লাগছে আর এখন খেয়ে তো পুরাই তরতাজা লাগছে মন আর শরীর৷”
“অনেকদিন পর তোকে এভাবে বাচ্চাদের মতো কথা বলতে দেখলাম। না হলে তো আমার বাচ্চা মেহের কোথায় যেনো হারিয়েই গেছিলো৷ যে কিনা সবার কাছে গম্ভীর হলেও তার বাবার কাছে সব খুলে বলতো৷ আজ আবার এভাবে দেখে ভালো লাগলো।”
মেহের বিছানার নিচে ফ্লোরে বসে বাবার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পরে। মেহেরের বাবাও যত্ন করে মেয়ের চুলে বিলি কেটে দেয়৷
“বাবা মাহি কোথায়? বাসায় এসে একবারের জন্যও মেয়েটাকে দেখলাম না।”
“তুই যখন বাসায় আসলি তখন আয়াতের কাছে ছিলো ছাদে। এখন তো তোর মায়ের কাছে ঘুমাচ্ছে। থাক না আজ তোর মায়ের কাছে।”
“ওহ।”
“আজ মা ছেলে মিলে গল্প করি।”
“হুম।”
“কি ভাবছিস মা?”
“বাবা আমি কিছুই বুঝতে পারি না।”
“কি নিয়ে?”
“আয়াত।”
চলবে,,,,,#দুপাতার_পদ্ম
#পর্ব_২৭
#Writer_Fatema_Khan
কাঠফাটা রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে আয়াত৷ ঘেমে ভিজে গেছে তার পরনের ধুসর রঙের শার্ট টা। অপেক্ষা করছে নির্ধারিত বাসের জন্য। আজ পাঁচ বছর পর সে তার বন্ধুদের সাথে ট্যুরে যাচ্ছে৷ গায়ে এখন আর জ্বর নেই তবে দূর্বলতা আছে কিছুটা৷ রাস্তার মোড়ে বাস এসে থামলে আয়াত তাতে উঠে পরে। বাস চললো বান্দরবানের উদ্দেশ্যে।
“কিরে দোস্ত অনেক দিন পর ঘুরার প্ল্যান, আমরা তো তুই দেশে আসার পর পরই কোথাও ঘুরতে যাওয়ার প্ল্যান করতে বললাম। কিন্তু তুই মানা করে দিলি। তা হঠাৎ এমন ফোন করে সবাইকে নিয়ে দুইদিনের ভেতর প্ল্যান করলি? বাসায় সব ঠিক আছে, মানে মেহের আপু কি তোকে এক্সেপ্ট করে নি?”
আয়াতের ছোট বেলার ফ্রেন্ড আহনাফ প্রশ্নটি করে বসলো আয়াতকে৷ আয়াত কোনোরূপ ভনিতা না করেই বললো,
“তার নিজেরই জানা নেই সে কি চায়। আমি বুঝতে পারি তার দোটানা কিসের। সে এখনো আবির নামক লোকটা থেকে বেড়িয়ে আসতে পারে নি। সে যে এখন আবির আর আয়াত নামক দুইটা মানুষে আবদ্ধ। সে এখন এমন একটা রূপ যে দুইটা পদ্ম পাতায় যেনো একটি পদ্ম ফোটে তেমন। যা তাকে #দুপাতার_পদ্ম নামে আখ্যায়িত করে। আমি যে তাকে শুধু আমাতে রাঙাতে চাই। সেখানে অন্যকারো অস্তিত্ব থাকবে না। সে শুধুমাত্র আমার নামের পদ্ম হয়েই থাকবে। না থাকবে কোনো রূপ সংকোচ, না থাকবে দোটানা। তার অস্তিত্বে কেবল এই আয়াত থাকবে।”
“এতটা ভালোবাসিস!”
“তাকে না ভালোবেসে থাকা যায় বুঝি? কই আমিতো পারি নি। শত বাধা আছে আমাদের মাঝে। আর সবচেয়ে বড় বাধা মেহের নিজেই। তবুও আমি যখন ভালো না বেসে থাকতে পারি নি, আর পারবও না তার থেকে দূরে থাকতে। দূরে থাকার চেষ্টা করি নি এমনটা কিন্তু নয়, অনেক চেষ্টা করেছি। কিন্তু কি বলতো আহনাফ, এই বেহায়া মন তাকে দূরে থেকেও বিন্দুমাত্র ভুলতে পারে নি আর সেই মানুষটি যখন তার সামনে থাকে কি করে দূরে থাকা যায়?”
“তাহলে এখন এভাবে হঠাৎ দূরে যাওয়ার মানে কি? নাকি পালাচ্ছিস তার থেকে!”
“তার থেকে নয়, বরং নিজেকে কিছুটা স্পেস দিচ্ছি। একটু রিফ্রেশমেন্টের দরকার। আর মেহের নিজেও নিজেকে কিছুটা টাইম দিক। আমি সামনে থাকলে খালি পালাই পালাই করে। তার থেকে বরং আমার অবর্তমানে একটু নিজেকে জানুক, কি চায় তার মন সে বুঝুক। তবুও যদি সে ভাবে তার সাথে আমাকে সে মেনে নিবে না তবে তাই হোক। কখনো তার সাথে জোর করব না। কারণ জোর করে কারো ভালোবাসা পাওয়া যায় না। আর আমি শুধু মেহেরকে নয় সাথে মেহেরের ভালোবাসা চেয়েছি। যদি মেহেরের ভালোবাসাই না থাকে শুধু মানুষটা দিয়েই বা আমি কি সুখী হব? মানুষ বড্ড অদ্ভুত প্রাণী জানিস আহনাফ।”
“যেমন!”
“আমরা ভালোবাসি ভালো থাকার জন্য, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই আমরা ভালোবাসার মানুষের সাথে ভালো থাকি না। ভালো না থাকলে তখন আর সেখানে ভালোবাসা থাকে না। যা থাকে তা দায়বদ্ধতা। তখন সবাই সেই দায়বদ্ধতা থেকে বের হওয়ার চেষ্টায় থাকে। যেমনটা করেছে আবির মেহেরের সাথে। কিন্তু আমি চাই না এমনটা আবার মেহেরের সাথে হোক। আমিও যে ঠিক এমনটাই করব না মেহেরের সাথে তার কজ নিশ্চয়তা, আমিও কিন্তু একটা মানুষ। ভালো থাকার জন্যই কিন্তু মেহেরকে নিজের করে চাই, আর যদি ২, ৪, ৫ বছর পরও মেহের আমাকে ভালোবাসতে না পারে তখন হয়তো স্বার্থপর হয়ে যাব। আবার আমার মেহেরকে আমি সেই একই কষ্ট দিয়ে ফেলতে পারি। যা আমার মেহের সইতে পারবে না। তাই জোর করে নয় সে যেনো আমার হয় কিন্তু ভালোবেসে।”
“এত গভীর চিন্তা করিস না ভাই, তোর কথায় বুঝা যাচ্ছে তুই মেহেরের সাথে এমন কিছুই করবি না। তাই নিশ্চিন্ত থাক।”
“তুই আবারও ভুলে যাচ্ছিস, আমিও মানুষ। কারো ভালোবাসা পাওয়ার কাঙাল বলতে পারিস। যদি কখনো তা না পাই তার প্রতি হিংস্র হব না তার নিশ্চয়তা আমি দিতে পারছি না। মানুষ মাত্রই পরিবর্তনশীল। তাই মেহের আমার না হোক কিন্তু দশ বছর পর তাকে দেখে আমার মুখে যেনো হাসি ফুটে। মেহের যেনো হাসি মুখে আমার সাথে কথা বলতে পারে। কোনো সংকোচ না থাকে দুইজনের ভেতর। যা আবিরের জন্য এখন মেহেরের কাজ করে। প্রথম আমি মেহেরের ভালো বন্ধু পরে অন্য কিছু৷ মেহেরের সিদ্ধান্তকে আমি সম্মান করি। সে যা চায় তাই হবে। তার অপেক্ষায় আছি। কাছে এলে জড়িয়ে ধরব নিমিষেই আর না আসলেও আফসোস নেই। আমিতো জানি আমার ভালোবাসায় কোনো ঘাটতি ছিল না। আর না কখনো থাকবে।”
“সত্যি তুই কেমন যেনো আয়াত! মানুষ যেখানে নিজের ভালোবাসা ছিনিয়ে নেয় সেখানে তুই ছেড়ে দিয়েছিস। এই আশায় সে ফিরে আসবে তোর কাছে, আর না ফিরলেও আফসোস নেই।”
“বাদ দে। এই মুহূর্ত গুলো এনজয় করি। এটাই এখন আমাদের মূখ্য কাজ বুঝলি।”
“হুম।”
“আমরা খুশি না জেনেও নিজেকে খুশি রাখার প্রচেষ্টা। আমি জানি তুই ভালো থাকবি না যদি না মেহের আপু তোর না হয়। সামনে যদি সারাদিন ভালোবাসার মানুষটার বিচরণ থাকে তাহলে ব্যর্থ মানুষটা কি করে ভালো থাকে? তবুও ভালো থাকিস ভালোবাসা এটাই মন থেকে দোয়া। ভালো থাকবেন মেহের আপু তবে আমার বন্ধুর সাথে। আপনি ছাড়া যে সে ভেঙে পরবে তা আয়াত মুখে স্বীকার না করুক তার চোখ বলে দেয়। শত লুকানোর চেষ্টায়ও ব্যর্থ সে। বন্ধুত্ত্ব হয়তো এটাকেই বলে, শত না বলা কথাও বন্ধু বুঝে নেয়।”
আয়াতের বন্ধ চোখ জোড়ার দিকে তাকিয়ে মলিন হেসে ভাবনায় ডুব দেয় আহনাফ। আয়াতের দিক থেকে চোখ সরিয়ে পাশে তাকায়। বাসের জানালার দিকে তাকিয়ে ভাবে,
“এই পিছু ফেলে আসা গাছগুলোর ন্যায় আমরাও যদি নিজেদের দুঃখ গুলোকে পিছনে ফেলে আসতে পারতাম কত না সুখময় হতো প্রতিটি মানুষের জীবন। কিন্তু তা তো হবার নয়। আমাদের মন কোনো অচেনা পথ নয় যে, আমাদের সামনে আসা সবকিছুকেই আমরা উপেক্ষা করতে পারি। এটা মানুষের অক্ষমতাও বলা যায়, আমরা মানব জাতি নিজেদের কষ্ট ভুলতে পারি না। তেমনি আমিও ভুলতে পারি নি তাকে। সে যে মেহের বলতে পাগল আমার এই বন্ধুকে মন দিয়ে বসেছিলো। আমিও তো ভুলতে চেয়েছিলাম, কিন্তু ভুলা আর হলো কই? আমরা এমন কেনো নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি চাওয়া আমাদের? আচ্ছা সে কি জানে আয়াত মেহের আপুকে ভালোবাসে, নাকি এখনো সেই ভ্রমেই আছে আয়াতকে কোনো একদিন সে পাবে? বড্ড পীড়া দেও তুমি পিচ্চি। কয়েক দিনের পরিচয়ে আজও পুড়ছি আমি৷ সেই খবর কি রাখ তুমি, আমিও বোকা বোকা কথা ভাবি। তুমিতো আমার মনের খবরই জানো না আমার পুড়ে যাওয়ার খবর কি করে রাখবে? তবে কষ্ট পেয়েছিলাম এটা জেনে যে তুমি আয়াতকে মন দিয়ে বসে আছো। যেখানে তার মন অনেক আগেই আরেকজনের হয়ে আছে। আমি কষ্ট পাচ্ছি সেই কষ্ট যে তুমিও পাবে তা যে আমার সত্যি সহ্য হবে না। তবুও কিছুই করার নেই। না জেনে বিষ পান যখন করেছো তার যন্ত্রণা তো সহ্য করতেই হবে।”
এসব ভাবনার মাঝেই চোখ বুজে নিলো আহনাফ।
আজ খুব বেলা করেই ঘুম ভাঙলো মেহেরের। ঘুম ঘুম চোখে মোবাইলটা হাতে নিয়ে ঘড়ির সময় দেখে নিলো মেহের। সকাল ১০ঃ৩০ টা বাজে। কিছুটা অবাক হয়েই তাকালো মেহের মোবাইলের ঘড়ির দিকে। না ঠিকই দেখছে সে। ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে নিচে এলো। খাবার টেবিলে কেউ নেই, এর মানে সকলেই খাবার খেয়ে যার যার দৈনন্দিন জীবনে ব্যস্ত হয়ে পরেছে। মেহের রান্নাঘর থেকে নিজের খাবার এনে খাওয়া শুরু করলো। মেহেরের মা রান্নাঘর থেকে চায়ের কাপ এনে মেহেরের সামনে রেখে বললো,
“কিরে আজ শরীর খারাপ নাকি, এত বেলা করে উঠলি যে!”
“আমি তো টেরই পাই নি মা। কখন এত বেলা হয়ে গেলো!”
“শরীর ভালো না লাগলে আজ অফিস যাওয়ার দরকার নেই। আজ মা মেয়ে মিলে সারাদিন সময় কাটাবো।”
“ওহ, ভালো তো মা মেয়ে মিলে সারাদিন সময় কাটাবে আর আমাকে দূরে ঠেলে দিবে বুঝি?”
“দূর পাগলি। তুই তো আমার ছোট বোন, তোকে কি করে দূরে ঠেলে দেই!”
চাচী এসে মাকে জড়িয়ে ধরলো। মা আর চাচীর এমন ভালোবাসা সত্যি মেহেরকে আবেগী করে তুললো৷ এর মাঝেই তার ভাবনায় নাড়া দিলো আয়াত নামক মানুষটা। আয়াত কি আজ ভার্সিটি গেছে, তার জ্বর কি কমেছে, জ্বর না কমলে তার যাওয়ার দরকার কি, এতটা অবুঝ কেনো সে, আচ্ছা আজও কি আরশি আয়াতকে জড়িয়ে ধরবে? এসব ভাবনার মাঝেই মেহেরের চাচীর ফোনে কল আসলো। তিনি কল রিসিভ করে কিছুক্ষণ কথা বললেন। তার কথা শুনে মেহের বুঝলো আনিকা কল দিয়েছে। ওপাশ থেকে আনিকা হয়তো জিজ্ঞেস করছে আয়াতের জ্বরের কথা। মেহের ভাবলো তারমানে চাচীর কাছ থেকেই শুনেছে আয়াতের জ্বর। হঠাৎ করেই চাচী বলে উঠলো,
“এই ছেলে কারো কথা শুনে নাক? তুই বল আনিকা মা এই অসুস্থ শরীর নিয়ে কেউ কি বাসার বাইরে বেড়িয়ে যায়। তাও আবার ব্যাগ পত্র নিয়ে। বললো ট্যুরে যাচ্ছি। কই যাচ্ছে, কয়দিন থাকবে কিছুই বললো না।”
মেহের যেনো অবাকের শীর্ষ পর্যায়ে।
“আয়াত বাসায় নেই, ট্যুরে গেছে তাও আমাকে কিছুই বললো না। কিন্তু এমন কিছু হবে তা আমার ভাবনার বাইরে ছিলো।”
চলবে,,,,,#দুপাতার_পদ্ম
#পর্ব_২৮
#Writer_Fatema_Khan
“জীবনে চলার পথে আমরা অনেক কিছুর সম্মুখীন হই। এই যেমন ধর শিশুরা যখন প্রথম হাটতে শিখে তারা তো প্রথমেই হাটা শিখে যায় না। প্রথম দিকে হোচট খায়, ব্যাথা পায়, তারপর আবার চেষ্টা করে। পূনরায় আবার হোচট খায়। তাই বলে কি তারা হাটা ছেড়ে দিবে? কখনোই না। তখন তাদের হাতটা ধরে হাটা শেখায় তাদের মা কিংবা বাবা। শিশুরা তাদের মা বাবার হাতটাকে বিশ্বাস করে আকড়ে ধরে, কারণ তারা জানে এই হাত তাদের ধোকা দিবে না। ঠিক তেমনি আয়াত তোর জীবনে বিশ্বস্ততার আরেক নাম। আয়াত আগে থেকেই তোকে ভালোবাসে বলেই তোর খুশি চেয়ে দূরে সরে গেছে। এখন যখন তুইও একবার হোচট খেয়ে পরেই গেছিস বিশ্বাসের সাথে আয়াতের হাতটা ধরাই যায়। আমার পূর্ণ আস্থা আছে আয়াতের উপর। আর এভাবে হাল ছেড়ে দেওয়ার কোনো মানে হয় না, নিজের জীবনকে আরেকটা সুযোগ দে। তোর জীবনের সাথে তুই একা না মা সাথে মেহেরের জীবনও জড়িয়ে আছে। আর সবচেয়ে বড় কথা হলো ছেলেটা অপেক্ষা করে আছে এই বুঝি তুই তাকে ভালোবেসে আগলে নিবি। এভাবে ছন্নছাড়া জীবন যাপনের ছেয়ে একটু ভেবে দেখ অনেক সুখ তোদের জীবনে অপেক্ষা করছে। যা হাত দিয়ে কুড়িয়ে নেওয়ার পালা শুধু। আর যদি তুই বয়স নিয়েও ভেবে থাকিস সেটা নিয়ে আমাদের কারোই কোনো মতবিরোধ নেই, আর সবচেয়ে বড় কথা হলো আয়াতের নিজের কোনো সমস্যা নেই। তাহলে সেখানে ভাবনার কি আছে! মাত্র তো দুইটা বছর সে এমন কি বেশি বল। আর সমাজের কথা ভেবে থাকলে এই ব্যাপারে আমি আর তোর চাচাও ভেবেছি। যেখানে আমার মেয়ে এতগুলো বছর কষ্ট করেছে সেখানে সমাজ কথা বলতে আসে নি তাই এখন আসলেও আমরা এসবে কান দিব না। আর এদের কোনো অধিকারও নেই কারো ব্যক্তিজীবনে হস্তক্ষেপ করার। কিছুদিন ভেবে দেখ তোর মন কিসে সায় দেয়, তোর উপর কারো জোর নেই। না আমরা তোকে কোনো সিদ্ধান্তে জোর করব আর না আয়াত করবে। তুই সময় নে কিছুদিন, নিজেকে বুঝার চেষ্টা কর। দেখবি তোর মন ভালো কিছুর আভাস দিবে। আরেকটা কথা আয়াত শুধু আমাদের সামনে না তোর সামনেই থেকেছে ছোটকাল থেকে তাই তোর জানা আছে সে কেমন। বাকিটা তুই ভালো বুঝিস। অনেক রাত হলো ঘুমিয়ে পর, মাহি না হয় আজ আমাদের সাথেই ঘুমিয়ে পরুক।”
গতকাল রাতে বাবার বলা কথাগুলো বারবার কানে বারি খাচ্ছিলো। মেহের চোখ বন্ধ করে রাখে কিছুক্ষণ। সে ভাবনায় মগ্ন। উঠে বারান্দায় দাঁড়িয়ে গ্রিলে হাত রেখে কপাল ঠেকিয়ে দেয় লোহার গ্রিলে। আজ অফিস যায় নি তাই আরও মনমরা লাগছে তার। হাতে থাকা মুঠোফোনটার লক খুলে আয়াতের নাম্বারটার দিকে তাকিয়ে আছে।
“আচ্ছা একটা কল কি দিব? কি করছে, এখন জ্বর আছে কিনা এসবও জানা নেই। ছেলেটা এমন কেনো, নিজের ভালো নিজে বুঝতে পারে না। থাক এখন আর কল দিব না হয়তো ব্যস্ত থাকবে।”
এই ভেবেই আবার মোবাইলটা লক করে দিলো। আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। জ্বলজ্বল করছে চারিপাশ, রোদ্র যেন উপচে পরছে। এই কয়দিনের বৃষ্টির পর আবার পৃথিবী আগুনের মতো উত্তাপ দিচ্ছে। ওড়নার এক কোনা দিয়ে কপালের আর গলার ঘাম মুছে আবার মোবাইলটা হাতে নিলো মেহের।
অনেকক্ষণ ধরে আয়াতের ফোন বেজেই যাচ্ছে, কিন্তু আয়াত এখনো ওয়াশরুম থেকেই বের হয়নি। বিরক্ত হয়েই আহনাফ উঠে মোবাইলটা হাতে নেয়। স্ক্রিনের উপরের নাম্বার সেইভ করা নেই তাই মুখের ভঙ্গিমা কিছুটা বিকৃত করেই কল রিসিভ করলো আহনাফ। কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে মেয়েলি কন্ঠস্বরে বলে উঠলো,
“ভাইয়া তোমার নাকি জ্বর, এই জ্বরের ভেতর কেনো ঘুরতে গেলে? নিজের একটু খেয়াল তো রাখা দরকার। আচ্ছা খালামনির কেমন লাগে বলো তুমি যদি এমনটা করো?”
ওইপাশে থাকা রমনীর গলার শব্দ শুনেই আহনাফের কথা বন্ধ হয়ে গেছে সেই অনেক আগেই। কানে মোবাইল রেখে চুপ করে তার কথা শুনে যাচ্ছে আহনাফ। যেনো জবাব দিলেই এই মিষ্টি কন্ঠের কথা আর শোনা যাবে না। আয়াত ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে আহনাফকে এভাবে দেখে ভাবে কে কল করলো আহনাফ কথাই বলছে না। তাই এগিয়ে গিয়ে কাধে হাত রাখলো। আহনাফকে চোখ দিয়ে প্রশ্ন করলো কে কল দিয়েছে? আহনাফ কথার উত্তর না দিয়ে আয়াতকে মোবাইল দিয়ে বিছানায় বসে পরলো। আয়াত ভ্রু কুচকে তাকায় আহনাফের দিকে। কিছু না বুঝে কানে মোবাইল রেখে জিজ্ঞেস করে,
“কে?”
“এতক্ষণ পর জিজ্ঞেস করছো আমি কে? ভাইয়া আমি আনিকা।”
আনিকা কল দিয়েছে বলে আহনাফ এমন হাসফাস করছে দেখে আয়াতের ভ্রু জোড়া আরও সংকুচিত হলো। কিছুক্ষণ আনিকার সাথে কথা বলে আয়াত ফোন রেখে দেয়। তারপর চুল মুছতে মুছতে আহনাফের দিকে এগিয়ে যায়।
“কিরে তোর আবার কি হলো! ঠিকই তো ছিলি হঠাৎ করে এমন দেখাচ্ছে কেনো?”
“কই নাতো, সব ঠিক আছে।”
“আনিকা কি তোকে কিছু বলেছে?”
“না তোর বোন তো জানেই না আমি কল রিসিভ করেছিলাম তুই না। সে নিজের মতো বকবক করেই গেছে। আর তোর ফোনে তোর বোনের নাম্বারই সেইভ নেই কেনো?”
“আসলে দেশে আসার পর কারো নাম্বারই সেইভ করা হয়ে উঠে নি। যাদের গুলো খুব জরুরি তাদের গুলাই করেছি।”
“আচ্ছা। এক কাজ কর একটু রেস্ট নে, তারপর সবাই খাওয়া দাওয়া করে কাছাকাছি কোথাও ঘুরতে বের হব।”
“হুম একটু রেস্ট নেওয়া দরকার। এমনিতেও জ্বর থেকে উঠেছি সবেমাত্র, এখনো শরীরের দূর্বলতা কাটে নি।”
আয়াত হাতে থাকা টাওয়েল টা ছড়িয়ে দিয়ে আহনাফের পাশে শুয়ে পরলো।
মেহের ছাদে আসলো আছরের নামাজ আদায় করে। ছাদে তেমন একটা আসা হয় না মেহেরের। কারণটা হলো আয়াত। আয়াতের জন্যই মূলত মেহের ছাদে আসে না। তবে আজ আয়াত বাসায় নেই তাই মেহের ছাদ টা ঘুরে ঘুরে দেখছে। ছাদে কাসফির লাগানো অনেক গাছ আছে। যেগুলোতে রোজ কাসফি এসে পানি দেয়, আগাছা পরিষ্কার করে, খুব যত্ন নেয়৷ এখানের বেশির ভাগ গাছই আয়াতের কিনে দেওয়া। কিছু গাছে ফুল ধরেছে কিছুতে ধরেনি। আকাশটাও আজ রক্তিম আভা দিয়ে সূর্য অস্ত যাবার জন্য প্রস্তুত। মেহের ছাদে থাকা একটা বালতি আর মগে পানি নিয়ে গাছগুলোর দিকে এগিয়ে গেলো। এসব গাছে কাসফি আর আয়াতই পানি দেয়। আজ ওদের দুইজনের একজনও নেই তাই মেহের ভাবলো সে ই না হয় দিয়ে দিবে। মেহের সবগুলো গাছে পানি দেওয়া শেষ হলে ছাদের এক সাইডে দাঁড়িয়ে আছে। হালকা শীতল হাওয়ার সাথে এই একাকিত্ব তাকে ভেতর থেকে স্পর্শ করছে খুব। চোখ বন্ধ করেই তার বাবার কথা, মায়ের কথা, আয়াতের আবেগের কথাগুলো তার কানে বাজছে।
“আপু এখানে একা একা কি করছো, আর আমি কিনা তোমায় পুরো বাড়ি খুঁজে বেরাচ্ছি৷”
কাসফির হঠাৎ করে ডেকে উঠায় চমকে পাশে তাকায় মেহের। কাসফিকে দেখে হেসে তাকে কাছে টেনে নেয়।
“কিছু করছিলাম না। তোর গাছগুলো দেখছিলাম আর তাতে পানি দিয়ে দিয়েছি৷ তারপর একটু শীতল হাওয়ায় দাড়ালাম৷ তা আমাকে খুজছিলি কেনো?”
“আপু তুমি কত ভালো। আমার গাছগুলোতে পানি দিয়ে দিয়েছো। আসলে আয়াত ভাইয়া থাকতে তো ভাইয়াই দিয়েছে। কিন্তু দুইদিন ভাইয়ার জ্বর আর আজ তো ভাইয়াই নেই তাই এই কয়দিন দেওয়া হয় নি৷ আর আজ তুমি দিয়ে দিলে৷”
“আচ্ছা নিচে চল।”
“আরেকটু থাকি, তারপর যাই।”
মেহের আর কিছু বললো না। কাসফির সাথে দাঁড়িয়ে স্নিগ্ধ পরিবেশ দেখছে। সচরাচর নিজের বারান্দা থেকে যতটুকু দেখা যায় ততটুকুই দেখে। কিন্তু আজ পুরো অন্তরীক্ষ তার সামনে। এই দুইদিন ঠান্ডা ভাব কমে আবার গরমের দিকে পদার্পন করেছে। ভ্যাপসা গরমে কপাল, গলা, নাক ঘেমে গেছে মেহেরের। আকাশে সাদা মেঘ ঘুরে ঘুরে বেরাচ্ছে। তবে বৃষ্টি হওয়ার আশংকা নেই বললেই চলে।
“আপু আয়াত ভাইয়ার ঘরে যাবে?”
এমন ধরনের কথায় মেহের চোখ বড় বড় করে তাকালো কাসফির দিকে।
“এগুলো কি ধরনের কথা কাসফি! কারো ঘরে যাওয়ার আগে তার থেকে পারমিশন নিতে হয়। কিন্তু আয়াতের অবর্তমানে তার ঘরে ঢুকা একদম উচিত না। চল নিচে চল।”
বলেই কাসফির হাত ধরে নিচে চলে গেলো মেহের। সূর্য ডুবেছে সে আরও কিছুক্ষণ আগেই। আকাশে গোল চাঁদটাও উঠে গেছে। কাসফিকে তার ঘরে দিয়ে মেহের নিজের ঘরে গেলো। অফিসের কাজ করতে বসে পরে মেহের। আজ সারাদিন বাসায় থেকে মা আর চাচীর সাথে গল্প গুজব, কাজে সাহায্য করা আর মাহিকে নিয়ে খেলা করা এসব নিয়েই ছিলো। অফিসে যায় নি তাই অনেক কাজ পেন্ডিং রয়ে গেছে৷ তবে মেহেরের আজ সবচেয়ে খারাপ লাগছে তার চাচীকে দেখে। যতই সবার সামনে হাসিখুশি থাকুক না কেনো উনি যে মনে মনে আয়াতকে নিয়ে চিন্তিত তা তার হাসির মাঝে মন খারাপটা দেখেই বুঝা যায়। এতদিন অফিস নিয়ে পরে থাকাতে মেহের খেয়াল না করলেও আজ সারাদিনে তার বুঝতে অসুবিধা হয় নি। তাই হয়তো মেহেরের মাও মেহেরকে আয়াতের ব্যাপারে সারাক্ষণ বলতে থাকে। আসলে দুইজন সারাদিন একসাথে সময় কাটায়, বোনের থেকেও বেশি গভীর সম্পর্ক তাদের। একজনের কষ্টে আরেকজন যে কষ্ট পাবে স্বাভাবিক। মেহের বড় একটা শ্বাস ফেলে সব চিন্তা মাথা থেকে ঝেরে নিজের কাজে মনোনিবেশ করলো৷ রাতের ভেতর অনেকগুলো কাজ শেষ করতে হবে, কিছু ফাইলও রিচেক করতে হবে। রাতের জন্যই সব ফেলে রেখেছে মেহের। এখন কাজ শেষ না করলে কাল অফিসে বসে বসে কাজ করতে হবে। প্রায় ৩ ঘন্টার মত কাজ করে উঠে দাঁড়ায় মেহের। নিচে গিয়ে এক কাপ চা বানিয়ে আবার ঘরে এসে কাজে মনোযোগ দেয় মেহের। কিছুটা রিফ্রেশমেন্টের জন্যই চা বানিয়ে আনা। না হলে একঘেয়েমি লাগবে। আরও ঘন্টা খানেক কাজ করার পর নিচে থেকে ডাক পরলো খেতে যেতে। এর ভেতর মেহেরের কাজও শেষ। ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিচে চলে যায় রাতের খাবার খাওয়ার জন্য। রাতের খাবার শেষ সবারই, কিন্তু টেবিল ছাড়ে নি কেউ এখনো। মেহের সবার উদ্দেশ্যে বললো,
“বাবা, চাচা তোমাদের সবার সাথে কিছু কথা ছিল। খাবার পরে যদি কিছুক্ষণের জন্য বসার ঘরে সবাই বসতে তাহলে আমি কিছু কথা বলতাম।”
মেহেরের চাচা চিন্তার রেখা কপালে এনে বললো,
“কি হয়েছে আম্মু, জরুরি কোনো কথা নাকি! এভাবে সবাইকে থাকতে বলছো।”
“জি চাচা। অনেক গুরুত্বপূর্ণ কথা না হলে এত রাতে সবাইকে থাকতে বলতাম না।”
চলবে,,,,,#দুপাতার_পদ্ম
#পর্ব_২৯(শেষ পর্ব-প্রথমাংশ)
#Writer_Fatema_Khan
বসার ঘরে সবাই উৎসুক দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে মেহেরের দিকে। মেহের তাদের সামনে বসে এক হাত দিয়ে অন্য হাত কচলাতে থাকে। কিছু সময় ব্যয় হবার পর আয়াতের বাবা বলেন,
“কি বলবে নিঃসংকোচে বলে ফেল মা৷ আমরা তোর কথা কখনো ফেলি নি।”
আয়াতের মা ভাবছে অন্যকিছু। তার ভাবনা জুড়েই আছে তার ছেলের ভবিষ্যৎ। মেহের এমন কিছু না বলে ফেলে যাতে তার ছেলের জীবনে আবার অন্ধকার নেমে আসে। দুইটা কাশি দিয়ে গলা পরিষ্কার করে মেহের তাকায় সবার দিকে। সবাই তার দিকেই কিভাবে যেনো তাকিয়ে আছে। মেহের আবার নিচের দিকে তাকায়।
“বাবা, চাচা তোমরা আমাকে ছোট থেকেই খুব যত্নে বড় করেছো। সত্যি বলতে অভাব, অপূর্ণতা কি জিনিস তা হয়তো আমি কখনোই বুঝি নি। সবসময় যা চেয়েছি তাই দিয়ে এসেছো আমাকে। কখনো কোনো কিছু নিয়েই মানা নেই। এমনকি জীবনের সবচেয়ে বড় সীদ্ধান্তটাও আমি নিজেই নিয়েছি। তোমাদের জানানো প্রয়োজন ছিলো তাই জানিয়েছি এমনটাই দেখায়। মা, চাচী তোমরা আমার মা আর চাচী কম বন্ধু বেশি ছিলে। স্কুল কলেজে কি হত না হত সব যেনো তোমাদের না বলে আমার শান্তি হতো না। সেই আমি কিনা কাউকে পছন্দ করি সেটা তোমাদের থেকে লুকিয়ে গেছি। যখন সবাই এই ব্যাপারটা জানে তখন যেকোনো মা ই তার নিজের সন্তানের খুশি টাই চাইবে। সেখানে চাচী তুমি আমার সুখ টা চেয়েছো। আয়াতের অনুভূতি জানা সত্ত্বেও কাউকে বুঝতে দাও নি। হাসি মুখেই আমার বিয়ের সব কিছুতে অংশ নিয়েছো৷ যেখানে তোমরা সবাই আমাকে এতটা সাপোর্ট করেছো সেখানে আমি শুধু নিজের স্বার্থ দেখে এসেছি। যখন সব বুঝতে পেরেছি তখন সব আমার হাতের বাইরে চলে গেছে। আয়াত! আয়াত মানুষটাই অন্যরকম। মেয়ে মানুষের আলাদা একটা ক্ষমতা থাকে। কেউ তাদের পছন্দ করলে তারা চট করে বুঝে ফেলে৷ আমার ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম নয়। আয়াতের অনুভূতি তার চোখে ভাসতো। আমি ইচ্ছে করেই বুঝেও না বুঝার ভান ধরতাম। কিন্তু আমিই বা কি করতাম আয়াতের জন্য আমি তো কখনো সেভাবে ভাবি নি। আমি তো একজনকেই ভালোবেসেছিলাম। আর সে আমাকে খুব নির্মম ভাবে ঠকিয়ে গেলো। ঠকে গিয়েও থাকতে চেয়েছিলাম বেঈমান মানুষটার সাথে। কিন্তু সে তো অন্য একজনের উপর এতটাই মুগ্ধ ছিলো যে নিজের বউ বাচ্চার কথা বেমালুম ভুলে গেছে। নিজের কষ্ট গুলো অনেক কষ্টে চাপা দিয়ে রেখে আসছি। আবার তখন আগমন ঘটে আয়াতের৷ তার আচার আচরণে আমি বুঝতে পারি তার অনুভূতি আগের মতোই আছে। কিন্তু আমি যে তাকে আমার এই অভিশপ্ত জীবনের সাথে জড়াতে চাই নি। তবে তার ভালোবাসা আমাকে তাকে নিয়ে ভাবতে বাধ্য করেছে৷ বুঝে উঠতে পারছিলাম না কি করলে আয়াত নিজের জীবনে এগিয়ে যাবে। কিন্তু কিছুই করতে পারি নি আমি। যতই আয়াতের থেকে দূরে যাওয়ার চেষ্টায় ছিলাম ততই তার সাথে জড়িয়ে যাচ্ছি৷ আমার এভাবে আয়াতকে এড়িয়ে যাওয়া শুধু আয়াতকে না সাথে আমার ভালোবাসার পরিবার টাকেও অনেক কষ্ট দিচ্ছে। তাই আমি একটা সীদ্ধান্ত নিয়েছি।”
আয়তের মা তাড়াতাড়ি বলে উঠলো,
“কি সীদ্ধান্ত নিয়েছিস মা?”
“আমি নিজেকে আরেকটা সুযোগ দিতে চাই। তোমাদের সীদ্ধান্তকে সম্মান জানিয়ে, মাহির কথা ভেবে, আমার প্রতি আয়াতের অসীম ভালোবাসার জন্য আর নিজের জন্যও আরেকবার সুযোগ দিতে চাই আমি। কারো জীবন তো কারো জন্য থমকে নেই৷ যার জন্য আমি রোজ শোক করি, সে তো দিব্যি সুখেই আছে। তবে কেনো আমি নিজের ও নিজের মেয়ের সুখ পায়ে ঠেলে দিব। আর যে এত বছর আমাকে ভালোবেসে গেছে, আমি ডিভোর্সি সাথে একটা মেয়েও আছে, এসব জেনেও আমাকে আপন করতে চায় তাকে কি করে আর কষ্ট দেই চাচী৷ বাবা, চাচা, চাচী আর মা তোমাদের সবার উদ্দেশ্যেই বলছি আমি আয়াতকে বিয়ে করতে রাজি।”
আয়াতের মা আর মেহেরের মা এক মুহূর্ত দেরি না করে মেহেরকে জড়িয়ে ধরে। আর কপালে মুখে চুমু খেতে থাকে। বাবা আর চাচার মুখেও তৃপ্তির হাসি। যেনো এমন একটা সংবাদের জন্যই অপেক্ষা করছিলেন তারা। মেহের মুচকি হেসে বসার ঘর থেকে উঠে নিজের ঘরে চলে গেলো৷
“কিরে এখানে একা একা দেবদাসের মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেনো?”
আহনাফের ডাকে পেছনে ফিরে আয়াত। আজ তিনদিন হলো আয়াত বাসার বাইরে। সবাই কল করে তার খোঁজ নিলেও মেহের একটা কলও দেয় নি। মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে বলে,
“জানিস সবাই কল দিয়ে আমার খোঁজ নিয়েছে। কিন্তু যার কলের অপেক্ষায় আমি আছি সে একটা কল তো দূর একটা টেক্সটও করে নি।”
“মন খারাপ করে না। আজ করবে দেখিস।”
আহনাফের বলতে দেরি হলো কিন্তু আয়াতের ফোনে কল আসতে দেরি হয় নি। হাতে থাকা ফোনটির দিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। মেহেরের নাম্বার স্ক্রিনের উপর।
“এই দেখ বললাম না ভাবি কল দিবে, ঠিক দিয়ে ফেলেছে। কথা বল আমি ওইদিকে যাই।”
আহনাফ চলে যেতেই আয়াত কল রিসিভ করতে যায়। কিন্তু কল রিসিভ করার আগেই কল কেটে যায়। আবার সাথে সাথে কল আসে। দেরি না করে আয়াত কল রিসিভ করে। ওপাশের কণ্ঠ শুনে আয়াত কিছুটা হতাশ হয়৷ মেহের না কাসফি কল করেছে। তবুও হাসিমুখেই কাসফির সাথে কথা বললো আয়াত।
“ভাইয়া তুমি কবে আসবে?”
“কেনো রে পিচ্চি ভাইয়াকে খুব মিস করছিস বুঝি?”
‘এইতো একটু। তবে আমি বেশ আনন্দে আছি এই মুহূর্তে। আমাদের সব আত্মীয় স্বজনরা আমাদের বাসায় আসতে শুরু করেছে। কি মজা অনেক আনন্দ করছি আমরা।”
“হুট করে সব আত্মীয় স্বজনরা বাসায় আসছে কেনো? কিছু হয়েছে বাসায়?”
‘ওইটা তো বলা যাবে না তোমাকে। আচ্ছা আচ্ছা রাখি তাহলে। তুমি তোমার ট্যুর এনজয় করো। আল্লাহ হাফেজ।”
আয়াতকে আর কিছু বলতে না দিয়ে কাসফি কল কেটে দিলো। সেই সময় আহনাফ আসলো। আয়াতকে এমন অন্যমনস্ক দেখে কাধে হাত রেখে বললো,
“কিরে ভাবি কি বলেছে যে তুই এমন স্ট্যাচু হয়ে আছিস?”
“আমরা কাল সকালেই ঢাকার উদ্দেশ্যে বের হব। বাসায় কি যেনো হচ্ছে, কিন্তু কি হচ্ছে বুঝতে পারলাম না। আর মেহের না আয়াত কল করেছে। সে কিছুই বললো না শুধু বললো আমাদের সব আত্মীয়রা নাকি আমাদের বাসায় আসছে।”
“আর কেউ কল করেছে?”
“না।”
“ঠিক আছে আমরা কাল সকালের ভেতর বের হব। তুই চিন্তা করিস না। সব ঠিকই থাকবে বাসায়।”
আয়াত মুচকি হেসে তাকায় আহনাফের দিকে তবে ভেতরে ভেতরে টেনশন হচ্ছে খুব।
সকাল থেকেই বসার ঘরে বাচ্চাদের ছুটাছুটি চলছে৷ মেহের সোফায় বসে আছে। আজ কেউই অফিস যায় নি সবাই বাসায় উপস্থিত। রান্নাঘর থেকে মহিলাদের গল্প গুজব আর হাসির শব্দ আসছে। ডেকোরেশনের লোকেরা বাড়ি সাজাতে ব্যস্ত। মেহের চারদিকের সাজসজ্জা দেখছে খারাপ লাগছে না তার। বরং এক অজানা ভালো লাগা কাজ করছে। বাচ্চাদের সাথে কাসফিও বাচ্চাদের মতো ছুটাছুটি করছে। তার পেছনে আস্তে আস্তে হেটে চলছে মাহি। তার ছোট ছোট পা দিয়ে পুরো বসার ঘরে বিচরণ করছে। বাড়ির সকল কাজ শেষ হতে হতে বিকেল হয়ে এলো। কিছু মেয়েরা কাসফি আর বাকি সব মেয়েরা মেহেরের ঘরে তৈরি হতে ব্যস্ত। আনিকা মেহেরের ঘরে বসেই তৈরি হচ্ছে। সাজার পর যেনো আনিকার রূপ উপচে পরছে। মেহের তার দিকেই তাকিয়ে আছে। আনিকা মেহেরের দিকে তাকিয়ে বলে,
“কি দেখছো আপু?”
“তোমায় খুব মিষ্টি লাগছে।”
“কি যে বলো আপু, সত্যি বলতে আজ তোমায় অন্যরকম লাগছে। ঠিক কোনো অপ্সরিদের মতো। ঠিক অনেকগুলো বছর পর তোমাকে সাজতে দেখেছি তাই হয়তো। আচ্ছা আপু তুমি কখনো সাজো না কেনো?”
“সাজ আমার কখনোই পছন্দ নয়। সাদামাটা ভাবটাতেই যেনো একটা মেয়ের আসল সৌন্দর্য ফুটে ওঠে। তাই সাজগোছ থেকে দূরে থাকি।”
সেই সকাল থেকে আয়াত একের পর এক সবাইকে কল করেই যাচ্ছে কিন্তু কল রিসিভ করার সময় কারো কাছেই নেই। টেনশনে মাথা ফেটে যাচ্ছে আয়াতের। আহনাফ আয়াতের এই অবস্থা দেখে বললো,
“তুই খামখ চিন্তা করছিস। দেখবি বাসায় গিয়ে কিছুই না কাসফি তোর সাথে মজা করছে।”
বাস থেকে নেমে একটা গাড়ি ভাড়া করে সোজা বাসার উদ্দেশ্যে বের হলো আয়াত। আয়াতের এমন ফ্যাকাসে মুখ দেখে আয়াতকে একা ছাড়ে নি আহনাফ। সেও তার সাথে আয়াতদের বাড়িতে যাচ্ছে। গাড়ি এসে গেইটের সামনে থামে। ভাড়া মিটিয়ে দুইজনেই গেইটের ভেতর ঢুকে। ঢুকেই চমকে যায়। দোতলা বিশিষ্ট বাড়িটি যেনো আজ বউ সেজেছে। চারপাশে আলো আর আলো। ঝারবাতি আর কাচা ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে বাড়িটি। আয়াতের সাথে সাথে আহনাফও বেশ অবাক হয়েছে। এমন কিছু চিন্তায় আসে নি দুইজনের। তারা তো খারাপ কিছুই চিন্তা করছিলো। আহনাফ আয়াতকে ডেকে বলে,
“ভেতরে চল। দেখি ভেতরে কি অবস্থা।”
আহনাফের কথা মতোই আয়াত আর আহনাফ বাসার দিকে এগিয়ে যায়। বাসায় অনুষ্ঠান বলে সদর দরজা খোলাই রাখা। তাই তারা দুইজনে নির্দিধায় ভেতরে ঢুকে যায়। ভেতরে ঢুকে দেখে সবাই উপরে মানে ছাদের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে৷ তবে বাসার কাউকেই আয়াত দেখতে পাচ্ছে না। তবে যাদের দেখা যাচ্ছে কাউকে আয়াত চিনে আবার কাউকে চিনে না৷ কিন্তু বেশিরভাগ তাদের আত্মীয় এটা সে দেখেই বুঝতে পারছে। আয়াত আর আহনাফও এগিয়ে যায়। আয়াত তার নিচের ঘরেই ব্যাগ পত্র রেখে দেয়৷ আহনাফও ব্যাগ রেখে আয়াতের সাথে উপরে চলে যায়। ছাদের দরজা খুলতেই আয়াতের পা থমকে যায়৷ গায়ে হলুদের সাজে স্টেজে বসে আছে মেহের। আয়াতের চোখে শুধু সুন্দর বললে কম হবে অপরূপের উপরে কোনো ব্যাখায়া থাকলে সেটাই গিয়ে পরতো আজ মেহেরের উপর। মেহের সবার সাথে হাসি মুখে কথা বলেই যাচ্ছে৷ স্টেজের সামনে আবার কেউ কেউ নাচ গান এসব করছে। আয়াতের এসব কিছু মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে৷ কয়েকদিন বাসাত ছিলো না বলে কি সবাই এভাবে তার পেছনে মেহেরকে বিয়ে দিয়ে ফেলবে নাকি। আহনাফ বলে,
“আগে ভেতরে চল তোর মা বা বাবা কাউকে খুঁজে বের কর। তারপর না হয় তাদের জিজ্ঞেস করিস কি হচ্ছে এসব৷”
আহনাফের কথা শুনে আয়াত এক মুহূর্ত দেরি করে না। আহনাফকে ছাদে রেখেই নিচে চলে গেলো। এদিকে আহনাফ হা হয়ে থাকলো আয়াতের কার্যকলাপে। আহনাফ কিছুটা এগিয়ে যায় স্টেজের দিকে৷ মেহেরের একপাশে কাসফি বসে আছে৷ মাহি ঘুরঘুর করছে৷ আর অন্যপাশে তাকিয়ে দেখে আনিকা বসে আছে। পা দুটো যেনো থমকে যায় আহনাফের। আজ কত বছর পর আনিকাকে দেখছে আহনাফ। সেদিন জানার পর সে আয়াতকে পছন্দ করে তারপর আর আনিকার সামনে আসে নি। আসে নি বললেও ভুল হবে, আনিকা ঢাকায় আসে নি হয়তো আয়াত দেশে ছিলো না বলে।
চলবে,,,,,
[আইডি রেস্ট্রিকটেড ছিলো বিধায় এতদিন পোস্ট করতে পারেনি। তার জন্য দুঃখিত]#দুপাতার_পদ্ম
#পর্ব_২৯(শেষ পর্ব-শেষাংশ)
#Writer_Fatema_Khan
আয়াত নিচে তার বাবার ঘরে গিয়ে দেখে তার মা আর চাচী কি যেনো কাজ করছে৷ তারা আয়াতকে দেখে একটা সৌজন্য মূলক হাসজ দিয়ে নিজেদের কাজে ব্যস্ত হয়ে পরে৷ আয়াত আবার অবাক হয়৷ এতদিন পর এসেছে কিন্তু তাদের কোনো হেলদোল নেই। মনে হচ্ছে সে কোথাও যায় নি৷ আয়াত নিজেকে সংযত করে তার মায়ের দিকে এগিয়ে গিয়ে বললো,
“মা আজ কি হচ্ছে বাসায়?”
“তুই ছাদ থেকে এসেছিস না? তাহলে তো জানিসই কি হচ্ছে। এত জিজ্ঞেস করার কি আছে?”
“মানে!”
“মানে আজ আমাদের মেহেরের গায়ে হলুদ হচ্ছে। এক কাজ কর এই নে ধর এই পাঞ্জাবিটা পরে রেডি হয়ে নে আর এটা তোর সাথে আহনাফ এসেছে না ওকে এটা পরতে বলিস। গায়ে হলুদের সময় কেউ টি-শার্ট পরে থাকে নাকি?”
“কার সাথে বিয়ে ঠিক করেছো মা? যেখানে তোমরা সবাই জানতে আমি মেহেরকে কি পরিমাণ ভালোবাসি।”
কার সাথে বিয়ে ঠিক করেছো মা? যেখানে তোমরা সবাই জানতে আমি মেহেরকে কি পরিমাণ ভালোবাসি।”
আয়াতের চোখের কোণে জল চিকচিক করছে তা আয়াতের মায়ের দৃষ্টি এড়ালো না। তিনি আয়াতের গালে হাত রেখে বললেন,
“যা তৈরি হয়ে নে।”
আয়াত আর কিছু না বলে রেগে নিজের ঘরে চলে এলো৷ বাসাভর্তি তাই আয়াত আর কিছু না ভেবে তৈরি হয়ে নিলো আর আহনাফকেও কল করে নিচে আসতে বললো৷ দুই বন্ধু তৈরি হয়ে ছাদের উপর গেলো। স্টেজের কাছে যেতেই সব মেয়েরা আয়াতকে টেনে নিয়ে মেহেরের পাশে বসিয়ে দিলো। আয়াত তো অবাকের শেষ সীমায়। মেহেরের দিকে তাকিয়ে দেখে সে মাথা নিচু করে বসে আছে। কি হচ্ছে তা বুঝতে দুই মিনিট সময় লাগলো আয়াতের৷ আহনাফ এগিয়ে গিয়ে বললো,
“ভাই তোরই বিয়ে এত ভাবিস না আর।”
“মানে তুইও জানতি এসবকিছু। তাহলে আমাকে বললি না কেনো? তুই নিজেও দেখলি আমি কাল থেকে কতটা টেনশনে ছিলাম।”
“এসব আমি জানি না। এসব ওই পিচ্চি কাসফির প্ল্যান।”
আয়াত চুপ করে যায়। কিছুক্ষণ পর মেহেরের কিছুটা কাছে ঘেষে মেহেরকে জিজ্ঞেস করে,
“তোমাকে কি কেউ জোর করছে এই বিয়ে নিয়ে?”
“আমি নিজে থেকেই জীবনে এগিয়ে যেতে চাই তাই এই সীদ্ধান্ত।”
আয়াত মুচকি হেসে সামনে তাকায়৷ একে একে সবাই আয়াত আর মেহেরকে গায়ে হলুদ মাখিয়ে দিচ্ছে। আহনাফ গিয়ে আনিকার পাশে বসেছে। ভনিতা না করেই বললো,
“কেমন আছো আনিকা?”
পাশে আহনাফকে দেখে আনিকা হেসে জবাব দেয়,
“আলহামদুলিল্লাহ ভালো ভাইয়া, আপনার কি অবস্থা?”
“কোনোরকম ছিলাম। তোমাকে দেখে এখন পুরোপুরি ভালো হয়ে গেছি।”
আনিকা হাসে নিচের দিকে তাকিয়ে। তারপর আসছি বলে স্টেজের সামনে নাচের জন্য চলে যায়। আহনাফ আনিকার হাসির কারণ কিছুটা হলেও বুঝতে পারে৷ এই হাসিতে ছিলো লজ্জা৷ তারমানে আনিকা আহনাফের মনের কথা জানে। ভেবেই আহনাফ হেসে পেছনের চুলগুলো খামছে আনিকার দিকে তাকায়। সে নাচে ব্যস্ত আর আহনাফ তার নাচ দেখায়।
গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান শেষে সবাই ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পরে৷ কেউ কেউ তো ছাদেই বিছানা পেতেছে৷ মেহের ফ্রেশ হয়ে বাইরে বের হয়ে আসলে আয়াতকে নিজের বিছানাত দেখতে পায়৷
“আয়ার এত রাতে আপনি এখানে? যান গিয়ে ঘুমিয়ে পরুন অনেক রাত হয়েছে।”
“তুমি বিয়েতে রাজি হলে কেনো? আমার প্রতি কি তোমার ভালোবাসা কাজ করে?”
“এখন কি এসব কথার সময়?”
“তুমি বলবে?”
“ভালোবাসি কিনা জানি না, তবে আপনার প্রতি আমার অনুভূতি কাজ করে। এখন সেটা কি ভালোবাসা নাকি জানা নেই৷ তবে এতটুকু জানি আপনার সাথে থাকলে আপনাকে ভালোবাসতে বাধ্য আমি। আমাকে কি সেই সুযোগটা দিবেন না আপনাকে ভালোবাসার?”
আয়াত আর কথা না বাড়িয়ে মেহেরকে জড়িয়ে ধরে৷ মেহেরও আয়াতের পিঠে আলতো করে হাত রাখে। জীবনে প্রথম হয়তো মেহের আয়াতকে জড়িয়ে পিঠে হাত রেখেছে। আয়াতের তো একের পর এক সারপ্রাইজ পাওয়ার দিন।
৬ মাস পর,
মেহের আয়নার সামনে বসে তৈরি হচ্ছে৷ আজ তারা চট্টগ্রাম যাবে। আহনাফ আর আনিকার বিয়ের কথা চলছে৷ কথা পাকাপাকি হলে আজই আংটি পরিয়ে দিয়ে আসবে। মেহেরের গায়ে হলুদের পর থেকেই দুইজনের ফোনে যোগাযোগ হয়৷ তারপর দুইজন ভালোবাসায় আবদ্ধ হয়। এবার প্রণয়কে পরিণয়ে রূপান্তর করার পালা৷ এদিকে আয়াতের এখনো কোনো খোজ নেই বাসায় আসার৷ একটু পর তাড়াহুড়ো করে ঘরের ভেতরে ঢুকলো আয়াত৷ আয়াতের হাতে একটা বিড়াল ছানা৷
“এই বিড়াল ছানা কোত্থেকে আনলেন?”
“কেনো কিনে আনলাম। কাল আমাদের কাসফির রেজাল্ট দিলো আর সে এ+ পেয়েছে তুমি কি জানো না! ওকে তো আমি কথা দিয়েছিলাম অনেক আগে দিব। কিন্তু রেজাল্ট ভালো হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। এখন সেটাও হয়ে গেছে। তাই আর ওকে অপেক্ষা করানো ঠিক হবে না৷ তাই কিনে আনলাম।”
“আপনি ভুলে যাচ্ছেন আমাদের দেরি হচ্ছে।”
“তুমিও কিছু ভুলে যাচ্ছ।”
“কি?”
“তোমার সাথেও আমার চ্যালেঞ্জ ছিলো কাসফি রেজাল্ট ভালো করলে আমি যা চাই তাই দিবে।”
“খুব মনে আছে আমার। তা কি চাই আপনার?”
“আসলে আবদারটা আমার না মাহির।”
“মাহির!”
“হুম।”
“তা কি সেটা?”
“মাহি চায় তার একটা খেলার সাথী আসুক। একটা ছোট্ট ভাই বা বোন আসুক। তা তুমি কি তাকে সেই উপহারটা দিবে না।”
“তৈরি হয়ে নিন। চট্টগ্রাম থেকে এসে না হয় মাহির জন্য খেলার সাথী আনার ব্যবস্থা করা যাবে৷”
বলেই মেহের ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলো। আয়াত জোরে হেসে দিয়ে বলে,
“পালাচ্ছো কোথায়, তুমি চাইলে কিন্তু আমি চট্টগ্রাম যাওয়ার আগেও ট্রাই করে দেখতে পারি।”
“অসভ্য লোক একটা। কিছুই মুখে আটকায় না মুখে।”
চট্টগ্রাম এসেছে তিনদিন হলো। এর মাঝে আনিকা আর আহনাফের আংটি বদল হয়ে গেছে। বিয়ের তারিখও তারা ঠিক করে যাবে কিছুদিনের ভেতর। মেহের বারান্দার ফ্লোরে বসে আছে তার পাশে আয়াত বসে মেহেরের চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।
“আয়াত।”
“হুম।”
“আপনি আমার জীবনের সেই প্রাপ্তি যাকে আমি কখনো পাত্তা দেয় নি। আমি বুঝেও না বুঝার ভান ধরে ছিলাম। আপনার ভালোবাসা অবহেলা করেছি। যাকে আকড়ে ধরতে চেয়েছি সেতো আমায় ভালোই বাসে নি কখনো।”
“এখন কি এসব পুরোনো কথা বলে মাহির খেলার সাথী আনতে বেঘাত ঘটাতে চাও? তাহলে এটা তোমার ভুল ধারণা। এসবে এখন আমি কান দিচ্ছি না। আমার তো এখন অন্যকিছু মন আছে।”
“আপনি এত অসভ্য কেনো আয়াত?”
“নিজের বউয়ের কাছেই তো অসভ্য তাই না, অন্য কোথাও তো যাচ্ছি না।”
“যান তো আপনার সাথে আমার কথাই নেই। কই আমি আপনাকে কতটা ভালোবেসে ফেলেছি সেই কথা বলছি আর আপনি আছেন কি নিয়ে।”
“সরি বউ। আমি তো জানি তুমি আমাকে কতটা ভালোবাসো৷”
বলেই মেহেরকে জড়িয়ে ধরে গালে ভালোবাসার পরশ একে দিলো। তারপর দুইজনে নিকশ কালো অন্তরীক্ষে চাঁদ তারাদের দেখতে ব্যস্ত হয়ে পরে।
সমাপ্ত।
[আসসালামু আলাইকুম। প্রথমেই ভুল ত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। আপনাদের অনেক অপেক্ষা করিয়েছি এই গল্পটাতে। তার জন্য অনেক দুঃখিত। অবশেষে আজ গল্পটা শেষ করলাম। সবাই আমার জন্য দোয়া করবেন আর আগামী গল্পেও আপনারা আমার গল্পের সাথেই থাকবেন সেই আশা রাখছি। আল্লাহ হাফেজ।]