#দূর_আলাপন
পর্ব-১৬
অদ্রিজা আশয়ারী
__________________
তিহা আহত চোখে তাকায়। কাছে গিয়ে হাত ধরে মারুফ সাহেবের। নিচু স্বরে বলে, ‘ কি বলছ বাবা? এসব কি বলছ তুমি? ভালো-খারাপ সবই তো আল্লাহর পক্ষ থেকে আসে। আল্লাহ তার প্রিয় বান্দাদেরই পরীক্ষা নেন বেশি। দেখেন সেই বান্দার ধৈর্য কতটুকু। এই দুঃসময় টা একদিন ঠিক কেটে যাবে। আল্লাহ দুঃখ যেমন দিয়েছেন, তেমনি সুখও দেবেন। তবে কেন তুমি বলছ এসব কথা! সারাজীবন তুমিই না আমাদের শিখিয়েছ কিভাবে সবর করতে হয়, অনেক অল্পেই কিভাবে সন্তুষ্ট থাকা যায়?’
মারুফ সাহেব অসহায় মুখে মেয়ের দিকে তাকান। তার মেয়ে কি সুন্দর বুঝদারের মত কথা বলতে শিখেছে, ঠিক যেরকমটা একসময় তিতিক্ষা বলত। অথচ তিনি নিজে এই পরিনত বয়সে এসেও আজ কিরকম ভেঙে পড়েছেন। দিনরাত চোখের জল ফেলছেন চিন্তায়, এসব দেখে দেখে।
তিহা ফের বলে, ‘তুমি এভাবে ভেঙে পড়ো না বাবা। তাহলে আমি একা কিভাবে সামলাবো এতসব? ‘
মারুফ সাহেব চোখের চশমা খুলে সামনে এগিয়ে যান। গিয়ে বসেন অদূরে রাখা চেয়ারে। তিহা বাবার পাশে এসে দাঁড়ায়।
কিছুক্ষণ নিরব থেকে কপালে হাত রেখে কি যেন ভাবেন তিনি। তারপর উত্তেজিত হয়ে মেয়েকে বলেন,’ তিহা, এসো যেভাবেই হোক আমরা তিতির একটা বিয়ের ব্যাবস্থা করি।’
তিহা হতাশ মুখে বলে,’ কে করবে ওকে বিয়ে বাবা? সবকিছু জানার পর, এইযুগে কেউ কি রাজি হয়? ‘
মারুফ সাহেব দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলেন। কিন্তু আবার নতুন উদ্যমে বলেন,’ না হোক আমার মেয়ের বড় ঘরে বিয়ে। আমরা নাহয় অসহায় কাউকে একটা খুঁজে এনে ওর সাথে বিয়ে দেব। দুজনকে রাখব এবাড়িতেই। মেয়েটার জীবনে তাহলে সত্যি একটা গতি আসবে। নাহয় এভাবে আর কতদিন? আমারও তো বয়েস হয়েছে। কদিনই বা আর বাঁচব? তারপর, কি হবে ওর?’
তিহা প্রতুত্তরে কিছু বলে না। কিছুক্ষণের জন্য ভাবুক হয়ে ওঠে সে। তারপর লম্বা একটা নিশ্বাস ছেড়ে ‘হুম’ বলে সে চলে যায় নিজের ঘরে।
এই নিয়ে তিহা অনেক ভাবে এরপর। নিনাদ তাকে মিষ্টি ভাষায় যেভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে সেদিন, তারপর আর ওর কথা ভাবা যায় না। অথচ এই নিনাদ একসময় কত পাগল ছিল তিতিক্ষার জন্য। যেকোনো পরিস্থিতিতে সে রাজি ছিল তিতিক্ষাকে বিয়ে করতে। তিহা বোঝে নিনাদ কষ্ট পেয়েছে। সবকিছু জানার পরও যেভাবে সে নিনাদকে রেখে অন্য কারো কাছে সপে দিচ্ছিল নিজের বোনকে। সেই ব্যাপার টা কষ্ট দিয়েছে তাকে। কিন্তু তাই বলে আজ এই দুঃখের দিনে সেসব কথা ধরে বসে থেকে, নিজে থেকে সবকিছু শেষ করে দেয়া। তা-ও কি ঠিক? কিন্তু নিনাদ তো করল তা-ই। তিহা তাই শেষে যুক্তি দিয়ে ভেবে দেখে মারুফ সাহেবের কথাগুলো। একবার সংসার জীবনে ঢুকে পরলে তিতিক্ষা সত্যিই হয়ত ঠিক হয়ে যাবে। বাস্তবতা মানুষকে চিনিয়ে দেয় অনেককিছু, জীবনটা কত জটিল, তার অলিগলি গুলো কত প্যাচানো তা মানুষ বুঝতে পারে সহজে। তিতিক্ষাও হয়ত সংসারে পড়ে বদলে যাবে। কত লোকেরই তো পরিবর্তন হয় এভাবে।
এরপরের দিনগুল ভীষণ ব্যাস্ত কাটে তিহার, তিতিক্ষা কে নিয়ে। প্রতিনিয়ত তিতিক্ষা কে সে বোঝাতে থাকে জীবন কোন ছেলেখেলা নয়। এভাবে দিনের পর দিন কাটতে পারে না একটা মানুষের। তিতিক্ষা কখনো বোঝে সবই, মাথা নেড়ে সায় জানায়, কখনো আবার অবুঝ হয়ে ওঠে ভীষণ।
এরমধ্যেই একটা ছেলে দেখা হয়। পিতামাতা হীন গরিব ছেলে। শহরে বাড়ি বাড়ি গিয়ে টিউশনি করে রোজগার করে যা দু’পয়সা। থাকে মেসে।
ছেলেটি সবকিছু জেনেই রাজি হয়। মারুফ সাহেব আশাবাদী হয়ে ওঠেন। এবার যদি হয় মেয়েটার একটা গতি…..।
তিতিক্ষার সাথে কথা বলার জন্য একদিন ডেকে পাঠানো হয় ছেলেটিকে। তিহা অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে বোনকে নিয়ে হাজির হয়। প্রথমে স্বাভাবিকই থাকে সে। কিন্তু ছেলেটির নাম শোনা মাত্রই তিতিক্ষা খেপে ওঠে হঠাৎ। সামনের টেবিলে রাখা পেপার ওয়েট ছুড়ে মারে সে ছেলেটির কপালে। কপালে রুমাল চেপে রক্ত মুছতে মুছতেই বাড়ি ছাড়ে ছেলেটি। তিতিক্ষাই তাকে বাধ্য করে বাড়ি ছাড়তে। পরবর্তীতে সে জানতে পারে তার অমার্জনীয় অপরাধ হল তার নামটা। রাজন। অতএব মারুফ সাহেবকে এই সম্মন্ধের আশাও ত্যাগ করতে হয়।
এবার তিহা এবং মারুফ সাহেব উভয়েই ভীষণ চিন্তায় পড়ে যান। এভাবেই যদি ছোট ছোট কারনে তিতিক্ষা পেছাতে থাকে, তাহলে আদৌও ওর বিয়ে হবে কিনা সন্দেহ। নিজে তো সে সম্পুর্না নয়। তবে কিসের অত বাছবিচার! তারাও অবশেষে বিরক্ত হয়ে ওঠেন।
সেদিন বিকেলে তিহা তখন চা করছিল রান্নাঘরে। ছোটন উঠোনে খেলছে। মারুফ সাহেব পত্রিকা পড়ছিলেন সোফায় বসে। তিতিক্ষা আছে নিজের ঘরে। বসে বই পড়ছে সে। তিতিক্ষা অনেকটা সুস্থ এখন। আজকাল আর সে পাগলামি করে না যখন তখন। দিনরাত ব্যাস্ত থাকে এটা সেটা নিয়ে। হয় বই পড়া কিংবা কুরআন তিলাওয়াত অথবা সেলাই। তিহা আর মারুফ সাহেবের জোরে অনেকটা স্বাভাবিক হয়েছে সে এখন। কিন্তু এখনো বেঁকে বসে ওই এক জায়গাতেই। বিয়ের কথা বললেই সে অযথা ভীষণ গম্ভীর হয়ে ওঠে।
মেয়েকে নিয়ে মারুফ সাহেবের দুশ্চিন্তা তাই কমে নি এখনো।
সেই শেষ অপরাহ্নে, সবাই যখন ব্যাস্ত নিজেদের কাজে তখন বাইরেই দরজায় একটা আওয়াজ ওঠে। কেউ বেশ শব্দ করেই উঠোনের শেষ মাথার লোহার গেইট খুলে এসে ঢোকে বাড়িতে। তিহা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে উঁকি দেয় সেদিকে। তখন আফরিন উঠোন পেরিয়ে এসে হন্তদন্ত হয়ে দাঁড়ায় কাঠের দরজা আগলে। তিহা তাকে দেখে অবাক হয়। বলে,’ আফরিন, তুমি হঠাৎ?’
আফরিন চিন্তিত মুখে সসংকোচে উত্তর করে,’ অনুরোধ, আপনি একবার আসেন আমার সাথে। নিনাদ ভাইয়ের কি জানি হইসে। এতদিন হয়া গেল এখনো তার জ্বর কমল না। ডাক্তারও দেখায় না, ওষুধও খায় না। সারাদিন দোর দিয়া বইসা থাকে ঘরে। আর রাত হইলেই খালি আবোলতাবোল কয়।’
তিহার কপালে ভাজ পড়ে, ‘তুমি আমাকে একটা কল করলেই তো পারতে আফরিন। এতদূর কষ্ট করে একা আসতে হত না। ‘
আফরিন স্বভাবমত শাড়িতে আঙুল পেচাতে পেচাতে ইতস্তত করে বলে, ‘নিনাদ ভাই তার ফোন, সিমকার্ড সব ভাইঙ্গা ফালাইসে সেইদিন। আমার আর চাচির ফোন থাইকাও ডিলিট কইরা দিল আপনেগো নাম্বার। তারপর আজকে নিজেই আমারে কইল আপনারে নিয়া যাইতে। তাই…… দয়া কইরা আপনে আসেন আমার সাথে এক্ষণি।’
আফরিনের কথা শেষ হতেই তিহা দৌড়ে যায় ঘরে। মুহূর্ত পরেই বেরিয়ে আসে গায়ে বোরকা জরিয়ে। বলে, ‘চল।’
নিনাদের বাড়ি পৌঁছাতেই শিউলি বেগম তিহাকে দেখে ছুটে আসেন। করুণ স্বরে কাঁদতে কাঁদতে বলেন,’ ও মায়া, আমার নিনাইদ্দার কি হইল একটু দেহো না। কেমন জানি হয়া গেসে ছেরাডা। আমার কথা একদম শুনে না। সারাদিন বইসা থাকে ঘরের দরজা বন্ধ কইরা। কিছু কইলে খালি হাসে। আমারে কইতে চায় না কিছু। তুমি কথা কউ তার লগে। হেরে বিয়ার দিবার চাইতাছি যহন থাইকা তহন থাইকাই এমন অদ্ভুত আচরন করতাসে। ওরে তুমি কউ তার কাউরে পছন্দ থাকলে আমারে কউক। ও যা চায় তাই হইব। আমি ওর পছন্দের মাইয়ার লগেই ওরে বিয়া দিমু।’
তিহা হালকা হেসে বলে, ‘আপনি অত ভাববেন না ফুআম্মা। আমি দেখছি। কি ব্যাপার।’ বলে সে এগোয় নিনাদের ঘরের দিকে।
নিনাদের ঘরের সামনে এসে তিহা ইতস্তত করে দাঁড়িয়ে পরতেই পেছন থেকে আফরিন সাথে সাথে বলে ওঠে ,’ খারায়া রইছেন কেন? নিনাদ ভাই কিছু মনে করব না। আপনি ভেতরে যান।’
তিহা পা বাড়ায়। ভেতরে গিয়ে দেখে নিনাদ চুপচাপ শুয়ে আছে বিছানায়। তাকে দেখেই সে ত্বরিতে উঠে বসে। মুখে কিছু বলে না। কেবল মুখ তুলে তিহাকে ডিঙিয়ে সে তাকায় পেছনে দাঁড়ান আফরিনের দিকে। আফরিনের সামনে নিনাদ কথা বলতে সংকোচ করছে দেখে তিহা ঘাড় ঘুড়িয়ে আফরিন কে বলে এক গ্লাস পানি নিয়ে আসতে। ব্যাপার টা বুঝতে পেরে আফরিন ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায় তৎক্ষনাৎ। ফিরে এসে রেখে যায় এক গ্লাস ভর্তি পানি।
পুরো ঘরে আলো আঁধারির আবছা জাল বিছানো। নিনাদ অপরাধীর মত মাথা নুইয়ে বসে আছে বিছানায়। তিহা আড়চোখে একবার তাকায় সেদিকে। নিনাদকে দেখে মনে হচ্ছে সে ভীষণ অসুস্থ। মুখও কেমন বিষাদে পূর্ণ যেন তার।
তিহা একটা চেয়ার টেনে বসে বিছানা থেকে কিছুটা দূরে। স্বাভাবিক গলায় কথা শুরু করে। কোনরকম সৌজন্যতা না দেখিয়ে সরাসরি বলে,’ কেন ডেকেছিস বল।’
নিনাদ মুখ তোলে না। কয়েক মুহূর্ত কিছু যেন ভাবে। তারপর ভাঙা ভাঙা স্বরে বলে,’আমি সত্যিই দুঃখীত তিহা। তখন মাথার ঠিক ছিল না। তিতিক্ষা কে নিয়ে তুই কি অবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিস সেটা না বুঝেই আমি সেদিন কষ্ট দিয়েছি তোকে।’
তিহা ইতস্তত করে বলে, ‘না না, কিছু মনে করি নি আমি সেসবে।’
নিনাদ মলিন হেসে বলে,’আমি জানতাম। তুই কখনো আমাকে ভুল বুঝতেই পারিস না। তুই তো আমার বোন। ভাই অপরাধ করলেই কি বোন তাকে ছেড়ে দিতে পারে? তিহা শোন, আমি খুব কষ্টে আছি। আমি খেতে, ঘুমাতে পারি না। সব আমার থমকে আছে। একা থাকলেই শুধু একটা কান্নার আওয়াজ শুনতে পাই। আচ্ছা তিহা, আমার একটা অনুরোধ রাখবি? একবার নিয়ে যাবি আমাকে তোদের ওখানে? আমি সত্যিই…. ‘
তিহা তাকে হঠাৎ থামিয়ে দেয়। তারপর নিজেই বলে চাপা স্বরে, ‘হ্যাঁ, যাব তোকে নিয়ে। তার আগে বল কেন তুই এমন করছিস? শিউলি ফুআম্মার পছন্দের মেয়ের সাথে বিয়ের ব্যাপারে কেন তোর এত বিতৃষ্ণা? তোর চিন্তায় ফুআম্মার কি অবস্থা হয়েছে দেখেছিস? তুই কি তাহলে এখনো তিতিক্ষাকেই বিয়ে করবি বলে ভেবে রেখেছিস?’ বলে সে কৌতুহলী চোখে তাকায় নিনাদের দিকে।
-‘চাইলেই কি রাজি হবে ও?’ নিনাদ মলিন কণ্ঠে বলে।
তিহা একটু অবাক হয়। একদৃষ্টে সে তাকিয়ে থাকে নিনাদের দিকে। ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। তার গলায় আটকে থাকা কাঁটাটা যেন সরে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। কিন্তু নিজেকে সে সামলে নেয়। সহসাই গম্ভীর হয়ে ওঠে। বলে, ‘এখন তুই জ্ঞানে আছিস তো? ভেবে বলছিস সবকিছু? তিতিক্ষার সাথে যা ঘটে গেছে সেটা জানার পর ফুআম্মা কোনদিন ওকে মেনে নেবে বলে তোর মনে হয়? তাছাড়া আমার বোন জীবনে অনেক সয়েছে। এখন যদি আবার সবকিছু ঠিক হওয়ার পর ঝড় আসে, ও সামলাতে পারবে না।’
নিনাদ তীব্র স্বরে বলে, ‘তিতিক্ষার সাথে কি ঘটেছে সেসবে কিছু যায় আসে না আমার। আমি শুধু ওর পাশে থাকতে চাই। অহর্নিশ আমার শুধু মনে হয়। আমি এখানে থাকলে কখনো ঘটত না এমন কিছু। যদিও এই ভাবনা অযৌক্তিক। আল্লাহ যখন যা ঘটার লিখে রেখেছেন তা ঘটবেই।
তবুও আমি একটু শান্তি চাই। বাবা-মা কে হারানোর পর জীবনে আর কখনো আমাকে এত কষ্ট পেতে হয়নি। তুই তিতিক্ষা কে বল ও যা চাইবে তাই হবে। আমি শুধু ওর ছায়া হয়ে থাকব। এর বেশি আর কিছু চাইব না। শুধু সেটুকু নিশ্চিত হতে চাই, যেন জীবনে আর কখনো ঝড় না আসে।’ বলে নিনাদ থামে।
-‘আর ফুআম্মার ব্যাপার টা? ‘
-‘ফুআম্মা আমার জন্য সব মেনে নেবেন। নিশ্চয়ই রাজি হবেন।’
তিহা যেন হাফ ছেড়ে বাঁচে। আঁধার রাত্রির নিগূঢ়তা পেরিয়ে আবার নতুন করে সেদিন সে আশার আলো দেখতে পায়।
চলবে……..