দেশলাই – ৯ম পর্ব
বছর খানেক পরেই তাদের সম্পর্ক কেমন প্রাণহীন হয়ে পড়ে। ঘুড়ির সুতো কাটা পড়ে। ছন্দ পতন হয়। ইন্তিশা কেমন নীরব হয়ে যায়। ওর মোবাইল থেকে এখন আর মেসেজ বা কল আসে না। রাফসান কল দিলে কেবল ভদ্রতার বাক্যবিনিময় হয়। মেসেজ দিলে ‘হুম, হ্যাঁ’ ধরনের অনাগ্রহের উত্তর। রাফসান আগের মতো নীলগঞ্জে যেয়ে রাত কাটানোর বাহানা খুঁজে। কিন্তু ইন্তিশা সাড়া দেয় না। নানান অজুহাত দাঁড় করিয়ে বাঁধা দেয়। তার ভেতরে ভেতরে তখন রাগ হয়। কঠিন দু’একটা কথা বলে ফেলে। ঝগড়াঝাটি করে দু’জন ফোন রেখে দেয়। কিন্তু ওপাশ থেকে রাগ ভাঙানোর চেষ্টায় মোবাইল বেজে উঠে না। রাফসান কল বা মেসেজ না দিলে এভাবেই কয়েকদিন চলে যায়। আবার সে নিজ থেকেই কল দেয়। মেসেজ দেয়। খানিকটা স্বাভাবিক হয় সম্পর্ক। জোড়াতালি দিয়ে সম্পর্ক এভাবে জিইয়ে রাখার অঘোষিত একটা দায়িত্ব এসে পড়ে কেবল রাফসানের উপরেই।
তাই বলে ইন্তিশাকে পাওয়ার দাবী কমে যায়নি, বরং বেড়েছে। অন্যদিকে ইন্তিশা ধীরে ধীরে সরে যেতে থাকে। তাতে ঝগড়াঝাটি, রাগ, মান-অভিমান, অভিযোগ বাড়ে। আরও একটি বছর সম্পর্ক ভাঙা গড়ার খেলার ছলে চলে যায়।
সেদিন রাফসানের ইন্টারের টেস্ট পরীক্ষা শেষ। ততদিনে ইন্তিশা নিজ থেকে খোঁজ-খবর নেয়া পুরোদমে ছেড়ে দিয়েছে। রাফসানও এই কয়দিন পরীক্ষার ব্যস্ততায় সব সময় নিয়ম করে মেসেজ দেয়নি। আজ তিনদিন হলো তাদের কোনো যোগাযোগ নেই। শেষ মেসেজ এখনও সিন করেনি।
আজ শেষ পরিক্ষা দিয়ে সে যেন হাফ ছেড়ে বেঁচেছে। মেসে ফিরে গোসল আর খাওয়া-দাওয়া শেষ করে বিছানায় গা হেলিয়ে দেয়৷ মেসেজ সিন করেনি দেখে ডায়রেক্ট কল দেয়। তাকে অবাক করে দিয়ে মোবাইল বন্ধ দেখায়। অকারণ হোয়াটসঅ্যাপ, মেসেঞ্জারেও মেসেজ দেয়। না সিন হয় না।
– ‘সাদ, এই সাদ।’
রান্নাঘর থেকে জবাব দেয়, ‘কিরে ডাকছিস ক্যান?’
– ‘তোর মোবাইলটা দে ভাই।’
– ‘আরে বাল এখানে আইসা নে।’
রাফসান তাড়াতাড়ি রান্নাঘরে যায়।
– ‘মোবাইল দিয়ে কি করবি?’
– ‘দরকার আছে দে।’
রাফসন মোবাইল হাতে নিয়ে রুমে আসে। সাদের মোবাইলে নাম্বার তুলে কল দেয়। কিন্তু বিশেষ কাজ হয় না। ইন্তিশার মোবাইল বন্ধ।
আচমকা মোবাইল বন্ধ৷ মেসেজ সিন না হওয়ার কারণ বুঝতে পারে না সে। অস্থির হয়ে যায়। খাটে বসে আঁজলা করে মুখ ঘষতে থাকে। চুল ধরে টানে৷ অস্থিরতার সময় এরকম করা তার অভ্যাস।
হঠাৎ মাথায় এলো সুলতানার কথা।
তাড়াতাড়ি মোবাইল হাতে নিয়ে কল দেয়, ওপাশে রিং হয়ে কেটে আসে। আবার দেয়। না রিসিভ হয় না।
তার বুক ধুকপুক করে। নিজেকে মনে মনে তাচ্ছিল্য করে বুঝায়। মোবাইল তো বন্ধ হতেই পারে। এখানে অস্থিরতার কি আছে? তবুও তার ভয় কমে না। যেন অবচেতন মন কিছু একটা বুঝে নিয়েছে।
খানিক পর মোবাইলে রিং হয়। চমকে উঠে মোবাইলের স্ক্রিনে তাকায়। সুলতানা কল দিয়েছে।
– ‘হ্যালো, সুলতানা কেমন আছো?’
– ‘আমি আর কেমন জেনে লাভ আছে? তোমরা দু’জন তো ভুলেই গেছো আমাকে।’
রাফসান আর সেদিকে না গিয়ে মূল কথায় ফিরে যায়,
– ‘আচ্ছা ইন্তিশার কোনো খবর কি জানো? কয়েকদিন থেকে ওর মোবাইল বন্ধ কেন?’
– ‘জানি না তো।’
– ‘আচ্ছা আরেকটা উপকার করবে সুলতানা?’
– ‘কি বলো?’
– ‘ওদের বাড়িতে একবার যাবে? কি সমস্যা জানবে আর পারলে তোমার মোবাইল দিয়ে ফোন দিয়ে কথা বলাবে প্লিজ।’
– ‘একটা কথা বলি?’
– ‘বলো।’
– ‘ইন্তিশা চাইলে আমি এই উপকার করতে পারবো। কিন্তু সে কথা বলতে না চাইলে আমি কিছুই করতে পারবো না৷ তুমি হয়তো জানো না, আমি এই এলাকায় লোকাল না। আমার বাড়ি ময়মনসিংহ। বাবার চাকুরির কারণে এখানে থাকি আমরা। ইন্তিশার সঙ্গে সম্পর্ক আগে অনেক ভালো ছিল। এখন আগের মতো যোগাযোগও হয় না। আচ্ছা তবুও আমি যাবো।’
– ‘ধন্যবাদ সুলতানা। তুমি শুধু খোঁজ-খবর নাও।’
পরেরদিনই ইন্তিশার মোবাইল থেকে কল আসে। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে সেই মিষ্টি কণ্ঠ শুনতে পায়। তার ভেতরকার সমস্ত অলিগলিতে যেন একফালি শীতল হাওয়া ভিজিয়ে দিয়ে গেল।
– ‘তোমার মোবাইল বন্ধ কেন বলো তো? আর মেসেজ দেই সিন করো না?’
– ‘আগে বলো তুমি এতো অস্থির কেন রাফসান? সুলতানাকে আমাদের বাড়িতে পাঠানো ঠিক হয়নি। এমনিতেই আব্বু-আম্মু কীভাবে জানি টের পাইছেন সবকিছু। হাত থেকে মোবাইল নিয়ে অফ করে তালা মেরে রেখেছেন। ভার্সিটিতেও যেতে দিচ্ছেন না।’
– ‘বলো কি! এতোকিছু হয়ে গেল কীভাবে? এখন কি করবে?’
– ‘এতোকিছু তো হবেই রাফসান। তুমি বেশি বাড়াবাড়ি করেছো। আমাদের আরও আগেই লাগাম টেনে রাখা উচিত ছিল। তোমার এতো ঘন ঘন আসা যাওয়ায় কিছু বুঝলেন কি-না কে জানে।’
– ‘আল্লাই জানে। কিন্তু এখন কি করবে? আমাদের যোগাযোগ হবে কীভাবে?’
– ‘তুমি আছো তোমার যোগাযোগ নিয়ে। এদিকে আমার পড়ালেখা বন্ধ করে দিবে কি-না ভয়ে আছি। এখন থেকে তুমি আমার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করবে না৷ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আমি নিজেই যোগাযোগ করবো, ঠিক আছে? আর সুলতানাকে তুমি পাঠাবে না আমাদের বাড়িতে। ও এলে পরিবারের মানুষ আরও সন্দেহ করবে। এখন রাখছি।’
ওপাশ থেকে লাইন কেটে গেল। রাফসান মোবাইল পাশে রেখে মুখ ঢেকে খানিক্ষণ বসে রইল। নিজেকে সান্ত্বনা দিলো হয়তো সব ঠিক হয়ে যাবে। ইন্তিশা তার সঙ্গে নিজ থেকেই যোগাযোগ করবে।
কিন্তু মাস খানেক চলে যায় ইন্তিশার কোনো খোঁজ-খবর নেই৷ ওর নিষেধ থাকার পরও আবার সুলতানার সঙ্গে যোগাযোগ করে। অনুরোধ করে আবার ইন্তিশাদের বাড়িতে পাঠায়।
ফোনে কথা হয় দু’জনের।
ইন্তিশা কাঁদতে কাঁদতে বলে পরিবার বিয়ে দিয়ে দেবে। প্লিজ তুমি বিয়ের প্রস্তাব দাও আমার আব্বু-আম্মুর কাছে। আকাশ ভেঙে পড়ে রাফসানের মাথায়। এখনও তো তার বিয়ের বয়সই হয়নি। কীভাবে বিয়ে করবে? তার পরিবারও তো মানবে না। তাছাড়া বেকার ছেলের কাছে ওর বাবা-মা কি দেখে বিয়ে দেবে?
রাফসান আমতা-আমতা করে বলে,
– ‘তোমার মা-বাবাকে বলো সম্পর্ক আছে।’
ওপাশ থেকে ইন্তিশা জানায়,
– ‘হ্যাঁ, আমি বলেছি। ওরা চায় তুমি নিজের অবিভাবক নিয়ে সামনে আসো। বিয়ের প্রস্তাব দাও।’
– ‘প্রস্তাব দিলে কি বিয়ে দেবে?’
– ‘কীভাবে দেবে? তুমি মাত্র ইন্টারে পড়ো।আমি তো সেটা ওদের বলিনি। জানলে আমাকে মেরে ফেলবে সবাই।’
– ‘ইন্টারে তো তুমি জেনেই রিলেশন করছো।’
– ‘আরে বাবা, আমার মা-বাবা তো জানে না। আমি তো এখনও চাই তোমাকে। তুমি বললে আমি এখনই পালিয়ে চলে আসবো? পারবে তুমি আমার দায়িত্ব নিতে? তোমার তো বিয়েরও বয়স হয়নি। এদিকে আমার পরিবার বর খোঁজা শুরু করেছে।’
– ‘তাহলে এখন আমি কি করবো।’
– ‘এখন একটাই পথ আমি বাধ্য মেয়ে হয়ে মা-বাবার কথামতো চলবো। তাতে ওদের আস্থা আসবে আমার উপর। আমি তখন বলবো পড়ালেখা করতে চাই। এখন বিয়ে করবো না। তুমিও আপাতত কোনোভাবেই আমার সঙ্গে যোগাযোগ করবে না। সুলতানার সঙ্গেও না। আর নীলগঞ্জ ভুলেও আসবে না।’
রাফসান দীর্ঘদিন যোগাযোগ করা থেকে বিরত থাকে। কিন্তু ইন্তিশার বিরহ যন্ত্রণায় তো সে নিরবধি পুড়ছে। নিজেকে অন্যকিছুতে ব্যস্ত রাখতে চেষ্টা করতে গিয়ে আরও স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ে। গান শুনলে ইন্তিশার সঙ্গে কাটানো সমস্ত স্মৃতি তাকে তাড়া করে। নাটক-সিনামা দেখলে মনে হয় নায়িকা ইন্তিশাম। এই গল্প তাদের। উপন্যাস পড়তে গেলে বারংবার অন্যমনস্ক হয়ে যায়। সিম অপারেটর থেকে মেসেজ এলেই চমকে উঠে ভাবে এই বুঝি মেসেজ দিলো। কিন্তু না, ইন্তিশার মেসেজ আসে না। কল আসে না। তার ইন্টারের পরীক্ষার আগেরদিন সুলতানাকে আবার কল দেয়। সুলতানা জানায় ইন্তিশার সঙ্গে কথা বলে না। তাদের ঝগড়া হয়েছে। আর যেন তাকে কল না দেয়। এই লাইন কেটে দেয়। রাফসান কল দিলে আর কখনও সুলতানা রিসিভ করেনি। পাগলের মতো হয়ে যায় সে। দিনে-দুপুরে ছুটে চলে যায় নীলগঞ্জ। ওদের বাড়ির আশপাশে উঁকিঝুঁকি দেয়। না, ইন্তিশাকে দেখা যায় না কোথাও। ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসে।
এরপরই তার ফাইনাল পরীক্ষা শুরু হয়। নীলগঞ্জে চাইলেও যেতে পারে না৷ কিন্তু এই অবস্থায় পড়ালেখায় মনযোগ দেওয়া তার পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে। রাতভর গান শোনা, সিগারেট টানা, আনমনে বইয়ের পাতা ওল্টানো আর পরেরদিন আবার পরীক্ষা দেওয়া ছাড়া উপায় থাকে না৷ সমস্ত মস্তিষ্ক জুড়ে ইন্তিশা। প্রতিটি চিন্তায় কোনো না কোনোভাবে ইন্তিশা। খাওয়া-গোসল কিচ্ছু ভালো লাগে না। ঘুম থেকে উঠলে মনে হয় কি হবে উঠে? নিজের কাছেই যেন নিজেকে পাগল লাগে তার। কারও কাছে মনের সব কথা খুলে বলে ভীষণ কাঁদতে ইচ্ছে করে। কিন্তু কেউ শুনে না। সবার কাছে হাস্যকর লাগে। এই অবস্থায় এইচএসসি ফাইনাল পরীক্ষা চলছে। পড়ার টেবিলে মন বসছে না। পরীক্ষা ভালো হচ্ছে না। এটার জন্যও ভেতরে একটা অশান্তি শুরু হয়।
পরীক্ষার মাঝখানে একদিন ছুটি পায় সে। চলে যায় ইন্তিশার ভার্সিটিতে। গেইটের আশেপাশে হাঁটাহাঁটি করে। ওর বন্ধ ফোনে বারবার দেয়াল ঠেলানোর মতন কল দিয়ে ব্যর্থ চেষ্টা করে। নীলগঞ্জ বাজারে যায়। ওদের বাড়ির পাশের নদীর পাড়ে হাঁটে। কত ছোট ছোট স্মৃতি উঁকি দেয় মাথায়। কত রাত ইন্তিশার সঙ্গে কাটিয়ে কুয়াশার ভোরে চুপিচুপি এই রাস্তা দিয়েই সে ফিরে যেতো সিলেট। এই বাজার, এই নদীর পাড়েই হাঁটাহাঁটি করে সে ইন্তিশার ‘চলে আসো’ মেসেজের অপেক্ষা করতো।
এগুলো ভাবতেই ভাবতেই ইন্তিশার বাড়ির রাস্তায় গিয়ে সতর্কভাবে উঁকিঝুঁকি মারে। মাঝে মাঝে ভাবে বাড়িতে চলে যাবে৷ কিন্তু কি এক আশংকায় আর যাওয়া হয় না তার। পাছে ইন্তিশার আরও বিপদ আসে কি-না। পরিবারের মানুষ টের পেলে বেচারি ঝামেলায় পড়বে। মেসে ফিরে যায়।
পরীক্ষা শেষ হয়। তখন চুল-দাড়ি লম্বা হয়ে গেছে। নির্ঘুম রাত কাটিয়ে চোখের নিচে কালি পড়েছে। প্রেমিকার বিরহে হৃদয় পোড়ার সঙ্গে ঘন ঘন সিগারেট টেনে ঠোঁট কালো হয়েছে। এই রক্তাভ ঠোঁটের খুব প্রশংসা করতো ইন্তিশা। সেই ঠোঁট আজ তারই বিরহে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে৷
পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরেই সে বাসে উঠে ছুটে চলে যায় নীলগঞ্জ। এখন সারাক্ষণ অন্যমনস্ক থাকে সে। কেমন ঘোরের ভেতর দিয়ে দিনকাল কাটে। তার অবচেতন মন হয়তো বুঝে ফেলেছে সব। ইন্তিশা আর তার নেই। হারিয়ে ফেলেছে সে।
অসতর্ক ভাবে সিগারেট টেনে টেনে নীলগঞ্জ বাজার, নদীর পাড়, ইন্তিশাদের বাড়ির রাস্তায় উঁকিঝুঁকি মারে। কোথাও ইন্তিশাকে দেখা যায় না। অথচ কি অদ্ভুত ভাবে তার চোখের সামনে ভেসে বেড়াচ্ছে সে। ঘপটি মেরে বসে আছে মস্তিষ্কে৷ মিশে আছে সমস্ত চিন্তা-ভাবনা জুড়ে।
রাস্তা থেকে নাম ধরে হাঁক ছাড়ে রাফসান। ওদের রাস্তার পাশে শিমুল গাছে বসা কাকটি হাঁক শুনে কা কা করে উড়ে যায়। ইন্তিশা আসে না। আরও কয়েকটি ডাক দিয়ে রাস্তার কিনারায় বসে মুখ ঢেকে ডুকরে ডুকরে কেঁদে উঠে সে। কয়েকজন লোক এদিকে আসে। তারা বেশ কিছুদিন থেকেই লক্ষ্য করছিল। এসে কলার ধরে দাঁড় করিয়ে বলল,
– ‘তোর বাড়ি কই? এদিকে কিছুদিন পর পর ঘুরাঘুরি করিস কেন?’
সে চোখের জল মুছে স্পষ্ট গলায় বলে দেয়,
– ‘এ বাড়ির মেয়েকে আমি ভালোবাসি।’
‘ঠাস’ করে একজন গালে চড় দিয়ে বলল, – ‘শালার পুত মুতের গন্ধ গেছে তোর? সম্পর্ক মারাচ্ছিস এলাকায় এসে। গ্রাম কি ল্যাংটা পাইছিস? কয়েকদিন পর পর এসে ঘুরাঘুরি করিস। এই শালাকে বেঁধে ফেল। আর ওর অবিভাবকের ঠিকানা নিয়ে বল এসে ছুটিয়ে নিতে।’
তাকে ধরে সবাই বাজারের দিকে নিয়ে যায়। মুরব্বি কয়েকজন মাঝখানে পড়ে। জিজ্ঞেস করে কি সমস্যা? রাফসান চোখের পানি মুছতে মুছতে মুরব্বিদের জানায়,
– ‘ওই বাড়ির মেয়ের সঙ্গে আমার সম্পর্ক আছে, তাই আসি।’
মুরব্বি একজন ধমক দিয়ে বলল,
– ‘এই বেটা, এসব কথা মুখে আনতে লজ্জা করে না? বিয়ের আগে কিসের সম্পর্ক? চ্যাংড়া পোলাপান পড়ালেখা করবি৷ তা না করে পিরিতি কইরা বেড়ায়। এইযে এলাকার পোলাপান তোকে ধরলো। এখন যদি পিটায় কি করবি? আর যেন কখনও এলাকায় না দেখি, সোজা বাসে উঠে চলে যা। আর এই বাড়ির মাইয়ার বাপের সঙ্গে আমরা কথা বলবো৷ এলাকার মান-মর্যাদা আর রাখলো না।’
ফিরে আসতে হলো রাফসানের। একটা সময় পরীক্ষার রেজাল্ট বের হয়। জানতে পারে তিনটি বিষয়ে সে ফেইল করে ফেলেছে। বদ্ধ উম্মাদ হয়ে যায়। শহরের রাস্তাঘাটে মেয়ে দেখলে তেড়ে যায় মারতে। অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ শুরু করে। রুমমেট সাদ রাফসানের বাড়িতে ফোন করে তার মানসিক অবনতির কথা জানায়। তারা এসে নিয়ে যায় তাকে।
(গল্প যারা পড়ছেন কমেন্টে জানান দেবার অনুরোধ রইল)দেশলাই – ১০
প্রায় আটচল্লিশ ঘন্টা পর ট্রেন গন্তব্যে ফিরেছে। পুরনো দিনের স্মৃতিচারণ করতে করতে রাফসানের চোখবুঁজে ঘুম আসে।
দিলশাদ গায়ে ধাক্কা দিলে চোখ মেলে তাকায়।
– ‘এসে গেছি চলো।’
সবাই ব্যাগ-প্যাক নিয়ে নামে।
তাদেরকে স্টেশন থেকে এসে মোম্বাই থানে শহরের সাপরজি কোম্পানীতে নিয়ে যায় ফোর ম্যান। কিন্তু সেখানে দু’দিনও থাকা গেল না। হঠাৎ কড়াকড়ি শুরু হওয়ায় ইন্ডিয়ান আধার কার্ড ছাড়া ফোর ম্যান কোম্পানিতে কাজ দিতে পারলো না। টাকা-পয়সা নেই৷ পাসপোর্ট নেই। মুখে ভাষা নেই। মহাবিপদে পড়ে গেল তারা। দিলশাদ চারদিকে ফোন করে কাজের সন্ধান পেয়ে তাদের নিয়ে গেল ব্যাঙ্গালোর। মুম্বাই থেকে সেখানেও প্রায় চল্লিশ ঘন্টার ট্রেন জার্নি। গুদরেজ কোম্পানিতে কাজ হলো তাদের। ফোর ম্যান নকল আধার কার্ড বানিয়ে দিলো। সেটা স্কেন না করলে মোটামুটি রাস্তাঘাটে চলার মতো। কিন্তু সিমও কেনা যাবে না এই কার্ডে। সেখানে পাওয়া গেল শফিককে। সেও বাংলাদেশ থেকে এসেছে। কিন্তু সাথের লোকদের সঙ্গে ঝামেলা হওয়ায় একা কাজ করছে। যোগ দিল রাফসানদের সঙ্গে। কিন্তু রাতদিন কাজ করে পেমেন্ট হওয়ার পাঁচদিন আগে নকল কার্ড কোম্পানি স্কেন করে ধরে ফেললো। পেমেন্ট ফেলেই সেখান থেকে পালিয়ে চলে গেল তারা হায়দ্রাবাদ আরেক কোম্পানিতে। সেখানে দুই মাস কাজ করে অল্প টাকা পেল। কিন্তু রাফসানের পুরো টাকাটাই ইন্ডিয়া আসা খরচের জন্য দিলশাদরা রেখে দিল। কিছুদিন পর এই কোম্পানিতেও ঝামেলা হওয়ায় হায়দ্রাবাদ আরেকটি জায়গায় তারা চলে যেতে হলো। সেখানে মাস কয়েক কাজ করেছে। এভাবে চলে গেল প্রায় এক বছর। আজ হঠাৎ দিলশাদরা শফিক এবং রাফসানকে ফেলে চলে গেছে। রাফসানের কোনো কিছুতেই ভয় বা দুশ্চিন্তার লক্ষণ কখনও দেখা যায়নি। দিনকাল কেটে গেছে কেমন ঘোরের মধ্য দিয়ে। সকাল ছ’টায় কাজে গিয়ে রাত দশটায় ফিরে এলে ক্লান্ত শরীরে অজান্তেই চোখবুঁজে ঘুম আসে। আবার ভোরে কাজে যেতে হয়।
ইন্ডিয়ার এক বছরের এই ব্যস্ত জীবনে ইন্তিশার স্মৃতির অত্যাচার থেকে খানিকটা মুক্তিও পেয়েছে সে। এক সময় হাত কেটেছে, আত্মহত্যারও চেষ্টা করেছে। শেষপর্যন্ত চোখ যেদিকে যায় সেদিকেই চলতে গিয়ে এই আশ্চর্য জীবন। বাড়িতে ফোন দেয়নি কখনও। ইন্ডিয়ান নাম্বার দেখলে আরও নানান প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। এগুলো তার ভালো লাগে না৷ তবে এবার দেশে ফেরার পালা।
শফিক আর রাফসান বিকেলে মুসলিম পাড়ার একটি বাজারে গেল। সেখান থেকে ভাজা চিকেন নিয়ে তারা বসলো গিয়ে একটি পাহাড়ে। শফিক এক টুকরো চিকেন মুখে দিয়ে বলল,
– ‘মদ খাবি?’
– ‘না।’
– ‘কেন প্রথম প্রথম তো প্রতি রবিবারে মদ আনতে চলে যেতি। এখন বাদ দিয়ে দিলি মনে হচ্ছে।’
– ‘হ্যাঁ বাদ দিয়ে দিছি।’
– ‘ভালো করছিস। আচ্ছা একটা ব্যাপার খেয়াল করেছিস? ইন্ডিয়া সবকিছুর দাম অনেক কম, তাই না?’
– ‘হ্যাঁ, এইযে দেখিস না গরুর ঘাসের বস্তা বাইকে করে নেয়। বাইকের দাম খুবই কম। সকলের বাইক আছে।’
– ‘আর মোবাইল? ওই দিন অনিমেষ দা গুগলে সার্চ মেরে দেখালো তাদের দেশে যে মোবাইলের দাম মাত্র ছয় হাজার। বাংলাদেশে এগারো হাজার টাকা।’
– ‘আচ্ছা এখন বল। অনিমেষ দা’কে কি বললি?’
– ‘বলেছি আমরা দুই মাস কাজ করবো৷ তারপর টাকা পেলে দেশে চলে যাবো।’
– ‘কি বললো?’
– ‘আর কি বলবে। ওর না-কি দাদা বাংলাদেশী ছিলেন। তাই বাংলাদেশীদের প্রতি আলাদা একটা টান আছে। এইসব আরকি। বলছে কাজ করতে। দেশে যেতে হলে সহযোগীতা করবে।’
– ‘আমার বিশ্বাস হয় না সহযোগিতা করবে। বরং টাকা পেলে আমরা দেশে চলে যাবো এতে তার দুইজন লোক কমবে।’
– ‘তো কি করবে সে?’
– ‘টাকা না দিয়ে ছ্যাচড়ামি করে কাজ করাবে। দিচ্ছি, দেবো বলে মাসের পর মাস খাটাবে।’
– ‘করুক, এছাড়া আর কিচ্ছু করারও নাই। আমাদের সিমও নাই। দালালের নাম্বারও নাই। অন্য জায়গায় কাজেও যেতে পারবো না। সুতরাং অনিমেষ দা শেষ ভরসা।’
– ‘তাও ঠিক।’
তারা সন্ধ্যার দিকে রুমে ফিরে এলো। পরেরদিন থেকে নিয়মিত কাজে যেতে লাগল। মাস খানেক কাজ করতেই পুরো বিশ্ব মহামারী করোনায় থমকে গেল। মাস্ক পরে সচেতনভাবে কিছুদিন তারা কাজ করে। কিন্তু কয়েকদিন বাদেই লকডাউন হয়ে যায় পুরো হায়দ্রাবাদ। মহাবিপদে পড়ে রাফসান আর শফিক। তাদের কাছে টাকা নেই। কন্ট্রাক্টরও অনিমেষের কল ধরছে না। তবে আশার ব্যাপার অনিমেষ তাদের দায়িত্বটা নেয়। কোনো রকম খেয়ে-দেয়ে বাঁচে। প্রথম পনেরো দিন গৃহবন্দী থাকার পর মোদি সরকার ঘোষণা দেয় এক সপ্তাহ সকল রাজ্যের চাকরিজীবী, দিনমজুর, শ্রমিকরা নিজ রাজ্যে ফিরে যাওয়ার জন্য বিশেষ ট্রেন চালু করার। তখনই কোম্পানি খালি হয়ে সবাই নিজ রাজ্যে ফিরে যেতে থাকে। অনিমেষও ব্যতিক্রম নয়। কারণ এরপর ট্রেন, বিমান, গাড়ি অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে যাবে৷ তখন তো আর কাজও নেই। কোম্পানির বাইরেও যাওয়া যাবে না। না খেয়ে মরতে হবে। অনিমেষ রাফসান আর শফিককে একটা কাগজে তার নাম্বার দিয়ে বলল, ‘বাড়ার ছেলেরা বেঁচে থাকলে দেশে ফেরার সময় কলকাতায় গিয়ে কল দিস।’
রাফসান আমতা-আমতা করে বলল,
– ‘দাদা আমরা দেশ থেকে না হয় তোমার ব্যাংক একাউন্টে টাকা আনাবো। আমাদের যাওয়ার ব্যবস্থা কি হবে?’
– ‘তোদের লাউরা দেখে কি ট্রেনের টিকেট দেবে? এখন স্পেশাল ট্রেন চালু করছে আধার কার্ড তো চাইবেই সাথে মেম্বার চেয়ারম্যানের সঙ্গেও যোগাযোগ করে সরকারি গাড়ি দিয়ে কোয়ারেন্টাইনে পাঠাবে। আর হাওড়া স্টেশনে করোনা টেস্ট তো করবেই। এতো সহজ না যাওয়া, বুঝলি?’
কথাটি বলে অনিমেষ ব্যাগ-প্যাক নিয়ে মাস্ক পরে বেরিয়ে গেল। রাফসান আর শফিক তার পেছন পেছন গেইট পর্যন্ত আসে। অনিমেষ চলে যাওয়ার পর তারা আবার গেইটের ভেতরে এসে সিকিউরিটির ফোনালাপ শুনে চমকে উঠে। চেয়ারে বসে সিলেটি ভাষায় ফোনে কথা বলছে,
–‘অয় আইতাম তো চাইরাম। কিন্তু আইয়া তো করোনার সময় অইও বইতাখতাম অইবো। এর থাকি ইকানো কোম্পানির ভিতরে আছি। বেতনও দিবো।’
শফিকের বাড়ি যশোর হলেও বুঝতে পারছে সিকিউরিটি সিলেটি ভাষায় কথা বলছে। এর আগে হিন্দিতে কথা বলতে দেখেছে। রাফসান ধীর পদে সিকিউরিটির পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। তাদেরকে দেখে ফোন রেখে বলল,
– ‘আন্দার যাও, ইদার কিউ?’
– ‘ভাই আপনে কিতা সিলেটি নি? ইকানো কিলা আইলা?’
সিকিউরিটি ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলল,
– ‘না তো। আমি আসাম গোয়াহাটির। সিলেট তো বাংলাদেশ।’
রাফসান সঙ্গে সঙ্গে সতর্ক হয়ে গেল। কি ভুলটাই না করতে বসেছিল। আসাম যে সিলেটি ভাষায় কথা বলে তার মনেই ছিল না৷
– ‘ও আচ্ছা। ঠিক আছে ভাই।’ বলেই শফিককে নিয়ে হাঁটা শুরু করেছিল।
– ‘রুক রুক। মেরা সাথ আজা।’
দু’জন থমকে দাঁড়ায়। সিকিউরিটি পেছন ফেরে বলল, ‘আজা রে আজা।’
দু’জন ওর সঙ্গে যায়। নিজের দরজা খুলে বল,
– ‘আও আন্দার আও। বেটো ইদার।’
লোকটির পুরো মুখ সেভ করা। কেবল ঠোঁটের ওপরে বিছার মতো গোঁফ। তাদেরকে বিছানায় বসতে দিয়ে হাতের তালুতে বিমল নিয়ে বুড়ো আঙুল দিয়ে ঘষতে ঘষতে বলল,
– ‘দু’জনের বাড়ি কি বাংলাদেশে?’
শফিক চতুরতা করে বলল,
– ‘আরে না দাদা। আমাদের বাড়ি তো কলকাতা দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা বনগাঁ।’
লোকটি বিমল জিভের নিচে দিয়ে বলল,
– ‘গুদমারানি আমার কাছে মিথ্যে বলতে হবে না। আমি জানি একেকটা কোম্পানিতে শত শত অবৈধ বাঙালিরা কাজ করে।’
দু’জন মিইয়ে গেল একদম। কি বলবে তারা খোঁজে পাচ্ছে না। চুপচাপ বসে আছে।
রাফসানকে উদ্দেশ্যে করে বলল,
– ‘সিলেটের কোথায় বাড়ি?’
রাফসান স্পষ্টভাবেই বলে দিলো
– হবিগঞ্জ।’
– ‘আমার আপন বড় বোনের বাড়ি সিলেট জকিগঞ্জ।’
রাফসান বিস্মিত হয়ে বলল,
– ‘তা কীভাবে?’
– ‘আমরা তো বাংলাদেশেই ছিলাম। তখন বোনের বিয়ে হয়। তারপর আমরা চলে আসি আসাম।’
– ‘ও আচ্ছা।’
– ‘কিন্তু তোরা এখন দেশে যাবি কি করে? আর সব কর্মী তো বাড়ি চলে গেছে কাল থেকে গোসল আর বাথরুমের পানির গাড়িও আসবে না।’
– ‘বুঝতে পারছি না ভাই। আমরা যাদের সাথে এসেছিলাম তারাও ফেলে চলে গেছে।’
– ‘থাক, কোম্পানির স্টাফ আর সিকিউরিটিরা আছে। তাদের সঙ্গে কথা বলে আমাদের সাথে খাওয়া গোসলের ব্যবস্থা করা যায় কি-না দেখবো। কিন্তু সাবধান, বাংলাদেশী ভুলেও বলবি না।’
– ‘আচ্ছা দাদা।’
– ‘তোরা কি রান্না-বান্না পারিস?’
শফিক বলল,
– ‘হ্যাঁ দাদা। আমি পারি।’
– ‘তাহলে চলবে। তোরা দু’জন রান্না করে স্টাফকে খাওয়াবি। আমাদের সঙ্গে খাবি আর রবিবারে হাত খরচার ব্যবস্থা করে দেবো। তোদের তো এতো টাকারও দরকার নাই। মুসলিমরা মদও খায় না।’
– ‘হ্যাঁ দাদা ওসব লাগবে না।’
তারা প্রায় দুই মাস এভাবে থাকতে হলো। এক সপ্তাহের জন্য ট্রেন চালু করে আবার এই দুইমাস দেশের সবকিছুই বন্ধ ছিল। তারা স্টাফের রান্না করার দায়িত্বে ছিল। যদিও সমস্ত কাজ শফিককেই করতে হয়েছে। রাফসান কেবল সঙ্গে ছিল। এখন দোকানপাট সাস্থবিধি মেনে সকাল ছয়টা থেকে সন্ধা ছয়টা পর্যন্ত খোলা রাখা যাবে। নিজ রাজ্যের গাড়ি চলাচল করা যাবে। তবে স্কুল-কলেজ বন্ধ। দুইমাস পর আবার সাস্থবিধি মেনে ট্রেন চালু করেছে। কিন্তু সেই ট্রেনে যেতে হলেও অনলাইনে আধার কার্ড দিয়ে টিকেট কাটতে হবে। হাওড়া গিয়ে আবার করোনা টেস্ট। করোনা না হলেও কোয়ারান্টাইনে রাখবে চৌদ্দ দিন। এদিকে স্টাফের সবাই বাড়িতে চলে যাওয়ার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। সিকিউরিটিও চলে যাবে। রাফসান আর শফিক সকালে রান্নাবান্না করে মাস্ক পড়ে হাঁটতে হাঁটতে তারা উঁচু পাথর পাহাড়ে গিয়ে বসে। তারা বুঝতে পারছে সামনে আরও বিরাট বিপদ। শফিকেরও ভয়ে অবস্থা খুবই খারাপ। রাফসান শফিককে স্বাভাবিক করার জন্য প্রায়ই অপ্রাসঙ্গিক কথা বলে। পাথরের একটা টুকরো ছুড়ে মেরে বলল,
– ‘বাংলাদেশে এমন পাথরের পাহাড় কি আছে রে?’
– ‘আমার জানা মতো তো নাই।’
– ‘মনে হয় নাই।’
– ‘আচ্ছা এখন কি হবে? ওরা তো সবাই চলে যাবে।’
– ‘ব্যবস্থা তো একটা হবেই। আচ্ছা তুই ইন্ডিয়া আসলি কেন? এই যে এতো মানুষ রিস্ক নিয়ে ইন্ডিয়া আসে এর কারণ কি? দেশে কি কাজ নাই?’
– ‘দেশে তো কাজ নাই। আর ইন্ডিয়া আমরা কয়েক বছর আগে চল্লিশ হাজারের উপরে মাসে পেমেন্ট পেয়েছি। হাত খরচ, থাকা খাওয়া ছাড়াই। মিডলইস্টেও এতো রুজি ছিল না। কিন্তু ইদানীং কার্ড নিয়ে বেশি ঝামেলা হয়। এদিকে করোনাও এসেছে।’
– ‘ও আচ্ছা।’
– ‘এখন কি করবি কিছু ভেবেছিস?’
– ‘বেশি সমস্যা হলে পুলিশের কাছে ধরা দেবো। জেল হবে।’
– ‘আরে না। জীবন এখানেই শেষ হয়ে যাবে। তাছাড়া করোনার সময় মেরেও ফেলতে পারে।’
– ‘আরেকটা উপায় আছে।’
– ‘কি?’
– ‘এখন কিন্তু দোকানপাট দিনে খোলা থাকে। এদিকে কোম্পানিগুলোর কলোনিতে শ্রমিক বা সিকিউরিটিও নাই। তার মানে আমাদের হাতে শুধু টাকা থাকলেই থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা আছে।’
– ‘কিন্তু টাকা কীভাবে পাবো?’
– ‘টাকা পাবো৷ তার আগে বুকে সাহস দরকার। দেখ, আমাদের এখন দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। দেশ থেকে তো এমনিতেই আমরা টাকা আনতে পারবো না। কারণ এখানে বিকাশ নেই। গুগল পে তাদের ইন্ডিয়ার ভেতরেই শুধু হয়। দেখলি না তোরা দেশে টাকা ছাড়তে হলে কলকাতার দালালদের কাছে গুগল পে’র মাধ্যমে দিতে হয়। তারপর কলকাতার দালাল বাংলাদেশের ছাড়ে। আমাদের দ্বারা ব্যাংকে লেনদেন হবেই না। আমরা দালদেরও চিনি না। এখন বাঁচা-মরা সমান। এই অবস্থায় বাঁচার জন্য সবই করতে হবে।’
– ‘কি করবি?’
– ‘আজ রাতেই আমরা এখান ছেড়ে পালাবো।’
– ‘কি? পালিয়ে কি হবে?’
– ‘শোন, স্টাফ সবাই এক রুমেই থাকে। আমরা আজ নিজেদের রুমে না গিয়ে বাইরে থেকে পুরো রাত এদের দরজায় নজর রাখবো৷ কেউ রাতে দরজা খুলে টয়লেটে গেলে পিছে পিছে একজন গিয়ে বাইরে থেকে ছিটকিনি লাগিয়ে দিয়ে আসবো৷ বাকীরা ঘুমে থাকবে। আমরা একজন রুমে ঢুকে যাবো। ওদের সবার একটা করে ব্যাগ লোহার আঙটায় ঝুলিয়ে রাখা। ব্যাগ তালা মেরে ওরা মানিব্যাগ রাখে। আমরা সবগুলো ব্যাগ নিয়ে কোম্পানির পেছনের দেয়াল টপকে জঙ্গলের দিকে চলে যাবো।’
– ‘কিন্তু ব্যাগগুলো তো তালা।’
– ‘রান্না ঘর থেকে দা আগেই পেছনের গেইটের বাইরে রেখে আসবো। দা দিয়ে ডায়রেক্ট ব্যাগ কেটে ফেললেই হবে।’
– ‘কিন্তু যদি ধরা পড়ি?’
– ‘তো সমস্যা কি? আমরা তো এমনিতেই খুব সুখে না। তাছাড়া এক সঙ্গে সবাই তো ঘুম থেকে উঠে যাবে না। প্রয়োজনে একজনের হাতে রট রাখবো।’
– ‘আমার ভয় লাগে রে ভাই।’
– ‘কিসের বালের ভয়? কিছুই হবে না।’
প্ল্যান মতো তারা খুব সতর্কভাবে হাঁটাহাঁটি করে সময় কাটাতে লাগে। তাদের কাপড়-চোপড়ের ব্যাগ আর দা ইতোমধ্যে গেইটের বাইরে রেখে এসেছে। শফিকের হাতে একটি রট। স্টাফদের অনেকগুলো ব্যাগ হাতে করে নেয়া যাবে না। আলগোছে সব রটে ঢুকিয়ে কাঁধে নিতে হবে। কুকুরের ডাক শোনা যাচ্ছে। দূরে কোথাও মাইকে গানের আওয়াজ আসছে। রাত দু’টোর দিকে একজন দরজা ‘খ্যাক’ করে খুলে টয়লেটে যায়। রাফসান পেছন পেছন গিয়ে আলগোছে ছিটকিনি লাগিয়ে দেয়। ভেতর থেকে লোকটি কেবল গলা খাঁকারি দিয়ে নিজের জানান দেয়। বোধহয় ভেবেছে কেউ টয়লেটে যাওয়ার জন্য দরজায় ধাক্কা দিয়েছে। ছিটকিনি লাগানোর ব্যাপারটি বুঝতে পারেনি। পা চালিয়ে সে স্টাফদের রুমের দিকে যায়। শফিকের পা এগুচ্ছে না ভয়ে৷ রাফসান ঘরে ঢুকে তাকে হাত দিয়ে ইশারা করে। একটা একটা করে সব ব্যাগ শফিকের হাতে দেয় আর সে রটে ঢুকিয়ে নেয়। সব শেষেরটা নিয়ে আসার সময় এক জনের পায়ে উস্টা খেয়ে পড়ে যায় রাফসান। এক সঙ্গে স্টাফের কয়েকজন, ‘এই কি শব্দ হলো রে? কে ওখানে।’ বলে লাফিয়ে উঠে। রাফসান সঙ্গে সঙ্গে রটের এক মাথায় ধরে বলে
– ‘তাড়াতাড়ি বাইরে চল।’
দু’জন ব্যাগ নিয়ে বাইরে আসে। রাফসান রট ছেড়ে তাড়াতাড়ি এই দরজারও বাইরে থেকে ছিটকিনি লাগিয়ে দেয়। এদিকে টয়লেটের দরজায় ‘ঠাস, ঠাস’ আওয়াজ হচ্ছে। তাড়াতাড়ি রটের দুই মাথায় দু’জন ধরে পেছনের দিকে কোম্পানির বাইরে চলে যায়৷ তাদের ব্যাগও রটে ঢুকিয়ে দা হাতে দৌড়ে ঢুকে যায় গহীন জঙ্গলে। আপাতত স্টাফরা বুঝতে পারবে না ওরা কোনদিকে গেছে। এই সুযোগে তারা ব্যাগগুলো দা দিয়ে কাটতে থাকে। প্রথম দু’টা ব্যাগেই কোনো মানিব্যাগ পাওয়া গেল না৷ এর পরের ব্যাগে পনেরো হাজার টাকা এবং জিও সিম পায়। আরেকটি ব্যাগে পাঁচ হাজার টাকা আর একটি ওপরের গ্লাস ভাঙা স্মার্ট ফোন। এভাবে সব ব্যাগ কেটে আটত্রিশ হাজার টাকা পায়। মোবাইল আর সিমটাও সঙ্গে নেয়। মোবাইল অন হচ্ছে না। নষ্ট কি-না কে জানে। তবে মোবাইলের দরকার নেই। জিও সিম ঠিক থাকলেই হবে। দু’জন মশার কামড় উপেক্ষা করে একটা গাছের শেকড়ে চুপচাপ বসে থাকে। করোনার কারণে সন্ধ্যা থেকে ভোর ছয়টা অবধি কারফিউ। এখানে বসেই অপেক্ষা করতে হবে। আচমকা বাম পাশের রাস্তা দিয়ে একটা টর্চ লাইটের আলো দেখে তারা চমকে উঠলো।
… চলবে…
লেখা: MD Jobrul Islam
… চলবে..
লেখা: MD Jobrul Islam