একটু আগেই মা’কে কাফনের কাপড়ে ঢেকে দিয়ে এলো প্রিয়তি।পৃথিবীর বুকে এতিম হয়ে গেলো আজ সে।প্রিয়তির বাবা বোরহান সাহেব দ্বীতিয় স্ত্রীকে নিয়ে হানিমুনে গেছেন।কালই হুট করে প্রিয়তির বয়সী একটা মেয়েকে বিয়ে করে নিয়ে আসে প্রিয়তির বাবা।সেই কষ্ট’টা কিছুতেই সহ্য করতে না পেরে আজ সবার অগোচরে এই বিশালাকার নিষ্ঠুর পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন তিনি।মা’কে খাটিয়ায় তোলা পর্যন্ত একটুও কাঁদেনি প্রিয়তি।সবার সাথে বরই পাতার গরম জলে গোসল করিয়ে আতর,গোলাপজলে সাজিয়ে কাফন পরিয়ে মা’কে বিদায় দিয়ে নিজের ঘরে চলে এসেছে।জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে ওরা মা’কে নিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।মা আর ফিরবে না!কি একটা তীব্র কষ্ট বুকটা মুচড়ে ধরেছে।মনে হচ্ছে কষ্টের বিষ সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে।
কাল দুপুর বেলা প্রিয়তি মায়ের মাথায় তেল দিয়ে দিচ্ছিলো আর গল্প করছিলো।ছোটোবেলা থেকেই প্রিয়তি মায়ের খুব কাছের ছিলো।প্রায় প্রায়ই মা মেয়ে আড্ড দিতো।কালও তাই হচ্ছিলো।হঠাৎ দরজায় কলিং বেল বাজতেই প্রিয়তি উঠে গেলো দরজা খুলতে।দরজা খুলেই দেখলো তার বাবার সাথে নিজের সমবয়সী একটা মেয়ে দাড়িয়ে আছে।পরনে লাল রঙের একটা সিল্ক শাড়ি।মাথায় ঘোমটা দেওয়া।প্রিয়তি কৌতুহলী হয়ে জিগ্যেস করলো,’উনি কে বাবা?’
এরমধ্যেই জোহরা বেগমও চলে এসেছেন এখানে।বোরহান সাহেব মেয়েটার পিঠে হাত দিয়ে বললেন,’ও নতুন বউ।ওকে আজকে আমি বিয়ে করেছি ও তোর নতুন মা।’
একমুহূর্তের জন্য মনে হয়েছিলো দমটা আটকে এসেছে।ভেতরটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে।প্রিয়তি অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে বলল,’মানে কি বাবা?বিয়ে করেছো মানে?’
বোরহান সাহেব প্রিয়তিকে কে দরজা থেকে সরিয়ে দিয়ে মেয়েটাকে নিয়ে ভেতরে এলো।প্রিয়তি হতভম্ব হয়ে শুধু কেবল তাদেরই দেখছে।এদিকে জোহরা বেগম বিয়ের কথাটা শুনেই আর কিছু শুনলেন না দৌড়ে প্রিয়তির ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলেন।মায়ের খেয়াল হতেই প্রিয়তিও নিজের ঘরের দিকে ছুটলো কিন্তু ভেতর থেকে দরজা বন্ধ।প্রিয়তি বেশ কয়েকবার দরজা কড়া নেড়েছে কিন্তু ভেতর থেকে কোনো জাবাব আসে নি।ও ভেবেছিলো মা হয়তো কাঁদছে তাই দরজা খুলছে না।প্রিয়তি তখন আর ডাকলো না মা’কে।বসার ঘরে গিয়ে দেখলো তার বাবা মেয়েটার সাথে বসে রসের আলাপ করছে।এই দৃশ্যটা একদম সহ্য হলো না প্রিয়তি।নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সামনে টি-টেবিলের ওপর রাখা ফুলদানিটা এক আছাড়ে ভেঙে ফেললো।ঘটনার আকষ্মিকতায় বোরহান সাহেব প্রিয়তির দিকে চাইলেন সেই চাহনী রুঢ়!তিনি কাটাকাটা গলায় বললেন,’এসব কি প্রিয়তি?’
‘হ্যাঁ আমিও জানতে চাই এসব কি?কে এই মেয়ে।এখানে কি করে?’প্রিয়তিও গলায় দ্বিগুণ তেজ নিয়ে বলল।
‘বলেছিতো ওকে আমি বিয়ে করেছি।এখন থেকে ও এই বাড়ির বউ।’
‘কি করে করতে পারো তুমি এটা?একটা মেয়ের বয়সী মেয়েকে বিয়ে ছিঃ।’প্রিয়তির গলায় তাচ্ছিল্য।
‘বেশ করেছি।আমি আর ওই ফকিন্নির বাচ্চার সাথে সংসার করবো না।’বোরহান সাহেব কথা হলো উচ্চস্বরে বলে উঠলেন।
প্রিয়তি কিছু বলতে যেয়েও বলল না।সোজা চলো গেলো মেয়েটার কাছে।মেয়েটাকে কষে এক চড় দিয়ে বলল,’রাস্তার মেয়ে কোথাকার!আমার মায়ের সংসার ভাংতে এসেছিস কেনো?বেরিয়ে যা বাড়ি থেকে।এই বাড়িতে,এই সংসারে তুই থাকতে পারবি না।এটা আমার মায়ের সংসার।’
কথা শেষ করতে না করতেই বোরহান সাহেব প্রিয়তি আচমকা পরপর দু’টো চড় মেরে দিয়ে বলল,’কোন সাহসে তুই ওর গায়ে হাত দিস?মেরে হাত ভেঙে ফেলবো।ও এবাড়িতেই থাকবে।আমিও দেখি কি করিস তোরা।আর হ্যাঁ ওই ফকিন্নির বাচ্চাকে বলবি যেনো আমার বাড়ি থেকে চলে যায় আর তুইও যদি বেশি তেড়িবেড়ি করিস তাহলে দরজা খোলা আছে সোজা বেরিয়ে যাবি।’
এগুলো বলেই বোরহান সাহেব মেয়েটাকে নিয়ে বেরিয়ে গেলো।ওরা যেতেই প্রিয়তি ধপ করে সোফায় বসে পড়লো।কখনো ঘুণাক্ষরেও টের পায় নি প্রিয়তি এমনও হতে পারে।খুব কষ্ট হচ্ছে ওর!এমনিতেই আজ একুশটা বছর মায়ের চোখের পানি দেখেই বড়ো হয়েছে প্রিয়তি।কখনো স্বামীর কাছ থেকে ভালোবাসা পায় নি মানুষটা।তবুও একা হাতে তিল তিল করে এই সংসারটা জুড়েছে।এখন তারই সাজানো সংসারে অন্যকেউ রাজত্ব করবে এর চেয়ে কষ্টের আর কি হতে পারে!
প্রিয়তি সোফা থেকে উঠে আবারও দরজায় নক করলো কিন্তু কোনো সাড়া নেই।যেনো ভেতরে কেউই নেই।আরো অনেক্ক্ষণ দরজা ধাক্কানোর পর জোহরা বেগম দরজা খুললেন।মায়ের চেহারা দেখেই প্রিয়তির কান্না চলে আসছে।কাঁদতে কাঁদতে চোখ লাল হয়ে গেছে।মাথার পাশের রগটা দপদপ করছে।প্রিয়তি মা’কে জড়িয়ে ধরে বলল,’মা তুমি কষ্ট পেয়ো না তোমার সংসার তোমারই হবে আর কেউ আসতে পারবে না এখানে।’
জোহরা বেগম কিছু বললেন না।প্রিয়তিকে সরিয়ে রান্নাঘরে গেলেন।প্রিয়তিও মায়ের পিছনেই গেলো। প্লেটে ভাত বেড়ে প্রিয়তিকে দিয়ে বললেন,’নে খেয়ে নে।’
‘তুমি খাবে না?’
‘আমার ক্ষিধে নেই।তুই খেয়ে নে।আমার বড্ড ঘুম আসছে।মাথাব্যথা করছে।আমাকে ডাকিস না।আমি তোর রুমে ঘুমাবো।’
এই বলেই জোহরা বেগম চলে গেলো প্রিয়তির ঘরে।প্রিয়তি একটু খেয়ে ভাত ঢেকে চলে এলো।জোহরা বেগম প্রিয়তির রুমের দরজা বন্ধ করে রেখেছে।প্রিয়তি মা’কে আর না ডেকে ছাঁদে চলে গেলো।আজকে মায়ের মনের অবস্থা ভালো না।
সন্ধ্যার আজান পড়ে গেছে।প্রিয়তি একটা টিউশনি করিয়ে বাসায় এসেছে মাত্র।ফ্রেশ হয়ে মা’কে ডাকলো কিন্তু সে দরজা খুলছে না।অনেকবার ডাকার পরও খুলছে না।এবার প্রিয়তির ভয় লাগছে কারণ মা কখনোই এতো ঘুমায় না।আর আজকে সেই দুপুরে ঘুমিয়েছে এখনো কি ওঠেনি?
প্রিয়তি উপায়ন্তর না পেয়ে পাশের ফ্ল্যাটের লোকদের ডাকলো।ওনারা এসে দরজা ভাঙতে সাহায্য করলো।কিন্তু দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকতেই সবাই স্তব্ধ!
ফ্যানের দড়িতে ঝুলছে জোহরা বেগম।জিহ্বাটা বেহ হয়ে আছে আর চেখ গুলো শীতল দৃষ্টিতে চেয়ে আছে প্রিয়তির দিকে।প্রিয়তি সাথে সাথে জ্ঞান হারালো।
যখন প্রিয়তির জ্ঞান ফিরলো তখন রাত আট’টা।চারপাশে মানুষ গিজগিজ করছে।সব চেনা পরিচিত মুখ।জ্ঞান ফিরতেই প্রিয়তির মনে পড়লো সব।কাউকে কিছু না বলে উঠে মায়ের কাছে চলে গেলো।জোহরা বেগমের লাশটা ঘরের বাইরে রাখা হয়েছে।প্রিয়তি চেয়েছিলো ঘরে রাখতে কিন্তু আত্মীয় স্বজনের কথায় আর রাখতে পারলো না কিন্তু নিজে ঠিকই বাইরে সারারাত মায়ের পাশে বসেছিলো।এই রাতটাই মা’কে মন ভরে দেখতে পাবে।এরপর আর কখনো না।
সকাল পর্যন্ত মায়ের লাশের পাশে বসেছিলো প্রিয়তি।সকালে কয়েকজন মহিলার সাথে মায়ের শেষ গোসল দিলো।তারপর নিজের হাতে আতর,গোলাপজল দিলো।কাফন পরিয়ে মায়ের কপালে শেষবারের মতো একটা চুমু দিলো।যখন ওরা মা’কে নিয়ে যাচ্ছিলো তখন প্রিয়তি নিজের ঘরে ফিরে আসে।বিছানায় বসে ফ্যানের দিকে তাকায়।ফাঁসির দড়িটা এখনো ঝুলছে।প্রিয়তি মায়ের লেখা চিরকুট’টা খুললো।তাতে কাঁপাকাপা অক্ষরে লেখা
‘প্রিয়তি,
মা আমার।আমি মরার পর যেনো ওই লোকটা আমার মুখ দেখতে না পরে।এই শেষ ইচ্ছেটা পূরণ করে দিস মা।ভালো থাকিস না।’
চিরকুট’টা পড়তেই কান্নায় ভেঙে পড়লো প্রিয়তি।
এমনিতেও বোরহান সাহেব জোহরা বেগমের লাশ দেখতে পাবেন না কারণ সে এখন নতুন বউয়ের সাথে হানিমুনে তাকে জানানো হয়েছে সে নাকি আসছে!কিন্তু সে আসার আগেই জোহরা বেগমের দাফন হয়ে গেছে।
কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছিলো প্রিয়তি।বিকেলের দিকে যখন ঘুম ভাঙলো তখন দেখলো ওর ঘরেও কয়েকজন মহিলা গল্পগুজব করছে।এরা ওর আত্নীয়ই।প্রিয়তি কাউকে কিছু না বলে ঘরে থেকে বের হতেই দেখলো বসার ঘরে ওর বাবা কয়েকজনের সাথে কথা বলছে।মুখটা দুঃখী দুঃখী করে রেখেছে।আর কেউ না জানুক প্রিয়তি জানে ওর মায়ের খুনী এই জানোয়ারটা।ও কখনো ওকে ক্ষমা করবে না।এখন ওকে দেখেই মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে প্রিয়তির মন চাচ্ছে খুন করে দিতে।প্রিয়তি আবার নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারালো।তেড়ে গেলো বোরহান সাহেবের দিকে।ওনার কলার টেনে ধরে বলল,’তুই,হ্যাঁ তুই আমার মায়ের খুনী।তোকে কখনো মাফ করবো না আমি।’
প্রিয়তিকে ওর দুই ফুপু মিলে ছাড়িয়ে অন্যরুমে নিয়ে গিয়ে শান্ত করে।তারপর বড় ফুপু বলল,’প্রিয়তি তুই ক’টা দিন আমাদের বাসায় থাক।’
প্রিয়তি কিছু বলল না।বড় ফুপু ওর কয়েকটা জামা গুছিয়ে নিজের সাথে নিজের বাড়ি নিয়ে গেলেন।প্রিয়তি আপত্তি করে নি কারণ এ বাড়িতে থাকলেই ওই খুনীটার চেহারা দেখতে হবে।আর ওকে খুন করতে মন চাইবে।
ওইদিন বড়ো ফুপুর সাথে প্রিয়তি চলে গেলো।তিনদিন পর খরচার দিন প্রিয়তি ওই বাড়িতে গেলো।তবে সেখানে থাকে নি।খরচা শেষ করে মায়ের জবর জিয়ারত করে আবার ফুপির বাসায় চলে এলো।এই তিনদিন কারো সাথে কথা বলে নি প্রিয়তি।সবাইকে বিরক্ত লাগছে তার।খাওয়া দাওয়াও তেমন করে না এখন।
আজ রাতেও কিছু না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়েছে।হঠাৎ মাঝরাতে শরীরে কারো হাতের ছোয়া পেতেই প্রিয়তি সজাগ হয়ে গেলো কিন্তু নড়াচড়া করলো না বুঝতে চেষ্টা করলো।কোনো একটা হাত প্রিয়তির পেটে চলাফেরা করছে।এবার এটা ধীরে ধীরে ওপর উঠতে নিলেই প্রিয়তি লাফিয়ে উঠে বসলো।সাথে সাথেই কেউ একজন উঠে দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করলো কিন্তু প্রিয়তি ওকে চেপে ধরে চিল্লাতে লাগলো।প্রিয়তির চিল্লনিতে ওর ফুপু আর ফুপাতো ভাইরা চলে এলো।তারপর রুমের লাইট জ্বালাতেই দেখলো প্রিয়তি যাকে চেপে ধরে রেখেছে সে ওর ফুপাতো ভাই ফয়েজ!সবাই অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে।সবচেয়ে বেশি অবাক প্রিয়তির ফুপু!
চলবে…
#দ্বিতীয়_বসন্ত
#পর্বঃ০১
#Arshi_Ayat
(ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।কার্টেসী ছাড়া কপি নিষেধ।)