#ধূসর_রঙের_প্রজাপতি
#ফাতেমা_তুজ
#part_4
মেয়েটা এতো বার বার বাসা থেকে পালিয়ে যায় তাও তোমরা কিছু বলো না কেন ?
এই ভাবে তো মেয়ের চরিত্র খারাপ হয়ে যাবে।
কোথায় কোন অঘটন ঘটায় আসবো পরে তোমাদের বংশের মুখ কালো হইবে।
আর লাই দিও না তো।
আব্দুর রহমানের গা ঝাঝানো কথা গুলো শুনে হাত শক্ত হয়ে গেছে আহনাফের।
বোনের নামে কঠোর কিছু কথা শুনে নিজেকে সামলাতে পারছে না ওহ।
নেহাতি ভদ্রলোক ওর গুরুজন নাহলে দাঁত ভেঙে ফেলতো ওহ।
আহনাফ লম্বা করে শ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করলো। ওরা খুব ভালো করেই জানে ওর বোন আবার ফিরে আসবে। তবে এবার এতো সহজে ফিরবে না ওহ।
প্রতি বারের মতো ছোট খাটো আয়োজনের বিয়ে হলে একদিনের মাঝেই ফিরে আসতো ঝিল।
তবে এবার ঘটা করে লোক সমাগম করে বিয়ের আয়োজন করা হয়েছিলো।
যার দরুন পালিয়ে গেছে ঝিল। আহনাফ ভদ্র লোক কে এড়িয়ে ফোন লাগালো।
ওর বাবা ভাই সবাই খোঁজ লাগিয়েছে। মেয়েটা কে অনেক বেশি ভালোবাসে ওরা। তাই বার বার বিয়ের আয়োজন , যাতে তাঁদের ঘরের আলো ঘরেই থাকে।
রোহন চিপস এর প্যাকেট থেকে টিপস খাচ্ছে। আহনাফ বিরক্তি নিয়ে বলল
_ তুই এমন একটা পরিস্থিতিতে অ্যাপল চিপস খাচ্ছিস ?
আর ইউ ওকে ইয়ার ?
_ আম ওকে। বাট তোরা সবাই ঠিক নেই। ঝিল বিয়ে করতে চায় না তবু ও তোরা বিয়ের জন্য পাগল হয়ে যাচ্ছিস।
আহনাফ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল
_ তুই ও জানিস তাহলে ?
আহনাফ ভ্রু কুঁচকে বলল
_ বনু তোকে ও বলে গেছে ওহ কোথায় যাচ্ছে ?
রোহন লাফিয়ে উঠলো। আহনাফের কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বলল
_ তার মানে তুই ও জানিস ?
আহনাফ মাথা ঝাঁকালো। দুজনেই এক সাথে হেসে উঠলো। ঝিলের ঝাকাস মাথাতেই এমন ধরনের প্ল্যান সম্ভব।
দুই ভাই কেই বলে গেছে অথচ দুজনের কেউ জানে না একে অপরের কথা।
আহনাফ রোহনের হাত থেকে চিপস এর প্যাকেট নিয়ে চিপস খেতে লাগলো।
অন্য দিকে মুখ গোমড়া করে বসে আছেন ঝিলের তিন পাপা আর তিন ভাই।
আশে পাশের সব জায়গায় খুঁজেছে। কিন্তু ঝিল সেখানে নেই। তবে খুব বেশি চিন্তা নেই ওনাদের কারন ঝিল কে সকল ধরনের সেফটি শিখানো হয়েছে।
বরাবর ই মির্জা বংশের মেয়েরা প্রখর বুদ্ধি সম্পূর্ণ। তবে আশি বছর পর মির্জা বংশে ঝিল ই একমাত্র কন্যা সন্তান হয়ে জন্মেছে।
সকলের চোখের মনি মেয়েটা। ছোট থেকে প্রানখোলা রেখেছে সবাই। এক জন ছেলের মতো করে বড় করেছেন।
তবে মেয়েরা মায়ের জাত , তাদের নারী সত্তা কখনো বিলীন হবার নয়।
আমাদের সমাজের নিকৃষ্ট চোখ গুলো নারী দের খুবলে খায়।
তাই নারীদের এক পা ও সাবধানে ফেলতে হয়।
*
বিকেলের ছটফটে রোদ্দুরের মাঝে দাড়িয়ে আছে অভিনব।
বিডির প্রতি একটা আলাদা মায়া এসে গেছে ওর। কেমন যেন সব কিছু আপন আপন মনে হয়।
বছর খানেক পর বিডি তে আসার কথা থাকলে ও আসতে পারে নি ওহ।
দেড় বছর পেরিয়ে যাওয়ার পর অভিনব আবার বিডি তে এসেছে তা ও তার নানার বাসায়।
মামাদের এতো এতো ভালোবাসা পেয়ে অভিনব মুগ্ধ।
সপ্তাহ খানেক ধরে এসেছে ওহ ,অথচ সবাই এমন আচারন করছে যেন অভিনব আজ ই এসেছে।
রোজ এতো শত আয়োজন , উল্লাস আর হৈ হুল্লর।
ভাই বোনেরা ও বেশ ভালোবাসে ওকে। অভিনব কে মামিরা ও খুব ভালোবাসেন।
সচরাচর মামিরা ভাগ্নে দের দেখতে পারেন না।
আর এখানে সমস্ত টাই উল্টো।
অভিনব পকেটে হাত গুঁজে ভাবছে আদৌ কি কখনো মামারা সব কিছু মেনে নিবে?
এই কয়েক দিনে কয়েক শত বার বলার চেষ্টা করে ও কিছু বলতে পারে নি অভিনব।
সবাই প্রচন্ড অভিমানি , কেউ ই ওর মা বাবা কে মেনে নিচ্ছেন না।
হয়তো চাঁপা অভিমান টা এতো বছরে ও কাটিয়ে উঠতে পারে নি।
কিন্তু কেন পারে নি ?
তার পেছনে কি কোনো গুরুতর কারন লুকিয়ে আছে ?
ত্রিশ বছর আগে কি আরো কিছু হয়েছিল?
যার জন্য সবাই এখনো রেগে আছেন।
অভিনব ফোঁস করে দম ফেলল । মাথা কাজ করছে না ওর , একটা ট্যুর এ যেতে পারলে ভালো হতো।
প্রকৃতির সান্নিধ্য পেয়ে মাথার জট গুলো হয়তো খুলে যেত।
অভিনব নিভু নিভু সূর্যের দিকে তাকিয়ে রইলো।
ধূসর আকাশ টা কেমন লালচে বর্ন ধারন করেছে।
কয়েক টা মেঘ ও দেখা যাচ্ছে। কি আশ্চর্য ফ্রেবুয়ারি মাসে ও বুঝি আজকাল আকাশে মেঘ করে ?
অভিনব প্রশস্ত হাসলো , প্রকৃতির নানান রূপ , নানা রঙে সজ্জিত তারা।
_ ইহান ভাইয়া তুমি এই সন্ধ্যা বেলাতে কি করছো?
ফুলের কথাতে পেছন ফিরে তাকালো অভিনব। অভিনবর ছোট মামার মেয়ে ফুল। বলতে গেলে এ বাড়ির সব থেকে ছোট সদস্য। বয়স 11 ক্লাস 5 এ পড়ে। ফুলের নামের মতোই ,ফুল দেখতে ও খুব মিষ্টি।
অভিনব মৃদু হেসে বলল
_ ফুল ঝুঁটি এসেছে দেখছি। ভাইয়া তো সন্ধ্যা বিলাস করছিলাম।
_ সন্ধ্যা বিলাস সেটা আবার কি ?
_ সন্ধ্যা বিলাস হলো সন্ধ্যা কে উপভোগ করা।
ফুল খিল খিল করে হাসলো। অভিনব খুব ঘুরিয়ে কথা বলে। যাহ ফুলের কাছে বেশ মোহনীয় লাগে।
অভিনব পকেটে হাত রেখে বলল
_ ফুল সোনার জন্য আমার কাছে একটা উপহার আছে। ফুল ঝুঁটি কি সেটা নিতে চায় ?
ফুল উল্লাসের সাথে মাথা ঝাঁকালো। বাসার সবাই ফুল কে ফুল ঝুঁটি বলেই ডাকে। আর অভিনব আদর করে মাঝে মাঝে ফুল সোনা বলে।
অভিনব নামটা একটু হিন্দু দের মতো লাগে বিধায় এ বাড়ির সবাই ওকে ইহান বলে ডাকে।
অভিনব পকেট থেকে একটা চকলেট বের করতেই ফুল ইয়ে বলে লাফিয়ে উঠলো।
অভিনব প্রশস্ত হেসে বলল
_ নাও এটা শুধু তোমার জন্য এনেছি , রূপার জন্য আনি নি।
ফুল উজ্জল চোখে তাকালো। রূপা ওর বড় বোন , দুজনের বয়সের ফারাক 5 বছরের হলে ও রূপার সাথে ওর লেগেই থাকে।
ফুল চকলেট টা খুলে একটা বাইট দিয়ে বলল
_ মামুনি তোমাকে ডাকছে।
অভিনব আলতো হেসে বলল
_ তুমি যাও আমি একটু পর ই আসছি।
ফুল চলে গেল। অভিনব লম্বা করে শ্বাস ফেললো। মায়ের সাথে মামাদের সম্পর্ক ঠিক করতে ওকে খুব বেগ পেতে হচ্ছে।
এবার যে করেই হোক সম্পর্ক ঠিক করেই যাবে ওহ।
*
_ম্যাম আপনার ক্যাশ, আর কার্ড ।
ঝিল স্মিত হেসে টাকা গুলো নিলো। আগে থেকেই ক্যাশ কলেক্ট করে রাখলো। নাহলে ওর পাপা আর ভাইয়েরা কার্ড এর মাধ্যমে ওর লোকেশন পেয়ে যাবে।
এবার পনের দিনের আগে বাড়ি ফিরবে না ওহ।
সবাই কে আচ্ছা করে টাইট দিবে। কার্ড টা ব্যাগে পুরে নিয়ে ভালো করে মুখ টা ঢেকে নিলো ঝিল।
কে জানে কাকে কাকে ওর খোঁজে পাঠিয়েছে। ধরা খেলে সব প্ল্যান ভেস্তে যাবে।
ঝিল কাঁধের ব্যাগ টা ভালো করে ঝুলিয়ে হাঁটা লাগালো।
যদি কার্ড এর মাধ্যমে ওর লোকেশন ট্র্যাক করে তাহলে ওহ কোন লোকেশন থেকে টাকা তুলেছে তা জেনে যাবে ওরা।
তাই দ্রুত এখান থেকে চলে যাচ্ছে ওহ। মির্জাপুর থেকে গুলশানে এসে টাকা তুলেছে আপাতত গন্তব্য মিরপুর।
মিরপুরে ওর বেস্ট ফ্রেন্ড এর বাসাতে দুদিন থাকবে।
আর তারপর অন্য কোথাও যাবে।
শীতের কারনে শরীর যেন থেমে যাচ্ছে। সন্ধ্যা সাত টা বাজতেই কুয়াশা তে ছেয়ে গেছে সব।
সি এন জি করে যেতে পারবে না ওহ।
রিক্স আছে , তাই লোকাল বাসে করেই যাবে।
গুলশান 1 বাস স্ট্যান্ড এ দাঁড়িয়ে আছে ঝিল। কাঁধে স্টাইলিশ কলেজ ব্যাগ আর বা হাতে ছোট্ট একটা লেডিস হ্যান্ড পার্স।
বার বার ঘড়ি দেখে যাচ্ছে। বাস হয়তো জ্যামে পরে আছে।
মিনিট পনের পর মিরপুর 10 নং গোলচত্বর এর বাস এসে থামলো।
ঝিল আসে পাশে তাকিয়ে দ্রুত বাসে উঠে গেল।
মাঝের একটা সিটে গিয়ে বসলো। তারপর ফোনের লক খুলে মৌনতা কে ফোন লাগালো।
ফোন রিসিপ করেই ঝিল কে কিছু বলতে না দিয়ে মৌনতা বলল
_ এই ঝিল কোথায় তুই ? এতো লেট হচ্ছে কেন ? ফোন দিতে ও বারন করেছিস।
এতো এতো টেনশনে মাথা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
দেখ সাড়ে সাত টা বাজে, আর ও আগে আসার কথা ছিলো তোর ।
_ একটু তো কথার বলার সুযোগ দে মৌন।
_ হুম হুম বল।
_ আমি গুলশান 1 বাস স্ট্যান্ড থেকে বাসে উঠে পরেছি।
মিরপুর 10 নং গোলচত্বর যেতে গুগল ম্যাপের লোকেশন অনুযায়ী মিনিট 35 লাগলে ও আমার আসতে জ্যামের কারনে হয়তো 1 ঘন্টা লেগে যাবে।
তাই আমি তোকে বাস থেকে নেমে ফোন দিবো। তুই আমাকে পিক করে নিবি ওকে ?
_ ওকে । সাবধানে আছিস ঝিল, তোকে নিয়ে চিন্তা হচ্ছে খুব।
_ আরে এতো ভাবিস না তো। সেফটির জন্য সব ই আছে আমার কাছে।
ডোন্ট ওরি , আর শোন
_ হুমম বল।
_ আমার জন্য মগজ চপ আর খাসির চাপ অর্ডার করে রাখ এসে খাবো।
আর শোন নান খাবো না , আটার রুটি অর্ডার করবি।
মৌনতা হো হো করে হেসে বলল
_ ওকে ওকে ডোন্ট ওরি। এবার তাড়াতাড়ি আয় তুই।
বাই
_ বাই।
ঝিল ফোন টা রেখে দিলো। মিরপুর 10 এর বিখ্যাত খাবারের মধ্যে শওকতের কাবাব একটি।
ঝিল যেখানে যায় সেখানের কিছু স্পেশাল ফুড অবশ্যই খাবে।
না হলে জার্নির মাহাত্ম্য কি হবে ?
*
অভিনবর পাশে বসে আছেন অভিনবর বড় মামা ইববান শিকদার।
ওনার নামের অর্থ হলো সময়। আর তার চরিত্রে ও রয়েছে সময়ের প্রতি দারুন খেয়াল।
সময়ের অপচয় তিনি একদম ই পছন্দ করেন না।
অভিনব প্রশস্ত হেসে বলল
_ মামা কিছু বলবে ?
_ হুমম ইহান শোন আমি কয়েক দিনের জন্য সিলেট যাবো।
ব্যবসায়িক কাজে আর কি তাই আমি না ফেরা অব্দি আমেরিকা তে ফিরে যাবি না বুঝেছিস ?
অভিনব সরস হাসলো। শান্ত স্বরে বলল
_ সমস্যা নেই মামা আমার পাসপোর্ট এর মেয়াদ বাড়ানো আছে।
তাছাড়া তেমন কোনো সমস্যা ও হবে না। আর আমি তো বেশ কিছুদিন থাকবো বলেই এসেছি।
অভিনবর কথাতে ইববান শিকদার তুষ্ট হলেন।
ছেলেটার মুখের দিকে তাকালেই ওনার সব কঠোরতা কেমন করে যেন উবে যায়।
ছেলেটার মুখে আলাদা কোনো শক্তি আছে।
অভিনব আশে আশে তাকিয়ে বলল
_ মেঝো মামুনি মোঝো মামা আর ছোট মামা কোথায় ?
_ বাইরে গেছে হয়তো। এসে পরবে , দিন রাত এটা সেটা নিয়ে পরে থাকে।
কি জানে আবার কি হয়।
_ আহহ থাক না বাদ দাও ঐ সব।ছেলেটার যত্ন তে যেন কোনো ত্রুটি না থাকে সেটা দেখো।
অভিনব হাত গুঁজে বসে রইলো। ওনারা কিছু লুকাতে চাইছেন।
মাথা ব্যথা করছে , প্রকৃতির সাথে থাকলে ভালো লাগতো হয়তো।
ভ্রমন প্রেমি দের এই এক সমস্যা । প্রকৃতির সান্নিধ্য ছাড়া এক মুহুর্ত চলে না।
অভিনব বেশ কিছুক্ষণ ভেবে বলল
_ বড় মামা তুমি তো সিলেট যাচ্ছো। আসতে আসতে বেশ কিছুদিন লাগবে।
তোমার সাথে নিশ্চয়ই আরফান ভাইয়া , তামির , সাদাদ ও যাবে।
_ হ্যাঁ ওরা ও যাবে।
_ তাহলে বাসাতে দানেশ , রূপা আর ফুল ঝুঁটি থাকবে।
বাচ্চা গুলোর সাথে আমি তো খেলতে পারবো না।
তো যদি কোথাও একটা ট্যুর দিয়ে আসি আমি।
ইববান শিকদার কিছু একটা ভেবে বললেন
_ তুই তো আমাদের সাথেই যেতে পারিস।
_ মামা তোমাদের সাথে গেলে ও ঘুরতে পারবো না।
আর আমি ট্রাভেল করতে খুব পছন্দ করি।
_ আচ্ছা ঠিক আছে যাস না হয় । তবে কোথায় যাবি ?
_ সুন্দরবন যেতে চাচ্ছি। যান্ত্রিক জগত থেকে একটু বাইরে আর কি।
ইববান শিকদার প্রসন্ন হাসলেন। তিনি নিজে ও ট্রাভেল করতে ভালোবাসেন।
তবে পরিবার সামলিয়ে যেতে পারেন না।
যদি ও কয়েক মাস পর পর ফ্যামিলি ট্রিপ এ যান ওনারা।
অভিনবর দিকে প্রখর দৃষ্টি দিয়ে তাকালেন। ছেলেটার মুখের দিকে তাকাতেই বোনের কথা মনে পরে গেল।
বুকের ভেতর চাঁপা কষ্ট টা যেন উতলিয়ে পরছে।
অভিমান ছাপিয়ে ভালোবাসা গুলো বেরিয়ে আসতে চাইছে।
ইববান শিকদার দ্রুত স্থান ত্যাগ করলেন।
#ধূসর_রঙের_প্রজাপতি
#ফাতেমা_তুজ
#part_5
মিরপুর 10 নং গোলচত্বরে বাস থামতেই ফোঁস করে দম ফেলল ঝিল।
এতো এতো জ্যামের কারনে দেড় ঘন্টা লেগে গেল। মাত্র 10 কিলোমিটার অথচ সময় লাগলো দেড় ঘন্টা।
বাংলাদেশের যানজট কি কখনোই কাটবে না ?
ঝিল গোলচত্বরে দাঁড়িয়ে ফোন লাগালো মৌনতা কে। মৌনতা ফোন রিসিপ করে বকবক শুরু করে দিলো।
ঝিল ক্লান্ত হয়ে পরেছে। মৌনতা এক দমে হাজার কথা বলে বলল
_ কি রে আছিস নাকি গেছিস ?
কথা বলিস না কেন ?
_ মৌন তুই কথা বললে কাউকে কথা বলতে দিস ?
_ উফফ সরি। যাই হোক কোথায় তুই আর কতো দেরি হবে?
ঝিল চারদিকে তাকিয়ে মুখ টা ঢেকে নিয়ে বলল
_ গোলচত্বরে এসে পরেছি এবার প্লিজ তাড়াতাড়ি আয়।
আমি হাঁপিয়ে গেছি , ক্লান্ত লাগছে , মনে হচ্ছে মাথা ঘুরে যাবে।
মৌন উচ্চশব্দে বলল
_ এই না নাহহ ঝিলি একটু পর অজ্ঞান হো প্লিজ।
আমি এসে নিই তারপর , দু মিনিট লাগবে জাস্ট।
ঝিল ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। এই মেয়েটা এমন পাগল কেন ?
কেউ কি ইচ্ছে করে অজ্ঞান হয়।
মিনিট পাঁচেক পর ই মৌনতা কে দেখতে পেল ঝিল।
মৌনতা হাত দিয়ে ইশারা করছে ওকে। ঝিল মলিন হাসলো , সত্যি খুব খারাপ লাগছে ওর।
মৌনতা রোড পেরিয়ে এসে ঝিল কে জড়িয়ে ধরলো। ঝিল এক হাতে পিঠ চাপরে বলল
_ প্লিজ এবার নিয়ে যাহ আমাকে আম ট্রায়ার্ড।
মৌনতা মেকি হাসি দিয়ে বলল
_ বিয়ের আসর থেকে ছয় বার পালিয়ে আসা মেয়ে নাকি ট্রায়ার্ড।
আচ্ছা বিয়ে টা করে নিলে কিহ বা হয় ?
আঙ্কেল রা ও নিশ্চিত হয়ে যাবে আর তুই ওহ ঝামেলা মুক্ত হবি।
ঝিল ভেঙ্চি কেটে বলল
_ নো ওয়ে। আমি এই পৃথিবীকে আর ও অনেক জানতে চাই। বিয়ে মানেই এক বস্তা প্যারা।
স্বাধীনতা বলতে কিছু ই থাকবে না। সকলের মন জোগাতে গিয়ে পা পিছলে অকালে মরার শখ নেই আমার।
ঝিলের কথা তে হো হো করে হেসে উঠলো মৌনতা। ঝিল বাঁকা চোখে তাকিয়ে বলল
_ তুই বিয়ে টা করে নে আমি না হয় তোর শশুর বাড়িতে নেক্সট বার পালিয়ে যাবো।
নতুন এক্সপেরিয়েন্স ও হবে তোর শশুর বাড়ি ও ঘোরা হবে।
মৌনতা আবার খিল খিল করে হাসলো। ঝিল বিরক্তি নিয়ে বলল
_ প্লিজ এখন চল , আমার খিদে পেয়েছে।
মৌনতা হাসি থামিয়ে ঝিল কে নিয়ে নিজের বাসাতে গেল।
বিশাল এক কম্পার্টমেন্ট এর সেভেন ফ্লোর এ মৌনতাদের বাসা।
মৌনতা লম্বা হেসে বলল
_ লিফ্ট নষ্ট হয়ে গেছে।
ঝিলের চোখ দুটো রসগোল্লার মতো হয়ে গেল। মৌনতা হো হো করে হেসে বলল
_ মজা করছিলাম।
ঝিল বোকার মতো তাকিয়ে রইলো। এই মেয়েটা ওকে টেনশন দিয়েই মেরে ফেলবে।
*
অভিনব ফেসবুক স্ক্রল করছে। বিভিন্ন ট্রাভেল এজেন্সি খুঁজে খুঁজে দেখছে। সুন্দরবন ঘুরতে হলে সাধারনত ট্রাভেল এজেন্সির সাথে ই যেতে হয়।
সেখানে একা যাওয়ার সাধারন পারমিশন নেই। তবে কেউ চাইলে সম্পূর্ন ঝুঁকি নিয়ে পারমিশন নিতে পারে সেটা ভিন্ন বিষয়।
তবে ট্রাভেল এজেন্সি ছাড়া সকাল বেলা খুলনা থেকে মংলা হয়ে সুন্দরবন ঘুরে সন্ধ্যায় ফিরে আসা যায়।
সেক্ষেত্রে পর্যটন কেন্দ্র গুলো তেমন উপভোগ করা যায় না।
তাছাড়া ভ্রমন গাইড ছাড়া সুন্দরবন ঘুরতে যাওয়া প্রচন্ড রিক্সের।
তার জন্য সবথেকে সুবিধা জনক আর বেস্ট উপায় হচ্ছে ট্রাভেল কোম্পানির প্যাকেজ নিয়ে ঘুরতে যাওয়া।
অভিনব গত বছর ও সুন্দরবন গিয়েছিল। তবে সেটা ভারত থেকে , আর ভারতের সুন্দর বনের পর্যটন কেন্দ্র গুলো ওর কাছে কেমন আর্টিফিশিয়াল লেগেছে।
প্রকৃতির সেরা সান্নিধ্য পায় নি ওহ তার উপর সেটা ছিলো এক দিনের ট্যুর।
সাধারনত সুন্দরবন ট্যুর এর বুকিং কনফার্ম করা হয় অনেক দিন আগে থেকেই।
আসন ফাঁকা থাকা সাপেক্ষে যাত্রার তারিখের কমপক্ষে সাত দিন আগে পর্যন্ত বুকিং কনফার্ম করা হয়।
বুকিং মানে কনফার্মেশন মানি জমা দিয়ে আসন নিশ্চিত করা।
বুকিং কনফার্ম করতে হলে ডেডলাইনের মধ্যে টাকা জমা দিতে হয়।
চাইল্ড পলেসি ও রয়েছে : সেখানে 3 বছর বয়স অব্দি শিশুদের আসন ফ্রি , 3+ থেকে 6 বছরের শিশুদের জন্য ছাড় আছে।
সেক্ষেত্রে বাচ্চাদের বাসের সিট ও শিপে কেবিন শেয়ার করতে হবে।
কিন্তু অভিনবর কাছে এতো দিন অপেক্ষা করার মতো সময় নেই।
ওহ চায় দ্রুত প্রকৃতির সাথে একটু মিতালি গড়তে।
অভিনব বেশ চিন্তিত হয়ে পরলো।
বেশ কয়েকটা ট্রাভেল এজেন্সি দেখলো অভিনব। সেখানে একটা ট্রাভেল এজেন্সি পেয়ে গেলো, যেটা পরশু ই যাবে সুন্দরবন আর এটাতে ইমার্জেন্সি এন্ট্রি নেওয়া হচ্ছে।
তারা নিজেদের নতুন উদোক্তা বলে দাবি করেছে।
তাদের বিশেষত্ব হচ্ছে ট্রাভেলার দের দ্রুত সুযোগ সুবিধা দেওয়া।
যেহেতু অন্য এজেন্সি গুলো তে যেতে গেলে লেট হবে তাই অভিনব ঠিক করলো এটাতেই যাবে।
এজেন্সির সমস্ত ডিটেলস চেইক করে দেখলো অভিনব।
এখানে এন্ট্রির জন্য টাকা আগে পেমেন্ট করতে হবে । তাও আবার সাধারনের থেকে বেশি পেমেন্ট দিতে হবে।
অভিনব সে দিকে পাত্তা দিলো না। টাকা যত লাগুক সমস্যা নেই ওর ।
টাকা দেওয়ার বিভিন্ন পদ্ধতি আছে। স্বশরীরে কিংবা বিভিন্ন কার্ডের মাধ্যমে আসন কনফার্ম করা যেতে পারে।
অভিনব নিজের কার্ড এর মাধ্যমে টাকা পেমেন্ট করে আসন কনফার্ম করে নিলো।
তারপর বাংলাদেশের সুন্দরবন নিয়ে একটু রিসার্চ করলো।
এটা অভিনবর স্বভাব যেখানে যাবে তা সম্পর্ক আগে ধারনা নিয়ে নিবে।
এটা প্রতি টা ট্রাভেলার দের ই করা উচিত।
*
রাত প্রায় এগারোটা ঝিল সাধারণত এই সময়ে ঘুমে বিভোর হয়ে থাকে।
তবে আজ ওর চোখে ঘুম নেই। শরীর ক্লান্ত হলে ও মনে শান্তি মিলছে না।
মৌনতার বাসা টা ওর কাছে তেমন পছন্দ হয় নি। বিশেষ করে বাড়ির সর্ব বয়স্ক সদস্য মৌনতার দাদি ।
বৃদ্ধা ঝিল কে তেমন পছন্দ করেন নি।ঝিল আসতেই কেমন চোখে তাকিয়ে ছিলেন।
আগের যুগের মানুষের মনোভাব যেমন হয়। ঝিল লম্বা করে শ্বাস ফেলল।
মৌনতার বাসা তে থাকতে ইচ্ছে হচ্ছে না ওর। কোথাও যেতে পারলে ভালো লাগতো ।
কোনো রিলেটিভের বাসাতে যাওয়া যাবে না। তাহলে কয়েক টা দিনের জন্য যাবে টা কোথায় ?
ঝিলের মুখ টা বাংলার পাঁচের মতো হয়ে আছে দেখে মৌনতা ঝিল কে বাহু দ্বারা ধাক্কা দিলো।
ঝিল আনমনেই উত্তর করলো
_ হুহহ
_ কি হইছে তোর ? মন খারাপ নাকি ? আরে জানু মন খারাপ করিস না। এমন তো নয় বাসা থেকে পালিয়ে আসার জন্য তোকে সবাই বকা দিবে।
ইসসস সবাই কতো ভালো। আমার বাসাতে যদি জানে আমি রিলেশনে আছি তাহলেই শেষ।
পা ভেঙে বাসায় ফেলে রাখবে।
মৌনতার কোনো কথাই ঝিলের কান অব্দি পৌছালো না।
মৌনতা একাই বক বক করতে করতে থেমে গেল।
ঝিলের দিকে সরু চোখে তাকিয়ে রইলো। ঝিলের চোখ দুটো মাথার উপর ভন ভন করে ঘোরা সিলিং এর দিকে।
এমন ভাবে তাকিয়ে আছে যেন সিলিং পর্যবেক্ষন করার গুরু দায়িত্ব টা শুধু ওর।
মৌনতা ফোঁস করে দম ফেলল। ঝিল কে কোনো কালেই বুঝে উঠতে পারে নি ওহ।
দুজনের প্রায় চার বছরের পরিচয়। কলেজের ফাস্ট ডে থেকেই বেশ জমে উঠেছে ওদের বন্ধুত্ব। তবে ঝিল পুরো ঝিলের মতোই , যার গভীরতা মাপার জন্য গভীর এক চোখের প্রয়োজন।
পরিবারের আদরে বড় হওয়া মেয়েটার মানসিকতা খুব ভালো হলে ও কিছু বিষয়ের প্রতি গভীর খোব ওর।
তার একটা হলো বিয়ে , সবাই বিয়ের স্বপ্ন দেখলে ও মেয়েটা সেই স্বপ্ন দেখে না।
হয়তো নিজ চোখে সংসার জীবন দেখা হয় নি বলেই।
বোধ হওয়া থেকেই তো মা কে দেখতে পায় নি।
পুরো পুরুষ ফ্যামিলি তে বেড়ে উঠা একটা মেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন হবে সেটাই স্বাভাবিক।
ঝিলের মুখের দিকে তাকালেই মৌনতার বেশ মায়া হয়।
মেয়েটার মধ্যে কেমন এক সুখ খুঁজে পায় ওহ।
মৌনতা হঠাৎ করেই ঝিল কে জড়িয়ে শুইয়ে পরলো।
ঝিল সামান্য চমকালো, লম্বা করে দম ফেলে বলল
_ মৌন কি হয়েছে তোর ?
_ কিছু না তোকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে হলো একটু।
ঝিল প্রশস্ত হাসলো। মৌনতার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল
_ ইসস তোর যদি বি এফ না থাকতো তাহলে আমি তোকে আমার ভাবি করে নিতাম।
মৌনতা বিগলিত হাসলো। এই কথা টা কয়েক শত বার বলেছে ঝিল।
ঝিল ঘনঘন শ্বাস ফেলছে। মৌনতা ভ্রু কুঁচকে বলল
_ তোর কি কোনো বিষয় খারাপ লেগেছে ঝিল ?
_ আরে না। আসলে আমার বুক ভরে শ্বাস নিতে ইচ্ছে হচ্ছে।
সেটা এই কোলাহলপূর্ণ সমাজে আমি উপভোগ করতে পারছি না।
_ বিয়ে করে নে দেখবি সব রঙিন লাগলে।
ঝিল মজার ছলে বলল
_ বিয়ে টা করে নিই আর এক গাঁদা ছেলে পুলে জন্ম দিয়ে তাদের সামলানোর দায়িত্ব পেয়ে যাই তাই না।
তারপর কিছু আবেগ নিয়ে আবার বলা শুরু করলো
_সব রঙিন হয় না রে , আই নো প্রতি টা মেয়ে কখনো না কখনো মা হওয়ার স্বপ্ন দেখে।
কিন্তু আমি নিজেই তো কখনো মায়ের সান্নিধ্য পাই নি।
আমি কি করে আমার সন্তান দের ভালোবাসা দিবো বল।
আর আমার ভয় হয় , প্রচন্ড ভয় হয়।
আমি যেমন রোজ আমার আম্মু আর মামুনিদের অভিযোগ করি আমাকে ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য।
তাদের ভালোবাসা না পেয়ে কাঁদি। আমার সন্তান যদি বলে আমি কেন ওকে অন্য মায়ে দের মতো ভালোবাসতে পারি না।
তখন আমি কি জবাব দিবো বল তো।
ঝিল কিছুটা নিরব হয়ে আবার বলা শুরু করলো।
_আমি যখন স্কুলে দেখতাম আমার বন্ধুরা মায়েদের সাথে হেঁটে হেঁটে আসছে।
তখন আমি এক দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে থাকতাম।
কেন আমার আম্মু নেই। এতো এতো অভিযোগ করতাম।
অনেকের মা নেই তো কাকি রা আছে , আন্টি রা আছে।
আমার তো তাদের কেউ ই নেই। একজন মায়ের ভালোবাসার ছিটে ফোঁটা ও আমার গাঁয়ে নেই।
হ্যাঁ আমার পাপা ভাইয়া রা আমাকে জান দিয়ে ভালোবাসে।
কিন্তু একটা মায়ের অভাব কি কখনো পূরন হয় ?
তাঁদের এতো এতো ভালোবাসা ও আমাকে খুশি করতে পারে নি।
রোজ কেদেছি একজন মায়ের হাতের ছোঁয়ার জন্য।
মামুনি রা থাকলে ও এতো কষ্ট হতো না।
কিন্তু আমার ভাগ্য এতো টাই খারাপ যে আমি কারো ভালোবাসা পাই নি।
আমি কি করে মা হই বল তো ?
সে সবের গুন আমার মাঝে যে নেই। আমি আমার এক পৃথিবী তে একা।
মায়ের অভাব কেউ পূরন করতে পারে না। তবে লাঘব করার জন্য ও আমার কেউ ছিলো না।
আমি মা হলে কলঙ্কের তকমা লাগবে।
আমার সন্তান কষ্ট পাবে , আর আমি হবো কলঙ্কিত মা।
যে তার নিজ গর্ভের সন্তান কে সঠিক ভালোবাসতে পারবে না।
ঝিলের কথাতে কাঁদতে কাঁদতে মৌনতার হিচকি উঠে গেছে।
অথচ ঝিলের চোখে এক ফোঁটা পানি ও নেই।
সেই প্রবাদ বাক্য টাই সত্য
” অল্প শোকে কাতর আর অধিক শোকে পাথর ”
হ্যাঁ ঝিল পাথর হয়ে গেছে।
জীবনের উনিশ টি বছরের মধ্যে সতের টি বছর রোজ কেঁদেছে মেয়েটা আর কতো কাঁদবে ওহ ?
তবু চোখে জল যে শেষ হবার নয়। তাই চোখ থেকে বেহায়া নোনা জলের ফোয়ারা নেমেই যায়।
ঝিল এক চমৎকার হাসলো। মৌনতা কে জড়িয়ে ধরে বলল
_ এটা কিছুই নয় মৌন। এটা আমার ভাগ্য আমি মেনে নিয়েছি।
বাচ্চা দের মতো ফ্যাচ ফ্যাচ করে কাঁদবি না প্লিজ।
এবার মৌনতা ডুকরে কেঁদে উঠলো। ঝিলের বুক থেকে চাঁপা কষ্ট টা গলায় এসে আটকে গেছে।
ওহহ চিৎকার করে কাঁদতে চেয়ে ও পারছে না।
বুকের ভেতর থেকে এক দলা অভিমান বাঁধা হয়ে দাড়িয়েছে।
ভাগ্যের উপর বড্ড অভিমান হয়ে গেছে।
মায়ের নরম হাতের ছোঁয়া পাওয়ার আকুলতা কখনো লাঘব হবে ওর ?
নাকি এভাবে জীবনের শেষ দিনটা কেঁটে যাবে।
এতো এতো সুখ পেয়ে ও অসুখী হয়ে রবে ?
এ যন্ত্রণার যার শুধু সেই বুঝে তার জ্বালা।
(