#নক্ষত্র_বন্দনা
#পর্ব_১৩
#লেখায়_জারিন
৬২. (ক্ষুদ্রাংশ)
‘ইরিন, তুমি তো নক্ষত্রের স্ত্রী।তাহলে ওর ইনকাম সোর্স সম্পর্কে তুমি কেন জানতে না? জিজ্ঞেস করোনি কখনো?’
৬৩.
‘সত্যি বলতে মায়ের ওমন প্রশ্নে আমি প্রচন্ড রকম অপ্রস্তুত পরিস্থিতি পড়ে গেছিলাম। সত্যিই তো যার সাথে ছয় মাস সংসার করছি তার সম্পর্কে বলতে গেলে কিছুই জানি না। কখনো সামান্য কৌতুল দেখাইনি। জিজ্ঞেস করা তো অনেক পরের ব্যাপার। ‘ নিজের বেগতিক অবস্থার বর্ণনা দিয়ে বললো ইরিন।
‘তো আপনি কি বলেছিলেন সেদিন?’ রাফিদ বললো।
‘আমি আর কি বলতাম, সত্যিই তো জানা ছিল না কিছুই। তবুও, কৈ এর তেলে কৈ ভাজার চেষ্টা করেছিলাম যৎ সামান্য। বলেছিলাম উনি বাড়ির একমাত্র ছেলে। নিজের বিজনেস দেখছে। এত সম্পদের মালিক। তাই আর আলাদাভাবে জিজ্ঞেস করিনি। তাতেই অবশ্য কাজ হয়েছিল। মা আর কিছু বলেননি। ‘- নিজের এমন কাজে নিজেই গর্বিত হওয়ার মত করে হেসে বললো ইরিন।
‘হুম…বুঝলাম। কিন্তু তারপর? ‘
‘বাকিটা ব্যক্তিগত। ‘ বেশ সাবলিল ভংগিতে বললো ইরিন।
‘আমাকে যে গল্পটা শোনাচ্ছেন সেটাও তো ব্যক্তিগত। ইনফ্যাক্ট আপনি আপনার সাথে সাথে মি.নক্ষত্র এবং তার পুরো ফ্যামিলির কিচ্ছা কাহিনী আমার সামনে মেলে দিয়েছেন। এটা কি ছিল তবে?’
কিঞ্চিৎ কপট রাগ দেখিয়ে বললো রাফিদ। ইরিন তার এবং নক্ষত্রের বিশেষ মূহুর্তগুলোর কথা খুব যত্ন করে এড়িয়ে যায়। এটাই উচিৎ এবং রাফিদ সেটা জানেও। কিন্তু প্রতিবার ব্যক্তিগত বলে কাটিয়ে দেওয়াটা রাফিদের খারাপ লাগে আজকাল।
‘আমি নক্ষত্রের ব্যাপারে এগুলো বলেছি যাতে আপনি উনাকে জানেন..বুঝতে পারেন ভালোভাবে। মানুষটাকে নিয়ে আপনার মনে স্বচ্ছ ধারণা তৈরী হোক।’
‘তাকে জেনে আমি কি করবো?’
‘আপনার বুঝতে সুবিধা হবে যে তার জন্য আমি কতটা অযোগ্য। ‘ মলিন হেসে বললো ইরিন।
রাফিদের মুখটাও চুপসে গেল। ইরিনকে সে কষ্ট দিতে চায়নি। কিন্তু, না বুঝে সেটাই করে ফেলেছে সে। তাই পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য বললো, ‘এত ব্যক্তিগত কথা জানলাম, বাকিটুকু জানলেই বা কি হতো? রাফিদ রে তোর কপালে রোমান্টিক গল্প শোনার চান্স নাই। হাউ ব্যাড লাক!’ -মুখে দুঃখী দুঃখী ভাব এনে আফসোসের ভংগিতে বললো রাফিদ।
রাফিদের এমন ভংগিমা দেখে হেসে ফেললো ইরিন। মুচকি হেসে বললো, ‘এ অধ্যায়ের বাকিটুকু বিশেষ ব্যক্তিগত। তাই বলছিনা এটুকু।’
‘হ্যাঁ,এরপরেই তো পুতুল সোনার আগমন, তাই না?’
ইরিনকে লজ্জায় ফেলার জন্য রসিকতা করে বললো রাফিদ। কিন্তু, ইরিন সেটা পাত্তা দিলো না। স্বাভাবিকভাবেই বললো, ‘উহু। পুতুলের আগমন হয়েছে আরও পরে। আমার ভুলের কর্মফল ভোগ করেছে অন্যজন। ‘
‘মানে?’ বিভ্রান্ত গলায় প্রশ্ন করলো রাফিদ। কারণ ডায়রিতে পরের অংশে নক্ষত্র-ইরিনের সন্তানের জন্মের কথাই লেখা।তাহলে ইরিন এমন বললো কেন? রাফিদের মনে আসা প্রশ্নটা আর জিজ্ঞেস করতে হলো না। উত্তর দিল ইরিন নিজেই। হাত ঘড়িতে সময় দেখলো ইরিন। রাত ৯ টা বেজে গেছে। বাড়ি ফিরতে হবে। তাই সব গুছিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো সে। ক্লান্ত মুখে মলিন হেসে বললো,
‘পুতুল আমাদের দ্বিতীয় সন্তান। ‘
৬৪.
ক্যাফে থেকে বেরিয়ে নদীর পাড়ে ঘাসের রাস্তাটা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে ইরিন ও রাফিদ। রাস্তাটা বেশ লম্বা। মেইন গেট পর্যন্ত যেতেও বেশ সময় লাগে ক্যাফে থেকে বেরিয়ে এই পথে হাঁটলে। রাফিদের আজ জেদ উঠেছে। সে সবটাই শুনবে আজ। হোক সেটা যতই ব্যক্তিগত। পুতুলের জন্মের কথাটা একটা ভীষণ রকম বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছে ওর মনে। সব না জানলে ওর শান্তি হবে না।
অগ্যতা, রাফিদের জেদের সাথে আপোষে আসে ইরিন। বলার স্বার্থে যেটুকু না বললেই নয় অতটুকুই বলবে। হোক না তাতে সামন্য ব্যক্তিগত মূহুর্তের কথা। এতটুকু সহজ তো সে রাফিদের সাথে হয়েই গেছে এতদিনে, যার জন্য অকপটে নিজের কৃতকর্মের কাহিনী বলতে পারছে তাকে। তাহলে এটুকুই বললেই আর কি!
পাশাপাশি হাঁটছে দুজন। মাঝে স্বাভাবিক দূরত্ব বিদ্যমান।হাঁটতে হাঁটতেই নিস্তব্ধ রাতের নিরবতায় ছেদ ঘটিয়ে ইরিনের কন্ঠে উঠে এলো কিছু অব্যক্ত মূহুর্তের কথা।
‘মায়ের সাথে কথা শেষ করে আমি যখন নিজের ঘরে ফিরে আসি তখন রাত ৮ টা। নক্ষত্র তখনো বাড়ি ফেরেননি। আমি উনাকে বেশ কয়েকবার ফোন করেছিলাম। কিন্তু, উনি ফোনকল রিসিভ করেননি। মা বলেছিলেন উনি উনার মায়ের কাছে, মানে উনার মায়ের কবর যেখানে ওখানে গিয়েছেন। এটা উনার স্বভাব বলতে পারেন। যখনই উনার মন খারাপ হয়, তীব্র যন্ত্রণা হয় উনি ওখানে গিয়ে বসে থাকেন। সময় কাটান উনার মায়ের সাথে। তাই আমি যাতে উনার জন্য চিন্তা না করি। সত্যি বলতে, সেদিনই প্রথম আমার উনার জন্য চিন্তা জাগে মনে। আমি অপেক্ষা করি তার বাড়ি ফিরে আসার। কিন্তু, রাত ১০ টায়ও উনার বাড়ি ফেরার নাম নেই।
মা রাতে খেতে ডাকলেও আমি খেলাম না। উনার জন্য অপেক্ষা করতে থাকলাম। অপেক্ষা করতে করতেই ঘুমিয়ে যাই একসময়। আমার যখন ঘুম ভাঙে তখন রাত ১ ছুঁই ছুঁই। মোবাইল হাতড়ে যখন সময়টা দেখি, আমি প্রায় ধড়পড় করে উঠে বসি। পাশ ফিরে নক্ষত্রকে খুঁজি। কিন্তু পাই না। বিছানা থেকে নামতে গিয়ে দেখি আমার পায়ের কাছে খাটে মাথা এলিয়ে দিয়ে মেঝেতে বসে আছেন উনি। আমি আস্তে ধীরে এগিয়ে গিয়ে উনার কাছে গিয়ে বসলাম। ঘরের মৃদু নীলাভ আলোতেও আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম তার ক্লান্ত পরিশ্রান্ত ঘুমন্ত মুখখানি।
আমার মাঝে সেদিন কি চলছিল আমি নিজেও বুঝিনি। আসলে একটা মানুষ যখন অন্য একটা মানুষ সম্পর্কে জানে বা জানতে শুরু করে সেটাই হয় মানুষটার সংস্পর্শে আসার…তার সাথে মেন্টালি এটাচমেন্টের সূত্রপাত। আমারও বোধয় সেটাই হয়েছিল। ছয় মাস ঘর করার পরেও যে নক্ষত্রকে কেবল একটা রক্ত মাংসের মানুষ হিসেবে, নিজের স্বামী হিসেবে জেনে এসেছিলাম, প্রথমবারের মত তাকে আমার নিজের কেউ বলে মনে হয়েছিল। চামড়ার রঙ কালো বলে যে মুখের দিকে আমি স্বেচ্ছায় কোনদিন তাকিয়ে দেখিনি, প্রথমবারের মত সেই মুখটাকেই আমি নতুন করে আবিষ্কার করলাম।
আম্মু আমাকে উনার মায়ের কিছু ছবি দেখিয়েছিলেন। বাবার সাথে সংসার করার সময়কার ছবি।’
‘আম্মু মানে আপনার দ্বিতীয় শাশুড়ি, রাইট?’ কনফিউজড হয়ে জিজ্ঞেস করলো রাফিদ।
‘হ্যাঁ, সেদিন থেকে আমি আমার শাশুড়িকে উনার মতই আম্মু বলে ডাকতে শুরু করি। আর উনার মাকে ‘মা’ বলে। ‘ মিষ্টি হেসে বললো ইরিন।
‘আচ্ছা, তারপর? ‘
‘ছেলে সত্যিই তার মায়ের রূপ রঙ নিয়েই এসেছে এই পৃথিবীতে। আমি খুব মনোযোগ দিয়ে দেখেছিলাম তাকে সেদিন। একদম মায়ের মতই মায়া মায়া মুখ। মাথা ভর্তি এক ঝাঁক কোঁকড়া চুল। প্রসস্থ..মসৃণ কপাল। ঘুমের মাঝেও বোধয় যন্ত্রণা ছুঁয়ে যাচ্ছিল তাকে। কপালের কুচকে যাওয়া রেখাগুলো সেটাই বোঝাচ্ছিল। ভীষণ ইচ্ছে করছিল তার চুলের গহীনে আঙুল ডুবিয়ে দিতে। আমাকে বাঁধা দেওয়ারও কেউ ছিল না তখন। উনি তো দিতেনই না…এমনকি আমার নিজ সত্ত্বাও না, যে কিনা উনাকে স্বেচ্ছায় ছোঁয়া তো দূর উনার সামান্য কাছেও ঘেঁষতে চাইতো না।
কিন্তু, সেরাতে আমি নিজের ইচ্ছের পালে হাওয়া দিয়েই দিলাম। ভালোবেসে নয়, ক্ষণিকের মোহে পড়েও নয়, অন্তরালের অজ্ঞাত মায়ার বশেই হয় তো পরম মমতায় আমি আঙুল ডুবিয়ে দিলাম উনার কোমল চুলের ভাঁজে ভাঁজে। ‘
‘ওয়াও….হাউ রোমান্টিক!’ উচ্ছ্বাসিত কন্ঠে বললো রাফিদ। একই সাথে উত্তেজনা আর কৌতুহল মিশেল গলায় জিজ্ঞেস করলো, ‘ তারপর?’
‘তার পরেরটুকু আমার ভুল বলবো নাকি চরম অন্যায় জানি না। তবে, সেরাতে আমাদের মাঝে এমন একটা মূহুর্ত তৈরী হয় যার বর্শবর্তী হয়ে আমরা একে অন্যের গভীর সংস্পর্শে জড়াই। এমন নয় যে আমি সেবার প্রথমবারের মত উনার গভীর সংস্পর্শে জড়িয়েছিলাম। কিন্তু, সেরাতের মূহুর্তটা ছিল একেবারে ভিন্ন। ‘
‘কিন্তু, আপনি তো বলেছিলেন আপনি নিজেদের ব্যক্তিগত মূহুর্তগুলো বরাবরই সুকৌশলে এড়িয়ে যেতেন। তাহলে তা এতটা গভীরে পৌঁছালো কি করে,হুউউউ?’ খানিকটা খোঁচা মেরেই বললো রাফিদ কথাটা।
রাফিদের ইংগিত বুঝতে পেরে আলতো হাসলো ইরিন। অকপট কন্ঠে সাবলিলভাবেই বললো,
‘রিতুর ব্যাপারটা নিয়ে আমি উনার সাথে আপোষের সংসার করার সিদ্ধান্ত নেই। দিনের পর দিন একটা স্বাভাবিক স্ত্রীর মতই উনার সাথে সংসার করতে থাকি। সে আমি যতই তাকে নিজের বলে মন থেকে নাই বা মানতে পারতাম।
সত্যি বলতে, আমি নিজেকে কেবল দায়িত্বের খাতিরে উনার স্ত্রী ভাবলেও উনি আমাকে মন থেকেই স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। উনার জন্য একদম সহজ…স্বাভাবিক একটা সম্পর্ক ছিল এটা। আমাকে সব ভাবেই স্ত্রীর সম্মান.. অধিকার..মর্যাদা সবটাই দিয়েছিলেন উনি। সময় সময় আমাকে ভালোবেসে কাছে টেনে নিতেন। শুরুতে নানান বাহানায় তা এড়িয়ে গেলেও একসময় নিজেকে মানিয়ে নেই উনার সাপেক্ষে। উনার স্পর্শের কাছে আমি কেবল স্ত্রীর কর্তব্যের খাতিরে সঁপে দিতাম নিজেকে। তাই সে রাতেও উনার গভীর সংস্পর্শে জড়ানোটা আমার কাছে নতুন কিছু ছিল না। নতুন ছিল প্রথমবারের মত নক্ষত্রকে নিজের গভীর সংস্পর্শে জায়গা করে দেওয়া। একই সাথে মিসেস. ইয়াসমিন রাওনাফ ইরিন থেকে নিজের অজান্তেই মনে প্রাণে মিসেস.নক্ষত্র হয়ে ওঠার যাত্রায় আমার প্রথম পদার্পণ। ‘
কথাটা শেষ হতেই রাফিদ লক্ষ্য করলো ইরিনের চোখে মুখে অন্যরকম এক আভার সৃষ্টি হয়েছে। একদম সত্যিকার অর্থে একটা সুখকর ব্যাপার যেভাবে সম্পূর্ণ ভেতর থেকে একটা মানুষের প্রশান্তির জানান দেয়, ঠিক তেমনই প্রশান্তির ছাপ ইরিনের মাঝেও ফুটে উঠেছে বলে মনে হলো রাফিদের।
পুলকিত নয়নে তাকিয়ে ইরিনের ঠোঁটের বাঁকে জুড়ে বসা চমৎকার হাসিটুকু দেখলো সে। ওই মূহুর্তে ওর মনে হলো, ইরিন যতই ভুল করুন না কেন…মনে প্রাণে সত্যিই সে নক্ষত্র বন্দনায় সঁপে দিয়েছিল নিজেকে। সেই সুখ, খুশি আজও ওর মাঝে বিদ্যমান। যদিও ভাগ্য তাকে করুণা করেনি। নক্ষত্রের ছত্রছায়া থেকে দূরে চলে আসতে হয়েছে তাকে, কিন্তু তাতে কি! ইরিন আজও নিজ মনেই সুখ পুষে যায় কেবলমাত্র নক্ষত্রকে ভালোবেসে।
সব ভাবনার শেষে নিরবতা ভেঙে দাঁত কেলিয়ে হেসে ফেললো রাফিদ। দুষ্টুমির স্বরে বললো,
‘বিস্তারিত শুনতে চাই।’
ইরিন আর এবার রাফিদের কথায় সায় দিল না। গাড়ির দরজা খুলে রাফিদের মুখোমুখি তাকিয়ে দৃঢ় গলায় বলল, ‘ দুঃখিত! ওটা অতি বিশেষভাবে ব্যক্তিগত, যার বিস্তারিত নামক কোন শাখা প্রশাখা নেই। এখন দয়া করে আপনি কি আমায় বাসায় পৌঁছে দেবেন নাকি আমি উবার কল করবো?’
‘আরে আরে…রাগ কেন করছেন মিসেস.নক্ষত্র? না বলতে চাইলে থাক।আমি আর জিজ্ঞেস করছিনা কিছু। নাউ ওকে?’ কপট ভীতসন্ত্রস্ত মুখ করে বললো রাফিদ।
রাফিদের আচরণে হাসি পেলেও তা সতর্কতার সাথে চেপে গেল ইরিন। এখন নরম হওয়া চলবে না। নরম হলেই রাফিদ আবারও পেয়ে বসবে। শেষে না চাইতেও ওকে সব উগড়ে দিতে হবে। এই লোক কথার প্যাঁচে ফেলার উস্তাদ বনে গেছে একেবারে। এটা নিয়ে কিছু বলতে গেলেই আত্মসমর্পনের মত দু হাত তুলে বলবে, ‘প্রোফেশনাল স্কিল ম্যাম….এন্ড আই কান্ট হেল্প ইট। ‘ আর এরপর ইরিনেরও সত্যি আর কিছুই বলার থাকে না।
ইরিম গম্ভীর মুখেই চুপচাপ রাফিদের গাড়িতে উঠে বসলো। রাফিদও আর কথা বাড়ালো না। ভদ্রমত গাড়ির ড্রাইভিং সিটে উঠে বসলো। পাশ ফিরে ইরিনকে দেখলো জানলার বাইরে তাকিয়ে আছে। রাতের আকাশের দিকে মুখ করে। আজ অনেক অনেক কিছু বলা হয়ে গেছে তার রাফিদের কাছে। অতীতের সুদীর্ঘ পথ ফিরতি কদমে চলতে হয়েছে। সুখ, দুঃখের অনেক অনেক চড়াই উৎরায়ের মুখোমুখি হতে হয়েছে সে যাত্রায়। ক্লান্ত হয়ে গেছে হয় তো। এবার তাকে বিশ্রামের সুযোগ না দিলেই নয়।
ইরিনের থেকে চোখ ফিরিয়ে স্টিয়ারিং এ হাত রাখলো রাফিদ। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চাবি ঘুরিয়ে গাড়ি সার্ট দিল। গন্তব্য ইরিনের বাড়ি।
৬৫.
গাড়ি চলছে আপন গতিতে। ইরিন ক্লান্ত ভংগিতে মাথা এলিয়ে দিয়েছে সিটে। দৃষ্টি বাইরের রাস্তায়। শহর জুড়ে রাত জাগা সোডিয়াম বাতি আর রঙ বেরঙের আলোর প্রহরীদের ছাড়িয়ে ছুটে চলেছে সে আপন গন্তব্যে। ধীরে ধীরে চোখ বন্ধ হয়ে এলো ইরিনের। ঘোর বেঘোরে এলোমেলো পথ ধরে সে এগিয়ে গেল সেই রাতের একান্ত মূহুর্তে এবং কিছু নতুন অনুভূতির জন্মলগ্নে।
‘ইরিন যখন নক্ষত্রের মাথায় বিলি কাটতে কাটতে তাকে মনোযোগ দিয়ে দেখতে ব্যস্ত, ঘুম ভেঙে গেল নক্ষত্রের। সদ্য অসম্পূর্ণ ঘুম ঘুম চোখ নিয়ে সোজা হয়ে বসতেই ইরিনকে দেখতে পেল নিজের খুব কাছাকাছি। ইরিন খুব অপ্রস্তুত হয়ে গেল ব্যাপারটাতে। চুলের ভাঁজে ডোবানো আঙুল সরিয়ে নিল দ্রুত। শাড়ির আঁচল টেনেটুনে ঠিক করে সোজা হয়ে বসলো খানিক। নক্ষত্র দেখলো সব চুপচাপ। বললো না কিছুই।
ইরিন এবার পূর্ণদৃষ্টি মেলে দেখলো একবার নক্ষত্রকে। জুম্মায় যাওয়ার জন্য সুতির ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি পায়জামা পড়েছিল আজ। চেঞ্জ করা হয়নি আর। সেই পোশাকেই বেড়িয়ে গেছিল আবার। সারাদিনই বাইরে কাটিয়েছে। জামা কাপড় খানিক কুচকে আছে। পায়জামা পাঞ্জাবিতেও জায়গায় জায়গায় কাদা মাটি লেগে আছে। নক্ষত্র যে সত্যিই তার মায়ের কবরের কাছে গিয়েছিল তারই প্রমাণ এই কাদামাটি , এটা বুঝতে আর অসুবিধা হলো না ইরিনের।
নক্ষত্রকে সাদা পাঞ্জাবিতে দেখে বিয়ের প্রথম রাতের কথা মনে পড়লো ইরিনের। সেদিন সাদা পোশাকে এই মানুষটাকেই ভূতের মত লেগেছিল তার কাছে। অথচ আজ শুভ্র সাদা পাঞ্জাবিতে কি মায়াময় আর পবিত্র লাগছে তাকে। একদম অবুঝ নিষ্পাপ শিশুর মতই।
ইরিনের হঠাৎ মনে হলো, যন্ত্রণায় জর্জরিত হলে বুঝি মানুষকে এমন নিষ্পাপ লাগে? একদম সাদামাটা কিংবা অসুন্দর মুখেও রাজ্যের মায়া, সৌন্দর্য ভর করে? নাকি আজ তার মন বদলে গেছে? দেখার দৃষ্টি বদলে গেছে? ‘ মনে এসব প্রশ্ন জাগতেই সাথে সাথেই তা উপড়ে ফেললো ইরিন। এত হিসেব নিকেশে যাবে না সে। এখন নতুন করে কোন ভাবনা জাগতে দেওয়ার সুযোগ নেই। তার ভবিষ্যৎ জায়গা অন্য কোথাও এখন। এখানে বাঁধা পড়া যাবে না কিছুতেই।
এসব সাত পাঁচ ভাবনা আর মনের দোলাচলে মূহুর্তেই ভেতর ভেতর হাঁপিয়ে উঠলো ইরিন। দীর্ঘশ্বাস ফেলে নক্ষত্রের মুখপানে চাইলো সে। চোখে চোখ পড়তেই ধক করে উঠলো ইরিনের মনের ভেতর। লাল লাল চোখে উদ্ভ্রান্তের মত দৃষ্টি মেলে তার দিকে তাকিয়ে আছে নক্ষত্র। তাকে দেখে ইরিনের মনে এক অজানা ঝড় বয়ে গেল। কষ্টে দুমড়ে মুচড়ে গেল ভেতরটা।
নক্ষত্রকে কখনো জোর আওয়াজে কথা বলা তো দূর কারও সাথে সামান্য খারাপ ব্যবহার করতেও দেখেনি ইরিন কখনো। স্বল্পভাষী হলেও কাজ কর্মের, দায় দায়িত্বের ব্যাপারে ভীষণ যত্নশীল। ইরিনের প্রতিও তার কোন কিছুর খামতি নেই। এই ছয় মাসের স্বল্পদৈর্ঘ্য সংসারে ইরিন কখনো নক্ষত্রের দ্বারা সামান্য কষ্টও পায়নি। সবসময় হাসি মুখে কথা বলে যখনই বলে। তার বোনেরা তার জন্য অস্থির। এমনকি রিতুও। কাজ বাদে যতক্ষণ সময় পায় সব হয় তার বোনেদের জন্য, রিতুর জন্য..নয় তো ইরিনের জন্য।
অথচ আজ এই মানুষটারই এক ভিন্ন রূপের সাথে পরোক্ষভাবে পরিচয় ঘটেছে তার। লাল লাল চোখজোড়া প্রমাণ, মানুষটা খুব করে কেঁদেছে আজ। শুকনো মুখটা জানান দিচ্ছে সকালের পর আর কিছু খাওয়া হয়নি তার। বিদ্ধস্ত মনে পড়ে ছিল মায়ের কবরের পাশে। ইরিনের ভীষণ কষ্ট হচ্ছে এই নক্ষত্রকে দেখে। তাকে এ অবস্থায় মেনে নিতে। ইরিনের অগোচরে চোখজোড়ায় এসে জড় হলো সিক্ততা। ঝাপসা হওয়া দৃষ্টিতে অবাক হলো ইরিন নিজেই। এই অপ্রত্যাশিত ব্যাপারটা পুরোপুরি অপ্রস্তত করে দিল তাকে।
৬৬.
নক্ষত্রের দৃষ্টি খেয়াল করতেই আরও বেশি অস্বস্তিতে কুঁকড়ে গেল সে।এবং তাকে আরও বেশি অবাক করে দিয়ে বসা অবস্থাতেই খাট থেকে মাথাটা তুলে ইরিনের কোলের উপর এলিয়ে দিল নক্ষত্র। দু হাতে ইরিনের কোমড় জাপটে ধরলো বেশ শক্ত করেই। যেন কোন প্রিয় কিছু হারিয়ে ফেলার আশংকায় তাকে সর্বোচ্চ ক্ষমতা দিয়ে আকঁড়ে ধরে রাখতে চাইছে সে। তারপর, ইরিনকে আশ্বাস্ত করে শিশুসুলভ আদুরে গলায় বললো, ‘কাঁদে না ইরিন…আমি একদম ঠিক আছি। মন খারাপ করে না আর। ‘
নক্ষত্রের এমন ধাঁচের কথায় ইরিন যারপরনাই অবাকের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছালো। নক্ষত্র ভাবছে ইরিন ওর চিন্তায়, ওর কষ্টে কষ্ট পাচ্ছে। কিন্তু, সত্যিই কি তাই?
নাহ…ইরিন জানে এমন কিছুই না। সে তো কখনো নক্ষত্রের কোন ব্যাপারে কিছুই বোধ করে না। তার ভালো খারাপ কোন কিছুতেই কিছু যায় আসে না ইরিনের, সেখানে তার কষ্টে কষ্ট পাওয়া….অসম্ভব একেবারে।
হঠাৎ নক্ষত্রের স্পর্শে চমকে উঠলো ইরিন। ভাবনার জগৎ থেকে বেরিয়ে খেয়াল করলো নক্ষত্র নড়েচড়ে উঠায় তার চুলগুলোর ঘষায় ইরিনের পেটে সুড়সুড়ি লেগেছে। তাই এভাবে শিউরে উঠেছে সে।
এদিকে নক্ষত্র একদম চুপচাপ। শান্ত বাচ্চাদের মত গুটিশুটি মেরে চোখ বুঝে শুয়ে আছে ইরিনের কোলে। এই দেখে আনমনেই নিঃশব্দে হেসে উঠলো ইরিন। আবারও আলতো করে আঙুল ডুবালো নক্ষত্রের চুলে। বিলি কাটতে কাটতেই জিজ্ঞেস করলো, ‘কখন ফিরেছেন?’
‘সময় দেখিনি।’ নিস্তেজ গলায় জবাব দিল নক্ষত্র।
‘আমাকে ডাকেননি কেন এসে?’
‘তুমি ঘুমাচ্ছিলে ইরিন।’
‘তাতে কি! ডেকে দিলেই তো উঠে পড়তাম। ‘
‘তুমি ঘুমালে আমার ডাকতে ইচ্ছে করে না।’ আহ্লাদি গলায় বললো নক্ষত্র।
‘কেন?’ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো ইরিন।
‘তুমি সারাদিন কত কাজ করো।রাতে ক্লান্ত হয়ে ঘুমাও। ঠিক যেমন মা ঘুমাতো। ‘
‘এ্যা..! আমি কই কি কাজ করি এত! এখানে তো আমাকে তেমন কিছুই করতে হয় না। সারাদিন প্রায় শুয়ে বসেই কাটে আমার। ‘
‘উহু। ‘
‘কি..উহু?!’
‘জানো ইরিন, মা সারাদিন বাসায় বাসায় কাজ করতো। গার্মেন্টসেও কাজ করেছে কয়েক বছর। সারাদিন তার কত খাটাখাটনি। তারপরেও আমার যত্ন করতো। খেয়াল রাখতো। আর রাতে যখন ক্লান্ত হয়ে ঘুমাতো, তখন কি যে নিষ্পাপ লাগতো দেখতে!
আমার পরীক্ষা থাকলে যখন রাত জেগে পড়তাম। মাও জেগে থাকতে চাইতো আমার সাথে।কিন্তু সারাদিন কাজ করে এসে রাতে ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে যেত একসময়। তখন আমি দেখতাম। ভীষণ সুন্দর লাগতো তখন মাকে।
তুমি ঘুমালে তোমাকে দেখতে এমন সুন্দর লাগে। একদম নিষ্পাপ। ঠিক একটা ঘুমন্ত পরীর মনে হয় তোমাকে। তাছাড়া, তখন তোমাকে দেখতে সুবিধা হয় আমার।’
‘আমাকে এভাবে দেখেন আপনি?!’
‘হু, দেখি মাঝে মাঝে।’
‘কেন??’ কিছুটা টেনেই বললো ইরিন। নক্ষত্রের চুলে বিলি কাটাও থেমে গেল ওর। এতটাই অবাক হলো সে নক্ষত্রের এমন কথায়।
এ কথার জবাবে ইরিনের কোল থেকে মাথা তুলে ওর মুখ পানে চাইলো নক্ষত্র। কিন্তু কোমড় ছাড়লো না। ইরিনের চোখে চোখ রেখেই বললো,
‘তোমাকে দেখলে আমার অদ্ভুত শান্তি লাগে ইরিন। যেমন মাকে দেখলে লাগতো। তুমি তো এমনিতেই কত সুন্দর, ইরিন । যখন চুপচাপ ঘুমিয়ে থাকো তাতে অন্যরকম একটা রূপ যোগ হয় তোমার মাঝে। আমি ওটার নাম জানি না। কিন্তু আমার মনে হয় আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ পাওয়াগুলোর তুমি একটা। যে কিনা বিশেষভাবে শুধুই আমার। যে আমাকে আমার সব অতীত, সব খামতির উর্ধ্বে গিয়ে নিজের করে নিয়েছে। আমাকে জায়গা দিয়েছে নিজের গভীরে, সব থেকে গোপনে। যার আমি ছাড়া অন্য কারো জন্য বিন্দুমাত্র ভাগ নেই। যাকে অন্যকারো জন্য হারাতে হবে না আমার। ‘
‘আর যদি হারিয়ে যাই?’ – বেখেয়ালি মনে প্রশ্ন করে বসলো ইরিন। তার এ প্রশ্নে নক্ষত্র কয়েকমুহূর্ত তার চোখের দিকে তাকিয়ে রইলো। ওই দৃষ্টির অর্থ বোঝা মুশকিল। ইরিন সে অর্থ বুঝতে চাইলো না। কেবল তার উত্তর শোনার জন্য অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করলো।
ক্ষণিক সময় পরে দৃষ্টি সরিয়ে নিল নক্ষত্র। পুনরায় ইরিনের কোলে মাথা গুঁজে দিয়ে বললো, ‘গেলে যাবে। যাকে সব উজার করে দিয়েও আগলে রাখার যোগ্যতা আমার নেই, তাকে আটকাই কি করে…বলো?!’
ইরিন ভীষণ কষ্ট পেল নক্ষত্রের এমন কথায়। কিন্তু, কেন পেল সেটা সে নিজেও বুঝলো না। অথচ, নক্ষত্রের এ কথায় তার খুশি হওয়া উচিৎ। সে ছেড়ে গেলেও নক্ষত্র কিছুই বলবে না, এটাই তো চায় সে। তাহলে? কেন খুশি হতে পারছে না সে?
ভাবনার কোন কূল কিনারা না পেয়ে হতাশ হয়ে চাপা শ্বাস ফেললো ইরিন। নক্ষত্রের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,
‘ সারাদিন তো বোধয় কিছুই খাওয়া হয়নি। উঠুন এবার। ফ্রেশ হয়ে এসে, খেয়ে নিন। ‘
‘খাবো না। ‘
‘খেতে হবে। দেখি উঠুন তো। ছাড়ুন আমাকে। ‘ নক্ষত্রকে ঠেলেঠুলে উঠানোর চেষ্টা করলো ইরিন। কিন্তু নক্ষত্র নড়লো না। ইরিন বুঝলো এভাবে কাজ হবে না। মিথ্যা আপোষ করে বললো, ‘আচ্ছা..না খেলেন। কিন্তু উঠুন এখন। জামা কাপড় চেঞ্জ করে ফ্রেশ হয়ে নিন। কাদামাটি লেগেছে তো। আমার শাড়ি ময়লা হচ্ছে।’
নক্ষত্র কথা বাড়ালো না। ইরিনকে ছেড়ে চুপচাপ উঠে পড়লো। চেঞ্জিং রুম থেকে কাপড় নিয়ে সোজা ওয়াসরুমে গিয়ে ঢুকলো। ইরিন আবারও অবাক হলো। একই সাথে খুশিও হলো। তার কথা কাজে দিয়েছে দেখে। খুশি মনেই সে ঘর থেকে বেরিয়ে নীচে গেল। নক্ষত্রের জন্য খাওয়ার ব্যবস্থা করতে।
৬৭.
খাবার গরম করে ঘরেই নিয়ে আসে ইরিন। সোফায় বসে অপেক্ষা করতে থাকে নক্ষত্রের জন্য। তবে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না তাকে। খানিক সময়ের মাঝেই নক্ষত্র বেরিয়ে এলো। ছাই রঙা টাউজার আর কালো রঙের গেঞ্জি পরেছে সে। তার কোঁকড়ানো ভেজা চুলগুলো থেকে টুপটাপ করে পানি পড়ছে এখনো। দেখেই বোঝা যাচ্ছে মোছা হয়নি ভালো করে। ইরিন মুগ্ধ হয়ে দেখলো এই নক্ষত্রকে।
নিজ মনে আউড়ালো, ‘আজ কি এই লোকের আলাদা করে রূপ খুলেছে নাকি? এত সুন্দর লাগছে কেন তাকে? মাশাল্লাহ!’ তারপর নিজেই থতমত খেয়ে গেল নিজের কথায়। মিছেমিছি মনকে প্রবোধ দিল এই বলে যে, তার মতিভ্রম হয়েছে। আর কিছুই না। নক্ষত্র আগে যা ছিল তাই আছে। আর আজীবন তাই থাকবে। তাকে দেখে মুগ্ধ হওয়ার কিছু নেই। ‘
ইরিনের ভাবনার মাঝেই বিছানায় এসে বসেছে নক্ষত্র। মাথা নিচু করে রেখেছে। ভাবছে হয় তো কিছু। ইরিন এগিয়ে গিয়ে কিছুটা দূরে নক্ষত্রের মুখোমুখি হয়ে দাঁড়ালো। সে খেয়াল করলো নক্ষত্রের চুল থেকে পানি ঝরছে এখনো। সব পানি গিয়ে পাপোষের উপর গিয়ে পড়ছে। ভিজিয়ে দিচ্ছে পাপোষখানা। আরও কয়েক কদম এগিয়ে গেল ইরিন। বিছানার উপর থেকে নক্ষত্রের পাশে থাকা তোয়ালেটা তুলে নিল নিজ হাতে। কোন রকম চিন্তা ভাবনা এবং সংকোচ ছাড়াই তা দিয়ে আলগোছে মুছে দিতে লাগলো নক্ষত্রের ভেজা চুলগুলো।
নক্ষত্র কোন প্রতিক্রিয়া দেখালো না ইরিনের এ কাজে। যেভাবে বসে ছিল, সেভাবেই বসে রইলো চুপচাপ।
৬৮.
চুলগুলো ঠিকঠাকভাবে মুছা হয়ে গেলে ইরিন টাওয়ালটা নিয়ে বেলকোনিতে মেলে দিয়ে এলো। ফিরে এসে দেখলো নক্ষত্র এখনো ওভাবেই বসা। ফলে আবারও নক্ষত্রের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো ইরিন। কাঁধে হাত রেখে বললো, ‘আসুন, খেয়ে নিন। আমি ঘরেই নিয়ে এসেছি সব। ‘
‘তুমি যদি কখনো স্বেচ্ছায় আমাকে ছেড়ে যেতে চাও, যেও। আমি আটকাবো না। কিন্তু মায়ের মত আমার থেকে হারিয়ে যেও না, প্লিজ। এটা আমি মানতো পারবো না ইরিন। ‘
এটুকু বলে মাথা তুলে চাইলো নক্ষত্র। ইরিন চমকালো নক্ষত্রকে দেখে। তার চোখগুলো এখনো ভীষণ লাল। আবারও কেঁদেছে সে। এখনো কাঁদছে নিরবে। কিসের জন্য এই কান্না? ইরিনকে হারিয়ে ফেলার ভয়ে?
মনে এই প্রশ্ন জাগতেই সমস্ত শরীর যেন অবস হয়ে এলো ইরিনের। এতখানি ভালোবাসে এই মানুষটা তাকে? কিন্তু কেন বাসে? ইরিন তো তাকে একটুও ভালোবাসে না। তার কাছে থাকতেও চায় না। কেবল আপোষে সঁপে দিয়েছে নিজেকে। নক্ষত্রের কাছে, এই সংসার জীবনে। তাহলে নক্ষত্র কেন এত ভালোবাসবে তাকে?
মন জানান দিল, ‘কাউকে ভালোবাসার জন্য তার ভালোবাসা পাওয়া জরুরি নয়। ভালোবাসা শর্ত সাপেক্ষে কোন বিনিময় প্রথা নয়। ভালোবাসা সর্বদা একপাক্ষিক অনুভূতি। এর জন্ম বা শেষ হওয়া কারো ইচ্ছেতে হয় না। মনের ওপর জোর খাটিয়ে একে সৃষ্টি বা ধ্বংস করা যায় না। তুমি তাকে ভালো নাই বাসতে পারো, কিন্তু তার ভালোবাসা তুমিই। তোমার ভালো বাসা বা না বাসায় তার ভালোবাসায় কোন প্রভাব ফেলবে না।’
ধীরে ধীরে নক্ষত্রর খুব কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়ালো। নক্ষত্রের চোখ মুখে যে অভ্যন্তরীণ যন্ত্রণার ছাপ ফুটে উঠেছে তা এবার ধারালোভাবে আঁচড় কাটলো ইরিনকে। যেটা একেবারেই সহ্য হলো না ইরিনের। আবারও চোখ ভিজে এলো তার। আলতো করে হাত রাখলো নক্ষত্রের মাথায়।
ইরিনকে কাছে পেয়ে নক্ষত্রের ভয়, যন্ত্রণা সব যেন আবারও মাথা চাড়া দিল উঠলো। ইরিনের বুকে মুখ গুঁজে ওর কোমড় জাপটে ধরলো। ভেজা কন্ঠে অনেকটা অস্পষ্ট স্বরেই বললো, ‘ ইরিন, আমি রোজ আল্লাহকে বলি সে যেন আমার আগে তোমাকে হারাতে না দেয়। তুমিও প্লিজ একটু বলো।আমাকে যেন আর কিছু হারিয়ে…হেরে গিয়ে তার কাছে যেতে না হয়। একটু বলো প্লিজ। ‘
ইরিনের টলমলে চোখ এবার বাঁধ ভাংলো। শক্ত করে নক্ষত্রের মাথাটা চেপে ধরলো নিজের বুকে। নক্ষত্র কাঁদছে। অসহনীয় এক যন্ত্রণায় জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে সে। কাঁদছে ইরিন নিজেও। আজকের দিনটার আগে অবদি সে ভাবতো নক্ষত্র রাজ কপাল নিয়ে জন্মেছে। আরামে আয়েশে বড় হয়েছে। তার কোন দুঃখ নেই। কষ্ট তাকে ছোঁয়নি কখনো।
অথচ আজ তার সম্পূর্ণ ধ্যান ধারণাকে বদলে দিয়ে তার সামনে প্রকাশ হয়েছে সত্যিকারের অন্ধকারে জেগে থাকা এক নক্ষত্রের। এতটা যন্ত্রণা তো সে তার মধ্যবিত্তের টানা পোড়নের সংসারেও সহ্য করেনি। মাথার উপর বাবার স্নেহের হাত ছিল সব সময়। অথচ এই মানুষটার তো জন্ম থেকেই বাবা থেকেও ছিল না। বাবার স্নেহ, ভালোবাসা পায়নি। পেয়েছে শুধু হারানোর যন্ত্রণা। এত কষ্ট কেন দিল তাকে সৃষ্টিকর্তা! জানা নেই ইরিনের। তবে,ওর মনে পড়লো শায়লার বলা কথাটা। ‘অন্ধকার ছাড়া নক্ষত্রের দ্যুতি ছড়ায় না। ‘ আর এই নক্ষত্রের জীবনে এমন অন্ধকার অতীত ছিল বলেই হয় তো আজকেই এই নক্ষত্র।
৬৯.
নক্ষত্রের মাথায় পরম মমতায় হাত বুলিয়ে দিল ইরিন। এমন স্পর্শে নক্ষত্র মাথা তুলে চাইলো ইরিনের দিকে। ইরিন তার দু গালে হাত রেখে খুব যত্ন করে ঠোঁটের আদর ছুঁইয়ে দিল কপালে। সিক্ত কন্ঠে তাকে আশ্বস্ত করে বললো,
‘আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন। আপনি যা হারিয়েছেন বা হারাবেন, জানবেন যে তার থেকেও উত্তম কিছু আপনার জন্য আছে বলে ওটা আপনার হয়নি। অথবা আপনাকে জীবনের অন্য ধারায় প্রবাহিত করবে বলেই আপনি নিজের প্রিয় জিনিস হারিয়ে নতুন কোন কিছুকে প্রিয় করে পাবেন। হোক সেটা আপনার মা বা আমি। কিংবা অন্য যে কোন কিছু।
এই যে দেখুন না, আজ মা নেই বলেই আপনি আম্মুকে পেয়েছেন। অদ্রিজা, কনকের মত বোন পেয়েছেন। নিজেকে এতখানি যোগ্য করে তুলেছে যে আপনি চাইলেই নিজের একটা আলাদা সাম্রাজ্য করে নিতে পারেন। এটাই কি যথেষ্ট নয় এটা প্রমাণ করার জন্য যে, সৃষ্টিকর্তা আপনাকে এতসব দিবেন বলেই মাকে উছিলা হিসেবে আপনার থেকে নিয়ে গেছেন?!’
‘আমার আর কিছু চাইনা ইরিন। তোমাকে হারিয়ে বিপরীতে আর কিছুই পাওয়ার নেই আমার।’ অস্থির গলায় বললো নক্ষত্র।
নক্ষত্রের কথায় ইরিনের প্রতি দৃঢ় ভালোবাসা, যা ইরিনকে আরও বেশি আচ্ছন্ন করে দিল নক্ষত্রতে। প্রথমবারের মত নিজে থেকে নক্ষত্রকে জড়িয়ে নিল গভীর আলিঙ্গনে। যেখানে ঠাই পাওয়ার পর নিজেকে মনে হবে সবচেয়ে নিরাপদ। ঠিক যেমন মায়ের মমতায় ঘেরা আলিঙ্গনে মিশে গেলে লাগে। নক্ষত্রেরও তেমনটাই মনে হলো। সে নিজেও ওই নিরাপদ আশ্রয়টুকুকে নিজের সর্বস্ব দিয়ে আকঁড়ে ধরলো। নিজের সবটুকু ভালোবাসা ঢেলে দিল তাতে।
ধীরে ধীরে দুটি মানব মানবী মিশে যেতে থাকলো একে অপরের মাঝে। ইরিন নিজেকে উজাড় করে দিল নক্ষত্রের গভীর সংস্পর্শের কাছে। নক্ষত্রকে আগলে নিল নিজের গভীরে। যেন তার মাঝে মিশে গিয়ে অবসান ঘটাবে তার সকল যন্ত্রণার। চিরতরে মুছে দেবে সকল কষ্টের রেশ।
কিন্তু ইরিন তখনো জানে না, কিছু কষ্টের কখনো অবসান হয়না। বরং, নতুন কিছু কষ্টের সাথে মিশে গিয়ে রূপ নেয় যন্ত্রণায়। যা জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ঝলসে দেয়। আমৃত্যু তাতে জ্বলতে হয়।আর আজকের এই রাত, এই স্পর্শ, এই মূহুর্ত সবটাই এক অনাগত কষ্টের জন্য সৃষ্টি হওয়া আগাম যন্ত্রণা।
৭০.
কিছু অপার্থিব সুখময় মূহুর্ত শেষে যন্ত্রণারাও ঘুমিয়ে গেছে দুটি মানুষের হৃদয়ের ক্ষততে। প্রশান্তির হাওয়া বয়ে চলেছে মন বন্দরে। পরম স্বস্তিতে নক্ষত্র নিজের বুকে ভীষণ যত্নে আগলে রেখছে নিজের প্রিয়তমাকে। ইরিন নিজেও কোন রকম সংকোচ…জড়তা..অস্বস্তি ছাড়াই লেপ্টে আছে নক্ষত্রের উন্মুক্ত বুকে। নক্ষত্র যত্নকরে আঙুল চালিয়ে যাচ্ছে ইরিনের মোলায়েম চুলের ভাঁজে ভাঁজে।
ভোর হতে এখনো অনেকটা সময় বাকি। ইরিনকে বুকে নিয়ে শুয়ে থাকা অবস্থাতেই হঠাৎ সংশয়ভরা কন্ঠে নক্ষত্র ডাকলো,
‘ইরিন?!’
‘হু…. ‘ঘুম ঘুম চোখে জবাব দিল ইরিন।
‘তুমি আমাকে ভালোবেসে ফেলেছো, তাই না?’
চোখ বন্ধ করে নক্ষত্রের বুকে শুয়ে ছিল ইরিন। নক্ষত্রের এমন প্রশ্নে চট করে চোখ খুলে তাকালো সে। অপ্রস্তুত গলায় বললো, ‘হঠাৎ এমন কেন মনে হচ্ছে আপনার? আমি তো আগে থেকেই…’
ইরিনের কথা সম্পূর্ণ হতে দিল না নক্ষত্র। মাঝ থেকে নিজেই বলে উঠলো, ‘উহু। তুমি আগে আমায় ভালোবাসতে না। এখন বাসো হয় তো।’
‘এমন মনে হওয়ার কারণ?’ কপাল কুচকে প্রশ্ন করলো ইরিন। তা দেখে মুচকি হাসলো নক্ষত্র। খানিক ঝুঁকে ইরিনের কপালে জুড়ে দিল তার প্রেমময় স্পর্শ। তারপর জিজ্ঞেস করলো,
‘ডিড ইউ ফিল সামথিং?’
‘আপনি ভালোবাসেন আমাকে।’ ধীমি স্বরে জবাব দিল ইরিন।
‘আজ তোমার স্পর্শগুলোও অন্যরকম ছিল ইরিন। আমরা যতবার কাছাকাছি এসেছি তোমার স্পর্শগুলো কখনো এতটা গাঢ় মনে হয়নি আমার। তুমি আমাকে ছুঁয়েছো ঠিকই কিন্তু তোমার মন আমাকে স্পর্শ করেনি। যেটা আজ করেছে। ‘
‘কে বলেছে আপনাকে এসব? কি সব উদ্ভট কথা বলছেন আপনি?’
কপট রাগ দেখিয়ে বললো ইরিন। নক্ষত্রের কথায় আজ ও নিজের কাছে নিজেই প্রশ্নবিদ্ধ। কারণ, সে নিজেও বুঝতে পারছে এতটা নিঃসংকোচে এর আগে কখনোই নক্ষত্রতে মিশেনি সে। এর আগে প্রতিবার নক্ষত্রের যে স্পর্শগুলো শুধু ওর শরীর ছুঁয়েছে, আজ তা শরীর ভেদ করে অন্তঃস্থলের কোথাও একটা গিয়ে নাড়া দিয়েছে বারেবারে। হয় তো সেটা মনেই।
অথচ, ইরিন জানে সে কখনো এভাবে নক্ষত্রের স্পর্শ অনুভব করেনি যেভাবে আজ করেছে। তবে কি নক্ষত্রের কথাই ঠিক? ইরিন ভালোবেসে ফেলেছে তাকে?
মস্তিষ্ক কড়াভাবে প্রজ্ঞাপন জারি করলো, এ অসম্ভব! এক রাতে কখনোই ভালোবাসা হয় না। শরীর শরীরের টানে সাড়া দিবে এটাই স্বাভাবিক। এতে ভালোবাসা থাকা জরুরি নয়। সেও নক্ষত্রকে ভালোবাসে না।’
কিন্তু, ইরিনের প্রজ্ঞাপনের উপর ঘোর বিরোধিতা জারি করলো নক্ষত্রের জবাব।
‘মেয়েদের মাঝে জন্ম থেকেই মাতৃসত্বার বসবাবাস করে, ইরিন। তাই তারা খুব সহজেই ভালোবাসতে জানে। কিন্তু, বাবা, ভাই, নিজের ছেলেকে যত সহজে ভালোবাসতে পারে…আপন করে নিতে পারে, অন্য কোন পুরুষের ক্ষেত্রে সেটা পারে না।
প্রেমে পড়া সহজ ইরিন। ছেলেরা মেয়েদের মাতৃসত্ত্বার আদলে লালিত যত্ন, ভালোবাসার কবলে পড়েই খুব সহজে তাদেরকে ভালোবেসে ফেলে। কিন্তু, মেয়েরা নিজের বিশেষ পুরুষটিকে ভালোবাসতে সময় নেই। হোক সে পুরুষ নিজের প্রেমিক বা হাজবেন্ড।আর একবার যাকে ভালোবেসে ফেলে তাকে মন প্রাণ উজার করে ভালোবাসে।
আর আমাদের বিয়েটা যেভাবে হয়েছে তাতে রাতারাতি তোমার থেকে ভালোবাসা আশা করা আমার জন্য বোকামি ছাড়া আর কিছুই হতো না। তুমি আমাকে ভালোবাসোনি, তবুও আমরা কাছাকাছি এসেছি…একে অন্যের গভীরে মিলেমিশে গেছি বহুবার। কিন্তু, আজ আমার মনে হয়েছে আমরা এক হয়েছি প্রথমবার। তুমি আমাকে ভালোবেসে ছুঁয়েছ। তুমি আমাকে ভালোবেসে ফেলেছো,ইরিন। ইজ ইট? এ্যাম আই রাইট, মিসেস.নক্ষত্র?’ আদুরে ভংগিতে ইরিনে নাক টিপে দিয়ে বললো নক্ষত্র।
৭১.
ইরিন কতক্ষণ অপলক তাকিয়ে রইলো নক্ষত্রের হাসি হাসি মুখখানির দিকে। নক্ষত্রের কথাগুলো তাকে নিজের বিপক্ষে বিভ্রান্তিতে ফেলে দিয়েছে।
নক্ষত্র ওকে ভালোবেসে স্পর্শ করে এটা বুঝতে কখনোই অসুবিধা হয়নি ইরিনের। নারী হিসেবে পুরুষের কামনা আর ভালোবাসার তফাৎটা সে ভালোই বুঝে। নক্ষত্রের স্পর্শে কমনার ছিটেফোঁটাও পায়নি সে আজ অবদি। যা ছিল সবটাই ভালোবেসে…যত্নে কাছে টেনে নেওয়া। কিন্তু, ইরিন স্বীকার করতে বাধ্য…আজকের স্পর্শের স্বাদ ছিল অন্যদিনের তুলনায় একেবারে ভিন্ন। আজ সে অস্বস্তিতে গাঁট হয়নি ক্ষণিকের জন্যও। বরং কেমন সুখ সুখ অনুভূতিরা ছুঁয়ে গেছে বারেবার। তবে কি ভালোবাসা ভালোবাসাকে ছুঁয়েছে বলেই আজ সব অন্যরকম ছিল?’
নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করে ইরিন। কিন্তু উত্তর দেওয়ার সাহস করেনা। যদি উত্তর তার বিপক্ষে হয়?!
ইরিনকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে হেসে ফেললো নক্ষত্র। দুষ্টু স্বরে আবারও প্রশ্ন করলো, ‘এন্সার মি। এ্যাম আই রাইট, মিসেস.নক্ষত্র?’
ইরিন চোখ নামিয়ে নিল। অগোছালো স্বরে জবাব দেয়, ‘যেটা অনুভব করতে পারছেন সেটা নিয়ে প্রশ্ন কেন করছেন! ঘুমান এবার। ঘুম পাচ্ছে আমার। ‘
কথাগুলো বলতে বলতেই আদুরে বিড়ালে মত মুখ গুঁজে দিল সে নক্ষত্রের বুকে। তার বুকের ভেতরেও যে চলছে প্রবল ঝড়। অনেক অনেক প্রশ্ন নতুন করে ভাবিয়ে তুলছে তাকে। সব থেকে বড় প্রশ্ন এখন এটাই তার কাছে, ‘আবেগে আচ্ছন্ন হয়ে ভুল করে ফেললো কি কোন? কি হবে এর ভবিষ্যৎ? সুখ পায়রা ডানা ঝাপটাবে নাকি নতুন কোন যন্ত্রণায় আবারও পুড়তে হবে নক্ষত্রকে?!’
চলবে…