নাম_না_জানা_এক_পাখি পর্ব ৩৫+৩৬+৩৭

#নাম_না_জানা_এক_পাখি
লেখা: সাহিয়া সুলতানা
পর্ব: ৩৫

৫৭.
বাড়িতে বিয়ের ধুম লেগেছে। বাড়ি আবারো মেহমানে জড়োসড়ো হতে লাগলো। তপসীর মনে খুশির দোলা বইতে শুরু করলো কারন শীঘ্রই সুব্রতও বাড়ি আসবে। রনিতের বিয়ের আর পাঁচ দিন বাকি।

রনিত এসেছে আজ সকালেই । লম্বা এক মাসের ছুটি নিয়ে আসছে। তপসী দম বন্ধ করে কাজ করে যাচ্ছে। কাজ করার যত লোকই থাকুক না কেন বিয়ে বাড়িতে কাজ করার তবুও কোনো শেষ নেই। বাড়ির মোটামুটি এখনের জন্য শেষ বিয়ে বলে আয়োজন শুরু হচ্ছে আরো আগে থেকে।

একদম ম্যারেজ ডেকোরেটর স্পেশালিষ্ট এসেছেন ভারত থেকে৷ বিয়ের অ্যারেজমেন্ট সব তারাই করছে। বিয়েও হবে অনেক টা ভারতীয় ধারায়। মেহেদী, সংগীত, রঙ খেলা, গায়ে হলুদ, বিয়ে, কাল রাত্রি, বৌ ভাত ; প্রত্যেকটা দিনের জন্য আলাদা আলাদা ফাংশন, ডেকোরেশন সব প্লানিং করা হচ্ছে।

এখন থেকেই বাড়িতে বিয়ে বিয়ে ধুম লেগে গেছে। আজ রাতেই মেহেদী অনুষ্ঠান করা হবে। বাড়ির সব মেয়ে, বৌ রা মেহেদী পড়বে, রনিতকেও অবশ্য পড়ানো হবে সামান্য, সাথে সুন্দর করে লিখে দেওয়া হবে সুহানার নাম।

,
কাজের ফাঁকে ফাঁকে তপসী ঘড়ি দেখছে। সুব্রতের আসার কথা দুপুর দুইটা নাগাদ। কিন্তু আজ যেন দুইটা বাজছেই না। তপসীর মনে হতে লাগলো তাদের বাড়ির ঘড়ি নষ্ট হয়ে গিয়েছে নয়তো পৃথিবীর সময়ই থমকে গেছে। অপেক্ষা করাটা ভীষণ কষ্টকর বটে।

রনিত বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে ঘুমিয়েছিল। দীর্ঘ সময় ফ্লাইটে বসে থেকে এসে সে অনেকটাই টায়ার্ড হয়ে পড়েছিলো।
দুপুরে ঘুম ভাঙার পর মাথা ভারী লাগতে লাগলো রনিতের। রনিত হাত মুখ ধুয়ে রান্নাঘরের দিকে গেল।কড়া এক কাপ কফি খেতে হবে। নয়তো রাতের অনুষ্টানে সে কোনো ভাবেই বসে থাকতে পারবে না।

রান্নাঘরে সকাল থেকেই তপসী কাজ করছে। কাজের সাহায্যকারী মাসিও আছে একটা। তুলি কিছু সময় ইয়াজ করে দিয়ে কোথায় যেন হাওয়া হয়ে গেছে। তপসী একে ওকে দিয়ে খবর পাঠিয়েও খুঁজে পেল নাব।

রনিত রান্নাঘরে এসে তপসীকে দেখতে পেল। কাজের মাসীটা তখন কেউ একজনকে লেমনেড দিতে গিয়েছে। রনিত খুক খুক করে শব্দ করে তপসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইলো৷
তপসী এক পল তাকালো রনিতের দিকে। আবার কাজে মনোযোগ দিলো।

রনিত ক্যাবলা হেসে জিজ্ঞেস করলো,

—— পাক্কা গৃহিনী হয়ে গেছো দেখি বৌদি!

তপসী এবার হাতের আলুটা স্লাইস করতে করতে বললো,

—— গৃহিনী না হয়ে উপায় আছে রনিতদা? কিছু একটা তে তো পারদর্শী হতে হবে। তা, তোমার কিছু দরকার ছিল নাকি?

রনিত সোজা কাজের কথায় আসলো। কারন এখন আর সে মাথা সোজা করেই রাখতে পারছে না। কিচেন টেবিলের সামনে কোমড় ঠ্যাকিয়ে দাড়ালো। বললো,

—— এক কাপ স্ট্রং কফি করে দিতে পারবে তপসী? মাথা ব্যাথা করছে।

—— অবশ্যই পারবো। তুমি তোমার ঘরে গিয়ে বসো।

রনিত গেল না। কিচেনের টুল টেনে বসে পড়লো। তপসী জিজ্ঞেস করলো,

—— কি ব্যাপার? এখানে বসলে কেন? গরমে মাথা আরো ব্যাথা করবে।

—— কোম্পানি দেই তোমায়। এতোদিন পর বাড়ি এলাম অথচ কাউকেই ওমন দেখতে পাচ্ছি না।

—— তুমি ঘুমিয়ে ছিলে পরে মা আর কাকি গেল শপিং মলে। সুহানার জন,,,,, সুহানা দি’র জন্য কিছু কেনাকাটা বাকি। সেগুলোর জন্যই। আর বিয়ের ও কি কি যেন কেনা বাকি।

—— ওহ, রায়া কই?

—— রায়া দি ডেকোরেশন এর ওখানে মেহেদী অ্যারেঞ্জ করছে।

—— সবাই কাজে ব্যস্ত?

তপসী কফির মগ এগিয়ে দিয়ে বললো,

—— আমি ফ্রি আছি তো, বলো কি করতে হবে!

—— কিছুই করতে হবে না। কথা বলতাম এমনিই। আমি এখানে থাকলে কি তোমার রান্নায় ডিস্টার্ব হবে, তপসী ?

তপসী মাথা নেড়ে না করলো। মুখেও বললো,

—— চলো রনিতদা, আমায় বোর ফিল করা থেকে মুক্তি দাও।

—— যাহা হুকুম বৌদি।

৫৮.
তপসী কড়াইয়ে মাছ ছেড়ে দিলো। কড়াইয়ে নজর নিবিষ্ট রেখেই জিজ্ঞেস করলো,

—— তোমার এই কখনো ‘তপসী’ কখনো ‘বৌদি’ এর ইকুয়েশন টা আমায় বোঝাও তো।

—— কোনো ইকুয়েশন, মাল্টিপ্লিকেশন নেই। যখন যা ইচ্ছে হয় ডাকি। এতো হিসেব করে ডাকি না।

তপসী স্মিত হাসলো। রনিতই আবার জিজ্ঞেস করলো,

—— সুব্রত কেন আসছে না এখনো? ভাইয়ের বিয়ের দ্বায়িত্ব কি ওর কিছুই নেই?

তপসী হেসে বললো,

—— একটা প্রবাদ আছে না, ‘যার বিয়ে তার খবর নেই, পাড়াপড়শির ঘুম নেই’ তোমার বিয়েটা অনেকটা তেমনই দাদা। এই যে তুমি আসলে আজ, অথচ আমরা আরো কতোদিন আগ থেকে তোমার বিয়ের আয়োজন করে চলেছি।

—— তোমাদের আয়োজনে কেন আমার ভাই রইলোনা?

—— কারন সে তোমার চেয়েও ব্যস্ত। কবে থেকে বলছি ; সুব্রত সোনা, আসো আসো যলদি আসো। কিন্তু সে আসছেই না।

রনিত মুখের কফিটা অনেক কষ্টে গলাঃধকরণ করলো। গলায় আটকে যাওয়ার অবস্থাই হয়েছিল প্রায়। কফি টুকু পেটে পৌঁছাতেই জোরে জোরে হাসতে শুরু করলো।

তপসীকে বললো,

—— সুব্রত এতো আদরের ডাক উপেক্ষা করে ফ্রললো তপসী? সো স্যাড! দেখো ওইখানে আবার তোমার সুব্রত সোনা কোনো প্লাটিনাম না পেয়ে বসেছে।

তপসী চোখ সরু করে তাকালো রনিতের দিকে। ছেলেটা তার ছয় বছরের বড় হবে হয়তো, কিন্তু বন্ধুর মতোই মিলে গেছে। আচ্ছা সে কি সুহানার সবটা সম্পর্কে জানে?
তপসী ওইদিকে মাথা ঘামালো না। রনিতের দিকে রাকিয়ে বললো,

—— রনিত দা, ঠাকুরপো আমার, আপনি কি বিয়ের আগের কয়েকটাদিন হাসপাতালে এডমিট হতে চান? এই ধরুন, হাতের উপর এক কড়াই তেল উপুড় হয়ে পড়ে গেল!

রনিত ফাঁকা ঢোক গিললো। বললো,

—— বাইরে গাড়ির হর্ণ এর শব্দ আসছে তপসী। তোমার সুব্রত সোনায়ায়া এসে পড়েছে। প্লিজ তাকে গিয়ে নিয়ে আসো।

বাহিরে সত্যিই গাড়ির হর্ণের শব্দ হচ্ছে। গাড়ি নিয়ে অনেকেই আসছে। প্রায় সবাই ই গাড়ি নিয়ে এসেছে। তপসী একবার পার্কিং লট থেকেও ঘুরে এসেছে। সবাই হয়তো হাই ফাই ফ্যামিলি রহেকে বিলং করে। এখানেই তপসীই এক মধ্যবিত্ত শ্রেণিতে আঁটকে গেছে। যদিও উচ্চ মধ্যবিত্ত। তবুও এদেএ সাথে চাল চলণ মিলিয়ে চলতে পারছে না সে।

রনিত উঠে দাড়ালো। দরজারী সামনে গিয়েই চিৎকার করে উঠলো,
—— সুব্রত!

তপসী রান্নাঘর থেক্র দৌড়ে এলো। সত্যিই সুব্রত এসেছে। সুব্রত রনিতের পিঠে একটা কিল বসিয়ে দিলো।
বললো,

—— শালা মরি নি এখনো। এতো বড় চিৎকার দিতে আমার কানের পর্দা চিড়ে ফেললি তো।

রনিত সুব্রতকে জড়িয়ে ধরলো। ভাইয়ের পিঠে এক হাত রাখলো সুব্রত। রনিত ফিসফিসিয়ে বললো,

—— তুই মরবি কেন সুব্রত? তুই ভীষণ ভাগ্যবান। বলে বা দুঃখের পর সুখ আসে। তোরও এসেছে রে। সুখের সময় এখন তোর। তাই তো সবাই তোকেই ভালোবাসে ভাই। তুই হাজার বছর সুখী হতে বেঁচে থাক।

সুব্রত রনিতকে ধরে সোজা করলো। জিজ্ঞেস করলো,

—— এই, কখন থেকে কি বিরবির করছিস তুই? কিছুই তো বুঝলাম না।

রনিত সুব্রতের কাধে হাত রেখে বললো,

—— কই কি বললাম? কানে বেশি শুনক্সহিস তুই ইদানীং।

—— আমার বউ কই? ছাড় আমায়, সব জড়াজড়ি তোর সাথে করলে আমার বউয়ের সাথে কি করবো?

তপসী রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে সুব্রতের কথা শুনে লজ্জায় লালাভ হয়ে গেল। এখন আর সুব্রতের সামনে যেতে ইচ্ছে করছে না।

রবিত সুব্রতকে টেনে নিতে এলো রান্নাঘরের সামনে। ততক্ষণে তপসী কিচেনের একদম ভিতরে চলে গেছে। সুব্রত দরজার সামনে দাঁড়াতেই তপসী একদম কিছুই না জানার মতো করে বললো,

—— আপনি চলে এসেছেন? ফ্রেশ হোন, আমি জুস নিয়ে আসি।

রনিত মিটিমিটি হেসে বললো,

—— তপসী,, সরি বৌদি, একটু আগে ও’কে যেভাবে ডাকলে সেইভাবেই ডাকো না প্লিজ! আমার সামনে লজ্জা কিসের?

সুব্রত যদিও কিছুই বুঝলো না, তবুও রনিতের মাথায় থাপ্পড় দিয়ে বললো,

—— নির্লজ্জের সাননে আসলেই কি সবাই নির্লজ্জ হয়ে যায় রে?

—— বুঝলাম না কি বললি তু,,,,, ওয়েট, তুই আমায় মিন করলি সুব্রত? আমি নির্লজ্জ? সুব্রত তোর ফোর্স এখন আমি তোর উপরেই ড্রপ করবো। যাস্ট ওয়েট এন্ড সি।

কথা শেষ করেই রনিত সুব্রতের পিছনে দৌড়াতে লাগলো। সুব্রতও বাচ্চাদের ছুইছুই খেলার মতো রনিতের সাথে দৌড়াতে লাগলো।
তপসী ক্লান্ত চোখে তাকিয়ে রইলো তাদের পানে। সুব্রতকেই খেয়াল করে দেখে যাচ্ছে। কদম ছাট চুলের কাটিংটা কি তাকে এবার অতিরিক্তই মানিয়ে ফেলেছে? দিন কি দিন বয়স বাড়ার সাথে সাথে আরো সুন্দর কেন হচ্ছে?

তপসী নিজেরর মনেই আওড়ালো,

—— তোমার চোখের দিকে তাকালেই আমি জগৎ ভুলে যাই। চলে যাওয়ার আগে আমার ভুলো মন টাকেই সাথে করে নিয়ে যাও। আমি আর কিছুতেই কিছু মনে কর‍তে পারি না। তাই তো আত্নভোলা হয়ে যাই মাঝেমধ্যে।
#নাম_না_জানা_এক_পাখি
লেখা: সাহিয়া সুলতানা
পর্ব: ৩৬

৫৯.
সুব্রত ঘরে এসে বিছানায় বসে পায়ের জুতা খুলতে লাগলো। তপসী লেবুর শরবত নিয়ে ঘরে আসলো তখন। সুব্রত শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে তপসীর উদ্দেশ্য বললো,

—— তপসী, তোয়ালে টা এনে দাও তো। একদম তোয়ালে পরে এরপর ওয়াসরুমে যাবো।

—— দাড়ান দিচ্ছি।

তপসী শরবত সুব্রতের হাতে দিয়ে বারান্দায় গেল। সুব্রত ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো।
তপসী ফিরে আসতেও সুব্রত জিজ্ঞেস করলো,

—— তোমার এই ‘আপনি,তুমি’ এর কম্বিনেশন কলিং টা কবে শেষ হবে বলো তো?

তপসী সুব্রতের গলায় তোয়ালে রেখে বললো,

—— কেন ভালো লাগছে না?

—— মন্দ লাগছে না। তবে একেক বার একেক ভাবে ডাকলে কনফিউজড হয়ে যাই আমাকেই ডাকছো কিনা!

—— আজব কথা বার্তা। দুই রকম ডাকের ফিলিং ই দুই রকম। তুমি চাইলে মাঝে মাঝে আমাকেও ডাকতে পারো, বেবিইই।

—— আলাদা ফিলিং আছে নাকি?

—— হ্যাঁ তো। মাঝে মাঝে আপনাকে বেশি সম্মান করি আবার মাঝে মাঝে তোমাকে বেশি ভালোবাসি।

—— যারা সবসময় একটা ডাকে তারা কি হয় সম্মান করে নয় ভালোবাসে?

—— তাদের টা তো আমি বলতে পারি না। আমি তো দার্শনিক না, সমস্ত দর্শন করতে পারি না। নিজের অনুভূতিটুকুই তোমার কাছে টুক করে বলে ফেলি।

—— বাহ, আমায় এ মাঝে মাঝে ট্রাই করা উচিত।

—— হ্যাঁ করুন। ডেকেই দেখুন না।

—— ডাকবো ডাকবো।

,
সুব্রত দাঁড়িয়ে কোমড়ে তোয়ালে প্যাঁচিয়ে প্যান্ট চেঞ্জ করতে নিলেই তপসী চিৎকার করে উঠলো,

—— এ্যাই দাড়ান, আমি বাহিরে যাই আগে।

সুব্রত চোখ ছোট করে তপসীর দিকে তাকালো। জিজ্ঞেস করলো,

—— প্রবলেম কি?

তপসী আমতা আমতা করে বললো,

—— ইয়ে মানে, অনেক দিন পর এসেছেন তো৷ আপনাকে আবার নতুন নতুন লাগছে।

সুব্রত হো হো করে হেসে উঠলো। বললো,

—— নতুন লাগছে মানে কি আমায় এতোদিন ভুলে গিয়েছিলে নাকি?

তপসী শাড়ির আঁচল আঙুলে প্যাঁচাতে প্যাঁচাতে বললো,

—— ভুলে যাবো কেন? আমি তোমায় বুঝাতে পারছি না কেমন লাগছে।

সুব্রত তোয়ালে কোমড়ে জড়িয়ে তপসীর কাছে এসে দাঁড়ালো। হাত ধরে বললো,

—— আমার মুখের দিকে তাকাও তো।

তপসী মাথা উঁচু করে সুব্রত কে দেখলো এক ঝলক। আবার মাথা নিচু করে ফেললো।
সুব্রত তপসীর থুতনিতে ধরে মুখ উঁচু করে ধরে বললো,

—— আমি কি বদলে যাই তপসী? এইযে প্রত্যেকবার ছুটি কাটিয়ে চলে গেলে কান্না করো, চুপসে যাও, এমন কেন করো? জানো ওখানে একা বসে যখন তোমার এমন অবস্থার কথা শুনি বুকের মধ্যিখান টা ছিড়ে ফেড়ে যায়? এমন করো না বউ। সব জেনেই তো বিয়ে করেছিলে, তোমার তো শক্ত থাকার কথা ছিল, অথচ এতোই নরম হয়ে যাও যে আমি নিজেই ভেঙে গুড়িয়ে যাই।

তপসী সুব্রতকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বুকে মাথা রাখলো। কান্না করছে তপসী! সুব্রত তপসীর মাথাটা চেপে ধরলো নিজের বুকের সাথে। তপসী কান্নামাখা গলায় ই বললো,

—— আমি কি জানতাম বিরহ এতো কষ্টের? আগে কি দু-চারটা বিয়ে করেছি আমি? হুহ!

—— ছিঃ, এতোগুলা বিয়ে কেন করবে?

—— তাহলে? আমার তো একটাই বর, সেও যদি চলে যায় দূরে, কি নিয়ে থাকি বলুন তো? আপনাকে বললাম একটা ছোট সুব্রত চাই, কই দিচ্ছেনই না!

সুব্রত হাসবে না-কি কাঁদবে বুঝতে পারলো না। এতো বাচ্চামো কিভাবে করে তার বউ?

তপসী সুব্রতের বুকে নাক ঘষে বললো,

—— সরি, আমি জানি সবাইকে খুব কষ্ট দেই, কিন্তু আমি নিজেই কষ্টে থাকি, অন্যদের সুখ কিভাবে দেই?

—— ইউ কান্ট লাভ আদারস, আনটিল ইউ লাভ ইউরসেল্ফ। নিজেকে ভালো না বাসলে অন্যকে বাসা যায় না। তেমনি নিজেও সুখী না থাকলে অন্যকে সুখী করা যায় না।

—— আপনি দূরে থাকলে আমি সুখ ছুঁয়ে দেখতে পারি না।

—— ছুঁয়ে থাকবে কেন? হাতের মুঠোতে ধরে রাখবে।

—— আপনি চোখের সামনে থাকলেই ভালো থাকি, আর এমনিতেও চেষ্টা তো করছি সবসময় হাসিখুশি থাকার।

—— এইতো গুড!

তপসী আবার অবুঝের মতো বিলাপ করে বলে উঠলো,

—— আপনি কেন সবসময় কাছে থাকেন না?

সুব্রত কথা না বলে গান গাইতে লাগলো,

—— খোলা আকাশ কি এতো ভালো লাগতো?
যদি কিছু কিছু মেঘ নাই থাকতো?

তপসী নাক ফুলিয়ে বললো,

—— আপনি গান গাইছেন?

—— আমি তো তোমায় গানের কথা বুঝাতে চাইলাম। অনেকটা সময় দূরে থাকি বলেই তো বাড়ি আসলে এতো আনন্দ পাও। আর যদি সবসময় চোখের সামনে থাকতাম তাহলে টিপিকাল স্বামী স্ত্রীর মতো ক্যাট ফাইট করতাম বউ। সেই দিক দিয়েও আমরা কিন্তু এডভান্টেজ পাচ্ছি।

—— ক্যাট ফাইটই ক’জনের ভাগ্যে জুটে?

৬০.
রাত আটটার দিকে মেহেদীর অনুষ্ঠান শুরু হলো। গান বাজনায় একটা অন্যরকম আনন্দমুখর পরিবেশ।

তপসী শুভ্র কে কোলে নিয়ে বসে আছে সুব্রতের পাশে। রায়ার হাতে এখন মেহেদী লাগানো হচ্ছে। তুলির মেহেদী শুকিয়ে গেছে। হাত ধুয়ে এসে শুভ্রকে কোলে নিলেই তপসীও হাত ভর্তি করে মেহেদী লাগাবে।

সুব্রত শুভ্রের হাত নাড়াচাড়া করে খেলছিলো। সুব্রতের মা দ্রুত পায়ে হেটে আসলো তাদের সামনে। বললো,

—— রনিত কই? তোরা দেখেছিস ওকে?

সুব্রত খেলা থামিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

—— রনিত কই মানে কি?

—— কই মানে বুঝিস না? পাওয়া যাচ্ছে না ওকে। ফোনও বন্ধ, সারা বাড়ি খুঁজলাম পেলাম না। কাউকে কিছু বলেও যায় নি।

তপসী ভড়কে গেলো। পাওয়া যাচ্ছে না মানে কি? সুব্রত শান্ত স্বরে বললো,

—— মা, এমন ভাব করছো যেন হাপুড় পারা বাচ্চা ও। কোথায় চলে গেছে গেছে বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলছো! বন্ধুদের সাথে বাহিরে ঘুরছে হয়তো।

—— ওর বিয়ের অনুষ্ঠান চলছে আর ও বাহিরে ঘুরবে? আর ওর বন্ধু বান্ধব সব এই বাসায়। ও কার সাথে ঘুরে তাহলে?

সুব্রত কপাল কুঁচকে কিছুক্ষণ কি যেন ভাবলো। এরপর বললো,

—— মা ছাদে খুঁজেছো? দেখা যাবে ও ছাদে আর তুমি সারা দুনিয়া খুঁজে বেড়াচ্ছো।

সুব্রতের মা বললো,

—— ছাদে তো খোঁজা হয়নি। আচ্ছা আমি ছাদে খুঁজে আসি।

—— খুঁজতে হবে না তোমার। তুমি শুভ্র কে নাও, আমরা খুঁজে আসি।

—— দুইজনেরই যেতে হবে?

—— হ্যাঁ, জোড়ায় জোড়ায় যাবো। তুমি তোমার নাতি নিয়ে ঘুরো, যাও।

,
সুব্রতের মা শুভ্র কে নিয়ে চলে গেল। চলে যেতেই তপসী রাগী চোখে তাকালো সুব্রতের দিকে।
সুব্রত হেসে জিজ্ঞেস করলো,

—— ওভাবে দেখো না বউ, এখনই রোমান্স জেগে যাচ্ছে আমার।

—— আপনি চূড়ান্ত অসভ্য। তুমি বলেছিলে শুধু আমার সামনেই তোমার অনেক রূপ, এখন মা’কে কেন জোড়ায় জোড়ায় ঘোরার কথা বললে? রনিতকে পাওয়া যাচ্ছে না আর আপনি এখানে মজায় আছেন?

—— বাচ্চা ছেলে নাকি ও যে পাওয়া যাচ্ছে না। তোমার শ্বাশুড়ি মা ছাদে খুঁজে নি। এবং আমি সিউর ও ওখানেই আছে।

—— ওখানে কি করে একা একা?

—— ওর মন ভালো নেই। আমি ওকে চিনি। খুব চেষ্টা করছে নিজের অবস্থা সবার কাছে ভালো দেখাতে, বাট ও ভালো নেই। কিছু একটা নিয়ে ভীষণ আপসেট। তাই একা সময় পার করছে হয়তো।

—— সুহানা দি’র সাথে কোনো ঝামেলা হয়েছে কি?

সুব্রত আর কথা বাড়ালো না ওই বিষয়ে। তপসীর হাত ধরে বললো,

—— চলো ছাদে যাই। ফিরে এসে তো মেহেদীও লাগাবে তুমি।
#নাম_না_জানা_এক_পাখি
লেখা: সাহিয়া সুলতানা
পর্ব: ৩৭

৬১.
ছাদের সিড়িকোঠার সামনে আসতেই তপসী দেখতে পেলো তুলি দ্রুত পায়ে নেমে আসছে ছাদ থেকে। তপসী হাত চেপে ধরলো তুলির।

—— কোথায় ছিলি?

তুলি চমকে উঠে বললো,

—— ছাদে ছিলাম বৌদিদি৷

—— তোর মেহেদী ধুয়ে আমার কাছে যাওয়ার কথা ছিল শুভ্র কে নেওয়ার জন্য। তুই ছাদে কি করছিলি?

—— আমি আসতেই নিচ্ছিলাম তখন রনিতদা আমার ঘরে এসে বললো চা করে ছাদে দিয়ে আসতে তার জন্য। আমি চা দিয়েই আসলাম মাত্র।

সুব্রত জিজ্ঞেস করলো,

—— রনিত ছাদে একা?

তুলি সহজ স্বীকারোক্তি দিলো।

—— হ্যাঁ। এতোক্ষণ আমি ছিলাম।

—— কি করছে ও একা একা?

তুলি ঠোঁট উলটিয়ে বললো,

—— আমি কিভাবে জানবো? বৌদিদি শুভ্র কই?

—— শুভ্র মায়ের কোলে। যা নিয়ে নে ওকে কোলে।

তুলি চলে গেল। সুব্রত তপসীর দিকে তাকিয়ে বললো,

—— বলেছিলাম না গাধাটা হয়তো ছাদে।

,
ছাদে অন্য কারো উপস্থিতি টের পেয়ে ঘুরে দাড়ালো রনিত। সুব্রত হামি তুলে জিজ্ঞেস করলো,

—— কিরে ভাই? তোর বিয়ে টা কি আমরাই করে নিবো? খুঁজেই পাওয়া যায় না তোকে।

—— তোর বিয়ে না হলে বলতাম, যা ভাই তুই ই করে নে।

—— প্রেম করলি তুই আর বিয়ে করবো আমি? হুহ!

রনিত চায়ের কাপটা রেলিং থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো। মুখে তার সবসময়ের মতো অমায়িক হাসি। তপসীর বুকে গিয়ে লাগলো হাসিটা। রনিত এমন কথা কেন বলছে?

তপসীর বার বার মনে হচ্ছে তাদের প্রতি রনিতের অভিমান আছে। যা সে মুখ ফুটে বলতে চাইছে না, ব্যবহারে বুঝাতে চাইছে না। এমন কি হয়ে গেছে কয়েক দিনের ব্যবধানে!

সুব্রত হেসে বললো,

—— আগে হলে ভেবেই দেখতাম বল। এখন যখন সম্ভব না, চল নিচে। বিয়ের ফাংশনে এটেন্ড করে আমাদের উদ্দ্বার কর।

—— তোকেই উদ্দ্বার করছি। চল।

আবার তপসীর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

—— আমাকেও কি মেহেদী লাগিয়ে দিবে নাকি বৌদি?

—— অবশ্যই সুন্দর করে সুহানা লিখে দিবে। মেহেদী শুকিয়ে গেলে আমার কাছে আসবে। আমি চিনির জল লাগিয়ে দিবো। দারুণ রঙ আসবে, যত বেশি রঙ তত বেশি ভালোবাসা।

—— চিনি লাগাবো না। দেখি ভালোবাসার রঙ গাড় হয় নাকি ফিকে।

সুব্রত রনিতের কাধে হাত রেখে ছাদ থেকে নেমে গেল। তপসী একবার রেলিঙের সামনে গেল। কাপটা কি সত্যিই ফেলে দিলো কিনা চেক করতে। উপর থেকে স্পষ্ট কিছুই বুঝা গেল না, তবে সে সিউর রনিত কাপটা ফেলে দিয়েছে।
কিন্তু কেন? রাগ করে? কিসের এতো রাগ? অভিমান?

তপসী নিচে চলে গেল। সবাই আনন্দ করছে। সে নিজেও আনন্দে মত্ত হয়ে গেল। এত চিন্তা করে লাভ নেই। চিন্তায় কোনো ফলই হয় না।
শুধু শুধু মাথার অসুখ। এরচেয়ে ভালো যা হওয়ার হোক, নিজের মতো থাকো।

৬২.
রনিত নিজের হাতে শুধু সুহানা নামটাই লিখিয়ে নিলো। মেহেদী আর্টিস্ট আরো ডিজাইন করতে চেয়েছিল কিন্তু রনিত করতে দেই নি।

মেহেদীর অনুষ্ঠান সুন্দর ভাবেই শেষ হলো। রাত দেড়টার দিকে তপসী জগে জল ভরে ঘরে যাচ্ছিলো তখনই রনিত পথ আটকালো।

তপসী ভ্রু নাঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

—— কি ব্যাপার রনিত দা? দি’র চিন্তায় বুঝি ঘুম আসছে না? ঘুমিয়ে পড়ো নাহলে ফেস এর গ্লো চলে যাবে যাও যাও। নাহলে বিয়েতে বর কে হ্যান্ডসাম হাঙ্ক লাগবে না।

রনিত আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করলো,

—— তুমি কি সিউর মেহেদীর রঙ ভালোবাসার উপর ডিপেন্ডেবল?

তপসী চিন্তিত ভঙ্গিতে বললো,

—— রঙ গাঢ় হয় নি?

—— না, হয়েছে। তুমি আমার কথা উত্তর দেও।

—— আমি শুনে এসেছি ছোট থেকেই। যদিও কুসংস্কার তবুও অনেকক্ষেত্রেই সত্য হয়ে যায়।

—— সত্য হয় যাবে তো?

তপসী মাথা দুলিয়ে হ্যাঁ সূচক উত্তর দিলো। রনিত আবার বললো,

—— এক কাজ করি সুহানার কাছে ছবি চাই ওর মেহেদীর। দেখি রঙ কেমন। আমি যে তাকে এতো ভালোবাসি। ভালোবাসার রঙ ফুটলো কিনা।

তপসী হেসে বললো,

—— আরেহ, সুহানা দি মেহেদী লাগাবে নাকি?

—— কেন লাগাবে না?

—— আমাদের তো নিয়ম নেই। বাঙালি মেয়েরা বিয়েতে মেহেদী পড়ে না।

—— আমার ফ্রেন্ড তানজিলা তো পড়েছিল।

—— আহা, ওদের আর আমদের কাস্ট কি এক? ওরা তো লাগাবেই। আমাদের লাগাতে নেই।

—— উফফ, আমি এখন রঙ কিভাবে দেখবো।

—— বিয়ের পর দেখে নিয়ো। এখন যাও ঘুমাও। মাঝ রাতে বাচ্চাদের মতো মেহেদীর রঙ নিয়ে লাফাচ্ছে।

রনিত মনে মনে বললো,

—— এতোটুকু বিষয় যে আমার কতো ভালো লাগছে তোমায় তো বুঝাতে পারছি না তপসী। বুঝাতে পারলে আমার মন যে কতোটা শান্তি পেত তা কি জানো?

তপসী রনিতের চোখের সামনে তুড়ি বাজিয়ে বললো,

—— এখানেই ঘুমিয়ে পড়লে নাকি? ঘরে গিয়ে ঘুমাও। জগ ধরে দাঁড়িয়ে থেকে আমার হাত ব্যাথা হতে গেছে।

—— চলো তাহলে এগিয়ে দিয়ে আসি।

রনিত তপসীকে ঘর পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসলো। আসার আগে একবার সুব্রতের দিকে দেখলো। বিছানায় শুয়ে তপসীর বালিশ বুকে নিয়ে শুয়ে আছে। হুট করে রনিতের মনে হলো, তার ভাইটা সত্যিই ভীষণ ভাগ্যবান। তপসী এরচেয়েও বেশি ভাগ্যবতী।

,
একের পর এক সব অনুষ্ঠানই হচ্ছিল। খুব সুন্দর অ্যারেজমেন্ট। তপসীর আবার মন ফুরফুরে হয়ে গেল। এতো মানুষ জন, সর্বোপরি সুব্রতের সাথে থাকতে তার ভালো লাগছে।

চলবে…………
চলবে……..
চলবে……..………

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here