#নিয়তি
#অলিন্দ্রিয়া_রুহি
৮ (শেষ পর্ব)
আমার মনে হচ্ছে,আমি এখানে এসে বড় ভুল করে ফেলেছি। না আসলেই ভালো হতো। চাচীর এরকম কালো মুখ এবং খোঁচা মারা কথা হজম করতে হতো না। মনটা বিষন্নতায় ভরে আছে। দাদীর ঘরে ঢুকে আমি চুপ করে বসে আছি। জারিফার জন্য আসলেও জারিফা আমাকে ভুলেই গেছে একদম। আম্মুকে পেয়ে সে মহাখুশি। আমি অপেক্ষা করছি সকালের,সকাল হলেই এই বাড়ি থেকে বিদায় নেবো। এরপর এদিকে আমার ছায়াটাও কেউ দেখবে না আর,আশা করি। বুক চিঁড়ে একটা লম্বা,গভীর দীর্ঘশ্বাস বাতাসে মিশে গেল। সেই দীর্ঘশ্বাসের শব্দ দাদীর কর্ণকুহর অবধি পৌঁছেছে বোধহয়। তিনি আমাকে বললেন, ‘মন খারাপ করিস না বুইন। যা হয়, আল্লাহর ইশারায় হয়।’
আমি সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলাম, ‘এটা ভুল বললে। পৃথিবীতে কত পাপ হয়,খুন হয়,অন্যায় হয়। সেগুলোও কী আল্লাহর হুকুমে হয়?’
দাদী বললেন, ‘ওত বুঝি না বুইন। তোর কপালে সুখ আসবেই, আমি জানি।’
আমি মৃদু হাসলাম। আমার কপালে কোনোদিনই সুখ হবে না। কোনোদিনই না…
আমার জীবন থেকে সুখ নামক পাখিটা তো বহু আগেই অন্যের খাঁচায় নিজেকে সপে দিয়েছে! বুঝতে পারছেন না? না পারারই কথা,বুঝিয়ে বলি শুনুন। আমি একজন কে ভীষণ ভালোবাসতাম! ভীষণ…আমার জীবনের প্রথম এবং শেষ ভালোবাসা সে-ই। সে যে জানতো না এই কথাটি তা না,শুরু থেকেই সব জানতো। প্রথমে উপেক্ষা করে গেলেও আবেগের কাছে একসময় ধরা দিতে বাধ্য হলো। আমার ভালোবাসাকে কবুল করলে আমরা দু’জনে একটা সুন্দর জীবন যাপন করতে শুরু করলাম। অবাক হচ্ছেন? জানতে ইচ্ছে করছে,কে সেই মানুষটি? তাহলে শুনুন, আমার জীবনের সবচেয়ে গোপন অধ্যায়টির নাম হচ্ছে সাদাফ ভাই!
মাত্র বারো বছর বয়সে উনার প্রতি আমার প্রথম অনুভূতিটা জাগ্রত হয়। ভালোবাসা,প্রেম কী জিনিস তখনো ভালো করে বুঝতে শিখিনি। শুধু এতটুকু বুঝতে পারতাম, উনি আমার আশেপাশে থাকলে আমার ভালো লাগে। খারাপ মন ভালো হয়ে যায়, উনার কণ্ঠস্বর আমার অন্তর ঠান্ডা করে দিতো। উনাকে এক পলক দেখলে পুরো দিনটা আমি রুমঝুম খুশিতে কাটাতাম। এভাবেই কেটে গেল তিনটি মাস, তিন মাস পর উনি বাড়ি ছেড়ে চলে গেলেন ভালো জায়গায় পড়াশোনা করার জন্যে। তখনো তাকে বলা হয়নি, ভালোবাসি! আমি একরাশ বিষন্নতা আর অভিমান নিয়ে তার অপেক্ষায় দিন গুণতে লাগলাম। পারিবারিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তার সঙ্গে দেখা হতো ঠিকই! কিন্তু বলে উঠতে পারতাম না, আমি আপনাকে পছন্দ করি, ভালোবাসি! খুব গোপন ছিল এই বিষয়টি,একান্তই আমার!
সেবার আমার ছোট মামার বিয়ে। পরিবারের সবার দাওয়াত পড়ল। যথারীতি হলুদের দিন বিকেল বেলায়ই মাইক্রো ভাড়া করে যাওয়া হলো আমাদের। একই মাইক্রোতে সাদাফ ভাই ও ছিলেন। উনি তখন পড়াশোনা শেষে ভালো চাকরির চেষ্টা চালাচ্ছেন। ঘন চাপদাড়িতে উনাকে দেখতে এত সুন্দর লাগতো! আমি অপলক তাকিয়ে থাকতাম। মাঝে মাঝে চোখ পড়ে যেতো,আমি দৃষ্টি ফিরিয়ে নিতাম হতভম্ব হয়ে। লজ্জা লাগতো ভীষণ তাও উনার দিক থেকে নিজের নেত্র ফেরাতে পারতাম না। সেই বিয়ের সময়েই কীভাবে কীভাবে সাদাফ ভাই টের পেয়ে গেলেন, আমি তাকে পছন্দ করি! দুপুরের খাওয়া শেষে এক খিলি পান মুখে পুড়ে আমি বড়দের মতো করে চাবাচ্ছি, সাদাফ ভাই টুপ করে কোথা থেকে এলেন, আমার লাল ঠোঁটে আঙুল চালিয়ে চলে গেলেন। আমি বরফের ন্যায় জমে গেলাম ওখানেই। স্তব্ধ নয়নে তাকিয়ে রইলাম দীর্ঘকাল। কী হলো,ব্যাপারটা বুঝতে বুঝতে সাদাফ ভাই দ্বিতীয় দফায় এলেন, বললেন, ‘তুই এতটাও বুদ্ধিমতী হোস নি যে আমার থেকে লুকোবি সবকিছু।’
রাঙা হয়ে উঠল আমার গাল,কথাটি শোনামাত্র। ভালোবাসি বলা হয়নি, তবুও দু’জনে কাছে এসে পড়েছিলাম! উনি কথা দিয়েছিলেন, চাকরি নিয়ে ভালো পজিশনে গেলে আমার কথা সবাইকে জানাবেন। পরিবারের কেউ আপত্তি করবে বলেও আমার বিশ্বাস ছিল না। দুটো বছর একে অপরের সাথে চুটিয়ে প্রেম করেছিলাম,ওই দুটি বছরই আমার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ সময়, সর্বশ্রেষ্ঠ মুহূর্ত গুলো আমি ওখান থেকেই পেয়েছি। কাউকে বলে বোঝাতে পারব না কতটা সুখী ছিলাম আমি! কিন্তু নিয়তি! আমার নিয়তি আমাকে সুখী করতে চায়নি বোধহয়। তাই তো চাচা-চাচী কাউকে না জানিয়েই তন্দ্রা ভাবীকে আংটি পরিয়ে এসেছিলেন। পনেরো দিন পর সাদাফ ভাইকে দাওয়াতের কথা বলে সেই বাড়িতে নিয়ে যান এবং ঘরে ফেরেন বউ নিয়ে!
আমি যতটা না হতবিহ্বল হয়েছিলাম, তার চাইতেও বেশি হতবিহ্বল ছিলেন সাদাফ ভাই। বাসর রাতটা শুনেছিলাম, ঘরের বাইরেই কাটিয়ে দিয়েছিলেন রাগ করে। আমি অবশ্য বউ দেখে সেই যে বিদায় নিয়েছিলাম তাদের বাড়ি থেকে, আমাকে কেউ হারিকেন জ্বালিয়েও খুঁজে পায়নি। কিন্তু যখন শুনলাম সাদাফ ভাই কোনোভাবেই স্বাভাবিক হতে পারছেন না,তখন একবার গেলাম। ভীষণ সাহস নিয়ে! যেন কিছুই হয়নি, এমনি করে বললাম, ‘দুটো মাত্র বছর! কী হয় ভুলে গেলে? একজনকে পেতে চেয়ে আর চারজন মানুষকে কেন কষ্ট দিচ্ছেন আপনি?’
সাদাফ ভাই প্রত্যুত্তরে বলেছিলেন, ‘ভালোবাসি রূপ, বড্ড বেশি!’
গলার মাঝে আঁটকে রাখা দমটাকে আমি গিলে নিয়েছিলাম। কাঠ কণ্ঠস্বরে বলেছিলাম, ‘ভালোবাসার দিব্যি, স্বাভাবিক হন। সংসার করুন, ভাবী ভীষণ ভালো। আপনার সব কষ্ট দূর করে দেবে।’
সাদাফ ভাই ছাদের উপর আমার হাত জোড়া চেপে ধরে হাউমাউ করে কেঁদেছিল, আমি ফিরে তাকায়নি। বড় চাচী আড়ালে বলেছিলেন, তিনি নাকী সব জানতেন। আমাদের আচরণ উনার মনে সন্দেহ জাগিয়েছিল তাই এভাবে হুট করে বিয়ে করিয়ে দিয়েছেন। উনি কেন যে আমাকে সাদাফ ভাইয়ের স্ত্রী হিসেবে মেনে নিলেন না তা আজও জানি না! যদি আমি এরপরও সাদাফ ভাইয়ের সংসারে হস্তক্ষেপ করি তবে আমার বাবা-মাকে চূড়ান্ত অপমান করবেন। সেই চলে আসা, শেষ আসা।এরপর এই, এবার এলাম! মাঝে আর একবারও যায়নি সাদাফ ভাইয়ের বাড়িতে। তবে সবসময়ই তার খোঁজখবর রেখেছি। জারিফা হওয়ার সংবাদ টাও আমি পেয়েছিলাম নিজ থেকে খোঁজ করে। হাস্যকর লেগেছিল! যাকে এককালে পিঁপড়ে ছুঁলেও হিংসেয় মরতাম,সেই মানুষের সন্তান অন্যের গর্ভে! তবুও আমার এতটুকু জ্বলন হয়নি। তবে কী ভালোবাসা ঠুনকো ছিল, নাকী কঠিন নিয়তির কাছে সবটাই মিথ্যা? জানি না।
নিশ্চয়ই অবাক হয়ে ভাবছেন, যাকে নির্দোষ ভেবেছিলেন,তার ভেতরে কতবড় সত্য লুকিয়ে ছিল, তাই না? তবে হ্যাঁ,এটাও অস্বীকার করতে পারব না,প্রহর সাহেবকে ভীষণ মনে ধরেছিল আমার। যদি না অধরা নামক ব্যক্তিটি আমাদের দু’জনের ভেতর থাকত, তবে হয়তো ভীষণ সুন্দর একটি সংসার আমিও গড়তে পারতাম! একদিক থেকে অধরা আর প্রহর সাহেবকে ধন্যবাদ ও দিতে হয়। বিপদের সময়েও দু’জন দু’জনের হাত ছাড়েনি!
আর হ্যাঁ, একটা কথা বলতে ভুলে গিয়েছিলাম, আমার বিয়ের দিন বিছানায় যেই রক্তের দাগের কথা বলেছিলাম,তা অধরার ছিল। আমাকে বিয়ে করায় রেগেমেগে এই কান্ড ঘটিয়েছিল নাকী। যাইহোক, নিয়তি আমাকে কোনোভাবেই জয়ী হতে দিলো না। জানি না,এরপর আর কতবার হারতে হবে আমাকে! ভালোবাসা নামক শব্দটাকে মুছে দিয়েছি জীবন থেকে। এবার থেকে আমি একা বাঁচবো,আমার জন্য বাঁচবো। আমি আমাকে ভালোবাসি, আর কাউকে না.. কাউকেই না…
***
গভীর রাতে ফোনে ম্যাসেজ এলো, আমি এখনো জেগে। কোনোভাবেই দু’চোখের পাতা এক করতে পারছি না। ম্যাসেজ দিয়েছেন সাদাফ ভাই, ‘তন্দ্রাকে আমি ছাড়তে চাই রূপ।’
আমি ম্যাসেজ সিন করার সাথে সাথে সাদাফ ভাইয়ের নাম্বারটা ব্ল্যাকলিস্টে ফেললাম। যেখানে ভাগ্যে সুখ লেখা নেই, সেখানে আরেকজনের সুখ কেড়ে নিতে যাওয়ার আমি কে? সকাল হলেই এই বাড়ি ছাড়তে হবে আমাকে,যেভাবেই হোক। আর কোনোদিন আমার ছায়াটাও পড়বে না। জারিফা নামক নিষ্পাপ শিশুটি তার বাবা-মার ছত্রছায়ায় আনন্দে বড় হোক,দোয়া করি। আপনারাও করবেন,কেমন? আর হ্যাঁ, আমার জন্য দোয়া করবেন,নিয়তির সামনে উঠে দাঁড়াতে পারি যেন ততবার যতবার সে আমাকে নিচু করে দিতে চাইবে সমাজের সামনে….
(সমাপ্ত)