নীল জ্যোৎস্নার রাত ও তুমি পর্ব ২

#নীল_জ্যোৎস্নার_রাত_ও_তুমি
লেখনীতে- সুমাইয়া জান্নাত

পর্ব-০২

নোরার কথায় প্রত্যয়ের মামী ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে নোরার দিকে তাকালো। কিন্তু নোরা তাকে পাত্তা না দিয়ে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে রইল। যেন কিছুই হয়নি এমন একটা ভাব। নোরার স্বাভাবই এমন। উচিত কথা বলতে সে কখনো বড় ছোট বিবেচনা করে দেখে না। যা সত্য মুখের উপর বলে দেয়। হাসি মুখে উচিত জবাবটা দিয়ে দেয়। ভদ্রমহিলার রাগ হলো ভীষণ। সে একটু আগেই হিয়ার সাথে তুলনা করে নোরার প্রশংসা করছিল। আর সেই কি-না তার মুখের উপর ঝামা ঘষে দিলো‌। এতো সুন্দর দেখতে একটা মেয়ে অথচ মেয়েটার মধ্যে ভদ্রতার লেশমাত্র নেই। বড়দের সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় সেটাও বুঝি এই মেয়েটাকে তার বাবা-মা কোনদিন শেখায়নি। সে নোরাকে কিছু কঠিন কথা বলার জন্য মুখ খোলার আগেই তাকে উদ্দেশ্য করে প্রত্যয়ের মা শক্ত কন্ঠে বলে উঠলো,

– ভাবি এতো দিন পর আমার ছেলের বিয়ে উপলক্ষে এ বাড়িতে এসেছেন থাকবেন, খাবেন। আপনার যত্নে কোন ত্রুটি হলে আমাকে বলবেন। আমি সেটা দেখবো কিন্তু তাই বলে আমার ছেলের বউকে কোন বাজে কথা বললে আমি কিন্তু তা সহ্য করবো না। আপনার এরকম স্বভাবের জন্যই কিন্তু হাসিবটা ঘর ছেড়েছে। তাই বলছি আমার ছেলের ভালো নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না। আর আমার ছেলের বউয়ের মধ্যে কি গুন আছে আমি সেটা জানি। গায়ের রং ফর্সা হয়ে কি হবে যদি মনের ভেতরটা আপনার মতো হয়.. আর আমি আমার ছেলের জন্য কোন ভুল মেয়েকে বউ করে আনিনি। আমার ছেলের বউ যে একটা খাটি হিরা সেটা আপনি না বুঝতে পারলেও আমি জানি। হিয়াই প্রত্যয়ের জন্য পারফেক্ট।

শেষ কথাগুলো মেহেরুন্নেসা স্নেহের সাথে হাসিমুখে বললো।
প্রত্যয়ের মায়ের কথায় অপমানে ভদ্রমহিলার মুখটা থমথমে হয়ে উঠলো। কিছু বলার ইচ্ছে থাকলেও সে আর বলতে পারলো না। একদম ঠিক জায়গায় ঘা টা দিয়েছে মেহেরুন্নেসা। সত্যিই তার স্বভাবের জন্যেই তার ছেলের সংসারটা ভেঙ্গেছে। প্রত্যয়ের মামাতো ভাই হাসিব। প্রেম করে বিয়ে করেছিল। মেয়েটার বাবার বাড়ির আর্থিক অবস্থা খুব একটা ভালো ছিল না। একে তো ছেলে তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে বিয়ে করে এনেছে, তার উপর গরীব ঘরের একটা মেয়ে। সে জন্য প্রত্যয়ের মামী তার ছেলের বউয়ের সাথে খুব বাজে ব্যবহার করতো। সবসময় বাপের বাড়ি তুলে খোঁটা দিতো। মেয়েটা অনেক মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছে কিন্তু প্রত্যয়ের মামী যেন তার ছেলের পাশে সেই বৌকে সহ্যই করতে পারতো না। প্রতিদিনের পারিবারিক অশান্তির একপর্যায়ে না পেরে তার ছেলে বউ নিয়ে তাদের থেকে আলাদা হয়ে যায়। তাদের একমাত্র ছেলে শুধুমাত্র তার স্বাভের জন্যেই তাদের সাথে থাকে না। বৌ বাচ্চা নিয়ে আলাদা বাসা ভাড়া করে থাকে এর থেকে কষ্টের আর কি হতে পারে? হাসিব বলেছিলো, যদি তার মা নিজের ভুল বুঝতে পেরে তার স্ত্রীকে যোগ্য সম্মান দিয়ে নিয়ে আসে তবেই সে বাড়িতে ফিরতে। কিন্তু ছেলের জন্য মন খারাপ হলেও গরীব ঘরের মেয়ের কাছে নিজের ভুলের জন্য ক্ষমা চাইতে তা ইগোতে বাজে। আর আজ তার সেই দূর্বল জায়গাটাতেই আঘাত করেছে তার ননদ। তাই এতো তিক্ত কথার পৃষ্ঠে সে কিছুই বলতে পারলো না।

আর তার কথাগুলো শুনে হিয়া অবাক চোখে তাকালো তার দিকে। চোখে চোখ পড়তেই সে হালকা হেসে চোখের ইশারায় তাকে ভরসা দিলো। যেন তার চোখদুটো হিয়াকে বললো,ভয় পাস না আমি তোর মা। আমি সবসময় তার পাশে আছি। কথাটা ভাবতেই খুশিতে হিয়ার চোখ দুটো আবারো জলে ভরে উঠলো। তার মা তাদের সাথে থাকলে সেও বুঝি এভাবেই সব বিপদ থেকে তাকে রক্ষা করতো?….

°

প্রত্যয়দের পরিবারের একটা নিয়ম আছে। নিয়মটা হচ্ছে বিয়ের পর নব বধূ নিজ হাতে রান্না করবে এবং সবাইকে নিজ হাতে পরিবেশন করে খাওয়াবে। হিয়া তেমন রান্না পারে না। তাদের বাসায় রান্নাটা তার বাবাই করতো। আজ তাই সব রান্না মিসেস মেহেরুন্নেসাই করছে। হিয়া শুধু তার সাথে যতটুকু পারে সাহায্য করেছে। হিয়া আজ অনেক দিন পর খুব খুশি। অনেক বছর পর আজ যেন তার মায়ের অভাবটা পূরণ হলো।

_

ঘড়ির কাঁটায় এখন ঠিক দুপুর দুইটা বাজে। কাঁচে ঘেরা একটা কফিশপে সামনাসামনি বসে আছে প্রত্যয় আর নিবিড়। নিবিড় প্রত্যয়ের বেস্ট ফ্রেন্ড। প্রত্যয় কফির কাপে চুমুক দিচ্ছিলো তখন নিবিড় সকৌতুক কন্ঠে বলে উঠে,

– কাহিনী কি বলতো দোস্ত? ঘরে নতুন বউ রেখে সকাল সকাল আমার কাছে এসে বসে আছিস..ভাবি কি রাগ করে তোকে ঘর থেকে বের করে দিয়েছে নাকি? কাল রাতে কি ওভার জোজ দিয়ে ফেলেছিলিস….

এইটুকু বলতেই প্রত্যয় নিবিড়ের দিকে চোখ গরম করে তাকালো । আর তা দেখে নিবিড় একদম চুপসে গেল। জোরপূর্বক ঠোঁটের কোণে একটুকরো হাসি ফুটিয়ে প্রত্যয়ের দিকে একবার চেয়ে নিজের খাবারে মনযোগ দিলো। তা না করলে আজ তার খবর ছিল। প্রত্যয়ের এই চোখ গরম করে তাকানোটাকে খুব ভয় পায় সে‌। প্রত্যয় এমন করে তার দিকে তাকালো মানেই পরক্ষণে তাকে দু ঘা লাগিয়ে দেওয়া। এই কফিশপ মানুষের সামনে অন্তত প্রত্যয়ের হাতে মার খেতে চায়না সে।

প্রত্যয়ও চিন্তিত মুখে আবার কফির কাপে চুমুক দিলো। প্রত্যয়কে এমন চুপ থাকতে দেখে একটু বাদে নিবিড় আবার জিজ্ঞেস করল,

-কি হয়েছে? এই ভাবি কি বাসর রাতে তোকে রিজেক্ট করছে নাকি? নিশ্চয়ই সিনেমার মতো বলেছে, আমার বয়ফ্রেন্ড আছে। তাই আমি আপনাকে আমার স্বামীর অধিকার দিতে পারবো না। আর আপনি যদি জোর করেন তো আমার দেহ পাবেন কিন্তু মন পাবেন না। আর তার জন্যেই এতো আপসেট তুই?

– আল নাহিয়ান খান প্রত্যয়কে রিজেক্ট করবে কোন মেয়ে। যেখানে মেয়েরা আমার সাথে একবার কথা বলার জন্য পাগল হয়ে থাকে…

-তাহলে?

-আমার যার সাথে বিয়ে হয়েছে সেই মেয়েটা নোরা না। ওর কাজিন।

-মানে?

-হুম। হিমেল আংকেলের মেয়ে নোরা না। নোরা উনার ভাগ্নি। আমি ভুল করে নোরাকে আংকেলের মেয়ে ভেবেছি।

-তুই কি ভাবিকে সব বলে দিয়েছিস?

-হ্যা।দেখ স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক একটা পবিত্র সম্পর্ক। তাই আমি চাই না কোন মিথ্যে দিয়ে সম্পর্কটা শুরু হোক। তাই আমি আমার দিক থেকে সবটা হিয়াকে বলেছি। আমি চাই না এই বিষয় নিয়ে পরবর্তীতে কোন ভুল বোঝাবুঝি বা কোন ঝামেলার সৃষ্টি হোক।

নিবিড় কিছু বলবে তার মাঝেই নিবিড়ের ফোনটা বেজে উঠলো। নিবিড় ফোনের স্ক্রিনে এক পলক তাকিয়ে বললো,

-আন্টি ফোন করেছে।

তার কথায় প্রত্যয় ভ্রু কুঁচকে বললো,
-তোর আন্টি ফোন করেছে তো আমি কি করবো?

-আমার আন্টি তোর মা।

-ওহ রিসিভ কর। কোন জরুরী দরকারে হয়তো ফোন করেছে।

কথা বলা শেষে নিবিড় বললো,
– সবাই তোকে খুঁজছে। তোর শ্বশুর বাড়ির লোকজন চলে এসেছে। আজ তাদের মায়ের বৌ ভাত আর জামাই লাপাত্তা সবাই হাতে হারিকেন নিয়ে তোকে খুজে বেড়াচ্ছে।

প্রত্যয় স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,
-আগে কফিটা শেষ করি তারপর যাই।

নিবিড় বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে অধৈর্য গলায় বলে উঠলো,

-কাজের চক্করে তোর বিয়েটা মিস করেছি এখন আর বৌভাতটা মিস করতে চাচ্ছি না। তাড়াতাড়ি চল তো। তা নাহলে হাতে হারিকেন আর পেছনে বাঁশ নিয়ে এসে তোর শ্বশুর মশাই তোর সাথে আমাকেও বাঁশ দিবে। এখনো বিয়েটা করতে পারলাম না। তাই এতো তাড়াতাড়ি তোর শ্বশুর মশাইয়ের বাঁশ খেয়ে ঠাশ হতে চাই না।

অগত্যা প্রত্যয় ও উঠে দাঁড়ালো। পা চালালো তাদের গন্তব্যে।

_

করিডোর দিয়ে হেঁটে নিজের রুমের যাওয়ার সময় হঠাৎ করেই কারো সাথে ধাক্কা খেল প্রত্যয়। সেও যেমন আনমনে ছুটছিল অপর পাশের রমণীও একইভাবে ছুটছিল। হঠাৎ আকস্মিক কান্ডটা ঘটে গেল। তবে দুজনই নিজেকে সামলে নিয়েছে। প্রত্যয় সামনের মানুষটির দিকে তাকালো। নোরা! লাল লেহেঙ্গা আর ভারী মেকআপে কি সুন্দর লাগছে তাকে দেখতে। যেন ডানা কাটা পরী। নোরার লেহেঙ্গার ওড়না সরে গিয়ে তার মেদহীন ধবধবে উদরের কিছু অংশ দেখা যাচ্ছে। প্রত্যয় সেদিক থেকে দ্রুত চোখ সরিয়ে নিল। মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করছে। পরনারীর দিকে এভাবে তাকিয়ে থাকা একদম উচিত নয়।

~চলবে, ইনশাআল্লাহ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here