#নীলাম্বরীর_প্রেমে
#Tuhina pakira
পর্ব : ১৭
-” স্পর্শ দা আমার হাতটা ছাড়ো। ট্রেন চলে যাবে এবার প্লিজ।”
ট্রেন ততক্ষনে স্টেশনে দাঁড়িয়ে গেছে। কিছু যাত্রী উঠছে, কেউবা নামছে, কোনো কোনো কামরার দরজার সামনে আবার নামা- ওঠা নিয়ে চিৎকার চেঁচামেচি ও হচ্ছে।
-” কাল যেনো কী বলেছিলিস? “ও হ্যাঁ, আমি নাকি বেসুরে। ”
স্পর্শ মনে করে কাল রাতের কথাটা বলে আয়ুর দিকে তাকালো। আয়ু হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করছে আরেক বার ট্রেনের দিকে দেখছে। স্পর্শ অপর হাতে আয়ুর মাথায় গাট্টা মেরে বললো,
-” ওই আমি কী বেসুরে?”
আয়ু অনবরত মাথা নাড়াতে লাগলো। স্পর্শ ওর হাত ধরে টেনে ট্রেনের কাছে ছুটতে ছুটতে বললো,
-” আর যেনো কী বলেছিলি, জোনাক নাচে কেনো? আমি নাচলেই তো পারি। মনে পড়েছে আয়ু বুড়ি কাল রাতের ঘটনা?
আয়ু স্পর্শের পিছনে ছুটতে ছুটতে বললো,
-” এবারের মতো ট্রেনটা ধরিয়ে দাও। আর কখনো বলবো না। ”
-” সে তোকে চিন্তা করতে হবে না। নেক্সট টাইম আমি তোকে নাচ করে দেখিয়ে দেবো। পারলে শিখিয়েও দেবো।”
স্পর্শ আয়ু কে নিয়ে জেনারেল কামরায় উঠে কথাটা বলে ভিতরের দিকে পা বাড়ালো। আয়ুও স্পর্শের পিছনে গিয়ে দেখলো ও নিশ্চিন্তে একটা লোকের সঙ্গে কথা বলছে।
-” তুমি আমাকে লেডিস কামরায় না তুলে এখানে তুললে কেনো?”
আয়ুর কথায় সিটে বসে থাকা কয়েকজন ওর দিকে তাকালো। স্পর্শও ভ্রু কুঁচকে ওকে দেখে নিয়ে ওর সামনের ভদ্র লোক এবং ওনার পাশে থাকা মহিলাকে বললো,
-” আপনারা কোথায় নামবেন?”
-” আমরা নেক্সট স্টেশনে নামবো। আপনারা এখানে বসতে পারেন।”
-” থ্যাংক ইউ আঙ্কেল।”
-” ইটস মাই প্লেজার।”
আয়ু মুখ ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। মাঝে মাঝে জানলার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। জেনারেল কামরা এখন কিছুটা ফাঁকা। ভিড় প্রায় নেই। কিন্তু তা কতক্ষন বলা যাচ্ছে না। ভিড়ের মধ্যে লেডিস কামরায় ঠেলাঠেলিতে কিছু মনে না হলেও জেনারেলে অনেকেরই অস্বস্তি হয়। ঠিক যেমন আয়ুর হচ্ছে। এই যে ওর কিছুটা সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটা ওর দিকেই খুব কুরুচি পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। আয়ুর তো ইচ্ছে করছে ছেলেটাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করতে, “আপনি কি আগে কখনো মেয়ে দেখেননি?”
এই প্রশ্নটা করে ছেলেটাকে অস্বস্তিতে ফেললে কী খুব খারাপ হবে? মনে তো হয় না হবে। ব্যাপারটা বেশ ভালোই হবে। পরবর্তী কালে কোনো মেয়েকে চোখ দিয়ে গিলে খাবার আগে মনে রাখবে।
আয়ুর মনে হঠাৎ করেই এক তেজি সত্তার সঞ্চয় হলো। মুখে অনেক কথাই যেনো বেরিয়ে আসতে চাইছে। মন অনেক কিছু মনে করিয়ে দিচ্ছে। মন বারবার বলছে, ” আপনার নজরটা এখন আমার পায়ে দেখতে পেলে ভালো হতো। এতই যখন নিজের চোখ নিজের সীমায় থাকে না তখন তো নিজের চোখ গুলো অন্ধকে দান করে আসতে পারেন। আপনাদের মতো মানুষদের জন্য মেয়েরা এখনও দিনের বেলা যেখানে সুরক্ষিত না তখন রাতের অন্ধকারে তাদের সুরক্ষার কথা বলাই তো বিলাসিতা। ”
আয়ুর চোখের সামনে ভেসে উঠলো কিছু ভিডিও। কয়েক জন মেয়েকে দেখেছিল তারা খুব জোর গলায় বলছে , ‘আজকালকার দিনে মেয়েদের পোশাকের জন্যে নাকি তারা ধর্ষিত হন। এতে পড়ে ছেলেদের দোষ দেন। কিন্তু তারা কি করবে বলুন আপনারা যদি অশালীন পোশাক পড়ে বাইরে বেরোন। ‘
আয়ুর সেই ভিডিও এর কথা মনে পড়লে কিছু সত্যি কথা মাথায় আসে। আমাদের সমাজে সব মেয়ে অশালীন পোশাক পড়ে? আর ওই যে ছোটো ছোটো পাঁচ- ছয় বছরের বাচ্চারা ওরাও কী অশালীন পোশাক পড়ে? আয়ুর খুব ইচ্ছে করে কথা গুলো ওই ভিডিওর কমেন্টে লিখতে। কিন্তু ও কখনো লিখে উঠতে পারে নি। অন্যান্য কমেন্ট পড়েই ওর আশা চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে গেছে। মানুষ যে কত নোংরা কথা বলতে পারে তা তো ওর আন্দাজের বাইরে।
আয়ু চোখ বড়ো করে ছেলেটার দিকে তাকালো। যেমনটা অসুর বিনাশিনী মা দুর্গার দেখেন। আয়ুর যদি ত্রিনয়ন থাকতো এতক্ষণে ওই ছেলেটাকে ভস্ম করে দিতো। আয়ুর রাগী চোখের দিকে তাকিয়ে ছেলেটা এক পা পিছিয়ে গেলো। ভরা ট্রেনের মধ্যে মেয়েটা যদি একটা থাপ্পর ও মারে তাহলে ট্রেনের সব লোক ওকে বেধড়ক পিটবে। ছেলেটা চোখ সরিয়ে ট্রেনের বাইরের দিকে তাকিয়ে রইল। মাঝে মাঝে আড়চোখে আয়ুর দিকে যতবারই তাকিয়েছে ততবারই দেখেছে আয়ু চোখ পাকিয়ে ওর দিকেই তাকিয়ে রয়েছে।
-” এই আয়ু বসে পড় ওনারা উঠে গেছে।”
স্পর্শ এতক্ষণ ফোনে কথা বলছিল। ও উল্টো দিকে থাকায় আয়ুর মুখ ঠিক মত দেখতে পারছিল না।
স্পর্শের কথা শুনে আয়ু ওর দিকে ঘুরে তাকালো। আয়ুর মুখ দেখে স্পর্শ অবাক হয়ে তাকালো। ততক্ষণে স্ট্রেশনে ট্রেন থেমেছে। আয়ু আর সেই ছেলেটাকে দেখতে পায়নি। যতটা সম্ভব নেমে গেছে।
-” আয়ু কী হয়েছে তোর?”
আয়ু চুপ করে জানলার পাশের সিটে বসে বললো,
-” কিছু কীট কে শায়েস্তা করছিলাম। এছাড়াও দেখলাম আমার চোখের তেজ কতোটা?”
-” তো কী বুঝলি?”
-” কীট টা হেরে গেছে বুঝলে। জংলি কীট বলে মনে হলো না। তবে জংলি কীট হতে পারতো। কিন্তু আমার চোখের তেজে কিছুটা ঝলসে গেছে বোধহয়। যদি শোধরায় পরে। ”
স্পর্শ মুচকি মুচকি হাসলো। ওর আয়ু অনেক বড়ো হয়ে গেছে। আগের মত দুর্বল না সে। মানুষ- অমানুষের ফারাক ও বুঝতে শিখেছে।
20 মিনিটের মধ্যে ট্রেনে বেশ ভালোই ভিড় হয়েছে। আয়ু – স্পর্শ এতক্ষণ নিশ্চিন্তে বসে বাইরের প্রকৃতি দেখছিল। কিন্তু এবার ওদের এই ভিড়ে চ্যাপ্টা হতেই হবে। কারণ পরের স্টেশনেই ওরা নামবে। ওদের জায়গা থেকে দরজা পর্যন্ত যেতে দম বেরিয়ে যাবে একেবারে।
স্পর্শ আয়ুর হাত ধরে খুব সাবধানে দরজার কাছে এসে দাঁড়ালো। যতক্ষণ না ট্রেন স্টেশনে এলো আয়ু এক ঘোরের মধ্যে স্পর্শের দিকে তাকিয়ে রইল। স্পর্শের ঠিক এতটা কাছে ও আগে কখনো যাইনি। আয়ুর মনের মধ্যে কিছু একটা হচ্ছে। কী হচ্ছে আয়ু জানে না। তবে যা হচ্ছে তা কী ভালো? ভালো না। কারণ একটাই, অপর মানুষটা #নীলাম্বরীর_প্রেমে আবেশিত।
♠
বিকেল 5 টা।
আয়ু এখন স্যারের কাছে পড়তে এসেছে। কলেজ থেকে পড়ার জায়গাটা অনেকটাই কাছে তাই ওরা আর বাড়ি যায় না। একেবারে পড়ে বাড়ি ফেরে।
শোভন স্যার এখন ওদের নোটস লেখাতে ব্যস্ত। স্যার বাড়ির নীচের তলায় ড্রয়িং রুমে পড়ায়। জায়গাটা বেশ ছোটো হওয়ায় অনেককে সিঁড়ির তলায় বসতে হয়। আজ যেমন আয়ু, রুহি আর সজল সিঁড়ির তলায় বসেছে। আয়ু আর রুহিকে স্যার দেখতে পেলেও সজল কে স্যার দেখতে পারছে না। এতে অবশ্য সজলের বেশ লাভ।
আয়ু সহ অনেকেই তাড়াতাড়ি হাত চালিয়ে লিখে চলেছে। স্যার লেখাচ্ছেন চেন্নাই এক্সপ্রেসের স্প্রিডে কিন্তু ওদের কাছে মাল গাড়ির স্প্রিড হলে ভালো মনে হয়।
লেখার মাঝে মাঝে মাঝে রুহি হেসে চলেছে। একে স্যার দ্রুত বলছেন অপর দিকে রুহি ফ্যাচফ্যাচ করে হেসেই চলেছে। আয়ু এবার বিরক্ত হয়ে ওকে আস্তে করে চুপ করতে বললো। কিন্তু রুহি সজলের দিকে দেখছে আর হেসেই চলেছে।
-” পাগলের মতো হাসছিস কেনো?”
রুহি ফিসফিস করে বললো,
-” ঘুমোচ্ছে সজল।”
আয়ু রুহির কথায় রুহির মাথাটা নামিয়ে দেখলো সত্যি করেই সজল ঘুমোচ্ছে।
-” রুহি ওকে ডাক। স্যার দেখলে আজ ও গেলো। ”
রুহি সজলকে হাত দিয়ে একটু নাড়া দিতেই ও হুট করে চোখ খুলে তাকালো। স্যারের বলা শব্দ গুচ্ছ গুলো খাতায় আবার লিখতে আরম্ভ করলো। কিন্তু কিছুক্ষণ পর ও আবারও ঢুলতে লাগলো। রুহি ওকে আবারও ঠেলা দিল। সজল হাই তুলে রুহির ব্যাগের সাইড থেকে জলের বোতল বের করে হালকা জল হাতে নিয়ে চোখে দিল। তারপর একটু জল খেয়ে ব্যাগ থেকে ফোন বের করে দেখলো এই সবে ৫ টা ১৫ মিনিট বাজে।
-” ধুর এখনও ১৫ মিনিট বাকি। আমার আর ভালো লাগছে না।”
শেষের কথাটা একটু জোরেই বললো। যা স্যারের কানে গেলো।
– ” কার ভালো লাগছে না বাচ্চারা শুনি একটু?”
স্যারের কথায় সবাই একে অপরের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে কথাটা কে বললো। অপর দিকে রুহি আর আয়ু মুখ টিপে হেসেই চলেছে।
-” কী ব্যাপার আয়ু, তুমি হাসছো কেনো?”
আয়ু স্যারের কথা শুনে ঘাবরে গেলো। স্যার কে কি বলবে ঘুছিয়ে নিয়ে বলার মুহূর্তেই স্যারের একটা ফোন চলে এলো।
-” তোমরা চুপ করে একটু বসো আমি আসছি। তবে চিৎকার করবে না কেউ। সামনেই আমার ছেলের পরীক্ষা আছে। চুপ করে আজকের পড়াটা দেখো। ”
স্যার চলে যেতেই রুহি সজলের খাতাটা হাতে নিয়ে কিছু দেখে আয়ু কে দেখালো। সজল ঘুমের ঘোরে কি লিখেছে ভগবান জানে। কখনো পাতায় ইজিবিজি কেটেছে, কখনো একটার উপরে অন্য কিছু লিখেছে, কোথাও আবার এত ছোটো লিখেছে যে কিছু বোঝাই যাচ্ছে না।
রুহির সঙ্গে আয়ুও ফিক করে হেসে উঠলো। সজল মুখ ফুলিয়ে বললো,
-” 2 তো পর্যন্ত কলেজে ক্লাস করে 2 ঘণ্টা পড়তে এসে বসে থেকে আবারও পড়তে আমার ভালো লাগে না। সারাদিনে একটুও রেস্ট পাই না। সারাদিনের এক রুটিন। আমি প্রচুর পরিমাণে বোর এতে।
-” সে তো ঠিক বলেছিস। কিন্তু কী করবি? ওই হ্যাঁ আমরা যদি কোথা থেকে ঘুরে আসি কেমন হবে আয়ু?
আয়ু বলার আগেই সজল প্রায় চিৎকার করেই বলল,
-” দারুন আইডিয়া।”
সজলের চিৎকারে সকলে ওর দিকে তাকিয়ে আবার চোখ সরিয়ে নিলো।
– আরে আস্তে বল। কিন্তু কোথায় যাবি?”
রুহির কথায় আয়ু আর সজল ভাবতে লাগলো। ওদের ভাবনায় অবশ্য রুহিও যোগ দিল।
-” আমার কাছে আইডিয়া আছে। শোন।”
আয়ু রুহির কানে কানে কিছু বললো। রুহি সেই কথা সজলকে বলে দুজনে একসঙ্গে বললো,
-” ডান। ব্যাপক মজা করবো ঠিক আছে।”
কিছুক্ষণ পর স্যার এসে চিৎকার করার জন্য একটু বকে পড়াতে লাগলো।
#নীলাম্বরীর_প্রেমে
#Tuhina pakira
পর্ব : ১৮
সন্ধ্যে সাতটা নাগাদ স্পর্শ মোড়ের মাথার চায়ের দোকানে চলে যায়। অরূপ আর সাদ আগে থেকেই ওখানে বসে রয়েছে। এতদিন পর বন্ধুকে দেখে দুজনে গিয়ে স্পর্শ কে জড়িয়ে ধরে।
-” স্পর্শ তুই তো আরও কিউট ড্যাশিং হয়ে গেছিস?”
-” সাদ তোর ফালতু বকা বন্ধ কর। ”
-” সাদ কী এমন ভুল কথা বলেছে? তুই তো আরও স্মার্ট হয়ে গেছিস।”
-” বেশি বকিস না অরূপ। কেমন আছিস তোরা? কতো দিন পর সামনা সামনি হলাম বল!”
-” আমি তো বিন্দাস আছি। তবে অরূপের টা জানি না। ইদানিং খুব ব্যস্ত।”
সাদের কথায় তাল মিলিয়ে স্পর্শ ও বললো,
-” হ্যাঁ আমিও তাই দেখছি। যখনই ফোন করছি ফোন ব্যস্ত। কী ব্যাপার ভাই? ”
-” ব্যাপার তেমন কিছুই না। মা আমার জন্যে মেয়ে দেখেছে। ওই, তার সাথেই কথা বলি। আর কিছু না।”
অরূপ বেশ লাজুক হেসে কথাটা বললো। হঠাৎই ওর পিঠে জোরে খুশিতে ছোট ঘুষি মেরে উঠলো সাদ।
-” ওরে বাপরে মরে গেলাম। ওই শয়তান মারলি কেনো?”
-” আরে ভাই খুশির ঠেলায়। তুই তো আমাকে খুশি করে দিলি ভাই। তাড়াতাড়ি বিয়েটা কর। আমি তো আর ওয়েট করতে পারছি না। ”
-” বিয়ে তো অরূপের হবে। তোর এত কিসের মজা?”
-” আরে বুঝিস না কেনো স্পর্শ। অরূপের বিয়েতে অনেক মেয়ে আসবে ওখান থেকে আমিও আমার সেটিং করে নেবো। এই সিঙ্গেল লাইফ ভালো লাগে না। বাড়িতে মা বিয়ে কর কর করে মাথা খারাপ করে ফেলছে। যাকে পাচ্ছে তাকেই বলছে মেয়ে দেখতে। আমার কাকার মেয়ের এক বন্ধুর জন্যে আবার সম্বন্ধ নিয়েও চলে গিয়েছিল।”
স্পর্শ হেসে তিনটে চা বলে বেঞ্চে বসে বললো,
-” তা তো ভালোই। তো বিয়ে করে নে।”
-” তুই কর না। আমায় বলিস কেনো। আমি তো দু – তিন বছর প্রেম করে তারপর বিয়ে করবো। আমি কি আর অরূপের মতো অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ করবো নাকি?”
-” কে যেনো তার বাপকে যমের মতো ভয় পায়?”
-” হ্যাঁ তাইতো। এই অরূপ, কে সেই ভাগ্যবান?”
সাদের মুখ চুপসে গেল। ওর মুখ দেখে স্পর্শ আর অরূপ হেসে উঠলো। আসলে সাদ যতই বড়ো বড়ো কথা বলুক না কেন, ও ওর বাবাকে ভীষণ ভয় পায়। সাদের বাবা আর্মিতে ছিলেন ১২ বছর। ওনার মুখের হাসির কথাও মনে হয় গর্জন মেশানো। ওনার একবার ‘বাবু’ আওয়াজে পারলে সাদের এখনও কাপড়ে চোপরে হয়ে যায়। বাইরে যতই ফাঁকা ডায়লোগ দিক না কেনো। বাড়িতে বাবার কথায় এখনও ওঠে বসে সাদ। তবে বাবাকে ভীষন ভালবাসে।
সাদ কথা ঘোরানোর জন্যে চা বিক্রেতাকে বললো,
-” ভোলা কাকু চা হয়েছে?”
ভোলা চা এর ছোটো হাড়িতে কয়েকটা এলাচ ফেলে দিয়ে বললো,
-” এইতো হয়ে গেছে সাদ বাবা। ”
স্পর্শ ও ওর বন্ধুদের আড্ডা খানা বলা যেতে পারে এই ভোলা শর্মার চায়ের দোকান। তরুণ থেকে বৃদ্ধ সকলেরই সময় কাটানোর জায়গা এটা। আজ শনিবার হওয়ায় অনেকেই এখানে আড্ডা দিতে চলে এসেছে। গরম গরম চায়ের সাথে প্রজাপতি বিস্কুট কিংবা বাসনা এতে আড্ডা জমে ক্ষীর। ভোলা কাকু চায়ের ভাঁড় তিনটে ওদের দিকে এগিয়ে দিল।
-” কেমন আছো স্পর্শ বাবা?”
মধ্য বয়স্ক ব্যাক্তিটি তার ছোটো ব্যাক্তিদের বাবা , বাছা সম্বোধন করে।
-” আমি খুব ভালো আছি কাকা। তুমি কেমন আছো? ”
-” এই চলে যাচ্ছে। অনেকদিন পর তোমাকে দেখে খুব ভালো লাগছে।”
-” আমারও খুব ভালো লাগছে।”
অন্য খদ্দেরদের ডাকে ভোলা কাকু নিজের কাজে চলে গেলো।
-” হ্যাঁ রে, আমাদের মিথিলা শাকচুন্নির কী খবর?”
-” ওর খবর তো জিঙ্গালালা হুই হুই।”
সাদ দুই হাত তুলে নাচের স্টাইলে কথাটা বলল। স্পর্শ আর অরূপ হেসে দিল। অরূপ চায়েতে চুমুক দিয়ে বললো,
-” তোর সঙ্গে কথা হয় না স্পর্শ?”
-” ওই পেত্নীর কথা কি বলবো, প্রথম প্রথম দিনে কতবার যে ফোন করতো তার ইয়াত্তা নেই। কিন্তু কয়েক সপ্তাহ পর থেকে ফোন করতো ওই সপ্তাহে একবার। তারপর তো আর ফোনই করে না। মাঝে মাঝে হোয়াটসঅ্যাপে কেমন আছিস আর কি করছিস জিজ্ঞেস করতো। তারপর এখন তো কথাই হয় না।”
-” ওকে তো কেউ বলিনি তুই এসেছিস। ও জানতে পারলে ঠিকই দেখা করতো।”
অনেক দিন পর তিন বন্ধু মিলে অনেকক্ষণ আড্ডা দিলো। অরূপ আর সাদ চলে গেলো ওদের বাড়ি। কেবল স্পর্শ বসে রইলো। ভোলা কাকুকে আর একটা চা দিতে বলে ও তাকিয়ে রইল রাস্তার দিকে। এই রাস্তা দিয়ে নীলাম্বরী আসলেও আসতে পারে। বলা যায় না, মানুষ যখন কাউকে দেখার তীব্র ইচ্ছে নিয়ে অপেক্ষা করে; তখন দমকা হাওয়ায় মতো কখনো কখনো তার সঙ্গে দেখাও হয়ে যায়। আর স্পর্শের এখন নীলাম্বরীকে দেখার তীব্র ইচ্ছে করছে। যদি দেখা হয়, যদি দু- একটা কথা হয় তাহলে কি খুব খারাপ হবে? খুব কী খারাপ হবে তার সঙ্গে সোডিয়ামের আলোর ভিড়ে কয়েক মুহূর্ত পায়ে পা মিলিয়ে হাঁটলে?
♣
স্পর্শের সঙ্গে ওর মনের নীলাম্বরীর দেখা আদৌ হবে কিনা তা তো ঠিক জানিনা। তবে তার জীবনের আয়ুরেখার দেখা তো হতেই হতো। তাই তো দমকা হাওয়ায় মতো স্পর্শের বহু আকাঙ্খিত দৃষ্টি তার প্রতিবেশীনীর উপরেই পড়লো।
স্পর্শ সবে গরম চায়ে প্রথম চুমুক দিয়েছে। আয়ু অটো থেকে নামলো বলতে গেলে স্পর্শকে দেখতে দেখতে। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে আয়ু পার্সে কিছু খুঁজতে লাগলো। ভ্রু কুঁচকে স্পর্শ আয়ুর দিকে তাকিয়ে চা খেতে গিয়ে গরম চা মুখে পুরে ফেললো। কোনো মতে মুখের চা ঘিটে মুখে হাওয়া পুড়লো আবার বের করলো। চা টা খুব বেশি পরিমাণ গরম নেই। তাও জিভ হালকা জ্বলছে। ভোলা কাকার কাছে গিয়ে মানিব্যাগ থেকে অরূপ, সাদের এক কাপ করে আর ওর দুটো চায়ের চল্লিশ টাকা দিয়ে স্পর্শ গাড়ি আসছে কিনা দেখে রাস্তা পেরোলো।
-” কী হয়েছে?”
আয়ু পাশে তাকিয়ে দেখলো স্পর্শ৷ কিন্তু ওকে কিছু না বলে নিজের ব্যাগটা একবার চেক করে অটোওয়ালাকে বললো,
– ” দাদা দেখুন না আপনার কাছে ১০০ টাকা খুচরো হবে না৷ আমার কাছে ২০ টাকা খুচরো নেই৷ ”
– ” দিদি আমি তো বললাম আমার কাছে খুচরো হবে না৷ আপনি আশেপাশে দোকানে দেখুন যদি পান৷ ”
স্পর্শ আয়ুর দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকালো৷ কেনো ওকে বললেই তো হয়৷ ও তো জিজ্ঞেসও করলো ওর কি হয়েছে। স্পর্শ পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে বললো,
-” খুচরো লাগবে এটা বলতে কি তো খুব কষ্ট হচ্ছে? হলে বল , সামনেই একটা হাতুড়ে ডক্টর বসে ওর কাছে তবে নিয়ে যাই।”
আয়ু চুপ করে স্পর্শের দিকে গাল ফুলিয়ে তাকালো।
-” কতো টাকা দাদা? ”
-” ২০ টাকা।
স্পর্শ পকেট থেকে ২০ টাকা বের করে অটোওয়ালাকে দিতেই তিনি অটো নিয়ে চলে গেলো।
স্পর্শ পকেটে মানিব্যাগ রেখে বাড়ির দিকে হাঁটা দিল।
-” চল আয়ু। বাড়ি যাবি তো তুই?”
আয়ুকে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে স্পর্শ পিছনে এসে ওর সামনে দাঁড়িয়ে বললো,
-” এই যে ম্যাডাম চলুন। ”
আয়ু কিছু না বলে স্পর্শের দিকে ওর হাতের টাকাটা এগিয়ে দিল। স্পর্শ পকেট থেকে আবারও মানিব্যাগ বের করে হাঁটা দিল। আয়ুও ওর পিছু পিছু এলো। কিছুক্ষণ মানিব্যাগটা দেখে স্পর্শ ওটা আয়ুকে দেখার জন্যে ওর সামনে ধরলো। আয়ু একবার ব্যাগের ভিতরটা দেখে স্পর্শের দিকে তাকিয়ে দেখলো সেখানে খুচরো নোট কিছু নেই।
-” ঠিক আছে , আমি বাড়ি গিয়ে খুচরো করে দিয়ে দেবো।”
স্পর্শ পকেটে ব্যাগটা রাখতে রাখতে বললো,
-” তোর কি মনে হয় আমি বলবো আমাকে টাকা দিতে হবে না? ওই সব এখন অতীত। আগে বাবার টাকায় চলতাম তাই কিছু মনে হতো না। তবে এখন কষ্ট করে অর্জিত টাকা খরচ করতে খুবই মায়া হয়।
একটা মানুষ কতো পরিশ্রমের পর মাস শেষে নিজের পারিশ্রমিক পায় সেটা তারাই বোঝে। অনেকে তো নিজের প্রাপ্য পারিশ্রমিক টুকুও পায় না।”
আয়ু মন দিয়ে স্পর্শের কথা গুলো শুনলো। নিজের বাগের সাইড থেকে দুটো চকলেট লজেন্স বের করে একটা স্পর্শের দিকে এগিয়ে দিল। স্পর্শ লজেন্স এর প্যাকেট খুলে লজেন্স মুখে দিল।
-” ঘুষ দিলি আমাকে?”
-” আমি বড়ো সৎ মানুষ। ঘুষ টুস আমার অভিধানে নেই।”
-” আচ্ছা, তুই সৎ মানুষ! ”
-” এতে এতো অবাক হওয়ার কী আছে?”
-” না ওই আরকি। ”
নির্জন রাস্তায় দুজনে হেঁটে চলেছে। যেমনটা স্পর্শ চেয়েছিল, তার নীলাম্বরীর সাথে হাঁটতে। কিন্তু এটা তো আয়ু। তাহলে কি স্পর্শের ইচ্ছেটা ইচ্ছেই থেকে গেলো? আর আয়ু, আচ্ছা আয়ুর মনের কোনো চোরা আঁধারে স্পর্শকে নিয়ে এমন কোনো ভাবনা কি কখনো ছিল? হয়তো ছিল। তবে ভবিষ্যত তো জানি না। হয়তো আয়ু এখনও চায় স্পর্শের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে সারাটা জীবনের এক একটা মুহূর্ত পার করতে।
-” আচ্ছা আয়ু, দুই দিন হলাম আমি এসেছি। তুই একবারও তো বললিনা আমি কেমন আছি?”
আয়ু সামনের রাস্তার একটা ছোটো ইটকে পা দিয়ে ধাক্কা মেরে বললো,
-” কিছু মানুষকে দেখলে বোঝা যায়, সে কেমন আছে। সেই সেন্স থেকে আমার মনে হয়েছে তুমি ভালোই আছো।”
-” আগে কেমন ছিলাম বলতে পারবো না। তবে এই দুই দিন খুব ভালো আছি বুঝলি। ”
-” কেনো এই দুই দিন কী এমন ছিল?”
-” গেস কর।”
আয়ু মলিন হেসে বলল,
-” বুঝলাম। তো তোমার নীলাম্বরী কেমন আছে?”
দুহাত বুকের মাঝে গুজে স্পর্শ হাসলো। কিছু মানুষ বুঝেও বোঝে না; আর কিছু মানুষকে বোঝালেও বোঝেনা।
-” আছে তো। তবে সবাইকে বোঝাবার চেষ্টা করে সে বেশ ভালো আছে। আমাকেও করেছে। আমি কথা বাড়াই নি তার কথা মেনেই নিয়েছি। তবে কি বলতো, সে বড্ড অভিমানী। তার অভিমান এই আছে এই নেই। কখনো মনে হয় সে খুব করে অভিমান করে। আবার কখনো মনে হয় সে ঠিক মতো অভিমান করতেই পারে না। সে ভাবে আমাকে এড়িয়ে চললে আমার থেকে দূরে যাওয়া যায়। কিন্তু সে এটা বোঝে না, পাখি যতই দূর আকাশে যাক না কেনো। তার শেষ ঠিকানা তার সুখের নীড়ই হয়। সেও ঠিক ঘুরে ফিরে আমার কাছেই আসে।”
স্পর্শকে লুকিয়ে আয়ু তপ্ত একটা নিশ্বাস ফেললো। ভাবনাটা হলো, স্পর্শ বোঝেনি। কিন্তু এর আসল ভাব, স্পর্শ সবটাই দেখেছে, অনুভব করেছে। কারোর হৃদয় জোড়া চাপা লুকোনো অব্যক্ত কষ্টও সে উপলব্ধি করেছে। কিন্তু সে কিছুই বললোনা। ভনিতা সে করেই গেলো।
-” আয়ু ?”
-” হুহু।”
-” আমি অভিমানীর মলিন হাসি দেখতে ভালোবাসি। আহা! বড়ো ভালোবাসি।”
-” এটা কি তবে তোমার নিষ্ঠুরতা ভাববো?”
-” মানুষ ভাবে অনেক কিছুই তবে সব ভাবনা নিষ্ঠুরতা না। কিছু ভাবনা মনের গহীন ভালোবাসাও হয়। শুধু বুঝতে বেলা পড়ে যায়।”
(চলবে )
{