#নূরবাহার ( ৫ )
#মিমি_মুসকান ( লেখনিতে )
বিহারিনী দিদিরে নিয়ে তার বাপ মায়ের চিন্তার শেষ নেই। দিনে দিনে মেয়েটা বড় হয়ে যাচ্ছে, অথচ তাকে বিয়ে দিতে পারছে না। বিয়ের কথা পাকাপোক্ত হবার পরই বিয়ে ভেঙে যাচ্ছে। কেন ভেঙে যাচ্ছে তার নির্দিষ্ট কোন কারণও জানা যাচ্ছে না। বিহারিনীর পিতা মেয়ের কন্যার কথা চিন্তা করতে করতে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। মাতা আগ্রহ নিয়ে পুজো করে যাচ্ছে। এই বিপদ থেকে একমাত্র ঠাকুরই তাদের রক্ষা করতে পারে। এজন্য দিনের বেশির ভাগ সময়ই ঠাকুর ঘরে একমনে পুজো করে যাচ্ছে। ঘরের সব কাজকর্ম দেখছে বিহারিনী! তাদের আর্থিক অবস্থা মন্দ নহে, তবুও এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হচ্ছে।
বাহার উঠানোর সামনে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে বলছে, —“বিহারিনী দিদি, ও বিহারিনী দিদি!
বাহারের গলার স্বর পেয়ে ছুটে এলো বিহারিনী! তার পিতা বিরক্ত দৃষ্টিতে তাকালেন বাহারের দিকে। এই মাইয়াকে তার একদম পছন্দ না। অলক্ষ্মী মেয়েটা বাড়িতে পা রেখেই পুরো বাড়িটা অশুদ্ধ করে দিয়েছে। যতবার মানা করো না কেন? ফের এসে হাজির হয়। বিহারিনী নাকি ডেকে পাঠায়। নিজ কন্যাকেও বুঝিয়ে পারছেন না তিনি।
—“এতোদিন পর এলি বাহার!
—“তুমি নাকি আইতে কইছো!
—“আসতে বলছি বলেই তো এলি, নাহলে কি আর আসতি!
—“কেন ডাকছো গো বিহারিনী দিদি।
—“এদিক আয়! নাড়ু আছে, প্রসাদ আছে,একটু খেয়ে যা।
—“খাবার সময় নাই গো দিদি।
—“আহা একটু বস না!
সরল মনের বাহার বাড়ির অন্দরে প্রবেশ করল। তার মনে বিন্দুমাত্র চিন্তা ভাবনা নেই এই হাসিমুখে থাকা বিহারিনীর মনের নোংরা চিন্তা ভাবনা! প্রতিহিংসার আগু’নে জ্বল’ছে সে। রূপ নিয়ে হিং’সার প্রভাবটা যেন মেয়েদের জন্ম থেকেই থাকে। কিন্তু সেই হিংসার আড়া’লে যেই কুচক্র সে মনে আটছে তা কি ভাবা যায়!
এতো বড়লোকের মেয়ে হওয়া সত্ত্বেও তার অতোটা রূপ নেই যতটা না এই বাহারের আছে। কেন এতো রূপ তার, কি আছে এই মাইয়ার! তার চেয়ে কি কম কিছু আছে বিহারিনীর। মাথায় গোছা ভর্তি চুল, নামি দামি এতো শাড়ি, এতো সাজ অলংকার কিছুই তো নেই বাহারের। কিন্তু তবুও যেন মনে হয়, সবচেয়ে আসল জিনিসটাই এই বাহার নিয়ে গেছে। সে হচ্ছে রূপ! কোন পর পুরুষ বাহার কে দেখার পর অন্য মেয়েকে দেখতে চায় না। অন্য কোন মাইয়া নাকি তাগো মনে ধরে না। বাহারের মতো একটা অভিশপ্ত মাইয়া যদি এতো রূপের অধিকারী হয়ে থাকে, তাহলে সে হলো না কেন?
ঘন কৃষ্ণ বর্ণের আঁখি বিহারিনীর! শ্যামবর্ণ গাঁয়ের রঙ তার! কি নেই তার, টাকা পয়সা, সম্পত্তি সব আছে। মা বাপও আছে, সুনাম আছে। তবুও বুঝি এই মেয়ের বিয়ে আটকে থাকে। বিহারিনী শীতল দৃষ্টিতে বাহারের খাওয়া দেখছে। তার আঁখি কি স্বচ্ছ, কি সুন্দর! একবার দেখলে বার বার দেখতে ইচ্ছে করে। এতো টুকু বয়সেই মেয়েটা এতো রূপ নিয়ে আছে, বড় হলে তো সর্বনাশ বাঁধিয়ে ছাড়বে! তার নজরকাড়া হরিণী দৃষ্টি, এই দৃষ্টি কোন পর পুরুষের এড়িয়ে চলার ক্ষমতা নাই!
বাহার উঠে দাঁড়িয়ে বলল, —“দিদি আমি যাই গো!
—“আহ বোস না, আজ খিচুড়ী রান্না হচ্ছে, খেয়ে যাস কেমন?
বাহার দাঁড়িয়ে ঘ্রাণ শুকল। বিহারিনী হেসে কইলো, —“দেখলি কতো সুন্দর গন্ধ বেড়িয়েছে।
—“কিন্তু রান্না হইতে যে অনেক সময় লাগবো।
—“তাতে কি? তোর এতো তাড়া কিসের? এই ভর দুপুরে কোন নাগর তোর জন্য অপেক্ষা করবে শুনি!
—“দিদি, এমন কথাবার্তা কইবা না।
—“আচ্ছা যা বাবা, ভুল হয়েছে আমার। ভুলেই তো গেছিলাম, তোর তো আবার নাগর নেই!
বলেই হেসে উঠলো বিহারিনী! বাহার তাকিয়ে রইল তার হাসির দিকে। দিদি খুব সুন্দর করে হাসে। বাহার এলে যেন আরেকটু বেশি সুন্দর করেই হাসে। দিদি কে বাহারের খুব ভালো লাগে। খুব সুন্দর করে কথা কয়, বাহার এলেই তারে অনেক কিছু খাইতে দেয়, অনেক আদর করে। কিন্তু বারাবারিও করে? আইলে কিছুতেই যাইতে দিতে চায় না। রাইতে বাহারের লগে ঘুমাইতে চায়। কয়, “তোরে জড়িয়ে ধরে একটু ঘুমাই বাহার! রাতে তোর মাথায় হাত বুলিয়ে দিমু নি!” শুধু কি তাই, একগাদা জিনিসপত্র বের করে সাজাতে শুরু করে। নিজের সবচেয়ে সুন্দর শাড়িটা বাহার কে পড়িয়ে অলংকার পড়িয়ে দেয়। এসব বাহারের ভালোই লাগে কিন্তু দিদিমার ভালো লাগে না। একবার এমন দেইখা তো দিদিমা খুব রাইগা গেলেন। এই বাড়িতে আইতে মানা করছে। খালি কয়, ওই বিহারিনী তোরে হিংসা করে, তোর রূপ সহ্য করতে পারে না। ওই মাইয়ার চোখে আমি হিংসা দেখছি, তুই আর ওই বাড়িতে যাইবি না বুঝলি!” কিন্তু বাহারের মনে হয় দিদিমা একটু বাড়িয়ে বাড়িয়ে বলে, কই! বিহারিনী দিদি তো তাকে ভালোবাসে আদর করে, এহানে আবার হিংসা আইলো কোখান থেকে।
হাসতে হাসতে বিহারিনীর চোখে অশ্রু এসে জমল। উঠে দাঁড়িয়ে আলমারি থেকে নতুন শাড়ি বের করে কইলো, —“আয় বাহার, এই শাড়িটা তোরে পড়িয়ে দেই। খুব মিষ্টি লাগবো তোরে?
—“না গো, দিদিমা রাগ করবো।
—“আরে কিছু হবে না তুই আয় তো!
বলেই বাহার কে টেনে নিল। ঘরের দরজা বন্ধ করে যত্ন নিয়ে বাহার কে শাড়ি পড়িয়ে দিতে লাগল। পিচ্চি বাহারের নতুন শাড়ি পড়ার আগ্রহ কম না। শাড়িটায় বার বার হাত বুলিয়ে দেখছে সে। শেষবার নতুন শাড়ি পড়ছিলো সেইবার ঈদে! তাহেরা বেগম বাহার কে নতুন শাড়ি উপহার দিছিলো। সেই একবার শাড়িটা পইড়া দিদিমা রেখে দিছে। কইছে, নতুন শাড়ি বার বার পইড়া নষ্ট করার দরকার নাই। এদিকে বিহারিনী দিদি রোজ রোজ নতুন শাড়ি পড়ে। শাড়ি গুলা কি সুন্দর! বাহার হেসে উঠলো। জানালার ফাঁকে আসা আলোয় সেই হাসি দেখলো বিহারিনী! তার শরীর জ্ব’লতে লাগল, এই মেয়ের হাসি এতো সুন্দর কেন? কেন এতো শব্দ করে হাসে। পর পুরুষের সামনে এমনভাবে হেসে কি তাকে নিজের দিকে আহবান জানায় এই মেয়ে!
বাহার কে বিহারিনীর সহ্য হয় না, একদম সহ্য হয় না। এই নিয়ে পর পর ৯ টা বিয়ের সম্বন্ধ ভাঙলো বিহারিনীর। সবার এককথা, মাইয়র গাঁয়ের রঙ যে ময়লা! ওইদিকে তাগো পোলার ঢক খুঁজে পায় না বিহারিনী! কিন্তু মাইয়া চাই ঠিকই সুন্দরী! শেষবার যেই সম্বন্ধ এলো, সেখানের ছেলেকে খুব ভালো লাগলো বিহারিনীর। সুন্দর মতো খেয়ে দেয়ে কথাবার্তা বলে বিদায়ও নিলো। বিহারিনী তো ধরেই নিছিলো এইখানে তার বিয়ে এবার হবেই হবে। কিন্তু শেষ অবদি, শেষ অবদি কি হলো? মুনসী ঘটক এসে জানিয়ে দিলো ছেলেরা তাকে না বলছে! এই গ্রাম ছেড়ে যাবার পথে বাহার কে দেখে ছেলের মন নাকি ঘুরে গেছে। এবার সে এই মেয়েকেই বিয়ে করতে চায়। কথাগুলো শুনে বিহারিনীর ইচ্ছে করল পানিতে ডুই’বা ম’রতে! এভাবে অপমান হলো সে, এভাবে! ছিঃ! নিজের শরীরের উপর এখন ঘিন্না ধরে গেছে বিহারিনীর। এখন আর এই শরীর চায় না সে, কোনভাবেই চায় না। বাহারের রূপের কারণে সবাই তাকে দেবী বানায়, তাহলে সে কি? বাহারের দাসী! এতো কিছু থাকতে শেষে এই মেয়ের পায়ে জায়গা হবে তার!
শাড়ি পড়ানোর ছুতোয় বাহারের শরীরে বার বার হাত রাখছে বিহারিনী! তার আর এই মেয়ের শরীরের মাঝে খুঁত কোথায়। ঘাড়ের কাছে একটা তিল দেখে আশ্চর্য হলো বিহারিনী! চুলের আড়ালে থাকা এই তিল দেখলে কোন পুরুষের মাথা ঠিক থাকবে না। বার বার তারা চাইবে এই তিল ছুঁয়ে দেখতে। সবাই চাইবে বাহার তার হোক, তবে বিহারিনীর কি হবে? কেউ তাকে মন থেকে চায় না। কেন না।
বাহারের চুল গুলো বড় যত্ন করে বেঁধে দিল বিহারিনী! পায়ে আলতাও দিয়ে দিল। আলতা পরতে পেরে বাহারের যেন আর তর শয় না। পুরো বাড়ি জুড়ে তার ছোটাছুটি শুরু। শান্ত দৃষ্টিতে সেসব দেখে যাচ্ছে বিহারিনী! বাহার ছুটে এসে বিহারিনী হাত ধরে বলল, —“দিদি! আমায় কেমন লাগতাছে?
বিহারিনী হাসল। তার ভার হৃদয় যেন আর মানতে চাইছে না। ইচ্ছে করছে দরজা বন্ধ করে চেঁচিয়ে কাঁদতে। কেন বাহারের মতো রূপ পেলো না সে, কেন এভাবে বিয়ের সম্বন্ধ ভেঙে যাচ্ছে তার। কেউ ভালোবাসছে না কেন তাকে? এসবের ভাগিদার কে? কার জন্য হচ্ছে এসব? বাহার! এসব দোষ বাহারের! রাক্ষসী, অলক্ষ্মী , অভিশপ্ত এই মেয়ের দোষ !
কাজের মেয়েটা ছুটে এসে জানাল রান্না শেষ হয়ে গেছে। বিহারিনী বাহারের হাত ধরে ভাড়ার ঘরে দিকে গেল। বাহার উচ্ছাস যেন আর মানে না। এই বাড়ির খিচুড়ি এর আগেও খেয়েছিল সে। সেই স্বাদ এখনো তার মুখেই লেগে আছে। বাহার ফিরি পেতে বসে রইল। বিহারিনী থালায় খিচুড়ি বাড়ল। বাহার হাত পেতে কইলো, —“কি গো দিদি দাও, ক্ষিদায় যে আমার নাড়িভুঁড়ি সব বার হইয়া যাইবো এবার!
বিহারিনী হাসল। বলে উঠল, —“এগুলো ঠাকুরের ভোগ রে বাহার, মাকে একবার দিয়ে আসি, তারপর তোরে দিতাছি!
—“আরো অপেক্ষা করতে হইবো আমার?
—“আর কিসের অপেক্ষা তোর বাহার, দিনের পর দিন মমির পুতুল সেজে জনে জনে সামনের বসে থাকার কষ্ট বুঝিস তুই!
—“কেন বসে থাকো কেন?
—“ছেলেপক্ষ যে দেখতে আসে আমায়। জানিস, এ অবদি কতোজন এসে গেছে কিন্তু কারোর মনে ধরলাম না।
—“তাগো চোখ নাই দিদি , তুমি মন খারাপ কইরো না। দেইখো অনেক ভালা পোলা আসবো তোমার লইগা।
—“কি করে আসবো, এক রা’ক্ষসী যে তাদের নিজের বশে কইরা রাখছে!
—“কি কও কি? কে সে রা’ক্ষসী!
—“তুই ছাড়া আর কে হবে হতভাগী! এই রূপ নিয়ে কেন জন্মালি তুই! কেন সব পুরুষ রে নিজের বশে করতাছোস। আবার দেখো না, ভান টা কি ধরছে। যেনো কিছু বুঝে না!
বাহার উঠে দাঁড়াল। ভয়ে তার আত্না কাঁপছে। দিদিরে স্বাভাবিক লাগতাছে না। খুব অস্বাভাবিক আচরণ করতাছে সে। বাহার ঘর ছেড়ে বের হবার আগেই বিহারিনী ছুটে এসে তার চুলের মুঠি ধরে হিচড়ে ঘরের ভেতর আনলো। ব্যাথায় চিৎকার করছে বাহার। যন্ত্রণায় ছটফট করছে সে। তার দেহ থেকে প্রাণ টা যেন এবার বেরিয়েই যায়। বিহারিনীর পা দুটো জড়াইয়া ধইরা কইতাছে, —“দিদি গো, আমি মইরা যাইতাছি, ছাইড়া দাও আমায়। আর কখনো আমু না তোমাগো বাড়িতে আর কখনো না!
বাহারের এসব কান্না, ব্যাথা দেখে বিহারিনীর যেন আনন্দ লাগছে। তার মনের জ্বালা কমছে একটু একটু করে। সে মুঠি টা আলতো করে ছেড়ে দিয়ে আবারো শক্ত করে ঝাপিয়ে ধরল। ব্যাথায়, যন্ত্রণায় কাতর হয়ে পড়ল বাহার। ভয়ে তার ঠোঁট দুটো কাঁপছে। চিৎকারও করতে পারছে না। দিদির এমন বিভৎ’স রূপ দেখে যেন তার আত্না কেঁপে উঠলো। বিহারিনী ক্ষিপ্ত হলো আবারো, বাহারের চোখের অশ্রু তার রূপের সৌন্দর্য আরো দ্বিগুন বাড়িয়ে দিচ্ছে। ছুঁড়ে মারল তাকে। উনুনের আগু’নে জ্বলে যাওয়া লাকড়ি এনে পু’ড়িয়ে দিল বাহারের হাতখানা। নিজের সর্বস্ব দিয়ে “মা গো” বলে চিৎকার করেই চুপ হয়ে গেল বাহার। মেঝেতে হাত পা ছড়িয়ে জোরে জোরে হাসছে বিহারিনী! ঠাকুর ঘর থেকে ছুটে এসে মেয়ের এমন কান্ড দেখে হতভম্ব বিহারিনী মা! মেঝেতে লুটিয়ে পড়লেন তিনিও। পিতা এসে মেয়ের এমন ভয়ঙ্কর রূপ দেখে বাক শক্তি হারিয়ে ফেললেন। কাজের লোকেরা চুপচাপ উঁকি মেরে তামাশা দেখছে। সবাই বলছে বিহারিনী কে ভূতে ভর করেছে। তার হাবভাব ঠিক না। কেউ দেখছে না লুটিয়ে পড়ে থাকা দুঃখিনী বাহার কে। অচেতন অবস্থায় পড়ে আছে মেঝেতে। হাত টুকু তার জ্ব’লে পু’ড়ে যাচ্ছে। বিহারিনীর খু্শি যেন ধরে না। অন্তরের জ্বালা কমেছে তার। দিনের পর দিন যেই আগু’নে সে জ্বল’ছে আজ তাতে বাহারকেও জ্বলি’য়ে পুড়ি’য়ে ছাই করেছে। উঠনো দাঁড়িয়ে থাকা নুহাশ বাহারের খোঁজ করতে এসে তার চিৎকার শুনে চমকে উঠলো। ছুটে এসে বাহার কে নিষ্প্রাণ মেঝেতে পড়ে থাকতে দেখে চিৎকার করে বাহার কে ডেকে ছুটে গেল সে।
#চলবে….