#পথে_হলো_দেরি
#নুশরাত_জেরিন
#পর্বঃ২
,
,
গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে গিয়ে দরজা খোলে ইরা।
ভয়ে তার হাত পা অসাড় হয়ে আসে।
মনে মনে দোয়া দুরুদ পড়ে বুকে ফু দেয়।
শাম্মিকে দেখতে পায়না।হয়তো ইরাকে ডেকে আবার চলে গেছে সে।
ইরা ভীরু পায়ে ড্রয়িং রুমে আসে।
ড্রয়িংরুমে এক পুরুষ অবয়ব দেখে।
পেছন ঘুরে আছে সে,তাই মুখ দেখা যায়না।
কালো রংয়ের জ্যাকেট দেখা যাচ্ছে গায়ে।
ইরা এগোনোর শক্তি পায়না।
পা থরথর করে কাপে।
ভয় পায়,ভাবে হয়তো শৌখিন তাকে দেখলেই চিৎকার করে উঠবে।হয়তো এই অবস্থায়ই টেনে হিঁচড়ে বাড়ি থেকে বের করে দেবে।
ড্রয়িং রুমে সোফায় ইরার ফুপু রেহেনা বেগম বসে আছেন।
ইদানীং তার শরীরটা ভালো যাচ্ছে না।
শরীরে বাসা বেধেছে নানা রোগবালাই।শরীরের সাথে সাথে মনটাও তার ভালোনা।
একে তো ইরাকে নিয়ে চিন্তা। মেয়েটার জিবনে কি হলো তিনি বুঝতে পারেননা।
মনে হয় হয়তো শৌখিনের সাথে বিয়ে দিয়ে মেয়েটার দুঃখের জীবনে নতুন করে দুঃখ যোগ করেছেন তিনি।আবার শৌখিনকে নিয়ে চিন্তা।
ছেলেটাযে কি একরোখা জেদি হয়েছে।
যা বলবে তাই।
মাঝমাঝে ইমোশনাল ব্লাকমেইল করে দু’একটা কথা যদিও পালন করান রেহেনা বেগম তবুও তার একটু পরেই যা তাই।
তবুও তিনি চেষ্টা করে যাবেন।
ছেলেমেয়ে দুটোকে যদি এক করা যায়?
চেষ্টা করতে ক্ষতি কি?
পেছন ঘুরে ইরাকে গুটিসুটি মেরে দাড়িয়ে থাকতে দেখে রেহেনা বেগম বলে ওঠেন,
—কিরে ইরা,ঐখানে দাড়িয়ে আছিস কেনো?এদিকে আয়।
ফুপুর কথা শুনে ইরা চমকায়।হুট করে কথা বলায় ভয় পেয়েছে সে।
কয়েকটা শুকনো ঢোক গিলে ফুপুর কাছে এগিয়ে যায়।
ততক্ষণে শাম্মিও আসে।
দাড়িয়ে থাকা লোকটা ইরাকে দেখে পিছু ঘোরে।
মুচকি হেসে বলে,
—আরে ইরা,কেমন আছো?
ইরা বড়সড় নিশ্বাস ফেলে।বুকে হাত দিয়ে ধপ করে সোফার উপর বসে পরে।ভয় তার দুর হয় দ্রুত।
লোকটা শৌখিনের বন্ধু রিফাত।
বাল্যকালের বন্ধু।
মাঝেমাঝেই এ বাড়িতে আসে সে।
শৌখিন না থাকায় একটু কম আসা হয়।শৌখিন থাকলে আসা-যাওয়ার পরিমানটা বাড়ে।
রিফাতের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে ইরা বলে ওঠে,
—ওহ,এটা আপনি?
রিফাত অবাক নজরে তাকায়।ইরার পাশাপাশি সোফায় বসে।
বলে,
—তো কাকে ভেবেছিলে?
ইরা জবাব দেয়না।পাশ থেকে শাম্মি বলে ওঠে,
—ইরা হয়তো ভেবেছিলো শৌখিন ভাই।
রিফাত একপ্রকার লাফিয়ে ওঠে।
—কিহ?শৌখিন আসছে নাকি?কবে?কখন?কিভাবে?
আমাকে জানাওনি কেনো আন্টি?
কতোবছর দেখিনা বেটাকে?
দু,দুটো বছর।
রেহেনা বেগম হেসে ফেলেন।
রিফাতের মাথায় হাত বুলান।বলেন,
—পাগল ছেলে,এতো প্রশ্ন একসাথে করলে উত্তর কিভাবে দেবো?
হ্যা,আজ আসবে শৌখিন বুঝলি।
রিফাতের উচ্ছাস কমেনা।
বলে,
—সত্যি আন্টি? ও মাই গড।
তাহলে আমি কিন্তু আজ বাড়িতে যাবোনা।এখানেই থাকবো।
রেহেনা বেগম আবার হাসেন।
—থাকবি।তোকে নিষেধ কে করেছে?
—একমিনিট দাড়াও আমি সব বন্ধুদের কল করে জানাই ব্যাপারটা।
রিফাত হন্তদন্ত হয়ে বাড়ির বাইরে বেরোয়।
ফোন করে সব বন্ধুদের শৌখিনের বাড়ি ফেরার খবর দেয়।
ড্রয়িং রুমে বসেই সেসব কথা কানে আসে ইরার।
সে চুপিসারে রেহেনা ও শাম্মির দিকে তাকায়।
শৌখিন আসার কথায় তাদের মুখও খুশিখুশি দেখায়।
ইরা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।
তার সম্পর্কটা যদি স্বাভাবিক আর পাঁচটা সম্পর্কের মতো হতো তাহলে সেও নিশ্চয় খুশি হতো।
কিন্তু তা আর হলো কই।
তবু তো একপ্রকার ভালো আছে ইরা।
কিন্তু যদি মামার ঠিক করা ওই বয়স্ক লোকটার সাথে বিয়ে হতো?
লোকটার চেহারা হুট করে ভেসে উঠলো চোখের সামনে।
গাল ভরা পান চিবাতে চিবাতে কি লোলুপ দৃষ্টিতে তাকাচ্ছিলো লোকটা।
ভাবলেই গায়ে কাটা দেয় ইরার।
———–
ঘড়ির কাটা ১১টার ঘরে। চারিদিকে শুনশান নিরবতা। মাঝে মাঝে রেহেনা বেগমের দীর্ঘশ্বাসের শব্দ ভেসে আসছে।
ইরার মনে হচ্ছে রেহেনা বেগম কান্না আটকাতে চাচ্ছেন।তাই হয়তো এমন ঘনঘন নিশ্বাস ফেলছেন।
টেবিলে মাথা রেখে বসে আছেন রেহেনা বেগম।
মুখটা তার গম্ভীর।
শাম্মি এখানে নেই।সে এতোরাত জাগতে পারেনা।তাড়াতাড়ি ঘুমানো তার অভ্যাস।
সে নিজের রুমে চলে গেছে কিছুক্ষণ আগে।
ড্রয়িংরুমে ইরা আর রেহেনা বেগম বসে আছে।
বসে আছে বললে ভুল হবে।তারা অপেক্ষা করছে।
শৌখিনের ফেরার অপেক্ষা।
শৌখিন আজ আসবে বললেও দিন গড়িয়ে রাত হয়ে গেলো তারপরও আসেনি।
এমনকি ফোনও করেনি।
শাম্মি অনেকবার চেষ্টা করেছিলো কিন্তু ফোন সুইচড ওফ দেখাচ্ছিলো।
ইরার কষ্ট হচ্ছে।
রেহেনা বেগমের এমন করুন মুখ দেখে তার নিজেরই খারাপ লাগছে।
এটা তো ইরার ফুপু না,মা।
মায়ের স্নেহ ভালবাসা তো এই ফুপুই দিয়েছ তাকে।
সেই ফুপুকে এতোটা কষ্ট পেতে দেখে ইরারও কষ্ট লাগছে।
এতক্ষণ যাবত যে সে শৌখিন না ফেরায় খুশি হয়েছিলো সে এখন মনে প্রানে চাইছে শৌখিন ফিরুক।
নিজের মায়ের কাছে ফিরে আসুক সে।
দুটো বছর রেহেনা বেগম নিজের ছেলেটাকে দেখেননা।
একজন মায়ের কাছে কতোটা কষ্টকর এটা?
ইরার নিজের কাছে নিজেকে অপরাধী লাগে।মনে হয় হয়তো তার জন্য তার ফুপুর এতো কষ্ট।
গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে ফুপুর কাধে হাত রাখে ইরা।রেহেনা বেগম ঘার কাত করে তাকান।বলেন,
—ঘুম পাচ্ছে তোর?
যা না ঘুমা গিয়ে।আমি থাকবো এখানে।
ইরা চটপটে গলায় বলে,
—ঘুম কেনো পাবে?আমি কি শাম্মির মতো ঘুমকাতুরে?
রেহেনা বেগম মাথা নাড়েন।বলেন,
—সেকথা কখন বললাম?
কথা বলতে বলতে হাই তোলেন তিনি।
ইরা সামনে এসে দাড়ায়।
—দেখেছো? ঘুম আসলে কার পাচ্ছে দেখেছো?
রেহেনা বেগম মুচকি হাসেন।বলেন,
—রোজ ঘুমের ঔষধ খেতে হয় তো তাই একটু এমন হচ্ছে আমার।
–উহু,মোটেও না।তোমার ঘুম পাচ্ছে, খুব গভীর ঘুম পাচ্ছে।
—তুই বুঝি জানিস?
—হু জানিইতো।
একটু এগিয়ে এসে পাশে বসে ইরা।
সোফায় বসে ফুপুর কাধে মাথা রাখে।
আহ্লাদি স্বরে বলে,
—তুমি ঘরে গিয়ে ঘুমাওনা ফুপু।আমি আছিতো এখানে।
রেহেনা বেগম নিষেধ করতে চান।কিন্তু থেমে যান।কিছুক্ষণ চুপ থেকে চিন্তা করেন।
ইরা আর শৌখিনকে আলাদা কথা বলার সুযোগ দিতে চান।ভাবেন যদি এতে সম্পর্কটা ঠিক হয়।
—ঠিক আছে।আমি ঘরে গিয়ে বসি।
শৌখিন আসলে আমায় জানাস।
ইরা মাথা নাড়ে।
ফুপুকে ঘরে পাঠানোর জন্য এমন সাহসীকতার কাজটা করেছে সে।
ফুপু অসুস্থ, বয়স হয়েছে।এতো রাত জাগলে যদি আরও অসুস্থ হয়ে পরেন সেজন্যেই নিজে থাকতে চেয়েছে সে।
নয়তো শৌখিনের সামনে পরার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা ছিলো না তার।
বেশকিছু সময় চুপচাপ বসে থাকে ইরা।
অলস সময় পাড় করে।
দাত দিয়ে হাতের নখ কাটে।
মেঝেতে পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে খোঁচায়।
আবার ঘড়ির দিকে তাকায়।
তার নিজেরও কেমন ঘুমঘুম পায়।
সোফায় পা তুলে আধশোয়া হয়ে বসে।
মাথাটা কাত করে শোয়।
হঠাৎ কলিং বেলের আওয়াজে লাফিয়ে উঠে বসে।
হার্টবিট ড্রামের আকার ধারন করে।
এতো জোরে শব্দ হয় যেনো এক্ষুনি বুক চিঁড়ে বেরিয়ে আসবে।
বুকে হাত দিয়ে উঠে দাড়ায় ইরা।
শুকনো ঢোক গেলে।
যতই সাহস করে ফুপুকে পাঠিয়ে দিক না কেনো এখন ভয়ে শরীর অসাড় হয়ে আসে তার।
তবু মনে মনে সাহস সন্ঞ্চার করে।
ভাবে কি আর হবে?দরজা খুলে ইরাকে দেখলে শৌখিন নাহয় চিৎকার চেচামেচি ই করবে।আর খুব বেশি হলে বাড়ি থেকে বের করে দেবে।
কি আর হবে তাতে?
নিজের ভাবনায় নিজেই নিজেকে বকে ইরা।
কি আর হবে মানে?
বাড়ি থেকে বের করে দিলে সে যাবে কোথায়?
দরজার কাছে গিয়ে একটানে দরজার পাল্লা খুলে ইরা।
চোখমুখ খিঁচে দাড়িয়ে পরে মাথা নিচু করে।
বকা খাওয়ার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে।
,
,
চলবে…….