#পথে_হলো_দেরি
#নুশরাত_জেরিন
#পর্বঃ২০
,
,
ইরা আশেপাশে না তাকিয়েই হনহন করে হেটে রুমে আসে।
তার শরীর চলছেনা।চোখমুখে অন্ধকার নেমে এসেছে।
বুকটা জ্বলছে খুব।যাকে বিশ্বাস করেছিলো,বিশ্বাস করে নিজের সর্বস্ব তার হাতে তুলে দিয়েছিলো,অবশেষে সেই কিনা ঠকালো?এমন ভাবে?
ইরা খাটের উপর ধপ করে বসে পরলো।তার শরীর ভেঙে পরেছে।চলার মতো শক্তি পাচ্ছেনা।
কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে নিজেকে সামলে ওঠে ইরা।
ধীরপায়ে হেটে কাবার্ড থেকে জামা কাপড় বের করে।ওয়াশরুমে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে নেয়।
নিজেকে আয়নায় দেখে ভেঙে পরে খুব।
চোখ বেয়ে জলের স্রোত নামে।দুহাত দিয়ে মুখ ঢেকে হুহু করে কেঁদে ওঠে।
ভাবে,তার সাথেই কেনো এমনটা হয় সবসময়?সব কষ্ট কেনো ইরার জন্যেই বরাদ্দ থাকে?কেনো সুখের দেখা পেয়েও হারিয়ে ফেলে?তবে কি সত্যি সে সুখের দেখা পাবেনা?অধরাই থেকে যাবে?
তার মামি কি তবে সত্যি বলতো?তার কপালে সুখ নেই?সে কপালপোড়া?
দরজায় কড়া নারে কেউ।
ইরা দরজা খুলে দেখে রহিমা খালা।
বলে,
—ইরা মা তোমার ফুপু তোমায় ডাকে।
ইরা মাথা নাড়িয়ে বলে,
—আচ্ছা ঠিকআছে,তুমি যাও আমি যাচ্ছি।
রহিমা খালা চলে যেতেই ইরাও রুম থেকে বেরোয়।
ফুপুর রুমে গিয়ে দরজায় টোকা দেয়।
রেহেনা বেগম ইরাকে দেখে মুখে হাসি ফোটায়।তবে দেখে মনে হয় প্রানহীন হাসি।
সে বলে,
—আয় ইরা।আমার কাছে আয়।
ইরা গুটিসুটি পায়ে রেহেনা বেগমের কাছে গিয়ে দাড়ায়।
রেহেনা বেগম হাত টেনে পাশে বসান।
মাথায় হাত বুলান।
বলেন,
—চুল এতো অগোছালো করে রেখেছিস কেনো?যত্ন নিসনা একটুও?
তেলও নিসনা?
আয় আজ তোর মাথায় তেল লাগিয়ে দেই।
ইরা জবাব দেয়,
—আচ্ছা।
রেহেনা বেগম ড্রেসিং টেবিলের ওপর রাখা তেলের কৌটোর দিকে ইশারা করে বলেন,
—তেলের কৌটোটা এনে দে তো।
ইরা উঠে কৌটো এনে আবার বসে।রেহেনা বেগম যত্ন সহকারে তেল লাগায়।হাত দিয়ে বিলি কাটে।
ইরা চোখ বন্ধ করে।
তার মায়ের কথা মনে পরে খুব।মা ও তাকে এমন ভাবে যত্ন করতো।
ভাবনার মাঝে তার চোখ থেকে একফোটা জল গড়িয়ে পরে।রেহেনা বেগম সামনের আয়নায় তা স্পষ্ট দেখেন।
তিনি বলে ওঠেন,
—মায়ের কথা ভাবছিস ইরা?
ইরা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ে।
রেহেনা বেগম বলেন,
—,পাগলি মেয়ে,তাই বলে তুই কাঁদবি?
আমি কি নেই নাকি?
মা না হই মায়েরই তো মতোন?
মুখটা একটু গম্ভীর করে বলেন,
—তোকে একটা কথা জিজ্ঞেস করবো ইরা?
ইরা বলে,
—বলো?
—আমি যে তোর ভালো চাই এটা কি তুই বিশ্বাস করিস?
—কি যে বলোনা তুমি?অবিশ্বাস করার কি আছে?তাছাড়া তোমায় ছাড়া আর কাকে বিশ্বাস করবো বলোতো?
আর কে আছে আমার?
—তাহলে আমি যা বলবো তুই শুনবি?
—বলেই দেখোনা।
রেহেনা বেগম কিছুক্ষণ চুপ হয়ে থাকলেন।তার কন্ঠটা কেমন কাঁপছে।
পাশের ড্রয়ার থেকে কাগজটা বের করলেন কাপা হাতে।
ইরার সামনে ধরে বললেন,
—এই ডিভোর্স পেপারে সাইন করে দে।
ইরা চমকে উঠলো।ডিভোর্স পেপার?কার?তার আর শৌখিনের?
ইরা পৃথিবী থমকে দাড়ালো।
ভেতরে প্রলয়ংকরী ঝড় বয়ে চললো।
মনে হলো সে ভুল শুনেছে।মস্ত বড় ভুল।
সে বললো,
—কিহ?
—ডিভোর্স পেপার।
—তোমার ছেলে কি এ ব্যাপারে জানে?
রেহেনা বেগমের খারাপ লাগলো ইরার অবস্থা দেখে।একটা মেয়ের কাছে ডিভোর্স যে কি জিনিস তা তিনি বোঝেন।শৌখিন যতই বিয়েটা না মানুক ইরা তো মেনেছিলো।তার কাছে বিয়েটা তো ছেলেখেলা ছিলোনা।কিন্তু কি আর করার।দুজনেই যে বিয়েটার জন্য কষ্ট পাচ্ছে।
তাছাড়া শৌখিন তো একবার বলেছিলো,সে ডিভোর্স দিতে চায়।
যদিও ইদানীং কথাটা আর বলেনা সে।হয়তো রেহেনা বেগমের জন্য বলেনা।
তিনি বলেন,
—শৌখিনই তো বলেছিলো আমায়।যদিও আমি তখন ব্যাপারটা মেনে নিতে পারিনি।
কিন্তু এখন দেখলাম শুধু শুধু এই মিথ্যা বিয়েটা বয়ে বেরানোর কোন মানেই নেই।
ইরার মুখ থেকে আওয়াজ বের হলোনা কোনো।চোখ বেয়ে জলের বাধ নামতে চাইলো।ইরা অনেক কষ্টে আটকালো।
বহু কষ্টে ভেঙে ভেঙে বললো,
—সত্যি সে ডিভোর্সের কথা বলেছিলো ফুপু?
রেহেনা বেগম ইরার মাথায় হাত রাখলেন।বললেন,
—কষ্ট পাসনা ইরা।এটা নিছক একটা দুঃসপ্ন ভেবে ভুলে যা।আমি আবার নতুন করে তোর জিবন সাজিয়ে দেবো দেখিস।তোকে খুব ভালো জায়গায় বিয়ে দেবো।খুব সুখি হবি তুই।
ইরার কোন কথা কানে প্রবেশ করলো না।সে রোবটের মতো বললো,
—বলোনা ফুপু,সত্যিই তোমার ছেলে ডিভোর্সের কথা বলেছিলো।
রেহেনা বেগম মাথা ঝাকালেন।তার চোখেও জল।তিনি বুঝতে পারছেন ইরার কষ্ট হচ্ছে। তবে তিনিও যে নিরুপায়।
ইরা ফুপুর দিকে তাকিয়ে রোবটের মতো হাতে কলম তুলে নিলো।গটগট করে কাগজে নিজের নাম সই করে দিলো।
নিজের কষ্টটাকে নাহয় নিজের মাঝেই বেধে রাখবে সে।শৌখিন যে তাকে ভালোইবাসলো না।শুধু অভিনয় করলো।
ইরাকে বোকা বানালো।
সে আসলে মিতালিকেই ভালবাসে।নয়তো ডিভোর্সের কথা মাকে বলবে কেনো,?
তাছাড়া মিতালির সাথে আজ তো দেখলো ইরা শৌখিনকে।
দুজনেই হাসছিলো।
কি প্রানখোলা হাসি!
ইরা আর দাড়ালো না।এক দৌড়ে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালো।
💮💮
শৌখিন বাড়ি ফিরে খাবার খেয়ে রুমে ঢুকলো।পরক্ষনেই ইরার কথা মনে হলো তার।আজ সারাদিন সে ইরার দেখা পায়নি।
খাবার টেবিলেও দেখতে পায়নি।
সে নিজের রুম থেকে বেরিয়ে ইরার রুমের দিকে পা বাড়ালো।
পথিমধ্যে রেহেনা বেগমকে আসতে দেখে সে দাড়িয়ে পরলো।
রেহেনা বেগম শৌখিনের কাছেই যাচ্ছিলেন।
শৌখিনকে দেখে তিনি কাছে এগিয়ে আসেন।
বলেন,
—এতো রাতে কোথায় যাচ্ছিস শৌখিন?
শৌখিন মাথা নিচু করে।সে এতো রাতে ইরার ঘরে যাচ্ছিলো সে কথা মাকে কেমন করে বলবে?কথা ঘুরাতে সে বলে,
—তুমি কোথায় যাচ্ছিলে মা?
—তোর ঘরেই আসছিলাম।
—আমার ঘরে?এতো রাতে?
—একটা জরুরি কাজের জন্য।
শৌখিন মুখটা সিরিয়াস করে।বলে,
—জরুরি কাজ?কেনো?কি হয়েছে?
কি এমন জরুরি কাজ?
রেহেনা বেগম বলেন,
—আরে এতো উত্তেজিত হচ্ছিস কেনো?
তোর এতোদিনের ইচ্ছেটা পুরন করছি আজ।
—আমার ইচ্ছে?
রেহেনা বেগম হাতে রাখা কাগজটা সামনে বাড়িয়ে ধরেন।
বলেন,
—তুই তো এতোকাল ডিভোর্স ডিভোর্স বলে মাথা নষ্ট করে দিচ্ছিলি।আমিও ভেবে দেখলাম তোর কথাই ঠিক।
বিয়েটা থেকে বেরিয়ে আসলেই তোদের জন্য ভালো হবে।তুই ও কষ্ট পাচ্ছিস,ইরাও কষ্ট পাচ্ছে।
কি দরকার সবাইকে কষ্টে রাখার।
শৌখিন হতভম্ব হয়ে কাগজটা হাতে তুলে নেয়।তার হাত কাপে অনবরত।
কাগজে ইরার সিগনেচার দেখে বিস্ময়ে চোখ বড় হয় শৌখিনের।
সে বলে,
—এখানে কে সই করেছে মা?
—ইরা!
শৌখিনের হতভম্ব চোখ মুহূর্তেই রাগে রক্ত বর্ণ ধারণ করে।
রেহেনা বেগমকে পাশ কাটিয়ে সে হনহন করে ইরার রুমের দিকে এগোয়।
রুমের দরজা ভেতর থেকে লক করা।
শৌখিন জোরে জোরে দরজা ধাক্কায়।
বলে,
—ইরা?দরজা খোল ইরা।
আমি বলছি দরজা খোল!
ইরা দরজা খোলে না।শৌখিন আরও রেগে যায়।
সে এবার রীতিমতো দরজায় লাথি দেওয়া শুরু করে।রাগে তার মাথা কাজ করেনা।
ভেতরটা তার জ্বল জ্বল করে।
ইরা ডিভোর্স পেপারে সই করে দিলো?এতো সহজে?
কেনো?কেনো সে শৌখিনকে একবারও জানালো না?
শৌখিন আবার চেচালো,
—দরজা খুলবি নাকি আমি দরজা ভাঙবো?
ইরা দরজা খুলে দাঁড়ালো। তার চোখমুখের অবস্থা ভালোনা।দেখেই বোঝা যাচ্ছে কেঁদেছে খুব!
ফুলে গেছে চোখ।কেমন এলোমেলো দেখাচ্ছে তাকে।মুখটা কি শুকনো!
শৌখিনের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো।
এতক্ষণের জমানো রাগ তার ফুশ করে গায়েব হয়ে গেলো।
সে এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরলো ইরাকে।
গভীরভাবে কপালে চুমু খেয়ে নিলো।
আদুরে গলায় বললো,
—কি হয়েছে ইরা?এমন কেনো করলি বলতো?
আমার কি যে রাগ হয়েছিলো জানিস?
ইরা দুহাত দিয়ে ছিটকে সরে এলো শৌখিনের বাহু থেকে।
ঘৃণার দৃষ্টি ফেললো শৌখিনের উপর।ভাবলো,লোকটা এখনো অভিনয় করছে?এখনো?
নিজেই তো ডিভোর্স পেপার তৈরি করিয়েছে।রাস্তা ঘাটে মিতালির সাথে প্রেম করে বেড়াচ্ছে। তারপরও অভিনয় করছে।
ইরা বললো,
—বেড়িয়ে যান এই রুম থেকে।
শৌখিন চমকে উঠলো খুব।সে ইরার কাছ থেকে এমন প্রতিক্রিয়া আশা করেনি।সে আবার এগিয়ে ইরাকে ছুতে চাইলে ইরা সরে দাড়ালো।
বললো,
—খবরদার ছোঁবেন না আমায়।
শৌখিন বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে বললো,
—কেনো?কারনটা কি?
—কারন আমি কোন ঠকবাজ, বিশ্বাসঘাতকের ছোয়া চাইনা।
—আমি ঠকবাজ?বিশ্বাসঘাতক?
ইরা জবাব দিলোনা।কেনো যেনো তার কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।শুধু কান্না পাচ্ছে। অথচ এতক্ষণ যাবত একনাগাড়ে সে কেঁদেছে। দরজা আটকে হাউমাউ করে কেঁদেছে।
শৌখিন বললো,
—কি করেছি আমি?
—জানেন না?
শৌখিন রেগে গেলো খুব।ইরা কেনো এমন করছে তার মাথায় এলোনা।একে তো ডিভোর্স পেপারে সই করে বসে আছে।তারউপর এমন ব্যবহার?কেনো?
কারনটা কি?
সে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
—কথা প্যাচাবি না একদম।যা বলার সরাসরি বল?
—আমি কোন চরিত্রহীনের সাথে কথা বলতে চাইছিনা।রুচিতে বাধছে আমার!
শৌখিন এগিয়ে ইরার দুকাধ আকড়ে ধরলো।রাগে তার মাথা ফেটে যাচ্ছে। চোখ দিয়ে যেনো আগুন বের হচ্ছে।
বললো,
—আমি চরিত্রহীন?আমার সাথে কথা বলতে তোর রুচিতে বাঁধে?
তাহলে কার সাথে কথা বলতে ভালো লাগে বল?রিফাতের সাথে?
ইরা চেঁচিয়ে বললো,
—হ্যাঁ,হ্যাঁ।তার সাথেই কথা বলতে আমর ভালো লাগে।
শৌখিন মাথা দোলালো।তার মানে এই ব্যাপার!ইরা রিফাতের জন্য শৌখিনের সাথে এমন ব্যবহার করছে?তবে কি সে রিফাতকে ভালবাসে? তাহলে শৌখিনের সাথে কাটানো রাত?সেগুলো?
সেগুলো কি ছিলো?
শৌখিন জবাব পেলোনা।
সে পাশের টেবিলে লাথি দিয়ে গটগট করো হেটে রুম থেকে বেরিয়ে পরলো।
,
,
চলবে……