#পরিত্রাণ
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ১২
তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা রুমু। খবরটা শোনার পরপর বাড়িতে এলাহি কান্ড! বন্ধুবান্ধব আত্মীয়স্বজন সবাইকে দাওয়ার করে খাওয়ালেন ইউসুফ চৌধুরী। রোজ অফিস থেকে টেলিফোন করে রুমুর খোঁজ খবর নেন। অনিক অবশ্য খবরটা শুনে প্রথমে লজ্জায় লাল হয়ে গিয়েছিলো। বন্ধুবান্ধব মহলে এই নিয়ে বেশ খোঁচা শুনতে হয়েছে তাকে। দিনরাতে চব্বিশঘন্টা ‘আই হেইট গার্লস’, ‘আই হেইট গার্লস’ জপ করে অবশেষে এই পরিণতি! লজ্জায় ব্যপার না?
রুমু যখন লাজুক লাজুক মুখে তাকে খবরটা দিলো অনিক তার চেয়ে দ্বিগুন লজ্জা পাওয়ার ভান করে চোখ বড় বড় করে বললো,’এ কি করলে রুমু? আমার মানইজ্জত এভাবে লুটে নিলে?’ জবাবে রুমু ঠাস করে ওর পিঠে একটা কিল বসিয়ে দিয়ে বললো,’আমি একা করেছি?’
মার খেয়ে অনিক হাসলো। মাঝেমাঝে রুমুর মুখ থেকে এইধরনের কথাবার্তা শুনতে ভালোই লাগে তাঁর! তার জন্য খানিকটা উস্কে দিতে হয় রুমুকে! তারপরই রুমু আত্মবিস্মৃত হয়ে গড়গড় করে অনিকের ইজ্জতের তুলোধোনা শুরু করে দেয়! এমন সব কথাবার্তা বলে যা স্মরণ করে পরবর্তীতে সে নিজেই লজ্জা পায়! অনিক অবাক হওয়ার ভান করে বললো,’তবে কি করে হলো?’
তার দুষ্টুমিতে রুমুও অবাক হওয়ার ভান করে বললো,’ওমা তুমি জানো না? আকাশ থেকে উড়ে এসেছে সে!’ অতঃপর দুজনেই একসঙ্গে হেসে ফেললো। হাসিঠাট্টার ছলেই আরেকদফা ভালোবাসাবাসি হলো দুজনার!
★
তারপর মাসদুয়েক পরের কথা। একদিন সকাল বেলা , অফিসের জন্য রেডি হচ্ছিলো অনিক। রুমু মৌনমুখে খাটের ওপর বসে আছে। গতকাল রাতে ইউসুফ চৌধুরীকে নিয়ে অনিকের সাথে খানিকটা মনোমালিন্য হয়েছে তার। সেই থেকে এখন পর্যন্ত কথাবার্তা বন্ধ! অনিককে রেডি হতে দেখে আড়চোখে তার দিকে তাকিয়ে তাঁকে শুনিয়ে শুনিয়েই পেটে হাত রেখে বললো,’শোন বাবু, যে যাই বলুক না কেন, তুই কিন্তু একদম তোর বাপের মত হবি, বুঝলি। তোর বাপ তার বাপকে নাম ধরে ডাকে, তুই তোর চৌদ্দগুষ্ঠিকে নাম ধরে ডাকবি। তোর বাপকে ডাকবি অনিক পাগলা চৌধুরী! দাদুকে ডাকবি ইউসুফ দাদু! নানুভাইকে ডাকবি এ.ইকবাল নানু! আর মাকে ডাকবি রুমু আম্মু!..ঠিক আছে?’
অনিক এতক্ষন রুমুকে দেখেও না দেখার ভান করে বসে ছিলো। কিন্তু রুমুর বলার এক্সপ্রেশন দেখে হেসে ফেললো সে! বললো,’বাহ! এই তোমার রাগের নমুনা?’
-‘বাহ! তো বটেই। রাগের দেখেছো কি? ছেলেকে যদি আমি তোমার নাম ধরে ডাকতে না শিখিয়েছি তবে আমার নামও রুমু না। তখন আমিও দেখবো ছেলের মুখে বাবার বদলে ‘অনিক চৌধুরী’ ডাক শুনতে কেমন লাগে তোমার?’
রুমুর রাগের পাত্তা না দিয়ে অনিক দুষ্টু হেসে চোখ মেরে বললো,’কেন অনিক চৌধুরী ডাকবে কেন? আমি তো ওর আসল বাবা! তোমার কি কোন সন্দেহ আছে নাকি?’
রুমু থতমত খেয়ে গেলো। চোখমুখ লাল করে বললো,’ছোটলোকদের কথাবার্তা এমনই হয়!’
-‘বড়লোকদের কেমন হয়? তোমার মত?’
-‘সেটা তোমার না জানলেও চলবে। তুমি নিজের কাজে যাও! তোমার সাথে কথা বলছি না আমি।’
রুমুর ঝগড়ার মুডে আছে। প্রেগনেন্সির পর থেকেই হুটহাট মেজাজ গরম করে ফেলে। হাসি তামাসার ভেতরেও রেগে যায়! অনিক আর কথা বাড়ালো না।হাসিমুখে অফিসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেলো সে।
★
দুপুরবেলা অফিসে বসে কাজ করছিলো অনিক। প্রচুর কাজ জমে আছে। ইন্টারকম টেলিফোন বেজে উঠতেই ব্যস্তভাবে রিসিভার তুলে বললো,’ইয়েস, অনিক চৌধুরী স্পিকিং!’
তরুণ রিসিপশনিস্ট সালাম দিয়ে বিনয়ী কন্ঠে বললো,’আপনার সাথে একজন গেস্ট দেখা করতে চাইছেন স্যার। ইমার্জেন্সী বলছেন।’
-‘ঠিক আছে, পাঠিয়ে দাও।’
মিনিটখানেক বাদে দরজায় মৃদু করাঘাত পড়লো। অনিক ফাইল থেকে চোখ না তুলেই সাড়া দিলো ,’ইয়েস কাম ইন!’
গুটিগুটি পায়ে ভেতরে ঢুকলো আরিয়া। তার চোখেমুখে ভয়! ফাইল থেকে চোখ তুলে অনিককে অবাক হয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে অস্বস্তিতে কুঁকড়ে গেলো সে। যেখানে ছিলো সেখানেই দাঁড়িয়ে গেলো। অনিক গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করলো,’তুমি এখানে?’
অনিকের কাছে নতুন করে আরেকখানা চিঠি লিখেছেন অনিলা চৌধুরী। ভার্সিটি থেকে ফেরার পথে সেই চিঠিখানা অনিকের হাতে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব আরিয়ার ওপরেই পড়লো। প্রথমে রাজী হতে চায় নি সে। অনিককে তাঁর ভীষণ ভয় করে! কিন্তু অনিলা চৌধুরীর জোরাজুরিতে বাধ্য হলো। ক্লাস ছুটির পর শুধুমাত্র চিঠিটা পৌঁছে দিতেই কড়ারোদে হেটে হেটে এতদূর এসেছে সে। অনিকের প্রশ্নের জবাবে কুণ্ঠিত গলায় বললো,’মা আপনার কাছে একটা চিঠি দিয়েছেন।’
অনিক তাকে বেরিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে বললো,’দরকার নেই এসব চিঠিপত্রের, তুমি চলে যাও।’
আরিয়া গেলো না। এতদূর পথ এসেছে শুধুমাত্র চিঠিটা দেওয়ার জন্য। সেটা যদি না দেওয়া হয় তবে পরিশ্রমটাই বৃথা যাবে। তারওপর অনিলা চৌধুরী বারবার করে তাঁকে বলে দিয়েছেন, অনিক যতই বারণ করুক না কেন চিঠিটা যেন অনিকের হাতে পৌঁছে দেয় আরিয়া। তাই চিঠি হাতে নিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো সে। গরমে ঘেমে বড্ড পিপাসা পেয়েছে তাঁর। কিন্তু সাহস করে বলতে পারছে না। পাছে অনিক কিছু মনে করে? ধমক দিয়ে বসে?
তাকে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অনিক বিরক্ত হয়ে বললো,’কি হলো দাঁড়িয়ে আছো কেন? তোমাকে যেতে বলেছি না?’
‘একটু পানি খাবো!’, ভয়ে ভয়ে পানি চেয়েই বসলো আরিয়া।
অনিক থমকে গেলো। নিরবে কিছুক্ষন চেয়ে রইলো আরিয়ার শুকনো মুখখানা দিকে। কড়া রোদে চোখমুখ লাল হয়ে গেছে! কপালের কাছে বিন্দুবিন্দু ঘাম! হাত বাড়িয়ে টেবিলের ওপর রাখা পানির গ্লাসটা আরিয়ার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,’বসো।’
আরিয়া বসলো না। ইতস্তত করে পানির গ্লাসটা হাতে নিয়ে বললো,’না। ঠিক আছে।’ জবাবে অনিক তাঁকে পুনরায় বসার ইঙ্গিত করলো। এবার চুপচাপ বসে পড়লো আরিয়া। বলা যায় না কখনো আবার মেজাজ গরম করে বসে এই অ্যারোগেন্ট লোক! ঢকঢক করে পুরো পানিটা খেলো সে। খাওয়া শেষে কিছুক্ষণ ইতস্তত করে মৌনমুখে বললো,’মা বলেছিলো, একবার অন্তত চিঠিটা পড়ে দেখার জন্য।’
অনিক তার কথার জবাবে বললো,’পানি খাওয়া হয়ে গেছে? এবার তুমি আসতে পারো।’
-‘চিঠিটা?’
-‘তোমাকে আমি কি বলেছি, শুনতে পাও নি? যেতে বলেছি তোমাকে! আমি কোন চিঠিপত্র পড়বো না! যাও বেরোও।’
ধমক খেয়ে উঠে দাঁড়ালো আরিয়া। বেরিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো সে। কিন্তু যাওয়ার আগে একটা সাহসের কাজ করে গেলো সে। অনিকের টেবিলের ওপর চিঠিটা রেখে দ্রুত বেরিয়ে গেলো। ভয়ে আর পিছন ফিরে চাইলো না। অনিক অগ্নিদৃষ্টিতে কিছুক্ষন তার যাওয়ার দিকে চেয়ে থেকে অবশেষে দলামোচড়া করে চিঠিটা ঝুঁড়িতে ফেলে দিলো।
★
আরিয়া চলে যাওয়ার পর, পুনরায় কাজে মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করলো অনিক। কিন্তু কিছুতেই কনসেন্ট্রেট করতে পারলো না। চিঠিটার ভেতর কি এমন লিখা আছে তা জানার জন্য ভেতরে ভেতরে কৌতূহল অনুভব করলো। শেষমেশ ঝুড়ি থেকে চিঠিটা তুলে নিয়ে পড়তে শুরু করলো সে,
বাবা অনিক,
আশা করি ভালোই আছো। আমি জানি তুমি আমার ওপর রাগ করে আছো। রাগ করাটাই হয়ত স্বাভাবিক। হয়তো ভাবছো নিশ্চয়ই আবার কোন স্বার্থ নিয়ে তোমার কাছে চিঠি লিখেছি। কিন্তু না, আজকে আমি নিজের কোন স্বার্থের নিয়ে নয়, তোমার জন্য চিঠিটা লিখেছি বাবা। অতীতে আমার কারণে তোমার মনে যেই ভুলধারণার সৃষ্টি হয়েছিলো সেগুলো ভেঙ্গে দেওয়ার জন্য লিখেছি। আমি জানি, এতকাল যাবত তুমি তোমার পিতৃপরিচয় নিয়ে আত্মগ্লানিতে ভুগে এসেছো। হয়ত এখনো ভুগছো। তাই নিরুপায় হয়ে চিঠিটা লিখতে হলো। জানি না, খবরটা শুনলে তুমি খুশি হবে নাকি দুঃখ পাবে কিন্তু তবুও বলছি, তোমাকে একটা কথা জানানো প্রয়োজন মনে হলো, তোমার আসল পিতা ইউসুফ চৌধুরীই। হ্যাঁ তিনিই তোমার বাবা। অতীতে তাঁর প্রতি রাগ থেকে ভুলবশত তোমার ওপর আমি অনেক অবিচার করে ফেলেছি বাবা ! তারজন্য আমি লজ্জিত!
এটুকু পড়েই থামলো অনিক। তার বুকের ভেতর তীব্র মাত্রার ভূমিকম্প শুরু হয়েছে। হাতপা কাঁপছে! মাথার ওপর ফ্যান চলা সত্ত্বেও দরদর করে ঘামতে শুরু করলো সে! অবিশ্বাস্য, বিস্ফোরিত নয়নে হাতের চিঠিখানার দিকে চেয়ে রইলো। ইউসুফ চৌধুরী তার বাবা!…তাঁর বাবা! নিমিষেই চোখের পানি টুপ করে গড়িয়ে পড়লো চিঠির ওপর! কিছুক্ষন সময় নিয়ে নিজেকে সামলে নেওয়ার চেষ্টা করলো সে। ধীরে ধীরে চিঠির পরের অংশটুকু পড়লো। তেমন কিছু নেই। অনিলা চৌধুরী তাঁর কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চেয়েছেন। আর আরিয়ার দায়িত্ব নেওয়ার জন্য বারবার করে অনুরোধ করেছেন।
চিঠিটা হাতে নিয়ে উদ্ভ্রান্তের মত বসে রইলো অনিক। সে যেন নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। নিজের ওপর রাগ লাগছে! ইউসুফ চৌধুরীর অসহায় আকুতিগুলোর কথা মনে পড়তেই দুহাতে মুখ ঢেকে কান্না ঠেকালো সে।
চোখ মুছে রিসিভারটা তুলে বাসার নাম্বারে ডায়াল করলো। রুমু ইউসুফ চৌধুরীর ঘর গোছাচ্ছিলো, টেলিফোন রিং বাজতেই দৌড়ে এসে রিসিভ করলো। সকালে ঝগড়া করার পর থেকে ভেতরে ভেতরে অনিকের ফোনের অপেক্ষায় ছিলো সে। হাসিমুখে হ্যালো বলতে না বলতেই অনিক উচ্ছ্বাসিত কন্ঠে বললো,’হ্যালো রুমু, বাবা কি বাসায় আছে?’
রুমু রিসিভার কান থেকে নামিয়ে চেক করে দেখলো ঠিক আছে কি না। অনিকের হঠাৎ মতিভ্রম! জবাবে খানিকটা চেঁচিয়ে উঠে বললো,’কে?’
অনিক হাসলো। বললো,’বাবা!’
-‘কোন বাবা?’
-‘ঠাট্টা করো না প্লিজ। তাড়াতাড়ি বলো, বাবা কি বাসায় আছেন?’
-‘না।’
-‘কখন ফিরবেন?’
-‘সন্ধ্যায়!’
-‘ঠিক আছে। আমি রাখছি তাহলে।’
অনিক ফোন রাখার আগেই রুমু তাড়াহুড়া করে বললো,’এই শোনো, শোনো!’ অনিক জানে রুমু কি জিজ্ঞেস করবে। তবুও হাসিমুখে বললো,’কি?’
-‘তোমার কি হয়েছে? খুব খুশি খুশি লাগছে যেন?’
অনিক শব্দ করে হাসলো। বললো,’বউয়ের আবদার পূরন করে দিলাম। তোমার না খুব শখ ছিলো আমি ইউসুফ চৌধুরীকে বাবা বলে ডাকি? তাই তোমার আবদার মিটিয়ে দিলাম।’
-‘মজা করো না তো !’
-‘সত্যি বলছি। আমার বউ কি ফেলনা নাকি? সে চাইবে আর আমি করবো না তা কখনো হয়?’
-‘ঢং! সত্যি করে বলো কি হয়েছে তোমার? এত খুশি কেন তুমি?’, অধৈর্য শোনালো রুমুর কন্ঠস্বর!
অনিক ঠাট্টার সুরে বললো, ‘আবার বিয়ে করেছি তাই।’
-‘এবার কিন্তু টেলিফোন আছাড় দিয়ে ভেঙ্গে ফেলবো!’
রুমুর সত্যিই রেগে যাচ্ছে বুঝতে পেরে অনিক মুচকি হেসে একে একে অনিলা চৌধুরীর চিঠির কথা সব খুলে বললো তাকে। সব শুনে রুমু রাগত স্বরে বললো,’ও এইজন্যই আজকে হঠাৎ মিষ্টি মিষ্টি কথা বেরোচ্ছে। এতদিন যে আমি আর বাবা মিলে জান দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করেছি তখন তো আমাদের কথা বিশ্বাস করো নি, এখন একটা চিঠিই তোমার কাছে সব হয়ে গেলো?’
এইমুহূর্তে রুমুরঝাড়ি শোনার একদম ইচ্ছে নেই অনিকের। অনুতপ্ত কন্ঠে বললো,’ভুল হয়ে গেছে রুমু। অনেক বড় ভুল হয়ে গেছে। আই অ্যাম এক্সট্রিমলি সরি!’
যদিও রুমুর রাগ ঠেকাতে অনিক তাড়াতাড়ি করে সরি বলছে কিন্তু বাস্তবিক অর্থেই সে অনুভব করছিলো ইউসুফ চৌধুরীর প্রতি অনেক বেশি অবিচার করেছে সে। অনিকের বোকামির কারণে বিনাদোষে এতগুলো বছর বাবা ডাক থেকে বঞ্চিত ছিলেন তিনি। চোখে পানি চলে এলো তাঁর। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,’রাখছি আমি!’
★
সন্ধ্যার দিকে ইউসুফ চৌধুরীর নিজের ঘরে বসে রুমুর সাথে গল্প করছিলেন। রুমুর প্রেগন্যান্সির পর থেকে বাড়িতে আগের তুলনায় বেশি সময় দিচ্ছেন তিনি। সুযোগ পেলেই রুমুর সাথে নানারকম গল্পে মেতে উঠছেন। এতে করে তাঁরও মন ভালো হয়ে যায়, রুমুও মজা পায়। আজকের গল্পে বিষয়বস্তু অনিকের ছোটবেলার কাহিনী। গল্প শুনতে শুনতে রুমু খিলখিল করে হাসছিলো। অনিক অফিস থেকে বাসায় এসেই সোজা ইউসুফ চৌধুরীর ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালো। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে পর্দার আড়াল থেকেই নক করলো সে,’আসবো?’
ঘাড় ঘুরিয়ে দরজার দিকে চাইলেন ইউসুফ সাহেব। অনিকের গলা শুনে কিঞ্চিৎ অবাক হয়ে রুমুর দিকে তাকালেন। যেন বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। রুমু হাসলো। এই হাসির মানে,’আপনি একদম ঠিক শুনেছেন। আপনার ছেলে সত্যিই এসেছে বাবা!
ইউসুফ চৌধুরীর কাছ থেকে সাড়া না পেয়ে অনিক আবারো ইতস্তত করে বললো,’আসবো বাবা?’
ইউসুফ চৌধুরী পূর্বের তুলনায় দ্বিগুণ চমকে উঠলেন। অনিক তাঁকে বাবা ডেকেছেন! তিনি ঠিক শুনেছেম তো? চোখবড়বড় করে পুনরায় রুমুর দিকে চাইলেন। রুমু এবারেও নিরব রইলো। আজকে পিতাপুত্রের দিন। সে শুধু দেখবে!
অত্যাধিক খুশিতে কেঁদে ফেললেন ইউসুফ চৌধুরী। আনন্দে দিশেহারা হয়ে বললেন,’আয় বাবা!’
পর্দা সরিয়ে ঘরের ভেতরে ঢুকলো অনিক। রুমু মোড়ার ওপর চুপচাপ বসে আছে। তাকে দেখে কিঞ্চিৎ লজ্জা পেলো অনিক। রুমু জানে ইউসুফ চৌধুরীর কাছে ক্ষমা চাইতে এসেছে অনিক। বউয়ের সামনে নিশ্চয়ই লজ্জা করবে! কিন্তু রুমু তো নড়বে না! একদম নড়বে না! এতদিন পর অনিক চৌধুরীকে বাগে পেয়েছে সে। আজকে সব ঝাল মিটিয়ে তবে ছাড়বে। রুমুর ভাবগতি দেখে অনিক বুঝে গেলো সে উঠবে না। ইউসুফ চৌধুরীর দিকে চেয়ে নম্র গলায় বললো,’আপনার সাথে একটু কথা ছিলো।’
ইউসুফ চৌধুরীর বিগলিত পিতৃহৃদয় তখন ছেলের মুখ থেকে পুনরায় বাবা ডাক শোনা আকাঙ্ক্ষায় ব্যাকুল! সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিলেন তিনি,’এখানে বলতে কি অসুবিধে হবে?’
অনিক রুমুর দিকে আড়চোখে চেয়ে বললো,’জি। ওকে একটু বাইরে যেতে বলুন! তুমি একটু বাইরে যাও রুমু’
ইউসুফ চৌধুরী মুখ খোলার আগেই রুমুর জবাব শোনা গেলো,’না! আমি বাইরে যাবো না! আমি বাবার সঙ্গেই থাকবো। যা বলার আমার সামনেই বলতে হবে, তাই না বাবা?’ সমর্থনের আশায় ইউসুফ চৌধুরীর মুখের দিকে চাইলো সে।
ইউসুফ চৌধুরী বিপাকে পড়ে গেলেন। একদিকে তাঁর ছেলে, সাতরাজার ধন! এতবছর তাঁকে কাছে পেয়েছেন! অন্যদিকে অতি আদরের বউমা। নিরুপায় হয়ে রুমুর দিকে চেয়ে অনুরোধের সুরে বললেন,’মা আমার! একটু?…একটু বাইরে যাও মা।’ হাতের আঙুল দিয়ে সময় ইঙ্গিতে করে দেখালেন তিনি। রুমুর খুব হাসি পাচ্ছে। অনিক তার ওপর বিরক্ত!
নিজের প্রতিজ্ঞা ভুলে গেলো রুমু। কথা ছিলো সে শুধু দেখবে কিন্তু এখন দেখার চাইতে বলার প্রতি আগ্রহ বেড়ে গেলো তাঁর। ইউসুফ চৌধুরীর কথার জবাবে গম্ভীর গলায় বললো,’ঠিক আছে, আমি বেরিয়ে যাচ্ছি। তবে আপনি কিন্তু ভুলেও আপনার ছেলেকে মাফ করবেন না বাবা। আমি জানি ও আপনার কাছে মাফ চাইতে এসেছে। আপনি কিন্তু একদম মাফ করবেন না।’
ইউসুফ চৌধুরী অবাক হয়ে অনিকের দিকে চাইলেন। অনিক মাফ চাইতে এসেছে? আজকে হঠাৎ তার ঘরে অনিকের আগমন দেখে তিনি বুঝে গিয়েছিলেন কিছু একটা হয়েছে। কিন্তু অনিকের মুখ থেকে বাবা ডাক শুনে এতটাই উচ্ছ্বাসিত হয়ে গিয়েছিলেন যে জিজ্ঞেস করতেই ভুলে গেলেন কি হয়েছে? কিন্তু অনিক মাফ চাইবে কিসের জন্য? সে কি তার ভুল বুঝতে পেরেছে?
অনিক মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। তাঁর চোখেমুখে স্পষ্টত অনুতাপ! পিতার মুখের দিকে তাকানোর সাহস নেই। এই মানুষটার সীমাহীন ভালোবাসা, স্নেহ মমতা তাকে অপরাধবোধ, আত্মগ্লানি মতে ডুবিয়ে মারছে। ইউসুফ চৌধুরী এবার রুমুর দিকে চাইলেন! রুমু নিশ্চয়ই জানে অনিক কি কারণে মাফ চাইতে এসেছে? রুমু ইশারায় অনিককে জিজ্ঞেস করতে বললো। ইউসুফ চৌধুরী সস্নেহে ছেলের মুখপানে চেয়ে বললেন,’কি হয়েছে বাবা?’
কিন্তু জবাবটা রুমুই দিলো। বললো,’কি আবার হবে। মায়ের চিঠি পেয়ে এতদিন পর বিশ্বাস হয়েছে আপনি ওর বাবা। তাই এখন কষ্ট লাগছে। দেখছেন না চোখের পানি কেমন টলমল করছে? কিন্তু এখন কষ্ট পেয়ে কি লাভ? এতদিন তো বুঝেনি। বুঝেছে?’
ইউসুফ চৌধুরী ছলছল চোখে ছেলের দিকে চেয়ে রইলেন। বললেন,’রুমু কি বলছে বাবা? তোমার মায়ের চিঠিই কি তবে আসল? সত্যিই আমার ভালোবাসার কোন মূল্য নেই?’
অনিক চমকে উঠলো! সত্যিইতো বলেছেন ইউসুফ চৌধুরী। কোনরকম প্রতিউত্তর না করে রুমুর সামনেই নিজের সমস্ত ইগো, আত্মঅভিমান, দ্বিধা, আড়ষ্টতা ভুলে বাবার পায়ের কাছে বসে পড়লো সে। অপরাধির মত সমস্ত অভিযোগ মাথায় তুলে নিয়ে বললো,’ভুল হয়ে গেছে বাবা। অনেক বড় ভুল। আপনি আমাকে শাস্তি দিন।’
রুমু হাঁ করে অনিকের দিকে চেয়ে রইলো। ভদ্রমাতালটার এই কি রূপ! সে ভাবতেও পারে নি অনিক হঠাৎ এমন কান্ড করে বসবে। এভাবে হঠাৎ করে কারো পা ছুঁয়ে ফেলা অনিকের জন্য সহজ কথা নয়! বোঝাই যাচ্ছে কতটা আত্মগ্লানিতে ভুগছে সে! পিতাপুত্রের গাঢ়গম্ভীর পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক করার জন্য কপট রাগের ভান করে বললো,’বসে থাকুক বাবা। আপনার পা ধরে বসে থাকুক। আপনি কিন্তু একদম তুলবেন না। শিক্ষা হোক।’
এই কথার জবাবে অনিক একফোঁটাও উত্তর করলো না। পিতার পায়ের কাছে মাথানত করে, নিরবে বসে রইলো সে। পুত্রঅহংকারে ইউসুফ সাহেব সগৌরবে হাসলেন! একজন পিতার জন্য এর চেয়ে বড় সম্মানের, বড় গর্বের আর কি হতে পারে! তার সন্তান তার পা ছুঁয়ে মাফ চাইছে। যতই বড় ভুলই করুক না কেন তাঁর কাছে হার স্বীকার করেছে। আত্মতৃপ্তিতে সমস্ত হৃদয় কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে গেলো তার। এতদিনের দুঃখকষ্ট নিমিষেই গায়েব হয়ে গেলো। ছেলেকে টেনে তুলে সস্নেহে তার মাথায় হাত রেখে বললেন,’ওঠ, বাব! তুই জানিস তুই যে আমার কলিজার টুকরা? শত চেষ্টা করেও কখনো তোর ওপর রাগ করে থাকতে পারি নি আমি। তোর দুঃখ, কষ্ট, তোর চাইতে হাজারগুন বেশি কষ্ট দিয়েছে তোর বাবাকে ! তোর জন্য অনিলা কেন,আমি আমার সমস্ত পৃথিবী ত্যাগ করে দিতে পারি বাবা।’ নিরুত্তর অনিক ছলছল চোখে বাবার দিকে চাইলো। খুব করে বাবাকে জড়িয়ে ধরতে মন চাইছে অনিকের।সমস্ত দ্বিধা, আড়ষ্টতা ভুলে গিয়ে পুরোনো সম্বোধনে ফিরে গিয়ে আবদারের সুরে বললো,’আমি তোমাকে একটু জড়িয়ে ধরি বাবা?’ তাঁর কথা শেষ হওয়ার আগেই ইউসুফ সাহেব টেনে বুকে জড়িয়ে ধরলেন তাকে। অশ্রুসিক্ত ভেজা গলাগ বললেন,’কেন ধরবি না। বাবাকে জড়িয়ে ধরতে আবার অনুমতি নিতে হয় নাকি?’
অতঃপর পিতা পুত্র দুজনে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে বাঁধভাঙা অশ্রুবিসর্জনে মেতে উঠলেন। কথায় আছে পুরুষ মানুষের কাঁদতে নেই! কিন্তু এরা দুজনেই কাঁদছে। সামনে দাঁড়ানো নারীমূর্তিটিকে উপেক্ষা করে খুব কাঁদছে। কাঁদছে রুমুও! তার চোখে এই পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য! এর চাইতে সুন্দর, নিখাদ আর হৃদয়স্পর্শী আর কিছু হতেই পারে না!
.
.
.
চলবে