#পরিত্রাণ
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ১৬
অনিকের কাধে মাথা রেখে আধশোয়া হয়ে বসে আছে রুমু। অনিক ল্যাপটপে মুভি দেখছে। বস্তুত মুভি দেখছে না, কাজটা সে করছে রুমুকে বিরক্ত করার জন্য। অফিস থেকে ফেরার পর ঝলমলে নতুন শাড়িতে রুমুকে দেখে বেশ অবাক হয়েছিলো অনিক। শাড়ির সাথে ম্যাচিং করে গয়না পরেছে। সাজগোজ করেছে! বিছানা গোছাতে গোছাতে গুনগুন করে গানও গাইছিলো। অনিক বেশ বুঝতে পারলো আজকে রুমুর মন ভালো! অতএব একটু ভাব নেওয়াই যায়! অর্থাৎ এইমুহূর্তে রুমুকে সরাসরি ইগ্নোর করবে সে!
ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে সোজা ল্যাপটপ নিয়ে বসলো। রুমু ভ্রু কুঁচকে সতর্ক চোখে একবার চাইলো তাঁর দিকে! সে এতসুন্দর করে সেজেছে অথচ অনিক দেখলোই না? কেন রুমু মোটা হয়ে গিয়েছে বলে? কিছুক্ষন উশখুশ করে বিছানায় উঠে বসলো। অনিক পাত্তা দিলো না। দেখেও না দেখার ভান করে নিজের মত মুভির দিকে চেয়ে রইলো সে। রুমুর রাগ হলো! অনিক তাকে ইগ্নোর করছে? রাগে মুখ ভেংচি কেটে চট করে খাট থেকে নেমে দাঁড়ালো সে। এক্ষুনি শাড়ি গহনা সব খুলে ফেলবে সে!
হতাশ হলো অনিক! রুমু এমন কেন! সে তো দিশেহারা প্রেমিকার মত একবার উদগ্রীব হয়ে বলতে পারতো,’তোমার জন্য এত সেজেছি অনিক! তুমি দেখছো না কেন?’ অনিকের কি শুনতে ইচ্ছে করে না? রুমুর একটা হাত চেপে ধরে মৌনমুখে বললো,’মানে একটা দিন একটু ছোট হলে কি তোমার খুব ক্ষতি হয়ে যেতো? সবসময় আমাকেই কেন আমাকেই সব বলতে হবে? আগে তো তুমি এমন ছিলে না?’
রুমু মুখটিপে হাসলো। বেশ হয়েছে! ভদ্রমাতালটা তাঁর সঙ্গে ভাব ধরতে এসেছে। এখন কেন? অনিকের মুখটা দেখার মত! ছোটবাচ্চাদের মতন গাল ফোলানো অভিমানী মুখ! অভিযোগের সুরে বললো,’আমি তোমাকে কোনদিন মাফ করবো না রুমু। তুমি আমাকে পুরো শেষ করে দিয়েছে। নিজের দিকে তাকালে আমার লজ্জা হয়! কি আমি কি হয়ে গেলাম! আমার কলিগরা প্রায়ই আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করে, তুমি নাকি আমাকে গৃহপালিত বর বানিয়ে ফেলেছো।’
রুমু হাসি চেপে রেখে বললো,’এতে লজ্জার কি আছে? তোমার বউকে তুমি ভালোবাসবে না?’
-‘বউ জিনিসটাই তো আমার জন্য লজ্জা ব্যপার! আমার মত মতিছন্ন, সৃষ্টিছাড়া লোকের আবার বউ? তারওপর তোমার ঐ বেবি বাম্প দেখলে তো মনে হয় লজ্জায় মরে যাই! কি করেছি আমি? হায়!হায়!’
অনিকের এসব বেহুদা কথায় রুমু পেট ফেটে হাসি আসছে! ইশস,কি বলছে অনিক এসব! লজ্জা যেন তার একারই আছে! রুমুর নেই? তাই বলে কি রুমু অনিককে ভালোবাসে না? অনিকের যতসব আজগুবি কথাবার্তা! রুমু তাঁর কাছ থেকে সরে গিয়ে বললো,’অসভ্য! এভাবে কেউ বলে? তোমার কথা শুনে তো মনে হচ্ছে আমি তোমার বউ নই। অচেনা একটা মেয়ে!’
অনিক থেমে গেলো। নিজের বলা কথাগুলো মনে মনে আরেকবার আউড়ে নিলো সে। বোধগম্য হতেই মুখে লাজুক হাসির রেখা ফুটে উঠলো! হাসলো রুমুও। এবার সে অনিকের কাছে ঘেঁষলো। আবদারের সুরে বললো,’সত্যিই করে বলোতো তোমার কি আসলেই আফসোস হয়?’
অনিক জবাব দিলো না, একটুখানি হাসলো কেবল! রুমু ছাড়লো না। অনুযোগ করে বললো,’বলো না প্লিজ?’
অনিক ফের হাসলো! সে জানে রুমু তাঁর কাছ থেকে কি শুনতে চায়। হয়ত রুমুও জানে এই আফসোস অনিকের সত্যিকারের আফসোস নয়! কিন্তু অনিক তো মুখে বলতে চায় না! সে কেবল অনুভব করতে চায়! আলতো করে রুমুর মাথাটা টেনে বুকে নিয়ে বললো,’যদি বলি হয় তবে কি করবে?’
রুমু চুপচাপ কান পেতে অনিকের হৃদস্পন্দন শুনলো। ধুপ! ধুপ! যেন প্রতিটা স্পন্দন কেবল রুমুর জন্য! অদ্ভুত অনুভূতি! অনিকের বুকের চারপাশটায় আঙ্গুল ঘোরাতে ঘোরাতে বললো,’নো! ইউর হার্ট স্যেইজ, ইউ ডোন্ট নিড টু ওর্যি রুমু, দেয়্যার ইজ নো রিগ্রেট! দ্যা হার্ট অনলি লাভস ইউ অ্যান্ড ইউ!’
নিজের বলা কথাগুলো যেন সমস্ত হৃদয় দিয়ে অনুভব করছিলো রুমু। দুহাতে তাঁকে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরে নিজের সঙ্গে মিশিয়ে নিলো অনিক। কপালে আলতো করে চুমু খেয়ে মিষ্টি হেসে বললো,’ইয়েস! দ্যা হার্ট অনলি লাভস ইউ অ্যান্ড ইউ! এন্ড ইট অলসো লাভস দ্যা লিটল সোল দ্যাট ইউ আর ক্যারিয়িং!’
রুমু মন্ত্রমুগ্ধের মত সব শুনছিলো এতক্ষন। সম্বিৎ ফিরে পেয়ে দুষ্টুমির সুরে বললো,’এসব বলেছো, বলে, ভেবো না আমি সব ভুলে যাবো। বাবুকে তো আমি তোমার নাম ধরেই ডাকতে শেখাবো!’
ধ্যান ভাঙলো অনিকেরও। হেসে উঠে বললো,’তবে আমিও তোমার বাবাকে নাম ধরে ডাকবো!’
রুমু কৃত্রিম ক্ষোভে তার বুকে আলতো করে কিল মেরে বললো,’কথায় কথায় আমার বাবাকে টানো কেন তুমি? তোমার সাথে উনার কিসের শত্রুতা? তোমার কোন পাকা ধানে মই দিয়েছেন তিনি?’
-‘আমার ইচ্ছে! আমি আবার ডাকবো, আসিফ ইকবাল!’
এবার রুমুর সাবধানি গলায় বললো,’খবরদার বলছি। বাবার নাম ধরে ডাকাটা দিনদিন তোমার অভ্যেস হয়ে দাঁড়াচ্ছে!’
-‘আসিফ ইকককবাল!’
অনিকের এই ধরনের মজা রুমুর একদমই পছন্দ নয়। মজা হোক আর যাই হোক শ্বশুরের নাম ধরে কেন ডাকবে? চোখমুখ লাল করে বললো,’কেন শুধু শুধু আমার মেজাজ খারাপ করছো তুমি?’
-‘তাহলে তুমি কেন বলেছো বাবুকে আমার নাম ধরে ডাকতে শেখাবে?’
রুমু হাল ছেড়ে দিলো! অসভ্যটার সাথে কথা বাড়াবাড়ি করে সে পারবে না। এখন তাঁর বাবার নাম ধরে ডাকবে বলছে পরে দেখা যাবে তাঁর চৌদ্দগুষ্ঠির নাম ধরে ডাকতে শুরু করে দিয়েছে। তার চাইতে নতি স্বীকার করে নেওয়াই ভালো। ত্যাক্ত গলায় বললো,’ওটা তো কথার কথা বলেছিলাম!’
অনিক যেন সব কিছু বুঝে ফেলেছে তেমনি মাথা নাড়িতে বললো, তাহলে ঠিক আছে, মাফ করে দিলাম।’ রুমু অগ্নিদৃষ্টিতে তাকালেও কথাগুলো হজম করে নিলো। তার অবস্থা বুঝতে পেরে অনিক দুষ্টু হেসে তাঁর দিকের হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো, দেখি এবার একটু কাছে আসো, তোমার তারিফ করি! কষ্ট করে শাড়ি পরেছো! ‘
রুমু ঝাড়া মেরে হাত সরিয়ে দিয়ে বললো,’ধরবে না আমাকে তুমি। অসভ্য! জংলি!’
ধমক খেয়েও অনিক হাসলো। আহ! রুমু কি সুন্দর করে বললো,’অসভ্য! জংলি!’ অনিকের কাছে মধুর লাগছে কেন? জংলি! কি মিষ্টি শুনতে!
★
শুভ ছেলেটা এবার সত্যি সত্যিই ডিস্টার্ব করা শুরু করে দিয়েছে আরিয়াকে। সেদিন চেয়ারম্যান স্যারের রুমে লাজুক লতার ন্যায় মাথা নুইয়ে বসে থাকা সরল সুন্দর আরিয়াকে বেশ মনে ধরে গিয়েছিলো তার! সেই রূপসী ক্রন্দনরত মুখ! সোজা বুকের বামপাশটায় গিয়ে লেগেছিলো শুভর! ইংরেজিতে যাকে বলে লাভ এ্যাট ফার্স্ট সাইট! শুভর হয়েছিলো লাভ এ্যাট ফার্স্ট ক্রাই!
তারপর থেকেই রোজ আরিয়ার পিছু নেওয়া শুরু করছে সে। আরিয়া বিপাকে পড়ে গেলো। এবার যদি শুভর কথা অনিককে বলে সে, অনিক একফোঁটাও বিশ্বাস করবে না। তাই বাধ্য হয়ে সে নিজেই শুভর সাথে কথা বলতে গেলো। ক্লাস ছুটিরপর শুভ একাডেমিক ভবনের নিচে দাঁড়িয়ে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছিলো। আরিয়া ইশারা করতেই এগিয়ে এসে বললো,’বলুন মিস কাঁদুনি? আমাকে ডাকছিলেন কেন?’
-‘আপনি রোজ রোজ আমার পিছু নেন কেন?’
-‘যেন আপনি আপনার ভাইয়ের কাছে আবার নালিশ করতে পারেন। আপনার ভাইকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে।’
আরিয়া ভ্রু কুঁচকে ফেললো। বললো,’মানে?’
শুভ হাসলো। বললো,’মানে খুব সোজা। আপনার পিছু যখন নিচ্ছি তখন আপনার বুঝে নেওয়া উচিৎ ছিলো আমি আপনাকে পছন্দ করি!’
আরিয়া বিব্রত হলো! গম্ভীর গলায় বললো,’আপনি তো দেখছি ভীষণ ডেস্পারেট!’
-‘কাইন্ড অফ!’
-‘ডেস্পারেট ছেলেদের আমার পছন্দ নয়!’
-‘ছেলে–দের পছন্দ করার তো কোন দরকার নেই? আমাকে করলেই হবে।’
স্পষ্টত বিরক্তি ফুটে উঠলো আরিয়ার মুখে। অধৈর্য কন্ঠে বললো,’সেদিন আপনার নামে মিথ্যে বলেছি বলে আপনি ইচ্ছে করে আমাকে বিরক্ত করছেন তাই না?’
শুভ খুব অবাক হওয়ার ভান করে বললো,’আপনি বিরক্ত হচ্ছেন?’
-‘বুঝতে পারছেন না?’
-‘একটু একটু পারছি। পুরোটা নয়।’
-‘আপনি প্লিজ আমাকে আর বিরক্ত করবেন না।’
-‘তবে কি করবো?’
-‘কিছুই করবেন না।’
-‘কিছুই করবো না?’
-‘না! কিছুই করবেন না।’
-‘আমি আপনার কথা কেন শুনবো?’
-”আপনার এত ‘কেন’র জবাব আমি দিতে পারবো না।’
-‘না দিলে আমিও আপনাকে বিরক্ত করবো। রোজ বিরক্ত করবো।’
আরিয়া বাধ্য হয়ে বিরক্ত মুখে বললো,’কারণ আপনি আমাকে পছন্দ করে তাই।’
শুভ হাসলো। বললো,’ঠিক আছে! আপনি যখন সত্যিটা নিজমুখে স্বীকার করেছেন তবে আমি আপনার কথা রাখবো। কিন্তু তারজন্য আপনাকেও একটা কাজ করতে হবে।’
-‘কী?’
-‘আপনি কিসে কিসে বিরক্ত হোন তার একটা লিস্ট আমাকে দিতে হবে। সেগুলো বাদ দিয়ে করবো!’
আরিয়া ভ্রুজোড়া কুঁচকে ফেললো। কিছুক্ষন সময় নিয়ে ভেবেচিন্তে বললো,’আপনার চেহারা, আপনার কন্ঠস্বর এবং আপনার লিখা সবই আমাকে বিরক্ত করে!’
-‘আমার লেখা? আমার লেখা আপনি পেলেন কোথায়? বাহ! প্রেমপত্র দেওয়ার আগেই সব রাস্তা বন্ধ করে দিলেন?’
-‘আপনার বিশ্বাস নেই। তাই বাধ্য হলাম!’
শুভ আবারো হাসলো। মনে মনে আরিয়ার বুদ্ধির তারিফ না করে পারলো না সে। একঢিলেই সব রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছে আরিয়া! একটু জোরে নিশ্বাস ফেলে বললো,’এত নিষ্ঠুর আপনি! সারাজীবন শুনে এসেছি মেয়েদের হৃদয় নাকি কোমল হয়! তুলোর মত নরম! আপনার হৃদয় আছে তো?’
আরিয়ার হাসি পেলো। কিন্তু এইমুহূর্তে তাঁর হাসিতে শুভ প্রশ্রয় পেয়ে বসতে পারে তাই গম্ভীর গলায় বললো,’আশা করি আপনার মনে থাকবে?’
শুভ হতাশ! আরিয়া স্পষ্টত তাকে ইগ্নোর করছে! শেষ চেষ্টাস্বরূপ নিজের কিলার টাইপ হাসিটা দিয়ে বললো,’জি! আপনি সবসময়ই আমার মনে-এ থাকবেন।’
শুভর ঘায়েল করাটা হাসিটা বাস্তবিকই মুগ্ধ করলো আরিয়াকে! ছেলেমানুষের হাসি এত সুন্দর হয়! শুভর গায়ের রঙ একেবারে ফর্সা নয়! উজ্জ্বল শ্যামলা। তবে মুখশ্রী দারুণ সুপুরুষ! নজর আটকে যায়! আরিয়া নিজেকে সংযত করে বললো,’আমি নয়! আমার কথাগুলো মনে রাখলেই চলবে!’
-‘বেশ তবে তাই হবে!’
-‘আসি তাহলে?’
-‘আসুন!’
আরিয়া হাঁটা ধরলো। শুভ একদৃষ্টিতে চেয়ে রইলো তার চলে যাওয়ার দিকে! আর কি দেখা হবে দুজনার? আরিয়া পেছন ফিরে চাইলো! মিষ্টি করে হাসলো। তারপর গাড়িতে উঠে গেলো! মেয়েটা এত নিষ্ঠুর কেন?
.
.
.
চলবে