#পরীজান
#পর্ব ৫৭
#Ishita_Rahman_Sanjida(Simran)
❌কপি করা নিষিদ্ধ ❌
বাদল দিনের মতো করে বৃষ্টি ঝরছে শহর জুড়ে। হঠাৎ বৃষ্টিতে এলোমেলো হয়ে গেল মানুষ জন। অনাকাঙ্খিত কোন কিছুই ভাল না। যেটা এই বৃষ্টি প্রমাণ করে দিচ্ছে। ফল ফলাদির দোকানিরা তাদের জিনিস পত্র ঢাকতে ব্যস্ত। হাসপাতালের সামনেই সারিবদ্ধ ভাবে ফলের দোকান রয়েছে। কেননা রোগীর জন্য ফলের বিশেষ প্রয়োজন। আত্মীয়রা দেখতে আসলে ফল নিয়েই আসে। দোকানিরা কুল হারালো বৃষ্টির জন্য। ফলমূল বৃষ্টি থেকে আড়াল করার চেষ্টা করতে লাগল সবাই। এমনি সময় পুলিশের জিপ টা থামল। নুরুজ্জামান বৃষ্টি মাথায় তাড়াহুড়ো করে হাসপাতালের ভেতরে চলে গেল। ওনার সাথে মুসকান ও এসেছে। নাঈম তার চেম্বারে বসে রোগী দেখছে। এসময়ে পুলিশ দেখে সবাই স্বাভাবিক ভাবেই নিল। কারণ দেশে খু*ন খা*রাবি অহরহ ঘটছে। হাসপাতালে পুলিশের আসাটা স্বাভাবিক।
নাঈমের ডাক এলো তাকে নুরুজ্জামান জরুরী তলব করেছেন। তবে এতে তার ভাবান্তর নেই। সামনের রোগীকে প্রেসক্রিপশন লিখে বিদায় করে দিয়ে নুরুজ্জামান কে ভেতরে ডাকে। নাঈম হেসে তাকে বসার জন্য বলে। সাথে মুসকান কে দেখে অবাক হল না সে। নাঈম বলল,’আমি জানতাম আপনি আসবেন।’
কথাটা সে নুরুজ্জামান কে উদ্দেশ্য করেই বলে। নুরুজ্জামান কথার পিঠে জবাব দেয়,’কীভাবে জানলেন যে আমি আসব?’
-‘আমার মনে হয় আপনি যে জন্য এসেছেন সেই বিষয়ে কথা বলাই ভাল।’
নুরুজ্জামান ঝেরে কাশলেন,’সেহরান শায়ের, যার ফাঁ*সি আগামীকাল রাত এগারোটা পঁয়তাল্লিশে হওয়ারকথা ছিল। কিন্তু আজ জানতে পারলাম যে খু*ন গুলোর দায়ে তাকে ফাঁ*সি দেওয়া হচ্ছে সেই খু*ন গুলো সে করেনি। আরেকটা বিষয় হচ্ছে আপনি সবটাই জানতেন। তাহলে কেন বলেননি আমাদের? আর পরীও যে মারা গেছে সেটাও বলেননি। কেন? আর কি কি লুকানো আছে সেটা আপনি বলুন।’
নাঈম এক পলক মুসকানের দিকে তাকিয়ে আবার নুরুজ্জামানের দিকে তাকাল,’আজকে দেখছি আমাকে বাকিটুকু বলতে হবে। দেখুন আমি চেয়েছিলাম শায়ের নিজের মুখেই সব বলুক। সে যে কতটুকু বলবে সেটাও আমি জানি। হ্যা আমি জানি শায়ের ওই খু*ন গুলো করেনি। পরীর দুই মা আর কাজের মেয়ে দুজনকে বাঁচানোর জন্য শায়ের নিজের ঘাড়ে দোষ নিয়েছে। পরী শায়েরের সম্পর্কে আপনি যতটুকু জানেন আমি তার থেকেও বেশি জানি। ওরা একে অপরের পরিপূরক। ভালোবাসার প্রতিযোগিতা সর্বক্ষণ দুজনের মধ্যে চলে। তাই পরীর কথাটা শায়ের ফেলতে পারেনি। আর আমিও তাই চুপ ছিলাম।’
নুরুজ্জামান রুষ্ঠচিত্ত কন্ঠে বলে,’এতে আপনিও অন্যায় করেছেন জানেন কি?’
-‘তাহলে অন্যায় আমি করেছি। যদি আপনি শাস্তি দিতে চান তো পারেন।’
-‘আপনি এটা বলুন যে পরীর দুই মা ভাই আর কাজের মেয়ে দুটো এখন কোথায় আছে? আমি নিশ্চিত আপনি জানেন ওরা এখন কোথায়?’
মৃদু হাসে নাঈম,’শায়ের বোধহয় জানত যে এরকম প্রশ্নের মুখোমুখি আমাকে হতে হবে। সেজন্য ওদের দায়িত্ব টা প্রথমে আমাকে দিলেও পরে সে নিজে ওদের সরিয়ে দেয় অন্য কোথাও। তবে এই মুহূর্তে আমি সত্যিই কিছু জানি না।’
মুসকান কে সাথে করে নুরুজ্জামান আবার থানার উদ্দেশ্যে রওনা হল। নাঈমের কাছে আর কোন প্রশ্ন আপাতত তার কাছে নেই। পরে মনে পড়লে আবার আসা যাবে। ইতিমধ্যে শায়েরের ফাঁ*সি বাতিল হয়েও গেছে। উপরমহলে শায়েরের বলা কথাগুলোর রেকর্ড পাঠানো হয়েছে। আবার নতুন করে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন উপর থেকে। গাড়িতে বসে মুসকান বলল,’ওই হ*ত্যা*কান্ডের তিনবছর পর শায়ের কে গ্রেফতার করেন আপনারা। আর বাকি তিনবছর শায়ের কারাবন্দি হয়ে ছিল। তারপর ফাঁ*সির হুকুম আসে। হিসেব টা কেমন জানি অন্যরকম হয়ে গেল না?’
-‘শায়ের কে ধরার পর দুইবছর ধরে ওর তদন্ত চলে। আইন এতই সহজ নাকি? শায়েরের ফাঁ*সির দিন আরো আগেই নির্ধারিত হয়েছিল। কিন্তু শায়েরের ইচ্ছা অনুযায়ী কালকের দিন ঠিক করা হয়।’
-‘শায়েরের ইচ্ছা অনুযায়ী!!’
-‘এটাই তার শেষ ইচ্ছা ছিল। আর মৃ*ত্যুর আগে আসামীদের শেষ ইচ্ছা পূরণের নির্দেশ আদালত দিয়ে থাকে। শায়েরের ইচ্ছাটা অদ্ভুত ছিল। তবুও এক বছর পিছিয়ে যায় ওর ফাঁ*সির। আর এখন ওর ফাঁ*সিই বাতিল। সময় বড়ই অদ্ভুত। সময়ের সাথে কেউ মৃ*ত্যুর কোলে ঢলে পড়ে তো কেউ বেঁচে যায়।’
থানায় এসে ওনারা দুজনে আবারও শায়েরের কাছে গিয়ে উপস্থিত হন। শায়ের এতক্ষণে টের পেয়ে গেছে
যে মুসকান সব সত্য বলে দিয়েছে। সে বলে উঠল, ‘আপনি কাজটা ঠিক করলেন না।’
-‘আপনিও কাজটা ঠিক করেননি। কেন নির্দোষ হয়েও দোষী হলেন? এখন আপনার এই খবর সারা দেশ জুড়ে ছড়িয়ে যাবে।’
-‘এমনটা করবেন না। পৃথিবীর কেউ যেন এই খবর না জানে।’
শায়েরের কথায় বিষ্মিত হল মুসকান,’আপনি এখনও এসব বলছেন? আত্মত্যাগ করা যায় কিন্তু আপনার মত আত্মত্যাগ ক’জন করে। সেটাই এবার বিশ্ব জানবে।’
-‘বিশ্ব আমার আত্মত্যাগ দেখবে না তারা দেখবে বিশ্বাসঘাতকতা। আপনি এই খবর কাগজে ছাপালে সবাই জেনে যাবে পরীজানের বাবা কাকার হিং*স্র*তার কথা। মেয়েরা তাদের বাবাকে বিশ্বাস করতে পারবে না। কাকা ভাইকেও অবিশ্বাস করবে। আশেপাশের কাউকেও ভরসা করবে না। তাহলে এসব গোপন থাকাই শ্রেয়। দো*ষীরা তো শাস্তি পেয়েছেই।’
মুসকান ভেবে দেখল শায়েরের কথা গুলো চিরন্তন সত্য। এই সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয় কিন্ত বদনাম হতে এক মুহূর্তও সময় লাগে না। এখন সবাই যদি জানে আফতাব পিতা হয়েও তার কন্যাদের হ*ত্যা করেছে তাহলে কোন মেয়েই তার বাবাকে চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করবে না। সব বাবা তো আফতাবের মত হয় না। কিছু বাবা মেয়েকে রাজকন্যা করে রাখেন। শায়েরের কথায় ফের মুগ্ধ হল মুসকান।
নুরুজ্জামান এবার শায়ের কে প্রশ্ন করল,’তোমার শ্বাশুড়ি এখন কোথায় আছে? কোথায় রেখে এসেছো তাদের?’
-‘আমি জানি না তারা এখন কোথায় আছে। জানলেও বলতাম না।’
-‘তুমিই তো ওদের সরিয়ে নিয়েছিলে। এখন সত্য বলো।’
-‘তিন বছর ধরে আমি জেলে বন্দি। আমি কীভাবে জানব তারা কোথায় আছে? আমি তাদের সিলেটের গাড়িতে তুলে দিয়েছিলাম। কিন্তু বর্তমানে তারা কোথায় আছেন তা জানা নেই। আর আপনারা ওনাদের সারা পৃথিবী ওলট পালট করে খুঁজলেও পাবেন না।’
নুরুজ্জামানের রাগ হল শায়েরের উপর। তিনি রাগে গজগজ করতে করতে চলে গেলেন। ওনার কাছে কোন ছবি নেই যা দিয়ে বিজ্ঞাপন দিবেন। কারণ তিনবছর আগে শায়েরের শ্বশুড়িই শায়েরের নামে কেস লিখিয়ে উধাও হয়ে গেছেন। শায়ের কে ধরতেই তিনবছর লেগে গেছে। কোন খোঁজ নিতে পারেনি নুরুজ্জামান। তখন শুধু শায়ের কে ধরার চিন্তাই ওনার মাথাতে ছিল। শায়ের যখন পুলিশের হাতে এল তখনই পরীর পরিবারের খোঁজ শুরু হল। কোথাও তাদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। নুরুজ্জামান ভেবেছিলেন শায়ের বুঝি সাক্ষীর অভাবে ছাড়া পেয়ে যাবে। কিন্তু শেষমেষ শায়ের নিজের মুখেই তার দোষ স্বীকার করে নেয়। কিন্তু এখন এই কেসের মোড় ঘুরে গেছে। অতি শীঘ্রই শায়ের ছাড়াও পেয়ে যাবে। শায়েরের মুখ থেকে আশানুরূপ আর কোন উত্তর পাওয়া গেল না। আর না গেল নাঈমের থেকে। নুরুজ্জামানের সন্দেহ শায়েরের উপর থেকেই গেল। সে শায়ের কে ছাড়ল না। যতক্ষণ না পর্যন্ত প্রত্যক্ষ আসামী ধরা পড়ছে ততক্ষণ পর্যন্ত শায়ের কে কারাবন্দি হয়ে থাকতে হবে। কিন্তু মাস দুয়েক যেতে না যেতেই উপর মহল থেকে চাপ দিচ্ছে শায়ের কে মুক্তি দেওয়ার। কেননা বিনা দোষে শায়ের তিনবছর জেলে থেকেছে। আর এখন তাকে আটকে রাখার কোন মানেই হয় না। বাধ্য হয়েই শায়ের কে মুক্তি দেওয়া হল।
ছাড়া পেয়ে শায়ের সর্বপ্রথম নাঈমের বাসায় গেল। নাঈম ও তার অপেক্ষাতেই ছিল। শোভন কে কোলে নিয়ে বসে আছে মুসকান। এই ছোট্ট ছেলেটাকে আদর দিয়ে বড় করেছে সে। মা না হয়েও মায়ের আদর স্নেহ দিয়েছে। আজ সে কীভাবে শোভনকে শায়েরের কাছে দিয়ে দেবে? বুক ভেঙে কান্না আসছে ওর। চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ছে। শোভন অনেক বার জিজ্ঞেস করছে মুসকান কাঁদছে কেন? কোন উত্তর দিতে পারেনি সে। শুধু অশ্রুসিক্ত নয়নে শোভনের দিকে তাকিয়ে রইল।
দরজা খুলে শায়ের কে ভেতরে আনল নাঈম। শায়ের কে দেখেই কেঁপে উঠল মুসকান। দুহাতে আঁকড়ে ধরল শোভন কে। অচেনা মানুষের আগমন ঘটতেই শোভন প্রশ্ন করে বসে,’ইনি কে আম্মু?’
সবার দৃষ্টি ঠেকল শোভনের মুখপানে। নাঈম কোন ভনিতা না করেই জবাব দিল,’তোমার আব্বু।’
ছোট্ট শোভন অবাক চোখে দেখল শায়ের কে!! শুভ্র পাঞ্জাবিতে আবৃত পুরুষটির মুখভর্তি দাঁড়ি। চুল গুলো এলোমেলো। কিন্ত চোখের দিকে তাকাতেই স্থির হল শোভনের দৃষ্টি। হিসেব মিলাতে পারছে না শোভন। মুসকানের কোল থেকে নেমে সে নাঈমের হাত ধরে বলল,’আমার আব্বু তো তুমি!! তাহলে এই লোকটা আমার আব্বু হল কীভাবে?’
নাঈম হাটু গেড়ে শোভনের সামনে বসে পড়ে। দুহাতে শোভনের গাল দুটো ধরে বলে,’দেখো বাবাই আমরা সবসময় চোখে যা দেখি আর কানে যা শুনি তা সত্য হয় না। সেরকমই তুমি এতদিন যাদের মা বাবা বলে জেনে এসেছো তারা তোমার বাবা মা নয়। তোমার বাবা ওই যে লোকটা দাঁড়িয়ে আছে উনি। আর আজ ওনার সাথে তুমি চলে যাবে। একদম মন খারাপ করবে না।’
শোভন কি বুঝল তা জানে না নাঈম তবে শোভন বলে উঠল,’তাহলে আমার আসল মা কোথায়? আমাকে তোমাদের কাছে কেন দিয়ে গেছে?’
-‘তোমার সব প্রশ্নের জবাব তোমার আব্বুই দিতে পারবে। যাও তোমার আব্বুর কাছে।’
নাঈম আর মুসকান কে করুন চোখে দেখে সে শায়েরের কাছে গেল। শায়ের এতক্ষণ চুপ থেকে ছেলেকে দেখছিল। কতটা সহজে সব মেনে নিল। ছেলেটা পরীর স্বভাব পেয়েছে বটে। কঠিন ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন। শোভন কে কোলে তুলে নিল শায়ের। গালে হাত রেখে কপালে চুমু খেয়ে বুকে জড়িয়ে নিল ছেলেকে। বাবার গলা ধরে কাঁধে মাথা রাখল শোভন। বাবা বাবা গন্ধ পাচ্ছে তাই শক্ত করে বাবার গলা ধরে রেখেছে সে। শায়ের চলে যাওয়ার আগে নাঈম মুসকান কে উদ্দেশ্য করে বলে,’আমি জেল থেকে ছাড়া পেতে চাইনি। কিন্তু যখন পেয়েই গেছি তখন আমি আমার ছেলেকে নিয়ে আলাদা দুনিয়ায় চলে যাব। আপনাদের ধন্যবাদ এতদিন আমার সম্পদ কে আগলে রাখার জন্য। আপনাদের এই ঋণ আমি কোনদিন পরিশোধ করতে পারব না।’
শায়ের চলে যেতেই নাঈম বসে পড়ল মেঝেতে। এতক্ষণ বহু কষ্টে নিজেকে সামলেছে সে। কিন্তু আর
নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। এতদিন যাকে নিজ সন্তানের স্থানে রেখেছিল তাকেই আজ দূরে সরিয়ে দিল। মুসকান নাঈমের পাশে বসে কাঁদতে লাগল। মুসকানের কষ্ট যেন একটু বেশিই হচ্ছে। নাঈম একহাতে মুসকান কে বুকে টেনে নিল। কষ্টের মাঝেও একটু খানি শান্তি অনুভব করল মুসকান। মানুষের একদিক দিয়ে কষ্ট আসলে অন্যদিক থেকে সুখ আসে যেন। আজ শোভন চলে গেল কিন্তু নাঈম কাছে টেনে নিল মুসকান কে।
সেদিনের পর আরও পাঁচ মাস কেটে গেছে। নুরুজ্জামান সবসময় শায়ের কে চোখে চোখে রাখত আড়াল থেকে। যদি কোন খবর পাওয়া যায়। কিন্তু নাহ,কোন খবর পাওয়া গেল না। শায়ের ছেলেকে নিয়ে দিব্যি দিন কাটাচ্ছে। এতে বিরক্ত নুরুজ্জামান। কেসটা এতদূর এসে থেমে গেল যেন। আর কোন তথ্যই পাচ্ছেন না তিনি। শুধুমাত্র একটা খবর তিনি পেয়েছেন শুধু। সেটা হল জুম্মান ওর বাবার সমস্ত সম্পত্তি বিক্রি করে দিয়ে দেশ ছেড়ে চলে গেছে। তাও বছর খানেক আগে। আর কিছুই জানা যায়নি। তাই এই কেস আপাতত বন্ধ।
নতুন বাড়িতে বাবার সাথে বেশ কাটাচ্ছে শোভন। মুসকান আর নাঈম প্রায়শই দেখা করতে আসে শোভনের সাথে। এভাবেই ওদের দিন কাটছে। একদিন সকাল বেলা হলুদ খামের চিঠি হাতে শায়েরের কাছে গেল শোভন। চিঠিটা শায়েরের দিকে এগিয়ে দিল শোভন। ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে চিঠিটা খুলল সে।
“সাত বছরের অপেক্ষা শেষ হতে চলছে। আপনার শাস্তির মেয়াদ শেষ। বাগানে অসংখ্য ফুল ফুটে আছে কিন্তু মালির অভাবে তা খুব তাড়াতাড়ি ঝরে পড়তে চলছে। ভ্রমর গুলোও অভিমান করে ফিরে যাচ্ছে।সৌন্দর্য শূন্য হতে চলছে মন বাগান। শূন্যতা খুব শীঘ্রই পূর্ণতা পেতে চাইছে। এ দূরত্ব কি ঘুচবে না??”
চিঠিটা পড়ে মৃদু হাসে শায়ের। বাবার হাসি দেখে শোভন জিজ্ঞেস করে,’কার চিঠি ছিল আব্বু?’
শোভন কে কাছে টেনে নিল শায়ের। বুকে জড়িয়ে ধরে শুধালো,’নতুন দিনের সূচনা হতে চলছে আমার রাজকুমার। আমাদের গন্তব্য এখনও শেষ হয়নি। নতুন সফরের জন্য তৈরি হও।’#পরীজান
#পর্ব ৫৮
#Ishita_Rahman_Sanjida(Simran)
❌কপি করা নিষিদ্ধ ❌
এলোকেশী রাঁখি শাক তুলতে রাস্তার ধারে এসেছে। রাস্তার পাশে পাট খড়ির তৈরি জানালা গুলো বাঁশের সাহায্যে দাঁড় করানো। পুঁই শাক গাছের লতাগুলো ছড়িয়ে আছে চারিদিক। বেশ দেখতে হয়েছে। ভাইয়ের ঘাড়ে বসে আর কতদিন খাবে সে? ভাইয়ের বউ কথা শোনাতে পারলেই বাঁচে। তাই শাক সবজি চাষ করে দুটো টাকা রোজগার করে। সম্পান থাকলে কি এই দূর্দিন দেখতে হতো? ছেলেটা অভিমান করে তাকে ছেড়ে চলে গেল। সেই সময়ে লখা যাচ্ছিল সেখান দিয়ে। হাতে তার গাঁধা ফুলের মালা। রাঁখির মনে পড়ে গেল আজ ইন্দুর ছোট ছেলের অন্নপ্রাসণ। মহা ধুমধামে তা পালন করা হচ্ছে। রাঁখি মনে মনে ভাবে যদি বিন্দু সম্পান থাকত তাহলে ওদের ঘরেও সন্তান থাকতো। লখা রাঁখিকে দেখে জিজ্ঞেস করে,’কি’বা আছো মাসি? শরীর ভালা তো?’
রাঁখি মলিন হাসিতে জবাব দিল,’ভালা রে লখা। ইন্দুর পোলা কি ভালা আছে?’
-‘ভালাই আছে। তুমি একটু পরে যাইও কিন্তু। আমার খারানের সময় নাই।’
লখা দ্রুত পায়ে প্রস্থান করে। লখার চলে যাওয়ার পর পরই চুল দাড়ি ভর্তি একটা পাগলের আবির্ভাব হলো। চুল দাঁড়ি এতই ঘন যে তাকে চেনার উপায় নেই। চেহারার ও বিচ্ছিরি অবস্থা। গ্রামের কিছু ছেলে মেয়ে পাগলটাকে উত্যক্ত করছে আর তার পিছু পিছু আসছে। রাঁখি আবার মুখ ফেরাল। এই পাগলটাকে দেখে ঘৃণা হচ্ছে তার। কি নোংরা!! সুখানের পর আরো দুজন পাগল নূরনগরে দেখা গিয়েছে। তারা কোথা থেকে এসেছে নাম কি তা কেউই জানে না। চেহারা দেখে কিছু বোঝার উপায় ও নেই। এতে গ্রামের কোন ব্যক্তি মাথা ঘামায় না। পাগলের আবার কিসের পরিচয়? রাঁখি শাক তুলে নিয়ে চলে গেল। পিছন ফিরে ছেলে মেয়ে গুলোকে হাসি ঠাট্টা করতে দেখে হাসল সে। আস্তে করে বলে উঠল,’যেমন কর্ম তেমন ফল। যে রাজ্য চায় সে হয় ভিখারি।’
চোখের জল মুছে রাঁখি নিজ গন্তব্যে চলে গেল।
শোভন আজকেও একটা হলুদ খামের চিঠি পেলো। পিয়ন চিঠিটা দিতেই ওলট পালট করে দেখল সে। চিঠিটা কোথা থেকে এসেছে তা দেখতে চাইল। কিন্ত প্রেরকের কোন ঠিকানা নেই। বিরক্ত হল শোভন। নাকের ডগা ক্রমশ লাল হতে লাগল তার। সামনের দোকানে চিনি কিনতে গিয়েছিল সে। শায়ের বারণ করা সত্ত্বেও সে চিনি কিনে বাসায় ফিরছিল। বাসার গেইটের সামনে এসে দাঁড়াতেই পিয়ন চিঠিটা ধরিয়ে দিয়ে গেল। শোভন ধীর পায়ে ঘরে ঢুকতেই চেয়ারে বসা নুরুজ্জামানের দিকে চোখ গেল ওর। শায়েরের সাথে হাত নাড়িয়ে কথা বলছেন তিনি। চিঠিটা মুড়িয়ে মুঠোবন্দি করে নিল সে। যথা স্থানে চিনি রেখে শায়েরের সামনে গিয়ে দাঁড়াল সে। নুরুজ্জামান এতক্ষণে শোভন কে খেয়াল করে। শোভন পকেট থেকে চিঠিটা বের করে শায়েরের দিকে তুলে ধরে বলে,’আব্বু তোমার চিঠি এসেছে।’
শায়ের থমকালো!! নুরুজ্জামানের সামনেই দিতে হল চিঠিটা!! বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা দিল শায়েরের কপালে। ছোঁ মেরে চিঠিটা নুরুজ্জামান কেড়ে নিলেন। খাম খুলে চিঠি বের করে পড়তে লাগলেন। তবে লেখাগুলো পড়ে তার ভাব ভঙ্গি পরিবর্তন হয়ে গেল। তারপর শায়েরের দিকে সেটা এগিয়ে দিল। শায়ের ভেবাচেকা খেয়ে গেল। সে নিজেও পড়া শুরু করল,
“আমি তোমাকে খুব ভালবাসি আব্বু। তুমি পৃথিবীর সেরা আব্বু। আমাকে কত আদর করো!! আমি তোমার সাহসী রাজকুমার।”
চোখ তুলে শায়ের ছেলের দিকে তাকাল। শোভন খিলখিল করে হেসে উঠল। তাজ্জব বনে গেল নুরুজ্জামান। তিনি এসেছিলেন শায়েরের সাথে কেস নিয়ে আলোচনা করতে কিন্ত আশানুরূপ কিছুই পেল না। উল্টে বোকা বনে গেল। সে ভেবেছিল এই চিঠিতে বোধহয় কিছু আছে। কিন্তু তার ধারণা ভুল প্রমাণিত হল। নুরুজ্জামান চলে যেতেই শোভন পকেট থেকে আসল চিঠিটা বের করে দিল। শায়ের বেশ অবাক হল ছেলের কান্ডে। এতটা চতুরতার সাথে কাজটা করল কীভাবে সে? ভয় পাইয়ে দিয়েছিল!! মায়ের মতোই হয়েছে একদম। শায়ের হাসল আবার। শোভন জিজ্ঞেস করে,’আমরা কবে যাচ্ছি আব্বু??’
-‘খুব শীঘ্রই যাব আমার রাজকুমার। তোমার জন্য অনেক বড় উপহার আছে সেখানে।’
-‘উপহারটা কি তা আমি জানি!!’
-‘তুমি জানো? কীভাবে?’
শোভন কিছু বলল না। চুপ করে নিজের ঘরে চলে গেল। স্কুল ব্যাগটা খুলে একটা খাতা সে বের করল। সিমেন্টের মলাটের খাতাটা শোভনের অনেক বার পড়া হয়ে গেছে। বাংলা রিডিং সে খুব ভাল করেই পড়তে পারে। শোভন এই খাতাটা মুসকান কে অনেক বার পড়তে দেখেছে। তাই নিজের ব্যাগে করে খাতাটা সে নিয়ে এসেছে। এই খাতাটা অনেক বার তারও পড়া হয়ে গেছে। শেষে কিছু বাক্য পরী শোভনের জন্য লিখে গেছে,”আমার রাজকুমার আল্লাহর অনুমতি তে আমাদের আবার মুলাকাত (দেখা) হবে।”
সেই লেখাটায় হাত বুলিয়ে খাতাটা বুকে চেপে ধরল। মুখে হাসি ফুটিয়ে বলে উঠল,’আল্লাহ অনুমতি দিয়ে দিয়েছেন আম্মিজান।’
দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে শায়ের ছেলের কথা শোনে। এতটা বুদ্ধিমত্তার অধিকারী এই ছেলে!! যা শায়ের কে প্রতি পদে পদে বিষ্মিত করে দিচ্ছে। নুরুজ্জামান কে যেভাবে ঘোল খাওয়ালো!! ভাবতেই হাসি পেল ওর।
—-
মুসকান কে তাড়া দিচ্ছে নাঈম। তৈরি হতে সময় লাগছে বলে মৃদু ধমকাচ্ছে। আপাতত নাঈমের কথায় পাত্তা দিচ্ছে না মুসকান। সবুজ রঙের শাড়িটি পরিপাটি করে পড়ে তারপর বের হল সে। আজকে দুজনেই কাজ থেকে ছুটি নিয়েছে। কিন্ত মুসকান জানে না নাঈম তাকে এখন কোথায় নিয়ে যাবে? অনেক বার জিজ্ঞেস করেও কোন উত্তর মেলেনি স্বামীর কাছ থেকে। তাই হতাশ হয়ে নাঈমের পিছু ধরে সে। মুসকানের একটা হাত চেপে ধরে নাঈম। এতে মৃদু হাসি ফুটল মুসকানের ওষ্ঠাধরে। নাঈম রিক্সা ডেকে তাতে উঠে পড়ে। মুসকানের এতদিনে মনে হচ্ছে ওরা স্বামী স্ত্রী। এতগুলো বছর শোভন ছাড়া নাঈম কিছুই বোঝেনি কিন্তু আজ নাঈম মুসকানের এত কাছে এসেছে। ভালোই লাগছে মুসকানের। এতদিনে অন্তত স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক টা গাঢ় হয়েছে।
রিকশা থেকে নেমে ট্যাক্সি নিল ওরা। নাঈম এখনও মুখ খোলেনি।
ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট স্টেশনে ট্যাক্সি থামে। মুসকান অবাক হয়ে চারিদিক দেখে। সাংবাদিক হওয়ার দরুন দেশের সব জায়গাতেই সে গিয়েছে। এই স্টেশন থেকে ঢাকা টু কলকাতার ট্রেন ছাড়ে। মানে ভারত যাওয়ার ট্রেন। মুসকান অবাক হল এই ভেবে যে নাঈম এখানে কেন আসল? মুসকান কে সাথে নিয়ে আসার কারণ কি? নাঈমের তো কোন আত্মীয় ভারত থাকে না। তাহলে এখানে আসার কারণ টা কি? এসব ভাবতে ভাবতেই হাতে টান পড়ল। নাঈম ওর হাত ধরে স্টেশনের ভেতর নিয়ে গেল। মুসকান ও পা চালায় নাঈমের পিছু পিছু। কিছুদূর গিয়ে শায়ের কে দেখেই থমকে যায় সে।
সাদা রঙের পাঞ্জাবি পড়ে দাঁড়িয়ে আছে শায়ের। হাতা কনুই পর্যন্ত গোছানো। চোখে সুরমা দেওয়া। ঠোঁটে সুন্দর হাসি। পরীর বলা মালির সৌন্দর্য চোখের সামনে দেখছে সে। পরীর বর্ণনা হুবহু মিলে গেছে। তবে মুসকান আরও অবাক হল শোভন কে দেখে। অবিকল বাবার বেশ ধারণ করেছে সে। টানা টানা চোখে সুরমা পড়েছে বাবার মতো। সাদা পাঞ্জাবি গায়ে জড়ানো। মুসকান কে চোখে পড়তেই শোভন দৌড়ে গিয়ে ওর কোলে উঠে পড়ল। মুসকান শোভন কে বুকে জড়িয়ে ধরে নাঈমের দিকে তাকাল সে। নাঈম বুঝল এবার তার চুপ থাকলে চলবে না,’শায়ের শোভন কে নিয়ে কলকাতা চলে যাচ্ছে। ওখানেই থাকবে ওরা।’
বিষ্ময়বিমূঢ় মুসকান!! তাহলে তো আর ওর দেখা হবে না শোভনের সাথে। ওর চোখের পানি আটকাতে পারেনি শায়ের আর শোভনকে। ট্রেন ছাড়ার সময় আসতেই নিজ কামরায় গিয়ে বসে ওরা। শোভন জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে শেষবারের মতো নাঈম মুসকান কে বিদায় জানায়। অতঃপর শায়ের কে বলে,’কিছু পেতে হলে কিছু ত্যাগ করতে হয় তাই না আব্বু?’
ছেলের কথায় মুচকি হাসল শায়ের,’অবশ্যই!! সবকিছু একসাথে পাওয়া অসম্ভব। দুনিয়া কে তুমি যা দেবে দুনিয়াও তোমাকে তাই দেবে।’
-‘তুমি দুনিয়াকে কি দিয়েছিল আব্বু? যার জন্য এতদিন কষ্টে ছিলে?’
দীর্ঘশ্বাস ফেলে শায়ের জবাব দিল,’কিছু সময় আমি দুনিয়াকে কষ্ট দিয়েছিলাম তাই আমিও কষ্ট পেয়েছি। তবে আমি ভালোবাসাও দিয়েছি। তাই তো এখন বাকি জীবনে দুনিয়াও আমাকে ভালোবাসা দেবে।’
-‘কিন্তু আমি সবসময় এই দুনিয়া কে ভালোবাসা দেব।’
ছেলের কথায় হাসল শায়ের। লম্বা ভ্রমণ শেষে ট্রেনটি ভারত পৌঁছাল। তবে কলকাতা স্টেশনে নামল না শায়ের। আবার নতুন গন্তব্য ধরল ট্রেনটি। এবার গিয়ে থামল জলপাইগুড়ি স্টেশনে। ব্যাগ থেকে গরম কাপড় বের করে দুজনেই পড়ে নিল। শীত শীত ভাবটা আরো এগোলে আস্তে আস্তে তীব্র হবে। যদিও এখন অনেক কম শীত করছে। স্টেশন থেকে নেমে দার্জিলিং এর বাস ধরে শায়ের। নিউ জলপাইগুড়ি গুড়ি থেকে দার্জিলিং এর কার্শিয়াং শহর ৫৩ কিলোমিটার দূরের পথ। মধ্য প্রহরের শেষের দিকে কার্শিয়াং এর বাসে ওঠে ওরা। বাকি রাত টুকু বাসেই কাটে বাবা ছেলের। পাহাড়ি রাস্তা তার উপর প্রচন্ড শীত। ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরেছে শায়ের। গরম কাপড় পড়া সত্ত্বেও উষ্ণতা দিতে চাইছে সে। শোভন পরম নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে বাবার বুকে। গন্তব্যে পৌঁছেও শোভনের ঘুম ভাঙল না। তখন ফজরের আযান পড়েছে। ছেলেকে কোলে তুলে নিয়ে আরেক হাতে ব্যাগ ধরে বাস থেকে নেমে পড়ল সে। গাড়ি নিয়ে হাজির হল ছোট্ট একটা বাড়ির সামনে। ততক্ষণে শোভনের ঘুম ভেঙে গেছে। দরজায় টোকা দিতেই একটা যুবক এসে দরজা খুলে দিল। শোভনের কাছে সম্পূর্ণ অচেনা সেই যুবকের চেহারা। তবে যুবক টা যেন শায়ের কে চেনে। কারণ শায়ের হাসছে সামনের যুবককে দেখে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই অচেনা পুরুষটি কোলে তুলে নিল শোভন কে। কিছু বলছে না শোভন। শুধু চেয়ে চেয়ে দেখছিল সবকিছু। ঘরের ভেতরে ঢুকতেই আরো কয়েকজন নতুন মুখের সম্মুখীন হল সে। কাউকেই চিনতে পারছে না শোভন।
এই ভোর বেলা কি তার জন্যই এই মানুষ গুলো জেগে ছিল? কিন্ত কেন? এরা কারা? একমনে এসব ভেবে চলছে সে। বাবার দিকে তাকিয়ে দেখল ওর বাবাও অস্থির নয়নে আশেপাশে চোখ বুলাচ্ছে। শায়েরের অস্থিরতা দেখে অচেনা যুবকটি বলে উঠল,’সে ঘরে নেই সে পাহাড়ে।’
বাক্যটা শেষের সাথে সাথে শায়েরের অস্তিত্ব যেন মুহূর্তেই মিলিয়ে গেল। শায়ের ছুটল পাহাড়ের দিকে।
তবে তাকে কেউ বাঁধা দিল না। বাঁধা দেওয়ার সাহস যেন কারো নেই। প্রকৃতিও চায় শায়েরের পদচরণ পাহাড়ে পড়ুক। শীতের কুয়াশা গুলো যেন স্বাক্ষী থাকলে চায় উতলা পুরুষটির ভালোবাসার। তাই তারাও শায়েরের সাথে ধেয়ে যাচ্ছে পাহাড়ে। গন্তব্য যখন শেষ হল দূরে একটা নারী অবয়ব ভেসে উঠল। এই শীতের মধ্যেও নারীটির শরীরে নেই শীত নিয়ন্ত্রিত বস্ত্র। পাতলা শাড়ি পড়ে সে খোলা চুলে দাঁড়িয়ে আছে। দাঁড়িয়ে আছে বললে ভুল হবে। কোমল হাতে সে স্পর্শ করছে চা পাতা গুলোতে। কচি পাতা ছিঁড়ে রাখছে হাতে থাকা ছোট্ট ঝুরিতে। কিছু পল থেমে গিয়ে ধীমি পায়ে সামনে এগোচ্ছে শায়ের। ঠোঁটজোড়া প্রসারিত করে সে একটা শব্দ উচ্চারিত করতেই নারী অবয়বটির হাত থেমে গেল।
#পরীজান
#পর্ব ৫৯
#Ishita_Rahman_Sanjida(Simran)
❌কপি করা নিষিদ্ধ ❌
সূর্য এখনও দিগন্তে দেখা দেয়নি। সহজে দেখা দিবে বলে মনে হয়না। কুয়াশাচ্ছন্ন চারিদিক,দূর দূরান্তের কিছুই দেখা যাচ্ছে না। যদিও কার্শিয়াং এর শীত দার্জিলিং এর মতো তীব্র নয়। এখানকার আবহাওয়া সারাবছরই আরাম দায়ক। তবুও আজ যেন কুয়াশা আর শীত অন্যদিনের তুলনায় একটু বেশিই। কাছের কিছুও স্পষ্ট দেখা যায় না। ধোয়াশা লাগছে সব, প্রকৃতিও যেন অপরূপ সৌন্দর্য ঢেলে দিয়েছে ধরণিতে। সেজন্যই বোধহয় কুয়াশাচ্ছন্ন পৃথিবীটা মোহনীয় লাগছে। ধীর পায়ে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে শায়ের। নারী অবয়বটির মুখটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না কুয়াশার জন্য। তাই সে সামনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে।
কুয়াশা ভেদ করে সে এলোকেশী তনয়ার সামনে এসে দাঁড়াল। সাত বছর পর মধুরতম কন্ঠস্বর শায়েরের কানে পৌঁছাল,
‘আসসালামুআলাইকুম মালি সাহেব!!!’
বহুদিনের তৃষ্ণা যেন নিবারণ হতে চলেছে শায়েরের। তবুও গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে ওর। শুষ্ক গলায় সালামের উত্তর দিল সে,’ওয়ালাইকুম আসসালাম পরীজান!!!’
-‘কেমন আছেন?’
পরীর এই প্রশ্নের জবাব দিল না শায়ের। উল্টে নিজেই প্রশ্ন করে বসল,’আমি কি আপনাকে জড়িয়ে ধরতে পারি? তৃষ্ণায় বুকটা খাঁ খাঁ করছে!! শীতকালকেও আমার কাছে তেজস্ক্রিয় চৈত্রের মত মনে হচ্ছে।’
দুকদম এগিয়ে এল পরী। পায়ে তার জুতো নেই। শীতল কার্শিয়াং কে সে পরিপূর্ণ ভাবে আজ উপলব্ধি করতে চাইছে সে। শায়েরের এই প্রশ্নের পরিবর্তিতে সেও প্রশ্ন করে,’আমি কি আপনাকে অনুমতি দিতে পারি?’
পরী মুচকি হাসল কথাটা বলে। বিপরীতে শায়ের ও মুচকি হাসল। তবে সে খেয়াল করল তার চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। পরীর চোখেও অশ্রুকণা সে দেখতে পেল। শায়ের কে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে পরী নিজেই এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরে শায়ের কে। স্বামীর গলায় মুখ ডুবিয়ে দিয়ে তার শরীরের ঘ্রাণ চুম্বকের মতো টেনে নিল নাকে। শক্ত করে শায়েরের গলা আঁকড়ে ধরে রইল সে। নিজের অর্ধাঙ্গিনীকে ধরে সাত বছরের তৃষ্ণা মেটাতে লাগল শায়ের। এত কাছে আসার জন্যই তো এত দূরত্ব ছিল তাদের মধ্যে। এরকম সুন্দর সমাপ্তি পাওয়ার জন্য সাত বছর কেন সাত যুগ দূরে থাকতে শায়ের রাজি। তবুও যেন ওর সমাপ্তিটা তার পরীজানের সাথেই হয়। পরীকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে ওর সারা মুখে চুমু খেয়ে আবার জড়িয়ে নিল নিজ বক্ষে। পরী শুধু স্বামীর পাগলামো দেখতে লাগল। আর অশ্রু বিসর্জন দিতে লাগল। পরীকে বুক থেকে সরিয়ে সোজা করে দাঁড় করাল শায়ের। তারপর বলল,’আপনি শীতের কাপড় পড়েননি কেন? ঠান্ডা লাগবে তো!’
তৎক্ষণাৎ নিজের গায়ের চাদরখানা পরীকে পড়িয়ে দিল সে।
-‘শীত আপনার লাগবে না? ঠান্ডা তো আপনারও লাগবে।’
-‘পাথরের অশ্রু আসে না,তেমনি ছেলেদের কষ্টও কষ্ট মনে হয় না।’
পরী মৃদু হাসল,’অনেক কথা জমে আছে মালি সাহেব। পাহাড় সমান কথা। আপনি শুনবেন??’
-‘আল্লাহ আপনার জন্যই আমাকে সৃষ্টি করেছেন। আমি আপনি সবসময়ই একে অপরের কথা শুনব। দূরে থাকলে একে অপরের কথা ভাববো। আপনি বলুন। আমি আজ আর কিছুই বলব না আপনার সব কথা শুনে যাব শুধু।’
-‘আমাদের দূরত্ব তাহলে ঘুচলো!!’
-‘আপনার আমার মাঝে দূরত্ব কখনোই ছিল না। এই সাত বছর আমি আপনার মধ্যেই ছিলাম। আর আপনি আমার ভেতর।’
-‘অনেক কষ্ট দিয়েছি আপনাকে আমি। ক্ষমা করুন আমাকে!!’
পরীর ঠোঁটে আঙুল চেপে ওকে চুপ করিয়ে দিয়ে শায়ের বলে উঠল,’আপনি ক্ষমা চাইছেন কেন? আপনি আপনার স্থানে সঠিক ছিলেন আর সর্বদা থাকবেন। আমি সেই আগের পরীজান কে সবসময় দেখতে চাই!!’
-‘কথা দিচ্ছি আর কখনোই আপনাকে দূরে ঠেলে দিব না। শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার সময় ও আপনাকে আমার চোখ দুটো খুঁজবে।’
-‘আমি যতটা নিঃশ্বাস নেব তা আপনার সাথেই নেব। যত দূর্গম রাস্তাই হোক না কেন তা আপনার সাথেই হাটব। আল্লাহ যদি তার ইবাদত ব্যতীত কারো ইবাদত করার হুকুম দিত তাহলে আমি একমাত্র আপনার ইবাদত করতাম পরীজান।’
টলমল চোখে পরী বলে,’এত সুখ আমি কোথায় রাখি
মালি সাহেব? আপনার ভালোবাসার গভীরতা যে আমি মাপতে পারছি না!’
-‘আমার ভালোবাসা অনেক গভীর পরীজান। এই গভীরতা মাপতে গেলে আপনি তল খুঁজে পাবেন না।তলে হারিয়ে যাবেন।’
প্রকৃতিকে চমকে দিয়ে কুয়াশা সরে যাচ্ছে। হয়তো সূয্যিমামা শীঘ্রই উঁকি দিবে। তার যেন হিংসে হচ্ছে এই মুহূর্তে। সে ব্যতীত প্রকৃতি স্বাক্ষী হয়েছে শায়ের পরীর ভালোবাসার। শায়ের পরীকে আবার বুকে টেনে নিয়ে সুধায়,’অবাধ্য মন শুধু আপনাকে পাওয়ার জন্য আরাধনা করে। আমার হৃদস্পন্দন শুনে বুঝতে পারছেন কি?’
পরী জবাব দেওয়ার সময় পেল না। তার আগেই নিজের সন্তানের মুখে ‘আম্মিজান’ ডাকটা তার হৃদস্পন্দন বাড়িয়ে দিল। শায়েরের বুক থেকে মাথা তুলে শোভনের দিকে তাকাল। দৌড়ে আসছে শোভন। পরী এগোল না,শোভন কাছে আসতেই হাটু মুড়ে বসে সে জড়িয়ে ধরল ছেলেকে। খুশিতে আত্মহারা মাকে পেয়ে শোভন। পরী ছেলের কপালে বার কয়েক চুমু খেল। এর থেকে সুন্দরতম দৃশ্য বোধহয় প্রকৃতিতে আর হতেই পারে না। সূর্য ধরণিতে উঁকি দিতেই শায়ের,পরী,শোভন সেদিকে তাকাল। এক নতুন দিনের সামিল হল তিনজন। সাথে নতুন জীবন শুরু করার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা বদ্ধ হল ওরা। শোভন দুহাতে মায়ের গাল ধরে দেখতে লাগল মাকে। ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে বলল,’আমার আম্মিজানের থেকে সুন্দর নারী এই পৃথিবীতে কেউ নেই।’
ছেলের কথায় হাসল পরী। মা ছেলেকে দেখে শায়ের ও হাসল। পরী আর ওর দূরত্ব শায়ের মেনে নিতে পেরেছে কিন্ত মা ছেলের দূরত্ব মানতে শায়েরের অনেক বেশি কষ্ট হয়েছে। তবে এছাড়া তখন কোন উপায় ছিল না। নাঈম তখন পরীর সাথে শোভনকে দিতে রাজি হয়নি। ওতটুকু বয়সে শোভনের কষ্ট হতো। পরীরা তখন পালিয়ে এসেছিল বাংলাদেশ থেকে। নৌকা করে পাড়ি দিতে হয়েছিল নদী। বর্ডার পার হতে অনেক কসরত করতে হয়েছে। নাঈম তা ভেবেই শোভনকে পরীর সাথে শোভন কে যেতে দেয়নি। সেদিন পরী বারবার অশ্রুসিক্ত নয়নে ছেলেকে দেখছিল। বেশিক্ষণ বুকে জড়িয়ে ধরে রাখতে পারেনি। সময় খুব কম তাই জীবন সঙ্গী আর সন্তান কে বিদায় দিয়ে পরী পাড়ি জমায় ভারতের কার্শিয়াং শহরে। সাথে ওর পরিবার ও। তবে সবাই আলাদা আলাদা ভাবে বর্ডার পার হয়ে এসেছে। পরবর্তীতে সবাই এক হয়েছে। জুম্মান পিকুল কে নিয়ে আগেই সেখানে ছিল। রুপালিকে জমিদার বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার আগেই জুম্মান আর পিকুল কে সে পাঠিয়ে দেয় কার্শিয়াং এ। পরবর্তীতে পরীরাও জুম্মানের কাছে চলে আসে। তার পর জুম্মান ই পরীর চিকিৎসা করায়। ভারতের চিকিৎসা পরিস্থিতি অনেক ভাল। ডাক্তার দেখানোর পর তারা পরীকে প্লাস্টিক সার্জারির কথা বলে। এতে সে তাড়াতাড়ি সুস্থ হবে। কিন্ত পরী জানত এতে ওর চেহারায় বেশ পরিবর্তন আসবে। সেজন্য পরী নিজেই নাকচ করে দেয়। থাক না তার পোড়া মুখ। সে তার মালির পরীজান হয়েই বাকি জীবনটুকু কাটিয়ে দিতে পারবে। কিন্ত বোনের সিদ্ধান্ত মেনে নিল না জুম্মান। প্লাস্টিক সার্জারি না করলেও চিকিৎসা চালিয়ে গেল সে। পরী শুধু বিষ্মিত নয়নে জুম্মান কে দেখেছিল সেদিন। এই কি সেই ছোট্ট জুম্মান? যাকে কোলে পিঠে করে বড় করেছে ও? সেই ছোট্ট জুম্মান আজ পরিপূর্ণ যুবকে পরিণত। সবার ভালোবাসায় পরীর চিকিৎসা বিফলে যায়নি। দ্রুতই সুস্থ হয়েছে পরী।
আঁকাবাঁকা পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে বাড়ির পথ ধরেছে পরী। তার একহাত শায়েরের হাত ধরে আছে। শোভন শায়েরের কোলে। নতুন দিনের নতুন সূচনা। জীবনে সবকিছুই আজকে নতুন লাগছে পরীর কাছে। পথ পেরিয়ে বাড়িতে এসে পৌঁছাল ওরা। দরজা খুলল জুম্মান। শায়ের পরী ভেতরে প্রবেশ করতেই জুম্মান বলে উঠল,’পরী আপা তোমার ছেলে ভিশন চতুর। সুন্দর ভাই বাইরে যেতেই সেও ইচ্ছা পোষন করে তোমার কাছে যাবে। আটকাতে পারলাম কই? ওকে পাহাড়ে নিয়ে যেতেই আমাকে বাড়িতে পাঠিয়ে দিল!!’
শোভন ঠোঁট ফুলিয়ে রাগ দেখিয়ে বলে,’মা বাবা আর ছেলের মাঝে অন্য কাউকে আসতে নেই তা জানো না বুঝি মামা?’
জুম্মান ভড়কে গেল শোভনের কথায়,’জানলে কীভাবে আমি তোমার মামা?’
শোভন হাসল জুম্মানের কথায়। ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে পরী জিজ্ঞেস করে,’চিনলে কীভাবে মামাকে? বলে দাও!’
-‘সেটা বলা যাবে না। বাকি সবাই আসুক দেখি চিনতে পারি কি না?’
শায়েরের কোল থেকে নেমে হট্টগোল শুরু করে দিল শোভন। একে একে সবাই এসে হাজির। শোভন প্রথমে মালার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। সম্পূর্ণ অবলোকন করল মালাকে। গায়ে শাল জড়ানো সুন্দর নারীটিকে চিনতে অসুবিধা হল না শোভনের। ওই খাতার বর্ণনা অনুযায়ী শোভন মালা আর জেসমিন কে চিনে ফেলল। কুসুম আর শেফালির নাম বললেও কোনটা কুসুম আর কোনটা শেফালি তা বলতে পারল না। মায়ের মতো সুন্দর আরেকটি নারীকে দেখে শোভন বলে উঠল,’তুমি মেজ আম্মু তাই না? কিন্ত তুমি তো মারা গিয়েছো? তাহলে?’
—-
দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। পুড়ছে কাগজগুলো। চেয়ারে বসে এক দৃষ্টিতে তা দেখছে নাঈম। পরীর পাঠানো সমস্ত চিঠি সে আজ পুড়িয়ে দিয়েছে। আর কোন বিন্দুমাত্র প্রমাণ সে রাখবে না। রুমি নাঈমের পাশে বসে বলল,’আমি এখন সব সত্য জানতে চাই নাঈম। এই চিঠিগুলো পরী আমার কাছে পাঠাত। কিন্ত পরী আর শায়ের এতদিন আলাদা ছিল কেন? পরীর বাবা কাকাকে যদি শায়ের খু*ন না’ই করে থাকে তাহলে কে করল? পরী?’
দীর্ঘশ্বাস ফেলে নাঈম,’কে বলেছে পরীর বাবা আর কাকা মারা গেছে?’
-‘মানে? এই বিষয়টা নিয়ে এতকিছু। আর তুই বলছিস ওনারা বেঁচে আছে? কীভাবে? তাহলে এত সব নাটকের প্রয়োজন ছিল কি? আরেকটু হলেই তো শায়েরের ফাঁ*সি কার্যকর হয়ে যেত!!’
নাঈম হেসে উঠল বলল,’শায়ের কে এতটাই বোকা মনে করিস তুই? তোর কি মনে হয়? ছোট্ট ছেলেকে ফেলে কি পরী এত সহজেই জমিদার বাড়িতে চলে গেল? আর কতগুলো মানুষ কে খু*ন করে চলে এল? সবকিছু কি এতই সহজ? আর শায়ের কে কি পুলিশ গ্রেফতার করেছে? নাহ শায়ের নিজেই ধরা দিয়েছে।’
#চলবে,,,
#চলবে,,,,,