ডিভোর্সের চার বছর পর প্রাক্তন স্বামীর সাথে দুমিনিট বসে কথা বলাটাও যেখানে অস্বস্তিকর সেখানে পুরো একটা রাত কিভাবে পার হবে! তাও আবার এতোটা কাছাকাছি। এতোদিন পর এভাবে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতিতেই দেখা হতে হলো দুজনের! এমন পরিস্থিতি থেকে তো পালানোও সম্ভব নয়। কথাটা মনে মনে ভেবেই অস্থির হয়ে ওঠলো ফাল্গুনী।
ঘাড় ফিরিয়ে পাশের সিটে তাকালো ফাল্গুনী। জাগ্রত চোখ বন্ধ করে জানালার পাশের সিটে মাথা এলিয়ে আছে। ঘুমিয়ে আছে নিরবে। চোখ খুলে যখন দেখবে তার পাশ ঘেঁষে বিধ্বস্ত অতীত বসে আছে, বসে আছে ফাল্গুনী নামের সেই মেয়েটা যাকে একদিন ঘারধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছিলো মা বোনের কথায়। বিচ্ছেদের মতো কালো অন্ধকারে ডুবিয়ে দিয়েছিল যাকে, সে আজ তার পাশ ঘেঁষে বসে আছে। তখন কি করবে? কি বলবে সে? রাতের এগারোটা বাজে। পুরো বাসে একটি সিট ও খালি নেই যে সেখানে গিয়ে সে বসবে।
ফাল্গুনী মনে মনে উপরওয়ালার কাছে প্রার্থনা করছে জাগ্রতর এই ঘুম যেনো আগামী সকাল হওয়ার পরই ভাঙে। দুজনকে যেনো মুখোমুখি না হতে হয়। কিন্তু বিধিবাম, তৎক্ষণাৎ পিছনের দিকের সিটে একটা বাচ্চা কান্না করে ওঠলো বাস কাঁপিয়ে। তুমুল কান্নার শব্দে জাগ্রত চোখ মেলে চেয়েছে। ফাল্গুনীর শ্বাস আটকে গেছে জাগ্রতকে চোখ মেলে চাইতে দেখে। শ্বাস নিতে ভুলে গেছে যেনো সে। চোখ বড়সড় করে তাকিয়ে আছে সে জাগ্রতর সদ্য ঘুম ভাঙা মুখশ্রীতে। কিন্তু জাগ্রত তার দিকে এখনও তাকায়নি। সে জানালার বাইরে তাকিয়ে আছে। বাইরের বোর্ডগুলো দেখে হয়তো বোঝার চেষ্টা করছে বাস টা কতদূর এগিয়েছে। নাম টা বোঝার চেষ্টা করছে স্থানীয় এলাকার।
ফাল্গুনী ভাবলো ওড়না দিয়ে মাথা ঢেকে নেবে। ওড়না টান দিয়ে মাথায় দিতে গিয়ে ঘটে গেলো আরেক বিপদ। ফাল্গুনীর কনুইয়ের গুঁতো লেগে গেছে জাগ্রতর বাহুতে। জাগ্রত তার বাহুতে আচমকা গুতো খেয়ে এবার ঘার ঘুরিয়ে চাইলো তার পাশের সিটে বসে থাকা রমণীর দিকে। দেখতে পেলো এক রমণী মাথায় দেড় হাত সমান ঘোমটা দিয়ে কাচুমাচু হয়ে বসে আছে। পড়নে সাদা কালো মিশেলের কামিজ আর ওড়না। হাত মোড়ামুড়ি করে যাচ্ছে অবিরত। হাল্কা বর্ণের হাতের লোমগুলো দেখা যাচ্ছে দাড়িয়ে আছে। মেয়েটার কি এই গরমে শীত করছে নাকি!
জাগ্রতর মনে এক মুহুর্তের জন্য এক অভাবনীয় চিন্তার সংক্রমণ হলো। তার মনে হলো যেনো মেয়েটি সদ্য বিবাহিতা কোন নারী। যে বসে আছে তার বাসর ঘরে। লজ্জা আর ভয়ে হাত পা মোড়ামুড়ি করে যাচ্ছে আর অস্থিরতায় গায়ে কাটা দিচ্ছে তার। সাথে আছে বিশাল এক ঘোমটা। তৎক্ষনাৎ তার কাছে অনুপস্থিতি লক্ষণীয় হলো লাল রঙের। সাদা কালোর জায়গায় লাল টুকটুকে রং হলেই ষোলোকলা পূর্ণ হতো।
জাগ্রত খানিক হেসে দিলো নিজের অজান্তেই। তবে হাসিটির স্থায়িত্ব বড়োই অল্প সময়ের। হটাৎ তার মনে পড়ে গেলো লাল টুকটুকে শাড়ি পড়ে পুতুলের মতো বসে থাকা এক ষোড়শী রমণীর শ্যামলা মুখাবয়ব। জাগ্রত চোখ বন্ধ করে ফেললো। মনে করতে চায় না সে। ভাবতে চায় না সেই সময়ের কথা। ওসব দুঃস্বপ্ন ছিল। শুধুমাত্র দুঃস্বপ্ন। একটুও মনে করবে না তাকে। একটুও না।
বাস চলছে সাই-সাই গতিতে। মাঝেমধ্যে বিকট হর্ণের আওয়াজ ভেঙে দিচ্ছে নিরবতার দেয়াল। ফাল্গুনীর চোখে ঘুম নেই এক রত্তি। গত এক ঘন্টা যাবত ঘোমটা দিয়ে বসে আছে সে চুপচাপ। যেনো ঘুমে সে মহা অচেতন। এ ঘুম যেনো ভাঙার নয় কোন ঝাঁকুনি বা হর্ণ এর প্রহারে। জাগ্রত জেগে আছে। কানে এয়ারফোন গুঁজে মাথা এলিয়ে রেখেছে। দৃষ্টি তার বাইরের দিকে। মাঝে মাঝে জোনাকির মতো আলোর বহর চোখে পড়ছে তার। কোথাও ঝাঁকে ঝাঁকে কোথাও বিচ্ছিন্নভাবে।
বরিশাল এর গৌরনদী বাস কাউন্টার থেকে বাস এ উঠেছে ফাল্গুনী। বাস এ ওঠার পর তাড়াতাড়ি বাস ছেড়ে দিচ্ছিলো। দুটি লাগেজ ও একটি ব্যাগ বক্সে রাখতে গিয়ে সময় নষ্ট হয়েছে বেশ কিছুটা। তাই তারাহুরো করে সিট খুঁজে বসে পড়েছে বিনা খেয়ালে। যদিও এটুকু খেয়াল ছিলো পাশের সিটে একজন পুরুষ বসে আছে আর টিকিট কাউন্টারের লোকটাও বলেছিলো সিট শেয়ারিং করতে হবে একজন পুরুষ মানুষের সাথে। নয়তো দুদিন পর টিকিট বুক করতে হবে। কিন্তু বাড়ি ফেরাটা অতীব জরুরি হওয়ায় মেনে নিতে হয়েছে। একদিন দেরি করাও সম্ভব নয় তার।
বাসে ওটার পর বসার সিটটি আরামদায়ক অবস্থায় সমন্বয় করে সুস্থির হতেই তার খেয়াল হয় পাশে বসা পুরুষ মানুষটি কোন অজ্ঞাত কেউ নয়। মানুষটি তার প্রাক্তন। প্রাক্তন বলাই যায়। বিচ্ছেদ তো বিচ্ছেদ-ই। হয়তো আগের কোন কাউন্টার থেকে বাসে উঠেছে । তাই ঘুমিয়ে ছিলো এতোক্ষণ।
জাগ্রতর হটাৎ খেয়াল হলো পাশের সিটে বসা মেয়েটি যেন নিশপিশ করছে। কেমন মোড়ামুড়ি করছে। জাগ্রত ভালো করে চেয়ে দেখলো, বোঝার চেষ্টা করলো বিষয়টি। একে-তো অচেনা একটি মেয়ে তারওপর আবার এত বড় একটা ঘোমটা দিয়ে রেখেছে। কিছু জিজ্ঞেস করতেও সংকোচ হচ্ছে। মেয়েটির অস্বাভাবিক নড়াচড়া বেড়েই চলেছে। মানবিকতার খাতিরে জাগ্রত না পেরে জিজ্ঞেস করেই বসলো।
‘আপনার কি কোন সমস্যা হচ্ছে? অসুস্থ বোধ করছেন? পানি খাবেন?’
ফাল্গুনী জবাব দিলো না। তার পেটের ভেতর ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। গলা বেয়ে ওঠে আসছে যেনো পেটের নাড়িভুড়ি সব। কোনভাবেই ঠিক হয়ে বসতে পারছে না। গত আধ ঘন্টা যাবত এই ভয়টাই সে পাচ্ছিলো। আসার সময় বমির ট্যাবলেট টা খেয়ে আসা হয়নি মনের ভুলে। তাই এই অবস্থা। যেকোনো সময় বমি হয়ে যাবে। এবার কি হবে! জাগ্রত তো জানালার পাশে বসে আছে। তাকে সরতে বলতে গেলেও তো কথা বলতে হবে। গলার আওয়াজ যদি চিনে ফেলে। তাহলে তো মহাবিপদ।
জাগ্রত তার প্রশ্নের জবাব পেলো না। খানিক বিরক্ত হলো তাতে। ভাবলো মুখ ফুটে বললে কি সমস্যা বেড়ে যাবে নাকি। কিন্তু মেয়েটির এমন অস্বাভাবিক নড়াচড়া দেখে ঠিক থাকতে পারলো না। কিছু একটা ভাবলো। তারপর বললো,
‘আপনার বমি পাচ্ছে? তাহলে আপনি আমার সিটে এসে বসুন আমি আপনার সিটে যাচ্ছি। আর এই নিন পানির বোতল। ধরুন। আপ…’
জাগ্রত তার কথা শেষ করে ওঠতে পারেনি। তার আগেই হুমড়ি খেয়ে পড়েছে ফাল্গুনী তার ওপরে। জানালাটা খোলাই ছিলো। ফাল্গুনী নিয়ন্ত্রণ করে ওঠতে পারে নি। গলা বেয়ে ওঠেছে তার। তাই গা বাঁচাতে জাগ্রতর ওপর দিয়ে গিয়ে জানালার বাইরে মাথা রেখে বমি করে দিয়েছে। মাথায় এখন ঘোমটা তো দূর ওড়নাটা তার কাঁধ ও ছেড়ে দিয়েছে। এক কাঁধে ঝুলে আছে কোনমতে।
জাগ্রত চোখমুখ খিঁচে কোনমতে বসে আছে। রাগে মাথা দপদপ করছে। যেনো আগুন জ্বলছে মাথায় দাউদাউ করে। মেয়েটার কি সাহস। এভাবে একটা পরপুরুষ এর গায়ে লেপ্টে দাড়িয়ে তারপর বমি করছে। এমন ভাবে আছে যে ওপাশে সরে ও বসতে পারবে না সে। এতোক্ষণ তো একেবারে প্যাকেট হয়ে বসেছিলো। যেনো মুখ দেখালেও পাপ হয়ে যাবে। আর এখন! যখন থেকে সমস্যা মনে হচ্ছিল তখন জানালার পাশের সিটে এসে বসলেই হতো। তাকে একবার সিট পরিবর্তনের জন্য অনুরোধ করলে কি সে মানা করতো নাকি। এখন আবার বমি করে তার গা না মাখালেই হলো।
ফাল্গুনী বমি করে ক্লান্ত হয়ে গেছে। হাতে আছে জাগ্রতর দেওয়া পানির বোতল।জানালার বাইরে মুখ রেখেই মুখটা ধুয়ে কুলকুচি করে নিলো। এবার বেশ ভালো লাগছে। রাস্তার কিনারের দিকে সিট হওয়ায় বাইরে মাথা বের করতে সুবিধা হয়েছে। এপাশে কোন গাড়ি চলাচল করছে না। নয়তো বিপদ হতো। মাথা ভিতরে আনতে গিয়ে ফাল্গুনীর টনক নড়লো। কি করেছে সে এতোক্ষণ! আর এখনই বা মাথা ভেতরে করে তার মুখোমুখি হবে কি করে। এভাবে থাকতে থাকতে তো কোমরটাও ধরে এসেছে। কতক্ষণ মানুষটার গায়ের ওপর দিয়ে থাকবে এভাবে। মানুষটা যে তাকে জানালা দিয়ে এখনো ছুড়ে মারেনি তাই তো কপাল।
জাগ্রত বুঝতে পারছে অজানা মেয়েটির বমি এখন বন্ধ হয়েছে। এমনকি হাত মুখ ও ধুয়ে নিয়েছে। কিন্তু বুঝতে পারছে না মেয়েটি এখনও সোজা হয়ে নিজের সিটে গিয়ে কেনো বসছে না। জোর করে শক্তি খাটিয়ে আরও বমি করতে চাচ্ছে নাকি! নাকি জানালার বাইরে মাথা বের করে নিজেকে কোন হিরোইন ভেবে নাকে মুখে বাতাস লাগিয়ে চুল উরানোর ধান্দা করছে। ইচ্ছে করছে টেনে হিঁচড়ে জায়গা মতো বসিয়ে দিতে। জাগ্রত ইতস্তত হয়ে ডেকে ওঠলো। খানিক কাঠিন্যে বলে ওঠলো
‘এইযে শুনছেন। আপনি কি দয়া করে নিজের জায়গায় বসবেন প্লিজ। আর নয়তো একটু কষ্ট করে সিট থেকে বেড়িয়ে ওপাশে সরে দাড়ান। আমি বের হচ্ছি তারপর আপনি জানালার পাশে বসে পড়ুন। আমি আপনার সিটে বসছি। তবুও সরুন প্লিজ।’
ফাল্গুনীর এবার মাঝ সমুদ্রে হাবুডুবু খাওয়ার যোগাড়। এবার কি করবে! জাগ্রতর নজর এড়িয়ে কি করে বসবে সে সিটে। কোমরটাও তো এভাবে থাকতে সায় দিচ্ছে না। মনে হচ্ছে যেনো হাড়গুলো সব আলাদা হয়ে যাচ্ছে। তাহলে কি সেই ফেলে আসা অতীতের সম্মুখীন এভাবেই হতে হবে। আর কোন উপায় ও তো নেই। লোকটার মুখোমুখি হওয়ার চাইতে তো জানালা দিয়ে লাফানোর অপশনটা বেশি করে টানছে।
জাগ্রতর বিরক্তি আর ফাল্গুনীর ভয়ের পর্দা ভেদ করে হটাৎ উদয় হলো এক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। বাসটি ডানদিকে মোড় নিতে গিয়ে একটি বাইকের সম্মুখীন হতে হতে বেঁচে গেছে। সামান্য ভেদে এক্সিডেন্ট হওয়া থেকে বেঁচে গেছে বাইকটি। এতে সম্পূর্ণ দোষ ছিলো বাইক চালকের। তাই তাড়াতাড়ি বাইক নিয়ে কেটে পড়েছে সে। বাস চালক ও থেমে না থেকে চলতে শুরু করেছে তীব্র গতিতে। এই বাইক আর বাস একে অপরের মুখোমুখি না হলেও মুখোমুখি হয়েছে অন্য দুজন। বাসের ঝোঁক সামলাতে না পেরে ফাল্গুনী তার নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে। আষ্টেপৃষ্ঠে জায়গা করে নিয়েছে জাগ্রতর কোলে। জাগ্রতও আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে ফাল্গুনীকে। দুজনের দুরত্ব এখন বহুদূরে।
#পুনর্মিলন
#গুঞ্জন_চৈতি
#সূচনা_পর্ব
~চলবে