#পুনর্মিলন
#গুঞ্জন_চৈতি
#পর্ব_৬
প্রথমে তা-ও মনে হচ্ছিল তুমি আমায় দেখে চ’ম’কে’ছ, অ’স্ব’স্তি’র স্বী’কা’র হচ্ছো, হয়তো কিছুটা ভ’য় ও পেয়েছো কিন্তু না, তারপরেই আবার ধীরে ধীরে ব’দ’লে যাচ্ছো! তোমাকে আমার অ’চে’না লাগছে, ব’ড্ড অ’চে’না। চার বছরে একটা মানুষের এতোটা ব’দ’ল কি সত্যিই অ’ভা’ব’নীয় নয়?
‘আচ্ছা, আমরা দুজন মু’খো’মু’খি হওয়ার পর আপনার মুখ নিঃ’সৃ’ত প্রথম কথা যেনো কি ছিলো? মনে আছে?’
‘এটা বুঝি আমার প্রশ্নের উত্তর ছিলো?’
‘ওকে। তাহলে চুপচাপ বসে থাকুন। কারোও কোন কথা বলার প্রয়োজন নেই আর প্রশ্নোত্তরের পর্ব বাড়ানোর ও দরকার নেই। কোন একজন যাত্রী নেমে গেলে আমি নাহয় সিট ব’দ’লে নেবো।’
জাগ্রত দমে গেলো। বিরক্তি ভরা কন্ঠে নরম করে বললো,
‘আমার অতো গুছিয়ে মনে নেই। তোমার তো মনে আছে, তুমিই বলো। বলে তোমার কথা শে’ষ করো তারপর আমাকে আমার প্রশ্নের উত্তর দাও, প্লিজ।’
‘বলেছিলেন টাঙ্গাইলে নিজের বাড়ি রেখে আমি বরিশালে কেনো? নিজের বাড়িতে কি জায়গা হয়নি নাকি, বরিশালে তো আমার কোন আত্মীয় নেই তবুও সেখানে কেনো। নিজের বাড়িতে মানিয়ে থাকতে পারিনি ইত্যাদি ইত্যাদি। এরকম কিছু কথাই বলেছিলেন রাইট?’
জাগ্রত জবাব না দিয়ে অপলক চেয়ে রইলো। ফাল্গুনী উত্তরের আশায় বসে রইলো না। বলতে শুরু করলো,
একটু আগেই আবার প্রশ্ন করলেন, সে’পা’রেশ’ন এর দিন থেকে এ পর্যন্ত আমি কোথায় ছিলাম। তাই না?’
‘কি বোঝাতে চাচ্ছো?’
‘মুখোমুখি হওয়ার পর নিজেকে আমার সামনে এমন ভাবে উপস্থাপন করলেন যেনো আমার খোঁজ খবর আপনি কিছুই জানেন না। ক’স্মি’নকা’লে কখনো শোনেন ও নি আমি আমার বাড়িতে নেই। মানে টাঙ্গাইলে নেই। তারপর বেশ আ’য়ে’শ করে তু’চ্ছ’তাচ্ছি’ল্য করলেন আমায়। ছো’ট করার কোন ফাঁ’ক ফোকড় ও বাদ দেন নি। তারপর একটু আগে আবার প্রশ্ন করছেন সে’পা’রে’শন এর দিন থেকে এ পর্যন্ত আমি
কোথায় ছিলাম। বিষয়টা হা’স্য’কর না? আপনি সব জেনেও এমন ভাবে নাটক চালিয়ে গেলেন যেনো আপনি কিছুই জানেন না আমার ব্যাপারে। তা এসব না’ট’কে’র মূল উদ্দেশ্য এই তো যে আমি যেনো জানতে না পারি আপনি আমার খোঁ’জ রেখেছেন। তাহলে আপনার মেল ই’গো’তে ঠে’স লাগতো। তাই না?
জাগ্রত আবারও নি’য়’ন্ত্রণ হারালো। সব ভুলে গেলো আর রা’গে’র বসে চি’ৎ’কা’র করে বলে উঠলো,
‘হ্যাঁ হ্যাঁ আমি তোমার খোঁ’জ নিয়েছি, তোমায় মনে করেছি, তোমাকে এক পলক দেখার আশায় বারবার ছু’টে গেছি ওই বাড়ি কিন্তু কোন খোঁ’জ পাইনি। কেউ বলেনি তুমি কোথায়। তারপর একবছর বাদে যখন সে’পা’রে’শন এর…’
‘কেউ খোঁ’জ দেয়নি মানে! বুঝলাম না ব্যাপার টা। কোথায় খোঁজ করেছেন আর কে খোঁজ দেয় নি?’
‘কোথায় আবার নেবো? যেখানে তোমরা থাকতে সেখানে নিয়েছি। তোমার জেঠুমনির বাড়িতেও খোঁজ করেছি।অনেক খোঁ’জ নেওয়ার চেষ্টা করেছি তোমাদের, পাই নি। শুধু এটুকু জানতে পেরেছিলাম তোমরা কেউ ও ভাড়া বাসায় আর থাকো না। বাড়িওয়ালাও এর থেকে বেশি কিছু বলেনি। কোথায় আছো তা জানতে পারি নি। পু’লি’শের সাহায্য নেওয়ার মতো কোন সুযোগ ছিলোনা। তাহলে অনেক কিছুর জের নিয়ে টানাটানি হতো। এমনিতেও কোর্টের ও নির্দেশ ছিলো এক বছর নাগাদ কেউ কারো লাইফে ইন্টার ফেয়ার করতে পারবো না। তুমি ভরণ পোষণ নিতেও অ’স্বী’কার করেছিলে তাই তোমার সাথে যোগাযোগ ও ছিলো না। তোমার ফ্যামিলিরও কোন খোঁজ ছিলো না। শেষে নি’রুপা’য় হয়ে ছেড়ে দিয়েছিলাম সব আশা। তারপর দিন যাচ্ছিলো আর তোমায় নিয়ে অ’ভি’যোগ এর পাল্লা ভারী হচ্ছিলো। ক্ষো’ভের পাল্লা বেড়েই যাচ্ছিলো। ভাবতাম তোমায় সামনে পেলে সবার আগে দু গা’লে দু চ’ড় বসাবো। খুব অ’প’মা’ন করবো, ঘৃ’ণা করবো, সবার সামনে ছো’ট করবো, কাঁদাব, আর আর আর…আ……..
কথা বলতে বলতেই জাগ্রত চিৎকার করে উঠলো। চিৎকার করে মাথা চেপে ধরে বললো,
‘তুমি আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভু’ল ছিলে সবচেয়ে বড় ভু’ল। আমাকে নিঃ’শে’ষ করে দিয়েছো তুমি। নিঃ’শে’ষ করে দিয়েছো। তুমি কখনোই সু’খি হতে পারবে না, কখনোই না। কোনোদিনও না। তোমাকে মে’রে ফেলতে ইচ্ছে করে আমার আর তারপর নেজেকে।’
বাসের সকল যাত্রীর মনোযোগ এখন জাগ্রত আর ফাল্গুনীর দিকে। তবে এখন আর কেউ বিরক্ত হচ্ছে না। বেশিরভাগই মজা লুটছে আর নিজেদের মধ্যে স’মা’লো’চ’না’র ঝ’ড় তুলছে। কিছু মানুষ উৎ’সুক নয়নে দেখে যাচ্ছে শুধু, কোন প্রতি’ক্রিয়া ছাড়া। আর কয়েকজন ব্যা’থি’ত হচ্ছে একটি সম্পর্কের বি’চ্ছি’ন্নতার নজির দেখে। আফসোস করছে একটি সম্পর্কের ভাঙন দেখে। ক’ন্ট্রা’ক্টর ও সামনে আসেনি। একটু দূরে দাঁড়িয়ে দেখে যাচ্ছে সব। আর মাঝে মাঝে বাস চালককে গিয়ে এদিকের খবর দিচ্ছে। এরই মধ্যে বাস থেমে গেলো। মির্জাপুর এসে পৌঁছিয়েছে বাস। দুজন যাত্রী নেমে গেলো সেখানে। ভোর হতেও দেরি নেই। আলো ফুটতে শুরু করে দিয়েছে অল্প অল্প করে। কিছুক্ষণের পরেই দেখা মিলবে হলদে বামনের। অ’জ’স্র আলো আর অল্প তে’জ নিয়ে পদার্পণ করবে পৃথিবীর বুকে। তারপর ধীরে ধীরে নিজেকে মেলে ধরবে প্রকৃতির সোনামাখা অঙ্গে। দূর হবে সমস্ত কালো অন্ধকার।
‘উঠে দাঁড়ান।’
জাগ্রত দু’হাতে চুল খামচে ঝুঁ’কে বসেছিলো। এর মধ্যেই কানে আসে ফাল্গুনীর নরম কন্ঠ। কন্ঠ শুনে মনেই হচ্ছে না এতোক্ষণ কিছু হচ্ছিল তাঁদের মধ্যে। জাগ্রত মাথা তুলে অ’গ্নি’চূর্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো ফাল্গুনীর চোখে। তবে ফাল্গুনীর দৃষ্টি এদিক সেদিক করে হ্যান্ড পার্স গোছাতে ব্য’স্ত। একবারও নয়ন জোড়া তুলে দেখেনি জাগ্রত আর তার দৃষ্টিকে। কেনো দেখেনি তা শুধু সেই জানে। নিম্নমুখি হয়েই জাগ্রতকে কথা ছুড়ে দিয়েছে সে।
পার্স ব্যাগটি হাতে নিয়ে চল’ন্ত বাসেই উঠে দাঁড়ালো ফাল্গুনী। জাগ্রতকে আবারও বললো উঠে দাঁড়াতে। জাগ্রত বুঝে গিয়েছে ফাল্গুনী তার কোন কথার উত্তর দেবে না। এড়িয়ে যাবে প্রতিটা কথা। কিন্তু তার পেটের কথা ক’লা-কৌ’শল করে ঠিকই বে’র করে নিয়েছে।
ফাল্গুনীর চোখে চোখ রেখে জাগ্রত বললো,
‘বসে পড়ো। কেননা গন্তব্যে পৌছানোর আগ পর্যন্ত আমি তোমার সাথ ছাড়ছি না।’
‘সাথ তো চার বছর আগেই ছে’ড়ে’ছেন। এখন আবার নতুন করে না’ট’ক কেনো করছেন?’
‘এক হাতে কখনো তালি বাজে না। যাই হোক, আমি উঠছি না আর না তোমাকে যেতে দিচ্ছি। চুপচাপ বসে পড়ো আর আমার প্রত্যেকটা প্র’শ্নে’র উত্তর দাও।’
ফাল্গুনী বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো জাগ্রতের দিকে। হয়তো ভেবে নিলো কিছু আর ছ’ক ক’ষে করে নিলো কোন প’রি’ক’ল্প’না। তারপর বসে গেলো নিজের সিটে। জাগ্রতকে বললো,
‘আমি যদি নিজে থেকে কিছু না বলি তাহলে আপনার সা’ধ্যি নেই আমায় দিয়ে কিছু বলানোর। সেটা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন?’
জাগ্রত শুধু চেয়ে রইলো আর এক দী’র্ঘ’শ্বা’স টেনে নিলো। কোন জবাব দিলো না। ফাল্গুনী বললো,
‘আপনার সমস্ত প্র’শ্ন’গু’লো যদি সাজিয়ে একের পর এক মানে একবারে বলে ফেলতে পারেন তাহলে তার উত্তর আমি দেবো। অন্যথায় নয়। আর হ্যাঁ কোন প্র’শ্ন বা’কি রয়ে গেলে বা ভু’লে গেলে সেটা পরে রিপিট করতে পারবেন না। বলুন রাজি?’
ফাল্গুনীর এমন যু’ক্তি’হী’ন কথার পৃষ্ঠে প্রত্যুত্তর করলো না জাগ্রত। যেকোন শ’র্তে’ই সে রাজি। তাই এক চু’ল ও সময় ন’ষ্ট করলো না প্রশ্নের বহর সাজাতে। তৎ’ক্ষ’না’ৎ বলে উঠলো,
‘সে’পা’রে’শন এর পর থেকে এ পর্যন্ত কোথায় কোথায় ছিলে? কার সাথে ছিলে? হটাৎ করে সে’পা’রে’শ’ন এর দিন পুরো পরিবার মিলে গা’য়ে’ব কেনো হয়েছিলে? আর আমার পরে তোমার জীবনে কি কোন পু’রু’ষ এসেছে? এসে থাকলে সে কি সোহাগ? সোহাগ তোমাকে ভালোবাসে? তুমি কি সোহাগ কে ভালোবাসো?’
শেষ প্রশ্নে অ’জ’স্র দী’র্ঘ’শ্বা’স আর বুক ফাঁ’টা আ’র্ত’না’দ এর তী’ব্র গ’ন্ধ যেনো ভেসে ভেসে বেড়াচ্ছে। যে গ’ন্ধে খেই হারালো ফাল্গুনী। তবুও সংযত করলো নিজেকে। বেশ মনেযোগ দিয়ে জাগ্রতর সমস্ত কথা শুনলো। তারপর বললো,
‘আপনি তাহলে এটুকুই জানেন! আর এটুকুই আপনার অভিযোগ?’
‘এটুকুই জানেন মানে কি? হ্যাঁ! কি হলো উত্তর দাও। আচ্ছা, এতোগুলো প্রশ্ন হয়তো ভুলে গেছো। থাক আমি মনে করিয়ে দিচ্ছি।’
‘তার দরকার নেই, আমি সহজে কিছু ভুলি না। চারবছর আগের অতীতই এখনো ভুলতে পারলাম না। সদ্য শ্র’ব’ণ করা প্রশ্নগুলো কি করে ভুলি?’
‘তাহলে বলো।’
‘এক্ষুনি যে বলতে হবে এমন তো কোন কথা ছিলোনা। বলবো বলেছি তবে তা কবে বা কখন বলবো তা তো বলিনি। বলেছি কি?’
জাগ্রত ক্রো’ধে গ’র্জ’ন করে বললো, ‘তাহলে বলতে কেনো বললে?’
ফাল্গুনীর সোজাসাপ্টা জবাব, ‘জেনে নিলাম আপনি ঠিক কতোটা জানেন আর কতোটা জানতে চান।’
জাগ্রত ক্রু’দ্ধ হলো। ক্রো’ধে তার গাঁ যেনো ঈ’ষ’ৎ কাঁ’প’ছে। কঠিন ধাঁ’চে ঝট করে উঠে পরলো সিট থেকে আর এক সিট সামনে খালি হওয়া সিট টায় গিয়ে বসে পড়লো ধপ করে। ফাল্গুনী স্ব’স্তি’র শ্বা’স নিলো। সিটে মাথা এলিয়ে দিয়ে বু’কে হাত দিলো হৃ’ৎ’স্প’ন্দ’নে’র হিসেব
নিকেশ করতে। হিসেবে বড্ড গ’র’মি’ল লাগছে। যেনো হৃ’দ’য় থেকে কেউ ধুকপুক করা কম্পন য’ন্ত্র চু’রি করে নিয়েছে। তাই হৃদয়ের ক’ম্প’ন’কৃ’ত হিসেবে এতো গ’র’মিল। হটাৎ অনুভব হলো পাশের সিটে কেউ এসে বসেছে। ফাল্গুনী চোখ না খুলেই বলে উঠলো,
‘ফিরেই যখন আসবেন তাহলে গেলেন কেনো?’
‘আপনি কি সারাজীবন থেকে যেতে বলছেন?’
ফাল্গুনী ত’ড়ি’ৎ বেগে চোখ মেললো। গলাটা তো অ’চে’না। পাশে দৃষ্টি ফেললে দেখতে পায় জাগ্রত নয় বসে আছে অ’চে’না একটি ছেলে। চোখ ঘোরালে আবার চো’খে পড়ে জাগ্রত সামনের সিট থেকে সিটের উপর দিয়ে মাথা উঁ’চু করে চে’য়ে আছে হ’ত’বা’ক হয়ে। অচেনা পুরুষ কন্ঠে বুঝি আ’ন্দো’ল’ন শুরু হলো তার বুকে!
#পুনর্মিলন
#গুঞ্জন_চৈতি
#পর্ব_৭
ফাল্গুনী তড়িৎ বেগে চোখ মেললো। পাশে জাগ্রত নয় বসে আছে অ’চে’না একটি ছেলে। চোখ ফেরালে আবার চোখে পড়ে জাগ্রত সামনের সিট থেকে সিটের উপর দিয়ে মাথা উঁচু করে চেয়ে আছে হ’ত’বা’ক হয়ে। দুদিকের পরিস্থিতি বুঝে ফাল্গুনী মাথায় হাত চেপে নিজেই নিজেকে বলে উঠলো, ‘বি পজেটিভ ফাল্গুনী! বি পজেটিভ।’
‘আমারও!’
অচেনা ছেলেটির মুখে ‘আমারও’ শব্দটি শুনে প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টিতে তাকালো ফাল্গুনী। জিজ্ঞেস করলো, ‘মানে?’
ছেলেটি মিষ্টি হেসে জবাব দিলো, ‘ব্লাড গ্রুপ। আমারও বি পজেটিভ।’
‘আমাকে কি আপনার রক্তশুন্যতার রুগী বলে মনে হচ্ছে?’
‘কই নাতো…।
‘তাহলে ব্লা’ড গ্রু’পের প্রচার করতে এসেছেন যে।’
‘হা হা হা। প্র’চা’র করতে আসিনি পরিচিত হতে এসেছি। এতোক্ষণ তো স্কোপই পাচ্ছিলাম না। আর কিছুসময় পর তো আপনি নেমে যাবেন। তাই সিট খালি হতে দেখে চলে এলাম।’
‘আপনি চেনেন আমায়?’
‘না আপনাকে চিনি না তবে আপনাদের দুজনের মাঝে এই দুরত্বটাকে আমি চিনি।’
‘দুরত্ব চেনা যায় না, অনুভব করা যায়।’
‘হ্যাঁ, ভালো বলেছেন। আমি অতো গুছিয়ে বলতে পারি না। যাইহোক….’
ছেলেটাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে ফাল্গুনী চট করে বলে উঠলো,
‘আপনার সিট কোথায়?’
‘আপনার সিট এর এক সিট পিছনে।’
‘সেখানে গিয়ে বসুন। আমি অচেনা কারো সাথে সিট শেয়ার করে এভাবে কথা বলতে কমফোর্টেবল নই।’
‘যদি কিছু মনে না করেন একটা কথা বলতে চাই।’
‘বলুন।’
‘আপনাদের পিছনে বসার দরুন প্রথম থেকে শুরু করে এতোক্ষণ অবদি আপনাদের দুজনের সমস্ত কথাই আমি শুনেছি। আপনাদের সম্পর্কের অতীত ও বর্তমান নিয়ে আমার ছোটখাটো একটা ধারণা হয়ে গেছে। আমার মনে হয়েছে আপনারা এখনো ভালোবাসেন দুজন দুজনকে। আলাদা কেনো হয়েছেন জানি না। আলাদা হওয়ার অযুহাত খুজলে মাইলের পর মাইল লম্বা লিস্ট খুঁজে পাওয়া যায়। কিন্তু ভলোবেসে একসঙ্গে থাকার জন্য একটি অযুহাত ও-ই যথেষ্ট। সেই একটি অযুহাত খুঁজে নেবেন। পৃথিবীর সবথেকে সুখী ব্যক্তি মনে হবে নিজেকে। আমিও সেই পথেরই পথিক। অযুহাত খুজতে ও খুঁজে দিতে নেমে পড়েছি ভাঙ্গনের রাজপথে। আপনাদের মাঝে আমার মতোই আরেক অধমের ছিটেফোঁটা নজরে এলো, তাই আগ বাড়িয়ে কথা বলতে এলাম। আর প্রথম কথাটা মজা করে বলেছিলাম মাফ করবেন। ভালো থাকবেন। আসছি।’
ফাল্গুনী ভাবলেশহীন। যেনো প্রাণহীন কোন কাঠের পুতুল। বসে আছে শক্ত হয়ে। জাগ্রত প্রথমে ছেলেটার কথা শুনে সিট ছেড়ে দাড়িয়ে পড়ে ক্ষুদ্ধ নয়নে তাকিয়ে থাকলেও পরের কথাগুলো শুনে বসে পড়েছে সিটে। চুপচাপ বসে শুনে গেছে কথাগুলো। আর তারপর অতীত হাতড়ে খোঁ’জ শুরু করেছে সেই একটি অ’জু’হা’তের। যা নিয়ে থাকা যেতো একসাথে। ছিলো তো তেমন হাজারও অজুহাত, ছিলো অনুভূতির বহর। কিন্তু বুঝতে বড্ড দেরি হয়ে গেছিলো কিনা। তাই ধরে রাখতে পারেনি তার হৃদয়হরনীকে।
ফাল্গুনী ভাবছে, ভালোবাসার পূর্ণতা শুধু একজন মানুষকে ঘিরে হয়না। পরিবারের সবাইকে নিয়ে হয়। আর যদি পরিবার সে পূর্ণতা না দিতে পারে তাহলে একমাত্র অবলম্বন থাকে নিজের স্বামী। আর সেই স্বামী যখন বিবেক বিবেচনা না করেই ঘোষণা করে দেয় ‘তুমি যোগ্য নও’, অবিশ্বাসের পর্দা টাঙানো চোখে তাকায় আর চোখে চোখে চোখ রেখে দৃষ্টি দিয়েই ঘোষণা করে দেয় ‘তুমি মিথ্যেবাদী’ তখন কোন অযুহাত ও-ই পারে না সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে। ফিকে পরে যায় সব অযুহাত। রঙচটা ঘুনে খাওয়া লাগে সম্পর্ক আর জং ধরে যায় সকল অনুভূতিতে।
বাস থেমেছে টাঙ্গাইল শহরে। বেশ কিছু যাত্রী নেমে গেছে এরইমধ্যে। সবাই যার যার কাছে থাকা রিসিট দেখিয়ে ব্যাগপত্র বের করে নিচ্ছে। জাগ্রতের তেমন বড় কোন ব্যাগ ছিলো না সাথে। তাই সে এক কোনায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে যাচ্ছে ফাল্গুনীকে। সে এখন নিজের ব্যাগপত্র বের করায় ব্যাস্ত। ফাল্গুনীর থেকে চোখ সরিয়ে ফোনের স্কিনে চোখ রাখলো। ছয়টা বাজে। জাগ্রত লুকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটি দোকানের কোনায় গিয়ে। বাস থেকে নেমেই সিএনজিতে উঠেছিলো। তারপর ফাল্গুনীর চোখের আড়াল হতেই নেমে গেছে। ডাবল ভাড়া দিয়ে সিএনজি বসিয়ে রেখে দিয়েছে খানিক সামনেই। ফাল্গুনী কোথায় যায় এবং কার সাথে যায় তা সে দেখতে চায়। কেউ নিশ্চয়ই নিতে আসবে বা এসেছে। নাকি একা যাবে? যদি বাড়িতে যায় তাহলে অনায়াসে আবারও দেখা করা যেতে পারে। আর খোলাসাও হবে অনেক কিছু। দুরত্ব তো বেশি নয়। এক ঘন্টাও লাগে না। কিন্তু যদি অন্যকোথাও যায় তাহলে!
ফাল্গুনী ব্যাগপত্র নিয়ে সুস্থির হয়ে দাঁড়ালো। আশেপাশে চোখ বুলিয়ে দেখতে পেলো না জাগ্রতকে। সিএনজি নিয়ে চলে যেতে দেখেছে সে জাগ্রতকে। একটি অটো ভাড়া করে রওয়ানা হলো নিজ গন্তব্যে। অটো যতোটা পথ এগোতে থাকলো ফাল্গুনীর বুকটা ততোধিক ভারী হতে থাকলো। মানুষটাকে আসার সময় শেষবারও দেখা হলো না। কি নিষ্ঠুরতম অনূভুতি হচ্ছে হৃদয়পটে। যাওয়ার আগে শেষ দেখাও করে গেলো না। শুধু শুধুই তাকে দেখাতে টাঙ্গাইলে নেমে গেলো। একেবারে এলেঙ্গা গিয়ে নামলেই হতো।
জাগ্রত ফাল্গুনীকে অটোতে উঠতে দেখে অবাক হলো। হিসেব অনুযায়ী ওর তো এখন সিএনজি নিয়ে সখিপুর এর দিকে যাওয়ার কথা। উল্টোদিকে যেতে দেখে অবাকই হলো। বিস্ময়-বিহ্বল হলো অতি মাত্রায়। ফাল্গুনীদের নিজেদের বাড়ি বা যেখানে বাসা ভাড়া থাকতো তার কোনটাই তো ওদিকে নয়। কিছুদূর পিছু নেওয়ার পর দেখতে পেলো ফাল্গুনী অটো পাল্টে সিএনজি নিলো। রওয়ানা হলো এলেঙ্গার দিকে। জাগ্রতও আলাদা সিএনজি নিয়ে পিছু করলো। বেশ কিছুক্ষণ পর সিএনজি থামলো এলেঙ্গায় গিয়ে। তারপর একটি রিক্সা নিয়ে আবারও রওনা হলো কোথাও। কিছুদূর যাবার পর থেমে গেলো রিক্সাটি আর নেমে গেলো ফাল্গুনী। পা বাড়ালো পাশের টিনের দোচালা বাড়ির ভেতরে। জাগ্রতও ঢুকে গেলো বাড়ির ভেতরে। তবে দুরত্ব বজায় রাখতে গিয়ে হারিয়ে ফেললো ফাল্গুনীকে। আর কোথাও দেখতে পেলো না। অস্থির হয়ে চারিদিকে দেখতে লাগলো। হটাৎ সামনে পড়ে গেলো একজন বৃদ্ধা মহিলা। এক হাতে লাঠি ধরে আরেক হাতে কোমর চেপে দাড়িয়ে আছে চোখমুখ কুঁচকে। গায়ের চামরার থেকে মুখচোখের ওপর ভাজের প্রকাশ বেশি বলে মনে হচ্ছে জাগ্রতর। হটাৎ সেই বৃদ্ধা মহিলা লাঠি উঁচিয়ে মারার ভঙ্গিতে বললো,
‘ওই ছেমড়া! তুই এমবা কইরা চাইয়া চাইয়া কি দেহস লো? বাড়ির বিতর হানছস ক্যা? বাইর অ কইছি বাইর অ।’
‘ঠাকুমা এই মাত্র একটি মেয়ে এলোনা বাড়ির ভেতরে সেই মেয়েটি কোথায় গেলো? এইমাত্রই ভেতরে ঢুকেছে আমি দেখেছি। পড়নে সাদা কালো কামিজ ওড়না ছিলো। এখানে তো কতগুলো ঘর। একসাথে অনেকগুলো বাড়ি দেখছি। আমি বুঝতে পারছি না। আপনি কি দেখেছেন এমন কাউকে? একটু বলবেন আমায়।’
‘তুই তো পোলা সুবিধার না লো। মেয়া মাইনষের পিছা লইয়া আইছস আমগোর বাড়ি। ও হাসি বাইরে আয় বউ। দেখ তর মাইয়ার নাগর আইজ বাড়ি তোমক আইয়া পড়ছে। বাইর অ তুই বাইর অ।’
‘আপনি এসব কি বলছেন! আমি ওর স্বামী.. মানে প্রাক্তন.. মানে বুঝতেই তো পারছেন।’
‘কি কইলি লো ছেরা! তাইলে তুই সত্যিই হেই পোলা! আর তগোর বিয়াও হইয়া গেছে? হায় হায় কি সর্বনাশ হইয়া গেছে গো! ও হাসি বউ বাইর অ রে, কোতায় যাইয়া হানছস? ও সুভাষ রে তর মেয়া বেবাকটির মাতা হেট কইরা ছাড় দেয় নাই বিয়াও কইরা হালাইছে। বাইরাইয়া যাইয়া খালি এক রাইত থাইক্যা আহে নাই বিয়াও করছে বলে ন*চ্ছা*রে।’
জাগ্রত হতবাক, হতুম্বুবুদের ন্যায় উদ্দাম বেগে এক ধাক্কা খেলো। হৃদয় টা যেনো টুকুস করে খসে পড়ে গেলো পেটের কোন এক কোনায়। পেট হাতড়ে খোঁজ করা মুশকিল। খালি খালি বুক নিয়ে আশপাশ নজর চালালো। কয়েক জোড়া পা এগিয়ে আসছে এদিকেই। সবার মুখাবয়বে ভ’য়’ঙ্ক’র উ’ল্কা’র চিহ্ন যেনো জ্বলজ্বল করছে। এতোক্ষণ অবদি তাও ঠিক ছিলো কিন্তু একটু দূরে দৃষ্টি পড়তেই অন্তর আত্মা গা ছাড়া হয়ে গেলো জাগ্রতর। একজন অর্ধবয়স্ক লোক হাতে কু’ড়া’ল নিয়ে এগিয়ে আসছে এদিকেই। চোখে মুখে রমরমা অ’গ্নি’শি’খা। পড়নের কালো নিল রঙের চেক লুঙ্গির ভাঁজে আবার ছোটখাটো একখানা ছু’রি ও গোঁজা আছে।
‘হাসি কোরে? তর মেয়ারে দরজার সিকল খুইলা বাইরে আন। ওই শঙ্কর যাছে, নিয়ায় আঁখিরে। অর সামনে আইজ কুবামু এই খা****র পো**লা**রে। বাইর কর অরে।’
সুভাস চন্দ্রের হুমকিসংশ্লিষ্ট ক্ষুদ্ধ গলার জোরালো চিৎকারে কেঁপে উঠলো বাড়ির উঠোনে দাঁড়ানো প্রতিটা মানুষ। হাসি তার মুখে কাপড় চেপে ফুপিয়ে কেঁদে দিলেন নিজের স্বামীর এহেন রুপ দেখে। এর মধ্যে সুভাষ চন্দ্রের দুই ভাই শঙ্কর চন্দ্র আর উত্তম চন্দ্র দু’হাতে জাপটে ধরে আটকে ফেলেছেন সুভাষ চন্দ্রকে। একপ্রকার ধস্তাধস্তি জাবরদস্তির উপর আঁটকে রাখার চেষ্টা করছে দু ভাই। অকস্মাৎ ঘটনায় এতোক্ষণ যাবত সব নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে দেখছিলো জাগ্রত। প্রথম দফায় ভয় খানিক পেয়েছিলো বৈকি। জব্বর খিঁচ দিয়েছিলো কুড়াল হাতে কাউকে তার চোখে দৃষ্টি বজায় রেখে এগিয়ে আসতে দেখে। তবে সবার কথোপকথোন শুনে সবার এমন মারকাটারি হাবভাব প্রদর্শনের হেতু বুঝতে সক্ষম হয়েছে জাগ্রত। সবাই অন্যকারো সঙ্গে যে তাকে গুলিয়ে ফেলেছে তা এতোক্ষণে বুঝে গেছে সে। তাই এবার মুখ খুললো জাগ্রত। ঠান্ডা হয়ে সবার উদ্দেশ্য বললো,
‘একজন আমায় অভিশাপ দিয়োছিলো, বলছিলো ধুঁকে ধুঁকে আমার আত্মা গা ছাড়া হবে। বহুত কষ্ট পাবো জীবনে। তার অভিশাপ কিন্তু আমার গায়ের লোমে লোমে লেগে আছে। বহুত কষ্ট পেয়েছি এ পর্যন্ত। এখন বাকি আছে শুধু ধুঁকে ধুঁকে আত্মা গা ছাড়া করে মরে যাওয়া। তাই আপনার ওই কু’ড়া’লে’র দু এক কো’পে আমার কিছুই হবে না। আর না ওই ল্যাড়ল্যাড়ে ছু’ড়ি দিয়ে কিছু হবে। এতো সহজে আমি মরবো না তাই ওসব রাখুন। আমাকে না জিজ্ঞেস করেই এক সেকেন্ডের মধ্যে আমায় কারো ভেগে গিয়ে বিয়ে করা জামাই বানিয়ে দিলেন। একবার নিজেদের মেয়েকে আনিয়ে নিশ্চিত তো করে নিন আমিই সেই অধম কিনা। এবার দয়া করে হাঙ্গামা বাদ দিয়ে আমাকে কেউ একজন জিজ্ঞেস করুন আমি কে, আর কেনো এসেছি। আমিও একটু সুযোগ পাই কিছু বলার। প্লিজ।’
এতোক্ষণের রমরমা অগ্নিসংযোগে জল ঢেলে দিয়েছে জাগ্রত। পরিবেশ টা হটাৎ করেই শান্ত হয়ে গেলো। কম বেশি সবার মুখাবয়বে বিরাজ করছে সন্দিগ্ধতা আর লজ্জাবোধ। এর মধ্যে আগমন হলো নতুন এক মুখের। কেউ একজন টেনে নিয়ে এলো একটি মেয়েকে। মেয়েটি যেনো প্রাণহীন কোন শুকনো লতা। মেয়েটির দৃষ্টি ও মৃত নদীর মতো খড়খড়ে। সুভাষ চন্দ্র আঁখি বলে ডেকে উঠলো মেয়েটিকে।
মেয়েটি চোখ তুলে তাকালো না। ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলো। একজন মহিলা কানে কানে কিছু বললো মেয়েটিকে। তাতেও তাকালো না। কিছুক্ষণ ধ্যান ধরে দাঁড়িয়ে থেকে হটাৎ বলে উঠলো,
‘সে আসে নি কাকী। সে এলে এতোক্ষণ তোমরা কু’ড়া’ল ছু’ড়ি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারতে না। হাত জোর করে দাঁড়িয়ে থাকতে!’
আঁখির রুদ্ধ কন্ঠের কথা শেষ হতে না হতেই বাড়িতে পুলিশের আগমন হলো। সাথে উপস্থিত হলো নতুন এক জোড়া পা।
~চলবে