#পুনর্মিলন
#গুঞ্জন_চৈতি
#পর্ব_২৪
“কি বলছেন এসব? আর পার্থ দা কি সত্যি শুধু আমি এসেছি বলেই এতো রাত করে এসে রেখে গেলো জিনিয়াকে? আমার কেনো সবটা স্বাভাবিক লাগছে না?”
“পার্থ যে স্বাভাবিক ভাবে শুধু তোমার উদ্দেশ্যে আসে নি জিনিয়াকে নিয়ে সেটুকু হলফ করে বলতে পারি। কিন্তু কেনো এসেছে তা জানি না।”
ফাল্গুনী চুপ করে রইলো। আর কোন প্রশ্নের গিট বাঁধালো না। ভাবলো জাগ্রতর যখন ইচ্ছে হবে সে নিজেই বলবে যতটুকু সে জানে। জাগ্রত পরিবেশ পাল্টাতে জিজ্ঞেস করলো,
“বিকেল থেকে শাড়ী পড়ে আছো বিরক্তি লাগছে না? অভ্যেস তো নেই। চাইলে পাল্টে নিতে পারো।”
ফাল্গুনী মাথা নাড়িয়ে বলল, “অভ্যেস হতে কতক্ষণ?”
দুজনে চুপচাপ বসে রইলো আবার। ফাল্গুনী জিনিয়াকে নিয়ে ভাবতে লাগলো আগে পিছে মিলিয়ে। হটাৎ সব ভাবনা চিঁড়ে নতুন কিছু একটা খেলে গেলো জ্যামে আটকানো মস্তিষ্কে। তৎক্ষনাৎ বড় বড় রসগোল্লার ন্যায় হয়ে গেলো চোখদুটো। আশার দ্যুতি ছড়ালো ফাল্গুনীর মন মস্তিষ্কে। কিছুসময় আগ পর্যন্ত যা প্রায় অসম্ভব বলে মনে হচ্ছিল তা এখন এক চুটকিতেই সম্ভব বলে মনে হলো। শুধু চুটকি বাজানোর হাতটা শক্ত হতে হবে। তাহলেই অসম্ভবকে সম্ভব করা যাবে।
ফাল্গুনী নিজের মনের ভেতর চলা উত্তেজনা আর উদ্বেগ সামলে নিতে বড় বড় শ্বাস টেনে নিয়ে ধীরে ধীরে শ্বাস ছাড়লো। নিজেকে শান্ত করে পাশে ফিরে তাকাতেই চমকে উঠলো। জাগ্রত তার পানে-ই চেয়ে আছে। দৃষ্টিতে গাঁথা প্রশ্নমালা। সে মালা ছিঁড়ে পরার আগেই ফাল্গুনী বলে উঠল,
“হটাৎ মায়ের কথা মনে হয়েছিলো। আর মনটা কেমন অশান্ত হয়ে উঠেছিলো। তাই উত্তেজনায়….”
“স্টপ ফাল্গুনী!”
ফাল্গুনী একটু ভীতিগ্রস্ত হলো। অসহায় চোখে চেয়ে রইলো জাগ্রতর পানে। ভাবলো শত অগণিত ভাবনা। জাগ্রত চোখ বন্ধ করে ঘাড়ে হাত দিয়ে বলল,
“এভাবে কৈফিয়ত দেবে না কখনো। আমি চাইলেও না।”
ফাল্গুনী শান্ত হলো। শুধু শান্ত নয় তৃপ্ত-ও হলো। জিজ্ঞেস করলো,
“কেনো?”
জাগ্রত চোখ খুলে আঁড়চোখে চেয়ে বলল,
“যেখানে কৈফিয়ত থাকে সেখানে ভরসা থাকে না।”
ফাল্গুনী আরাম করে বসে বলল, “ভরসা করেন আমাকে?”
জাগ্রত এক মুহুর্তও দেরি না করে জবাব দিলো, “করতে চাই।”
ফাল্গুনীর উচ্ছ্বসিত মনটা এক নিমিষেই আঁধারে ছেয়ে গেলো। নরম গলায় জিজ্ঞেস করলো, “তার মানে করেন না?”
জাগ্রতর কাটখোট্টা জবাব, “না! করিনা ভরসা। তবে তা নিজেকে। তোমার ব্যাপারে এখনো অজ্ঞাত।”
ফাল্গুনী এবার ধৈর্য হারা হয়ে অধৈর্য গলায় বলল, “হেঁয়ালি করে কথা ঘুরাচ্ছেন?”
জাগ্রত চকিতে ঘুরে বসলো। শুয়ে পরলো ধপাস করে। বালিশ বানিয়ে নিলো ফাল্গুনীর কোমল কুশনের ন্যায় কোলটাকে। মাথা উঁচিয়ে তারপর ফাল্গুনীর চোখে চোখ রেখে বলল,
“একটা সময় বিশ্বাস করতাম আমি তোমাকে ভালোবাসি, ভরসা করি, বিশ্বাস করি। কিন্তু তা ভুল ছিলো। করতাম না তোমায় ভরসা। ছিলো না কোন বিশ্বাস এর ছিটেফোঁটা। আমার ভাবনা-ই ছিলো ভুল। যদি বিশ্বাস করতাম, ভরসা করতাম; তবে শুধুমাত্র মা-বোনের কথায় তোমাকে এক মুহুর্তেই অবিশ্বাস করে নিতাম না। তেমাকেও বলার সুযোগ দিতাম। কিন্তু দিই নি। তাই এখন নিজের বিশ্বাস এর উপরেই বিশ্বাস নেই। নিজেকেও ভরসা করি না এখন আর। আর দেখো, এখনও ভাবি আমি তোমাকে ভরসা করি। বিশ্বাস করি নিজের থেকেও বেশি। কিন্তু আসলেই করি কি না তা প্রমাণ হবে সময় আর পরিস্থিতি ভেদে। যদি এমন সময় কখনো আসে, পরিস্থিতি তৈরি হয় বিশ্বাস অবিশ্বাসের দেয়াল দাঁড় করিয়ে; তবে সেদিন নিজেকে পরোখ করে নিবো না হয়। তারপর তোমাকে বলবো। ভরসা করি কি না। বিশ্বাস আছে কিনা। তবে একটা কথায় গত চার বছরে কিন্তু আমি দৃঢ় নিশ্চিত হয়ে গেছি।”
ফাল্গুনী মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনছিলো জাগ্রতর অকপটে বলা স্বীকারোক্তি। শেষ কথাটা শুনে মিষ্টি করে আগ্রহী গলায় জিজ্ঞেস করলো, “কি কথা?”
জাগ্রত ফাল্গুনীর কোলে রাখা মাথাটা পেটের দিকে একটু ঘেষিয়ে ডান হাতে ফাল্গুনীর গালে আলতো ছুঁয়ে বলল,
“ভালোবাসি। তোমাকে প্রচন্ডরকম ভালোবাসি। গত চার বছরের প্রতিটা মুহুর্ত আমাকে খুব করে অনুভব করিয়েছে আমি আমার ফাগুনকে আমার নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসি। অনেক বেশি ভালোবাসি।”
ফাল্গুনী মিটমিট করে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো তৎক্ষনাৎ। ঘার-ও পাশ ফিরিয়ে নিলো। দৃষ্টি সরিয়ে ঘাড় ফিরিয়ে নিলেও জাগ্রতর হাত টা তো আর পারলো না সরাতে। তা যথাস্থান দখল করে আছে। জাগ্রত তার আগে থেকেই ফাল্গুনীর গালে রাখা হাত দিয়ে আবার আগের জায়গায় ঘুরিয়ে দিলো ফাল্গুনীর লজ্জানত মুখশ্রী। ফাল্গুনী যেনো শরীর ছেড়ে দিয়ে বসে আছে জাগ্রতর প্রতিটা ছোঁয়াকে সায় জানাতেই। জাগ্রত গালের দখল ছেড়ে হাত চালালো ফাল্গুনীর কেশ পাতালে। পাঁচ আঙ্গুলে ঘাড় জরিয়ে আস্তে করে নিচু করে নিলো ফাল্গুনীকে। দুজনের পর্বতের ন্যায় খাড়া নাক দুটো প্রায় ছুঁই ছুঁই করছে। ফাল্গুনীর গলা শুঁকিয়ে কাঠ। ভেতরে দুরুম দারুম আওয়াজ হচ্ছে অগোছালো সুরে। চিনচিনে ব্যথা যেনো বুকটা আজ ছিঁড়েই ফেলবে। কিছুক্ষণ আগ অব্দি জাগ্রতর অনিমেষ দৃষ্টি ফাল্গুনীর পুরো মুখ জুড়ে বিচরণ করছিলো। কখনো চোখ তো কখনো নাক, কখনো গাল তো কখনো ঠোঁট। কিন্তু এখন! তার দৃষ্টি শুধু ফাল্গুনীর গোলাপের পাপড়ির ন্যায় ঠোঁট জোড়াতে-ই আবদ্ধ। আর কোথাও নড়েচড়ে বেড়াচ্ছে না তার দৃষ্টি। ফাল্গুনীর ইচ্ছে করছে চোখ বন্ধ করে নিতে। তাকিয়ে থাকার জোর পাচ্ছে না শরীরে। যখন ভাবলো না আর পারছে না সে জাগ্রতর দৃষ্টি গায়ে মাখতে, এবার বন্ধ হোক দু নয়ন। তখনই আচমকা জাগ্রত ছেড়ে দিলো তাকে। হাত সরিয়ে গুটিয়ে নিলো আর পাশ ফিরিয়ে মুখ গুজে দিলো তার পেটে। গরম কয়লার উত্তাপ ছড়ালো নিঃশ্বাসের গভীর ছোঁয়ায়। ফাল্গুনীর শরীর আর মন দুই কেঁপে উঠলো নড়বড়ে আধভাঙা বাঁশের সেতুর ন্যায়। বিস্ময়-বিহ্বল হয়ে খেই হারালো নিজ সত্তার। চোখমুখ খিঁচে অবচেতন মনে কাঁপা কন্ঠে বলে উঠলো,
“এর থেকে ভালো ছিলো ঠোঁটটাই ছুঁয়ে দিতেন। পেটে নাক-মুখ গুঁজে কেনো অত্যাচার করছেন?”
দু লাইনের বলা শেষ কথাটাতে দুজনের অভিব্যক্তি হলো দুরকম। ফাল্গুনী লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে পড়িমরি করে মুখ লুকালো দু’হাতে। আর জাগ্রত হেসে কুটিকুটি হবে নাকি বউকে চুমু খাবে সে চিন্তায় দ্বিধান্বিত হলো। বুঝে উঠলো না বউ তাকে চুমু খাওয়ার অনুমতি দিলো নাকি পেটে মুখ গুঁজতে মানা করলো। জাগ্রত ভেবে ভেবে অযথা সময় নষ্ট করলো না। চট করে শাড়ীর ফাঁক গলিয়ে চুমু খেয়ে নিলো পেটের মাঝখানে। তারপর লক্ষ্মী বর হয়ে আরাম করে শুয়ে রইলো ফাল্গুনীর কোমর জাপটে। আর ফাল্গুনী! সে তো যেনো তুলোর ওজনে হাওয়ায় উড়ছে। ঝড়োমেঘের মতো উড়ো উড়ি করছে অনুভূতির শোরগোলে বুঁদ হওয়া এক রঙিন আকাশপটে।
___________________
আঁখি স্নান সেরে সেই আগের শাড়ীটা-ই পড়ে ঠিকঠাক হয়ে বেরোনোর প্রস্তুতি নিলো। বাথরুমের দরজা খুলে একটু উঁকি দিতেই দেখতে পেলো নিসান এদিকেই চেয়ে আছে। যেনো রাজ্যের যত বিরক্তি মজুদ করা আছে সব নিসান এর মুখমন্ডলেই মজুদ করা। আঁখি ভেজা পায়ে এগিয়ে আসবে করে যেই পা বাড়াবে ওমনি নিসান বলে উঠলো,
“এক স্নান করতে গিয়ে দু-দুবার বেরিয়েছো অলরেডি। একবার বললে টাওয়াল চাই আরেকবার তো ভুলেই গেলে কি চাই। এবারও কি ভুলে গেছো কিছু? নাকি হয়েছে তোমার স্নান?”
আঁখি অভিমানী কন্ঠে বলল, “হয়েছে।”
নিসান একটুখানি ঠোঁট এলিয়ে হাসলো। মাথা ঝাঁকিয়ে বলে উঠলো, “হুম! বউটার গলায় দেখি অভিমান জমেছে।”
আঁখি এগিয়ে এসে দাঁড়ালো নিসান এর সম্মুখভাগে। হয়তো প্রস্তুতি নিলো কিছু বলার। নিসান দিলো না সেই সুযোগ। আঁখিকে এক পলকে কোলে তুলে নিলো চট করে। আঁখি হতভম্ব হয়ে গেলো। আচমকা শুন্যে ভেসে উঠায় নিসানের শার্টের কলার খামচে ধরলো হাতের পাঁচ আঙ্গুলের সমস্ত জোড়ে। ছিঁড়ে নিলো দুই বস্তু। একটা দৃশ্যমান আরেক অদৃশ্য। গলার কাছে কলারের নিচে থাকা দুই নাম্বার বোতাম টা দৃশ্যমান হলো ছিঁড়ে পরে গিয়ে। অদৃশ্য রইলো একজনের বুকের ভেতরটা ছিঁড়ে যাওয়ার দৃশ্য। আঁখির হাতটা যে নিসান এর বামদিকটা খামচে দখল করে আছে! বুক-টা
তো ছিঁড়বেই।
“কোলে তুলবেন বলে স্নান করিয়ে আনলেন? তাছাড়া কোলে তোলা যেতো না? অশুচি ছিলাম বুঝি?”
নিসান ঝরঝরিয়ে হেসে উঠলো। বলল,
“না। যাতে আমার পেট না খারাপ হয় তাই স্নান করিয়েছি।”
আঁখি চোখ খিঁচিয়ে কপাল ঠেকালো নিসান এর বাহুতে। ওভাবেই মুখ আড়াল করে মিনমিনিয়ে বলল, “কোল থেকে নামান।”
“যদি না নামাই? তাহলে কি করবে?”
আঁখি দুষ্টু হাসি দিয়ে চটপটে স্বরে বলে উঠলো, “কি আর করবো? ঘুমিয়ে পড়বো। কোলে চড়ে মন্দ লাগছে না। মনে হচ্ছে ঘুম হবে ভালো।”
নিসান আশ্চর্য চেহারা বানিয়ে হা করে রইলো। বিশ্বাস হচ্ছে না আঁখি এতো কথা বলছে তাও আবার এতো সহজ চিত্তে। নিসান তো ভেবেছিলো আঁখির লজ্জা ভাঙিয়ে ওকে সহজ করতে করতেই বছর খানেক কেটে যাবে। কিন্তু সেতো একদম তাক লাগিয়ে দিচ্ছে আরও তাকেই।
“ঘুম চাই না? ঘুম পারাচ্ছি আজ তোমায়! চলো বিছানায় চলো।”
আঁখি নিসান এর বাহু থেকে মাথা উঠিয়ে হড়বড়িয়ে বলে উঠলো, “এই না আমার ঘুম পায়নি। দাঁড়ান! দাঁড়ান!”
“আরে চলোই না।”
নিসান বিছানায় উঠে নামিয়ে দিলো আঁখিকে। তাকে বসিয়ে দিয়ে নিজে শুয়ে পড়লো তার কোলে মাথা রেখে। আঁখি শুকনো ঢোক গিললো কয়েক বার। বারংবার! নিসান আঁখির চোখে দৃষ্টি বজায় রেখে বালিশের নিচে হাত ঢুকালো। হাত বের করে আনলো একটা তেলের শিশিসহ। আঁখির হাতে দিয়ে বলল,
“একটু আগে জাগ্রত দা আর ফাল্গুনীর সাথে কথা হলো। ফাল্গুনী বলল তুমি নাকি মাথায় তেল দিয়ে শুধু হাত বুলিয়ে দিলেও আরামে ঘুম এসে যায়। কতগুলো রাত তোমার জন্য ঘুমোতে পারিনি সে হিসেব আছে? রাখনি তো। এই নাও তেল। আজ আমি ঘুমোবো তুমি জেগে জেগে আমায় ঘুম পাড়াবে। ওকে?”
আঁখি হেসে ফেললো। ঝরা হাসি ছড়ালো পুরো চোখমুখ জুড়ে। যত্ন করে অল্প তেল ঢেলে নিলো হাতের তালুতে তারপর আলতো হাতে মালিশ করতে লাগলো নিসান এর ঝরঝরে চুলগুলোয়। নিসান এর ঠোঁটেও ঝুলছে হাসি। কিছুক্ষণ অতিবাহিত হলো এভাবেই। মিনিট দশেক পর আকস্মিক উঠে পড়লো নিসান। আঁখির কোল থেকে মাথা উঠিয়ে বালিশ টেনে মাথায় গুঁজে নিলো। তারপর আঁখির দিকে হাত বাড়িয়ে ইশারা করলো বুকে এসে শুতে। আঁখি লজ্জা মুখশ্রী নিয়ে ঝটপট মুখ লুকালো নিসান এর বুকে শুয়ে পরে। নিসান আঁখির মাথা নিজের বুকে চেপে ধরে লম্বা এক শ্বাস টেনে নিয়ে ধীরে ধীরে শ্বাস ছাড়লো। মৃদু স্বরে ডেকে উঠলো আঁখি বলে। আঁখি জবাব দিলো, “হুম” করে উঠে। নিসান এর গলা হটাৎ গম্ভীর হয়ে গেলো। রাশভারী কণ্ঠে বলল,
“কিছু কথা বলবো। মন দিয়ে শোনো।”
আঁখি পরিস্থিতির গম্ভীরতা টের পেয়ে মাথা তুলতে নিলো নিসানের বুক থেকে। নিসান বাঁধা দিলো। শক্ত করে চেপে ধরে রইলো বুকের পাঁজরে। তারপর ক্ষীন কন্ঠে বলতে লাগলো,
“আমি আমার বাবা-মাকে অনেক ভালোবাসি আঁখি। প্রচন্ড সম্মান করি। তাঁদের অমতে বিয়ে করেছি তোমায়।৷ তাদের মত ছিলো না এই বিয়েতে। তাঁরা অন্যকাউকে বেছে নিয়েছিলো আমার বউ হিসেবে দেখবে বলে। কিন্তু আমি তোমাকে ভালোবেসে অন্য কাউকে কি করে এ বুকে জায়গা দিতাম বলো? অনেক চেষ্টা করেছি বাবা-মাকে রাজি করাতে। পারিনি তাদের মন গলাতে। শেষমেশ তাদের অমতে আর অনুপস্থিতিতেই বিয়ে করতে হয়েছে তোমাকে। কাল সকালে রওয়ানা করবো বরিশালের উদ্দেশ্যে। বাড়ি ফেরার পর বাবা-মা হয়তো তোমাকে মেনে নেবে না। হয়তো বরন-ও করবে না তোমাকে। আমি জানি না। আমি সত্যিই জানি না বাবা-মায়ের প্রতিক্রিয়া কি হবে, আমি জানি না! তারা যাই করুক না কেনো আমি কিন্তু তাঁদের ছাড়তে পারবো না আঁখি। না তাঁদের ছাড়তে পারবো আর না তোমায় ছাড়তে পারবো। আমার সবাইকেই চাই। তোমাকে কিছুই করতে হবে না শুধু বাবা-মা কিছু বললে তা নিয়ে মন খারাপ করো না। একটু মানিয়ে নিয়ো কিছুদিন। তাঁদের একমাত্র ছেলে আমি। আমার বিয়ে নিয়ে অনেক আশা ছিলো যে তাঁদের। আমি ভেঙে দিয়েছি সবটা। তাই তাঁদের রাগ করে থাকাটাই তো স্বাভাবিক তাই না? তবে আমার ভরসা আছে বাবা-মায়ের উপর। তাঁরা তোমাকে এমন কিছু বলবে না যাতে তুমি ছোট হও। শুধু একটু সময় চাই। আমি ঠিক বাবা-মাকে মানিয়ে নেবো। তারা খুব বেশিদিন রাগ করে থাকতে পারবে না আমার উপর। আর আমি জানি তোমার উপরেও রাগ করে থাকতে পারবে না মা। মায়ের তো তোমার মতোই একটা লক্ষ্মীমন্ত মেয়ের আশা ছিলো তার ছেলের বউ হিসেবে। আর মায়ের রাগ পরে গেলে বাবাও গলে যাবে। আমি শুধু তোমার সাথ চাইছি। পাশে থাকবে তো আমার? পারবে তো বাবা-মাকে মানিয়ে নিতে?”
আঁখির মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেছে নিসান এর বাবামায়ের অমতের কথা শুনে। কিন্তু প্রকাশ না করে নিসানের বুকে আরও একটুখানি শক্ত হয়ে জেঁকে শুয়ে নিলো। তারপর ভরসা দিয়ে বলল, “আপনি পাশে থাকলে আমি সব পারবো। আপনি চিন্তা করবেন না। সব ঠিক হয়ে যাবে।”
আঁখি ভরসা দিলো ঠিক কিন্তু নিজে ভরসা পেলো না। ভয় হলো মনের ভেতর। যদি না পারে তাদের মন জয় করতে তাহলে কি হবে? নিসান তো আগে থেকেই বলতো সে তার বাবা-মাকে নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসে। সেই বাবা-মা যদি শেষমেশ কোনভাবেই মেনে না নেয় তার মতো অতি সাধারণ এক তুচ্ছ মেয়েকে তাহলে কি নিসান ছেড়ে দেবে তার হাত? আঁখি নিজমনে করা নিজের প্রশ্নে চমকে উঠলো। আর ভাবতে পারলো না এ নিয়ে। যদি ভাবনাতেই এতো অসহায় অনুভব হয় তবে পরবর্তী পরিস্থিতি কি করে সামাল দেবে সে!
#পুনর্মিলন
#গুঞ্জন_চৈতি
#পর্ব_২৫
রাতের নিকষিত কালো আধার চিঁড়ে সূর্য মাথা উঁচিয়ে দন্ডায়মান হবে অল্প কিছুক্ষণ পর-ই। চারপাশে এখনো আঁধারের চাদর বিছিয়ে আছে ঘাটে ঘাটে। এই ঘুটঘুটে আঁধারে গলিয়ে নৈঋতের এক কোন ধরে এগিয়ে চলেছে এক নারী অবয়ব। এগিয়ে চলেছে এক মা। বড্ড ভীতু সেই হাসির মনে আজ ভুতপ্রেতের ভয় নেই কোন। মুখে নেই তেত্রিশ কোটি দেবদেবীদের নাম। হৃদয়ে আছে শুধু সন্তানকে বাঁচানোর তাগিদ। আর আছে সন্তানের মঙ্গল সাধন করার প্রবল আকাঙ্ক্ষার দাবদাহ।
পুরো চল্লিশ মিনিট এর পথ বিশ মিনিটে পার করে চলে এসেছে হাসি তার বোনের বাড়ি। পুরো পথ একরকম দৌড়ে পার করে এসেছে। সময়ের হিসেব তার নেই। তবুও তার মনে হচ্ছে আরও আগে কেনো আসলো না সে। আরও জলদি পা চললো না কেনো! সময় যে বড্ড কম। দেরি না হয়ে যায়।
হাসি ক্লান্ত পায়ে এগিয়ে গেলো তার থেকে বয়সে তিন বছরের বড় বোন খুশির ঘরের দরজায়। পুরোনো মরচে পড়া টিনের ছাপড়া ঘরে ঘুনে খাওয়া কাঠের দরজায় কড়া নাড়লো ঠকঠক করে। তিনবার কড়া নাড়লো ধীরে ধীরে-ই। কিন্তু সারা পেলো না কোনো। তারপর অধৈর্য হয়ে জোরে শক্ত হাতে এক শব্দ করলো দরজায়। এবার আওয়াজ এলো ভেতর থেকে। খুশি “কেরা রে” বলে উঠে এগিয়ে এলো বোধ হয় দরজার কাছে। হাসি জবাবে শুধু কাঁপা ক্ষীন স্বরে বললো, “আমি রে দিদি”।
খুশি দরজা খুলে অবাক হয়ে গেলো বোনের ঘামে চপচপ করা মুখশ্রী দর্শন করে। শরীরে লেপ্টানো পুরোনো সুতি শাড়ীটাও প্রায় ভিজে উঠেছে। খুশি জলদি করে হাসির হাত ধরে ভেতরে নিয়ে যেতে নিলে হাসি বাঁধা দিলো। উল্টে তাকেই বাইরে টেনে নিয়ে আসলো তৎক্ষনাৎ। একেবারে কলপাড়ে গিয়ে পাতানো ইঁটের উপর বসে ধরপর করা হাঁপানো বুক চেপে ধরে বলে উঠলো,
“ঘরে না দিদি। এনে বয়। ঘরে জাইম্বু আছে।”
“তর কি হইছে বোইন? তুই এমন হাঁপাইতাছস কেন? এহনো তো ভোরের আলোও ফুটে নাইকে, কি আন্ধার চাইরোদিকে। তুই আইলি কেমনে একলা একলা? তর না ভুতের ডর আত্মা বুঝাই?”
“ডর তো এহন আমার মেয়ারে নিয়া রে দিদি। আঁখির বাপে সর্বনাশের খেলায় নামছে। হে আঁখিরে দিয়া নিজের কাম হারতে পারে নাই এহন লাকি রে চায় নিজের কাম হারনের নিগা। উপরওয়ালা সহায় আছিলো তাই আঁখি পার পাইয়া গেছে। উপরওয়ালা নিজে ওর নিগে একজন দেবতার মতো স্বামী জুটাইয়া দিছে। কিন্তু লাকিরে কেরা বাঁচাইবো দিদি! হে তো এহন লাকিরে বিয়া দিবার চায় ওই বউ মরা রতনের নগে।”
“কি কস তুই? লাকি একটুহানি মেয়া, ওর বয়স হবাই ষোল পরছে। ওরে এহনি বিয়া দিমু না। আর ওই রতনের নগে তো না-ই।”
হাসি গতকাল রাতে তাকে বলা সুভাষ এর সমস্ত কথা পুঙ্খানুপুঙ্খ খুলে বললো দিদিকে। সব শুনে খুশি বলল,
“বললেই হইলো? লাকি আমগো মেয়া। আমার মেয়া ও। ওর জন্মের পর থিকা আমি পালছি নিজের মেয়া মনে কইরা। তর জামাই তো কইছিলো-ই হে লাকিরে একবারে দিয়া দিছে আমারে। তাইলে এহন কেন এই কতা কয় হে? আহুক দেহি কেমনে আমার মেয়া নিয়া যায় আমিও দেহি। তুই এইটুকুতেই এমনে ভয় পাইয়া এই ভোর রাইতে ছুইট্টা আইছস? এহনো ভীতুই রইয়া গেলি হাসি।”
“দিদিরে! এতোক্ষণ তো খালি আমারে কওয়া হের কতাগুনা হুনলি। পুরা কতা হুন। রাইতে হে হুইয়া পড়ার পর আমি পাকের ঘরে গেছিলাম ছড়াইনা মরিচ গুনা গুছাইয়া থুইতে। হেনথিকা মোবাইলের শব্দ পাইছি। আমার মনডায় যানি কেন কামর দিয়া ধরছিলো মোবাইলের শব্দ হুইনা। পরে দরজার বাইরে খারাইছিলাম হের কতা হুনতে। হে মেবাইলের শব্দ না বারাইয়া কতা কইতে পারে না। মোবাইলে কতা কওয়া ওই বেডার কতাও হুনা গেছে বাইর পর্যন্ত। হে কইলো রতন নাকি কোন ঘটক নিয়া কাইল মেয়া দেইখা আইছে দুইডা। দুইডাই রতনের পছন্দ অইছে। এহন তার মধ্যে যেকোন একটা বাইছা লইবো বিয়া করতে। এক সপ্তাহের মধ্যেই বিয়ার কাম হারবো। এই খবর হুনার পর আঁখির বাপে তহন তহন-ই ওই কুলাঙ্গার রতনরে ফোন লাগাইছে। রতনরে ভরসা দিয়া কইছে হের পরির নাহাল আরেকখান মেয়া আছে আঁখির চেয়াও সুন্দরী। এক্কাবারে রতনের মনের মতন। আরও যে কতো প্রশংসা! রতন দেখপার চাইছে আইজ। কইছে সক্কাল সক্কাল আইবো লাকিরে দেখতে। পছন্দ হইলে তহনই আংটি পরাইয়া মন্দিরে নিয়া মালাবদল হারবো। বিয়া ফালাইয়া রাইখা ঠক দিবার কোন সুযোগ দিবো না। এই কতাগুনা যে হইছে তা আমারেও আর কয়নাই আঁখির বাপ। আমিও না হুনার ভান ধইরা কিছু সময় পর ঘরে যাইয়া হুইয়া পরছি। সারা রাইত ঘুমাই নাই এই ডরে যদি ভোরের আগে না উঠতে পারি!”
হাসি কথা বলতে বলতে কেঁদে বুক ভাসিয়ে দিয়েছে। ফুপিয়ে উঠছে গা কাঁপিয়ে। খুশির মনেও ভয় ঢুকে গেছে। গায়ের জোরে কতোটা আটকাতে পারবে সে এই বিয়ে? আইনত তো তার কোন অধিকার নেই লাকির উপর। তাহলে লাকিকে বাঁচাবে কি করে?
___________________
ভোরের অকৃত্তিম আলো ফুটেছে ধরিত্রীর বুকে। কানায় কানায় শোভা পাচ্ছে সূর্যের নরম আলো। ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই কোমর বেঁধে ফাল্গুনী লেগে পড়েছে রান্নাঘরে। কিছুক্ষণ পর জিনিয়া-ও উঠে গেছে রান্না ঘরের টুংটাং আওয়াজ শুনে। এসে হাত লাগিয়েছে ফাল্গুনীর সাথে রান্নার কাজে।
রান্নার ফাঁকে সুকৌশলে নিজের কথা পারছে ফাল্গুনী। ধীরে ধীরে নানান কথা চালিয়ে যাচ্ছে অতীত বর্তমান মিলিয়ে। সহজ হতে চাইছে জিনিয়ার সাথে। জিনিয়া-ও যে নিজ প্রয়োজনে ভাব জমিয়ে নিচ্ছে অনায়াসে তা টের পাচ্ছে ফাল্গুনী।
“কতো সকালে উঠেছো ফাল্গুনী? সবে সাতটা বাজে, এখনই ডায়নিং টেবিল ভর্তি করে ফেলেছো দেখছি খাবার দিয়ে।”
ফাল্গুনী পিছু ফিরে দেখলো জাগ্রত হাই তুলছে রান্নাঘরের কোনায় দাঁড়িয়ে। জিনিয়া ডায়নিং এ গুছিয়ে রাখছে খাবার গুলো সব। সে জল ভর্তি জগ হাতে নিয়ে এগিয়ে এসে দাঁড়ালো জাগ্রতর সামনে। স্বতস্ফুর্ত মুখশ্রীতে বলল,
“অনেক ভোরে ঘুম ভেঙে গেছিলো। আর ঘুম-ই আসছিলো না। তাই এসে রান্নার কাজে হাত লাগিয়েছি। জিনিয়া বলল জেমি নাকি মাংস পরোটা খুব পছন্দ করে আর আপনিও তো পরোটা খুব পছন্দ করেন তাই আপনাদের জন্য মাংস আর পরোটা করেছি আর আমার জন্য ভাত আর একটু সবজি করেছি। উলটে পালটে খেয়ে নেওয়া যাবে। চলুন ফ্রেশ হবেন। আমিও একটু ফ্রেশ হবো। কাপড়টাতে তেল মশলা লেগে গেছে। একেবারে স্নান সেরে নেবো।”
“একসঙ্গে?”
ফাল্গুনী পাশ কাটিয়ে গা বাঁচালো কোনমতে। জবাব তো দূর চাইলোনা পর্যন্ত। জাগ্রত হাসি চেপে রেখে চলে চলে গেলো ফ্রেশ হতে। যেতে যেতে ডাইনিং টেবিলের এক কোনায় বসা জেমিকে আদর করে গেলো দু’গালে দুই চুমু বসিয়ে। জিনিয়া চুল বেঁধে দিচ্ছে তার। জাগ্রত জেমিকে আদর করে আর সময় ব্যায় করেনি। সোজা চলে গেছে ওয়াশরুমের দিকে। জিনিয়ার সাথে এখনও অব্দি কোন কথা বলে নি। না সে বলেছে আর বা জিনিয়া বলেছে। তবে জিনিয়া যে কিছু বলতে চায় তা সে গতকালই বুঝে নিয়োছে। হয়তো সময় বুঝে বলে ফেলবে যা বলার।
________________
সকাল দশটা বেজে ত্রিশ মিনিট। নবীনগর থেকে ভোরের বাস ধরে বরিশাল এসে পৌঁছে গেছে নিসান আর আঁখি। দুজনে দাঁড়িয়ে আছে দোতলা বাড়ির নিচতলার দোরগোড়ায়। সামনে সদর দরজা খুলে দাঁড়িয়ে আছে চন্দনা রাণী। ছেলের পাশে মাথা ভর্তি সিঁদুর আর পড়নে লাল টুকটুকে জামদানী শাড়ী পড়া মেয়ে দেখে ধক করে উঠেছে তার বুকের ভেতর। একটু দুরেই ভেতরে দাঁড়িয়ে আছে অরিন। হাতে একটি ছোট টিফিন বক্স ধরে রাখা। সেও চেয়ে আছে ঘোলা চোখে অনিমেষ।
আঁখি চট করে চন্দনার পা ছুঁয়ে প্রণাম করে নিলো। নিসানও আঁখির সঙ্গে পা ছুঁয়ে নিয়েছে মায়ের। যা বোঝার বুঝে গেছে চন্দনা। অতএব অযথা প্রশ্ন বাঁধলো না। একটু সরে দাঁড়ালো দরজার সামনে থেকে। জায়গা করে দিলো ছেলে ছেলের বউকে ভেতরে আসতে দিতে। মুখভঙ্গিতে বুঝতে পারলো নিসান তার মায়ের মনের অভিব্যক্তি।
নিসান ঢুকলো না ভেতরে। কোমল কন্ঠে ডেকে উঠলো মা বলে। জিজ্ঞেস করলো,
“বরন করবে না মা তোমার ঘরের লক্ষ্মীকে? এমনি এমনিই লক্ষ্মী প্রবেশ করাবে?”
চন্দনা খানিক তাচ্ছিল্য সুরে বলে উঠলো,
“যদি না করি তাতে কি লক্ষ্মী প্রবেশ করবে না? ফিরে যাবে দরজার ওপার থেকেই?”
“মা!”
“ভেতরে চলে আয়। লক্ষ্মীকে কতক্ষণ দাঁড় করিয়ে রাখবি। লক্ষ্মী আবার রুষ্ট না হয়ে যায়। আজকালকার লক্ষ্মীদের বড্ড দাম বাবা।”
কথার মাঝেই অরিন এগিয়ে এলো। চোখ ভর্তি জল আর আটকে আসা কন্ঠে চন্দনাকে আমি আসছি মাসিমা বলে বেরিয়ে গেলো নিসানকে পাশ কাটিয়ে। চন্দনা অরিন এর যাওয়ার দিকে অসহায় চোখে চেয়ে রইলো। ভেঙে এলো তার কন্ঠনালী। মেয়েটার কি দোষ ছিলো? সে তো কোন দোষ করেনি। তাহলে দোষ কি তার নিজেরই? হবে হয়তো!
~চলবে