পূর্ণশশী পর্ব -০৪

#পূর্ণশশী (রিপোস্ট)
পর্ব-৪
ফারহানা আক্তার রুপকথা
______________________
চোখ মুখ যখন উল্টে আসার উপক্রম তখনই হঠাৎ নিস্তেজ হাতটাকে অনেকটা জোর করেই উঠালাম আমি। নিঃশক্তি হয়েই কোনমতে অংশের বাহুর নিচে স্পর্শ করলাম আর অমনি অংশের হাত ছুটে গেল আমার গলা থেকে৷ শিউড়ে উঠেছে অংশ। কাতুকুতু আজ আমার জীবন বাঁচালো। কোন একদিন মজার ছলে অংশ বলেছিলো কাতুকুতু সহ্য করতে পারে না সে বাহুর নিচে আর পায়ের তালুতে। আজ আমি যখন যমদূতকে প্রায় দেখেই ফেলছিলাম তখনি মনে পড়লো এই কথা আর তাই অমন হাতে স্পর্শ করলাম অংশের বাহুর নিচে। লম্বা চওড়া মানুষটাকে নাগাল পাওয়া খুব একটা সহজসাধ্য ছিলো না। তবুও আঙ্গুলের ডগায় ছুঁতে পারায় জীবনটা রক্ষা পেল। কিন্তু এমন কেন করলো তা জানতে পারলাম একটু পরই৷

“এতোটা বেহায়া না হলে চলছিলো না? আমার ভাইকে বিয়ে করেছিস কেন আমায় ফিরে পেতে?”

কন্ঠে রাগ ঝরে পড়ছে অংশের৷ আমি তখনও লম্বা লম্বা শ্বাস নিচ্ছি। শরীর নিস্তেজ দাঁড়িয়ে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়ছে৷ হয়তো এক্ষুনি জ্ঞান হারাবো৷ চোখে অন্ধকার দেখছি চোখের সামনে অংশের মুখটা দেখতে দেখতেই অদৃশ্য হয়ে গেল।

চোখ পিটপিট করে খুলেই দেখতে পেলাম দরজায় অংশের বউ দাঁড়িয়ে আছে । মেয়েটা বড্ড মিষ্টি দেখতে। দেখলে শুধু দেখতেই ইচ্ছে করে আমার। মাথায় কারো স্পর্শ অনুভব করতেই মেয়েটির থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ঘাড় বাঁকিয়ে দেখলাম। মা আমার ডান পাশে মাথার কাছে বসে মাথায় হাত বুলাচ্ছে৷ এরপর একে একে চোখে পড়লো রানু আন্টি, অংশের ফুপু আর আমার বাবা দাঁড়িয়ে আছে। পূর্ণ, অংশ আর তার বাবা কেউ উপস্থিত নেই এখানে৷ শোয়া থেকে বসতেই মা বলল, “এখন কেমন লাগছে রে মা? গলায় কি খুব ব্যাথা?”

গলায় ব্যাথা! ওহ, মনে পরেছে অংশ আমার গলা চেপে ধরেছিলো। তবে কি আমি সত্যিই জ্ঞান হারিয়ে ছিলাম। হবে হয়তো তাছাড়া আমি বিছানায় এলাম কি করে! আমি ভাবছি এরই মধ্যে বাবা বলে উঠলেন, “আমি গাড়িতে বসছি শশীর মা তুমি ওকে নিয়ে জলদি এসো।”

-কোথায় যাবো? আমি প্রশ্ন করলাম।

-কোথায় যাবো মানে কি?

দাঁত মুখ খিঁচে বাবা বললেন৷ বুঝলাম না এই সামান্য প্রশ্নে এতোটা রেগে যাওয়ার কি হলো।

“আমি যাবো না বাড়ি। যেদিন সম্পত্তি আমায় দেবে সেদিন যাবো ফিরে।”

মায়ের দিকে তাকিয়ে বললাম কথাটা৷ বাবা তো এবার আমাকে প্রায় থাপ্পড় লাগাতেই এগিয়ে এলো। ভাগ্যিস মা আর রানু আন্টি বাঁধা দিলেন৷

“তোমার মত নির্লজ্জ, বেহায়া আর এতোটা অসভ্য মেয়ে এই দুনিয়ায় আর দু’টো নেই। যখন যা মন চাচ্ছে তাই করছো। একটা বার ভাবো না তোমার এসব ফালতু, অকওয়ার্ড কাজকর্মে কতো গুলো মানুষ সাফার করতে পারে। প্রেমিক তোমায় ছেড়ে অন্য মেয়েকে নিয়ে সুখে আছে সেটা সহ্য করতে পারলে না৷ এলে তার ভাইকে বিয়ে করে তার বাড়িতে। এসেও ক্ষান্ত নও আবার প্রেমিকের হাতেই মার খেতে তার কাছেই… ”

“বাবা স্টপ, আমি এমন কিছুই করিনি অংশ নিজেই এসে আমাকে খুন করতে চেয়েছে।”

বলেই কান্না করতে লাগলাম। আমি ভালোবাসি অংশকে তা কেউ কেন বুঝতে পারে না৷ আমার কষ্ট কেউ বোঝে না আমার বাবাও আমায় ভুল বোঝে।

“একদম কান্না করবে না এখানে৷ উঠো বাড়ি ফিরে চলো আর হ্যা যদি পূর্ণের সাথে সংসার করতেই চাও তবে অবশ্যই আমাদের বাড়ি থেকেই করবে৷ এখানে আর দ্বিতীয় বার পা রাখবে না।”

বাবা কথা শেষ করে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হলেন। কিন্তু বাঁধ সাধলো পূর্ণের ফুপু৷ মহিলা বয়স হলেও গলার স্বর এখনও অনেক কঠোর আর স্পষ্ট।

“হ যান যান মাইয়া লইয়া। বেদ্দপ মাইয়া একলা একলাই বিয়া বয়। এরুম মাইয়া আমাগো বাড়ির বউ হইয়া থাকবার পারবো না।”

ফুপুর কথাটায় আমি সহ আরো দু’জন ব্যক্তি লজ্জিত আর অপমানিত হলো৷ সে দু’জন হলো রানু আন্টি আর অংশের বউ । কারণ, তাদের দু’জনেরই বিয়ে একা একাই হয়েছে। কোন আত্মীয় স্বজন ছিলো না কোন অনুষ্ঠান হয়নি। সময় করে বলবো তাদের বিয়ের ঘটনা আপাতত আমার নিজেরটাই চলুক৷

মা এবার বলে উঠলেন, “থামুন আপা আপনি একটু বেশিই বলছেন এবার। আমার মেয়ে একা বিয়ে করলে আপনাদের ছেলেও কাউকে নিয়ে করেনি। বিয়েটা আমার মেয়ের আপনাদের ছেলের সাথেই হয়েছে তাই যা বলার আগে তাকে বলবেন।”

“আহ, শারমিন তর্ক বিতর্ক বন্ধ করো এখানে আমরা কারো সাথে ঝগড়া করতে আসিনি। শশীকে বলো চুপচাপ চলে আসতে।”

“আমি যাবো না বললাম তো। কেন শুনছো না তুমি। মা চলে যাও তোমরা।”

আমি বলার পরও বাবা শুনলেন না আরো কিছুক্ষণ আমাকে ধমকে পরে মা’কে নিয়ে চলে গেলেন। পূর্ণের ফুপুও ফুঁসতে ফুঁসতে বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে। মহিলা বয়সের তুলনায় একটু বেশিই তেজ দেখায়। আমিও কম না হাড়ে হাড়ে শায়েস্তা করে ছাড়বো একদম। আমাকে বেদ্দপ বলা বের করবো দাঁড়াও। বিড়বিড় করে এসবই বলতে গিয়ে আবার থেমে গেলাম। মহিলা আমায় বেয়াদব বলছে আর আমি তো সত্যিই বেয়াদবি করছি। ভুল তো কিছু বলে নি। রানু আন্টি অংশের বউকে ইশারা করতেই সে চলে গেল। ফিরে এলো পাঁচ মিনিট পর হাতে করে একটা প্লেট আর একটা বাটি নিয়ে । প্লেটে তিনটা পরোটা আর বাটিতে সবজি। সকালের নাস্তা করিনি আমি। ওরা করেছে কিনা তাও জানি না। জ্ঞান ফেরার পর থেকে তো এসবই হৈ চৈ ঝগড়া চলল।

“শশী, এই খাবার গুলো খেয়ে নাও। অনেক বেলা হয়েছে খিদে নিশ্চয়ই পেয়েছে।”

রানু আন্টি একদম আস্তে আস্তে কথা বলেন। আমার ভালো লাগলো কথা গুলো তাই পরোটা ছিঁড়ে সবজি নিলাম খেতে। মুখে দেওয়ার আগে জিজ্ঞেস করে নিলাম, “আপনারা খেয়েছেন?”

আন্টি বললেন, ‘হ্যা ‘ তিনি খেয়েছেন কিন্তু অংশের বউ খায়নি৷ তাকে ভদ্রতা দেখিয়ে বললাম, “বসো তুমিও খাও।”

-না আপু আপনি খান আমি পরে খাবো।

বেশ! আমি আর কিছু না বলে পরোটা মুখে পুরে নিলাম৷ খাবার নিয়ে ভদ্রতা বেশিক্ষণ ভালো না। ‘আগে পেট পূজা বাদ ম্যা কাম দুজা’ হিন্দিতে একটা কথা আছে। আপাতত আমি সেই কথাটাই মেনে নিলাম। কিন্তু বিপত্তি খাবার গিলতে চেষ্টা করেও গিলতে পারলাম না ব্যাথায়। টপটপ করে চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরতে লাগলো আমার ব্যাথায়। রানু আন্টি আর মেয়েটা দু’জনেই অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করতে লাগলেন, কি হয়েছে কাঁদছি কেন?

-বললাম, গলায় ব্যাথা খাবার গিলতে পারবো না।

আন্টি মাথায় হাত বুলিয়ে অংশের বউকে বলল এগুলো নিয়ে যাও আর বাটিতে করে পায়েশ আনো। মেয়েটা একদম শান্ত প্রকৃতির যে কাজটা বলা হয় চুপচাপ করে। আমি হলে কখনো এমনটা করতাম না। আমি তো এক নম্বরের ঘাড়ত্যাড়া স্বভাবের। বলতে হয় অংশের কপাল ভালে তাই তো এমন মিষ্টি একটা বউ পেল।

দুপুরে আমি আর রানু আন্টি কিচেনে রান্না করছি আর অংশের বউ ঘরদোর ছাফ করছে। কে বলবে আমি এ বাড়িতে নতুন বউ কালই এসেছি৷ কোমড় বেঁধে কাজে লেগে আছি। যে মেয়ে বাবার বাড়িতে এক গ্লাস পানি ঢেলে খেতে বাড়িসুদ্ধ লোক মাথায় তোলে সে আজ কাজ করছে নিঃশব্দে । আশ্চর্য হলেও সত্যি এটাই। কিন্তু ফুপু শ্বাশুড়ি বজ্জাত মহিলা সেই কখন থেকে একা একা বকবক করে চলছে। একবার আমায় নিয়ে কীর্তন করছে, একবার অংশের বউ আরেক বার রানু আন্টিকে নিয়ে।

“কপাল খারাপ বইলা বাপের বাড়ি আইছিলাম। আইজ তার শাস্তি পাইতাছি৷ বাপ-মা নাই দেইখা আমার কথার কুনু দাম দেয় না কেউ। যার যেন তে মন লয় মাইয়া লইয়া আইয়া পরে৷ বেলাহাজা কাম কাইজ বিয়া করতেও কেউরে ডাকে না একলা একলাই হগোল করে।”

বিলাপ করে বলে চলছে ফুপু৷ আর আমার তো হাসিতে পেট ফাটার উপক্রম ফুপুর কথা গুলো শুনে৷ রানু আন্টিকে বললাম, “ফুপু কে আরেকটু রাগিয়ে দিয়ে আসি?”

“এই না না তাহলে এই ধরনের কথা আজ আর সারাদিনেও শেষ হবে না।”

রানু আন্টি সতর্ক করলেন আমায়। আমি তো অসতর্কই বেশ আছি। তরকারিটা আন্টিকে দেখতে বলে গেলাম ফুপুকে আরো একটু রাগাতে।

“ফুপু আপনার বিয়ে কি একা হয়েছিলো নাকি সবাইকে নিয়ে?”

আমার কথা শুনে ফুপু বিলাপ করা বন্ধ করে তাকালেন আমার দিকে।

“ওই মাইয়া দূর হ আমার চোক্ষের সামনে তে।” ঝাড়ি দিয়েই বললেন।

-বলেন না ফুপু আপনার বিয়ে কিভাবে হলো।

“ওই ছেমড়ি কেমনে হইবো আবার অনুষ্ঠান কইরা হগোল কুটুম রে দাওয়াত খাওয়াইয়া বিয়া হইছে আমার। পাঁচ খান গরু জবাই কইরা পাঁচ গেরামের মানুষ খাওয়াইয়া হইছে আমার বিয়া। লাল জরির শাড়িখান পিন্দা পরে গেছি শ্বশুড়বাড়ি। তোগো মত জামাইর হাত ধইরা ডেং ডেং কইরা আহি নাই।”

মুখ টিপে হাসছি আমি ফুপুর কথা শুনে ওদিকে সব শুনে মুখ কালো করে দাঁড়িয়ে আছে অংশের বউ। ফুপুর সাথে আরো কিছুক্ষণ এমন সব কথা বলে আবার গেলাম কিচেনে৷ লাঞ্চের সময় হয়েছে আরো আগেই কিন্তু আমার সেন্সলেস হওয়ার পর সময় নষ্ট হয়েছে অনেকটা। আমার শ্বশুড় বাড়ি এলেন খেতে। নিজের ছোট্ট একটা ব্যবসা উনার তাই তিন বেলা সময় করে বাড়িতেই খেতে আসেন। উনি আসতেই রানু আন্টি ঝটপট খাবার বেড়ে দিলেন৷ ফুপুও ভাইয়ের সাথেই বসলেন খেতে৷ ওনাদের খাওয়ার পর রানু আন্টি, আমি আর অংশের বউ বসলাম খেতে কিন্তু আমি এবারও শুধু পায়েশই খেলাম অন্য খাবার গিলতে পারছি না বলে৷ খাওয়া শেষে যে যার ঘরে চলে গেলাম। এরই মধ্যে অংশের বউ দরজায় টোকা দিয়ে আমায় ডাকলো, “আপু আসবো? ভাইয়া কল করেছে।”

কন্ঠ শুনে চিনতে পারলাম, “ভেতরে এসো।”

ভেতরে এসেই ফোন দিলো আমার হাতে আমি ফোন কানের কাছে নিয়ে ‘হ্যালো’ বললাম। কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে পরে কথা বলল পূর্ণ।

“শরীর কেমন এখন?”

“ভালো”

“খাবার খেয়েছেন?”

‘হ্যা’

“গলায় ব্যাথা আছে?”

‘হ্যা’।

-আপনার জন্য মোবাইল নিয়ে আসবো রাতে। সিম কি নতুন আনবো নাকি আপনার আগেরটাই…

“হুম এভরিথিং ইজ ওকে এন্ড ডান, বাই” বলেই কল কেটে দিলাম। হাবা হাশমত কোথাকার ফোন দিয়ে একেবারে চৌদ্দগুষ্টির খবর বলছে। আমি কি তোর বউ নাকি এত কথা বলিস ক্যান আজাইরা, হুহ!”

কথাটা বিড়বিড় করেই খেয়াল হলো আমি তো তারই বউ। মোবাইল টা ফেরত দিতেই মেয়েটি চলে যাচ্ছিলো। আমি ডাকলাম তাকে, শোনো!

‘জ্বি ‘ নিচের দিকে তাকিয়েই জবাব দিলো।

-এখন কি ঘুমাবে?

“নাহ, দুপুরে ঘুম আসে না আমার।”

আমতা আমতা করেই জবাব দিলো৷ বুঝলাম না ওর কি স্বভাবই মিনমিনে নাকি আমাকে দেখলেই এমন করে৷

“ওহ, না ঘুমালে বসো এখানে আমরা গল্প করি। পরিচিত হই একে অপরের সাথে। কাল থেকে তো শুধু খাওয়া দাওয়ার প্রয়োজনেই কথা হলো।”

‘জ্বি, আচ্ছা।

“আমার সাথে নরমাল ভাবেই কথা বলো ফরমাল হওয়ার দরকার নেই। কেমন যেন বস কর্মচারী টাইপ ফিলিং হয় নয়তো।”

কে জানে কি বুঝলো একটু করে শুধু মাথা নাড়লো।
“এখানে বসো” বলেই আমার পাশে বিছানায় বসতে বললাম। মেয়েটিও চুপচাপ বসে পড়লো।প্রথমেই নাম জিজ্ঞেস করলামও জবাবে বলল, মৌশি।

‘মৌশি’! আমার হৃৎপিণ্ড প্রথম শব্দেই থেমে গেল কিছু সময়ের জন্য । নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে আবার জিজ্ঞেস করলাম তার বাবার বাড়ি কোথায়, পড়ালেখা কতটুকু, বাবা কি করে। ওর মুখ থেকে সবটা শুনে এতটুকু পরিষ্কার মেয়েটি অংশের আগের অফিসের বসের মেয়ে৷ এই সেই মেয়ে যার জন্য অংশের সাথে আমার অনেকবার ঝগড়া হয়েছে। এই মেয়ের জন্মদিনের জন্যই অংশ আমার জন্মদিনে উপস্থিত হতে পারেনি গত বছর। একই তারিখে জন্ম আমার আর মৌশির পার্থক্য শুধু তিন বছরের। আমার জীবনে এই তিন সংখ্যাটাই অশুভ একটা সংখ্যা। অংশের সাথে সম্পর্কের মেয়াদ তিন বছর, আমার আর মেয়েটির বয়সের পার্থক্য তিন বছর আমার আর অংশের বয়সের পার্থক্যও তিন বছর । আমার আর পূর্ণের বয়সের পার্থক্য তিন মাস । এমনকি আমার আর অংশের চুমু খাওয়ার সংখ্যাও তিন৷ কি আশ্চর্যরকম ভাবে এই তিন আমার জীবনে ধ্বংসাত্মক সংখ্যা হয়ে দাঁড়িয়েছ । দেহ মন জুড়ে বিষাদের উপস্থিতি টের পাচ্ছি আমি। এই মুহুর্তে এই মেয়েটির আমার চোখের সামনে থাকাটা বিপদজনক । তাই ওকে বলে উঠলাম, “নিজের ঘরে যাও আমি ঘুমাবো মাথাব্যাথা করছে।”

সে আর কোন কথা না বলে চলে গেল। আর আমি মাথার উপর বালিশ চাপা দিয়ে শুয়ে পড়লাম। কান্না পাচ্ছে খুব৷ অংশ কে আমি ভুলবো কি করে? তাকে ছাড়া বেঁচে থাকা প্রতি মুহুর্তে মৃত্যু স্বাদ গ্রহণ করা আমার জন্য এক কথা। বুকের ভেতর ছটফটিয়ে প্রাণ পাখিটা আমায় ছেড়ে যেতে চাইছে৷ পার্থিব খনিকের সুখ আমার অপার্থিব যন্ত্রণার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভালোবাসলে কি সবাই এতোটা কষ্ট পায়? নাকি কষ্ট শুধু আমার ঝুলিতেই ছিলো।মনের যন্ত্রণায় কাঁদতে কাঁদতে এক সময় চোখ লেগে গেছে আমার। সন্ধ্যায় ঘুম ভাঙলো আমার এক পুরুষ কন্ঠ শুনে। ঘুমের ঘোরে কন্ঠটা শুনতে একদম অংশের মনে হলেও চোখ খোলার পর সেই কন্ঠ পূর্ণের মনে হলো। আর সামনে দাঁড়িয়ে ডাকছিলো পূর্ণই তবে ঘুমের ঘোরে কন্ঠটা ওরকম লাগলো কেন!

-আপনার কি শরীর খুব খারাপ?

আমি ভালো করে চোখ খুলে দেখলাম নাহ, এটা পূর্ণই হয়তো ঘুমের আগে অংশকে নিয়ে ভাবছিলাম তাই এমনটা লেগেছে। অংশ আবারও প্রশ্ন করলো আমার শরীর কেমন। আমি বললাম ভালো আছি এখন৷ তারপর আর কোন কথা বলেনি পূর্ণ চলে গেছে রুম থেকে। একটা জিনিস খেয়াল করলাম কাল থেকে পূর্ণ এই ঘরে আসে নিজের জিনিসপত্র নেয় কিন্তু তারপর আর দাঁড়ায় না। ও কি অন্য রুমে থাকে? কাল রাতেও তো কিছু কাগজ পত্র হাতে বের হলো মনে হয়েছে অফিসের কাগজপত্র । ধ্যাৎ, আমি কেন তার কথা ভাবছি। বাথরুমে যাওয়া দরকার কিন্তু এই বাড়িতে বাথরুমে যাওয়ার জন্যও ঘরের বাইরে যেতে হয়, হুহ। এত্তোবড় একটা রুম ভেতরে তো বিশাল একটা বাথরুম করা যায় তা না বাইরে পাবলিক টয়লেট বানিয়ে রেখেছে৷ একা একা বকবক করে চলে গেলাম বাথরুমে। দরকারি কাজ সেরে মুখ হাত ধুয়ে রুমে এলাম। এ রুমে ছোট্ট একটা ড্রেসিংটেবিল আছে পুরানা আমলের সেটার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখলাম৷ এক দিনেই চেহারায় এত পরিবর্তন ! উহুম, কোন বিশেষ কিছু না চোখ, মুখ ফোলা এই পরিবর্তন । আর তার কারণ কান্না আর প্রচুর পরিমাণের ঘুম। নিজের গাল, মুখে হাত দিয়ে দেখছিলাম তখন চোখ পড়লো গলায়। দু’পাশে লালচে হয়ে আছে। এতোটা জোরেই চেপে ধরেছিলো। আমাকে কি সত্যিই খুন করার ইচ্ছে ছিলো তার? আর এতোটা রাগ কি শুধু তার ভাইকে বিয়ে করেছি বলে!

“আলমারিতে কয়েকটা শপিং ব্যাগ আছে। চেক করে নিন তাতে আপনার প্রয়জনীয় কিছু জিনিস রয়েছে।”

পূর্ণ পেছন থেকে বলে উঠলো৷ এই ছেলেটা কখন হুট করে চলে আসে আবার চলে যায় আমি টেরই পাই না।

আলমারি খুলেই দেখলাম কয়েকটা ব্যাগ। সব গুলো ব্যাগ বিছানায় রেখে সব বের করতেই আমার চোখ কপালে। আমি ব্যবহার করি এমন সব কসমেটিকস থেকে শুরু করে দু’জোড়া জুতোও আছে। একটা পার্স আর মোবাইলও আছে৷ অবাক না হয়ে পারছি না সব আমার পছন্দের ব্র্যান্ড এর। এই ছেলে এত কিছু কি করে জানলো? আর সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছি আমি তা হলো চুড়ি দেখে। নীল রঙের কাঁচের চুড়ি এক নয় দুই নয় প্রায় শ’খানেক চুড়ি আর সব নীল রঙের। চুড়িতে আমার বরাবরই দূর্বলতা আর এক সাথে এত্তো গুলো! আমার মুখ দেখার মত ছিলো। একটু আগেও যে আমি আমার প্রাক্তনের কথা ভেবে বিধ্বস্ত, বিরহী হয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলাম৷ আর এখন এই নীলের মোহে সব ভুলে ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে সুখী মানুষ বনে গেছি।

রাতের খাবার খেতে টেবিলে সবাই এক হয়ে বসতেই হন্তদন্ত হয়ে অংশ এলো কোথা থেকে। আমি খাবার নাড়াচাড়া করে যাচ্ছি অনেকক্ষণ ধরেই অংশ কে দেখে সেটাও বন্ধ করে দিলাম। তার হাতে অনেক গুলো হাওয়াই মিঠাই। আঁড়চোখে তাকালাম মৌশির দিকে৷ এ বাড়িতে বাচ্চা নেই একটাও। আর ছোট বলতে মৌশি মানে মিসেস মৌশি ইমতিয়াজ। তবে কি তার জন্যই এনেছে অংশ এগুলো। হাওয়াই মিঠাই আমার ফেভারিট তা অংশ জানে। প্রায়ই আমরা একসাথে ঘুরতে গেলে অংশ যেখান থেকেই হোক যেভাবেই হোক হাওয়াই মিঠাই আনতো। বিষাদ ভরা জীবন আমার ভুলে ভরা আমি। পূর্ণ খাবার খাচ্ছে আর আমায় দেখছে লুকিয়ে তা আমি ঠিক বুঝতে পারছি। অস্বস্তি হচ্ছে খুব এখানে থাকতে। অংশ টেবিলের সামনে এসে আমার আর পূর্ণের মাঝামাঝি জায়গায় হাওয়াই মিঠাই গুলো রেখে বলল, “রাস্তায় একটা বাচ্চা ছেলে বিক্রি করছিলো তাই নিয়ে এলাম। অনেক গুলো আছে সবাই খেয়ো পরে।”

আমি এবার আর বসে থাকতে পারলাম না৷ এটাই আমার অংশ রাস্তায় পথশিশু, ফুল বিক্রেতা ছেলে মেয়ে কিংবা হাওয়াই মিঠাই বিক্রি করে এমন ছোট বাচ্চা দেখলেই সে সব কিনে নিতো। উদ্দেশ্য থাকতো গরীব বাচ্চাটা যেন কম পরিশ্রমে নিজের জিনিস গুলো বিক্রি করে খুশি মনে বাড়ি ফিরতে পারে৷ আজও এমনই করেছে৷ আমি ভীষণ লোভী হয়ে পড়বো এমন অংশকে দেখতে থাকলে। প্রতিশোধের জায়গায় পুনরায় তাকে ফিরে পেতে চাইবো৷ এতে না আমি ভালো থাকবো না অংশ,না মৌশি। আর পূর্ণ! উফ, এই একটা জায়গায় আমি অপরাধী ভীষণভাবে৷ এই ছেলেটাকে কেন আমাদের মাঝে টানলাম? ছেলেটা নিঃসন্দেহে সাধারণ, সহজ-সরল একজন মানুষ । খাবার টেবিল ছেড়ে চলে এসেছি৷ পেছন থেকে ফুপুর গলার আওয়াজ শোনা গেল। উনি একাধারে বকে যাচ্ছেন আমায়৷ তবে ভালো একটা ব্যাপার উনি অকথ্য ভাষায় গালি দেন না তাই সয়ে যেতে পারি।

রাত প্রায় দশটা বাজে দিনে ঘুমানোর ফলে আমার চোখে ঘুমের ‘ঘ’ও নেই এখন। পূর্ণকে দেখলাম রুমে এসে ট্রাউজার আর একটা পাতলা টি শার্ট নিয়ে বের হয়ে গেল। যাওয়ার আগে আমাকে বলে গেছে আমি যেন বাবাকে ফোন দিয়ে একটু কথা বলি। তারা হয়তো চিন্তিত আমায় নিয়ে। কিন্তু আমি করবো না ফোন কাউকে গো ধরে রইলাম। পূর্ণ বোধ হয় অন্য রুমে ঘুমাবে আজও তাই চলে গেছে। মনে মনে আলহামদুলিল্লাহ বললাম আমিও চাই না এক ঘরে থাকতে তার সাথে। ভাগ্যিস পূর্ণ অন্য ছেলেদের মত নয় বউয়ের উপর জোর খাটাতে আসে না। হয়তো সত্যিই আমায় ভালোবাসে তাই এতোটা ছাড় দিচ্ছে। ঘুম আসবে না তাই রুম ছেড়ে বের হলাম। এ বাড়িতে অল্প একটু খোলা জায়গা আছে সামনে তারপর মেইন গেইট। সবাই যার যার ঘরে আমার একটু হাঁটাহাঁটি করার অভ্যাস আছে তাই ভাবলাম ওই খোলা জায়গায় হেঁটে আসি। ওদিকটায় লাইটও আছে তাই অন্ধকারের ভয় নেই। দরজার কাছে যেতেই দেখলাম দরজা খোলা তার মানে বাড়ির কোন এক সদস্য এই মুহুর্তে বাইরেই আছে। কিন্তু কে? মনের মধ্যে ভয় কাজ করছে না আমার বের হয়ে খোলা জায়গায় হাঁটতে হাঁটতে উত্তর দিকের শিউলি ফুলের গাছের কাছে গেলাম। এখানে একটা শিউলি ফুল গাছ আছে তা আমি দেখিনি আগে শুধু জানতাম অংশই বলেছিলো তাদের বাড়িতে উত্তর দিকে শিউলি ফুল গাছ৷ তার প্রিয় ফুল শিউলি আর তাই সে নিজেই স্কুলে পড়াকালীন সময়ে তার নিজের ঘরের দিকে সেটা লাগিয়েছে৷ তার ঘরের জানালা আর বেড উত্তরমুখী। আমি এদিক ওদিক তাকাতেই চোখে পড়লো আবছা আলোয় একটা পুরুষ অবয়ব। লম্বা, চওড়া, স্বাস্থ্যবান একজন তার মানে এটা অংশ। কারণ পূর্ণ অংশের চেয়েও শর্ট আর পূর্ণের চুল গুলো সবসময় পরিপাটি কেমন যেন লেপ্টে থাকে মাথায়। আর এখানে যে দাঁড়িয়ে আছে তার চুল এলোমেলো, ঝাকড়া কিছুটা৷ এটা অংশই তাকে দেখে আর দাঁড়িয়ে থাকার সাহস হলো না এই আধো আলো আধো অন্ধকারে। আমি ফিরে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই আচমকা থাবা বসিয়ে হাত ধরে নিলো অংশ আমার৷ ও কাছে আসতেই নাকে লাগলো উৎকট গন্ধ খেয়াল করলাম তার হাতে জলন্ত সিগারেট ।

-এখানে কেন এসেছো?

-সেই কৈফিয়ত কি তোমাকে দেবো?

“দিতে হবে৷ কেন এসেছো আর কি ভেবে এসেছো? আমাকে ফিরে পাবে ভেবে থাকলে ভুলে যাও শশী। আর যত দ্রুত সম্ভব আমার ভাইয়ের জীবন থেকে সরে যাও।”

“কি মনে করো নিজেকে? হ্যা! প্রিন্স হ্যারি? না কি বাংলাদেশের সব মেয়ের ক্রাশ শেখ তন্ময়? তোমাকে ফিরে পেতে চাইবো কোন দুঃখে বলো তো? তোমার মত সেকেন্ড হ্যান্ড বসের সম্পত্তির লোভে তার মেয়ের পিছে পড়ে থাকা ছেলেকে আমি ফিরে পেতে চাইবো? আমি শশী রায়হান চাইবো! ভাবলে কি করে? তোমার মত ফালতু মিডল ক্লাস ছেলের চার্ম দেখে তোমার পিছনে পড়ে থাকবো ভাবো কি করে? ভালোবেসে ছিলাম তবে সেই ভালোবাসা ইমতিয়াজ আহমেদ অংশের লোভের নিচে দেবে অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে।”

রাগে আমার গা রি রি করছে মন বলছে আরো কিছু গালি খুব ভয়ানক কিছু গালি দিতে কিন্তু তা আর করতে পারলাম না। কারণ, সামনের জানালায় একটা মানবীর অবয়ব দেখা গেল। শাড়ির আঁচল উড়ছে একটু একটু৷ ওটা মৌশি কারণ সেই ঘরটা অংশের। আর মেয়েটা হয়তো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমাদেরই দেখছে তাই এই মুহুর্তে জায়গাটা ছেড়ে চলে যেতে চাচ্ছি। কিন্তু যাওয়ার আগেই হুট করে এক অকল্পনীয় কাজ করে বসলাম৷ ফট করে অংশের হাতের সিগারেটটা নিয়ে তারই হাতের কব্জিতে চেপে ধরলাম। সিগারেটটা চেপে ধরেই আমি অংশের মুখের দিকে তাকালাম৷ তার চোয়াল শক্ত, চোখ লাল হয়ে গেছে অথচ একটা হিসস… করেও আওয়াজ করেনি। আমার চোখ বেয়ে ঝরঝর করে অশ্রু ঝরতে লাগলো। ফেলে দিলাম সিগারেটটা অংশও ছেড়ে দিলো আমার হাত৷ আমি চলে গেলাম নিজের ঘরে মানে পূর্ণের ঘরে।

চলবে
(ভুল-ত্রুটি ক্ষমা করবেন । এডিট ছাড়া পর্ব দিলাম বরাবরের মতোই )

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here