#প্রণয়ের_সূচনা
#লেখিকা_Nazia_Shifa
#পর্ব_৫৪
_____________________________
ড্রয়িংরুমের সোফায় মুখোমুখি হয়ে বসে আছেন মিসেস দিশা আর সুচনা। সূচনা কে নিয়ে তাদের বাসায় এসেছে প্রনয়। এত রাতে তাদের কে দেখে মিসেস দিশা আর আরহাম সাহেব দুজনই ঘা বড়ে গিয়েছিলেন। এদিকে দুজনের মধ্যে একজন ও কিছু খুলে বলছে না। মিসেস দিশা ঘাবড়ানো কন্ঠে জিজ্ঞাসা করলেন-
–‘কি হয়েছে একটু খুলে বলবি তো?
সূচনা সহসা বলে উঠলো-
–‘সত্যিটা শুনতে চাই,যেটা আমার কাছ থেকে লুকানো হয়েছে।
মিসেস দিনার টন ক নড়লো যেন,ফট করে তাকালেন প্রনয়ের দিকে।প্রনয়ের মুখয়ব আর দৃষ্টি দেখে যা বোঝার বুঝে নিলেন। চোখের সামনে পুরোনো ঘটনা গুলো ভেসে উঠলো ওনার।ভারী হয়ে উঠলো বুক। গম্ভীর কন্ঠে বললেন-
–‘কী জানতে চাও তা বলো।
সূচনা পূর্ণ দৃষ্টি রাখলো মিসেস দিশার উপর। ম্লানমুখে বললো-
–‘ তুমি প্রনয়কে আগে থেকেই চিনো ?নুরাইয়া আন্টি তোমার..?
–‘বান্ধবী..আমার বান্ধবী নুরাইয়া,বোনের মতো সম্পর্ক ছিল দুজনের। বিয়ের পরেও আমাদের সেই সম্পর্কে বিন্দু মাত্র পরিবর্তন আসেনি।নুরাইয়া আর ওর ভাই থাকতো ওদের ফুফুর বাড়িতে।বাবা -মা মারা যাওয়ার পরে ঠাই হয়েছিল সেখানেই।ওর ফুফা ফুফী ওকে খুব অল্প বয়সেই বিয়ে দিয়ে দেন ।বড়লোক ছেলে তারওপর নুরয়াইয়া সুন্দর হওয়ায় ছেলে পক্ষের কোনো দাবি দাওয়া ছিল না।ওদের আ্যরেন্জ ম্যারেজ ছিল,ওর স্বামীর সাথে ওর বয়সের ফারাক থাকলেও খুব ভালো ছিল, সুখেই ছিল দুজন। প্রনয়ের জন্ম,বেড়ে ওঠা, সব কিছু নিয়ে বেশ আনন্দে দিন পার করছিল। কিন্তু ইরা ওর পেটে আসার পর থেকেই ঝামেলা টা শুরু হয়। ইরাকে কনসিভ করার কথাটা ওর স্বামীকে জানানোর পর সে সোজা বলে দেয় এবোশনের কথা। কিন্তু নূরাইয়া কোনো ভাবেই রাজি হয়নি, কিভাবে হবে?মা তো! নিজের সন্তানকে কী কোনো মা মে রে ফেলতে পারে? তার জন্য পা ষান হতেও ভয়ংকর রকমের পাষা ন হৃদয়ের অধিকারী হতে হয়।কিন্তু নূরাইয়া তো একদম মোমের ন্যায় ছিল, হালকা তাপে গলে যাওয়ার মতো,সহজ-সরল একদম।তাইতো নিজের স্বামীর পরকীয়া সম্পর্কে ঘুনাক্ষরেও টের পায়নি,সন্দেহ জিনিসটা আসেইনি ওর মাথায়,বড্ড বিশ্বাস করতো যে।রোজ রোজ এই প্রেগ্ন্যান্সি নিয়ে ঝ গড়া হত তাদের। আমিও প্রেগন্যান্ট ছিলাম তখন নয় মাসের। তুই পেটে এসেছিলি।ঐ অবস্থায় আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি ওকে দেখতে যাওয়ার। কিন্তু সব ঘটনাই বলেছিল আমাকে। নুরাইয়া ওর প্রেগনেন্সির সাত মাসের সময় জানতে পারে ওর স্বামীর পরকীয়ার কথা।বিশ্বাস ভেঙ্গে চুরমার হওয়ার পর ও নিজেকে সামলে নিয়েছিল। প্রেগনেন্সির নয়টা মাস পী ড়া দায়ক ছিল ওর জন্য কিন্তু সব কিছু ছাপিয়ে সে নিজের সন্তানকে জন্ম দিয়েছে। হসপিটালের পেমেন্ট,ওকে বাসায় নিয়ে যাওয়া,সব ওর স্বামীই করেছিল। কিন্তু টাকা দেয়া ছাড়া, স্ত্রী-সন্তানদের কোনো কিছুর ই কোনো খেয়াল ওনার ছিল না। তারপর একদিন নুরাইয়া সামনাসামনি তাকে বলে দিল যে, সে জানে তার পরকীয়ার কথা।এতে লাভ তার স্বামীর ই হয়েছে। তার এতো দিন যে লুকোচুরি করতে হতো সেটা বন্ধ হয়ে গেল। তারপর থেকে লোকসম্মুখেই শুরু হলো নোং রামি। ছেলে-মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে নুরাইয়া পড়ে ছিল সেখানেই। কিন্তু তারপর… তারপর… তারপর সব শেষ হয়ে গেল এক রাতে….তুই ছোট ছিলি, এক বছর কয় মাস হবে।২০০৫ সালের ৩০ শে ডিসেম্বর প্রনয়ের জন্ম দিন ছিল।১২ তম জন্মদিন,নুরাইয়া আমাদেরও দাওয়াত করেছিল,কিন্তু যাওয়া হয়নি কারণ তুই সেদিন অনেক বেশি অসুস্থ ছিলি। তাই যখন বললাম, তুই অসুস্থ যেতে পারবো না ও তোর খেয়াল রাখার জন্য এক গাদা জ্ঞান দিল।আর সে..টাই ছিল ওর সাথে আমার শে..শেষ কথোপকথন।’
মিসেস দিশা শেষের কথাখানি বলতে বলতে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন। সূচনাও কাদছে।প্রণয় স্বাভাবিক ভাবেই বসে আছে।তার পাশেই নত মস্তকে বসে আছেন আরহাম সাহেব, ওনার চোখ জোড়াও ছলছল করছে। স্ত্রীর এই প্রিয় বান্ধবীর সম্পর্কে তো উনিও জানেন, তার করুন মৃত্যুর কথা জানেন।মিসেস দিশা নিজেকে সংযত করলেন, আবারো বলা শুরু করলেন-
–‘তখন রাত তিনটা কী তার একটু কম হবে, কলিং বেল এর আওয়াজ, দরজায় বিরতীহীন কড়াঘাতে আর ভীত কন্ঠের “আন্টি” ডাক শুনে যখন দরজা খুললাম বুক ধ্ব ক করে উঠলো!প্রনয় দাড়িয়ে আছে ছোট্ট ইরাকে নিয়ে।ঘেমে নেয়ে একাকার অবস্থা তার,
বড় বড় দম নিচ্ছিল সে। কিছু বলার আগেই এক প্রকার দৌড়ে এসে ঘরে ঢুকে সদর দরজা বন্ধ করে দেয়।তোর আব্বু আর আমি বারবার জিজ্ঞেস করছিলাম কি হয়েছে? কি হয়েছে? তার পৃষ্ঠে সে এতোটুকুই বলেছিল-
–‘আন্টি ইরাকে একটু ঘুম পাড়িয়ে দিবেন? তার কোল থেকে ছোট্ট প্রান টাকে নিয়ে গেলাম রুমে। পরিশ্রম করতে হলোনা খুব তাড়াতাড়িই ঘুমিয়ে গেল। ঘুমন্ত তোর পাশেই শুইয়ে রেখে বাইরে আসলাম। তার পর সেই নির্মম সত্যের মুখোমুখি হলাম।নুরাইয়ার মৃত্যুর খবরে আমি ভেঙে পরেছিলাম একদম,দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল,বুক ফেটে কান্না আসতো। শুধু ভাবতাম আমারই এই অবস্থা,প্রণয় এর অবস্থা কেমন?কিন্তু ছেলটা একেবারে পাথরের ন্যায় হয়ে গিয়েছিল।কান্না করতে দেখিনি আমি একবারও।ওর আত্মিয় স্বজন দের সাথে সাথে এমনিতেও সম্পর্ক ছিল না,আর যখন শুনলো সে ‘আত্মহত্যা’ করেছে , তখন ঝামেলায় জরিয়ে যাবে ভেবে বিধায় আর পরিচয়ই দেয়নি। অনেক ভেবে চিন্তে ঠিক করলাম পরের দিন রাতের ট্রেনেই তোর দাদা বাড়ি চলে যাবো ওদের নিয়ে। কারন তখন একটা জিনিসই মাথায় ঘুরছিল যে- আর যাইহোক ওদের দুজনের জীবন বাঁচাতে হবে।ঐ পিশা চটার হাতে পড়তে দেয়া যাবেনা। ভাবনা অনুযায়ী সব কিছুই ঠিক ছিল। কিন্তু যাওয়া হয়নি। কারন সেদিন রাতেই খবর আসে তার মৃত্যুর কথা। সেদিন বিকেলে প্রনয়দের খোঁজে আমাদের বাসায়ও এসেছিল কিন্তু আল্লাহ সহায় ছিলেন বলেই হাতে পড়েনি তার। ওনার মৃত্যুর পর সব ধামা চাপা পড়ে যায়। কারন কারোরই মাথা ব্যথা ছিল না ওনার মৃত্যু নিয়ে না ওনার না নুরাইয়ার..ওর ভাই মানে প্রনয়ের মামা ইসহাক ভাই তাও চেয়েছিলেন আইনি ব্যবস্থা নিতে.. কিন্তু কী করবেন?যার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিবেন সেই তো মা রা গেছে।আর তার মৃত্যুর আগেই সবকিছুই টাকা দিয়েযা করার করে গিয়েছিল।আর উনি প্রনয় আর ইরার কথা ভেবেও আর কিছু বলেননি। তখন আর্থিক অবস্থা ও তেমন উন্নত ছিল না।শুধু প্রণয় আর ইরাকে নিজের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন উনি।তারপর থেকে ওরা তাদের কাছেই বড় হয়েছে।ইরা কিছু ই জানেনা এসবের।আমিই নিষেধ করেছিলাম কারণ আমার ব্যাপারে একটু বলতে গেলে পুরো ঘটনা সামনে এসে পড়ার ভয় ছিল তাই।প্রণয়ের সাথে যোগাযোগ ছিল সবসময় ই।কিন্তু ও যে তোকে আগে থেকেই চিনত বা জানত এমন না।তোকে যেদিন দেখতে এসেছে সেদিনই প্রথম দেখেছিল তোকে।তোর বাবার পছন্দ ছিল,আমার ও অমত ছিল না তাই,আমরাই কথা এগিয়েছিলাম আগে।
মিসেস দিশা থামলেন এবার,কয়েক মিনিটের জন্য চুপ করে থাকলেন।হুট করে সূচনার এক হাত নিজের হাতে নিয়ে বললেন-
–‘শোন ইরাকে যে কারণে বলিনি তোকেও সেকারণেই বলিনি।ঐ ঘটনার বর্ননা করতে চাইনি।চাইনি সেটা আবার সামনে আসুক।কিন্তু বিয়ের পরে প্রণয়ই বলেছিল যে সময় হলে সে সব বলে দিবে তোকে।তুই ভুল বুঝিস না কাউকে।
সূচনা ক্রন্দনরত কণ্ঠে বললো-
–‘আমি ভুল বুঝচ্ছি না আম্মু, আমার ই দোষ, আমিই তারাহুরো করেছি নাহলে এমনভাবে সবটা সামনে আসত না।আমাকে মাফ করে দিও।আ’ম সরি আম্মু।
মিসেস দিশা কিছু না বলে সূচনাকে জড়িয়ে ধরলেন। তাদের মা মেয়ের মিষ্টি মুহুর্তের সাক্ষী হলেন আরহাম
সাহেব আর প্রণয়।সূচনাকে ছেড়ে দিয়ে মিসেস দিশা প্রণয়ের কাছে গেলেন, প্রণয়ের মাথায় হাত রেখে বললেন –
–‘শোন বাবা,আমি তোর পাশে ছিলাম না?এখনো কিন্তু আছি আর আমি যতদিন বেচে আছি থাকব।বুঝেছিস?
প্রণয় বাধ্য ছেলের মতোন হাসি টেনে মাথা দুদিকে নাড়ালো।মিসেস দিশা আর আরহাম সাহেব রুমে চলে গেলন তাদের।তারা যেতেই প্রণয় সূচনাকে উদ্দেশ্য করে বললো-
–‘রুমে যাওয়া যাবে?
সূচনা পানিতে টইটুম্বুর আঁখি জোড়া প্রণয়ের দিকে তাক করলো।মাথা দুদিকে নাড়িয়ে নিচু স্বরে বললো-
–‘হু চলুন।
_______________________________
ফ্রেশ হয়ে এসে সোজা বেডে শুয়ে পড়েছে সূচনা।রুমে এসে ‘হু’, ‘হা’ ছাড়া আর কোনো কথা বলেনি সে।তার পাশে ই যে প্রণয় আধশোয়া হয়ে ছিল বেডে সেটাও যেন উপেক্ষা করে গেছে সে।প্রণয় কিঞ্চিৎ অবাক হয়েছে বটে।দু’বার ডাকার পরেও যখন সাড়া দিল না সূচনা।তখন প্রণয় নিজেই তার পাশে শুয়ে তাট বাহু টেনে নিজের দিকে ঘোরালো।জড়িয়ে ধরেই শুয়ে রইলো কতক্ষণ।সূচনা নড়লো না,কিছু বললো ও না।উত্তর জানা স্বত্ত্বেও প্রণয় জিজ্ঞেস করলো-
–‘কাদছো কেন?
ধারণা অনুযায়ী জবাব দিল না,জবাবের অপেক্ষা ও করলো না প্রণয়।সূচনার ফুপিয়ে ফুপিয়ে কান্নার আওয়াজ ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে লাগলো।প্রণয় কিছু বললো না, কান্না করতে মানা ও করলো না।মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললো-
–‘ক্ষণিকের কান্না যদি লম্বা সময়ের সুখ দেয় তাহলে কান্না করতে নিষেধ করবনা আমি, বাধ সাধবনা। এই কান্নার সমাপ্তি আজকেই ঘটুক কালকের সকালে তার ছায়া না পড়ুক।’
.
.
.
সকাল দশটা সময়।ব্যস্ত নগরীর কোলাহল রাস্তায়,গাড়ি চলছে থেমে থেমে।একটু জ্যাম ছুটছে গাড়ি একটু এগোচ্ছে। সূচনার বিরক্তি চেপে রেখে বসে আছে, তার পাশে ড্রাইভিং সিটে প্রণয়।এক হাত তার স্টিয়ারিং এ, অন্য হাতে পরিহিত ঘড়িতে বারংবার সময় পরখ করছে। সূচনা এবার কিছু টা অধৈর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলো-
–‘কোথায় যাচ্ছি?
–‘পুলিশ স্টেশনে।
প্রণয়ের তৎক্ষনাৎ জবাব।পুলিশ স্টেশনের কথা শুনে সূচনা অবাক হওয়া কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো-
–‘পুলিশ স্টেশনে? কিন্তু কেন?সেখানে কেন যাব?
–‘বাকি টা জানতে হবেনা?তাই যাব।
–‘কিন্তু?
–‘মুগ্ধ যেতে বলেছে।কেস যেহেতু ও সামলেছে তো ও ই ভালো জানে।তাই যাবো।রিল্যাক্স আমি আছি না।
প্রণয়ের শেষ বাক্য নিরবে হাসলো সূচনা। মনে মনে আওড়ালো –
–‘আপনি আছেন দেখেই তো ভ য় হয়না কোনো কিছু তে,চিন্তা হয় না।
#চলবে