প্রণয়ের আসক্তি পর্ব -৩২ ও শেষ পর্ব

#প্রণয়ের_আসক্তি
৩২(অন্তিম পর্ব)
#WriterঃMousumi_Akter

এতক্ষণ উপস্হিত সকলে স্তম্ভ হয়ে গিয়েছে।সকলের চোখ দিয়ে অঝরে গড়িয়ে পড়ছে পানি।কারো মুখে কোনো কথা নেই।এমন একটা ধাক্কা তাদের জন্য অপেক্ষা করছিলো তারা কল্পনাও করতে পারে নি।জীবন এত নির্মম পর্যায়েও যেতে পারে।পরিস্হিতি এতটা অস্বাভাবিক নিষ্টুর ও হতে পারে।মানুষের জীবনে অনেক নির্মম ঘটনা ঘটে কিছুদিন কষ্ট পেয়ে ভুলেও যাতে পারে কিন্তু এই নেওয়াজ চরিত্র টি নিরব, মৃথিলা,মৃথিলার মা-বাবা,নিজের পরিবার সবার জীবনের জন্য নিজের জীবনের যে আত্মত্যাগ আর বলিদান দিয়ে গিয়েছে সেটা কেউ কোনদিন মন থেকে মুছে দিতে পারবে না।কেউ কোনদিন ভুলতে পারবে না এই নির্মম বাস্তবতা।

নিরব অস্বাভাবিক হয়ে গিয়েছে।ওয়ালে নিজের হাত কয়েক টা ঘুষি দিয়ে বললো,এটা আমি কি করলাম।একজন ফেরেশতার মতো মানুষের জীবন কেড়ে নিলাম।যেখানে মানুষের জীবন বাঁচানো আমার উদ্দেশ্য সেখানে একজন নিরঅপরাধ মানুষের গায়ে হাত তুলেছি তাকে ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়েছি।ওহ শিট!আমার কোনো যোগ্যতা নেই চাকরি করার।যতক্ষণ না নিজে ওই ফাঁশিতে ঝুলতে পারছি আমি এই পৃথিবীতে এক বিন্দু ও নিঃশ্বাস নিতে চাই না।ফাঁসি আমার হওয়া উচিত।আমি এতটা ভুল করলাম।যে মানুষ টা একা এতগুলো মানুষ কে বাঁচিয়েছে সেই মানুষ টাকে অপরাধী ভেবে মেরে ফেললাম।নিরব কাঁদছে আর বলছে নেওয়াজ আঙ্কেল কেনো একবার বললেন না আমাকে সত্যিটা আমি আপনার মেয়ের কিছুই হতে দিতাম না।একজন বাবা এতটাও ভালবাসতে পারেন তার সন্তান কে তা আপনাকে না দেখলে বুঝতাম না।আপনার মেয়ে যখন জানবে তার বাবা নিরঅপরাধ ছিলো কিভাবে সহ্য করবে আপনাকে হারানোর যন্ত্রণা।কিভাবে বলবো তাকে এই কঠিন সত্য কথা।

মৃথিলার মাথা ভীষণ ঘুরছে।এমনিতেই অনেক কিছু গিয়েছে তার উপর দিয়ে।মৃথিলার স্মৃতিচরণ হচ্ছে তার রহিম চাচা তাকে কত আদর করে মা বলে ডাকতো।জীবন থেকে এমন একজন মানুষ কে হারিয়ে ফেলবে ভাবতেই পারে নি।অঝরে কেঁদে চলেছে সবাই।আহনাফ মাহমুদ নিরব কে বোঝালো।এখানে নিরবের কোনো দোষ নেই সব টা মঈন সিদ্দিকীর চালাকি ছিলো।মুনতাহা, তার মা আর তার ভাই ঢাকাতেই আছে।নিরব গাড়ি পাঠালো মুনতাহা দের আনার জন্য।

___________________________________

যে ঘরে এতদিন যে চেয়ারে আহনাফ মাহমুদ আর তার ওয়াইফ কে বেঁধে রাখা হয়েছিলো সেই ঘরেই সেই চেয়ারে এতদিন মৃথিলার বাবা সেজে থাকা মানুষ টা মানে মেধার বাবাকেও এনে বেঁধে রাখা হয়েছে সাথে তার ওয়াইফ কেও।গোটা পুলিশ ডিপার্টমেন্ট এর মাঝে তুফান উঠে গিয়েছে শাহ নেওয়াজ এর ঘটনা শুনে।ঢাকা শহর নড়ে গিয়েছে এমন ঘটনায়।সবার মাঝে ভীষণ উত্তেজনা কাজ করছে।কিছুক্ষণের মাঝেই মেধাকেও তার মা বাবার পাশে এনে আরেক টা চেয়ারর বেঁধে রাখা হলো।মৃথিলার মন মানতে নারাজ একটা মানুষ এতটা খারাপ বাবা ও হতে পারে।একটা মানুষ এতটা নিখুত অভিনয় ও করতে পারে।আজ ঊনিশ টা বছর পরে আবার ও মুখোমুখি আহনাফ মাহমুদ আর মঈন সিদ্দিকী।নিরব, রিফাত,সুপ্তি উপরের সব বড় অফিসার রা উপস্হিত।সবাই আহনাফ মাহমুদ কে পেয়ে ভীষণ খুশি।আজ বিচারের ভার আহনাফ মাহমুদের উপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।মঈন সিদ্দিকীর মুখে আজ কোনো কথা নেই।আহনাফ মাহমুদ শাহ নেওয়াজ কে চক্রান্তে ফাঁসিয়ে মারার জন্য লোহার সিক পুড়িয়ে এক চোখ তুলে নিলেন মঈন সিদ্দিকীর।সুপ্তি মেধার মা সহ মেধা এবং মঈন সিদ্দিকী কে কয়েক শ বেতের আঘাত করলো।এই শাস্তি তাদের জন্য কিছুই নয়।এই সেই মঈন সিদ্দিকী যে অনেক মানুষ কে টুকরো টুকরো করে কেটেছে।অনেক নিষ্পাপ মেয়েকে দেহব্যাবসায় লিপ্ত করিয়েছে।সেই সাথে নিজের পাপের সঙ্গী করেছে নিজের মেয়ে এবং স্ত্রী কে।এই পরিবার টায় একটা ক্রিমিনাল আর অপরাধী পরিবার।সহস্র বেতের আঘাতে রক্তাক্ত আজ মঈন সিদ্দিকীর পরিবার।তাদের যে অপরাধ সাধারণ মানুষের পক্ষে তাদের শাস্তি দেওয়া সম্ভব নয়,যেকোনো শাস্তি তাদের জন্য কম হয়ে যাবে।পরকাল ই তাদের উপযুক্ত শাস্তি দিতে পারবে। মঈন সিদ্দিকীর অন্য চোখ ও তুলে নেওয়া হয়।চোখ হারিয়ে যন্ত্রণায় ছটফট করছে মঈন সিদ্দিকী।ক্ষমা চাইছে নিজের যাবতীয় কাজের জন্য।নাক দিয়ে উত্তপ্ত গরম পানি আর ঝালের পানি ঢেলে শাস্তি দিয়েও মন ভরে নি কারো।এসব শাস্তি তাদের অরাধের কাছে খুব ই নিম্ন শাস্তি ছিলো।মৃত্যু কালে মেধা বললো,বাবা নেওয়াজ আঙ্কেল মেয়ের জন্য একটা জীবন পার করলো আর তুমি নিজের মেয়েকে পাপের জগতে নিয়ে এসেছিলে। মেধার মা ও বললো,মানুষ পরকালে চায় যেনো স্বামির সাথে কাটাতে পারে জান্নাতে।আমি এমন জঘন্য মানুষ কে পেয়েছিলাম ইহকালেই জাহান্নাম এর শাস্তি ভোগ করছি।নিজেও পাপ করেছো আমাদের ও পাপি করেছো।তোমার মতো খারাপ মানুষ যেনো পৃথিবীতে জন্ম না নেয়।

আরেক টা সত্য বেরিয়ে এলো মৃত্যু কালে মেধার মা প্রকাশ করলেন সেই জঘন্য সত্য।মিথুকে নিজের মেয়ে পরিচয় দেওয়ার একটায় কারণ ছিলো যেভাবে নেওয়াজ কে মঈনের অপরাধ কাধে নিয়ে মরতে হয়েছে ঠিক সেইভাবেই মেধার অপরাধ মৃথিলার কাধে দিয়ে মৃথিলাকে আইনের চোখে অপরাধী প্রমান করা।মৃত্যুর আগে তাদের তিনজনের ই চোখ তুলে নেওয়া হলো,গায়ে লবন মরিচ লাগানো হলো,নাকে মরিচের পানি ঢেলে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মারা হলো।

নিজের বাবার জীবনের সব সত্য জেনে মুনতাহাসহ তার ফ্যামিলি হাউ মাউ করে কেঁদে যাচ্ছে।নিরব মাথা নত করে ক্ষমা চেয়েছে মুনতাহার কাছে।মুনতাহা খুব কাঁদছে।নিজের বাবার এমন মৃত্যু কোনো সন্তান ই মেনে নিতে পারে না।

এক রাশ অভিমান নিয়ে বাবাকে উদ্দেশ্য করে বললো,,বাবা তুমি কেনো এতটা ভালো।কেনো এতটা ভালবাসলে বাবা।তোমার মেয়ে এত গুলো বছর অপেক্ষা করেও তোমাকে কাছে পেলো না।অনেক কষ্ট হচ্ছে বাবা। ভাল থেকো বাবা ওপারে।পৃথিবীর সব বাবার প্রতি সম্মান বাড়িয়ে চলে গেলে তুমি।আই লাভ ইউ বাবা।

মুনতাহার মায়ের আর্তনাদ,কেনো আমাকে একটা বার বললে না তুমি।তোমার শেষ যাত্রায় তোমার ভালবাসার বিনিময়ে ঘৃনা দিয়েছি।ওপারে কি দেখা হবে আমাদের।তোমার মতো ভালবাসার মানুষ কে চিনতে বড্ড ভুল করেছি ক্ষমা করে দিও আমাকে।

অস্বাভাবিক কাঁন্নায় ভেঙে পড়েছে মুনতাহা আর তার পরিবার।

আহনাফ মাহমুদ মুনতাহা কে নিজের মেয়ে বলে বুকে টেনে নিলেন।

মুনতাহা আর তার মা বাকি জীবনে হয়তো ভাল থাকতে পারবে না নেওয়াজ এর কথা ভেবে।সারাটা জীবন এই নিখুঁত ভালবাসা পোড়াবে সবাইকে।

শাহ নেওয়াজ কে তার পুরো জীবনের কৃতিত্বের জন্য দেওয়া হলো এক বিশেষ সম্মাননা।ইতিহাসে তার নাম টা আজীবন লেখা থাকবে।
_________________________________
আজ দীর্ঘদিন পর আহনাফ মাহমুদ নিজের মেয়ে জামাই নিয়ে ফিরছে তার দেশের বাড়ি।সুজলা, সুফলা বাংলাদেশে এই সবুজ প্রকৃতি অনেক বছর চোখে দেখে নি আহনাফ মাহমুদ।সবুজ অরন্য ঘেরা প্রকৃতির মন মাতানো দৃশ্য প্রাণ ভরে উপভোগ করছে আহনাফ মাহমুদ এবং তার ওয়াইফ।মিসেস শিরিনা মাহমুদ এবং আলতাফ মাহমুদ এর জন্য এই শেষ বয়সে এমন সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছিলো সেটা তাদের কল্পনার বাইরে ছিলো।ছেলে বৌমার ছবি হাতে নিয়ে দুজনে কাঁদছে। এমন সময় তার বাড়ির গেটে এসে গাড়ি থামলো।মিসেস শিরিনা মাহমুদ এবং আলতাফ মাহমুদ দরজা খুলে বাইরে এসে চমকে গেলো।তাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে আজ তাদের ছেলে আর বৌমা। এটা যেনো অবিশ্বাস্য ঘটনা ছিলো তাদের কাছে।ছেলে বৌমার কাছে বুকে জড়িয়ে নিয়ে পরম ভালবাসা আর আবেগে অশ্রুজল ফেললো।মৃথিলা তাদের নাতনি এটা যেনো আরো বড় সারপ্রাইজ ছিলো তাদের জন্য।শেষ বয়সে এসে পরিপূর্ণ সংসার ফিরে পাবে এটা অকল্পনীয় ছিলো তাদের কাছে।অতীতে ঘটে যাওয়া সমস্ত ঘটনা শুনে স্তম্ভিত হলো তারা দুজন।আজ এই পরিবারে খুশির বন্যা বয়ে যাচ্ছে।খুশিতে মাতোয়ারা নড়াইল শহর।

আজ আকাশের চাঁদটাকে যেনো বড্ড খুশি দেখাচ্ছে।চাঁদ তার সব টুকু আলো ঢেলে দিয়েছে ধরণিতে।সেই আলোর নিচে আকাশ পানে তাকিয়ে সুয়ে আছে দুজন মানব মানবী।তাদের চোখ ভরা প্রেম,বুক ভ রা ভালবাসা নিয়ে দুজন দুজনের কাছাকাছি এসেছে।কলঙ্কিনী চাঁদের সব টুকু কলঙ্ক যেনো আজ মুছে গিয়েছে অপূর্ব মায়ায় সেজেছে চাঁদ।সেই সাথে আজ মৃথিলা সেজেছে তার প্রিয়তমর মনের মতো সাজে।বাইরে থেকে বকুল ফুলের ঘ্রাণ ভেষে আসছে।আহা!কি মিষ্টি সে ঘ্রাণ।নিরব নেশাক্ত চোখে দেখছে মৃথিলাকে আর মৃথিলা দেখছে চাঁদ।অনেক বাঁধা বিপত্তির পরে মহা প্রণয় হয়েছে নিরব আর মৃথিলার।আসক্তিতে মেতে উঠেছে দুজনের মন।তাদের পৃথিবী ভালবাসায় ভরে উঠেছে।

নিরবের দুষ্টু ওষ্ট বার বার মৃথিলাকে ছোয়ার আসক্তিতে নিরব কে টানছে।প্রেমিক হৃদয় কোনো বাঁধা না মেনে প্রেয়সীর সর্বাঙ্গে ওষ্টের ছোয়ায় ভালবাসার তুফান তুললো।দুজন মানব -মানবী দুজনের একান্ত কাছাকাছি চলে এলো।পূর্ণিমার গোলাকার চাঁদ সাক্ষী রইলো তাদের ভালবাসার।

–কেটে গিয়েছে আরো ছয়টা মাস——
নিরব ডাকছে মিসেস মৃথিলা আপনি কি জানেন না সকাল সকাল আপনার মুখটা না দেখলে সে সকাল কে আমার অভিশপ্ত লাগে।

–এই আমি ওয়াশ রুমে আছি এত ডাকাডাকি হচ্ছে ক্যানো?উঠে পড়ুন অফিস যাবেন না।

–ম্যাডাম আমি উঠবো না।আজকের সকাল টা এভাবে নষ্ট হতে দিও না। কাল রাতে কত আশা নিয়ে ঘুমিয়েছিলাম,সকালে বউকে জড়িয়ে ধরে আদর করবো।আর তুমি কিনা উঠে চলে গেলে।কাম ফার্স্ট মিসেস মৃথিলা।আই ওয়ান্ট টু সাম রোমান্স উইথ ইউ।

–এ সব নেহি চালতা ওকে!ওয়াশ রুমে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছি।

–এইভাবে রোমান্টিক মুড টা নষ্ট করছো ক্যানো?

–মৃথিলা ওয়াশ রুম থেকে বেরিয়ে ইউরিন টেস্ট এর কীট টা দেখিয়ে বললো পজিটিভ মিষ্টার।আপনি বাবা হতে চলেছেন।

নিরব বেড থেকে এক লাফে উঠে, মৃথিলাকে জড়িয়ে ধরে গালে চুমু দিয়ে বললো,আই লাভ ইউ এক আকাশ হ্যাপিনেস। বাবা হবার মতো আনন্দ আর কোনো কিছুতে নেই।তুমি আমার জীবনের প্রতিটি মুহুর্তের সুখের কারন।একটা দীর্ঘ জীবন পাড়ি দিবো তোমার সাথে।

নিরব-মৃথিলার সুখের জীবন কাটুক আজন্মকাল।

সমাপ্ত।

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here