#প্রণয়ের_ত্রিভুবন
#সুপ্তি_আনাম
পর্বঃ ০৭
–‘শুভ্রি! মা ভুলে গিয়েছিস, তোর ক্লাস আছে আজ? ওঠ! ‘
মায়ের ডাকাডাকিতে অনেক কষ্টে চোখ খুলে শুভ্রিলা। মুখটা বাঙলার পাঁচ এর মতো করে আছে৷ সকাল সকাল কেউ হুট করে ঘুম ভাঙিয়ে দিলে ব্যাপারটা বেশ অসহ্য লাগে তার কাছে। ঘুম কাতুরে কন্ঠে বলে,
–‘উহু মা আরেকটু ঘুৃমোতে দাও না!’
–‘কোনো আরেকটু না! ক্লাস ফাঁকি দিতে চাস? যা জলদি ফ্রেশ হয়ে নাস্তা কর গিয়ে!’
কোনো রকমে চোখ কচলাতে কচলাতে বিছানা ছাড়লো শুভ্রিলা। চোখে এখনও ঘুমের ছিটা লেগে আছে। ওয়াশরুম থেকে এসে নিজের ফোনটা চার্জ থেকে খুলতে লাগলো শুভ্রিলা। ফোনটা একবার চেইক করতেই চোখদুটো কপালে গিয়ে ঠেকলো তার। ‘একি! পিহুর সাতটা মিসড্ কল? নিশ্চই কিছু হয়েছে নয়তো এই মেয়ে ফোন করার মানুষ নয়।’ নিজেকে নিজেই বলে পিহুর নম্বরে ফোন লাগাতে শুরু করে শুভ্রিলা। ফোনটা যেতে না যেতেই রিসিভ করে নেয় পিহু। শুভ্রিলাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই পিহু বলে ওঠে,
–‘কিরে কই তিই জলদি আয় ভার্সিটিতে’ পিহুর গমগমে সুর শুনে কিঋু একটা হয়েছে বুঝতে বাকি রইলো না শুভ্রিলার। চারিদিকে মানুষের হল্লার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। পিহুকে সন্দিগ্ধচিত্তে শুভ্রিলা জিজ্ঞেস করে বসে,
–‘কেনো? আজ এতো তাড়া কেনো? কি হয়েছে?’
–‘আগে জানলে আবার কি হবে? তুমি খালি একটু জোস্ করে সেজেগুজে এসো, আর হ্যা দেরী করলে তোমার ভাত অন্যকেউ খেয়ে নিবে!’ কথাটি বলেই মিনমিনে হাসি দেয় পিহু। পিহুর কথায় বোধগম্য হলো না শুভ্রিলার। অগত্যাই তাকে কোনোরকম নাস্তা খেয়ে ভার্সিটির উদ্দেশ্যে ছুটে চলতে হলো।
.
.
একটা রিকশা নিয়ে সামনের দিকে এগোয় শুভ্রিলা। তার কৌতূহলি মনটা কি হয়েছে তা জানার জন্য আনচান করছে। বারবার রিকশাওয়ালাকে বলছে একটু জোড়ে চালাতে। উত্তেজনার ঠেলায় ঠিকমতো সাজাও হয়নি। চুলে বেনী করতেই অর্ধেক সময় পার হয়ে গেছে। তাও একটা সুন্দর ড্রেস পড়েছে। বলা যায় না, ভার্সিটিতে কোনো ফাংশানও থাকতে পারে। মনে মনে একশ একটা গাল দিচ্ছে পিহুকে। মেয়েটা বললে কি এমন হয়ে যেতো!
ভার্সিটির সামনে যেয়ে তাজ্জব হয়ে যায় শুভ্রিলা। একি! এতো লোকের ভিড় কেনো, আর বড় এই গেইটটা এভাবে এতো সাজানো কেনো? কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলো না শুভ্রিলা। রিকশা থেকে নেমে যখন ভার্সিটির ভেতরে পৃরবেশ করবে এমন সময় তাদেরই ব্যাচমেটরা তার কাছে আসতে থাকে। সবারই হাতে রক্তিম লাল বর্ণের গোলাপের একটা ডাল। সবাই একে একে এসে তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। শুভ্রিলা কিছুতেই কিছু বুঝছে না। আবার প্রশ্নও করতে পারছে না। চুপচাপ সবার থেকে গোলাপগুলো গ্রহন করছে। ছেলে-মেয়ে সবাই মুচকি মুচকি হেসে তার হাতে গোলাপগুলো ধরিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। একে একে পঞ্চান্নজন মানুষ তাকে এভাবে ধরিয়ে ধরিয়ে দিয়ে যায়। এরপর কই থেকে পিহু ছুটে আসে। সেও সেজেছে। পিহুর মুখে হাসির ফোয়ারা বইছে৷ এসে এসে উত্তেজিত কন্ঠস্বরে বলে,
–‘চলো চলো!’
–‘কই যাবো? আর এগুলা কি হচ্ছেটা কি? ‘
–‘অতসব তোমাকে না জানলেও চলবে আগে আসো, আর তোমাকে না লাইট মেকআপ করে আসতে বলেছিলাম আজকের দিনে? ‘
–‘কেনো? আজকের দিনে কি মাদার তেরেসা জন্মগ্রহণ করেছিলো? ‘
শুভ্রিলার কথার কোনো প্রতিত্তোর না করে তাকে ভেতরে নিয়ে যায় পিহু।
ভেতরে ঢুকে আরও এক দফা অবাক হয় শুভ্রিলা। ভেতরে আরো সুন্দর করে সাজানো। সবাই হাতে বেলুন নিয়ে আছে। এবার যা ঘটে তা দেখার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলো না শুভ্রিলা। একদল ছেলে সামনে দাড়িয়ে সবাই সাদা টিশার্ট পড়ে রয়েছে৷ একে একে তারা পেছন থেকে সামনে ঘুরতে শুরু করে। তাদের হাতে থাকা ব্যানারগুলো আকাশে মেলে দেয়। ব্যানারে প্রতিটা ওয়ার্ড করে লেখা আছে, লাভ ইউ শুভ্রু! এটা দেখে ছোটমটো শক্ খায় শুভ্রিলা। এক সময় সবাই দু’দিকে সুবিন্যস্তভাবে সাইড হয়ে যায়।
মাঝখানদিয়ে সামনে এগোয় এহমার। আজকে একটু বেশি হ্যান্ডসাম লাগছে তাকে। সামনে এগিয়ে একটা মুচকি হাসি দেয় এহমার। এরপর তার সামনে হাটু গেড়ে বসে পড়ে সে। থমথমে গলায় তাকে উদ্দেশ্য করে বলতে শুরু করে,
—‘সুপ্রিয়া শুভ্রিলা, তোমাকে আর আমাকে নিয়ে করা প্রথম দিনের ট্রলটার কথা মনে আছে? তুমি হয়তো বোঝোনি শুধু আমাকে নিয়েই নয় বরং তোমাকে নিয়েও সেদিন ট্রল করা হয়েছিলো। তুৃমি এটা বুঝোনি, আমি বুঝেছিলাম। চুপ করে গিয়েছিলাম। এইতো কিছু দিন আগে আমার নম্বর নেওয়ার জন্য তার দ্বারা (পিহুকে দেখিয়ে) আমার মাথা ফাটিয়ে নম্বর কালেক্ট করলে।তবে, ফোন দাও নও একটিবারও। তুমি কি জানো, তোমার একটি মাত্র আওয়াজ শোনার জন্য আমার মনটা কেমন ব্যাকুল হয়ে থাকতো? খালি প্রহর গুণতাম যে কখন তুমি ফোন দিবে। কিন্তু তুমি দিলেই নাহ। সেদিন লাইব্রেরীতে ঘটে তোমার নরম ঠোঁটের ছোঁয়া আমাকে উন্মাদ করে দিয়েছে। তখন থেকেই ধরে নিয়েছি তোমাকে মিনিটে মিনিটে এভাবেই লাভ ইউ বলতে বলবো! আমার উন্মাদ মনটাকে আমি আর সামাল দিতে পারছি না। তুমি কি পারবে আমার মনটাকে সামাল দিতে? পারবে একটা তাজা প্রেমের সঞ্চার ঘটাতে? পারবে আমার উন্মাদনাকে নিয়ন্ত্রণ করতে? পারবে আমার ভালোবাসাগুলোকে মনগহীনে যত্ন করে রেখে, কিছু ভালেবাসা ফিরিয়ে দিতে? যদি এগুলোর উত্তর হ্যা হয় তবে, তুমি সারাজীবনের জন্য শুধু আমার।
এহমারের কথায় ইমোশনাল হয়ে পড়ে শুভ্রিলা। ভীষণ কান্না পাচ্ছে তার। চোখ থেকে দুফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ে। এ দেখে ঘাবড়িয়ে যায় এহমার। শুভ্রিলা কোনো নেগেটিভ কিছু করে বসবে না তো? সবার থমথমে, অস্থির, কৌতূহলী চাহনি তাদের দিকে নিবদ্ধ। কাদতে কাঁদতেই শুভ্রিলা বলে,
–‘হ্যা আমি আপনার মনটাকে সামাল দিবো, হ্যা আমি আপনার মনে তাজা প্রেমের সঞ্চারণ করবো, হ্যা আমি আপনার উন্মাদনাগুলোতে হারিয়ে যাবো, হ্যা আমি ভালোবাসার বিনিময়ে ভালোবাসা ভ্যাটসহ ফিরিয়ে দিবো। সবগুলোর উত্তর হ্যা, হ্যা এবং হ্যা!’
এহমারের মুখ হাসিতে ঝলমলিয়ে উঠে। শুভ্রিলাকে জড়িয়ে ধরে, সাথে শুভ্রিলাও। শুভ্রিলার কানে ফিসফিসিয়ে বলে,
‘এখন আমি ফিসফিসিয়ে বলছি তোমার কাছ থেকে এটাই এসপেক্ট করেছিলাম আমার প্রাণের সঞ্চারিণী! ‘
পুরো ক্যাম্পাসজুড়ে হাত তালির ধ্বনি বাজছে। কেউ কেউ উৎফুল্লে চিৎকারও দিচ্ছে। এক সময় এহমার আবার বলে,
–‘এক সময় তারা আমাদের নিয়ে হেসছিলো তবে, আজ দেখো সবাই সাপোর্ট দিচ্ছে। এটাই আমাদের সুবিশাল প্রাপ্তি! ‘
সবার সামনে শুভ্রিলার হাতে ডায়মন্ডের রিংটা পড়িয়ে দেয় এহমার। মুখে হাসির ঝলকানি ওঠে যায় সবার। ভীষন খুশি শুভ্রিলাও। নিজের চোখকে এখনও বিশ্বাস করতে পারছে না সে!
স্বাভাবিক হয়ে শুভ্রিলা পিহুর দিকে দৃষ্টি দেয়। পিহু তাকে দেখে চোখ টিপে। সাথে মুচকি হাসি হাসছে। তারদিকে তাকিয়ে কিছুটা বেকায়দায় পড়তে হয় শুভ্রিলাকে।
————————-
–‘কিরে আজকে এতো বড় ধামাকা পাইলা, কপালটা তোমার সোনা দিয়ে গড়ানো ভাই!’
পিহুর কথায় হাসি তুঙ্গে উঠে শুভ্রিলার ও সাথে সব মেয়েগুলো হেসে ওঠে। আজকে মেয়েগুলো কেমন আগে পিছু ঘুরছে শুভ্রিলার। সবাই এসে আংটিটা দেখে যাচ্ছে। আংটিটায় অসাধারণ একটা ডিজাইন করা। তন্মধ্যে ডায়মন্ডের টুকরোগুলো জ্বল জ্বল করছে।
–‘আসলেই লাকি মানতে হবে তোমাকে। সেই কাল রাত থেকে এহমার মানে আমাদের দুলাভাইয়া ঘুৃম বিসর্জন দিয়ে অফিস কর্তৃপক্ষকে ম্যানেজ করলো। তারাও কিছুতেই অনুষ্ঠান করতে দিবে না আর এহমারও এখানেই করবে। শেষমেশ তারা রাজি হয়। এরপর এই শুরু হলো এটা আনোরে, ওটা আনোরে, সাজাওরে, বেলুন ফোলাওরে দুনিয়ার খাটনি! আর এই সবে আমরাও হেল্প করেছি। এহমার চেয়েছিলো ফাইভ স্টার হোটেলে করতে বাট আমরা বলি, তুমি তো মনে হয় না তার কথায় একটা ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে যাবে! তাই এখানেই ব্যবস্থা করা হলো। আর আংটিটা ও বগে থেকেই কিনে রেখেছিলো। অবশ্য তুৃমি যাতে সারপ্রাইজড হও সে জন্য এহমার তোমার কাছ থেকে এসব হাইড রাখতে বলেছিলো!’
একটা মেয়ে বলে ওঠে। কথাগুলো শুনতে বেশ ভালো লাগছিলো শুভ্রিলার৷ একটা মানুষ নিজের প্রিয়তমাকে পেতে কি-না করতে পারে? মনে মনে ভালোবাসার অনুভূতিগুলো মাথা চারা দিয়ে উঠছে।
চলবে,