প্রমত্ত অঙ্গনা
(০৮)
চারিপাশেই গাছগাছালি, পাখির কিচিমিচির ধ্বনি যেন আঁখির সব ক্ষ*ততে অল্পের জন্য ওষুধের কাজ করল ,বাড়ি থেকে অল্প দূরে একটা সুন্দর জায়গা,বেশ একটা বন্য পরিবেশ কিন্তু ওতো গভীর না,আশেপাশ জনশূণ্য,কোলাহলমুক্ত পরিবেশ,সকালের সিগ্ধ বায়ু তার সাথে করে যেন নিয়ে যাচ্ছে আঁখির মনের সব তি*ক্ত ঘ্লানি,বেশ ভালোই লাগছে আঁখির পরে থাকা শুকনো পাতার উপর দিয়ে হাঁটতে,আঁখির কদমে সেগুলোর ম্যাচম্যাচ করে উঠা শব্দে আঁখির মনে বেশ আনন্দের খেলা মাতিয়ে তুলেছে,তাই আপন মনেই হাঁটছে সেগুলোর উপর দিয়ে, সাত সকালে এমন পরিবেশে হাঁটা যে আঁখির নিত্যদিনেরই পছন্দ, হঠাৎ আঁখি আশেপাশে কারো উপস্থিতি আন্দাজ করতে পারল,কারণ সে হঠাৎ দাঁড়িয়ে যাওয়ার পরও অন্য স্থানও থেকে শুকনো পাতার ম্যাচম্যাচ শব্দটা তার কানে এলো, মানে তার আশেপাশে কেউ আছে যে আঁখির সাথে এখানে বিচরণ করছে,চারপাশেই বিচক্ষণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখল আঁখি,না কাউকে পেলো না,হয়ত কোনো ব্যাং বা ছোটো কোনো প্রজাতির পশু হবে যা পাতার উপর দিয়ে গেছে তাই সেদিকে আর ভ্রুক্ষেপ করল না আঁখি,কারন শব্দটা একবারই কানে এসেছে তার,আবারও হাঁটায় মন দিলে আঁখি,কিন্তু না কেন যেন মনে হচ্ছে কেউ ওর উপর নজর রেখে চলেছে,ছোটোবেলা থেকে আঁখির ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের ক্ষমতা প্রচুর,সবকিছুতেই সহজে অভিজ্ঞতা অর্জন করে নেওয়ার আলাদা প্রতিভাসম্পন্ন সে।তাই নির্দিদায় বলতে সক্ষম হচ্ছে কেউ ওর পিছু করছে,এবার বেশ জোর গলায় চারপাশ কাঁপিয়ে বলল আঁখি।
কে?কে আমার পিছু নিচ্ছে? সাহস থাকলে সামনে আয়।
আঁখি নিজের প্রশ্নের কোনো উত্তর পেল না,দুঃশ্চিন্তাগ্রস্ত হলো বড্ড, কেউ ওর পিছু করছে এটা নিশ্চিত আঁখি,তবে কে সে?
আঁখি হাতে থাকা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল প্রায় ৮ টা বেজে গেছে,বাড়ি থেকে বেশ দূরে চলে এসেছে সে,এবার তাকে বাড়ি যেতে হবে,তাছাড়া আজ হাসপাতালেও যেতে হবে।তাই বাড়ির দিকে হাঁটা ধরল।
বড় একটা গাছের পিছন থেকে আঁখির যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইল কালো হুডি পরিহিত কেউ একজন,মুখে কালো মাস্ক সাথে হাতে কালো রঙের হাতমোজা,পায়েও কালো সু।
হোয়্যাট্সআপে আজকেও আঁখির নাম্বার চেক করছে আদৃত,একদিন এই নাম্বার থেকেই যে সবথেকে বেশি নোটিফিকেশন আসত।
ডা.সাহেব কেমন আছেন?মিস করছেন আমায়?জানি তো করছেন,হিটলার আঁখিকে ভোলা এত সহজ নয়।
ডা.সাহেব আমি আপনার বাড়ির বাইরের রাস্তায় এসে দাঁড়িয়ে আছি,আপনি নিচে আসেন নইলে আমাকে উপরে এসে আঙ্কেল আন্টিকে ঘুম থেকে উঠাতে হবে।
ওই ডাক্তার সাহেব কোথায় আপনি?রিপ্লাই কেন করেন না?আপনার কোন পাঁকা ধানে মই দিলাম আমি?জানেন তো পাকা ধান কখনও স্ব চোখে দেখিও নি মই কি করে দিব!
কথাগুলো ভেবে প্রায়ই দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়ে আদৃত,না আঁখি তাকে ব্লক করল আর না তো সে,তবে হুট করে যে সেই ছয় বছর আগে ম্যাসেজ দেওয়া বন্ধ করল আঁখি আজও দেয় না,সারাদিন তো এই নাম্বারে অনলাইন পায় আদৃত আঁখিকে, চেক করে যে বার বার,যদি এখন একটা ম্যাসেজ আসে সে আশে,তবে আঁখির হয়ত তাকে মনেই নেই যে ম্যাসেজ করবে,কথাটা মেনে নেওয়া কতটা ক*ষ্টসাধ্য তা শুধু আদৃত জানে।
কেন চলে গেলে আঁখি?আজ তোমার সুখের জন্য তোমাকে ছেড়ে চলে আসলাম,তবে আমি যে ভালো থাকতে পারছি না আঁখি,আমার জীবনের প্রথম ভালোবাসা,সেই প্রথম নারী তুমি আর তোমাতেই যে এই মনের সমাপ্তি আঁখি,তুমি কি তা আদোও জানো?
শত চেষ্টার পরেও রাতভর চোখে নিদ্রা জোটাতে ব্যার্থ হলো আদ্রিশ,শরীরকে তো সুখের ভেলায় ভাসিয়ে দিয়েছিল সে তবে মনের প্রশান্তি আনতে অক্ষম হলো,রাতে রিদিকার পাশ থেকে আবার নিজ কক্ষে চলে এসেছিল আদ্রিশ,দেয়ালে টাঙানো আঁখির ছবি দেখে গিয়েছিল রাতভর,আঁখি সত্যিই ওকে ছেড়ে চলে গেছে ভাবতেও বুক কেঁপে উঠছে তার বার বার,না আঁখি তাকে কখনও ছেড়ে যাবে না,আঁখি নামক রমণী যে তার প্রেমে বদ্ধ উ*ন্মা*দ, যে এক আদ্রিশের জন্য সকল কিছু ত্যাগ দিল সে আদ্রিশকেই ছেড়ে যাবে ভাবাও দূরুহ,তবে আঁখি যে সত্যিই বাড়ি ত্যাগ করে গেল,ব্লক করে দিল আদ্রিশকে সকল জায়গা থেকে,বন্ধ করল আঁখিকে পাশে পাওয়ার সমস্ত রাস্তা, আঁখি তো আদ্রিশকে চোখে হারাত,অল্পক্ষণের দূরত্ব তার মনে বড্ড অভিমানের যোগান দিত।মনে পরল আদ্রিশের এমনই একদিনের ঘটনা।সেদিন আদ্রিশ কাজ থেকে তাড়াতাড়ি আসবে বললেও জরুরি কাজে পরে গিয়ে বাড়ি ফিরল দেরিতে,এদিকে তার অপেক্ষায় আঁখি অভিমানে ভরপুর হয়ে বসে রইল নিজের কক্ষে,আদ্রিশ বাড়ি ফিরে বুঝতে পারল তার ভালোবাসার কাঙাল, তার প্রেমে প্রমত্ত অঙ্গনার তার অপেক্ষায় মনে বেশ অভিমান জমেছে।তাই পিছন থেকে হাসিমুখে এসে তাকে জড়িয়ে ধরল বেশ অধিকারত্ব নিয়ে,কানের লতিতে চুমু দিয়ে বলল।
″সরি সুইটহার্ট, আর কখনও দেরি হবে না।″
″আমি কারও সুইটহার্ট না,ছাড়ো আমায়, কাজে ছিলে কাজে যাও আমার কাছে আসলে কেন?আমি তো পা*গল সব কাজ কর্ম ফেলে এসে তোমার জন্য অপেক্ষা করি।″
″বললাম তো সরি,আর কখনও হবে না এমন,শেষবারের মতো ক্ষমা প্রার্থী তোমার প্রেমে এই ব্যাকুল হৃদয়।″
আঁখি অতি অভিমানে কিছুই বলছে না।
″কথা বলবে না আমার সাথে?″
″না″
″সত্যিই বলবে না?″
″না″
″শিওর তো তুমি?″
″শিওর″
″ঠিক আছে চলে যাচ্ছি, যতক্ষণ না ফিরার কথা বলবে ততক্ষণ আর ফিরব না″
অতঃপর আদ্রিশ চলে গেল তার এক বন্ধুর বাসায়,সে জানত তার আঁখি তার উপর পাহাড় সমান অভিমান করে থাকলেও তার দূরত্ব সইবে না,আর আঁখির সাথে এমন মজা করা যে তার প্রায় দিনেরই প্রিয়,তাই সেদিন লুকিয়ে গিয়েছিল,আধ ঘন্টার মধ্যেই আঁখির ফোন দেওয়া শুরু হলো আদ্রিশকে,আদ্রিশ মজা করে ওর ফোন ধরছিল না যার ফলস্বরূপ আঁখির মনের অস্থিরতা প্রবল বেগে বেড়ে কান্নায় পরিণত হয়েছিল,ভয়েস ম্যাসেজ করে কেঁদে কেঁদে বলছিল আদ্রিশকে ফিরে আসতে,তার কান্নার ধ্বনি উতলা করেছিল আদ্রিশের মন তখন,তাই ছুটে এসেছিল সেদিন তার হৃদহরণীর কাছে,আঁখি ঝাপটে ধরেছিল তাকে কাছে পেয়ে,বুকে লেপ্টে কান্না মিশ্রিত আধুরি স্বরে বলেছিল।
″কোথায় চলে গেছিলে?আর কখনও এভাবে গেলে কি করব জানি না।″
″আরে তুমিই তো বললে কথা বলবে না,আর তুমি কথা না বললে আমি কি করে থাকি বলো?″
″তাই বলে দূরে চলে যাবে?খবরদার আর যদি এমন করেছ তো,রাগ হোক বা অভিমান আমরা একে ওপরের সাথে থেকে মানিয়ে নিব কিন্তু কখনও দূরে যাব না।″
″কখনই যাব না,লাভ ইউ ফুলপরি।″
″লাভ ইউ মো*র আমার উকিল সাহেব।″
মেনে নিতে পারছে না আদ্রিশ,আঁখি তো কখনও ওকে ছাড়া থাকতে পারে না তবে আজ কেমনে চলে গেল!কেমনে থাকতে পারছে ওকে ছাড়া!
ভাবতে ভাবতে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসছিল আদ্রিশ হঠাৎ বাহির থেকে দ্রুত পাশে রিদিকাকে ঘরে প্রবেশ করতে দেখল।সোজা প্রশ্ন করল তাকে।
রিদিকা কোথায় গিয়েছিলে এতো সকাল সকাল।
ঘরে ঢুকার ক্ষণে আদ্রিশকে প্রথম খেয়াল করে নি রিদিকা,আদ্রিশের হঠাৎ প্রশ্নে বেশ হকচকিয়ে উঠল– কিছুটা থেমে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে জবাব দিলো।
ওই তো একটু হাঁটতে মন চাইছিল সকাল বেলা তাই হাঁটতে বেড়িয়ে ছিলাম,তুমি কখন উঠলে?টেবিলে বসো আমি নাস্তা দিই।
আদ্রিশ আর ওতো না ভেবে নাস্তার টেবিলের একটা চেয়ারে বসে পরল,একদৃষ্টিতে নাস্তার টেবিলের দিকেই তাকিয়ে ছিল,মনে চলছিল তখন আঁখির স্মৃতি,হঠাৎ কেউ সামনে এনে একটা পায়েশের বাটি রাখল,পায়েস দেখেই ঠোঁটে এক জলক হাসি টেনে আঁখি নামটা বলে উঠল,আশায় নয়ন ভরে হুটহাট চোখ তুলে তাকালে সামনে দাঁড়ানো উক্ত ব্যক্তিকে দেখে হাসিটা মলিন হল তার।মন টা যে এই সুন্দর সকাল বেলা আঁখির দর্শন করতে চাইছিল খুব করে,আঁখি প্রায় দিনই ব্রেকফাস্ট এ আদ্রিশের জন্য পায়েশ বানাত তাই আজকে আশাটা রাখা ভুল ছিল না আদ্রিশের,এক পলকের জন্য মনে হয়েছিল তার আঁখি ফিরে এসেছে।রিদিকা এবার হাসিমুখে বলল।
″পায়েশ বানিয়েছি খেয়ে নাও।″
″খাব না,কাজ আছে।″
আর না বসে টেবিল থেকে উঠে বাহিরের দিকে প্রস্থান করল আদ্রিশ,রিদিকা স্বাভাবিক দৃষ্টিতে তার যাওয়ার পানে তাকালেও বাম হাতে পায়েশের বাটির গায়ে শক্ত করে ধরে রাখল যেন হাতের জো*রে বাটিটা এখনই ভেঙে দিবে।
নিজের জন্য নতুন জিনিসপত্র কালকেই কিনে নিয়ে এসেছিল আঁখি,একটাও শাড়ি কিনে নি,আদ্রিশ ওকে শাড়িতে দেখতে বেশি পছন্দ করত,নিজের কখনও মন না থাকলেও আদ্রিশের জন্যই রোজ শাড়ি পরার অভ্যেস গড়েছিল আঁখি,এখন সে অভ্যেসটাও ছেড়ে দেওয়ার দিন চলে এসেছে,আজ আর কাঁদে নি আঁখি,দুই দিনেই চোখের তলায় কালি পরেছে,মুখটা কেমন শুকিয়ে গেছে,ফর্সা মুখে ফ্যাকাশে ভাবটা কেমন জানি বেমানান লাগছে,তবে কেন তাকে বেমানান লাগবে?আদ্রিশ যখন নতুন বউকে নিয়ে খুশি থাকতে পারে তবে আঁখি কেন একাকিত্বে পারবে না,আবারও সিঙ্গেল জীবনের মজা নেওয়ার সুযোগ এসেছে এটা কি কম পাওনা,হাজারও দুঃখের মধ্যে একটা খুশি থাকার কারণ খুঁজে যদি সত্যি ভালো থাকা যায় তবে মন্দ কিসে।কথাটা ভেবে মুখে একটা প্রশান্তিময় হাসি ফোটালো,জিন্সের সাথে লং টপস পরে নিল,চোখে কাজল টানল,চুলগুলো ছেড়ে দিলো,কানে হালকা দু’টো দুল পরেছে,ঠোঁটে লিপস্টিক দিয়ে পাতলা এক আবরণ তৈরি করেছে,সবশেষে এপ্রোন টা গায়ে দিলো,অনেকদিন পর পুরাতন ফর্মে ফিরে এসে আঁখি প্রাণবন্ত একটা হাসি দিলো আয়নায় নিজেকে দেখে।সাজটা অনেকাংশেই তার শরীর ও মনের ফ্যাকাশে ভাবটা যে ঢেকে দিয়েছে।খুশি মনে ব্যাগটা হাতে নিয়ে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হল আঁখি।
হঠাৎ আরিয়ান মির্জা আদৃতকে কল দিয়ে বসলেন,আদৃত ফোন উঠাল।
″আসসালামু আলাইকুম বাবা,কি করছ?
″আদৃত তোর মা হঠাৎ হার্ট এ্যা*টাক করেছে,আমি বুঝে উঠতে পারছি না কি করব!আমরা ওকে হাসপাতালে নিয়ে এসেছি,ও বার বার তোকে দেখতে চাইছে,প্লিজ বাবা তুই চলে আয় এবার।″
″কী….!মা এখন কেমন আছেন?″
″ডাক্তার এখনও কিছু জানাননি।″
″তুমি চিন্তা করো না বাবা আমি এখনই আসছি আর্জেন্ট ফ্লাইটে।″
″তুই জলদি আয় বাবা,রাখছি।″
ফোনটা কেটে দিয়ে বেশ গুমরো মুখ করে আরিয়ান মির্জা স্ত্রী শায়েলা মির্জার দিকে তাকিয়ে বললেন।
″এত বড় মিথ্যে না বলালে হত না?″
″তোমার মিথ্যে যদি আমার ছেলে আমার বুকে ফিরাতে সক্ষম হয় তবে এমন মিথ্যে আমি তোমায় রোজ বলাব।″
কথাটা বলে ফিক করে হেসে দিলেন শায়েলা মির্জা,আরিয়ার মির্জাও স্ত্রীর এমন কথায় মুচকি হাসলেন।
চলবে…….
আরোহী নুর……